দ্বাদশ অধ্যায়: বিবিধ:
বিষয় নং-১: মসজিদে দুনিয়াবী কথাবার্তা বললে, চল্লিশ বছরের নেক আমল বরবাদ:
মাওলানা মুতিউর রহমান কৃত ‘এসব হাদিস নয়’ গ্রন্থের ১১১ পৃষ্ঠায় লিখেছে ‘‘এটা রাসূল (ﷺ) এর হাদিস নয় বরং লোকমুখে হাদিস।’’ তাছাড়া ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ৪৮০ পৃষ্ঠায়ও অনুরূপ বক্তব্যের সমর্থন দিয়েছেন।
মসজিদে বসে দুনিয়াবী ও অপ্রাসঙ্গিক কথাবলা হারাম; এ কথাটি সত্য। বিভিন্ন হাদিসের বর্ণনা দ্বারা এ বিষয়টি সঠিক হিসেবে প্রমাণিত। মসজিদ তৈরীর উদ্দেশ্য সালাত আদায়, আল্লাহর যিকর, ইত্যাদি কাজের জন্য। এ জন্যই হযরত আনাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) বলেন, এগুলো শুধু আল্লাহর যিকর, সালাত ও কুরআন তিলাওয়াতের জন্য। ১
➥১. বায্যার, আল-মুসনাদ, ১৩/৭৮ পৃঃ হা/৬৪২৬, মুসলিম, আস্-সহীহ, ১/২৩৬ পৃঃ হাদিস:২৮৫, তাহাভী, শরহে মুশকিলুল আছার, ১২/৫৩২ পৃঃ ও ১/১৩ পৃঃ হাদিস:১০, বায়হাকী, আস-সুনানুল সুগরা, ৪/১২৬ পৃঃ হাদিস: ৩২৩৬, সুনানে কোবরা, ১০/১৭৬ পৃঃ হাদিস, ২০২৬৪ ও ২/৫৭৮ পৃঃ হা/৪১৪২
উপরোক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেল মসজিদ দুনিয়াবী কথা বলার স্থান নয়। মিশকাতুল মাসাবীতে ‘বাবুল মাসাজিদ’ অধ্যায়ে হযরত হাসান বসরী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) ইরশাদ ফরমান-
وَعَنِ الْحَسَنِ مُرْسَلًا قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ يَكُونُ حَدِيثُهُمْ فِي مَسَاجِدِهِمْ فِي أَمْرِ دُنْيَاهُمْ. فَلَا تُجَالِسُوهُمْ فَلَيْسَ لِلَّهِ فِيهِمْ حَاجَةٌ . رَوَاهُ الْبَيْهَقِيّ فِي شعب الْإِيمَان
-‘‘ওহে লোকেরা, শুন! এমন এক যমানারও আগমন ঘটবে যখন মানুষেরা মসজিদে তাদের দুনিয়াবী কথাবার্তা বলবে। যখন এ ধরনের যামানা এসে যাবে, তখন তোমরা তাদের সাথে বসিও না। মহান আল্লাহ্ এহেন লোকদের থেকে সম্পূর্ণ অমুখাপেক্ষী।’’ ২
➥২. ইমাম বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান, ৪/৩৮৭ পৃঃ হাদিস:২৭০১, খতিব তিবরিযী : মিশকাত : কিতাবুল মাসাজিদ : ১/১৫৬ পৃঃ হা/৭৪৩, মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত, কিতাবুল মাসাজিদ, ২/১৪০ পৃঃ হাদিস: ৭৪৩, ইবনে রযব হাম্বলী, ফতহুল বারী, ৩/৩৪৫ পৃঃ
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ؓ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ : يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ يَتَحَلَّقُونَ فِي مَسَاجِدِهِمْ وَلَيْسَ هِمَّتُهُمْ إِلَّا الدُّنْيَا لَيْسَ لِلَّهِ فِيهِمْ حَاجَةٌ فَلَا تُجَالِسُوهُمْ هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ وَلَمْ يُخَرِّجَاهُ [التعليق - من تلخيص الذهبي] ৭৯১৬ - صحيح
-‘‘হযরত আনাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেন, মানুষের মধ্যে এমন এক সময় আসবে, যখন তারা তাদের মসজিদ গুলোতে বৃত্তাকারে বসবে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে দুনিয়া। এদের মধ্যে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। তোমরা এদের সাথে বসবে না। ইমাম হাকিম নিশাপুরী হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।’’ ৩
➥৩. মুফতি আমিমুল ইহসান: ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার, ১/২৮৩ পৃঃ হাদিস:৭৯২, হাকেম নিশাপুরী, আল মুস্তাদরাক, ৪/৩৫৭পৃঃ হা/৭৯১৬, ইমাম যাহাবী, তালখিছ গ্রন্থে হাকেমের সাথে সহীহ হওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ ؓ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ : سَيَكُونُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ يَكُونُ حَدِيثُهُمْ فِي مَسَاجِدِهِمْ لَيْسَ لِلَّهِ فِيهِمْ حَاجَةٌ
-“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, শেষ যামানায় কিছু মানুষ এরূপ হবে যে, তাদের কথাবার্তা তাদের মসজিদ গুলোর মধ্যে হবে। এদের আল্লাহর কোন আবশ্যকতা নেই।’’ ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তার ‘আস্-সহীহ’ গ্রন্থে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। ৪
➥৪. ইমাম দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ২/৩১৯ পৃঃ হা/৩৪৪৫, ইমাম হায়সামী, মাওয়ারিদুয্-যামান : ২/৮-৯পৃঃ, ইমাম তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর, ১০/১৯৮ পৃঃ হা/১০৪৫২, ইমাম আবূ নুয়াইম ইস্পাহানী, হিলয়াতুল আউলিয়া, ৪/১০৯ পৃঃ ইমাম ইবনে হিব্বান, আস্-সহীহ, ১৫/১৬৩ পৃঃ ইমাম ইবনে আদি, আল-কামিল, ২/২৪১ পৃঃ, ক্রমিক- ২৯৩, মুফতি আমিমুল ইহসান : ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার; ১/২৮৩ পৃঃ হা/৭৯৩
তবে সনদে (بَزِيع بن حسان) নামক একজন রাবী রয়েছে, ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তাকে দ্বঈফ রাবীদের গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন। (যাহাবী, দিওয়ানুল দ্বুআফা, ১/৪৬ পৃ. ক্রমিক. ৫৬৭)
শুধু তাই নয় আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী বলেন,
قَالَ ابْنُ الْهُمَامِ فِي شَرْحِ الْهِدَايَةِ: الْكَلَامُ الْمُبَاحُ فِي الْمَسْجِدِ مَكْرُوهٌ يَأْكُلُ الْحَسَنَاتِ
-‘‘ইমাম কামালুদ্দীন ইবনুল হুমাম (رحمة الله) তাঁর শরহে হেদায়ায় বলেন, মসজিদে বৈধ কথাবার্তা বলাও মাকরুহে তাহরীমী, আর তা নেক আমল খেয়ে ফেলে বলে উল্লেখ করেছেন।। (মোল্লা আলী ক্বারী, মিরকাত: ২/৪১৮পৃ. হাদিস:৭৪৩)
শুধু তাই নয় ইমাম নববী (رحمة الله) বলেন, মসজিদে জোরে ইলম আলোচনা বা অন্যান্য কথা বলা মাকরুহে তাহরীমী। (মিরকাত, ২/৪১৯ পৃ. হাদিস:৭৪৪)
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন, ইমাম মালেক (رحمة الله) কে প্রশ্ন করা হলো যে মসজিদে জোরে ইলম আলোচনা করা সর্ম্পকে, অত:পর তিনি বলেন, এই ইলম শিক্ষায় এবং অন্যান্য কাজে কোন নেকি নেই। (মিরকাত, ২/৪১৯ পৃ. হাদিস:৭৪৪)
দেখুন আমাদের দেশে কিছু লোক রয়েছে যারা দ্বীনের দাওয়াতের নাম দিয়ে মসজিদকে নিজের ঘরের মত বাসস্থান বানিয়ে কথাবার্তা বলার স্থান বানিয়ে নিয়েছে।। এমন লোকদের থেকে দূরে থাকা ওয়াজিব যা উক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়। বিস্তারিত জানার জন্য আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু আল্লামা মুফতি আলী আকবার সাহেব (মা. জি. আ.) বিরচিত ‘প্রচলিত তাবলীগ জামাতের স্বরূপ উন্মোচন’ এবং আমার লিখিত ‘ইসলাম ও প্রচলিত তাবলীগ’ গ্রন্থদ্বয় পড়ুন। আশা করি সঠিক বিষয়টি বুঝে আসবে। এখন আসুন দেখি চল্লিশ বছরের হাদিস কোথাও আছে কিনা।
আমরা প্রথমে বলবো কোনো কিতাবে নেই বলা জ্ঞান শূন্যতার পরিচায়ক এবং একটি হাদিসকে অস্বীকার করার নামান্তর। যেমন উসূলে ফিক্বহের প্রসিদ্ধ কিতাব নুরুল আনওয়ার এর লেখক আল্লামা শায়খ আহমদ মোল্লা জিওন (رحمة الله) স্বীয় তাফসীরে আহমদিয়াতে সূরা জীনের ১৮ নং এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেন- মসজিদে দুনিয়াবী কথা বলা নিষেধ। তারপর এ হাদিস শরীফ ব্যক্ত করেন-
قال النبى ﷺ من تكلم بكلام الدنيا فى خمسة مواضع احبط الله تعالى منه عبادة اربعين سنة الاولى فى المسجد و الثانى فى تلاوة القران و الثالث فى وقت الاذان و الرابع فى مجلس العلماء و الخامس فى زيارة القبور-
-‘‘নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি পাঁচ জায়গায় দুনিয়াবী কথা বলবে আল্লাহ্ তা‘য়ালা তার চল্লিশ বছরের (নফল) ইবাদত নষ্ট করে দিবেন, এক. মসজিদ, দুই. কুরানুল কারীম তিলাওয়াতের কালে. তিন. আযানের সময়. চার. জ্ঞানী আলিমদের মজলিসে, পাঁচ. কবরে যিয়ারতকালে।’’ ৫
➥৫. আল্লামা মোল্লা জিওন : তাফসীরে আহমদিয়া, পৃ-৭২৪
অতএব প্রমাণ হলো এই হাদিস কিতাবে হাদিস হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। যদিও হাদিস দ্বঈফ হউক তারপরও তা হতে তাকওয়া অর্জন করতে হবে। তারা ইবনে তাইমিয়ার অনুসারী কাযি শাওকানীর দলীল গ্রহণ করেছে অথচ তার ফাওয়াইদুল মাজমু‘আ ফি আহাদিসিল মাওদ্বুআত, ১/২৫ পৃষ্ঠা (যা দারূল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রূত, লেবানন মুদ্রিত)
চল্লিশ বছরের ইবাদত নষ্ট হবার কথা উল্লেখ নেই, বরং সারা জীবনের আমল নষ্ট হয়ে যাবে উল্লেখ রয়েছে। যেমন তার বর্ণনার ধরণ হলো:
مَنْ تَكَلَّمَ فِي الْمَسْجِد بِكَلَام الدُّنْيَا أَحْبِط اَلله أَعْمَاله قَالَ الصَّغَانِي مَوْضُوْع
-‘‘যে ব্যক্তি মসজিদে দুনিয়াবী কথা বলবে ‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা তার সব আমল বরবাদ করে দিবে। ইমাম সাগানী (رحمة الله) উক্ত হাদিসকে জাল বা বানোওয়াট বলেছেন।’’৬
➥৬. শাওকানী:ফাওয়াইদুল মাওজুআত, ১/২৫ পৃঃ
এখানে দুটি বিষয় পাওয়া গেল এক. কাযি শাওকানীর নিজস্ব কোন মতামত নেই। ২. তিনি আল্লামা সাগানীর রায় উল্লেখ করেছেন আর ইমাম সাগানী চল্লিশ বছরের আমল বরবাদ হবে হাদিসকে জাল বলেননি যা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা এবং তার ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ। তিনি সমস্ত ইবাদত নষ্ট হয়ে যাবে তাকে জাল বলেছেন। আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله)ও সব আমল বরবাদ হবে বলে উক্ত হাদিসকে জাল উল্লেখ করেছেন। ৭
➥৭. মোল্লা আলী ক্বারী : মওজুআতুল কাবীর : ১১৭ পৃষ্ঠা
উক্ত হাদিসটি যেহেতু বিখ্যাত উসূল বিদগণ গ্রহণ করেছেন সেহেতু বলা যায় উসূলবিদগণ মওদ্বু হাদিস বর্ণনা হতে বিরত থাকাই তাদের নীতি। অবশ্যই তার নিকট উক্ত হাদিসের সনদ জানা রয়েছে।