অধ্যায়ঃ ক্বোরআন ও সুন্নাহ্'কে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা



❏ 'বিদ'আত কাকে বলে�

❏ 'লাইসা মিনহু'র উৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা, দ্বীন মানে কি�

                                          

❏ দরসে হাদীসঃ [হাদীস নং- (১৩৩)]

○ অধ্যায়ঃ [( ﺑﺎﺏ ﺍﻻﻋﺘﺼﺎﻡ ﺑﺎﻟﻜﺘﺎﺏ ﻭﺍﻟﺴﻨﺔ ) : ক্বোরআন ও সুন্নাহকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা] (টীকাঃ ১)

[ﻋﻦ ﻋﺌﺸﺔ ﻗﺎﻟﺖ ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﷺ ﻣﻦ ﺍﺣﺪﺙ ﻓﻰ ﺍﻣﺮﻧﺎ ﻫﺬﺍ ﻣﺎﻟﻴﺲ ﻣﻨﻪ ﻓﻬﻮ ﺭﺩ . ‏] - ‏( ﻣﺘﻔﻖ ﻋﻠﻴﻪ )

হযরত আয়েশা [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﯽٰ ﻋﻨﻬﺎ] হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলাল্লাহ [ﷺ] এরশাদ করেনঃ

"যে ব্যক্তি আমার দ্বীনে এমন রীতি উদ্ভাবন করে, যা এ দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখানযোগ্য।" (টীকাঃ ২)

[বোখারী, মুসলিম]

□ উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখায় বলা হয়েছেঃ


                                   

১. [( ﺑﺎﺏ ﺍﻻﻋﺘﺼﺎﻡ ﺑﺎﻟﻜﺘﺎﺏ ﻭﺍﻟﺴﻨﺔ ) : ক্বোরআন ও সুন্নাহকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা]

◇ টীকাঃ ১. ﻋﺼﻢ ‏) , ‏( ﺍﻋﺘﺼﺎﻡ )) হতে গঠিত। এর অর্থ নিষেধ করা, বিরত রাখা। পূতঃপবিত্র হওয়াকে এ জন্যই ( ﻋﺼﻤﺖ ) বলা হয়, যেহেতু তা গুনাহ থেকে বিরত রাখে। সেটার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- শক্তভাবে ধরা, ছুটে যাওয়া ও পালিয়ে যাওয়া, রুখে রাখা। শরীয়তের পরিভাষায়, সত্যতার উপর বিশ্বাস এবং সেটা অনুসারে নিয়মিতভাবে আমল করাকে ( ﺍﻋﺘﺼﺎﻡ ) বলা হয়। এখানে ( ﻛﺘﺎﺏ ) মানে 'ক্বোরআন-শরীফ' এবং 'সুন্নাহ্' মানে হুযূর [ﷺ]'র ওই সব পবিত্র বাণী, বরকতময় আমল ও অবস্থা, যেগুলো মুসলমানদের জন্য আমলের উপযোগী। হুযূরের এসব কর্মকে শরীয়ত বলা হয় এবং পুণ্যময় অবস্থাকে তরীক্বত বলা হয়। সূফীদের দৃষ্টিতে হুযূরের শরীর মুবারকের অবস্থাদি হল শরীয়ত, ক্বলবের অবস্থাদি হচ্ছে তরীক্বত, রুহের অবস্থাদি হাক্বীক্বত এবং 'সির্' (একটি বাত্বেনী স্তরের অবস্থা)কে মা'রিফাত। 'সুন্নাত' এর মধ্যে এ সবই অন্তর্ভুক্ত।

স্মর্তব্য যে, হুযূরের বৈশিষ্ট্যাবলী ( ﺧﺼﻮﺻﻴﺎﺕ ) 'সুন্নাহ্' নয়। সুতরাং নয়(০৯) জন স্ত্রী বিবাহাধীন রাখা, উটের উপর আরোহন করে তাওয়াফ করা, মিম্বরের উপর নামায পড়ানো ইত্যাদি যদিও হুযূরের পূণ্যময় কার্যাবলী; কিন্তু আমাদের জন্য এইগুলো অনুসারে আমল করার বিধান নেই। প্রত্যেক 'সুন্নাহ' হাদিস; কিন্তু প্রত্যেক 'হাদিস' সুন্নাহ নয়। এজন্য গ্রন্থকার [ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ] এখানে 'সুন্নাহ্' বলেছেন, 'হাদীস' বলেন নি এবং নবী করিম [ﷺ] এরশাদ করেছেন ( ﻋﻠﻴﻜﻢ ﺑﺴﻨﺘﻰ ) (আমার সুন্নাহ্'কে আঁকড়ে ধরো), ( ﺑﺤﺪﻳﺜﻰ) (আমার হাদিসকে) বলেন নি। তাছাড়া আমাদের নাম, আল্লাহর প্রশংসাক্রমে, 'আহলে সুন্নাত' অর্থাৎ সমস্ত সুন্নাত অনুসারে আমলকারী, 'আহলে হাদিস' নয়। কেননা, সমস্ত হাদিসের উপর কেউ আমল করতে পারে না এবং কেউ 'আহলে হাদিসও হতে পারে না।

এটাও স্মর্তব্য যে, শরীয়তের দলীল চারটিঃ 'কিতাবুল্লাহ্' (ক্বোরআন), সুন্নাহ্, ইজমা'-ই উম্মত এবং মুজতাহিদীনের ক্বিয়াস। কিন্তু কিতাব ও সুন্নাহ্ হচ্ছে সব দলীলের মূল আর ইজমা ও ক্বিয়াস ওইগুলোর পরে। কেননা, যদি কোন মাসআলা প্রথমোক্ত দু'টিতে পাওয়া না যায়, তখনই এ শেষোক্ত দু'টির দিকে মনোনিবেশ করবে। তাছাড়া, ক্বিয়াস হচ্ছে, ক্বোরআন-সুন্নাহ'র মর্মার্থ প্রকাশকারী। এ কারণে গ্রন্থকার (মিশকাত প্রণেতা) শুধু কিতাব ও সুন্নাহ্'রই উল্লেখ করেছেন। অপর দু'টির উল্লেখ করেন নি। নতুবা এ দুটিও অত্যন্ত জরুরী। সিদ্দীক্ব-ই আকবর ও ফারুক্ব-ই আ'যমের খিলাফত উম্মতের ইজমা' বা ঐক্যমতের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাঁদের খিলাফতকে অস্বীকার করা কুফর। বাজরা এবং চাউলের মধ্যে সূদ হারাম; কিন্তু কিতাব ও সুন্নাহ্'তে এর স্পষ্ট উল্লেখ নেই। ক্বিয়াস দ্বারাই ওইগুলো হারাম হওয়া প্রমাণিত। এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ আমার কিতাব 'জা-আল্ হক্ব' প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডে দেখুন। কিতাব ও সুন্নাহ্ হচ্ছে সমুদ্র; কোন ইমামের জাহাজে বসে সেটা অতিক্রম করো। কিতাব ও সুন্নাহ্ ঈমানী চিকিৎসার ঔষধ। কোন রুহানী চিকিৎসক অর্থাৎ মুজতাহিদ ইমামের পরামর্শক্রমে সেগুলো ব্যবহার করো।

২. [( ﻣﻦ ﺍﺣﺪﺙ ﻓﻰ ﺍﻣﺮﻧﺎ ﻫﺬﺍ ﻣﺎﻟﻴﺲ ﻣﻨﻪ ﻓﻬﻮﺭﺩ ) : (যে ব্যক্তি আমার দ্বীনে এমন রীতি উদ্ভাবন করে, যা এ দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখানযোগ্য।)]

◇ টীকাঃ ২.

অর্থাৎ এ উদ্ভাবনকারী প্রত্যাখ্যাত (মরদূদ্দ) অথবা তার এ উদ্ভাবন প্রত্যাখানযোগ্য। স্মর্তব্য যে, ( ﺍﻣﺮ ) মানে দ্বীন-ইসলাম এবং ( ﻣﺎ ) মানে আক্বাইদ। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইসলামে ইসলাম বিরোধী আক্বীদা উদ্ভাবন করে- সেও প্রত্যাখ্যাত আর ওই আক্বাইদও বাতিল।

সুতরাং রাফেযী, ক্বাদিয়ানী এবং ওহাবী ইত্যাদি বাহাত্তর ফির্কা, যাদের আক্বাইদ ইসলাম বিরোধী, সবই বাতিল।

অথবা ( ﺍﻣﺮ ) দ্বারা দ্বীন বুঝায় এবং ( ﻣﺎ ) দ্বারা আমলসমূহ বুঝায়। আর ( ﻟﻴﺲ ﻣﻨﻪ ) -এর মর্মার্থ হচ্ছে- 'ক্বোরআন ও হাদীসের বিরোধী।' অর্থাৎ যে কেউ দ্বীনে এমন আমল উদ্ভাবন করে, যা দ্বীন অর্থাৎ কিতাব ও সুন্নাহ্'র বিপরীত হবে, যা দ্বারা সুন্নাত উঠে যায়, ওই উদ্ভাবনকারীও মরদূদ এবং এরুপ আমলও বাতিল।

যেমনঃ উদূর্তে কিংবা বাংলায় খোতবাহ্ ও নামায পড়া, ফার্সীতে আযান দেওয়া ইত্যাদি। এর ব্যাখ্যা হচ্ছে ওই হাদীস, যা সামনে আসছে। তা হচ্ছে যে কেউ বিদ্'আত সৃষ্টি করে, তখন আল্লাহ্ সুন্নাতকে উঠিয়ে নেন।

আমার এ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এ হাদীস স্বীয় ব্যাপকতার উপর প্রযোজ্য হবে। এতে কোন শর্তারোপের প্রয়োজন নেই। মিরক্বাত প্রণেতা বলেন, ( ﻟﻴﺲ ﻣﻨﻪ ) দ্বারা বুঝা গেল যে, দ্বীনের মধ্যে এমন কাজের উদ্ভাবন করা, যা কিতাব ও সুন্নাহ্'র বিরোধী নয়, তাবে মন্দ বলা যাবে না।

প্রচারেঃ Ishq-E-Mustafa ﷺ

● হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা সম্বলিত টীকা পেতে সার্চ করুনঃ

f/Ishq-E-Mustafa ﷺ

[সূত্রঃ মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, কৃত- মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী]



❏ 'সুন্নাহ' ও হাদীসের মধ্যে পার্থক্যঃ


❏ প্রত্যেক বিদ্'আত গোমরাহী'র প্রকৃত অর্থঃ

❏ সাহাবীদের আবিষ্কার সুন্নাত, নাকি বিদ্'আত?

❏ খিলাফত শুধু ক্বোরায়শেই; 'ইমামত' (বাদশাহী) ব্যাপক।

                                                

❏ দরসে হাদীসঃ [হাদীস নং- (১৫৮)]

○ অধ্যায়ঃ [ক্বোরআন ও সুন্নাহ্'কে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা]

[ﻭﻋﻨﻪ ﻗﺎﻝ ﺻﻠﻰ ﺑﻨﺎﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﷺ ﺫﺍﺕ ﻳﻮﻡ ﺛﻢ ﺍﻗﺒﻞ ﻋﻠﻴﻨﺎ ﺑﻮﺟﻬﻪ ﻓﻮﻋﻈﻨﺎ ﻣﻮﻋﻈﺔ ﺑﻠﻴﻐﺔ ﺫﺭﻓﺖ ﻣﻨﻬﺎ ﺍﻟﻌﻴﻮﻥ ﻭﻭﺟﻠﺖ ﻣﻨﻬﺎ ﺍﻟﻘﻠﻮﺏ ﻓﻘﺎﻝ ﺭﺟﻞ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﻛﺎﻥ ﻫﺬﻩ ﻣﻮﻋﻈﺔ ﻣﻮﺩﻉ ﻓﺎﻭﺻﻨﺎ ﻓﻘﺎﻝ ﺍﻭﺻﻴﻜﻢ ﺑﺘﻘﻮﻯ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﺍﻟﺴﻤﻊ ﻭﺍﻟﻄﺎﻋﺔ ﻭﺍﻥ ﻛﺎﻥ ﻋﺒﺪﺍ ﺣﺒﺸﻴﺎ ﻓﺎﻧﻪ ﻣﻦ ﻳﻌﺶ ﻣﻨﻜﻢ ﺑﻌﺪﻯ ﻓﺴﻴﺮﻯ ﺍﺧﺘﻼﻓﺎ ﻓﻌﻠﻴﻜﻢ ﺑﺴﻨﺘﻰ ﻭﺳﻨﺔ ﺍﻟﺨﻠﻔﺂﺀ ﺍﻟﺮﺍﺷﺪﻳﻦ ﺍﻟﻤﻬﺪﻳﻴﻦ ﺗﻤﺴﻜﻮﺍﺑﻬﺎ ﻭﻋﻀﻮﺍ ﻋﻠﻴﻬﺎ ﺑﺎﻟﻨﻮﺍﺟﺬ ﻭﺍﻳﺎﻛﻢ ﻭﻣﺤﺪﺛﺎﺕ ﺍﻻﻣﻮﺭ ﻓﺎﻥ ﻛﻞ ﻣﺤﺪﺛﺔ ﺑﺪﻋﺔ ﻭﻛﻞ ﺑﺪﻋﺔ ﺿﻼﻟﺔ . ‏]

: ‏( ﺭﻭﺍﻩ ﺍﺣﻤﺪ ﻭﺍﺑﻮ ﺩﺍﺅﺩ ﻭﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻯ ﻭﺍﺑﻦ ﻣﺎﺟﺔ ﺍﻻ ﺍﻧﻬﻤﺎ ﻟﻢ ﻳﺬﻛﺮ ﺍﻟﺼﻠﻮﺓ )

তাঁরই (হযরত 'ইরবাদ্ব ইবনে সারিয়াহ্ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ) হতে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেছেন, "একদিন আমাদেরকে রাসূলাল্লাহ্ [ﷺ] নামায পড়ালেন। তারপর আমাদের দিকে চেহারা মুবারক ফিরিয়ে বসলেন এবং অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ওয়ায করলেন, যার প্রভাবে অশ্রু প্রবাহিত হলো, ভয়ে অন্তর কেঁপে ওঠলো। (টীকাঃ ১) এক ব্যক্তি আরয করলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ! সম্ভবত এটাই বিদায়-ভাষণ। (টীকাঃ ২) সুতরাং কিছু ওসীয়ত করুন! হুযূর এরশাদ করলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্'কে ভয় করার, বাদশাহ্'র কথা শ্রবণ ও আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছি, (টীকাঃ ৩) যদিও সে হাবশী গোলাম হয়। (টীকাঃ ৪) কেননা, আমার পরে তোমাদের মধ্যে যে জীবিত থাকবে সে প্রচুর মতপার্থক্য হতে দেখবে। (টীকাঃ ৫) সুতরাং তোমরা আমার এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফা-ই রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো। (টীকাঃ ৬) তা দাঁত দ্বারা মজবুতভাবে চেপে ধরো। প্রত্যেক নতুন কথাবার্তা থেকে দূরে থাকো। কেননা, প্রতিটি নতুন জিনিস বিদ্'আত এবং প্রত্যেক বিদ'আত গোমরাহী।" (টীকাঃ ০৭)

[এটা আহমদ, আবূ দাঊদ এবং তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ্ বর্ণনা করেছেন; কিন্তু (তাঁরা তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ্) উভয়েই নামাযের ঘটনা বর্ণনা করেন নি।]

□ উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখায় বলা হয়েছেঃ


                                   

১| (একদিন আমাদেরকে রাসূলাল্লাহ্ [ﷺ] নামায পড়ালেন। তারপর আমাদের দিকে চেহারা মুবারক ফিরিয়ে বসলেন এবং অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ওয়ায করলেন, যার প্রভাবে অশ্রু প্রবাহিত হলো, ভয়ে অন্তর কেঁপে ওঠলো।)

◇ টীকাঃ ১.

এমনিতেই হুযূর [ﷺ] -এর প্রতিটি ওয়াযই চিত্তাকর্ষক বা হৃদয়গ্রাহী হতো। কিন্তু বিশেষ করে এ ওয়ায অত্যন্ত প্রভাব সৃষ্টিকারী ছিলো। যা'তে খোদাপ্রেম ও আল্লাহ্'র ভয়ের সাগরে ঢেউ খেলছিল। ইশক্ব বা প্রেমের কারণে অশ্রু ঝরে এবং ভয়ের কারণে অন্তরে ভীতি সৃষ্টি হয়। ﺑﻠﻴﻎ (বালীগ) শব্দ দ্বারা 'প্রভাবপূর্ণ' বুঝায়।

২| (এক ব্যক্তি আরয করলেন, এয়া রাসূলাল্লাহ! সম্ভবত এটাই বিদায়-ভাষণ।)

◇ টীকাঃ ২.

অর্থাৎ হুযূরের ওফাত শরীফ নিকটবর্তী এবং তিনি তেমনভাবে কথা বলছেন, যেমন- বিদায়কালে বলা হয়। তিনি যেন আপন উম্মতকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এবং আখেরী উপদেশমালা প্রদান করছেন। সুবহানআল্লাহ্! সাহাবা-ই কেরামের তীক্ষ্ণ মেধাশক্তির উপর আমাদের প্রাণ উৎসর্গ হোক।

৩| (সুতরাং কিছু ওসীয়ত করুন! হুযূর এরশাদ করলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্'কে ভয় করার, বাদশাহ্'র কথা শ্রবণ ও আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছি)

◇ টীকাঃ ৩.

বুঝা গেলো যে, বাস্তবিকই হুযূরের ওফাত শরীফ নিকটবর্তী ছিলো, এজন্য তাঁদের কথা প্রত্যাখ্যান করা হয় নি; বরং আকাঙ্কা পূরণ করা হয়েছে। জানা গেলো যে, হুযূর আপন ওফাতের সময় সম্পর্কে জানেন এবং এটা এমন পূর্ণাঙ্গ বাণী যে, সমস্ত বিধান এতে এসে গেছে। ﺗﻘﻮﻯ ﺍﻟﻠﻪ (আল্লাহ্'র ভয়)'র মধ্যে সমস্ত দ্বীনী বিধান এবং বাদশাহ্'র আনুগত্য ও সমস্ত রাজনৈতিক বিধান রয়েছে।

৪| (যদিও সে হাবশী গোলাম হয়।)

◇ টীকাঃ ৪.

অর্থাৎ যদি তোমাদের বাদশাহ্ কালো হাবশী গোলামও হয়, তবুও তার আনুগত্য করো; তার বংশ ও গড়ন দেখো না। তার আদেশ মান্য করো।

স্মর্তব্য যে, 'খিলাফত' ক্বোরাঈশ বংশীয়দের জন্য নির্দিষ্ট; কিন্তু 'রাজত্ব' যে কোন মুসলমান লাভ করতে পারে। সুতরাং আলোচ্য হাদীস, এ হাদীস ﺍﻟﺨﻼﻓﺔ ﻣﻦ ﻗﺮﻳﺶ -এর বিরোধী নয়। তাছাড়া শাসকের আনুগত্য ওই সব বিধানে করা হবে, যেগুলো শরীয়ত বিরোধী নয়। তাছাড়া, শাসক হবার পরেই তার আনুগত্য করা হবে। ইয়াযীদ বৈধ শাসক হয় নি; হযরত হুসাইন [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ] তাকে শাসকই মানেন নি। সুতরাং তাঁর আমল এ হাদীসের বিরোধী নয়। শাসক বানানো এক কথা আর শাসক হবার পর আনুগত্য করা অন্য কথা।

৫| (কেননা, আমার পরে তোমাদের মধ্যে যে জীবিত থাকবে সে প্রচুর মতপার্থক্য হতে দেখবে।)

◇ টীকাঃ ৫.

রাজনৈতিক মতভেদও, ধর্মীয় মতভেদও। যেমনঃ হযরত ওসমান [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ]'র খিলাফতকালের শেষের দিকে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং হযরত আলী [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ]'র খিলাফতকালে রাজনৈতিক মতভেদের সাথে সাথে ধর্মীয় মতভেদও প্রকাশ পায়। যেমনঃ জবরিয়া, ক্বদরিয়া, রাফেযী, খারেজী (বাতিল সম্প্রদায়গুলো)'র উদ্ভব হলো।

স্মর্তব্য যে, আল্লাহ্'র অনুগ্রহক্রমে সম্মাণিত সাহাবীদের মধ্যে দ্বীনী মতভেদ সৃষ্টি হয় নি। সম্মাণিত সাহাবী সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। হুযূরের এ পবিত্র বাণী অত্যন্ত ব্যাপক এবং তাঁর এ পূর্বাভাস হুবহু সঠিক হয়েছিলো।

৬| (সুতরাং তোমরা আমার এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফা-ই রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো।)

◇ টীকাঃ ৬.

প্রত্যেক 'সুন্নাত' অনুসরণযোগ্য। কিন্তু প্রতিটি হাদীসের অনুসরণ করা যায় না। হুযূরের বৈশিষ্ট্যাবলী ( ﺧﺼﻮﺻﻴﺎﺕ ) সম্বলিত হাদীস, রহিত বিধান, আমলসমূহ ও হাদীস, কিন্তু 'সুন্নাত' নয়। এ জন্য এখানে হাদীসকে আঁকড়ে ধরার আদেশ দেওয়া হয় নি; বরং সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার জন্য বলা হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্, আমরা 'আহলে সুন্নাত'। দুনিয়ায় 'আহলে হাদীস' কেউ হতে পারে না। সাহাবা-ই কেরামের আমল এবং কার্যাবলীও শাব্দিক অর্থে 'সুন্নাত'; অর্থাৎ দ্বীনের উত্তম ত্বরীকা বা পন্থা; যদিও সেগুলোর উদ্ভাবন 'বিদ্আত-ই হাসানাহ্'। ফারুকে আযম হযরত ওমর [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ] যথারীতি তারাভীহ্'র নামায জামাত সহকারে চালু করেছিলেন, যাকে তিনি নিজেই বিদ্'আত বলেছেন। তিনি বলেন- ﻧﻌﻤﺖ ﺍﻟﺒﺪﻋﺔ ﻫﺬﻩ (এটা কতই উত্তম বিদ্'আত!) তাঁর এ বাণী আলোচ্য হাদীসের বিরোধী নয়। কেননা, তা শরীয়তের ভাষায় বিদ'আত, আভিধানিক অর্থে সুন্নাত। অথচ মুসলমানদের জন্য তা একটি বাধ্যতামূলক করণীয়।

স্মর্তব্য যে, সমস্ত সাহাবী হিদায়াতের নক্ষত্র। বিশেষতঃ খোলাফা-ই রাশিদীন। সুতরাং আলোচ্য হাদীস এই হাদীসের বিরোধী নয়- ﺍﺻﺤﺎﺑﻰ ﻛﺎﻟﻨﺠﻮﻡ (আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য)। প্রত্যেক সাহাবীর অনুসরণই নাজাতের মাধ্যম।

৭| (তা দাঁত দ্বারা মজবুতভাবে চেপে ধরো। প্রত্যেক নতুন কথাবার্তা থেকে দূরে থাকো। কেননা, প্রতিটি নতুন জিনিস বিদ্'আত এবং প্রত্যেক বিদ'আত গোমরাহী।)

◇ টীকাঃ ৭.

এখানে 'নতুন জিনিস' দ্বারা 'নতুন আক্বীদা' বুঝানো উদ্দেশ্য, যা ইসলামে হুযূরের পরে উদ্ভাবিত হয়েছে। এ জন্য যে, এখানে সেটাকে গোমরাহী বলা হয়েছে। গোমরাহী আক্বীদাতেই হয়ে থাকে, আমলে নয়। সুতরাং এ হাদীস আপন স্থানে ব্যাপকার্থক। সুতরাং ক্বাদিয়ানী, চকড়ালভী, রাফেযী ও খারেজী -এ সবই বিদ'আত ও গোমরাহী।

আর যদি এটা দ্বারা 'নতুন আমল' বুঝানো উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এ হাদীসটি ﻋﺎﻡ ﻣﺨﺼﻮﺹ ﺍﻟﺒﻌﺾ অর্থাৎ প্রতিটি মন্দ বিদ্আতই গোমরাহী। 'বিদ্আত-ই হাসানাহ্' (উত্তম বিদ্'আত) কখনো মুবাহ্, কখনো মুস্তাহাব, কখনো ওয়াজিব এবং কখনো ফরযও হয়ে যায়। হাদীসের কিতাবসমূহ এবং ক্বোরআনের পারাগুলো বিদ্'আত; কিন্তু উত্তম বিদ্'আত। এর গবেষণালব্ধ বিশ্লেষণ ইতোপূর্বে করা হয়েছে।


□ হাদীস শরীফের ব্যাখ্যা সম্বলিত টীকা পেতে সার্চ করুনঃ

f/Ishq-E-Mustafa ﷺ

[সূত্রঃ মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, কৃত- মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী আশরাফী বদায়ূনী, বঙ্গানুবাদঃ মাওলানা আব্দুল মান্নান, ১ম খন্ড, পৃ. ১৭০,১৭১ হাদীস নং-১৫৮ এর টীকাঃ (৯১-৯৭) দ্রব্যষ্ট, প্রকাশনায়ঃ ইমাম আহমদ রেযা রিসার্চ একাডেমী, চট্টগ্রাম।


❏ বিদ্আতের প্রকারভেদের পক্ষে মজবুত দলীলঃ

                                          

❏ দরসে হাদীসঃ [হাদীস নং- (১৬১)]

○ অধ্যায়ঃ [ক্বোরআন ও সুন্নাহ্'কে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা]

[ﻭﻋﻦ ﺑﻼﻝ ﺑﻦ ﺍﻟﺤﺎﺭﺙ ﺍﻟﻤﺰﻧﻰ ﻗﺎﻝ ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﷺ ﻣﻦ ﺍﺣﻰ ﺳﻨﺔ ﻣﻦ ﺳﻨﺘﻰ ﻗﺪ ﺍﻣﻴﺘﺖ ﺑﻌﺪﻯ ﻓﺎﻥ ﻟﻪ ﻣﻦ ﺍﻻﺟﺮ ﻣﺜﻞ ﺍﺟﻮﺭ ﻣﻦ ﻋﻤﻞ ﺑﻬﺎ ﻣﻦ ﻏﻴﺮ ﺍﻥ ﻳﻨﻘﺺ ﻣﻦ ﺍﺟﻮﺭﻫﻢ ﺷﻴﺌﺎ ﻭﻣﻦ ﺍﺑﺘﺪﻉ ﺑﺪﻋﺔ ﺿﻼﻟﺔ ﻻﻳﺮﺿﻬﺎ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﺭﺳﻮﻟﻪ ﻛﺎﻥ ﻋﻠﻴﻪ ﻣﻦ ﺍﻻﺛﻢ ﻣﺜﻞ ﺍﺛﺎﻡ ﻣﻦ ﻋﻤﻞ ﺑﻬﺎ ﻻ ﻳﻨﻘﺾ ﺫﻟﻚ ﻣﻦ ﺍﻭﺯﺍﺭﻫﻢ ﺷﻴﺌﺎ - ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻯ ﻭﺭﻭﺍﻩ ﺍﺑﻦ ﻣﺎﺟﺔ ﻋﻦ ﻛﺜﻴﺮ ﺑﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﻋﻤﺮ ﻭﻋﻦ ﺍﺑﻴﻪ ﻋﻦ ﺟﺪﻩ]

অর্থাৎঃ হযরত বেলাল ইবনে হারিস মুযানী (টীকাঃ ১) [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ] হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলাল্লাহ্ [ﷺ] এরশাদ করেনঃ

"যে ব্যক্তি আমার মৃত সুন্নাতকে, যা আমার পরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, জীবিত করবে, (টীকাঃ ২) সে ওইসব লোকের সমান সাওয়াব পাবে, যারা তদনুযায়ী আমল করে- ওইসব আমলকারীর সাওয়াবের মধ্যে হ্রাস পাওয়া ছাড়াই। (টীকাঃ ৩) আর যে ব্যক্তি এমন ভ্রান্ত বিদ্'আত উদ্ভাবন করবে, যাতে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল অসন্তুষ্ট, (টীকাঃ ৪) তার উপর ওইসব লোকের সমান গুনাহ্ বর্তাবে, যারা তদনুযায়ী আমল করবে; আর এতে তাদের গুনাহ্ হতে কিছুই হ্রাস পাবে না।

এ হাদীস ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে মাজাহ্ হাদীসটি কাসীর ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে 'আমর হতে বর্ণনা করেছেন এ ধারায়- তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন। (টীকাঃ ৫)

□ উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখায় বলা হয়েছেঃ


                                   

১. (হযরত বেলাল ইবনে হারিস মুযানী [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ])

◇ টীকাঃ ১.

তিনি সাহাবী। ৫ম হিজরীতে মুযাইনাহ্ গোত্রের প্রতিনিধিদলের মধ্যে হুযূরের খেদমতে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ বরেন। ৮০ বছর বয়সে ৬০ হিজরীতে ওফাত পা। মদীনা মুনাওয়ারার নিকটে আশ'আর নামক স্থানে বসবাস করেন।

২. (যে ব্যক্তি আমার মৃত সুন্নাতকে, যা আমার পরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, জীবিত করবে)

◇ টীকাঃ ২.

অর্থাৎ যে সুন্নাত মুসলিম সমাজ ছেড়ে দিয়েছে, তা নিজেও আমল করে এবং অন্যদেরকেও আমল করার প্রতি উৎসাহিত করে। যেমনঃ বর্তমান যুগে দাঁড়ি রাখা।

৩. (সে ওইসব লোকের সমান সাওয়াব পাবে, যারা তদনুযায়ী আমল করে- ওইসব আমলকারীর সাওয়াবের মধ্যে হ্রাস পাওয়া ছাড়াই।)

◇ টীকাঃ ৩.

কেননা, আল্লাহ্'র এ বান্দা সুন্নাতকে জীবিত করার ক্ষেত্রে মানুষের তিরষ্কার ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ সহ্য করে। সুন্নাতের খাতিরে সব কষ্ট সহ্য করে থাকে। সুতরাং সে বড় মুজাহিদ। কোন উত্তম কাজের উদ্ভাবনকারী যে সাওয়াব পাবে সেটার প্রচার-প্রসারকারীও একই সাওয়াব পাবে।

৪. (আর যে ব্যক্তি এমন ভ্রান্ত বিদ্'আত উদ্ভাবন করবে, যাতে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল অসন্তুষ্ট)

◇ টীকাঃ ৪.

এখানে ﺑﺪﻋﺔ শব্দটি ﻣﻮﺻﻮﻑ (বিশেষিত) এবং ﺿﻼﻟﺔ শব্দটি ﺻﻔﺖ (বিশেষণ); আর ﻧﻜﺮﻩ (অনির্দিষ্ট বিশেষ্য) দ্বারা ﻧﻜﺮﻩ (অনির্দিষ্ট বিশেষ্য)কে বিশেষিত করা হলে ﺗﺨﺼﻴﺺ বা নির্দিষ্টকরণের অর্থ বুঝায়। এখানে ﺑﺪﻋﺔ কে ﺿﻼﻟﺔ (ভ্রান্তি) দ্বারা বিশেষিত করা 'বিদ্আত-ই হাসানাহ্' (উত্তম বিদ্'আত)কে পৃথক করে দেওয়ার জন্যই। [মিরক্বাত] অর্থাৎ মন্দ বিদ্আতসমূহের উদ্ভাবক জঘন্য অপরাধী। যেমনঃ উর্দূ ভাষায় ক্বিরাত ও আযান বলা, অথবা অন্য সব সুন্নাতবিরোধী কাজ। পক্ষান্তরে, উত্তম বিদ্'আতগুলোর উদ্ভাবক সাওয়াবের উপযোগী হবে। যেমনঃ ইলম-ই সরফ (শব্দপ্রকরণ) ও ইলম-ই নাহ্ভ (আরবী ব্যাকরণ)'র আবিষ্কারক, দ্বীনী মাদরাসাসমূহ বুযুর্গের ওরস, মীলাদ শরীফ এবং গেয়ারভী শরীফের মাহফিলের প্রবর্তক। এর আলোচনা ইতোপূর্বে করা হয়েছে। এ হাদীস বিদ্'আতের প্রকারভেদ বিন্যস্ত করার উৎস। 'কিতাবুল্ ইলম'-এও এ বিষয়ে আলোচনা আসবে।

৫. (এ হাদীস ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে মাজাহ্ হাদীসটি কাসীর ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে 'আমর হতে বর্ণনা করেছেন এ ধারায়- তিনি তাঁর পিতা হতে, তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেছেন।)

◇ টীকাঃ ৫.

কাসীর ইবনে 'আমর সর্বসম্মতিক্রমে দুর্বল বর্ণনাকারী। ইমাম শাফে'ঈ [ﺭﺣﻤﻪ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ] বলেন, "লোকটি বড় মিথ্যুক ছিলো।" তার দাদা আমর ইবনে 'আউফ সাহাবী ছিলেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলাম ক্রহণ করেন। তাঁরই প্রসঙ্গে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়- [ﺗَﻮَﻟَّﻮﺍ ﻭَّﺃَﻋْﻴُﻨُﻬُﻢْ ﺗَﻔِﻴﺾُ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺪَّﻣْﻊِ] (ফলে, তারা এভাবে ফিরে যায় যে, তাতের চোখগুলো থেকে অশ্রু বিগলিত হতে থাকে। ৯:৯২) তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করেন এবং হযরত আমীর-ই মু'আবিয়া [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ]'র শাসনামলে ওফাত পান। বদরের যুদ্ধে হুযূর [ﷺ]'র সাথেই ছিলেন।

[সূত্রঃ মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, কৃত- মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী আশরাফী বদায়ূনী, বঙ্গানুবাদঃ মাওলানা আব্দুল মান্নান, ১ম খন্ড, পৃ. ১৭২,১৭৩ হাদীস নং-১৬১ এর টীকাঃ (১০২-১০৬) দ্রব্যষ্ট, প্রকাশনায়ঃ ইমাম আহমদ রেযা রিসার্চ একাডেমী, চট্টগ্রাম।]


❏ 'বিদ্আত-ই সাইয়্যেহ্' (মন্দ বিদ্'আত) হচ্ছে সেটাই, যা সুন্নাত'কে নিশ্চিহ্ন করেঃ

                                             

                         

❏ দরসে হাদীসঃ [হাদীস নং- (১৭৮)]

○ অধ্যায়ঃ [ক্বোরআন ও সুন্নাহ্'কে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা]

[ﻭﻋﻦ ﻏﻀﻴﻒ ﺍﺑﻦ ﺍﻟﺤﺎﺭﺙ ﺍﻟﺜﻤﺎﻟﻰ ﻗﺎﻝ ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﷺ ﻣﺎ ﺍﺣﺪﺙ ﻗﻮﻡ ﺑﺪﻋﺔ ﺍﻻ ﺭﻓﻊ ﻣﺜﻠﻬﺎ ﻣﻦ ﺍﻟﺴﻨﺔ ﻓﺘﻤﺴﻚ ﺑﺴﻨﺔ ﺧﻴﺮ ﻣﻦ ﺍﺣﺪﺍﺙ ﺑﺪﻋﺔ . ‏] : ‏( ﺭﻭﺍﻩ ﺍﺣﻤﺪ )

অর্থাৎঃ হযরত গুদ্বায়ফ ইবনে হারিস সুমালী (টীকাঃ ১) [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ] হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলাল্লাহ্ [ﷺ] এরশাদ করেনঃ

"কোন সম্প্রদায় বিদ্'আত উদ্ভাবন করে না, কিন্তু অনুরুপ সুন্নাত উঠিয়ে নেওয়া হয়। (টীকাঃ ২) সুতরাং সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা বিদ্'আত উদ্ভাবন করা থেকে উত্তম।" (টীকাঃ ৩)

[আহমদ]

□ উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখায় বলা হয়েছেঃ


                                   

১. (হযরত গুদ্বায়ফ ইবনে হারিস সুমালী [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ]।)

◇ টীকাঃ ১.

তাঁর সাহাবী হওযার বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ইবনে হাব্বান 'কিতাবুস্ সিক্বাত' গ্রন্থে বলেছেন, হযরত গুদ্বায়ফ বলেছেন, "আমি হুযূরের যুগে জন্মগ্রহণ করেছি এবং বাল্যকালেই তাঁর সাথে করমর্দন ও বায়্'আত্ গ্রহণ করেছি।" যদি এ বর্ণনা সহীহ্ হয়, তাহলে তিনি সাহাবী। 'সুমালা' 'বনী আযদ' গোত্রের একটি শাখা, যার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলো, এ জন্যই তাঁকে সুমালী বলা হতো।

২. (কোন সম্প্রদায় বিদ্'আত উদ্ভাবন করে না, কিন্তু অনুরুপ সুন্নাত উঠিয়ে নেওয়া হয়।)

◇ টীকাঃ ২.

এ হাদীস ওই সব হাদীসের ব্যাখ্যা, যেগুলোতে বিদ্'আতের কুফলের বর্ণনা এসেছে। অর্থাৎ মন্দ বিদ্'আত হচ্ছে ওই আমল, যা সুন্নাতের বিপরীত উদ্ভাবন করা হয়, যে অনুসারে আমল করলে, সুন্নাত উঠে যায়। যেমনঃ আরবীতে নামাযের খোতবা ও আযান দেওয়া। এখন এগুলো (বাংলায় কিংবা) উর্দূতে সম্পন্ন করলে তা এ সুন্নাতকে বিদায় করে দেবে। কারণ, উর্দূতে আযান সম্পন্নকারী আরবীতে দিতে পারছেনা। অনুরুপ, মাথা ঢেকে পায়খানায় যাওয়া সুন্নাত। খালি মাথায় পায়খানায় গমনকারী এই সুন্নাতের উপর আমল করতে পারে। প্রতিটি মন্দ বিদ্'আতের এ-ই অবস্থা। ছোট বিদ্'আত ছোট সুন্নাত'কে বিলুপ্ত করে ফেলে এবং বড় বিদ্'আত বড় সুন্নাত'কে। ﻣﺜﻠﻬﺎ দ্বারা এটাই বুঝানো উদ্দেশ্যে। 'বিদ্'আত-ই হাসানাহ্' (উত্তম বিদ্'আত) কোন সুন্নাত'কে বিলুপ্ত করে না; বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা সুন্নাতের প্রসার করে। দেখুন- ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেওয়া সুন্নাত। সুতরাং এর জন্য কিতাবাদি ছাপানো, মাদরাসা তৈরী করা, সেখানে পাঠদানের পাঠ্যতালিকা ও কোর্স চালু করা, যদিও বিদ্'আত বা নব উদ্ভাবিত, কিন্তু এগুলো সুন্নাতের সহায়ক; পরিপন্থী নয়। বুযুর্গ লোকদের স্মৃতিস্মারক প্রতিষ্ঠা করা সুন্নাত। সুতরাং সে জন্য মীলাদ শরীফের মাহফিল, ওরসের অনুষ্ঠান ইত্যাদি ক্বায়েম করা এর সহায়ক; পরিপন্থী নয়। এ স্থানে 'মিরক্বাত' প্রণেতা বলেছেন, "বিদ্আত-ই হাসানাহ্' সুন্নাতের সাথে সংশ্লিষ্ট।

৩. (সুতরাং সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা বিদ্'আত উদ্ভাবন করা থেকে উত্তম।)

◇ টীকাঃ ৩.

এখানে ﺧﻴﺮ (কল্যাণ), ﺷﺮ (মন্দ) -এর মোকাবেলায় এসেছে। অর্থাৎ মন্দ বিদ্'আতগুলো উদ্ভাবন করা মন্দ এবং এর বিপরীতে সুন্নাত অনুসারে আমল করা উত্তম। কেননা, সুন্নাতের মধ্যে 'নূর' রয়েছে এবং মন্দ বিদ্'আতে অন্ধকার রয়েছে। এ অর্থ নয় যে, মন্দ বিদ্'আতগুলোও ঠিক; কিন্তু সুন্নাতসমূহ উত্তম।

[সূত্রঃ মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, কৃত- মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী আশরাফী বদায়ূনী, বঙ্গানুবাদঃ মাওলানা আব্দুল মান্নান, ১ম খন্ড, পৃ. ১৮৪, হাদীস নং-১৭৮ এর টীকাঃ (১৪৫-১৪৭) দ্রব্যষ্ট, প্রকাশনায়ঃ ইমাম আহমদ রেযা রিসার্চ একাডেমী, চট্টগ্রাম।]


❏ দরসে হাদীসঃ [হাদীস নং- (১৭৯)]

○ অধ্যায়ঃ [ক্বোরআন ও সুন্নাহ্'কে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা]

[ﻭﻋﻦ ﺣﺴﺎﻥ ﻗﺎﻝ ﻣﺎ ﺍﺑﺘﺪﻉ ﻗﻮﻡ ﺑﺪﻋﺔ ﻓﻰ ﺩﻳﻨﻬﻢ ﺍﻻ ﻧﺰﻉ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﻦ ﺳﻨﺘﻬﻢ ﻣﺜﻠﻬﺎ ﺛﻢ ﻻﻳﻌﻴﺪﻫﺎ ﺍﻟﻴﻬﻢ ﺍﻟﻰ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﻤﺔ . ‏]

: ‏( ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺪﺍﺭﻣﻰ )

অর্থাৎঃ হযরত হাসান (টীকাঃ ১) [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ] হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

"কোন সম্প্রদায় স্বীয় দ্বীনে বিদ্'আত উদ্ভাবন করে না, কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা তাদের কাছ থেকে অনুরুপ সুন্নাত উঠিয়ে নেন। (টীকাঃ ২) তারপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত সেটা তাদের মধ্যে ফিরিয়ে দেন না।" (টীকাঃ ৩)

[দারেমী]

□ উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখায় বলা হয়েছেঃ


                                   

১. (হযরত হাসান [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ])

◇ টীকাঃ ১.

তাঁর নাম মুবারক হাস্সান ইবনে সাবিত, উপনাম 'আবুল ওয়ালীদ'। তিনি আনসারী, খাযরাজ গোত্রীয়। তিনি আরব কবিদের শিরমণি। হুযূরের প্রিয় কবি এবং হুযূর মোস্তফা [ﷺ]'র প্রশংসাযুক্ত কবিতা আবৃত্তিকারী। তাঁর জন্য হুযূর স্বীয় মসজিদে মিম্বর শরীফ স্থাপন করতেন, যার উপর দাঁড়িয়ে হুযূরের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি হুযূরের প্রশংসামূলক ক্বসীদা আবৃত্তি করতেন। তিনি একশ' বিশ বছর বয়স পান। ৪০ হিজরীর কিছু পূর্বে হযরত আলী [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ]'র খেলাফতকালে ওফাত পান। (ইমাম ইবনে আব্দুল বার মালিকী তাঁর ওফাতের সন তিনটি উল্লেখ করেছেন: উল্লিখিত সন, ৫০ হিজরী ও ৫৪ হিজরী। |আল্ ইস্তী'আব|)

ইন্শা-আল্লাহ্! ক্বিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত নাত পরিবেশনকারী হযরত হাস্সান [ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ]'র পতাকাতলে থাকবেন। যেমনঃ এরশাদ হচ্ছে-

[ﻳَﻮْﻡَ ﻧَﺪْﻋُﻮ ﻛُﻞَّ ﺃُﻧَﺎﺱٍ ﺑِﺈِﻣَﺎﻣِﻬِﻢْ]

(যে দিন আমি প্রত্যেক দলকে আহ্বান করবো তাদের ইমাম সহকারে। |১৭:৭১|)

২. (কোন সম্প্রদায় স্বীয় দ্বীনে বিদ্'আত উদ্ভাবন করে না, কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা তাদের কাছ থেকে অনুরুপ সুন্নাত উঠিয়ে নেন।)

◇ টীকাঃ ২.

এর ব্যাখ্যা ইতোপূর্বে করা হয়েছে। 'দ্বীন'র শর্তারোপ করা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, 'বিদ্আত-ই সায়্যিআহ্' (মন্দ বিদ্'আত) সর্বদা দ্বীনের মধ্যে উদ্ভাবিত হবে। দুনিয়াবী আবিষ্কারগুলোকে 'বিদ্আত-ই সায়্যিআহ্' বলা যাবে না। বিদ্'আতের যত কুফল বর্ণিত হয়েছে, সবই ওই বিদ্'আত সম্পর্কে বুঝানো হয়েছে, যা দ্বীনের মধ্যে উদ্ভাবিত হয়েছে এবং যা সুন্নাত'কে বিলুপ্ত করে দেয়। আর যদি 'দ্বীন' দ্বারা আক্বাইদ বুঝানো উদ্দেশ্য হয়, যেমন- বাহ্যিকভাবে বুঝা যায়, তাহলে হাদীসের অর্থও সুস্পষ্ট।

৩. (তারপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত সেটা তাদের মধ্যে ফিরিয়ে দেন না।)

◇ টীকাঃ ৩.

অর্থাৎ মন্দ বিদ্'আত যে সম্প্রদায়ের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তনের তাওফীক্ব বা সামর্থ্য তাদের অর্জিত হয় না। সুন্নাত হচ্ছে বৃক্ষস্বরুপ এবং ওই সব বিদ্'আত হচ্ছে সেটার জন্য কোদালস্বরুপ। যখন বৃক্ষকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলা হয়, তখন সেগুলো আর তাতে সংযুক্ত হয় না।

[সূত্রঃ মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, কৃত- মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী আশরাফী বদায়ূনী, বঙ্গানুবাদঃ মাওলানা আব্দুল মান্নান, ১ম খন্ড, পৃ. ১৮৪,১৮৫, হাদীস নং-১৭৯ এর টীকাঃ (১৪৮-১৫০) দ্রব্যষ্ট, প্রকাশনায়ঃ ইমাম আহমদ রেযা রিসার্চ একাডেমী, চট্টগ্রাম।

Top