বিষয় নং-০২: ‘যার কোন পীর নেই তার পীর শয়তান’


‘এসব হাদীস নয়’ গ্রন্থে মাওলানা মুতীউর রহমান ১৩১ পৃষ্ঠায় ও মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেব তার “প্রচলিত জাল হাদীস” গ্রন্থের ১৯১ পৃষ্ঠায় এবং ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার লিখিত ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ৪৪৪ পৃষ্ঠায় এটা উলে­খ করে এটিকে জাল হাদিস বলে চালিয়ে দিয়েছেন।


আসলে মূলত এটা হাদিস নয়, বরং মাশায়েখের বাণী। তাই এটাকে হাদিস মনে করাটা ভুল বা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। এছাড়া বায়াত হওয়ার গুরুত্বের উপর আরও অনেক হাদিস রয়েছে। পীরের হাতে বায়াত হওয়া ছাড়া কোন মুসলমান সফলকাম হতে পারবে না। আজ পর্যন্ত যাঁরা আউলিয়ায়ে কেরাম হয়েছেন তারা কেউ পীরের হাতে বায়াত হওয়া ছাড়া হতে পারেননি, হতে পেরেছেন এমন কোন নজিরও নেই। খুঁজে দেখলে দেখা যাবে সকলেরই শায়খ ছিল।


নিম্নে বর্ণিত দলীল ছাড়াও পীরের হাতে বায়াত হওয়ার গুরুত্বের ব্যাপারে আরো অনেক কোরআন হাদিসের দলীল রয়েছে। কিতাব দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংঙ্কায় সংক্ষিপ্ত করা হল।


১। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, 


مَنْ خَلَعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ، لَقِيَ اللهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لَا حُجَّةَ لَهُ، وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِي عُنُقِهِ بَيْعَةٌ، مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً


-‘‘যে ব্যক্তি ইমামের আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিলো,  সে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর সাথে এমতাবস্থায় সাক্ষাত করবে, তার হাতে কোন দলীল থাকবে না। যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করলো যে, তার গলায় বায়আতের বেড়ি থাকলো না,  সে জাহেলীয়াতের মৃত্যুতে মৃত্যুবরণ করলো।’’ ২

২ .    

ক. ইমাম মুসলিম : আস সহীহ : কিতাবুল ইমা’রত, ৩/১৪৭৮ পৃ. হা/১৮৫১ এবং ৫৮

খ. খতিব তিবরিযী, মিশকাতুল মাসাবীহ, ৩/৫ পৃ. কিতাবুল ইমারত, হা/৩৬৭৪

গ. ইমাম আহমদ,  আল-মুসনাদ, ২/১৫৪ পৃ.


জাহেলী যুগে যারা মৃত্যুবরণ করেছে তারা কী ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে নাকি বেঈমান হয়ে তা সকলের জানা কথা। একজন হক্কানী ওলীয়ে কামেলের সোহবতে না থাকলে শয়তান তাকে বেঈমান পথভ্রষ্ট করতে পারে যে কোন মূহুর্তে। 


বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনুল হাজ্জ আল মালেকী (رحمة الله) {ওফাত.৭৩৭ হি.} তাঁর ’আল মাদখাল’ গ্রন্থে লিখেন-


أَنَّ الْمُرِيدَ لَهُ اتِّسَاعٌ فِي حُسْنِ الظَّنِّ بِهِمْ، وَفِي ارْتِبَاطِهِ عَلَى شَخْصٍ وَاحِدٍ يُعَوِّلُ عَلَيْهِ فِي أُمُورِهِ، وَيَحْذَرُ مِنْ تَقَضِّي أَوْقَاتِهِ لِغَيْرِ فَائِدَةٍ. 


-‘‘মুরিদের জন্য এও অবকাশ রয়েছে যে, সে স্বীয় যুগের সমস্ত শায়খ বা পীরের প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করবে এবং একজন পীরের দামানের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে আর স্বীয় সকল কাজে তার উপরই নির্ভর করবে। অনর্থক সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকবে।’’  ৩

৩  . আল্লামা ইমাম শায়খ ইবনুল হাজ্ব : আল মাদখাল : ৩/১৫৫ পৃ.


শুধু তাই নয় সূফী কুল সম্রাট ইমাম শা’রানী (رحمة الله) তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ’’মিযানুশ শরীয়্যাতুল কুবরা’’-এ উলে­খ করেন, 


سمعت سيدى على الخواص رحمه الله عليه يقول : انما أمر علماء الشريعة الطالب بالالتزام مذهب معين وعلماء الحقيقية للمريد بالالتزام شيخ واحدـ 


-‘‘আমি (আমার পীর) হযরত আলী খাওয়াছ (رحمة الله) কে বলতে শুনেছি যে,  তিনি শরীয়তের অনুসারীকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন মাযহাব চারটা থেকে নির্দিষ্ট একটি মাযহাবের তাকলীদকে নিজের জন্য অপরিহার্য করে নেয়। আর তরীকতের আলিম মুরিদকে বলেছেন, তারা যেন একজন পীরকে অপরিহার্য করে নেয়।’’  ৪

৪ .  আল্লামা ইমাম শা’রানী : আল মিযানুল কোবরা : ১/২৩ পৃ.


হযরত তালহা (رضي الله عنه) স্বীয় ইজতিহাদী ভুল স্বীকার করে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (رضي الله عنه) এর হাতে যখন পুনরায় বায়াত গ্রহণ করতে চাইলেন কিন্তু জালিমের হাতে ভীষণ আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার কারণে আমীরুল মুমিনীন পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর ছিলো না। তখন তার পাশ দিয়ে আমীরুল মুমিনীনের একজন সেনা সদস্য অতিক্রমকালে তাকে ডেকে হযরত তালহা (رضي الله عنه) তার হাতে বায়আতে তাজদীদ করলেন। এরপরই তিনি ইন্তিকাল করলেন। হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী (رضي الله عنه)  এ ঘটনা শুনে বললেন-


أَبَى اللَّهُ أَنْ يَدْخُلَ طَلْحَةَ الْجَنَّةَ إِلَّا وَبَيْعَتِي فِي عُنُقِهِ


-‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা তালহার জান্নাতে যাওয়াকে চাননি যতক্ষণ পর্যন্ত আমার বায়আত তার স্কন্ধে ছিলো না।’’  ৫

৫ . ইমাম হাকিম নিশাপুরী : আল মুস্তাদরাক : মানাকিবে তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ : ৩/৪২১ : হা/৫৬০১


তাই এতবড় একজন সাহাবী সে বায়াত না হওয়াতে যদি এইরূপ হয়ে থাকে,  তাহলে আমাদের অবস্থা কীরূপ হতে পারে! আমাদের যুগতো আরও বড় ফিতনার যুগ।


এ বাণী সম্পর্কে আলোকপাত:


‘যার কোন পীর নেই তার পীর শয়তান’ এটি অসংখ্য মাশায়েখে কিরামের বাণী, এখন এ বিষয়ে আমি কতিপয় মাশায়েখদের অভিমত তুলে ধরার চেষ্টা করবো। হযরত সায়্যিদুনা শায়খুশ শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (رحمة الله) তাঁর ‘আওয়ারিফুল মাআরিফ’ গ্রন্থে বলেন-


سمعت كثيرا من المشائخ يقولون من لم مفلحا لا يفلح ـ


-‘‘আমি অনেক আউলিয়ায়ে কিরামকে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি সফলকাম লোকের (ওলীদের) সান্নিধ্যে অর্জন করেনি সে সফলকাম হবে না।’’  ৬

৬ . আল্লামা শায়খ সোহরাওয়ার্দী : আওয়ারিফুল মাআরিফ : ২য় পরিচ্ছেদ : পৃ-৭৮


উক্ত কিতাবে আরও উলে­খ আছে-


عن ابى يزيد رضى الله تعالى عنه انه قال : من لم يكن له استاذ فامامه الشيطان ـ 


-‘‘হযরত আবু ইয়াযিদ বায়েজিদ বোস্তামী (رحمة الله) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,  যার পীর নেই, তার ইমাম বা পীর শয়তান।’’ ৭

৭ . আওয়ারিফুল মাআরিফ : ৭৮ পৃ.


শুধু তাই নয় ইমাম আবুল কাসিম কুশাইরী (ওফাত. ৪৬৫ হি.) তার উলে­খযোগ্য গ্রন্থ ‘আর রিসালায়ে কুশাইরী’ বলেন, 


يجب عَلَى المريد أَن يتأدب بشيخ فَإِن لَمْ يكن لَهُ أستاذ لا يفلح أبدا. هَذَا أَبُو يَزِيد يَقُول: من لَمْ يكن لَهُ أستاذ فإمامه الشَّيْطَان 


-‘‘মুরিদের জন্য করণীয় যে, কোনো পীরের দীক্ষা গ্রহণ করা। কারণ,  পীরহীন লোক কখনো (উভয় জগতে) সফলতা লাভ করতে পারে না। আবু ইয়াযিদ হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (رحمة الله) এটাই বলেছেন যে,  যার কোন পীর নেই, তার পীর শয়তান।’’ (ইমাম কুশায়রী, রেসালায়ে কুশাইরী, ২/৫৭৩ পৃ., পরিচ্ছেদ: بَاب المعرفة بالله )


অতঃপর তিনি আরও বলেন, 


وسمعت الأستاذ أبا عَلِي الدقاق يَقُول: الشجرة إِذَا نبتت بنفسها من غَيْر غارس فإنها تورق لكن لا تثمر كَذَلِكَ المريد إِذَا لَمْ يكن لَهُ أستاذ يأخذ منه طريقته نفسا فنفسا فَهُوَ عابد هواه لا يجد نفاذا


-‘‘আমি হযরত আলী দিকাক (رحمة الله) কে বলতে শুনেছি যে,  বৃক্ষ যখন কারো রোপন করা ছাড়া নিজে নিজেই জন্মে, এতে পাতা হয়,  কিন্তু ফল হয় না। তেমনি মুরিদের যদি কোন পীর না থাকে, যার কাছে তরীকতের এক একটি শ্বাস প্রশ্বাসের নিয়মাবলী শিক্ষা না লাভ করবে, তবে সে স্বীয় প্রবৃত্তির পূজারী,  সে সু পথ পাবে না।’’ ৮

৮ . ইমাম কুশায়রী, রেসালায়ে কুশাইরী, ২/৫৭৩ পৃ., পরিচ্ছেদ: بَاب المعرفة بالله 


হযরত সায়্যিদুনা মীর আবদুল ওয়াহিদ বলগিরামী (رحمة الله) সবঈ সানাবিল শরীফে বলেন, 


چوپيرت نيست پر تست ابليس * كہ راه دين نہ زدست ازمكر و تلبيس


-‘‘যখন তোমার পীর নেই,  তবে তোমার পীর শয়তান দ্বীনি পথে তো প্রতারণা ও ধোঁকার মাধ্যমে মানুষকে প্রতারিত ও বিতাড়িত করে।’’


ইমামুল আউলিয়া খাজা নিজামুদ্দীন (رحمة الله) এর ‘মালফ‚যাত’ তথা বাণী সংকলন ‘ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ’ এ এভাবে লিপিবদ্ধ আছে- মাওলানা সিরাজুদ্দীন হাফেয বাদায়ূনী (رحمة الله) তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরয করেন :


من ليس له شيخ فشيخه الشيطان


‘যার কোন পীর নেই,  তার পীর শয়তান’ এটি কি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর হাদিস? হযরত নিজামুদ্দীন আউলিয়া (رحمة الله) বলেন,  না এটি মাশায়েখের বাণী।’’ ৯

৯ . হযরত ফরিদ উদ্দীন আত্তার : ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ-৫৯ পৃ. 


অতএব প্রমাণিত হলো যে,  এটা হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (رحمة الله) সহ অনেক বাণী অর্থাৎ মাশায়েখের বাণী। শুধু তাই নয় এ প্রসঙ্গে আরও বর্ণনা রয়েছে,  বিশ্ববিখ্যাত মুফাস্সির, ফকীহ, আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (رحمة الله) সূরা কাহাফের ৬১ আয়াতের তাফসীরে বলেন, 


روى ابى يزيد البسطامي قدس سره من لم يكن له شيخ فشيخه الشيطان


-‘‘হযরত আবু ইয়াজিদ বায়জিদ বোস্তামী (رحمة الله) বলেন, যার কোন পীর নেই,  তার পীর শয়তান।’’ ১০

১০ . আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসীরে রুহুল বায়ান : ৫/২৬৪ পৃ., সূরা. কাহাফ, আয়াত ৬১-এর ব্যাখ্যা


বাবুনগরীদের অন্যতম গুরু রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেব তার ‘ইমদাদুস সুলুক’ কিতাবের ১৬৮ নং পৃষ্ঠাও (উর্দু) অর্থাৎ-‘‘যার কোন পীর নাই,  তার পীর শয়তান।’’ এ বাক্যটিকে সত্য বলে উলে­খ করেছেন।

Top