ফাতিহা, কুলখানী, চেহলাম ইত্যাদির বর্ণনা
এ আলোচনায় একটি ভুমিকা ও দু’টি অ্যধ্যায় রয়েছে।
ভূমিকা
দৈহিক ও আর্থিক ইবাদতের ছওয়াব অন্য মুসলমানকে দান করা জায়েজ এবং এটা ফলপ্রসূও হয়। কুরআন-হাদীছ ও ফকীহগণের উক্তি থেকে এর প্রমাণ মিলে। কুরআন কারীম মুসলমানদেরকে একে অপরের জন্য দুআ করার নির্দেশ দিয়েছেন। জানাযার নামায এজন্যই আদায় করা হয়।
❏ মিশকাত بَاب فضل الصَّدَقَة শীর্ষক অধ্যায়ে আছে, হযরত সাআদ (رضي الله عنه) একটি কুপ খনন করে বলেছিলেন-
وَقَالَ: هَذِهِ لِأُمِّ سَعْدٍ
-‘‘সাআদের মায়ের নামে উৎসর্গিত হল।’’ ৯৬
➥{ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ২/১৩০ পৃঃ হা/১৬৮১, পরিচ্ছেদ: بَابٌ فِي فَضْلِ سَقْيِ الْمَاءِ , খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ১/৫৯৭ পৃঃ হা/১৯১২, সুনানে আবি দাউদের এ হাদিসের তাহকীকে আলবানী এটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। তবে আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) তার মেরকাতে এ হাদিসটির আরেকটি সূত্র উল্লেখ করেছেন। (মেরকাত, ৪/১৩৪২ পৃঃ হা/১৯১২ এর আলোচনায়) }
ফকীহগণও ঈসালে ছওয়অবের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে দৈহিক ইবাদতের ইবাদতের ক্ষেত্রে পরনির্ভশীলতা নাজায়েয। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি অপরের বদলে নামায পড়লে, নামায আদায় হবে না। অবশ্য নামাযের সওয়াব দান করা যেতে পারে।
❏ মিশকাত শরীফে بَاب الْمَلَاحِم এর দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বর্ণিত আছে-হযরত আবু হুরাইরা (رضي الله عنه) কাউকে বলেছিলেন-
مَنْ يَضْمَنُ لِي مِنْكُمْ أَنْ يُصَلِّيَ لِي فِي مَسْجِدِ الْعَشَّارِ رَكْعَتَيْنِ، أَوْ أَرْبَعًا، وَيَقُولَ هَذِهِ لِأَبِي هُرَيْرَةَ.
-‘‘আমার পক্ষ হয়ে মসজিদে-আশারে দুঃরাকআত নামায পড়ার দায়িত্ব আপনাদের মধ্যে কে নিবেন? এবং বললেন এর সাওয়াব আবু হুরাইরার নামে উৎসর্গিত?।’’ ৯৭
➥{টিকাঃ
ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, ১/১১৩ পৃঃ হা/৪৩০৮, খতিব তিবরিযি, মিশকাত, ৩/১৪৯৬ পৃঃ হা/৫৪৩৪,
☞এ হাদিসটির সনদকে আলবানী যঈফ বলেছেন। সে এর কারণ হিসেবে এ সনদের রাবী (إبراهيم بن صالح بن درهم) কে দায়ী করেছেন।
☞অথচ ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তাকে সিকাহ রাবীর তালিকায় স্থান দিয়েছেন। (ইমাম ইবনে হিব্বান, কিতাবুস সিকাত, ৬/১৫ পৃঃ ক্রমিক- ৬৫২৯, আল্লামা মুগলতাঈ, ইকমালু তাহযিবুল কামাল, ১/২১৯ পৃঃ ক্রমিক- ২২৫, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, তাহযিবুত তাহযিব, ১/১২৮ পৃঃ ক্রমিক- ২২৮)
☞তাই এ হাদিসকে যঈফ বলার কোন কারণ নেই।}
এর থেকে তিনটি মাসায়েল জানা গেল-
এক: দৈহিক ইবাদত অর্থাৎ নামাযও কারো ঈসালে ছওয়াবের নিয়তে আদায় করা জায়েয,
দুই: মুখে উচ্চারণ করে ঈসালে সাওয়াব করা অর্থাৎ ‘হে খোদা, এর ছওয়াব অমুককে দান করুন’ এরকম মৌখিকভাবে বলা অনেক উত্তম।
তিন: বরকতের উদ্দেশ্যে বুযুর্গানে দীনের মসজিদ সমূহে নামায আদায়ে বিশেষ ছওয়াব রয়েছে।
আর্থিক ইবাদত বা আর্থিক ও দৈহিক সমন্বিত ইবাদত, যেমন যাকাত ও হজ্জ্বের ক্ষেত্রে যদি কেউ বলে, তুমি আমার পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দাও। তাহলে সে দিয়ে দিতে পারে, আর যদি আর্থিক সামর্থ্যবান ব্যক্তির কাছে হজ্জ্বের কার্যাদি সমাধা করার শক্তি না থাকে, তাহলে অন্যের দ্বারা বদলী হজ্জ্ব করা যায়। প্রত্যেক ইবাদতের ছওয়াব নিশ্চয় পৌঁছে থাকে। যদি আমি কাউকে স্বীয় সম্পদ দিয়ে দেই, তাহলে সে মালিক হয়ে যাবে। এটাও তদ্রুপ। অবশ্য সম্পদ কাউকে দিয়ে দিলে এতে নিজের কোন স্বত্ব বাকী থাকে না আর কয়েকজনকে দিলে তা ওদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। কিন্তু ছওয়াব যদি সবাইকে বকশিশ করা হয়, তাহলে সবাই পরিপূর্ণরূপে পায় এবং প্রদানকারী নিজেও বঞ্চিত হয় না। যেমন-অন্যদেরকে কুরআন পড়ানো হলো; ওরা সবাই কুরআন পড়তে শিখল, এতে শিক্ষাদাতার জ্ঞান খর্ব হলো না।
❏ এ প্রসংগে ফত্ওয়ায়ে শামীর প্রথম খন্ড دفن ميت শীর্ষক আলোচনাটুকু দেখুন। শিশুদের থেকে উপহার গ্রহণ নিষেধ, কিন্তু ছওয়াব গ্রহণ করা জায়েয। কতেক লোক বলেন যে ছওয়াব কারো কাছে পৌছে না; কেননা কুরআন করীমে উলেখিত আছে-
لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ
-‘‘প্রত্যেকের জন্য সেটাই কল্যানকর বা ক্ষতিকর, যা সে নিজেই করেছে।’’ ৯৮
➥{সূূরা বাক্বারা, আয়াত নং-২৮৬}
❏ কুরআন করীমে আরো উলেখিত আছে-
لَيْسَ لِلْإِنْسانِ إِلاَّ مَا سَعى
-‘‘মানুষের জন্য অন্য কিছু নেই, কিন্তু ওটা, যা নিজে আহরণ করে।’’ ৯৯
➥{সূরা নাজম, আয়াত নং-৩৯}
এতে বোঝা গেল অপরের কাছে নিজের কোন লাভ নেই। কিন্তু এ ধারণাটা ভুল। কেননা لِلْإِنْسانِ এর এ لام (লাম) অব্যয়টা মূলধন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ মানুষের জন্য নির্ভযোগ্য বিষয় ও মুলধন হচ্ছে নিজেরই আমলসমূহ। কেউ ঈসালে ছওয়াব করুক বা না করুক, এ আশায় যেন কেউ স্বীয় আমল থেকে উদাসীন না থাকে। (তাফসীরে খাযায়েনুল ইরফান, ইত্যাদি দ্রষ্টব্য) অথবা এ হুকুমটা হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) ও হযরত মূসা (عليه السلام) এর কাছে প্রদত্ত সহীফা সমূহের ছিল, কিন্তু ইসলামের নয়; এখানে সেটা উদ্ধৃতি করা হয়েছে মাত্র। বা উপরোক্ত আয়াতটা এ আয়অত দ্বারা মানসুখ বা রহিত হয়েছে -
وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمانٍ
-‘‘ঈমানের ক্ষেত্রে তাঁদের সন্তান-সন্তুতিরা তাঁদের অনুসরণ করে।’’ ১০০
➥{সূরা তুর, আয়াত নং- ২১}
এটাই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের বক্তব্য। এজন্য মুসলমানের শিশুরা মা বাপের বদৌলতে বেহেশতে যাবে, এবং আমল ছাড়া পদমর্যাদা লাভ করবে। (তাফসীরে জুমুল ও খাযেন দেখুন) বা এ আয়াত দ্বারা দৈহিক আমল সমূহের ব্যাপারে অন্যের উপর ভারাপর্ণকে নাকচ করা হয়েছে। এ কারণেই ওই আয়াতদ্বয়ের كَسَبَ (সঞ্চয়) ও سَعى (প্রচেষ্টা)-এর উলেখ আছে কিন্তু ঈসালে ছওয়াবের উলেখ নাই বা আয়াতদ্বয়ে ন্যায় বিচারের কথা বলা হয়েছে এবং ওটা হচ্ছে ফযীলত। মোট কথা, এর অনেক বিশ্লেষণ রয়েছে।
ফাতিহা, কুলখানী, দশভী, চেহলাম ইত্যাদি সেই ঈসালে ছওয়াবের বিভিন্ন আনুসাংগিক বিষয়মাত্র। ফাতিহাখানিতে কুরআন তিলওয়াত যা দৈহিক ইবাদত এবং সাদ্কা যা আর্থিক ইবাদত। উভয় ইবাদত একত্রিত করে ছওয়াব পৌঁছানো হয়।