আলবানীর খণ্ডনে শায়খ গোমারীর পত্র

মূল: শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আল-সিদ্দীক্ব আল-গোমারী

ইংরেজি অনুবাদ ও টীকা: মুহাম্মদ উইলিয়াম চার্লস্

অতিরিক্ত টীকা: শায়খ আবূল হাসান

বাংলা ভাষান্তর: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

আরবী ও অনলাইন সেট-আপ: রুবাইয়েৎ বিন মূসা


[তাওয়াসসুল ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি সম্পর্কিত হাদীস]


[Epistle in Refutation of Albani released online by www.marifah.net]


  • ভূমিকাঃ


মহান আল্লাহর (করুণাপূর্ণ) নামে আরম্ভ, যিনি অতি দয়াময় ও অনুগ্রহশীল।


সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের অধিপতি আল্লাহতা’লারই প্রাপ্য। উত্তম পরিণতি হবে তাঁদেরই যাঁরা খোদাভীরু। যারা সীমালঙ্ঘন করে থাকে তাদের সাথেই কেবল বৈরিতা বিহিত। আমি সালাত ও সালাম জানাই আমাদের আকা ও মওলা হযরত মুহাম্মাদুর (ﷺ) এর প্রতি এবং তাঁরই মহৎ পরিবার সদস্যদের (আহলে বায়ত) প্রতিও। আল্লাহ তা’লা হুযূর পাক (ﷺ)-এর সাহাবাবৃন্দ (رضي الله عنه) ও তাঁদের অনুসারীদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন (আমীন)।


মূল আলোচনায় উপনীত হয়ে আমি ঘোষণা করছি যে, শায়খ আলবানী, আল্লাহ মাফ করুন, এমন এক ব্যক্তি যিনি দুরভিসন্ধি ও আপন খায়েশ দ্বারা পরিচালিত। তিনি কোনো হাদীস [১] কিংবা ‘আসার’ [২] যেটা তার উদ্দেশ্যের পরিপন্থী, সেটা দেখামাত্রই যয়ীফ বা দুর্বল বলে নাকচ করে থাকেন। ধূর্ততা ও ধোকাবাজির সাহায্যে তিনি তার পাঠকদের বুঝিয়ে থাকেন যে তিনি-ই সঠিক; অথচ তিনি নেহায়েত ভ্রান্ত, বরঞ্চ পাপিষ্ঠ ও প্রতারক। এ ধরনের দ্বৈততা দ্বারা তিনি তার অনুসারীবর্গ, যারা তার প্রতি আস্থা রাখেন এবং তাকে সঠিক মনে করেন, তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তার দ্বারা বিভ্রান্তদের একজন হলেন হামদী সালাফী, যিনি ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’ [৩] গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন। এই হামদী সালাফীও একটি সহীহ হাদীসকে যয়ীফ বলার দুঃসাহস দেখিয়েছেন, কেননা তা তার গোষ্ঠীগত মতবাদের সাথে মিলেনি, ঠিক যেমনি তা তার শায়খের (মানে আলবানীর) লক্ষ্যের সাথেও মিলেনি। এর প্রমাণ হলো এই যে, হামদী সালাফী আহাদীসের দুর্বলতা সম্পর্কে যা বলেন, তা হুবহু তার শায়খেরই বক্তব্য।



তথ্যসূত্রঃ



[১] নোট: মহানবী (ﷺ) হতে বর্ণিত বাণী, অথবা তাঁরই কর্ম, স্বভাব, চরিত্র বা পবিত্র সুরত সম্পর্কিত বিবরণ।

[২] নোট: সাহাবী (رضي الله عنه) তথা হুযূরে পাকের সাথী হতে বর্ণিত বাণী; সাহাবীকে দেখেছেন, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে কিছু শুনেননি, এমন  তাবেঈন/অনুসারীর বর্ণনাও এ’  পর্যায়ভুক্ত।

[৩] নোট: ইমাম তাবারানী সংকলিত হাদীসের গ্রন্থ।

  • আলবানী ও হামদীর মুখোশ উন্মোচন 



এমতাবস্থায় আমি সত্য প্রকাশ এবং প্রতারক (আলবানী) ও প্রতারিত (হামদী) উভয়ের মিথ্যে দাবি খণ্ডনের আশা পোষণ করছি।


আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছি যে আল্লাহ ছাড়া কারো ওপর আমি নির্ভর করি না; তিনি-ই আমার সহায় এবং আমি তাঁরই প্রতি সমর্পিত।


❏ হাদিস :


ইমাম তাবারানী (رحمة الله) নিজ ‘মু’জাম আল-কবীর’ (৯:১৭) গ্রন্থে বর্ণনা করেন,

حَدَّثَنَا ابْنُ وَهْبٍ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْمَكِّيِّ، عَنْ رَوْحِ بْنِ الْقَاسِمِ، عَنْ أَبِي جَعْفَرٍ الْخَطْمِيِّ الْمَدَنِيِّ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ بْنِ سَهْلِ بْنِ حُنَيْفٍ، عَنْ عَمِّهِ عُثْمَانَ بْنِ حُنَيْفٍ: أَنَّ رَجُلًا، كَانَ يَخْتَلِفُ إِلَى عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ رَضِي اللهُ عَنْهُ فِي حَاجَةٍ لَهُ، فَكَانَ عُثْمَانُ لَا يَلْتَفِتُ إِلَيْهِ وَلَا يَنْظُرُ فِي حَاجَتِهِ، فَلَقِيَ ابْنَ حُنَيْفٍ فَشَكَى ذَلِكَ إِلَيْهِ، فَقَالَ لَهُ عُثْمَانُ بْنُ حُنَيْفٍ: " ائْتِ الْمِيضَأَةَ فَتَوَضَّأْ، ثُمَّ ائْتِ الْمَسْجِدَ فَصَلِّ فِيهِ رَكْعَتَيْنِ، ثُمَّ قُلْ: اللهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، يَا مُحَمَّدُ إِنِّي أَتَوَجَّهُ بِكَ إِلَى رَبِّي فَتَقْضِي لِي حَاجَتِي وَتُذَكُرُ حَاجَتَكَ " وَرُحْ حَتَّى أَرْوَحَ مَعَكَ، فَانْطَلَقَ الرَّجُلُ فَصَنَعَ مَا قَالَ لَهُ، ثُمَّ أَتَى بَابَ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ رَضِي اللهُ عَنْهُ، فَجَاءَ الْبَوَّابُ حَتَّى أَخَذَ بِيَدِهِ فَأَدْخَلَهُ عَلَى عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ رَضِي اللهُ عَنْهُ، فَأَجْلَسَهُ مَعَهُ عَلَى الطِّنْفِسَةِ، فَقَالَ: حَاجَتُكَ؟ فَذَكَرَ حَاجَتَهُ وَقَضَاهَا لَهُ، ثُمَّ قَالَ لَهُ: مَا ذَكَرْتُ حَاجَتَكَ حَتَّى كَانَ السَّاعَةُ، وَقَالَ: مَا كَانَتْ لَكَ مِنْ حَاجَةٍ فَأَذْكُرُهَا، ثُمَّ إِنَّ الرَّجُلَ خَرَجَ مِنْ عِنْدِهِ فَلَقِيَ عُثْمَانَ بْنَ حُنَيْفٍ، فَقَالَ لَهُ: جَزَاكَ اللهُ خَيْرًا مَا كَانَ يَنْظُرُ فِي حَاجَتِي وَلَا يَلْتَفِتُ إِلَيَّ حَتَّى كَلَّمْتَهُ فِيَّ، فَقَالَ عُثْمَانُ بْنُ حُنَيْفٍ: وَاللهِ مَا كَلَّمْتُهُ، وَلَكِنِّي شَهِدْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَتَاهُ ضَرِيرٌ فَشَكَى إِلَيْهِ ذَهَابَ بَصَرِهِ، فَقَالَ لَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «فَتَصَبَّرْ» فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ، لَيْسَ لِي قَائِدٌ وَقَدْ شَقَّ عَلَيَّ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «ائْتِ الْمِيضَأَةَ فَتَوَضَّأْ، ثُمَّ صَلِّ رَكْعَتَيْنِ، ثُمَّ ادْعُ بِهَذِهِ الدَّعَوَاتِ» قَالَ ابْنُ حُنَيْفٍ: فَوَاللهِ مَا تَفَرَّقْنَا وَطَالَ بِنَا الْحَدِيثُ حَتَّى دَخَلَ عَلَيْنَا الرَّجُلُ كَأَنَّهُ لَمْ يَكُنْ بِهِ ضُرٌّ قَطُّ حَدَّثَنَا إِدْرِيسُ بْنُ جَعْفَرٍ الْعَطَّارُ، ثنا عُثْمَانُ بْنُ عُمَرَ بْنِ فَارِسٍ، ثنا شُعْبَةُ، عَنْ أَبِي جَعْفَرٍ الْخَطْمِيُّ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ بْنِ سَهْلِ بْنِ حُنَيْفٍ، عَنْ عَمِّهِ عُثْمَانَ بْنِ حُنَيْفٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، نَحْوَهُ.

ইমাম তাবারানী (رحمة الله) ইবনে ওয়াহব হতে, তিনি শাবীব হতে, তিনি  রওহ ইবনে আল-ক্বাসিম হতে, তিনি আবূ জা’ফর আল-খাতামী আল-মাদানী হতে, তিনি  আবূ উমামা ইবনে সাহল ইবনে হুনাইফ হতে, তিনি উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه) হতে এই মর্মে যে, জনৈক ব্যক্তি খলীফা হযরত উসমান ইবনে আফফান [৪] (رضي الله عنه)’র কাছে নিজের কোনো প্রয়োজন পূরণের জন্যে গিয়েছিলেন। কিন্তু খলীফা তাঁর কথা শুনেননি, তাঁর প্রয়োজন-ও পূরণ করেননি। ওই ব্যক্তি হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه)-এর কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে আরয করেন। হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه) তাঁকে বলেন, “যাও, ওযূ করো! অতঃপর মসজিদে (নববীতে)গিয়ে দুই রাক’আত (নফল) নামায পড়ো এবং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করো এই বলে: ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে চাই আপনারই নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এর মধ্যস্থতায়, যিনি রহমতের পয়গম্বর। এয়া মুহাম্মদ (ﷺ)! আমি আমার প্রভুর শরণাপন্ন হলাম আপনারই মধ্যস্থতায়, যাতে আমার প্রয়োজন পূরণ হয়’ - এ দোয়া পাঠের পর তোমার প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করবে। এরপর আমার কাছে এসো, যাতে আমিও তোমার সাথে যেতে পারি (খলীফার দরবারে)।”


অতঃপর ওই ব্যক্তি চলে যান এবং যা তাঁকে বলা হয়েছিল তা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি খলীফা উসমান ইবনে আফফান (رضي الله عنه)-এর (দরবারের) দরজায় উপস্থিত হলে দ্বাররক্ষী তাঁকে হাত ধরে খলীফার সামনে নিয়ে উপস্থিত করেন। খলীফা নিজের মাদুর বিছিয়ে তাতে ওই ব্যক্তির পাশে বসেন এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, “আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি?” তিনি খলীফাকে নিজের প্রয়োজনের কথা জানালে তিনি তা পূরণ করে দেন। অতঃপর খলীফা তাঁকে বলেন, “আমি এতোক্ষণ পর্যন্ত আপনার সমস্যার কথা মনে করতে পারিনি। আপনার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমার কাছে আসবেন।” ওই ব্যক্তি এরপর খলীফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه)-এর কাছে যান এবং তাঁকে বলেন, “আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। খলীফা উসমান (رضي الله عنه) আমার দিকে তাকাননি, ফরিয়াদের শুনানিও দেননি, যতোক্ষণ না আপনি তাঁকে আমার ব্যাপারে সুপারিশ করেছেন।” হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه) বলেন, “আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, আমি তাঁর কাছে সুপারিশ করিনি।”


“আসলে আমি এক অন্ধ ব্যক্তিকে (ﷺ)-এর কাছে এসে নিজ অন্ধত্বের ব্যাপারে ফরিয়াদ করতে দেখেছিলাম। মহানবী (ﷺ) তাঁকে বলেন, ’তুমি কি ধৈর্য ধরতে পারো না?’ অন্ধ ব্যক্তি উত্তরে বলেন, ’এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমাকে পথ দেখাবার কেউ নেই এবং এটা আমার জন্যে কষ্টদায়ক হয়ে গিয়েছে।’ এমতাবস্থায় হুযূর পূর নূর (ﷺ) ফরমান, ’যাও, ওযূ করো। অতঃপর দুই রাকআত (নফল) নামায আদায় করে এই দোয়াটি (ওপরোক্ত দোয়াটি) পাঠ করো।’ আমি (উসমান ইবনে হুনাইফ) আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, আমরা স্থান ত্যাগ করিনি, দীর্ঘক্ষণ আলাপও করিনি, যখন ওই ব্যক্তি ফিরে আসেন এমন অবস্থায় যেন তিনি কখনো কোনো কষ্টে ছিলেন না (মানে অন্ধত্ব দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন না)।” [৫]


ইমাম তাবারানী (رحمة الله) ওপরের এই রওয়ায়াতটিকে সহীহ ঘোষণা করেছেন [৬] অথচ হামদী সালাফী তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন:


“এই হাদীসে অন্ধ ব্যক্তিটির বিবরণসম্বলিত অংশের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ-ই নেই। তবে সন্দেহ ঘটনার প্রথম অংশে (যেখানে সাহাবী উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه)’র কাছে অভাবী ব্যক্তিটি সাহায্য চেয়েছিলেন), যেটা বেদআতী গোষ্ঠী (মানে সুন্নীবৃন্দ) (ﷺ)-কে আহ্বান করার বেদআতী প্রথার বৈধতা দানের চেষ্টায় প্রয়োগ করে থাকে। [এই সন্দেহের কারণগুলো আমরা পরে ব্যাখ্যা করবো] [৭]


তথ্যসূত্রঃ


[৪] নোট: ২৩ হিজরী/৬৪৩ খৃষ্টাব্দ সালে তিনি হযরত উমর (رضي الله عنه)র স্থলাভিষিক্ত হন এবং ১২ বছর শাসন করার পর ১৮ যিলহজ্জ্ব ৩৫ হিজরী/১৭ জুন, ৬৫৬ খৃষ্টাব্দ সালে ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা ৮২ বছর বয়সে শহীদ হন; (ﷺ) তাঁর সাথে নিজ কন্যা রুক্বাইয়াকে বিয়ে দেন এবং রুকাইয়ার বেসাল হলে দ্বিতীয় কন্যা উম্মে কুলসূমকেও বিয়ে দেন। এ কারণে খলীফাকে মুসলমানবৃন্দ যিন্নূরাইন নামে ডেকে থাকেন।

[৫] মু’জাম আল-কবীর, ৯:১৭।

[৬] নোট: ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী (رحمة الله)-ও এটাকে তাই বলেছেন নিজ ‘মজমা’ আল-যাওয়াঈদ’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ১৭৯ পৃষ্ঠায়; আর ইমাম মুনযিরী নিজ ‘আল-তারগিব ওয়াল-তারহিব পুস্তকে ১:২৭৩ #১০১৮; এই বর্ণনা ইমাম তাবারানী (رحمة الله)-এর ‘মু’জাম আল-সগীর’ পুস্তকে (নং ৫০৮) বিদ্যমান এবং তিনি এটাকে সহীহ বলেছেন; এছাড়াও ইমাম সাহেবের ‘কিতাব আল-দু’আ’ বইটিতেও (২:১২৮৮) তিনি এটাকে সহীহ বলেন; শায়খ শু’আইব আরনা’উত-ও শায়খ গোমারী এবং সর্ব-ইমাম তাবারানী, আল-হায়তামী ও আল-মুনযিরীর মতো পূর্ববর্তী মুহাদ্দেসীনবৃন্দের সাথে একমত হন যে এ রওয়ায়াতটি সহীহ (শায়খ নূহ হা মিম কেলার সম্পাদিত ‘Reliance of the Traveler', সংযোজনী ডব্লিউ ৪০.৭, ৯৩৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)]।

[৭] নোট: হাদীসশাস্ত্রের বরেণ্য পণ্ডিতবৃন্দ অন্ধ ব্যক্তির বিবরণসম্বলিত এ হাদীসটিকে সহীহ হিসেবে বিবেচনা করেন। ইমাম তিরমিযী (رحمة الله) এটা বর্ণনা করেন(তিরমিযী : আস সুনান, ৫/৪৬১ হাদীস নং ৩৫৭৮) এবং বলেন

هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ، لاَ نَعْرِفُهُ إِلاَّ مِنْ هَذَا الوَجْهِ مِنْ حَدِيثِ أَبِي جَعْفَرٍ وَهُوَ الْخَطْمِيُّ.

যে এটা হাসান সহীহ গরীব; তিনি আরো বলেন যে এই এসনাদ (পরম্পরা) ছাড়া অন্য কোনো এসনাদে তিনি হাদীসটি পাননি। ইবনে খুযাইমা (رحمة الله) একই সনদে এটা বর্ণনা করেন নিজ ‘হাদীস’ পুস্তকে(২/২২৫ হাদীস নং ১২২৫); আর ইমাম আহমদ (رحمة الله) তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডের ১৩৮ পৃষ্ঠায় তা বর্ণনা করেন; ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) বর্ণনা করেন নিজ ‘আমল আল-এয়াওম ওয়াল-লায়লাহ’ পুস্তকের ৪১৭ পৃষ্ঠায়; ইমাম ইবনে মাজাহ (رحمة الله) বর্ণনা করেন তাঁর ‘আল-সুনান’ শীর্ষক বইয়ের ১ম খণ্ডের ৪৪১ পৃষ্ঠায়; আল-বুখারী বর্ণনা করেন নিজ ‘আল-তারিখ আল-কবীর’ পুস্তকের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ২১০ পৃষ্ঠায়; আল-তাবারানী আপন ‘মু’জাম আল-কবীর’ গ্রন্থের ৯ম খণ্ডের ১৯ পৃষ্ঠায় এবং ‘কিতাব আল-দু’আ’র ২য় খণ্ডের ১২৮৯ পৃষ্ঠায়; আল-হাকিম নিজ ‘মুসতাদরাক’ পুস্তকের ১ম খণ্ডের ৩১৩ ও ৫১৯ পৃষ্ঠাগুলোতে; তিনি এ হাদীসটিকে সহীহ বলেন এবং আল-যাহাবী ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থের ব্যাখ্যামূলক পুস্তকে তা নিশ্চিত করেন; আল-বায়হাক্বী এটা নিজ ‘দালা’ইল আল-নুবুওয়্যাহ’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ১৬৬ পৃষ্ঠায় এবং ‘আল-দা’ওয়াত আল-কবীর’ পুস্তকেও বর্ণনা করেন। ইমাম তিরমিযীর (একটি এসনাদে পাওয়ার) বক্তব্য সত্ত্বেও এ হাদীস আরেকটি এসনাদে পাওয়া যায়, যাকে বিশেষজ্ঞ হাদীসবিদমণ্ডলী ‘মুতা-বা’আহ’ নামে অভিহিত করেন। শু’বাহ একই হাদীস ইমাম আবূ জা’ফর হতে হাম্মাদ ইবনে সালামা’র এসনাদে বর্ণনা করেন, যেটা ইমাম তিরমিযী (رحمة الله)-এর সংস্করণে বিদ্যমান। শায়খ আবদুল্লাহ গোমারী এ হাদীসটি বিভিন্ন পৃথক সূত্র ও বিকল্প এসনাদ (মুতাবা’আহ)-সহ বর্ণনা করেন নিজ ‘আল-রাদ্দ আল-মোহকাম আল-মাতীন ‘আলা কিতাব আল-ক্বওল আল-মুবীন’ গ্রন্থের ১৪৪-১৪৯ পৃষ্ঠায় (কায়রো, মাকতাবাত আল-কাহিরা, ৩য় সংস্করণ, ১৯৮৬); যেমনিভাবে বর্ণনা করেন শায়খ মাহমূদ সাঈদ মামদূহ তাঁর ‘রাফ’আল-মিনারা ফী তাখরিজ আহাদীস আল-তাওয়াসসুল ওয়াল-যিয়ারাহ’ পুস্তকের ৯৪-৯৫ পৃষ্ঠায় (আম্মান, জর্দান, দারুল ইমাম আল-নববী, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৫)]   


হাদিসের সনদ মান বিশ্লেষণঃ 


“প্রথমতঃ 

❏ ইমাম তাবারানী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন যে (বর্ণনাকারীদের সনদ বা পরম্পরায়) শাবীব-ই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এ হাদীসটি বর্ণনা করেন।

“আবার শাবীবের বর্ণনাগুলো মন্দ নয় (লা বা’আসা বিহী) যদি তা হয় দুটি শর্তের অধীন: 

১/ তাঁর পুত্র আহমদ যদি তাঁর থেকে রওয়ায়াত করেন; এবং 

২/ শাবীব যদি ইঊনুস ইবনে এয়াযীদ হতে হাদীস বর্ণনা করেন। তবে বর্তমান ক্ষেত্রে শাবীবের এ রওয়ায়াত তিনজন হতে এসেছে: ইবনে ওয়াহব এবং শাবীবের দুই পুত্র ইসমাঈল ও আহমদ।


❏ “ইবনে ওয়াহবের বেলায় বলা চলে যে সিক্বা (তথা অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী)-মণ্ডলী শাবীব হতে গৃহীত ইবনে ওয়াহবের রওয়ায়াতগুলোর সমালোচনা করেছেন, ঠিক যেমনটি তাঁরা করেছেন খোদ শাবীবকেই। আর শাবীবের পুত্র ইসমাঈল একজন অপরিচিত ব্যক্তি।


❏ “যদিও ইমাম আহমদ (رحمة الله)-ও এই হাদীসখানি শাবীব হতে বর্ণনা করেছেন, তবুও এটা ইঊনুস ইবনে এয়াযীদ হতে বর্ণিত নয় [যেটা হামদী সালাফীর মতে শাবীবের রওয়ায়াতগুলোর গ্রহণযোগ্যতার জন্যে হাদীসশাস্ত্র বিশারদদের আরোপিত একটি শর্ত]।


“উপরন্তু, আহমদ ইবনে শাবীবের বর্ণিত এ হাদীসের মতন বা মূল লিপির ব্যাপারে মুহাদ্দেসীনের মধ্যে মতপার্থক্য বিদ্যমান।


❏ “ইবনে আল-সুন্নী এ হাদীসটি নিজ ‘আমল আল-এয়াওম ওয়াল-লায়লাহ’ পুস্তকে এবং হাকিম তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সনদে বর্ণনা করেছেন, কিন্তু ওগুলোর কোনোটাতেই হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه) অথবা খলীফা উসমান (رضي الله عنه)র দর্শনপ্রার্থী ব্যক্তিটির উল্লেখ নেই।


“আল-হাকিম এ হাদীসটি রাওহ ইবনে আল-ক্বাসিম হতে ‘আওন ইবনে ‘আমারা আল-বসরীর এসনাদে বর্ণনা করেছেন।


❏ “আমার শায়খ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী বলেন, ‘যদিও আওন বর্ণনাকারী হিসেবে দঈফ তথা দুর্বল, তথাপিও (উসমান ইবনে হুনাইফের ঘটনা ব্যতিরেকে) তাঁর বর্ণিত হাদীসটি শাবীবের বর্ণনা হতে শ্রেয়তর, কেননা রাওহ’র বর্ণনাটি আবূ জা’ফর আল-খাতমীর (উসমান ইবনে হুনাইফের ঘটনাবিহীন বর্ণনার) সূত্রে শু’বাহ ও হাম্মাদ ইবনে সালামাহ’র বর্ণনাগুলোর সাথে মিলে যায়।’” [হামদী সালাফী]       


হামদী সালাফীর ওপরে উদ্ধৃত বক্তব্যটি বিভ্রান্তিকর এবং বিভিন্ন দিক থেকে বিকৃত ব্যাখ্যা বটে। এটা তারই শায়খ আলবানী কর্তৃক নিজ ‘আল-তাওয়াসসুল’ পুস্তকের ৮৮ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত বক্তব্যের চর্বিত চর্বণ ছাড়া কিছু নয়। 


প্রামাণ্য দলিল - ১


❏ হাদিস :


হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه) ও খলীফা উসমান ইবনে আফফান (رضي الله عنه)র দর্শনপ্রার্থী ব্যক্তির ঘটনাটি ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله) তাঁর ‘দালা’ইল আল-নুবুওয়াহ’ গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ১৬৭-১৬৮ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন নিম্নবর্ণিত এসনাদসহ:

حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ شَبِيبِ بْنِ سَعِيدٍ الْحَبَطِيُّ، قَالَ: حَدَّثَنِي أَبِي، عَنْ رَوْحِ بْنِ الْقَاسِمِ، عَنْ أَبِي جَعْفَرٍ الْمَدِينِيِّ وَهُوَ الْخَطْمِيُّ، عَنْ أَبِي أُمَامَةَ بْنِ سَهْلِ بْنِ حُنَيْفٍ، عَنْ عَمِّهِ، عُثْمَانَ بْنِ حُنَيْفٍ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَجَاءَهُ رَجُلٌ ضَرِيرٌ فَشَكَا إِلَيْهِ ذَهَابَ بَصَرِهِ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ لَيْسَ لِي قَائِدٌ وَقَدْ شَقَّ عَلَيَّ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " ائْتِ الْمِيضَأَةَ فَتَوَضَّأْ، ثُمَّ صَلِّ رَكْعَتَيْنِ، ثُمَّ قُلْ: اللهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، يَا مُحَمَّدُ، إِنِّي أَتَوَجَّهُ بِكَ إِلَى رَبِّي فَيُجَلِّي لِي بَصَرِي، اللهُمَّ شَفِّعْهُ فِيَّ وَشَفِّعْنِي فِي نَفْسِي "، قَالَ عُثْمَانُ: فَوَاللهِ مَا تَفَرَّقْنَا وَلَا طَالَ الْحَدِيثُ حَتَّى دَخَلَ الرَّجُلُ وَكَأَنَّهُ لَمْ يَكُنْ بِهِ ضُرٌّ قَطُّ.

- এয়াক্বূব ইবনে সুফইয়া’ন বলেন, আহমদ ইবনে শাবীব ইবনে সাঈদ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে,তাঁর পিতা তাঁকে জানিয়েছেন,রাওহ ইবনে আল-ক্বাসিম হতে, তিনি আবূ জা’ফর আল-খাতামী হতে, তিনি আবূ উসামাহ ইবনে সাহল ইবনে হুনাইফ হতে এই মর্মে যে, জনৈক ব্যক্তি খলীফা উসমান ইবনে আফফান (رضي الله عنه)-এর দর্শনপ্রার্থী হন; আর তিনি (আবূ উসামাহ) পুরো ঘটনাটির (আনুপূর্বিক) বিবরণ দেন।


● এয়াক্বূব ইবনে সুফইয়া’ন হলেন (আবূ ইঊসুফ) আল-ফাসা’বী [৮]; তিনি একাধারে ছিলেন হাফেয [৯], ইমাম [১০]আল-সিক্বা [১১] , বরঞ্চ সিক্বার চেয়েও উত্তম এক আলেম।

এই হাদীসের সনদ একদম নির্ভরযোগ্য/সহীহ। [১২] অতএব, 

● হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه)র ঘটনাটি সম্পূর্ণ সত্য। অন্যান্য হাদীসবেত্তামণ্ডলীও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। 

● হাফেয আল-মুনযিরী (رحمة الله) এটাকে তাঁর ‘আল-তারগিব আল-তারহিব’ পুস্তকের ২য় খণ্ডের ৬০৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন; 

● আর ইমাম ইবনে হাজর হায়তামী মক্কী (رحمة الله) উদ্ধৃত করেন নিজ ‘মজমা’ আল-ক্বাওয়াঈদ’ গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ১৭৯ পৃষ্ঠায়।[১৩]


তথ্যসূত্রঃ


[৮] ইন্তেকাল: ১৭৭ হিজরী; তাঁর নাম ইমাম ইবনে হাজর (رحمة الله) নিজ ‘তাক্বরিব আল-তাহযীব’ শীর্ষক প্রসিদ্ধ মুহাদ্দেসীনবৃন্দের বৃত্তান্তমূলক বইয়ে উল্লেখ করেছেন (বৈরুত, দারুল রাশাদ, ৩য় সংস্করণ, ১৯৯১, ৬০৮ পৃষ্ঠা।

[৯] নোট: হাদীসবেত্তা যাঁর স্মরণশক্তি প্রখর; কারো কারো মতে এক লাখ হাদীস মুখস্থ করার মতো স্মরণশক্তিসম্পন্ন।

[১০] নোট: এলম আল-জারহ ওয়াল তা’দিল পণ্ডিত, যে হাদীসবেত্তার ন্যায়পরায়ণতা ও শাস্ত্রগত পাণ্ডিত্য এমন উচ্চ পর্যায়ের যে দিকনির্দেশনার জন্যে তাঁর ওপর অন্যান্য বিদ্বানবৃন্দ নির্ভর করেন; ইমামবৃন্দ-ই নির্ধারণ করতেন কারা দুর্বল বর্ণনাকারী আর কারা নির্ভরযোগ্য; একইভাবে, তাঁরা নির্ধারণ করতেন হাদীসের কোন্ সংস্করণটি সঠিক আর কোনটি ভুল বা দুর্বল; কেউ ইমাম হিসেবে একবার প্রতিষ্ঠা পেলে তিনি অভিসংশনযোগ্য হলেও কারো সমালোচনা-ই তাঁর খ্যাতি বা কর্তৃত্বকে খর্ব করতে পারতো না। এটাই এলম আল-জারহ ওয়াল তা’দিলের নীতিমালা্।

[১১] নোট: অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী যাঁদের ছিল আদালা তথা ন্যায়পরায়ণতা ও নিখুঁত ধীশক্তি; নিখুঁত ধীশক্তি বলতে রাবীকে সঠিকভাবে প্রথমবারের বর্ণনাটুকু শ্রবণ ও স্মরণ রাখতে হবে এবং তারপর যে কোনো সময় তিনি তা বর্ণনা করতে চাইলে সঠিকভাবে মনে করতে সক্ষম হতে হবে; আরেক কথায়, প্রথমবার থেকে প্রতিবারই সঠিকভাবে বর্ণনা করতে হবে; ন্যায়পরায়ণতা বলতে বোঝায় তিনি কখনো মিথ্যে বলেন না এবং কবীরা গুনাহ করেন না।

[১২] নোট: সহীহ পারিভাষিক শব্দ যা নিম্নের পাঁচটি গুণগত মানসম্বলিত বর্ণনাকে বোঝায়: ১/ এমন এক সনদ যা মহানবী (ﷺ) পর্যন্ত ফেরত গিয়েছে; ২/ এমন এক সনদ যেখানে প্রত্যেক রাবী সরাসরি বর্ণনাকারীর কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন; এই শর্তকে এত্তেসাল বলে; ৩/ প্রত্যেক রাবী তথা বর্ণনাকারী এলম আল-জারহ ওয়াল তা’দিল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সিক্বা হিসেবে বিবেচিত হতে হবে; ৪/ হাদীসের মতন তথা লিপি ও রাবীদের এসনাদ উভয়-ই অপ্রকাশ্য ত্রুটি (’ইল্লা) হতে মুক্ত হতে হবে; এই অপ্রকাশ্য ত্রুটি হাদীসের বা এর সনদের বিশুদ্ধতাকে পক্ষপাতদুষ্ট করতে পারে; এর সূক্ষ্মতা ইমাম দারাক্বুতনী, আল-তিরমিযী, আল-হাকিম, ইবনে রাজাবের মতো পণ্ডিতমণ্ডলী-ই কেবল বুঝতে সক্ষম; এবং ৫/ হাদীসের লিপি কোনো মুতাওয়াতির তথা জনশ্রুত হাদীসের অথবা আল-ক্বুরআনের (আল-নুসুস আল-ক্বাতেয়্যার) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার খেলাফ হতে পারবে না; কোনো রাবী তাঁর চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য রাবীদের সাথে বর্ণনা বা বর্ণনাকারীদের সনদের ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করতে পারবেন না; এরকম যদি হয়, তবে ওই হাদীসকে শায্ তথা অনিয়মিত/অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও এরই ফলে দুর্বল বিবেচনা করা হবে; এরকম অসামঞ্জস্য চিনতে হলে হাদীসশাস্ত্রের সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হবে, আর তাই এর একমাত্র যোগ্য ছিলেন প্রাথমিক যুগের ইমামমণ্ডলী।

[১৩] আল-তাবারানী এটা তাঁর ‘আল-মু’জাম আল-সগীর’ পুস্তকের ১ম খণ্ডের ১৮৪ পৃষ্ঠায় এবং ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’ গ্রন্থের ৯ম খণ্ডের ১৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন।

[১৪] নোট: শায়খ মাহমূদ সাঈদ মামদূহ নিজ ‘রাফ’ আল-মিনারা’ পুস্তকের ৯৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন যে আবূ যুর’আ, আবূ হাতেম ও আল-নাসাঈ সকলেই শাবীব সম্পর্কে বলেছেন, لاَ بَاْسَ بِهِ’ -তাঁর ভুল-ভ্রান্তি নেই। শায়খ মাহমূদ উল্লেখ করেন, “কোনো রাবী তথা হাদীস বর্ণনাকারীর নির্ভরযোগ্যতা প্রতিপাদন বা নিশ্চিত করতে এবং তিনি যা বর্ণনা করেন তাকে সহীহ বলে নিশ্চয়তা দিতে, অধিকন্তু (ইমাম বুখারী ও মুসলিমের) দুটি সহীহ হাদীসগ্রন্থে সেগুলোর উল্লেখকে নির্ভরযোগ্য বলে নিশ্চিত করতে এতোটুকু-ই যথেষ্ট হবে।  

[১৫] ইবনে আদী : আল কামিল, ৫/৪৭ পৃষ্ঠা নং ৮৯১।

নোট: আল-যুহরীর বইটি-ই হাদীসশাস্ত্রের প্রথম লিখিত বই। খলীফা উমর ইবনে আব্দিল আযীয, যাঁকে উত্তরসূরীবৃন্দ ইসলামের পঞ্চম খলীফা বলে প্রশংসা করেন, তিনি হাদীসশাস্ত্র লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা না হলে হারিয়ে যেতে পারে -এই আশঙ্কায় আল-যুহরীকে তা বই আকারে প্রকাশ করতে নির্দেশ দেন। অতঃপর আল-যুহরীর বইটি হাদীসশাস্ত্রের ইতিহাসে দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা করে। প্রাথমিক যুগে কোনো কিছু লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হয়নি। মুহাদ্দেসীনবৃন্দ নিজেদের প্রখর স্মরণশক্তির ওপর নির্ভর করতেন এবং লেখালেখির বিপক্ষে ছিলেন।


প্রামাণ্য দলিল - ২


❏ আহমদ ইবনে শাবীব এমন এক রাবী যাঁর ওপর ইমাম বুখারী (رحمة الله) নির্ভর করতেন। তিনি ইবনে শাবীব হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন নিজ ’সহীহ’ ও ‘আল-আদাব আল-মুফরাদ’ উভয় পুস্তকেই। আবূ হাতেম আল-রাযী-ও তাঁকে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য (সিক্বা) ঘোষণা করেন; আর তিনি এবং আবূ যুর’আ তাঁর কাছ থেকে হাদীস লিখে সংকলন করতেন। ইবনে ‘আদী উল্লেখ করেন যে 

قال علي : وقد كتبها عن ابنه أحمد بن شبيب. 

বসরাবাসী হাদীসবিদবৃন্দ তাঁকে সিক্বা বিবেচনা করতেন এবং আলী আল-মাদিনী তাঁর কাছ থেকে হাদীস লিখে নিতেন।


আহমদের পিতা শাবীব ইবনে সাঈদ আল-তামিমী আল-হাবাতী আল-বসরী-ও ছিলেন এমন হাদীস বর্ণনাকারী, যাঁর ওপর ইমাম বুখারী (رحمة الله) নিজ ‘সহীহ’ ও ‘আল-আদাব আল-মুফরাদ’ উভয় গ্রন্থের ক্ষেত্রে নির্ভর করতেন।


শাবীবকে সিক্বা বিবেচনাকারী হাদীসবেত্তাদের মধ্যে রয়েছেন আবূ যুর’আ, আবূ হাতেম, আল-নাসাঈ, আল-যুহালী, আল-দারাক্বুতনী এবং আল-তাবারানী।[১৪]

আবূ হাতেম বর্ণনা করেন যে শাবীব নিজের কাছে ইঊনুস ইবনে এয়াযীদের বইপত্র গচ্ছিত রাখতেন এবং আরো বলেন যে তিনি (শাবীব) হাদীসশাস্ত্রে সালেহ তথা নির্ভরযোগ্য ছিলেন, আর তার মধ্যে কোনো ভুল-ভ্রান্তি ছিল না

)।لأ بَأسَ بِهَا(


❏ ইবনে আদী বলেন,

سمعت علي بن المديني يقول : شبيب بن سَعِيد بصري ثقة ، كان من أصحاب يُونُس ، كان يختلف في تجارة إلى مصر ، وكتابه كتاب صحيح ، قال علي : وقد كتبها عن ابنه أحمد بن شبيب.

“শাবীবের কাছে আল-যুহরী’র বইয়ের একটি কপি ছিল। আল-যুহরী হতে ইঊনুস বর্ণিত অনেক হাদীস তাঁর কাছে গচ্ছিত ছিল।” [১৫] (আলী) ইবনে আল-মাদিনী বর্ণনাকারী শাবীব সম্পর্কে বলেন, “তিনি একদম নির্ভরযোগ্য (সিক্বা)। ব্যবসার উদ্দেশে তিনি মিসরে ভ্রমণ করতেন। তাঁর বইটি প্রামাণিক/খাঁটি (সহীহ)।” [১৬]


ওপরের আলোচনা শাবীবের তা’দিল তথা প্রামাণিকতার বিবরণ দিয়েছে।[১৭]   

পাঠকমণ্ডলী, আপনারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন যে শাবীবের বর্ণনাগুলো সহীহ হওয়ার জন্যে ইঊনুস ইবনে এয়াযীদ হতে সেগুলো বর্ণিত হতে হবে মর্মে কোনো শর্তারোপ এখানে করা হয়নি।

অধিকন্তু, আল-মাদিনী দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দেন যে শাবীবের বই প্রামাণিক। [১৮]


অপরদিকে, ইবনে আদী শাবীবের কাছে গচ্ছিত আল-যুহরীর বইয়ের ব্যাপারে মন্তব্য করার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন, কিন্তু তিনি শাবীবের বাকি সব বর্ণনা জানানোর ব্যাপারে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেননি। অতএব, আলবানী যে শাবীবের রওয়ায়াতগুলোর নির্ভরযোগ্যতার জন্যে ইঊনুস ইবনে এয়াযীদের কাছ থেকে তা হওয়া চাই মর্মে শর্তারোপ করেছেন, তা এক মস্ত ধোকা এবং বিদ্যা শিক্ষাগত নীতির ও ধর্মীয় আস্থার চরম লঙ্ঘন-ও।


শাবীবের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে  আমি (শায়খ গোমারী) ওপরে যা বলেছি, তা আরো সমর্থিত হয়েছে এই বাস্তবতার আলোকে যে, শাবীবের বর্ণিত মহানবী (ﷺ)-এর তাওয়াসসুল (অসীলা গ্রহণ)-কারী অন্ধ সাহাবীর অপর হাদীসটি-ও হুফফায তথা হাদীস বিশারদমণ্ডলী প্রামাণিক বলে ঘোষণা করেন; যদিও শাবীব তা আল-যুহরীর সূত্রে ইঊনুস হতে বর্ণনা করেননি, বরং রাওহ ইবনে আল-ক্বাসিম হতে বর্ণনা করেছিলেন।


অধিকন্তু, আলবানী দাবি করেছেন, যেহেতু ইবনে আল-সুন্নী ও আল-হাকিম কর্তৃক উল্লেখিত কতিপয় রাবীর বর্ণিত হাদীসে হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه)র ঘটনাটির উল্লেখ নেই, সেহেতু রওয়ায়াতটি সন্দেহজনক/দুর্বল (যঈফ)। এটাও আলবানীর ধোকাবাজির আরেকটা (জ্বলন্ত) উদাহরণ। 

উসূলে হাদীস তথা হাদীসশাস্ত্রের নীতিমালা সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা সম্যক অবহিত যে কিছু বর্ণনাকারী কোনো নির্দিষ্ট হাদীস গোটা বর্ণনা করেন; অপরদিকে অন্যান্যরা হয়তো নিজেদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী তা সংক্ষিপ্ত আকারে পেশ করতে পারেন।


উদাহরণস্বরূপ, 

❏ আল-বুখারী (رحمة الله) নিজ সহীহ গ্রন্থে এটা নিয়মিত করেছেন, যেখানে তিনি সংক্ষিপ্ত আকারে হাদীস বর্ণনা করেছেন, আর অন্য কেউ তা পূর্ণ আকারে উদ্ধৃত করেছেন।


❏ উপরন্তু, ইমাম বায়হাক্বী (رحمة الله)র বর্ণনায় হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه)র ঘটনাটি যিনি রওয়ায়াত করেন, তিনি অসাধারণ ইমাম এয়াক্বূব ইবনে সুফইয়ান। আবূ যুর’আ দিমাশক্বী তাঁর সম্পর্কে  বলেন:

“মানবজাতির দু জন মহৎ ব্যক্তি আমাদের মাঝে আবির্ভূত হন। তাঁদের মধ্যে একজন এয়াক্বূব ইবনে সুফইয়ান, যিনি উভয়ের মধ্যে বেশি দেশভ্রমণ করেন, তিনি তাঁর মতো আরেকজন বর্ণনাকারী তৈরিতে ইরাক্ববাসীর জন্যে (আজো) চ্যালেঞ্জ হয়ে আছেন।”


আওনের বর্ণনা যেটা বাস্তবিক-ই দুর্বল, সেটাকে আলবানী কর্তৃক হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ (رضي الله عنه)র ঘটনা বর্ণনাকারীদের রওয়ায়াতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করাটা আলবানীর দ্বৈততা ও জালিয়াতির তৃতীয় একটি দিক। 

❏ কেননা আওনের সূত্রে আল-হাকিম যখন অন্ধ সাহাবীর ঘটনাটি সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা করেন, তখন তিনি উল্লেখ করেছিলেন:

فَدَعَا بِهَذَا الدُّعَاءِ فَقَامَ وَقَدْ أَبْصَرَ تَابَعَهُ: شَبِيبُ بْنُ سَعِيدٍ الْحَبَطِيُّ، عَنْ رَوْحِ بْنِ الْقَاسِمِ «زِيَادَاتٍ فِي الْمَتْنِ وَالْإِسْنَادِ، وَالْقَوْلُ فِيهِ قَوْلُ شَبِيبٍ فَإِنَّهُ ثِقَةٌ مَأْمُونٌ»


“রাওহ ইবনে আল-ক্বাসিমের সূত্রে শাবীব ইবনে সাঈদ আল-হাবাতী এই একই হাদীসের মতন (লিপি) ও এসনাদ (পরম্পরা) উভয় ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত আরো কিছু বর্ণনা যোগ করেছেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত শাবীবেরই, কেননা তিনি একদম নির্ভরযোগ্য (সিক্বা) এবং আস্থাভাজন (মা’মূন)।” [ হাকেম : আল মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন, কিতাবুদ দোয়া, ১/৭০৭ হাদীস নং ১৯২৯]


আল-হাকিম এখানে যা বলেছেন, তা মুহাদ্দেসীনবৃন্দের ও উসূলে ফেক্বাহ’র (মানে ধর্মশাস্ত্রীয় আইনের নীতিমালার) দ্বারা সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত একটি বিধানকে সমর্থন যোগায়; আর তা হলো, কোনো রাবী যিনি একদম সিক্বা, তাঁর দ্বারা বর্ণিত অতিরিক্ত কথা/তথ্য গ্রহণযোগ্য (মক্ববূলা); অধিকন্তু, কেউ কোনো কিছু স্মরণ করতে পারলে তা যিনি স্মরণ করতে পারেননি, তার বিপরীতে প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত হয়।



তথ্যসূত্রঃ



[১৬] নোট: শায়খ মাহমূদ সাঈদ মামদূহ নিজ ‘রাফ’ আল-মিনারা ফী তাখরিজ আহাদীস আল-তাওয়াসসুল ওয়াল যিয়ারা’ শীর্ষক পুস্তকের ১০০ পৃষ্ঠায় বলেন যে আলবানী নিজ ‘আল-তাওয়াসসুল’ কিতাবের ৮৬ পৃষ্ঠায় আলী ইবনে মাদিনীর ওপরোক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ওর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রথমাংশ-ই ছেঁটে ফেলেন। অর্থাৎ, শাবীব একদম সিক্বা মর্মে অংশটি বাদ দেন। আলবানী ‘আল-তাওয়াসসুল’ বইয়ে লিখেন, “আলী আল-মাদিনী বলেন:

 سمعت علي بن المديني يقول ، كان يختلف في تجارة إلى مصر ،

‘তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে মিসরে যেতেন..’।” কিন্তু কোথাও আলবানী এ কথা স্বীকার করেননি যে আলী আল-মাদিনী শাবীবকে সিক্বা বা নির্ভরযোগ্য বলে অভিহিত করেছিলেন। শাবীব আস্থাভাজন নন বলে আলবানীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আল-মাদিনী কর্তৃক শাবীবের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি আলবানীর বাদ দিয়ে যাওয়াটি অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার।


[১৭] নোট: শায়খ মাহমূদ নিজ ‘রাফ’ আল-মিনারা’ গ্রন্থের ৯৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন আলবানী-ই প্রথম ব্যক্তি, যিনি শাবীব দুর্বল বর্ণনাকারী মর্মে দাবি উত্থাপন করেন। হাদীস বিদ্যার বিশারদ (এলম আল-জারহ ওয়াল তা’দিল পণ্ডিত) নয়জনের নাম শায়খ মাহমূদ উল্লেখ করেন, যাঁরা শাবীবকে সিক্বা ঘোষণা করেছিলেন। এই ইমামবৃন্দ হলেন আলী আল-মাদিনী, মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া আল-যুহালী, আল-দারাক্বুতনী, আল-তাবারানী, ইবনে হিব্বান, আল-হাকিম, আবূ যুর’আ, আবূ হাতেম ও আল-নাসাঈ।


[১৮] নোট: শায়খ মাহমূদ সাঈদ মামদূহ নিজ ‘রাফ’ আল-মিনারা ফী তাখরিজে আহাদীস আল-তাওয়াসসুল ওয়াল-যিয়ারা’ পুস্তকের ৯৯-১০০ পৃষ্ঠাগুলোতে উল্লেখ করেন যে কোনো রাবী তথা বর্ণনাকারীর নির্ভুল হওয়া (এবং ন্যায়পরায়ণ হওয়া যা হাদীস বর্ণনায় নির্ভরযোগ্যতার মাপকাঠিস্বরূপ, তা) দুই ধরনের: ১/ স্মৃতিশক্তিতে নির্ভুল হওয়া, এবং ২/ দাবত্ আল-কিতাবা তথা তিনি যা লিখেছেন তাতেও নির্ভুল হওয়া। আলী আল-মাদিনী কোনো রকম শর্তারোপ ছাড়াই প্রথমে ঘোষণা করেন যে শাবীব একদম নির্ভরযোগ্য (সিক্বা)। অতঃপর তিনি তাতে জোর দিতে বলেন যে তাঁর বই-ও প্রামাণিক, আর এক্ষেত্রে তিনি শাবীবের নির্ভরযোগ্যতাকে ওই বইয়ের জন্যে শর্তসাপেক্ষ করেননি।

Top