১ম অধ্যায়
তাকলীদের অর্থ ও প্রকারভেদ
তাকলীদের দু’টো অর্থ আছে, একটি আভিধানিক, অপরটি পারিভাষিক বা শরীয়তে ব্যবহৃত। তাকলীদের আভিধািনক অর্থ হলো গলায় বেষ্টনী বা হার লাগানো। শরীয়তের পরিভাষার তাকলীদ হলো- কারো উক্তি বা কর্মকে নিজের জন্য শরীয়তের জরুরী বিধান হিসেবে গ্রহণ করা, কেননা তাঁর উক্তি বা কর্ম আমাদের জন্য দলীলরূপে পরিগণিত। কারণ উহা শরীয়তে গবেষণা প্রসূত। যেমন, আমরা ইমাম আজম সাহেব (رحمة الله) এর উক্তি ও কর্মকে শরীয়তের মাস’আলার দলীলরূপে গণ্য করি এবং সংশিষ্ট শরীয়তের দলীলাদি দেখার প্রয়োজন বোধ করি না।
❏ ‘হুসসামীর’ টীকায় ‘রসূল (ﷺ) এর অনুসরণ’ অধ্যায়ের ৮৬ পৃষ্ঠায় ‘শরহে মুখতাসারুল মানার’ হতে উদ্ধৃত করা হয়েছে,
التَّقْلِيْدُ اِتِّبَاعُ الرَّجْلِ غَيْرَهُ فِيْمَا سَمِعَهً يَقُوْلً اَوْفِىْ فِعْلِهِ عَلَى زَعْمِ اَنَّهُ مُحَقِّقُ بِلَا نَظَرٍٍ فِى الدُّلِيْلِ.
অর্থাৎ তাকলীদ হলো কোন দলীল প্রমাণের প্রতি দৃষ্টিপাত না করে কোন গবেষকের উক্তি বা কৃত কর্ম শুনে তাঁর অনুসরণ করা।
❏ ‘নূরুল আন্ওয়ার’ গ্রন্থে তাকলীদের বর্ণনায় একই কথা বর্ণিত হয়েছে।
❏ ইমাম গাজ্জালী (رحمة الله) ও ‘কিতাবুল মুস্তাফা’ এর ২য় খন্ডের ৩৮৭ পৃষ্ঠায় বলেছেন,
اَلتَّقْلِيْدُ هُوَ قَبُوْلُ قَوْلٍ بِلاَ حُجَّةٍ.
অর্থাৎ তাকলীদ হলো কারো উক্তিকে বিনা দলীলে গ্রহণ করা।
❏ মুসাল্লামুস-ছবুত গ্রন্থে সংজ্ঞাটি এভাবে বলা হয়েছে,
اَلتَّقْلِيْدُ اَلْعَمْلُ بِقَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ حُجَّةٍ.
অর্থাৎ তাকলীদ হলো কোন দলীল প্রমাণ ব্যতিরেকে অন্যের কথানুযায়ী আমল করা।
উপরোক্ত সংজ্ঞা থেকে বোঝা গেল যে, হুযুর ‘(ﷺ)-এর অনুসরণকে তাকলীদ বলা যাবে না। কেননা তাঁর প্রত্যেকটি উক্তি ও কর্ম শরীয়তের দলীল। আর তাকলীদের ক্ষেত্রে শরীয়তের দলীলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয় না। সুতরাং আমাদের হুজুর (ﷺ) এর উম্মত হিসেবে অভিহিত করা হবে, তাঁর ‘মুকালিদ’ বা অনুসরণকারী হিসেবে গণ্য করা যাবে না। অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কিরাম ও দ্বীনের ইমামগণও হুজুর (ﷺ) এর উম্মত, মুকালিদ ন’ন। এরূপ সাধারণ মুসলমানগণ যে কোন আলিমেদ্বীনের অনুসরণ করে থাকেন, এটাকেও তাকলীদ বলা যাবে না। কেননা কেউ আলিমদের কথা বা কর্মকে নিজের জন্য দলীলরূপে গ্রহণ করে না। আলিমরা কিতাব দেখে কথা বলেন, এ কথা উপলব্দি করে তাঁদেরকে মান্য করা হয়। যদি তাঁদের ফত্ওয়া ভুল কিংবা কিতাবের বিপরীত প্রমাণিত হয়, তখন কেউ তা গ্রহণ করবে না। পক্ষান্তরে, ইমাম আবু হানীফা (رحمة الله) যদি কুরআন বা হাদীছ বা উম্মতের সর্বসম্মত অভিমত দেখে কোন মাসআলা ব্যক্ত করেন, তা’ও যেমনি গ্রহণযোগ্য, আবার নিজস্ব কিয়াস বা যুক্তিগ্রাস্য কোন মত প্রকাশ করলে, তাও গ্রহণীয় হবে। এ পার্থক্যটা স্মরণ রাখা একান্ত দরকার।
তাকলীদ দুই রকমের আছে, ‘তাকলীদে শারঈ’ ও তাকলীদে গায়ব শারঈ’। শরীয়তের বিধান সম্পর্কিত ব্যাপারে কারো অনুসরণ করাকে ‘তাকলীদে শারঈ’ বলা হয়। যেমন রোযা, নামায, যাকাত ইত্যাদি মাসাইলে ধর্মীয় ইমামদের অনুসরণ করা হয়। আর দুনিয়াবী বিষয়াদিতে কারো অনুসরণ করাকে তাকলীদে গায়র শারঈ বলা হয়। যেমন চিকিৎসকগণ চিকিৎসা শাস্ত্রে বু’আলী সীনাকে, কবিগণ দাগ, আমীর বা মির্যা গালিবকে এবং আরবী ভাষার দ্বিবিধ ব্যাকরণ-নাহ্ব ও ছরফের পন্ডিতগণ সীবওয়াই ও খলীল অনুসরণ করে থাকেন। এ রকম প্রত্যেক পেশার লোকেরা তাদের নিজ নিজ পেশার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অনুসরণ করে থাকে। এগুলো হলো দুনিয়াবী তাকলীদ।
আবার সুফীয়ানে কিরাম তাদের ওয়াজীফা ও আমলের ব্যাপারে নিজ নিজ মাশায়িখের উক্তি ও কর্মের অনুসরণ করে থাকেন। এটা অবশ্য দ্বীনী তাকলীদ, কিন্তু শারঈ তাকলীদ নয়। বরং একে তাকলীদ ফিত্ তারীকত বলা হয়। কেননা এখানে শরীয়তের মাসাইলের হালাল-হারামের ব্যাপারে অনুসরণ করা হয় না। হ্যাঁ, যে কর্ম পদ্ধতির অনুসরণ করা হয় উহাও ধর্মীয় কাজ বৈকি।
তাকলীদে গায়র শারঈ কোন ক্ষেত্রে যদি শরীয়তের পরিপন্থী হয়, তাহলে সে তাকলীদ হারাম। যদি ইসলাম বিরোধী না হয়, তাহলে জায়েয। বৃদ্ধা মহিলারা আনন্দ বিষাদের সময় বাপ-দাদাদের উদ্ভাবিত কতগুলো শরীয়ত বিরোধী প্রথার অনুসরণ করে, ইহা হারাম। চিকিৎসকগণ চিকিৎসা শাস্ত্রের ব্যাপারে বু’আলী সীনা প্রমুখের অনুসরণ করে থাকেন, ইহা ইসলাম বিরোধী না হলে জায়েয। প্রথম প্রকারের হারাম তাকলীদকে কুরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াতে নিষেধ করা হয়েছে এবং এ ধরনের তাকলীদকারীদের নিন্দা করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে নিম্নে কয়েকটি আয়াতের উল্লেখ করা হলো,
وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا
❏ ‘‘তার কথা শুনবেন না, যার দিলকে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ করেছি, যে নিজ প্রবৃত্তির বশীভূত ও যা’র কাজ সীমা লঙ্ঘন করেছে।’’
{সূরাঃ কাহাফ, আয়াতঃ ২৮, পারাঃ ১৫}
وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا
❏ ‘‘এবং যদি তারা (পিতা-মাতা) তোমাকে এমন কোন বস্তুকে আমার অংশীদাররূপে স্বীকার করানোর চেষ্টা করে, যা’র সম্পর্কে তোমার সম্যক ধারণা নেই, তবে তাদের কথা শুনিও না।’’
{সূরা লোকমানঃ আয়াতঃ ১৫, পারাঃ ২১}
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُوا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ
❏ ‘‘এবং যখন তাদেরকে (কাফিরদেরকে) বলা হয়, আল্লাহ্ তা’আলা যা অবতীর্ণ করেছেন, সে দিকে এবং রসূলের দিকে আগমন কর, তখন তারা বলতো, ওই কর্মপন্থাই আমাদের জন্য যথেষ্ট, যা’ আমাদের বাপ-দাদা দের মধ্যে অনুসৃত হয়ে আসছে। যদিও তাদের বাপ-দাদাগণ না কিছুই জানতো, না সৎপথে ছিল।’’
{সূরাঃ মায়েদা, আয়াতঃ ১০৪, পারাঃ ৭}
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا
❏ ‘‘যখন তাদেরকে বলা হতো; আল্লাহর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ অনুযায়ী চলো, তখন তারা বলতো, আমরা আমাদের বাপ-দাদাগণকে যে পথে পেয়েছি, সে পথেই চলবো।’’
{সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ১৭০}
উল্লেখিত আয়াত ও এ ধরনের অন্যান্য আরও আয়াতে শরীয়তের মুকাবিলায় মূর্খ বাপ-দাদাগণের হারাম ও গর্হিত কার্যাবলীর অনুসরণ করার নিন্দা করা হয়েছে। তারা বলতো, আমাদের বাপ-দাদাগণ যেরূপ করতেন, আমরাও সেরূপ করবো, সে কাজ জায়েয হোক বা না জায়েয। উল্লেখ্য যে, উল্লেখিত আয়াতের সঙ্গে শারঈ তাকলীদ এবং ধর্মীয় ইমামগণের অনুসরণের কোন সম্পর্ক নেই। অতএব ঐ সমস্ত আয়াতের ভিত্তিতে ইমামগণের তাকলীদকে শির্ক কিংবা হারামরূপে গণ্য করা ধর্মহীনতার নামান্তর। এ কথাটুকু স্মরণ রাখার দরকার।