প্রথম অধ্যায়:
উসূলে হাদিসের গূরুত্বপূর্ণ কতিপয় মূলনীতি:
বিষয় নং-০১. বর্তমান আহলে হাদিসদের দৃষ্টিতে দ্বঈফ হাদিস বলতে কী বুঝায়?
বর্তমান আহলে হাদিস তথা সালাফিদের নিকট দ্বঈফ হাদিস হলো এক প্রকার জাল হাদিস হিসেবে গণ্য, যেমনটি আলবানীর অনেক পুস্তকে দৃষ্টি দিলে তা অনুধাবন করা যায়। ১
➥১. এ ব্যাপারে আপনাদের হাতের নাগালে একটি পুস্তুক পাবেন, বইটির মূল হলো লিখক শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী যার অনুবাদ ও সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশের তথাকথিত আহলে হাদিস আবুল কালাম আযাদ। পুস্তকটির বাংলা নামকরণ করা হয়েছে ‘‘ছহীহ হাদীছের পরিচয় ও হাদীছ বর্ণনার মূলনীতি’’ যা আযাদ বুক ডিপু, ১৯, শাহী জামে মসজিদ মার্কেট, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম হতে প্রকাশিত। এ বিষয়ে বইটির ২৩ পৃ.২৫ পৃ ২৭ পৃ. দেখতে পারেন।
আহলে হাদিস শায়খ কামাল আহমদ তার লিখিত ‘যঈফ হাদীস কেন বর্জনীয়?’ (যা ওয়াহীদিয়া ইসলামিয়া লাইব্রেরী, রাণীবাজার, রাজশাহী, বাংলাদেশ হতে প্রকাশিত) গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটি নিয়েই আলোকপাত করেছেন। আরেক আহলে হাদিস মুযাফফর বিন মুহসিন তার লিখিত ‘যঈফ ও জাল হাদীছ বর্জনের মূলনীতি’ গ্রন্থে সকল মুহাদ্দিসীনে কিরামের নীতিমালাকে উপেক্ষা করে ৩৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘‘যার প্রতি (যঈফ হাদিসের উপর) আমল করা ঐকমত্যের ভিত্তিতে নাজায়েয।’’
তিনি যঈফ আর জাল হাদিসের হুকুমকে এক সাথে মিলিয়ে ৩৫ পৃষ্ঠায় লিখেন-‘‘অতএব শারঈ মানদণ্ডে জাল হাদীছ তো নয়ই, যঈফ হাদীছও গ্রহণযোগ্য নয়।’’
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! সকল মুহাদ্দেসীেেন কেরাম একমত যে, দ্বঈফ সনদের হাদিসও হাদিসের এক প্রকারের অর্ন্তভুক্ত; সনদের রাবির আদালতের ক্ষেত্রে সহীহ, হাসান, দ্বঈফ হয়ে থাকে। কিন্তু আলবানী ও তার উত্তরসূরীরা সকল ইমাম ও মুহাদ্দীসিনে কেরামের নীতিমালাকে উপেক্ষা করে, তারাই এক উসূলে হাদিসের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। অথচ আজ এ আহলে হাদিসগণ পৃথিবীর সমস্ত মুহাদ্দিসদের ইজমার বিপরীতে কথা বলছেন।
❏ এ বিষয়ে বিখ্যাত হাফেযুল হাদিস, ফকীহ, ইমাম নববী আশ-শাফেয়ী (رحمة الله) বলেন-
قد اتفق العلماء على جواز العمل بالحديث الضعيف فى فضائل الاعمال:مقدمة المؤلف
-‘‘উলামায়ে কিরাম এই বিষয়ে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন দুর্বল হাদিস ফাযায়েলে আমলের জন্য গ্রহণযোগ্য।’’ ২
➥২. ইমাম নববী : আরবাঈন : ১/২০ পৃ. এবং ইমাম ইবনে দাকিকুল ঈদ, শরহে আরবাঈনুন নববিয়্যাহ, ১/২০ পৃ.
❏ বিশ্ববিখ্যাত মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ফকিহ, আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী হানাফী (رحمة الله) ‘তাফসীরে রুহুল বায়ানে’ লিখেন-
لكن المحدثين اتفقوا على ان الحديث الضعيف يجوز العمل به فى الترغيب والترهيب
-‘‘তবে মুহাদ্দিসীনে কিরাম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, আকর্ষণ সৃষ্টি ও ভীতি সঞ্চারের বেলায় দ্বঈফ হাদিস অনুযায়ী আমল করা যায়েয।’’ ৩
➥৩. আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী : তাফসিরে রুহুল বায়ান, ২/৪১০ পৃ.
❏ এ বিষয়ে বিখ্যাত মুহাদ্দিস, ফকীহ, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (رحمة الله) লিখেন,
وَالضَّعِيفُ يُعْمَلُ بِهِ فِي فَضَائِلِ الْأَعْمَالِ اتِّفَاقًا
-‘‘দ্বঈফ হাদিস ফাযায়েলে আমলের মধ্যে আমল করার ব্যাপারে ইমামগণের ঐকমত্য হইয়াছে।’’ ৪
➥৪. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মওজু আতুল কাবীর : ১/৩১৫ পৃ. হা/৪৩৩
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! উপরের তিনজন নির্ভরযোগ্য আলেমের অভিমত থেকে জানতে পারলাম যঈফ হাদিস ফাযায়েলে আমলের জন্য গ্রহণযোগ্য সে বিষয়ে হাদিস বিজ্ঞানীদের ইজমা হয়েছে, তাহলে এ নীতি অমান্য করে আহলে হাদিসরা কি তাদের অর্ন্তভুক্ত হবেন!
কিন্তু আহলে হাদিস আলবানী সকল মুহাদ্দিসের ইজমার বিরোদ্ধে অবস্থান নিয়ে লিখেন-‘‘অনেকে এরূপ ধারণা পোষণ করেন যে, ফাযায়েলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীসের উপর আমল করা যাবে এ মর্মে কোনো মতভেদ নেই। বাস্তবিক পক্ষে তা সঠিক নয়।’’ (আলবানী, য‘ঈফ ও জাল হাদীছ সিরিজ, ১ম খণ্ড, ৫০ পৃ. তাওহীদ পাবলিকেশন্স, বংশাল, ঢাকা-১১০০)
পাঠকদের কাছেই বিচারের সিদ্ধান্ত অর্পন করা হলো, আপনারা কাকে মানবেন, আলবানীকে না ইমাম নববী (رحمة الله)সহ পৃথিবী বিখ্যাত ইমামদের!
অপরদিকে দ্বঈফ হাদিস যখন একাধিক সনদে বর্ণিত হবে তা আর দ্বঈফ থাকে না। মুহাদ্দিসীনে কিরামের এ নীতিমালাটি আহলে হাদিস স¤প্রদায় নিজেদের মতের পক্ষে যখন একটি দ্বঈফ সনদের হাদিসও আসবে তখন এটিকে ‘হাসান’ বলতে একটুও চিন্তা করে না, আর নিজেদের মত ও পথের বিরোদ্ধে যখন একাধিক সনদ নয় বরং ১৭ জন সাহাবি বর্ণনা করলেও তা তাদের নিকট দ্বঈফ সনদই থেকে যায়! ৫
➥৫. এ বিষয়ে আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বেরলবী (رحمة الله) এর সংকলিত ‘ফতোওয়ায়ে আফ্রিকায়’ রাসূল (ﷺ) আবূ বকর, উমর একই মাটির সৃষ্টির হাদিসের আলোচনায় দেখতে পাবেন যে একটি জাল হাদিসকেও ড. আবদুল্লাহ জাঙ্গীর তার ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ বইয়ের ৩৪৮ পৃষ্ঠায় আলবানীর দলিলের ভিত্তিতে ‘হাসান’ বলতে একটুও চিন্তা বা দ্বিধাবোধ করেননি। আবার আহলে হাদিস শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী আলেমের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র ও যে সূরা ইখলাস তিনবার পড়বে সে যেন সর্ম্পন্ন কুরআন পড়লো এবং ‘তোমরা মু‘মিনের অন্তর দৃষ্টিকে ভয় কর, কেননা তারা আল্লাহর নূর দ্বারা দেখে’ এ হাদিসটি দ্বারা ওলীদের কাশ্ফ প্রমাণিত হয় বিধায় মোট দশজনেরও বেশী সাহাবি হতে বর্ণিত হওয়ার হওয়ার পরেও হাদিসটিকে সে দ্বঈফ বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। অনূরুপ বহু উদাহারণ আমার এ পুস্তুকে পাবেন এবং আলবানীর এ সমস্ত বাতিল মতবাদ এবং ভুয়া তাহকীকের জবাব জানতে আমার ‘আলবানীর স্বরূপ উন্মোচন’ পড়ুন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, আলবানী ও তার উত্তরসূরীদের নিকট কোনো সনদের একজন রাবী মাজহুল (অপরিচিত) থাকলে তখন সেটিকে মাওদ্বু বা জাল হাদিস বলতে দ্বিধাবোধ করেন না। আমার বিভিন্ন পুস্তুকের অনেক স্থানে আলবানী ও তার অনুসারীদের এ মনগড়া নীতির খণ্ডন করেছি, এ কিতাবের বিভিন্ন স্থানেও আলবানীর এ ভুল নীতিমালার জবাব পাবেন, ইন শা আল্লাহ!