বিষয় নং-৬: তিনটি কারণে আরবীকে ভালবাসবে:
“হাদীসের নামে জালিয়াতি” গ্রন্থের ৬৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেন “এই কথাকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস বানোয়াট ও মিথ্যা হাদিস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কেউ কেউ দ্বঈফ বা দুর্বল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সনদ বিচারে কথাটি বানোয়াট বলেই বুঝা যায়।”
এ হাদিসটির একাধিক সনদ রয়েছে, তাই ভিন্ন ভিন্ন সনদের হুকুমও ভিন্ন; তাই তিনি প্রত্যেকটি সনদের পর্যালোচনা না তুলে ধরে এভাবে জাল বলা হাদিসের খাদেম দাবী করে আমানতের খিয়ানতকারীই বলা চলে।
প্রথম সূত্র:
ইমাম তাবরানী (رحمة الله)সহ এক জামাত ইমামগণ সংকলন করেন-
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ الْحَضْرَمِيُّ قَالَ: ثَنَا الْعَلَاءُ بْنُ عَمْرٍو الْحَنَفِيُّ قَالَ: نَا يَحْيَى بْنُ بُرَيْدٍ الْأَشْعَرِيُّ، عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ، عَنْ عَطَاءٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَحِبُّوا الْعَرَبَ لِثَلَاثٍ: لِأَنِّي عَرَبِيٌّ، وَالْقُرْآنُ عَرَبِيٌّ، وَلِسَانُ أَهْلِ الْجَنَّةِ عَرَبِيٌّ
-‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে হতে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) বলেন, তিনটি কারণে আরবকে ভালবাসবে, আমি আরাবী, কুরআনের ভাষা আরবী এবং জান্নাতের ভাষা ভাষীও আরবী।’’ ২০
➥২০. হাকিম নিশাপুরী : আল-মুস্তাদরাক : ৪/৯৭-৯৮ পৃঃ হা/৬৯৯৯, তাবরানী : মু‘জামুল কাবীর : ১১/১৮৫ পৃঃ হা/১১৪৪১, বায়হাকী : শুয়াবুল ঈমান : ৩/৩৪ পৃঃ হাদিস.১৩৬৪ ও ৩/১৬০ পৃঃ হা/১৪৯৬, সুয়ূতি : লা-আলীল মাসনূআ : ১/৪৪২ পৃঃ সাখাভী : মাকাসিদুল হাসানা : ৪৫-৪৬ পৃঃ হা/৩১, আজলূনী : কাশফুল খাফা : ১/৪৮ : হা/১৩৩, সুয়ূতি : জামেউস সগীর : ১/৪০ পৃঃ হা/২২৫, তাবরানী : মু’জামুল আওসাত : ৫/৩৬৯পৃঃ হা/৫৫৮৩, ইমাম উকাইলী : আদ্-দ্বঈফাউল কাবীর : ৩/৩৪৮ পৃঃ ক্রমিক- ১৩৮০, হায়সামী : মাযমাউদ যাওয়ায়েদ : ১০/৫২ পৃঃ হা/১৬৬০০, মুত্তাকী হিন্দী : কানযুল উম্মাল : ১২/৪৪ পৃঃ হা/৩৩৯২২, ইবনে আসাকীর : তারীখে দামেস্ক : ১/২৩০ পৃঃ ও ১/৩৪ পৃঃ ইমাম মাকদেসী : সিফাতুল জান্নাত : ১/৭৯ পৃঃ আল্লামা ওয়াহেদী : আত-তাফসীরে ওয়াহেদী : ১/৮১ পৃঃ, শায়খ ইউসুফ নাবহানী, ফতহুল কাবীর, ১/৪৬ পৃঃ হা/৩৫০, যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ৫/৬৪৯ পৃঃ ক্রমিক-৩১৬, ইবনে হাজার আসকালানী, লিসানুল মিযান, ৫/৪৬৬ পৃঃ ক্রমিক- ৫২৮০, সুয়ূতি, জামেউল আহাদিসঃ ১/৪৪৭ পৃঃ হা/৭১৪, ইবনে জাওযী, আল-ইলালুল মুতানাহিয়্যাহ, ৬/৪২৬ পৃঃ হাদিস.২৬৪১, ও কিতাবুল মওদ্বুআত, ২/২৯২ পৃঃ ক্রমিক-৮৫৯, ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী, ছিফাতুল জান্নাত, ১/৬১ পৃঃ হা/১৩৪, ও ২/১১২ পৃঃ হা/২৬৮, ইমাম জুনায়েদ বাজলী দামেস্কী, ফাওয়াইদু তামাম, ১/৬১ পৃঃ হা/১৩৪
পর্যালোচনা:
এ সনদটি ‘হাসান’ তবে ইমাম হাকেম (رحمة الله) সহীহ বলায় তার সাথে কেউ কেউ একমতও পোষণ করেছেন। এ সনদে ‘আ‘লা ইবনে আমর আল-হানাফী’ নামক একজন রাবীকে আলবানীসহ অনেকে অত্যন্ত যঈফ বলে, এ হাদিসকে জাল বলে থাকেন। রাবী আ’লায়ী সম্পর্কে ঈমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) লিখেন-
ونقل الحاكم في تاريخ نيسابور عن صالح جزرة أنه سئل عنه فقال: لا بأس به.
-“ইমাম হাকেম তার তারিখে নিশাপুরীতে সালেহ ইবনে যাযারাহ (رحمة الله) থেকে বর্ণনা করেন, তাকে রাবী আ‘লায়ী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি তার উত্তরে বলেন, তার হাদিস গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই।” ২১
➥২১. ইমাম আসকালানী, লিসানুল মিযান, ৫/৪৬৬ পৃঃ ক্রমিক- ৫২৮০
ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি তাদের প্রতিবাদে লিখেন-
وَقَالَ الْحَافِظ ابْن حجر فِي اللِّسَان: الْعَلَاء ذكره ابْن حبَان فِي الثِّقَات وَقَالَ صالِح جزرة لَا بَأْس بِهِ.
-‘‘ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) তার লিসানুল মিযান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তাকে সিকাহ রাবীর তালিকায় স্থান দিয়েছেন এবং সালেহ জাযরাহ (رحمة الله) বলেন, তার হাদিস গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই।’’ ২২
➥২২. ইমাম সুয়ূতি, লা আলিল মাসনূআ, ১/৪০৪ পৃঃ কিতাবুল মানাকিব এবং ইবনে হাজার আসকালানী, লিসানুল মিযান, ৫/৪৬৬ পৃঃ ক্রমিক ৫২৮০, ইমাম ইবনে হিব্বান, কিতাবুস্-সিকাত, ৮/৫০৪ পৃঃ ক্রমিক ১৪৬৮৮.
ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তিনি ইমাম আবু হাতেমের বরাতে লিখেছেন এটি তার মিথ্যা হাদিস। অথচ ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন-
وَقَالَ أَبُو حاتِم: كتبت عَنهُ مَا أعلمُ إِلَّا خيرا
-“ইমাম আবু হাতেম (رحمة الله) বলেন, আমি তার হাদিস লিপিবদ্ধ করেছি, আমি তাকে ভাল ছাড়া কিছুই জানি না।” ২৩
➥২৩. ইমাম সুয়ূতি, লা আলিল মাসনূআ, ১/৪০৪ পৃঃ কিতাবুল মানাকিব এবং আবু হাতেম, জারহু ওয়া তা’আদীল, ৬/৩৫৯ পৃঃ ক্রমিক ১৯৮৩, ইমাম আসকালানী, লিসানুল মিযান, ৫/৪৬৬ পৃঃ ক্রমিক- ৫২৮০
তাই এই হাদিসকে জাল বলা মানে অসংখ্য গ্রহণযোগ্য ইমামদের রায়কে এবং গবেষণাকে হেয় করা। এমনকি আহলে হাদিসদের ইমাম শাওকানী এ সনদটি আলোচনা করে লিখেছেন-
وَلَهُ شَاهِدٌ رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ فِي الأَوْسَطِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ
-‘‘এ হাদিসটির (যদিও সনদে সামান্য দুর্বলতা বিদ্যমান তবে) শাওয়াহেদ রয়েছে, যা ইমাম তাবরানী (رحمة الله) তার মু‘জামুল আওসাতে হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন।’’ (শাওকানী, ফাওয়াইদুল মাজমূআ, ৪১৩ পৃ. হা/১৭৩)
তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, এ সূত্রে সামান্য দুর্বলতা থাকলেও অন্য সূত্রে তাকে শক্তিশালী করেছে।
দ্বিতীয় সূত্র:
এ ব্যাপারে আরও একটি সনদের হাদিস পাওয়া যায়, ইমাম হাকেম ও তাবরানী (رحمة الله) সংকলন করেন-
حَدَّثَنَا مَسْعَدَةُ بْنُ سَعْدٍ، نَا إِبْرَاهِيمُ بْنُ الْمُنْذِرِ، نَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ عِمْرَانَ، ثَنَا شِبْلُ بْنُ الْعَلَاءِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَنَا عَرَبِيٌّ، وَالْقُرْآنُ عَرَبِيٌّ، وَلِسَانُ أَهْلِ الْجَنَّةِ عَرَبِيٌّ
-‘‘হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, আমি আরাবি ভাষী, কুরআন আরবী ভাষায় এবং জান্নাতের ভাষাও আরবী হবে।’’ ২৪
➥২৪. ইমাম তাবরানী : মু‘জামুল আওসাত : ৯/৬৯ পৃঃ: হা/৯১৪৭, হাইসামী, মাযমাউয যাওয়াইদ, ১০/৫৩পৃঃ হাদিস, ১৬৬০৩
সনদ পর্যালোচনা:
ইমাম সুয়ূতি দ্বিতীয় সূত্র সম্পর্কে লিখেছেন-
والْحَدِيث أخرجه الطَّبَرَانِيّ وَالْحَاكِم فِي الْمُسْتَدْرك وَصَححهُ وَالْبَيْهَقِيّ فِي شعب الْإيِمَان
-“ইমাম তাবরানী, হাকেম তার আল-মুস্তাদরাকে সহীহ সনদে বায়হাকী তার শুয়াবুল ঈমানে সংকলন করেন।’’২৫
➥২৫. ইমাম সুয়ূতি, লা আলিল মাসনূ, ১/৪০৪ পৃঃ কিতাবুল মানাকিব
এমনটি ইমাম ইরাকী (رحمة الله) ও বলেছেন। (ইবনে ইরাকী, তানজিহুশ-শরিয়াহ, ২/৩০ পৃ.)
আল্লামা আব্দুর রহমান ইবনে ইরাকী কেনানী (ওফাত ৯৬৩ হি.) উল্লেখ করেন-
(قُلْتُ) قَالَ الْحَافِظُ الْعِرَاقِيُّ فِي مَحَجَّةِ الْقُرْبِ: حَدِيثُ أَبِي هُرَيْرَةَ أَصَحُّ مِنْ حَدِيثِ ابْنِ عَبَّاسٍ وَشِبْلُ بْنُ الْعَلاءِ احْتَجَّ بِهِ ابْنُ حِبَّانَ فِي صَحِيحِهِ وَقَالَ إِنَّهُ مُسْتَقِيمُ الأَمْرِ فِي الْحَدِيثِ
-“আমি বলি, হাফেজুল হাদিস ইরাকী (رحمة الله) তার “মুহাজ্জাতিল কুরব” গ্রন্থে বলেন, ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) এর হাদিস সহীহ। শিবল ইবনু আ’লা (আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) এর সনদের রাবী)
হাদিস দ্বারা সহীহ ইবনে হিব্বান দলিল গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন তার হাদিস সঠিক।” ২৬
➥২৬. ইবনুল র্আরাক, তানজিহুশ-শরিয়াহ, ২/৩১ পৃঃ
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) তার জীবনীতে লিখেছেন-
وذَكَره ابن حِبَّان في الثقات
-“ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তাকে সিকাহ রাবীর তালিকায় তাকে স্থান দিয়েছেন।’’ ২৭
➥২৭. ইবনে হাজার, লিসানুল মিযান, ৫/২৩০ পৃঃ ক্রমিক- ৩৭৬০ এবংং ইবনে হিব্বান, আস্-সিকাত, ৬/৪৫২ পৃঃ ক্রমিক- ৮৫৫০
তাই আমরাও দুটি সূত্রের দুই জন রাবীকে নিয়ে যে বিভ্রান্ত করছেন তাদের দুজনই মোটামুটি গ্রহণযোগ্য।
ইমাম হাকিম নিশাপুরী (رحمة الله) হাদিসটির তিনি নিজেই দুটি সনদ বর্ণনা করেছেন, দুটিকেই তিনি সহীহ বলেছেন। নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, হাফেযুল হাদিস, ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতি (رحمة الله) সঠিক সমাধান দেন যে- هذا حديث صحيح -‘উক্ত হাদিসটি সহীহ।’ (ইমাম সুয়ূতি : জামেউস সগীর : ১/৪০ পৃ. হা/২২৫)
তাই আমরা কি ইমাম সুয়ূতির মত মুজাদ্দেদের রায় মানবো? নাকি ঘড়ি মেকানিক আহলে হাদিস আলবানীর! যে উক্ত হাদিসটি সরাসরি তার ‘সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দ্বঈফাহ’ গ্রন্থে জাল বলেছেন। (আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দ্বঈফাহ, ১/২৯৩ পৃষ্ঠা, হা/৩৬০)
তবে ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক (ওফাত. ১৮১ হি.) তার হাদিস গ্রন্থে সংকলন করেন-
أنا سَعِيدُ بْنُ أَبِي أَيُّوبَ قَالَ: حَدَّثَنِي عُقَيْلٌ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ قَالَ: لِسَانُ أَهْلِ الْجَنَّةِ عَرَبِيٌّ
-‘‘বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম শিহাব জুহুরী (رحمة الله) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেন, জান্নাতের ভাষা হলো আরবী।’’ (ইবনে মোবারক, কিতাবুয-যুহুদ, ২/৭১ পৃ.) এটির সনদ সহীহ, কিন্তু মুরসাল।