বিষয় নং-১০: রাসূল (ﷺ)‘র চেহরা আনওয়ারের আলোতে অন্ধকার আলোকিত হওয়া:
জনাব মাওলানা মুতীউর রহমান তার ‘এসব হাদীস নয়’ লিখিত কিতাবের ১৬৩ পৃষ্ঠায় উপরের হাদিসকে মিথ্যা প্রমাণ করতে না পেরে সহীহ বুখারীর একটি হাদিসকে অপব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, ‘‘বোঝা গেল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপস্থিতিতেও বাহ্য-আঁধার দূর হওয়ার জন্য দৃশ্য-নূরের (আলোর) প্রয়োজন হত।’’
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! উপরের এ বক্তব্যে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, অন্ধকারে রাসূল (ﷺ)-এর সামনে আলো না থাকলে তিনি এবং তার আশে-পাশের লোকেরা কিছুই দেখতে পেতেন না। বাস্তবতা কি তাই!
এখন কোনো অনর্থক কথা নয়, এ বিষয়ের সমর্থনে অর্থাৎ রাসূল (ﷺ) এর চেহরা মোবারক হতে নূর বা আলো প্রকাশিত হতো এ প্রসঙ্গে কতিপয় হাদিসে পাক উল্লেখ করবো, ইনশা আল্লাহ।
❏ অনেক হাদিসের ইমামগণ সংকলন করেন-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: وَلَا رَأَيْتُ شَيْئًا أَحْسَنَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ كَأَنَّ الشَّمْسَ تَجْرِي فِي وَجْهِهِ، وَمَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَسْرَعَ فِي مِشْيَتِهِ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَأَنَّمَا الْأَرْضُ تُطْوَى لَهُ إِنَّا لَنُجْهِدُ أَنْفُسَنَا وَإِنَّهُ لَغَيْرُ مُكْتَرِثٍ
-‘‘হযরত আবু হুরায়রা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল (ﷺ) এর চেয়ে অধিক সুশ্রী ও সুন্দর কাউকে দেখিনি। মনে হতো যেমন মুখমন্ডল থেকে কিরণ বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আমি তাঁর চেয়ে অধিক দ্রুতগতি সম্পন্নও কাউকে দেখিনি। তিনি যখন হাটতেন তখন মনে হত যেন মাটি তাঁর পিছনের দিকে সরে যাচ্ছে (অর্থাৎ খুব দ্রুত গতিতে পথ অতিক্রান্ত হচ্ছে) আমরা তার সঙ্গে হাটলে যথেষ্ট লাফাতে বা দৌঁড়াতে হতো। অথচ তিনি বেশ ধীরে হাটতেন বলে মনে হতো।’’ ১৪৩
১৪৩.
(ক) ইমাম তিরমিযী : আস-সুনান: অধ্যায় কিতাবুল মানাকিব : ৫/৬০৪ পৃ. হা/৩৬৪৮
(খ) ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি: খাসায়েসুল কোবরা : ১/১৩২পৃ. হাদিস ৩৭৬
(গ) ইমাম বায়হাকী: দালায়েলুন নবুওয়াত : ১/২৩৮ পৃ.
(ঘ) ইমাম ইবনে সাদ: আত্-তবকাতুল কোবরা: ১/২৮৭ পৃ.ও ১/৩১৮ পৃ.ও ১/৩১৯ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন
(ঙ) তিরমিযি, শামায়েলে মুহাম্মাদিয়া, ১/৮৬পৃ. হাদিস, ১১৬, দারুল ইহইয়াউত তুরাস আল-আরাবী, বয়রুত, লেবানন
(চ) ইমাম আবু শায়খ ইস্পাহানী, আখলাকুন্নাবী, ৪/৬২ পৃ. হাদিস, ৭৮৬
(ছ) ইমাম বগভী, আল-আনওয়ার ফি শামায়েলুল নাবিয়্যিল মুখতার, ১/৩৫২ পৃ. হাদিস, ৪৬২
(জ) কাযি আয়াজ মালেকী, শিফা শরীফ, ১/১৪৯ পৃ.
(ঝ) কাস্তাল্লানী, মাওয়াহেবে ল্লাদুন্নীয়া, ২/৬ পৃ.
(ঞ) ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ, ২/৩৫০ পৃ. ও ৩৮০ পৃ.(ঠ) ইমাম ইবনে হিব্বান, হাদিস, ৬৩০৯
(ঠ) ইমাম ইবনে সালেহ শামী, সবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২/৬ পৃ.
(ড) মোবারকপুরী, আর-রাহিকুল মাখতুম, ১/৪৪২ পৃ. দারুল , হিলাল, বয়রুত, লেবানন।
সনদ গ্রহণযোগ্যতা:
এ হাদিসটির মোট দু‘টি সূত্রে বর্ণিত আছে। কিছু নরকের কিটরা একটি সূত্র বর্ণনা করে অপর আরেকটি গোপন করে।
● তারা ইমাম তিরমিযির যে সূত্রটির দোহাই দেয় তা হলো-
حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ قَالَ: حَدَّثَنَا ابْنُ لَهِيعَةَ، عَنْ أَبِي يُونُسَ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ
-‘‘এ সনদে ‘ইবনে লাহি‘আহ’ (ওফাত.১৭৪হি.) কিছুটা নরম প্রকৃতির রাবী।’’ ১৪৪
১৪৪. তিরমিযি, শামায়েলে মুহাম্মাদিয়া, ১/৮৬পৃ. হাদিস, ১১৬, দারুল ইহ্ইয়াউত তুরাস আল-আরাবী, বয়রুত, লেবানন।
তাই তাদের দাবি হলো সনদটি দুর্বল। প্রথমত. আমি বলবো এ রাবীর হাদিসের মান ‘হাসান’ পর্যায়ের, সে বিষয়ে সামনে শবেই বরাতের ৭নং হাদিস পর্যালোচনায় বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত. আমি বলবো, এ সনদের অন্যতম রাবি তাবেয়ী আবি ইউনূস এর ছাত্রের মধ্যে ‘ইবনে লাহি‘আহ’ ছাড়াও অন্যরাও হাদিসটি তাঁর থেকে শ্রবণ করেছেন। যেমনঃ
● ইমাম বায়হাকী সংকলন করেছেন সে সনদটি হলো-
رِشْدِينُ بْنُ سَعْدٍ، قَالَ: أَخْبَرَنِي عَمْرُو بْنُ الْحَارِثِ، عَنْ أَبِي يُونُسَ، مَوْلَى أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ،
-‘‘এ সনদে ইবনে লাহি‘আহ রাবীর পরিবর্তে রাবি ‘আমর বিন হারেস রয়েছেন; আর তিনি সিকাহ রাবি তাতে কোন সন্দেহ নেই।’’ ১৪৫
১৪৫.
(ক) বায়হাকী, দালায়েলুল নবুয়ত, , ১/২০৯ পৃ., দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন
(খ) মুকরিজী, ইমতাউল আসমা, ২/১৫৬ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন
(গ) জালালুদ্দীন সুয়ূতি, খাসায়েসুল কোবরা, ১/১২৩ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।
❏ ইমাম বুখারী (رحمة الله)সহ অনেকে সংকলন করেন-
عن كَعْبَ بْنَ مَالِكٍ قَالَ: وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ إِذَا سُرَّ اسْتَنَارَ وَجْهُهُ، حَتَّى كَأَنَّهُ قِطْعَةُ قَمَرٍ، وَكُنَّا نَعْرِفُ ذَلِكَ مِنْهُ
-‘‘হযরত কাব বিন মালেক (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন আনন্দিত হতেন তখন মুখমন্ডল এমন উজ্জল হয়ে যেত, যেন এক খণ্ড চাঁদের চেয়েও সুন্দর। তাঁর এ অভ্যাস সম্পর্কে আমাদের সবারই জানা ছিল।’’ ১৪৬
১৪৬. ইমাম বুখারী : আস-সহীহ : ৪/১৮৯পৃ. হা/৩৫৫৬, ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি : খাসায়েসুল কুবরা : ১/১৩১ পৃ. হা/৩৬৯
❏ সাহাবীদের মধ্যে বিশ্ব বিখ্যাত কবি, হযরত হাস্সান বিন সাবিত (رضي الله عنه) রাসূল (ﷺ) এর সামনে কাসীদার মাধ্যমে এভাবে তাঁর প্রশংসা করেন-
مَتَى يَبْدُ فِي الدَّاجِ الْبَهِيمِ جَبِينُهُ ۞ يَلُحْ مِثْلَ مِصْبَاحِ الدُّجَى الْمُتَوَقِّدِ
-‘‘যখন অন্ধকার রাত্রে তার কপাল প্রকাশিত হতো, তখন অন্ধকার উজ্জ্বল প্রদীপের মত আলোকিত হয়ে উঠতো।’’১৪৭
১৪৭. ইমাম জুরকানী : শরহুল মাওয়াহেব: ৫/২৭৮ পৃ. (খ) বায়হাকী, দালায়েলুল নবুয়ত, ১/২৯৮ পৃ. (গ) মুকরিজী, ইমতাউল আসমা, ২/১৪৯ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন (ঘ) ইবনে সালেহ শামী, সবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ২/২১ পৃ. ও ১২/২৮৮ পৃ.
সর্বশেষ এ বিষয়ে একটি হাদিসে পাক উল্লেখ করবো।
❏ ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) সংকলন করেন-
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍؓ ، قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ ﷺ يَرَى بِاللَّيْلِ فِي الظُّلْمَةِ كَمَا يَرَى بِالنَّهَارِ مِنَ الضَّوْءِ
-‘‘হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) রাতের অন্ধকারে তেমন দেখতেন যেমনটি দিনের উজ্জ্বল আলোতে দেখতে পেতেন।’’ (ইমাম বায়হাকী, দালায়েলুন নবুয়ত, ৬/৭৫ পৃ.)
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! মহান রব তা‘য়ালা আমাদেরকে এ সমস্ত সত্য গোপনকারীদের থেকে হেফাযত করুন, আমিন।