মাহফিলে মীলাদ শরীফের বর্ণনা
এতে দু’টি অধ্যায় রয়েছে- প্রথম অধ্যায়ে মীলাদ শরীফের প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ প্রসংগে উত্থাপিত আপত্তিসমূহ ও এসবের জওয়াব দেয়া হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ে
মীলাদ শরীফের প্রমাণ
প্রথমে এটি জানা দরকার যে মীলাদ শরীফের হাকীকত কি এবং এর হুকুম? অতঃপর এও জানা দরকার যে এর প্রমাণসমূহ কি কি? মীলাদ শরীফের হাকীকত হচ্ছে হুযুর (ﷺ) এর পবিত্র জন্মগ্রহণের অবস্থা বর্ণনা করা অর্থাৎ গর্ভাবস্থার ঘটনাবলী, নূরে মুহাম্মদীর কারামত, বংশ পরিচয়, শৈশবাবস্থা ও হযরত হালীমা (رضي الله عنه) এর সেখানে লালন-পালন হওয়ার বর্ণনা এবং হুযুর (ﷺ) এর শানে গদ্যে বা পদ্যে কিছু পাঠ করাটাও এর অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং, এসব একাকী বর্ণনা করুন বা মাহফিলের আয়োজন করে বর্ণনা করুন যেভাবে হোক না কেন মীলাদ শরীফ বলা হবে। মাহফিলে মীলাদ শরীফের আয়োজন করা, পবিত্র জন্মের আনন্দ প্রকাশ করা, মীলাদের সময় সুগন্ধি লাগানো ও গোলাপ জল ছিটানো, মিস্টান্ন বিতরণ মোট কথা বৈধ উপায়ে আনন্দ প্রকাশ করা সবই মুস্তাহাব এবং বিশেষ বরকত ও আল্লাহর রহমত অবর্তীণ হওয়ার একটি অনন্য মাধ্যম।
১.হযরত ঈসা (عليه السلام) দু’আ করেছিলেন-
رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا.
-‘‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য ভর্তি খাজিনা প্রেরণ করুন, যাতে এটা আমাদের আগে পরে সবার জন্য ঈদে পরিণত হয়।’’
(সূরা মায়েদা, ১১৪)
বোঝা গেল যে হযরত মসীহ (عليه السلام) খাঞ্জা অবতীর্ণ হওয়ার দিনকে ঈদ হিসেবে পালন করেছেন, কেননা ঐদিন খাদ্য ভর্তি দস্তরখানা অবতীর্ণ হয়েছিল। হুযুর (ﷺ) এর আগমন আমাদের জন্য ঐ খাঞ্জা থেকে অনেক বড় নিয়ামত। সুতরাং, হুযুর (ﷺ) এর পবিত্র জন্মদিনও ঈদের দিনের মত। তবে হ্যাঁ, এ পবিত্র মজলিসে কোন হারাম কাজ করা বড় অপরাধ ও পাপ। যেমন মেয়েদের এতটুকু বড় কন্ঠে না’ত শরীফ পাঠ করা, যা অপরিচিত পুরুষ শুনতে পায়, এটি একান্ত নিষেধ। কেননা মেয়েলোকের আওয়াজ অপরিচিত পুরুষ শুনাটা জায়েয নয়। যদি কোন পুরুষ নামাযরত অবস্থায় কাউকে সামনে দিয়ে যেতে বাধা দিতে চায়, তাহলে আওয়াজ করে যেন, ‘সুবহানাল্লাহ্’ বলে দেয়। কিন্তু কোন মহিলা কাউকে বাধা দিতে চাইলে ‘সুবহানাল্লাহ্’ বলবে না এবং বাম হাতের পিঠে ডান হাত মারবে। এতে বোঝা গেল নামাযের অবস্থায় প্রয়েঅজনের সময়ও মহিলা কাউরে নিজ আওয়াজ শুনাতে পারে না। অনুরূপ মীলাদ শরীফে বাদ্য যন্ত্রের সাহায্যে না’ত পাঠ করা বড়ই পাপ। কেননা বাদ্য যন্ত্র হচ্ছে খেলাধুলার ব্যাপার ও নিকৃষ্ট বিষয়ের অর্ন্তভূক্ত। তদুপরি বাদ্যযন্ত্রের দ্বারা খেল-তামাসা করাটা হারাম। না’ত পাঠ হচ্ছে ইবাদত তুল্য, একে বাদ্য যন্ত্রের সাহায্যে পাঠ করাটা খুবই অন্যায়; যদি কোন জায়গায় মীলাদ শরীফে এ ধরনের অন্যায় কাজ করা হয়, তাহলে এসব অন্যায়কে অপসারণ করতে হবে। কিন্তু মীলাদ শরীফে কে বন্ধ করা যাবে না। যদি কোন মহিলা উচ্চ স্বরে কুরআন পাঠ করে বা কোন ব্যক্তি বাদ্যসহকারে কুরআন করীম তিলওয়াত করে, তাহলে এসব অন্যায়কে প্রতিরোধ করুন। তবে কুরআন তিলওয়াত করায় বাধা দিবেন না, কেননা এটা ইবাদত।
কুরআন, হাদীস ওলামায়ে কিরামের উক্তি এবং ফিরিশতা ও নবীগণের কর্মধারা থেকে মীলাদ শরীফ প্রমাণিত।
❏ কুরআন করীমে ইরশাদ করা হয়েছে-
وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ
-‘‘তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের শুকুর গুজার কর।’’
(সূরা বাক্বারা, ২৩১)
হুযুর (ﷺ) এর আগমন বড়ই নিয়ামত। মীলাদ শরীফে এরই আলোচনা করা হয়। সুতরাং, মীলাদ মাহফিল হচ্ছে এ আয়াতের অনুসরণ। পবিত্র কুরআন করীমে ইরশাদ করা হয়েছে-
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ.
-‘‘স্বীয় প্রভুর নিয়ামতের গুনর্কীতন কর।’’
(সূরা দ্বোহা, আয়াত, ১১)
ধরাধমে হুযুর (ﷺ) এর শুভ আগমন সমস্ত নিয়ামতের মধ্যে সবচেয়ে বড় নিয়অমত। আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং এর জন্য গর্ববোধ করেছেন। সুতরাং, এ সম্পর্কে আলোচনা করাটা এ আয়অতেরই অনুসরণ। আজকাল কারো সন্তান হলে প্রতি বছর জন্ম তারিখে জন্ম দিনের অনুষ্টান করা হয়, কেউ রাজত্ব লাভ করলে, প্রতি বছর ঐ দিনে আনন্দ উৎসব করা হয়। তাহলে যেদিন পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় নিয়ামতের আগমন ঘটেছে, তার জন্য আনন্দ প্রকাশ করাটা কেন নিষিদ্ধ হবে? স্বয়ং কুরআন করীম বিভিন্ন জায়গায় হুযুর (ﷺ) এর মীলাদ বর্ণনা করেছেন। যেমন এক জায়গায় আছে-
لَقَدْ جاءَكُمْ رَسُولٌ
-‘‘হে মুসলমানগণ, তোমাদের কাছে সম্মানিত রসূল (ﷺ) আগমন করেছেন।’’
(সূরা তাওবা, আয়াত, ১২৮)
এখানে জন্মের বর্ণনা করা হয়েছে। এর পর- مِنْ أَنْفُسِكُمْ -‘‘তোমাদের মধ্যে থেকে।’’(সূরা তাওবা, আয়াত, ১২৮) দ্বারা বংশ পরিচয়ের কথা বলা হয়েছে। অতঃপর حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ থেকে শেষ পর্যন্ত হুযুর (ﷺ) এর গুনর্কীতন করা হয়েছে। বর্তমাস মীলাদ শরীফেও এ তিনটি বিষয়েই আলোচনা করা হয়।
❏ পবিত্র কুরআন করীমে ইরশাদ করা হয়েছে-
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا
-‘‘আল্লাহ মুসলমানদের উপর বড়ই ইহ্সান করেছেন যে তাদের কাছে স্বীয় নবী আলাইহিস সাল্লামকে পাঠিয়েছেন।’’
(সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং-১৬৪)
❏ অন্যত্র পবিত্র কুরআন করীমে ইরশাদ হচ্ছে-
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ
-‘‘বিশ্ব প্রতিপালক সেই ক্ষমতাবান, যিনি স্বীয় নবী আলাইহিস সাল্লামকে হিদায়েত ও সঠিক দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন।’’
(সূরা ছাফ, আয়াত, ৯)
মোট কথা এ রকম অনেক আয়াত আছে, যেখানে হুযুর (ﷺ) এর পবিত্র জন্ম বৃত্তান্তের কথা বর্ণিত হয়েছে। এতে বোঝা গেল মীলাদের বর্ণনা করা আল্লাহরই সন্নাত। জমাত সহকারে নামাযের মধ্যে আমাদের আকা মাওলা (ﷺ) এর মীলাদ পালিত হয়। দেখুন, ইমামের পিছনে সমাবেশও রয়েছে, কিয়ামও হচ্ছে, আবার বেলাদত শরীফের বর্ণনাও হচ্ছে। এমনকি স্বয়ং কালেমায়ে তৈয়বিয়া মীলাদ শরীফের বর্ণনা রয়েছে। কেননা এ কালেমাতে আছে-
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ
-‘‘মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল।’’
(সূরা ফাতহ, আয়াত, ২৯)
رَسُولُ শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রেরিত আর প্রেরণ যেখানে আছে, সেখানে নিশ্চয় আগমনও আছে। অতএব, হুযুর (ﷺ) এর তশরীফ আনয়নের বর্ণনা হয়ে গেল এবং আসল মীলাদই পাওয়া গেল। কুরআন শরীফ আম্বিয়া আলাইহিস সালামেরও মীলাদ বর্ণনা করেছেন। সূরা মরিয়মে হযরত মরিয়ম (عليه السلام) এর গর্ভধারণ, হযরত ঈসা (عليه السلام) এর পবিত্র জন্মের বর্ণনা জন্মের বর্ণনা এমনকি হযরত মরিয়মের কষ্ট পাওয়া, কষ্টের সময় যে কথাগুলো বলেছেন। ৫৩
➥〈 সূরা মারিয়াম, আয়াত, ২৩ 〉
-يَا لَيْتَنِي مِتُّ قَبْلَ هَذا অতঃপর ফিরিশতাদের পক্ষ থেকে সান্তনা লাভ, এরপর ওই সময় হযরত মরিয়ম (عليه السلام) কি খাদ্য গ্রহণ করেছিলেন, অতঃপর হযরত ঈসা (عليه السلام) এর কওমের সাথে কলা বলা, মোট কথা সবই বর্ণনা করেছেন। এও বর্ননা করা হয়েছে যে হযরত আমিনা খাতুন নবীজীর ﷺ পবিত্র বেলাদতের সময় অমুক অমুক মুজিযা দেখেছেন । অত:পর আরও ইরশাদ করেন যে বেহেশ্তের হুরগন তাঁর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন এবং পবিত্র কা’বা শরীফ হযরত আমিনা খাতুনের ঘরকে সিজ্দা করেন, ইত্যাদি ইত্যাদিও হচ্ছে সেই কুরআনী সুন্নাত। অনুরুপ কুরআন শরীফ হযরত মুসা (عليه السلام) এর জন্ম, তাঁর শৈশবাস্থা, তাঁর লালন-পালন, তাঁর চালচলন, মাদয়ানে গমন,হযরত শুয়াইবের খিদমতে হাযির হওয়া, ওখানে অবস্থান ছাগলচরানো, বিবাহ, নবুয়াত লাভ ইত্যাদি সবকিছু বর্ণনা করেছেন। মীলাদে এসব কথাগুলো পর্যালোচনা করা হয়।
মুদারেজুন নাবুয়াত ও অন্যান্য কিতাবে উলেখিত আছে যে, সমস্ত নবীগণই নিজ নিজ উম্মতদের কাছে হুযুর (ﷺ) এর শুভাগমনের খবর দিয়েছেন।
❏ হযরত ঈসা আলাহিস সালামের বাণী কুরআনে উদ্ধৃতি করা হয়েছে-
وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ
-‘‘আমি এমন রাসূলের শুভ সংবাদদাতা, যিনি আমার পরে তশরীফ আনয়ন করবেন, যাঁর পবিত্র নাম আহমদ।’’
(সূরা ছাফ, আয়াত, ৬)
সুবহানাল্লাহ! শিশুদের জন্মের সপ্তম দিন মা বাপ নাম রাখেন। কিন্তু নবীজীর (ﷺ) বেলাদতের ৫৭০ বছর আগে হযরত মসীহ (عليه السلام) বলেন যে তাঁর (ﷺ) নাম আহমদ। কিন্তু ‘আহমদ হবে’ এ রকম বলেননি। বোঝা গেল যে তাঁর পবিত্র নাম আল্লাহ তাআলাই রেখেছেন। তবে কখন রেখেছেন, তা তিনিই জানেন। এও এক প্রকার মীলাদ শরীফ। তবে এটুকু পার্থক্য যে উনারা স্বীয় কওমের সমাবেশে বলেছেন যে তিনি (ﷺ) তাশরীফ আনবেন আর আমরা আমাদের সমাবেশে বলি যে তিনি (ﷺ) তাশরীফ এনেছেন। কথা একই, শুধু অতীত ও ভবিষ্যতের পার্থক্য। এতে বোঝা গেল মীলাদ শরীফ নবীদেরও সুন্নাত।
❏ আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ ফরমান -৫৪
قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِمَّا يَجْمَعُونَ-‘‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের ব্যাপারে বেশী করে আনন্দ প্রকাশ কর।’’
(সূরা ইউনুস, আয়াত, ৫৮)
➥〈 টিকাঃ
☞এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম সুয়ূতী (رحمة الله) বলেন-
وَأخرج أَبُو الشَّيْخ عَن ابْن عَبَّاس رَضِي الله عَنْهُمَا فِي الْآيَة قَالَ: فضل الله الْعلم وَرَحمته مُحَمَّد صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ الله تَعَالَى (وَمَا أَرْسَلْنَاك إِلَّا رَحْمَة للْعَالمين) (الْأَنْبِيَاء الْآيَة ১০৭)
-‘‘সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে আল্লাহর (ফদ্বল) বা অনুগ্রহ দ্বারা ইলমকে এবং (রহমত) দ্বারা নবি করিম (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- হে হাবিব আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ব-জগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্ররেণ করেছি (সুরা আম্বিয়া, আয়াত, ১০৭)।’’ (ইমাম সুয়ূতী, তাফসীরে দুররুল মানসূর, ৪/৩৬৭পৃঃ দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।)
☞আওলাদে রাসূল (ﷺ) ইমাম আবু জাফর বাকের (رحمة الله) বলেন, এখানে (ফদ্বল) দ্বারাও নবি পাক (ﷺ) কে উদ্দেশ্য। )সুয়ূতী, তাফসীরে দুররুল মানসূর, ৪/৩৬৭পৃঃ দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, ইমাম আলূসী, তাফসীরে রুহুল মা‘য়ানী, ১১/১৮৩পৃঃ ইমাম তিবরিসী, মাজমাউল বায়ান, ৫/১৭৭-১৭৮পৃঃ , ইমাম হাইয়্যান, তাফসীরে বাহারে মুহিত, ৫/১৭১পৃঃ ইমাম জওজী, তাফসীরে যাদুল মাইসীর, ৪/৪০পৃঃ ( তাই বুঝা গেল মহান রব তা‘য়ালাই তার রাসূল কে পাওয়ার কারণে আনন্দ বা ঈদ উদ্যাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। 〉
এতে বোঝা গেল যে, আল্লাহর অনুগ্রহে আনন্দ প্রকাশ করা আল্লাহরই হুকুম। তাহলে হুযুর (ﷺ) আল্লাহর অনুগ্রহও, আবার রহমতও। সুতরাং, তাঁর পবিত্র বেলাদাতের আনন্দ প্রকাশ করা এ আয়াত অনুযায়ী আমলই প্রকাশ পায়।
এখানে আনন্দ উল্লাস বলতে সর্ব প্রকার বৈধ আনন্দ উল্লাসকেই অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। সুতরাং, মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করা, এর জন্য সাজসজ্জা ইত্যাদি সব ছওয়াবের কাজ।
(৪) মাওয়াহেবুল লাদুনিয়া, মাদারেজুন নাবুয়াত ও অন্যান্য কিতাবে বেলাদত প্রসংগে আলোচনা উলেখিত আছে যে পবিত্র বেলাদতের রাতে ফিরিশ্তাগণ হযরত আমিরা খাতুন (رضي الله عنه) এর দুয়ারে দাড়িয়ে সালাত ও সালাম পেশ করেছিলেন। তবে চির অভিশপ্ত শয়তান দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পলায়নপর অবস্থায় ছিল। এর থেকে বোঝা গেল মীলাদ শরীফ ফিরিশতাদেরও সুন্নাত এবং এও বোঝা গেল, নবী করীম (ﷺ) এর পবিত্র জন্মের সময় দাড়িয়ে থাকা ফিরিশতাদের কাজ আর পালিয়ে থাকাটা হচ্ছে শয়তানের কাজ। এখন এটা জনগণেরই ইখতিয়ার, চাহে ফিরিশতাদের কাজ অনুযায়ী আমল করুক বা শয়তানেরই কাজ অনুযায়ী।
(৫) স্বয়ং হুযুর (ﷺ) এর মিম্বরের উপর দাড়িঁয়ে সাহাবায়ে কিরামের সমাবেশে স্বীয় বেলাদত পাক এবং স্বীয় গুণাবলী বয়ান করেছন। এর থেকে বোঝা গেল মীলাদ পাঠ রাসূলূল্লাহ (ﷺ) এরও সুন্নাত।
❏ মিশকাত শরীফের ২য় খন্ড فضائل سيد المرسلين শীর্ষক অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত আছে, আমি একদিন হুযুর (ﷺ) এর খেদমতে উপস্থিত হলাম। সম্বভতঃ হুযুর (ﷺ) এর কাছেও সংবাদটা পৌছেছিল যে কতেক লোক আমাদের পবিত্র বংশ মর্যাদা সম্পর্কে বিদ্রুপ করে।
فَقَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْمِنْبَرِ فَقَالَ:مَنْ أَنَا؟ فَقَالُوا: أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ. فَقَالَ: أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ الْخَلْقَ فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ ثمَّ جعلهم فرقتَيْن فجعلني فِي خير فِرْقَةً ثُمَّ جَعَلَهُمْ قَبَائِلَ فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ قَبيلَة ثمَّ جعله بُيُوتًا فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ بَيْتًا فَأَنَا خَيْرُهُمْ نفسا وَخَيرهمْ بَيْتا . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
-‘‘তখন নবী আলাইহি সাল্লাম মিম্বরের উপর দাড়িঁয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন, আমি কে? সবাই আরয করলেন-আপনি আল্লাহর রাসূল। তিনি ইরশাদ ফরমালেন আমি মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব। আল্লাহ মাখলুখ সৃষ্টি করেছন এবং আমাদেরকে শ্রেষ্ট সৃষ্টজীবের অর্ন্তভূক্ত করেছন। অতঃপর এদেরকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন-আরবী ও আযমী। আমাদিগকে যেটা বেশী মর্যাদাবান অর্থাৎ আরবীয়দের অর্ন্তভূক্ত করেছন। আবার আরবীয়দের মধ্যে কয়েকটি গোত্র আছে তন্মধ্যে যেটা শ্রেষ্ট অর্থাৎ কুরাাইশ গোত্রের অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে আমাদেরকে। পুররায় কুরাাইশ গোত্রের মধ্যে কয়েকটি বংশের উদ্ভব হয়েছে। আমাদেরকে সে সবের শ্রেষ্ট বংশের অর্থাৎ বনি হাশিমের অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে।’’
(সুনানে তিরমিযি, ৫/৫৪৩ পৃ. হা/৩৫৩২, খতিব তিবরিযি, মিশকাতুল মাসাবীহ, ৩/১৬০৪ পৃ, হা/৫৭৫৭)
একই মিশকাত শরীফে সেই একই পরিচ্ছেদে আরও উলেখিত আছে- আমি হলাম খাতেমুন নবীয়ীন অর্থাৎ নবীদের শেষ নবী। আমি হলাম হযরত ইব্রাহিম (عليه السلام) এর দু’আ, হযরত ঈসা (عليه السلام) এর ভবিষ্যদ্বাণী এবং নিজ আম্মাজানের প্রত্যেক্ষ দর্মন, যিনি আমার বেলাদতের সময় দেখেছিলেন যে তাঁর থেকে এমন একটি নুর বিকশিত হয়েছির যদ্বারা শাম দেশের অট্টালিকা গুলো তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। ওই সমাবেশে হুযুর আলাইহি সাল্লাম স্বীয় বংশ পরিচয়, গুনাবলী ও পবিত্র জন্মের ঘটনা বর্ণনা করেন। এ সবই মীলাদ শরীফে আলোচিত হয়। এ রকম হাজার হাজার হাদীছ পেশ করা যেতে পারে।
(৬) সাহাবায়ে কিরাম একে অপরের কাছে গিয়ে আবদার করতেন যে আমাকে হুযুর আলাইহিস সাল্লামের না’ত শরীফ শোনান। বোঝা গেল মীলাদ সাহাবায়ে কিরামেরও সুন্নাত। যেমন মিশকাত শরীফের فضائل سيد المرسلين শীর্ষক অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদে উলেখিত আছে, হযরত আতা ইবনে ইয়াসার বলেন যে, আমি আবদুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে আসের (رضي الله عنه) কাছে গিয়ে আরয করলাম, আমাকে হুযুর আলাইহিস সাল্লামের ঐ না’তটি শোনান, যেটা তাওরীত শরীফে উলেখিত আছে। তিনি তা পড়ে শোনান। অনুরূপ হযরত কা’ব বর্ণনা করেছেন যে আমি তাওরিত কিতাবে হুযুর আলাইহিস সাল্লামের নাতে পাবে এ রকমই পেয়েছি যে মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর রসূল; তাঁর প্রিয় বান্দা, তিনি (ﷺ) মন্দ স্বভাব ও কঠিন প্রকৃতির নয়, তাঁর জন্ম মক্কা মুকাররমায় এবং তাঁর হিজরত মদীনা থৈয়্যবায়, তাঁর দেশ শামের মধ্যেই হবে। তাঁর উম্মত আল্লাহর অনেক শুকরিয়া জ্ঞাপন করবেন। সুখ-দুঃখে সব সময় আল্লাহর প্রশংসা করবেন (মিশকাত শরীফ فضائل سيد المرسلين অধ্যায় দ্রষ্টব্য।)
(৭) এ পর্যন্ত আল্লাহর পিয় বান্দাদের ভাষ্যই বর্ণিত রয়েছে। কাফিরগণও হুযুরের পবিত্র বেলাদতে আনন্দ উল্লাস করেছে। এতে তাঁরা কিছু না কিছু উপকারও পেয়েছে। যেমন
❏ বুখারী শরীফের দ্বিতীয় খন্ড কিতাবুন নিকাহ- بَابُ ➥〈 وَأُمَّهَاتُكُمُ اللَّاتِي أَرْضَعْنَكُمْ 〉 [النساء: ২৩] وَيَحْرُمُ مِنَ الرَّضَاعَةِ শীর্ষক অধ্যায়ে উলেখিত আছে-
فَلَمَّا مَاتَ أَبُو لَهَبٍ أُرِيَهُ بَعْضُ أَهْلِهِ بِشَرِّ حِيبَةٍ، قَالَ لَهُ: مَاذَا لَقِيتَ؟ قَالَ أَبُو لَهَبٍ: لَمْ أَلْقَ بَعْدَكُمْ غَيْرَ أَنِّي سُقِيتُ فِي هَذِهِ بِعَتَاقَتِي ثُوَيْبَةَ
-‘‘যখন আবু লাহাব মারা গেল, তখন তার পরিবারের কোন একজন স্বপ্নে তাকে শোচনীয় অবস্থায় দেখলো। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো সে কি অবস্থায় আছে? আবু লাহাব বললো- তোমাদের থেকে পৃথক হওয়ার পর আমি কোন শান্তি পেলাম না। তবে হ্যাঁ তর্জনী আঙুল থেকে পানি পেয়ে থাকি, কেননা আমি ছুয়াইব নামক বাদীঁকে আযাদ করে ছিলাম এ আঙুলের ইশারায়।’’
(সহীহ বুখারী, ৭/৯ পৃ. হা/৫১০১)
ব্যাপার হলো আবু লাহাব হযরত আব্দুল্লাহর ভাই। তাঁর বাদী ছুয়াইবা এসে যখন তাকে খবর দিল যে আজ আপনার ভাই আব্দুল্লাহর সন্তান (মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ) জন্ম গ্রহণ করেছন, তখন তিনি খুশিতে সেই বাঁদীকে আঙুলের ইশারায় বলেছিলেন যাও আজ থেকে তুমি স্বাধীন। সে ছিল কট্টর কাফির যার পাপাচারের কথা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সেই খুশীর বরকতে আল্লাহ তার প্রতি এ করুণাটুকু করলো যে সে দোযখে যখন তৃষ্ণাবোধ করে তখন নিজেই সেই আঙ্গুলটা চুষতে থাকে, এতে তৃষ্ণা লাঘব হয়ে যায়। অথচ সে ছিল কাফির আর আমরা হলাম মুমিন; সে ছিল দুশমন কিন্তু আমরা অনুগত বান্দা। ভাতিজার জন্মেই সে খুশী প্রকাশ করেছিল; রাসূলুল্লাহর জন্য আনন্দ প্রকাশ করেনি। কিন্তু আমরা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর পবিত্র বেলাদতের আনন্দ উদ্যাপন করি। তাহলে, তিনি (আল্লাহ) হলেন দয়াবান, আমরা তার করুণার ভিখারী আমাদেরকে কি কিছু দিবেন না?
دوستاں راكجا كنى محروم- توكه بادشمناں نظردارى
অর্থাৎ যে দুশমনের ভালমন্দের খবর রাখে, সে কি কখনো বন্ধুদেরকে বঞ্চিত করতে পারে?
❏ মাদারেজুন নাবুয়াত দ্বিতীয় খন্ডে হুযুর আলাইহিস সাল্লামের দুপান অবস্থার আলোচনায় আবু লাহাবের সেই ঘটনাটি বর্ণনা করার পর বলেন-
ودريں جاسند است مراهل مواليدرا كه درشب ميلاد آں سرور سرور كنند وبذل اموال نمايند يعنى ابو لهب كه كافر بود چوں بسر در ميلاد آں حضرت وبذل شير جار يه دے بجهت آں حضرت جزا داده شد تاحال مسلماں كه مملو است همحبت وسرور وبذل مال دردے چه باشد وليكن بايد كه از بدعت هاكه عوام احداث كرده انداز تغنى وآلات محرمه ومنكرات خالى باشد
-‘‘এ ঘটনার মধ্যে মীলাদ পক্ষের জন্য বিরাট দলীল রয়েছে। যিনি হুযুর আলাইহিস সাল্লামের পবিত্র বেলাদতের রাতে আনন্দ প্রকাশ করে ও দান খয়রাত করে অর্থাৎ আবু লাহাব যে কাফির ছিল, কিন্তু যখন হুযুরের বেলাদতের খবরে আনন্দ প্রকাশ ও বাঁদীর দুধপান করার কারণে পুরষ্কৃত করা হয়েছিল, তাহলে ওই মুসলমানের কি হবে, যিনি ভালবাসা ও আনন্দে বিভোর এবং অকাতরে দান খয়রাত করেন। অবশ্য মাহফিলে মীলাদ শরীফ যেন সাধারণ লোকদের কুসংস্কার সমূহ অর্থাৎ গান-বাজনা ইত্যাদি থেকে পবিত্র থাকে।’’
(৮) প্রত্যেক যুগে এবং প্রত্যেক জায়গায় উলামায়ে কিরাম আওলিয়া মাশায়েখ ও সাধারণ মুসলমানগণ এ মীলাদ শরীফকে মুস্তাহাব মনে করে উদ্যাপন করে আসছেন ও করেছেন। মক্কা-মদীনায়ও বিশেষ মর্যাদার সাথে মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। যে দেশে যান না কেন মুসলমানদের মধ্যে এ আমলটা পাওয়অ যাবে। আল্লাহর ওলীগণ ও দেশবরেণ্য আলিমগণ এর বড় বড় উপকার ও বরকতের বর্ণনা করেছেন। আমি ইতিপূর্বে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছি-যে কাজকে মুসলমানগণ ভাল মনে করে, তা আল্লাহর কাছেও ভাল হিসেবে গণ্য। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ ফরমান- لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ -‘‘যাতে তোমরা হে মুসলমান, সাক্ষী হও।’’ (সূরা বাক্বারা, আয়াত, ১৪৩)
❏ হাদীছ শরীফে উল্লেখিত আছে-
أَنْتُمْ شُهَدَاءُ اللَّهِ فِي الأَرْضِ
-‘‘তোমরা পৃথিবীর মধ্যে আল্লাহর সাক্ষ্য।’’
(সহীহ বুখারী, ২/৯৭ পৃ. জানাযা অধ্যায়, হা/১৩৬৭)
সুতরাং পবিত্র মীলাদ মাহফিল মুস্তাহাব।
❏ ‘মুজমাউল বিহার’ গ্রন্থের শেষে ৫৫০ পৃষ্টায় উলেখিত আছে যে শাইখ মুহাম্মাদ জাহির (মুহাদ্দিছ) রবিউল আউয়াল প্রসংগে বলেন-
فَاِنَّهُ شَهْرٌ اُمِرْنَا بِاَظْهَارِ الْحَبُوْرِ فِيْهِ كُلَّ عَامٍ
-‘‘নিশ্চয় এটি এমন একটি মাস, যে মাসে প্রতি বছর আনন্দ প্রকাশ করার জন্য আমাদেরকে নির্দেম দেয়া হয়েছে।’’ বোঝা গেল যে প্রতি বছর রবিউল আউয়াল মাসে আনন্দ প্রকাশের নির্দেশ রয়েছে।
❏ তাফসীরে রূহুল বয়ানের ২৬ পারায় সূরা ফাতহের আয়াত مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ প্রসংগে ব্যাখ্যা করা হয়েছে-
وَمِنْ تَعْظِيْمِهِ عَمَلُ الْمَوْلِدِ إِذَا لَمْ يَكُنْ فِيْهِ مُنْكَرُ قَالَ الاِمَامُ السُّيُوْطِي قُدِّسَ سِرُّه يُسْتَحَبُّ لَنَا اِظْهَارُ الشُّكْرِ لْمَوْلِدِهِ عَلِيْهِ السَّلاَمْ
-‘‘মিলাদ শরীফ করাটা হুযুর আলাইহিস সাল্লামের প্রতি সম্মান, যদি এটা মন্দ কথাবার্তা থেকে মুক্ত হয়। ইমাম সুয়ূতী (رحمة الله) বলেন- হুযুর আলাইহিস সাল্লামের বেলায়েতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করা আমাদের জন্য মুস্তাহাব।’’
(ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, ৯/৫৬ পৃ., দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)
❏ অতঃপর আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী আরও বলেন-
وَقَدْ قَالَ اِبْنِ حَجَرْ الهَيْثَمِي اَنَّ البِدْعَةَ الحَسَنَةَ مُتَّفَقُ عَلَى نُدْبِهَا وَعَمَلُ الْمَوْلِدِ وَاَجْتِمَاعُ النَّاسِ لَهُ كَذَلِكَ اَىْ بِدْعَةُ حَسَنَةٌ قَالَ السَّخَاوِي لَمْ يَفْعَلَهُ أَحَدٌ مِّنَ القُرُوْنِ الثَّلاَثَةِ وَاِنَّمَا حَدَثَ بَعْدُ ثُمَّ لَا زَالَ اَهْلُ الإِسْلاَمِ مِنْ سَائِرِ الأَقْطَارِ وَالُمدْنِ الكُبَارِ يَعْمَلُوْنَ المَوْلِدَ وَيَتَصَدَقُوْنَ فِي لياليه بِاَنْوَاعِ الصَّدَقَاتِ وَيَعْتَنُوْنَ بِقَرَاءَةِ مَوْلِدِهِ الكَرِيْمِ وَيَظْهَرُ مِنْ بَرْكَاتِهِ عَلَيْهِمْ كُلُّ فضل عظيم قال ابن الجوزي من خواصه انه أمان في ذلك العام وبشرى عاجلة بنيل البغية والمرام وأول من أحدثه من الملوك صاحب اربل وصنف له ابن دحية رحمه الله كتابا في المولد سماه التنوير بمولد البشير النذير فأجازه بألف دينار وَقَدْ اِسْتَخْرَجَ لَهُ الْحَافِظُ اِبْنِ حَجر أَصْلاً مِنَ السُّنَّةِ وَكَذَا الْحَافِظُ السُّيُوْطِي وَرَدَّا عَلَى الفَاكِهَانِي المَالِكِي فِي قَوْلِهِ اِنَّ عَمَلَ الْمَوْلِدِ بِدْعَةٌ مُذْمَوْمَةٌ كَمَا فِي اِنْسَانُ الْعُيُوْن.
-‘‘ইমাম ইবনে হাজর হাইতমী মক্কী (رحمة الله) বলেন যে বিদ্আতে হাসানা মুস্তাহাব হওয়া সম্পর্কে সবাই একমত। মীলাদ শরীফের আয়োজন করা এবং এতে লোকের জমায়েত হওয়া অনুরূপ বিদ্আতে হাসানা। ইমাম সাখাবী (رحمة الله) বলেন যে তিন যুগের (সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেঈ’র যুগ) মধ্যে কেউ মীলাদ শরীফ করেননি। পরবর্তীতে চালু হয়েছে। অতঃপর চারিদিকে ও প্রতিটি শহরে-বন্দরে মুসলমানগণ সব সময় মীলাদ শরীফ করে আসছেন ও নানা রকম দান-খয়রাতও করে যাচ্ছেন, এবং হুযুর আলাইহিস সাল্লামের মীলাদপাঠের প্রতি খুবই গুরুত্ব দিয়ে আসেছেন। এ পবিত্র মাহফিলের বরকতে তাঁদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ নাযিল হয়। ইমাম ইবনে জুয়ী বলেন যে মীলাদ শরীফের বরকতে সারা বছর নিরাপদ থাকা যায় এবং এর ফলে উদ্দেশ্য সাধনের শুভ সংবাদ রয়েছে। যে বাদশাহ সর্বপ্রথম এটা চালু করেছিলেন, তিনি হলেন শাহ আরবল। আল্লামা ইবনে দাহ্ইয়া এর জন্য একটি মীলাদ শরীফের কিতাব রচনা করেন, যার জন্য বাদশাহ এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা বকশিশ দেন। হাফেজ ইবন হাজার আসকালানী (رحمة الله) ও হাফেজ সয়ূতী (رحمة الله) মীলাদের উৎপত্তি সুন্নাত দ্বারা প্রমাণ করেছন এবং যারা একে বিদ্আতে সাইয়া বলে নিষেধ করে থাকে, তা অগ্রাহ্য করেছেন। এমনটি ইনসানুল ইয়ূন গ্রন্থে রয়েছে।’’
(ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, ৯/৫৬-৫৭ পৃ., দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)
❏ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন-
لازَالَ اَهْلُ الاِسْلاَمِ يَخْتَلِفُوْنَ فِى كُلِّ سَنَةٍ جَدِيْدَةٍ وَيَعْتَنَوْنَ بِقِرَاءَةِ مَوْلِدِهِ الْكَرِيْمِ وَيَظْهَرُ عَلَيْهِمْ مِنْ بَرْكَاتِهِ كُلُّ فَضْلٍ عَظِيْمٍ.
-‘‘মুসলমানগণ প্রতি নববর্ষে মাহফিল করে আসছেন এবং তাঁরা মীলাদ পাঠের আয়োজন করেন। এর ফলে তাদের প্রতি অসীম রহমতের প্রকাশ ঘটে।’’ ৫৫
➥〈 মোল্লা আলী ক্বারী, মাওয়ারিদুর রাভী, ৫ পৃঃ 〉
❏ ভূমিকায় এ কবিতাগুলোও উলেখ করেন-
لِهَذَا الشَّهْرِ فِى الْاِسْلاَمِ فَضْلٌ- وَمَنْقَبَةٌ تَفُوْقُ عَلَى الشُّهُوْر
رَبِيْعٌ فِى رَبِيْعٍ فِى رَبِيْعٍ- وَنُوْرٌ فَوْقَ نُوْرٌ فَوْقَ نُوْرٌ
-‘‘ইসলামে এ পবিত্র মাসের বিরাট মর্যাদা ও ফযীলত রয়েছে, যার ফলে মাসটি অন্যান্য মাসের উপর প্রাধান্য পেয়েছে। সত্যিই এটা বসন্তের বসন্ত ও নূরের নূর।’’
উপরোক্ত ইবারতসমূহ থেকে তিনটি বিষয় বোঝা গেল-এক, পূর্ব-পশ্চিমের সকল মুসলমানগণ একে ভাল মনে করে পালন করেন; দুই-বড় বড় আলিমগণ, ফকিহগণ, মুহাদ্দিছগণ, তাফসীরকারকগণ ও সূফিয়ানে কিরাম, যেমন আল্লামা ইবনে হাজর, ইমাম সয়ূতী, হাইতমী, ইমাম সাখাবী, জুয়ী, হাফেজ ইবনে হাজর প্রমুখ একে ভাল কাজ মনে করেছন। তিনি এ মীলাদ শরীফের বরকতে সারা বছর বাড়িঘর নিরাপদ থাকে ও উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়।
(৯) যুক্তিও বলে যে মীলাদ শরীফ বড় কল্যানকর মাহফির। এতে অনেক উপকার রয়েছে।
প্রথমতঃ হুযুর আলাইহিস সাল্লামের ফযীলতসমূহের কথা শুনে মুসলমানদের অন্তরে হুযুরের মহব্বত বৃদ্ধি পায়। শাইখ আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী এবং অন্যান্য সূফিয়ানে কিরাম বলেন যে হুযুর আলাইহিস সাল্লামের প্রতি মুহাব্বত বৃদ্ধির জন্য বেশী করে দরূদ শরীফ পড়া এবং হুযুরের (ﷺ) জীবন বৃত্তান্ত পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। লেখাপড়া জানা লোকেরা বই-পুস্তক থেকে হুযুরের (ﷺ) জীবন বৃত্তান্ত জানতে পারেন। কিন্তু অশিক্ষিত লোকেরা পড়তে পারে না। তাই তারা এভাবে শোনার সুযোগ পায়।
দ্বিতীয়তঃ এ ধরনের পবিত্র মাহফিল বিধর্মীদের জন্য তবলীগের কাজ করে। তারাও এখানে শরীক হতে পারে, হুযুর আলাইহিস সাল্লামের পবিত্র জীবন বৃত্তান্ত শোনার সুযোগ পায় এবং ইসলামের সৌন্দর্য দেখতে পায়। খোদায় তাওফিক দিলে মুসলমানও হয়ে যেতে পারে।
তৃতীয়তঃ এ ধরনের মাহফিল দ্বারা মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় মাসায়েল বর্ণনার সুযোগ পাওয়া যায়। কতেক গ্রাম্যলোকেরা জুমআর নামাযে আসে না। তাদেরকে ডাকলেও তারা সাড়া দেয় না। তবে হ্যাঁ, মীলাদ মাহফিলের নাম বললে বড় উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে সমবেত হয়ে যায়। স্বয়ং আমি এর অনেক পরীক্ষা করে দেখেছি। এসব মসজিদে ধর্মীয় মাসায়েল বর্ণনা করুন, তাদেরকে হিদায়েত করুন; এটি সুবর্ণ সুযোগ।
চতুর্থতঃ মীলাদ মাহফিলে এ ধরনের কবিতা-ই রচনা করে পাঠ করা হবে, যাতে দ্বীনি মাসায়েলের বিবরণ থাকে এবং মুসলমানদেরকে হিদায়েত করা হবে। কেননা গদ্যের তুলনায় পদ্য মানুষের মন বেশী আকর্ষণ করে এবং সহজেই স্বরণ থাকে।
পঞ্চমতঃ এসব মজলিসের মাধ্যমে শুনতে শুনতে মুসলমানগণ হুযুর আলাইহিস সালামের বংশ পরিচয়, সন্তান-সন্ততি, পবিত্র স্ত্রীগণ, জন্মবৃত্তান্ত, শৈশবাস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করবে। আজকাল মিরজায়ী, রাফেজী প্রমুখ সম্প্রদায়গণ নিজ নিজ সম্প্রদায় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখে। রাফেজী সম্প্রদায়ের শিশুদেরও বার ইমাম ও খুলাফায়ে রাশিদীনের নামের উপর অভিসম্পাত করার কথা স্বরণ থাকে। কিন্তু আহলে সুন্নাতের শিশুরা কেন, বৃদ্ধারা পর্যন্ত এ ব্যাপারে উদাসীন। আমি অনেক বৃদ্ধকে হুযুর আলাইহিস সালামের সন্তান-সন্তুতি কয়জন? জামাতা কত জন? ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করেছি। কিন্তু তাতে তাদেঁরকে অজ্ঞ পেয়েছি। যদি এসব মজুলসে এর পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে অনেক উপকারে আসবে।
গড়ে উঠা কোন জিনিসকে নষ্ট না করে বরং নষ্ট হয়ে যাওয়া কোন জিনিসকে ঠিক করার চেষ্টা করুন।
(১০) বিরুদ্ধাবাদীদের পীর ও মুর্শিদ হাজী ইমাদাদুল্লাহ সাহেব “ফয়সালা-এ হাপ্ত মাসায়েল” নামক পুস্তিকায় মীলাদ শরীফকে জায়েয ও বরকতময় বলেছেন, যেমন তিনি ঐ পুস্তিকায় উলেখ করেছেন-“অধমের নীতি হচ্ছে যে, আমি মাহফিলে মীলাদ শরীফে যোগদান করি। বরং বরকত লাভের উপায় মনে করে প্রতি বছর এর আয়োজন করি এবং কিয়ামে তৃপ্তি ও আনন্দ পাই। আর্শ্চযের বিষয়! পীর সাহেবতো মীলাদ শরীফকে বরকতময় মনে করে প্রতি বছর এর আয়োজন করেন; অথচ তাঁর বিশিষ্ট শিষ্যদের আকদিা হচ্ছে মীলাদ মাহফিল শিরক ও কুফরী। জানি না, পীর সাহেবের ক্ষেত্রে কোন্ ফত্ওয়া বর্তাবে?
(১১) আমি উরস শীর্ষক আলোচনায় আরয করবো যে ফিকাহশাস্ত্রবিদগণের মতে বিনা দলীলে হারাম তো দূরের কথা, মাকরূহ তানযীহও প্রমাণ করা যায় না। আর মুস্তাহাবের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে মুসলমানগণ একে ভাল মনে করেন। তাহলে যে কাজ শরীয়তে নিষিদ্ধ নয় এবং মুসলমানরা যেটা সদুদ্দেশ্যে করে থাকেন বা সাধারণ মুসলমানগণ যেটাকে ভাল মনে করেন, তা মুস্তাহাব। এর প্রমা বিদ্আতের আলোচনায় করা হয়েছে। অতএব, মীলাদ শরীফ প্রসংগে বলা যায় যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি নিষিদ্ধ নয়, মুসলমানরা এটাকে ছওয়অবের কাজ মনে করেন এবং সমুদ্দেশ্যে করেন। সুতরাং এটি মুস্তাহাব। হারাম আখ্যাদানকারীরা এর হারাম হওয়া সম্পর্কে কোন সূষ্পষ্ট দলীল কুরআন বা হাদীছ থেকে পেশ করতে পারবে কি? শুধু শুধু বিদ্আত বললে চলবে না।