বিষয় নং-০৬: (لَوْلاكَ لَمَا خَلَقْتُ الأَفْلاكِ) ‘রাসূল (ﷺ) সৃষ্টি না হলে কিছুই সৃষ্টি হত না’ হাদিসের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ:


মাওলানা মুতীউর রহমান ‘এসব হাদীস নয়’ গ্রন্থের ১৬৩ পৃষ্ঠায় এ হাদিস নিয়ে লিখেছেন-‘‘এটা লোকমুখে হাদীসে কুদসী হিসেবে যথেষ্ট প্রসিদ্ধ। অথচ হাদীস বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে একমত যে, এটা একটা ভিত্তিহীন রেওয়ায়েত। রাসূল (ﷺ)-এর হাদিসের সঙ্গে এর সামান্যতম সম্পর্কও নেই।’’ 


উক্ত গ্রন্থের ১৬৪ পৃষ্ঠায় আরও লিখেছেন-“আল্লাহ তা‘আলা এই দুনিয়া ও সমগ্র জগৎ কেন সৃষ্টি করলেন তা জানার একমাত্র উপায় ওহী। ওহী শুধু কুরআন ও হাদীসেই সীমাবদ্ধ। যতক্ষণ পর্যন্ত কুরআনের আয়াত বা সহীহ হাদিসের মাধ্যমে এ কথা প্রমাণিত না হবে যে, একমাত্র তাঁর খাতিরেই সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে, ততক্ষণ এই আক্বীদা রাখার সুযোগ নেই।’’ 

অথচ উক্ত বইয়ে সে কোন মুহাদ্দিসের রায় ইবারত সহ উপস্থাপন করতে পারে নি।


অপরদিকে মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী সম্পাদিত ‘প্রচলিত জাল হাদীস’ ৫৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,-‘‘এ বাক্যটি হাদীসে কুদ্সী হিসেবে অনেক মহলে প্রসিদ্ধ। অথচ হাদীস শাস্ত্রের বিজ্ঞ ইমামগণ বাক্যটিকে মাওজু এবং ভিত্তিহীন রেওয়ায়েত বলে অভিহিত করেছেন।’’


তথাকথিত আরেক লেখক ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের ঈমান বিধ্বংসীকারী পুস্তক “হাদীসের নামে জালিয়াতি” এর ৩০৪ পৃষ্ঠায় এ হাদিস উল্লেখ করার পূর্বে লিখেছেন-‘‘এ ধরনের বানোয়াট কথাগুলোর একটি।’’ 

তিনি আরও একটু অগ্রসর হয়ে ৩০৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেন-‘‘মুহাদ্দিস একবাক্যে কথাটিকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ এ শব্দে এ বাক্য কোনো হাদীসের গ্রন্থে কোনো প্রকার সনদে বর্ণিত হয়নি।’’ 


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! এই জালিয়াতীকারী ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তো বললেন এ হাদিসটির কোন সনদই নেই; কিন্তু অন্যতম শীষ্য ড. মুহাম্মদ মানজুরুর রহমান তার লিখিত ‘মাউযু’ হাদীস বা প্রচলিত জাল হাদীস’ গ্রন্থের ১০৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘‘হাদীসটির সনদ মিথ্যা, বানোয়াট, আপত্তিকর ও অত্যন্ত দুর্বল বলে সাব্যস্ত।’’

আরেক আহলে হাদিস ড. খ ম আব্দুর রাজ্জাক এর লিখা জালিয়াতী গ্রন্থ ‘প্রচলিত ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন’ এর ৫১ পৃষ্ঠায় এ হাদিস সম্পর্কে লিখেন-‘‘হাদীস বিশারদগণ উল্লেখিত হাদীসটিকে একবাক্যে এটিকে বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন।’’ 


আহলে হাদিসদের তথাকথিত ইমাম নাসীরুদ্দীন আলবানী তার ‘সিলসিলাতুল আহাদিসিদ-দ্বঈফাহ’ গ্রন্থে এ হাদিস প্রসঙ্গে লিখেন-

موضوع. كما قاله الصغاني في  الأحاديث الموضوعة

-‘‘হাদিসটি জাল বা বানোয়াট, যেমনটি আল্লামা সাগানী তার মাওদ্বু হাদিসের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।’’ (আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দ্বঈফাহ, ১/৪৫০ পৃ. হা/২৮২) 


এবার আমরা দেখবো বিভিন্ন এখতিলাফী সমাধান সংক্রান্ত হাদিসের কিতাবসমূহে এ হাদিস সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ কী বলেছেন, আর বাস্তবতাই এ বিষয়টি প্রমাণিত কিনা।


ক. দেওবন্দী ও আহলে হাদিসদের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি আল্লামা আবুল হাসানাত আব্দুল হাই লাখনৌভী লিখেন-

لَكِن مَعْنَاهُ صَحِيح فقد روى الديلمي عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ مَرْفُوعًا: أَتَانِي جِبْرِيلُ فَقَالَ، قَالَ اللَّهُ يَا مُحَمَّدُ! لَوْلاكَ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَوْلاكَ مَا خَلَقْتُ النَّارَ

-‘‘তবে এ হাদিসটির মমার্থ সহীহ বা বিশুদ্ধ। কেননা, ইমাম দায়লামী (رحمة الله) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে মারফূ সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ)  ইরশাদ করেন, আমার নিকট একদা হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) আগমন করে বললেন, আপনার মহান রব বলেছেন,  হে মুহাম্মদ! আমি যদি আপনাকে সৃজন না করতাম না বানাতাম জান্নাত, না জাহান্নাম। (লাখনৌভী, আছাররুস সুনান, ৪৪ পৃ.) বুঝা গেল ইতোপূর্বের একজন মৌলভীও এ হাদিসটির বিষয়ে মাওলানা লাখনৌভির এ অভিমত উল্লেখ করেননি, উল্লেখ না করার কারণ হলো তাদের কাজই রাসূল (ﷺ)-এর শান ও মানকে গোপন করা, আর তাদের গোপন করার পিছনে রয়েছে এক বিশাল কালো শক্তির মদদ।


খ. দশম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) তাঁর লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মওদ্বুআতুল কাবীর’ এ উক্ত হাদিস  لَوْلَاكَ لَمَا خَلَقْتُ الْأَفْلَاك সম্পর্কে বলেন,  

قَالَ الصَّغَانِيُّ إِنَّهُ مَوْضُوعٌ كَذَا فِي الْخُلَاصَةِ لَكِنَّ مَعْنَاهُ صَحِيحٌ فَقَدْ رَوَى أَتَانِي جِبْرِيلُ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ النَّارَ وَفِي رِوَايَةِ ابْنِ عَسَاكِرَ لَوْلَاكَ مَاخلقت الدنيا- 

-‘‘আল্লামা সাগানী বলেন, لَوْلَاكَ لَمَا خَلَقْتُ الْأَفْلَاك এই হাদিসটি শব্দগতভাবে مَوْضُوعٌ বা জাল  (কিন্তু অর্থের দিক দিয়ে مَوْضُوعٌ নয়), আমি (মোল্লা আলী ক্বারী ) বলি, এর মর্মার্থ বা বিষয়বস্তু সঠিক। কেননা,  ইমাম দায়লামী (رحمة الله) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে মারফূ সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (ﷺ)  ইরশাদ করেন, আমার নিকট একদা হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) আগমন করে বললেন, আপনার মহান রব বলেছেন, হে মুহাম্মদ! আমি যদি আপনাকে সৃজন না করতাম না বানাতাম জান্নাত, না জাহান্নাম। ইমাম ইবনে আসাকির (رحمة الله) এর বর্ণনায় [হযরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত] এসেছে, আপনাকে সৃজন না করলে আমি দুনিয়া সৃষ্টি করতাম না।’’ ৬৪

৬৪.     মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফুআ, ২৯৬ পৃ. হা/৩৮৫


গ. অনুরূপ আল্লামা আজলূনী আশ-শাফেয়ী (رحمة الله) বলেন, 

قال الصغانى موضوع ، واقول لكن معناه صَحِيحٌ

-‘‘ইমাম সাগানী (رحمة الله) বলেন,  হাদিসটি শব্দগতভাবে বানোয়াট,  তবে আমি বলি উক্ত হাদিসের মর্মার্থ বা বিষয়বস্তু সহীহ বা বিশুদ্ধ (কারণ এ প্রসঙ্গে অনেক হাদিস রয়েছে)।  ৬৫

৬৫.     আল্লামা আজলূনী : কাশদুল খাফা : ২/১৪৮ পৃ. হা/২১২১


আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) লিখেন-

كما قال رسول الله ﷺ : أول ما خلق الله روحي وسائر الأرواح، إنما خلق ببركة روحه ونور وجوده كما روي لولاك لولاك لما خلقت الأفلاك فإنه صحيح

-‘‘এমনিভাবে রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, সমস্ত রূহ সমূহের মধ্যে মহান আল্লাহ আমার রূহকে প্রথমে সৃজন করেছেন। আর সবকিছু আমার রূহ এবং নূরের বরকতের পরশে সৃষ্টি ও অস্তিত্ব লাভ করেছে। যেমন বর্ণিত আছে, মহান রব ইরশাদ করেছেন, হে পিয়ারা হাবীব! আপনাকে সৃজন না করলে আমি কোনো কিছুই সৃষ্টি করতাম না। নিশ্চয়ই এ কথা বিশুদ্ধ.....।’’ (আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী, শরহে শিফা, ১/১৩ পৃ.)


আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) ‘মাদারেজুন নবুয়ত’ নামক সিরাত গ্রন্থের হাদিস হিসেবে, لَوْلَاكَ لَمَا خَلَقْتُ الْأَفْلَاك-‘আপনাকে সৃষ্টি না করলে কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না’ উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ মুহাদ্দিসগণ الْأَفْلَاك নিয়ে মন্তব্য করেছেন। রাসূল (ﷺ)  এর একটি উপাধি হল সাহেব-ই-লাওলাক। الْأَفْلَاك শব্দটি فَلَكٌ এর বহুবচন। মূলতفلك  শব্দের অর্থ হল মন্ডল। গ্রীক দার্শনিকদের মতে মন্ডল বারটি। বারি মন্ডল,  বায়ু মন্ডল,  অগ্নিমন্ডল, সাত আসমান সাতটি মন্ডল, আরশ মন্ডল, কুরসি মন্ডল। এ সব মন্ডলকে الْأَفْلَاك বলা হয়ে থাকে। 


আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) লিখেন-

(الأفلاك) أي انهدامها وتغيرها وانتقالها من أوضاعها بالكلية

-‘‘বস্তুর মূল উপাদান থেকে স্থানান্তরযোগ্য, পরিবর্তনশীল এবং ধ্বংসযোগ্যই হলো الْأَفْلَاك তথা মহাবিশ্ব।’’ (মোল্লা আলী ক্বারী, শরহে শিফা, ২/৫২২ পৃ.)


(الأفلاك) শব্দের ব্যাখ্যায় আনোওয়ার শাহ কাশ্মীরী লিখেন-

قال الشيخ الأكبر: إن الأفلاك إحدى عشر

-‘‘শাইখে আকবর মহিউদ্দিন ইবনে আরাবী (رحمة الله) বলেন, নিশ্চয়ই الْأَفْلَاك (মহাবিশ্ব) এর সংখ্যা ১১ টি।’’ (আনোওয়ার শাহ কাশ্মীরী, আরফযু সাযী, ৪/৫৬ পৃ. হা/২৪৩০-এর আলোচনায়)


নিম্নের আমি কতিপয় হাদিসে পাক আমি উল্লেখ করবো যেখানে সরাসরি الْأَفْلَاك শব্দটি ব্যবহার না হয়ে বার মন্ডলের কথা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এজন্য মুহাদ্দিস আল্লামা সাগানী তার খুলাসা গ্রন্থে الْأَفْلَاك শব্দটি বিশুদ্ধ নয় বলেছেন। আর একমাত্র আল্লামা সাগানীই এই শব্দটি মন্তব্য করেন, আর তার এ রায়কেই অনেকে তাদের গ্রন্থে নকল করেছেন। 


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! ইতোপূর্বে যে সমস্ত আলেমদের উদ্ধিৃতি দিয়েছে তাদের একজনও এ হাদিসটিকে শব্দগতভাবে প্রমাণিত না হলেও মমার্থ বিশুদ্ধ নয় বলেননি, আমি আশ্চর্যিত হয়ে যাই তখন যখন দেখি (মমার্থ বিশুদ্ধ বলেছে এমন মুহাদ্দিসদের) কিতাবের হাওয়ালা তাদের টীকায় দৃষ্টিগোচর হয়, এ সমস্ত ধোঁকাবাজ এ কিতাব পড়া সত্ত্বেও তারা এভাবেই সত্য গোপন করে যাচ্ছে অবিরত। তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য একটি-ই, কিভাবে রাসূল (ﷺ)-এর শান-মানকে ছোট করা যায়। মহান রব যেন আমাদেরকে এ সমস্ত ধোঁকাবাজদের থেকে আমাদের ঈমান ও আমলকে হিফাযত করেন। আমিন


এবার আমি আলোচনা করবো এ হাদিসটির সমর্থনে হাদিসের কিতাবে সনদসহ বর্ণনা রয়েছে কীনা।


প্রথম হাদিস:


ইমাম হাকেম (رحمة الله)সহ আরও অনেকে সংকলন করেন-

حَدَّثَنَا أَبُو سَعِيدٍ عَمْرُو بْنُ مُحَمَّدِ بْنِ مَنْصُورٍ الْعَدْلُ، ثنا أَبُو الْحَسَنِ مُحَمَّدُ بْنُ إِسْحَاقَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ الْحَنْظَلِيُّ، ثنا أَبُو الْحَارِثِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ مُسْلِمٍ الْفِهْرِيُّ، ثنا إِسْمَاعِيلُ بْنُ مَسْلَمَةَ، أَنْبَأَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ ؓ ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ :  لَمَّا اقْتَرَفَ آدَمُ الْخَطِيئَةَ قَالَ: يَا رَبِّ أَسْأَلُكَ بِحَقِّ مُحَمَّدٍ لَمَا غَفَرْتَ لِي، فَقَالَ اللَّهُ: يَا آدَمُ، وَكَيْفَ عَرَفْتَ مُحَمَّدًا وَلَمْ أَخْلُقْهُ؟ قَالَ: يَا رَبِّ، لِأَنَّكَ لَمَّا خَلَقْتَنِي بِيَدِكَ وَنَفَخْتَ فِيَّ مِنْ رُوحِكَ رَفَعْتُ رَأْسِي فَرَأَيْتُ عَلَىَ قَوَائِمِ الْعَرْشِ مَكْتُوبًا لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ فَعَلِمْتُ أَنَّكَ لَمْ تُضِفْ إِلَى اسْمِكَ إِلَّا أَحَبَّ الْخَلْقِ إِلَيْكَ، فَقَالَ اللَّهُ: صَدَقْتَ يَا آدَمُ، إِنَّهُ لَأُحِبُّ الْخَلْقِ إِلَيَّ ادْعُنِي بِحَقِّهِ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُكَ -

-‘‘হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ ফরমান, হযরত আদম (عليه السلام) যখন অপ্রত্যাশিতভাবে (ইজতেহাদি) ভুল করলেন তখন হযরত আদম (عليه السلام) আল্লাহর দরবারে আবেদন করলেন,  হে পরওয়ারদিগার! হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এর হকের উসিলায় আমাকে মার্জনা করুন। আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,  তুমি মুহাম্মদ (ﷺ) কে কিভাবে চিনেছ? জবাবে আদম (عليه السلام) আরজ করলেন, হে আল্লাহ! আপনি স্বীয় কুদরতি হাত দ্বারা আমাকে সৃষ্টি করে আমার দেহের অভ্যন্তরে যখন আত্মা প্রবেশ করিয়ে ছিলেন, তখন আমি মাথা তুলে আপনার আরশের পায়ায় লেখা দেখেছিলাম, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ আমি বুঝতে পারলাম, আপনি আপন নামের সাথে এমন একটি নাম মিলিয়ে রেখেছেন যেটি সমগ্র সৃষ্টি জগতে আপনার নিকট সবচেয়ে প্রিয়। আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, হে আদম! তুমি সত্য বলেছো। নিশ্চয় ঐ নাম সমগ্র জাহানে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। যেহেতু তুমি সেই নাম নিয়েই আমার কাছে প্রার্থনা করেছ,  সেহেতু আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। হে আদম! যদি মুহাম্মদ (ﷺ) না হতেন, আমি তোমাকেও সৃজন করতাম না।’’ ৬৬

৬৬. ইমাম হাকেম নিশাপুরীঃ আল মুস্তাদরাকঃ ২/৬৭২ পৃ. হা/৪২২৮, ইমাম তাবরানীঃ মু’জামুল আওসাত : ৬/৩১৩ হাদিসঃ ৬৫০২, তাবরানীঃ মু’জামুস সগীর : ২/১৮২ হাদিসঃ ৯৯২, ইবনে হাজার হায়সামীঃ মাযমাউদ যাওয়াইদ : ৮/২৫৩ : পৃ., ইমাম ইবনে আসাকিরঃ- তারিখে দামেস্ক : ৭/৪৩৭, আল্লামা ইবনে কাসীর, বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ১/১৮ পৃ., ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি, খাসায়েসুল কোবরা, ১/১২ হাদিসঃ ১২, ইমাম বুরহান উদ্দিন হালবীঃ সিরাতে হালবিয়্যাহ ১/৩৫৫ পৃ., ইমাম কাস্তাল্লানীঃ মাওয়াহেবে লাদুনীয়া, ১/৮২ পৃ., ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতিঃ তাফসীরে দুররে মানসুর, ১/১৪২ পৃ., ইমাম বায়হাকীঃ দালায়েলুল নবুয়তঃ ৫/৪৮৯ পৃ., ইমাম হাকেম নিশাপুরীঃ আল মাদখালঃ ১/১৫৪ পৃ., ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানীঃ হিলইয়াতুল আউলিয়া, আল্লামা শায়খ ইউসুফ নাবহানী : শাওয়াহিদুল হক্ব : পৃ নং: ১৩৭, আল্লামা শায়খ ইউসুফ নাবহানী : আনোয়ার-ই-মুহাম্মদিয়া : পৃ নং: ৯-১০, আল্লামা শাহ আ: আজীজ মুহাদ্দিস দেহলভী : তাফসীর-ই-আযীযী : প্রথম খণ্ডঃ পৃ-১৮৩, আল্লামা শায়খ ইউসুফ নাবহানী : আফযালুস্ সালাত : পৃ-১১৭, আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী : তাফসীরে রুহুল বায়ান: ২/৩৭০ পৃ. সূরা মায়েদা: আয়াত নং-১৫, আল্লামা ইবনে হাজার হায়সামী : শরহে শামায়েল : ১/১১৫ পৃ., আল্লামা শায়খ ইউসূফ নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ২/১১৪ পৃ:, ইমাম জুরকানীঃ শরহে মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়া, ১/১৭২ পৃ., শায়খ ইউসুফ নাবহানী : হুজ্জাতুল্লাহি আলাল আলামিন : ৭৯৫ পৃ. এবং ৩১ পৃ., মাকতুবাতুত- তাওফিকহিয়্যাহ্, কায়রু, মিশর। আল্লামা শফী উকাড়বীঃ যিকরে হাসীন, ৩৭ পৃষ্ঠা, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী : নশরত্তীবঃ পৃষ্ঠা নং- ২৮


সনদ পর্যালোচনা:


✦ ইমাম হাকেম নিশাপুরী (رحمة الله) এ হাদিসটি সংকলন করেন তিনি লিখেন-

هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ وَهُوَ أَوَّلُ حَدِيثٍ ذَكَرْتُهُ لِعَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ فِي هَذَا الْكِتَابِ

-‘‘এ হাদিসটির সনদ সহীহ।’’ (ইমাম হাকেম নিশাপুরী, আল মুস্তাদরাক, ২/৬৭২ পৃ. হা/৪২২৮)


❏ ইমাম হাকিম (رحمة الله) এর এ অভিমতকে বহু ইমামগণও গ্রহণ করেছেন, কেউ কোনো প্রতিবাদ করেননি। এর মধ্যে রয়েছেন ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (رحمة الله), শায়খ ইউসুফ নাবহানী (رحمة الله), শাহ্ আবদুল আযিয মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله), কাস্তালানী (رحمة الله), জুরকানী (رحمة الله), ইসমাঈল হাক্কী (رحمة الله),  ইবনে হাজার হাইসামী (رحمة الله), ইবনে কাসীর (رحمة الله), বুরহানউদ্দীন হালাবী (رحمة الله), মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله), এমনকি দেওবন্দের অন্যতম আলেম আশরাফ আলী থানবীরও। ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) এ বিষয়ে লিখেন-

رواه الحاكم فى صحيحه أن آدم- عليه السّلام- رأى اسم محمد- صلى الله عليه وسلم- مكتوبا على العرش، وأن الله تعالى قال لآدم لولا محمد ما خلقتك

-‘‘ইমাম হাকেম নিশাপুরী (رحمة الله) সহীহ সূত্রে সংকলন করেন যে, নিশ্চয় হযরত আদম (عليه السلام) আরশের পায়ায় মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নাম দেখতে পেয়েছিলেন এবং তখন মহান আল্লাহ হযরত আদম (عليه السلام) কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, হে আদম! যদি মুহাম্মদ (ﷺ) না হতেন,  তাহলে আমি তোমাকেও সৃজন করতাম না।’’ (ইমাম কাস্তালানী, মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যাহ, ১/৪৭ পৃ.)


❏ ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) এ গ্রন্থের আরেক স্থানে স্পষ্ট লিখেছেন-

وصح أن رسول الله- صلى الله عليه وسلم- قال لما اقترف آدم الخطيئة قال: يا رب

-‘‘রাসূল (ﷺ) থেকে সহীহ সনদে এসেছে যে, তিনি বলেছেন, হযরত আদম (عليه السلام) যখন অপত্যাশিত ভাবে ভুল করলেন তখন তিনি বললেন হে আমার রব.......।’’(ইমাম কাস্তালানী, মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যাহ, ৩/৬০৫ পৃ.)


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের মত আলেমগণ ইমাম কাস্তালানীর ৫০০ শত বছর পরে এসে উনাদের তাহকীকে ভুল ধরতে এসেছেন, উনারা শতশত বছর পূর্বে হাদিসের সনদ বুঝেননি। ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার গ্রন্থের ৩০৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘‘ইমাম বাইহাকী হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন।’’ এবার আমরা তার কথার বাস্তবতা দেখবো। 


❏ ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) এটি সংকলন করেন লিখেন-

تَفَرَّدَ بِهِ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ مِنَ هَذَا الْوَجْهِ عَنْهُ، وَهُوَ ضَعِيفٌ، وَاللهُ أَعْلَمُ

-‘‘এ হাদিসটি একক ‘আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ বিন আসলাম’ বর্ণনা করেছেন। সে দুর্বল হাদিস বর্ণনাকারী, মহান রবই এ বিষয়ে অধিক জ্ঞাত।’’ (দালায়েলুন নবুয়ত, ৫/৩৭৪ পৃ:) 


দেখুন কতবড় মিথ্যাচার। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব-


✦ হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইবনে কাসির (رحمة الله) স্বয়ং ইমাম বায়হাকী (رحمة الله)-এর অভিমত এভাবে উল্লেখ করেছেন-

قَالَ الْبَيْهَقِيُّ تَفَرَّدَ بِهِ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ وَهُوَ ضَعِيفٌ

-“ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) বলেন, ‘আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ আসলাম’ হতে এটি একক বর্ণনা, আর তিনি যঈফ।” (হাফিজ ইবনে কাছির: আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া, ২য় খণ্ড, ৬২৯ পৃ:)। 


শুধু তাই নয় উক্ত রাবীকে সে জাহেল প্রমাণ করতে গিয়ে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার গ্রন্থের ৩০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘‘আব্দুর রহমান ইবনু যাইদ ইবনু আসলাম (ওফাত. ১৮২ হি.) খুবই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী ছিলেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁর বর্ণিত হাদিস গ্রহণ করেন নি। কারণ তিনি কোনো হাদীস ঠিকমত বলতে পারতেন না, সব উল্টোপাল্টা বর্ণনা করতেন।’’


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! তার এ সামান্য বক্তব্যের মধ্যে কয়েকটি মিথ্যাচার রয়েছে। এক. রাবী আব্দুর রহমানকে কেউ অত্যন্ত দুর্বল কেউ বলেনি। যেমনটি ইতোপূর্বে বায়হাকী এবং ইবনে কাসিরের অভিমত দেখলাম। উদাহরণ স্বরূপ দেখুনঃ


✦ ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তার জীবনীতে লিখেন-

 وَفِيْهِم لِيْنٌ -

‘ সে কিছুটা নরম অর্থাৎ সামান্য দুর্বল প্রকৃতির।’’ (ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/৩৪৯ পৃ. ক্রমিক.৯৪) বুঝা গেল সামান্য দুর্বল রাবীকে জাহাঙ্গীর সাহেব ইচ্ছা করেই দুর্বলতা বাড়িয়ে দিলেন তার নিজের গুপ্ত ভাণ্ডার থেকে! 


✦ দ্বিতীয়ত. তিনি বক্তব্যে বলেছেন যে, কোন মুহাদ্দিস তার হাদিস গ্রহণ করে নি, সে কতবড় জাহেল দেখুন, সুনানে ইবনে মাযাহ এবং সুনানে তিরমিযিতে তার হাদিস বর্ণিত হয়েছে। 

(সুনানে ইবনে মাযাহ, হা/২৩৮, হা/৫১৯, হা/১১৮৮, হা/২৪৪৩, হা/২৭৬৬, হা/৩২১৮, হা/৩৩১৪, হা/৪০৬০, সুনানে তিরমিযি, হা/৪৬৫, হা/৪৬৬, হা/৬৩১, হা/৬৩২, হা/৭১৯, হা/৮৫২) 


✦ ইমাম তিরমিযি (رحمة الله) তাঁর চেয়েও আরেকজন শক্তিশালী রাবীর সাথে তুলনা দিতে গিয়ে লিখেও ছিলেন-

وَهَذَا أَصَحُّ مِنْ حَدِيثِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ.

-‘‘এ হাদিসটি ‘আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ বিন আসলাম’ এর বর্ণনা হতে অধিক বিশুদ্ধ।’’ (সুনানে তিরমিযি, ২/১৯ পৃ. হা/৬৩২) 


বুঝা গেল, দুজনের হাদিসটই সহীহ, তবে আব্দুর রহমানের হাদিস তুলনামূলভাবে কম সহীহ।

তৃতীয়ত. জাহাঙ্গ্রীর সাহেব উক্ত রাবীর বিষয়ে দাবী করেছেন যে, হাদিস পড়ার তাঁর কোন ইলমী যোগ্যতা ছিল না, 


❏ অথচ ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তাঁর জীবনীতে লিখেন-

وَكَانَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ صَاحِبَ قُرْآنٍ وَتَفْسِيْرٍ، جَمَعَ تَفْسِيْراً فِي مُجَلَّدٍ، وَكِتَاباً فِي النَّاسِخِ وَالمَنْسُوْخِ.

-‘‘হযরত আব্দুর রহমান (رحمة الله) তিনি কুরআনের ক্বারী এবং মুফাস্সির ছিলেন, তিনি কয়েক খণ্ডে কুরআনের তাফসিরও লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তিনি ইসলামের গূরুত্বপূর্ণ বিষয় নাসেখ মানসুখ বিষয়ে কিতাব লিপিবদ্ধ করেছিলেন।’’(ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৮/৩৪৯ পৃ. ক্রমিক.৯৪)


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! বর্তমানে উক্ত গ্রন্থের লিখক বেঁচে থাকলে আমি অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতেন একজন রাবীর নামে মিথ্যাচার করে তার কি লাভ!


❏ ইমাম নুরুদ্দিন হায়সামী (رحمة الله) বলেন,

عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ، وَفِيهِ كَلَامٌ، وَقَدْ وَثَّقَهُ ابْنُ عَدِيٍّ.

-“রাবী ‘আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম’ সম্পর্কে অনেক কথা রয়েছে, তবে ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله) তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন।” (ইমাম হায়সামী: মাযমাউয যাওয়াইদ, হা/৪৪১০)।


❏ ইমাম মিযযী (رحمة الله) বলেন,

وَقَال أَبُو أَحْمَد بْن عدي: له أحاديث حسان. وهو ممن احتمله الناس، وصدقه بعضهم. وهو ممن يكتب حديثه.

-“ইমাম আবু আহমদ ইবনে আদী (رحمة الله) বলেন, তার অনেক হাদিস ‘হাসান’ রয়েছে। সে এমন ব্যক্তি যার রেওয়াত লোকেরা গ্রহণ করেছেন এবং অনেকে তাকে সত্যবাদী বলেছেন এবং সে ব্যক্তির হাদিস লিখেছেন।” (ইমাম মিযযী: তাহজিবুল কামাল, রাবী নং ৩৮২০)


✦ ইমাম যাহাবী (رحمة الله) বলেন: وهو صاحب حَدِيثِ -“সে ছাহেবুল হাদিস অর্থাৎ মুহাদ্দিস ছিলেন।” (ইমাম যাহাবী: তারিখে ইসলামী, ৪/৯০৪ পৃ. রাবী নং ২০১)


তবে আফসোসের বিষয় হল, কাঠ মিস্ত্রী নাসিরুদ্দিন আলবানী তার ‘সিলসিলাতুল আহাদিসুদ দ্বঈফাহ’ এর (১ম খণ্ডের ৮৮ পৃষ্ঠায়) ২৫ নং হাদিসের আলোচনায় এ হাদিসকে এতজন ইমাম গ্রহণ করার পরও হাদিসটিকে জাল বলেছেন। আল্লাহ তার উপর লানত বর্ষণ করুন, যে একা সমস্ত ইমামদের বিরোদ্ধে গিয়ে নিজেকে বড় ইমাম বানাতে চেয়েছিল। আর প্রিয় নবীজি (ﷺ) এর শান-মানের ব্যাপারে ইহা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হাদিস।


সর্বশেষ এ হাদিসের বিষয়ে আমার বক্তব্য হলো এ হাদিসের আরেকটি সূত্র রয়েছে। 


❏ ইমাম আবু সা‘দ খরকুশী নিশাপুরী (ওফাত. ৪০৭ হি.) এ হাদিসটির আরেকটি সূত্র হযরত মূসা (عليه السلام)-এর ঘটনার মাধ্যমে এভাবে উল্লেখ করেছেন-

وعن ابن عباس رضي الله عنهما....... قال موسى عليه السّلام: ومن محمد يا رب؟ قال: الذي كتبت اسمه على ساق العرش قبل أن أخلق السماوات والأرضين بألفي عام، محمد رسولي وحبيبي وخيرتي من خلقي. قال: يا رب فإن كان محمد أكرم عليك من جميع خلقك فهل في قوله: ولولا محمد ما خلقتك

-‘‘হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন.......তখন মহান মূসা (عليه السلام) বললেন, হে মহান রব! মুহাম্মদ কে? মহান রব বললেন, তার নাম আমি আরশের পায়ায় লিখেছি আদম (عليه السلام) সৃজন করার হাজার বছর পূর্বে, হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) হলেন আমার রাসূল, আমার হাবীব এবং আমার সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম। হযরত মূসা (عليه السلام) বললেন, হে আমার রব! মুহাম্মদ (ﷺ) হলেন আপনার সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি। অতঃপর মহান আল্লাহ মূসা (عليه السلام) কে লক্ষ্য করে বলেন, যদি আমি তাকে না বানাতাম (হে মূসা!) আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না।’’ (আবূ সা‘দ খরকুশী, শরফুল মোস্তফা, ১/১৬৬ পৃ.)


পর্যালোচনা: 


প্রমাণিত হলো রাসূল (ﷺ) সৃষ্টি কে করা না হলে মূসা (عليه السلام) কেও সৃষ্টি করা হতো না, অপর বর্ণনায় দেখলাম হযরত আদম (عليه السلام) কথা এসেছে। সুতরাং আদম (عليه السلام) না হলে হয়তো আমাদের কোন মানবের জাতির উৎপত্তিও হত না। 


❏ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) লিখেন-

(ولو لاه ما خلقتك) ويقرب منه ما روي لو لاك لما خلقت الأفلاك

-‘‘(হে আদম! যদি আমি মুহাম্মদ (ﷺ) কে সৃষ্টি না করতাম তোমাকেও সৃজন করতাম না) এটি এ হাদিসের অর্থের নিকটবর্তী, যেমন বর্ণিত আছে, হে হাবিব! আপনাকে সৃজন না করলে আমি বানাতাম না কোনো কিছু।’’  (মোল্লা আলী ক্বারী, শরহে শিফা, ১/৩৮২ পৃ.)


দ্বিতীয় হাদিস:


ইমাম হাকেম নিশাপুরী (رحمة الله) সংকলন করেন-

حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ حَمْشَاذَ الْعَدْلُ، إِمْلَاءً، ثنا هَارُونُ بْنُ الْعَبَّاسِ الْهَاشِمِيُّ، ثنا جَنْدَلُ بْنُ وَالِقٍ، ثنا عَمْرُو بْنُ أَوْسٍ الْأَنْصَارِيُّ، ثنا سَعِيدُ بْنُ أَبِي عَرُوبَةَ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: أَوْحَى اللَّهُ إِلَى عِيسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ يَا عِيسَى آمِنْ بِمُحَمَّدٍ وَأْمُرْ مَنْ أَدْرَكَهُ مِنْ أُمَّتِكَ أَنْ يُؤْمِنُوا بِهِ فَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ آدَمَ وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَا النَّارَ وَلَقَدْ خَلَقْتُ الْعَرْشَ عَلَى الْمَاءِ فَاضْطَرَبَ فَكَتَبْتُ عَلَيْهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولٌ اللَّهِ فَسَكَنَ-

-‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা‘য়ালা হযরত ঈসা (عليه السلام) এর নিকট ওহী নাযিল করলেন, হে ঈসা! তুমি মুহাম্মদ (ﷺ) এর উপর ঈমান আন এবং তোমার উম্মতের মধ্যে যারা তাঁর যুগ পাবে তাদেরকে ঈমান আনতে বলো। কারণ যদি হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) না হতেন, তাহলে আমি না আদমকে সৃষ্টি করতাম,  না বেহেশত, না দোযখ সৃজন করতাম। আমি (আল্লাহ) যখন পানির উপর আরশ তৈরী করেছিলাম, তখন তা এদিক সেদিক কম্পন করতে লাগল। তখন আমি তার উপর কালেমা শরীফ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ লিখে দিলাম অতঃপর আরশ স্থির হয়ে গেল।’’  ৬৭

৬৭. ইমাম হাকেম নিশাপুরীঃ আল মুস্তাদরাক, ২/৬৭১ পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৪২২৭, আল্লামা ইমাম তকিউদ্দিন সুবকী, শিফাউস সিকাম, ৪৫ পৃ., আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী, আফজালুল র্কুরা, আল্লামা সিরাজুদ্দীন বলকীঃ ফতোয়ায়ে সিরাজিয়া, ১/১৪০ পৃ., আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারীঃ মাওদ্বুআতুল কাবীর, ১০১ পৃ., ইমাম ইবনে সা’দঃ আত্-তবকাতুল কোবরা, ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া, আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতিঃ খাসায়েসুল কোবরাঃ ১/১৪ পৃ. হাদিসঃ ২১, আল্লামা ইবনে হাজার হায়সামীঃ শরহে শামায়েলঃ ১/১৪২ পৃ., আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন নাবহানী, জাওয়াহিরুল বিহার, ২/১১৪ পৃ., ইমাম যাহাবীঃ মিযানুল ইতিদাল : ৫/২৯৯ পৃ. রাবী: ৬৩৩৬, আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানীঃ লিসানুল মিযানঃ ৪/৩৫৪ পৃ., ইমাম ইবনে হাইয়্যানঃ তবকাতে মুহাদ্দিসিনে ইস্পাহানীঃ ৩/২৮৭ পৃ., আবু সা‘দ ইবরাহিম নিশাপুরী, শরহে মুস্তফা: ১/১৬৫ পৃ., জুরকানী, শরহুল মাওয়াহেব : ১২/২২০ পৃ., ইবনে কাসীর, কাসাসুল আম্বিয়া, ১/২৯ পৃ. দারুল তা‘লিফ, কায়রু, মিশর, ইবনে কাসীর, সিরাতে নববিয়্যাহ: ১/৩২০ পৃ. দারুল মা‘রিফ, বয়রুত, লেবানন, ইবনে কাসীর, মু‘জিজাতুন্নাবী: ১/৪৪১ পৃ. মাকতুবাতুল তাওফিকহিয়্যাহ, কায়রু, মিশর, ইবনে সালেহ শামী, সবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ: ১২/৪০৩ পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।


হাদিসটির সনদ পর্যালোচনা: 


✦ ইমাম হাকেম (رحمة الله) এ হাদিসটিকে সংকলন করে লিখেন-

هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الْإِسْنَادِ وَلَمْ يُخَرِّجَاهُ

-‘‘এ হাদিসটির সনদ সহীহ, যদিওবা ইমাম বুখারী (رحمة الله) ও মুসলিম (رحمة الله) সংকলন করেননি।’’ (ইমাম হাকেম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক, ২/৬৭১ পৃষ্ঠা, হা/৪২২৭) 


✦ ইমাম হাকিম (رحمة الله) এর এ সমাধানকে ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله),  ইমাম সুবকী (رحمة الله),  ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله), মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله)সহ এক জামাআত মুহাদ্দিসগণ মেনে নিয়েছেন যে হাদিসটির সনদ সহীহ বলেছেন। 


ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ৩০৮ পৃষ্ঠায় উক্ত সনদের অন্যতম রাবী ‘আমর ইবনু আউস আল-আনসারী’ সম্পর্কে লিখেন-‘‘এ লোকটি মূলত একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না।.........এটি ইবনু আব্বাসের নামে বানানো জাল হাদীস।’’ অথচ তিনি নির্ভরযোগ্য কোন আসমাউর রিজালের আলোকে উক্ত রাবীকে অজ্ঞাত পরিচায়ক প্রমাণ করতে পারেননি। 


✦ অথচ ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতি (رحمة الله) ও আল্লামা নূরুদ্দিন আলী ইবনে আহমদ ছামহুদী (رحمة الله) তদীয় কিতাবে হাদিসটি সহীহ্ হওয়ার কথা এভাবে লিখেছেন-

وَأخرج الْحَاكِم وَصَححهُ -“ইমাম হাকেম  (رحمة الله) হাদিসখানা সংকলন করেছেন, সহীহ্ বলে মত প্রকাশ করেছেন।” (ইমাম সুয়ূতি: খাসায়েসুল কোবরা, ১/২৯ পৃ:; আল্লামা সামহুদী: ওফাউল ওফা, ৪/২২৪ পৃ:)


✦ বিখ্যাত আসমাউর রিজালবিদ আল্লামা মুগলতাঈ (رحمة الله) রাবী ‘আমর বিন আউস’ এর বিস্তারিত জীবনী আলোচনা করেছেন তিনি তাকে মাজহুল বলেননি। (মুগলতাঈ, ইকমালু তাহযিবুল কামাল, ১০/১৩৩ পৃ. ক্রমিক.৪০৬৩)


পর্যালোচনা:


এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) কে সৃষ্টি করেছেন। এ হাদিস থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হল যে রাসূল (ﷺ) কে সৃষ্টি করা না হলে না আদম (عليه السلام) কে সৃষ্টি করা হতো, না জান্নাত, না জাহান্নাম সৃষ্টি করা হতো।


তৃতীয় ও চতুর্থ হাদিস:


❏ ইমাম দায়লামী (رحمة الله)সহ একজামাত ইমামগণ সংকলন করেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত।  তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ؓ مَرْفُوعًا أَتَانِي جِبْرِيلُ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ النَّار

-“একদা আমার নিকট হযরত জিব্রাঈল (عليه السلام) এসে বললেন, মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেছেন, হে মুহাম্মদ ! আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি সৃজন করতাম না বেহেশত, আর  না দোযখ।’’ ৬৮

৬৮. 

ক. ইমাম ইবনে সালেহ শামী, সবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১/৭৫ পৃ.

খ. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : আসরারুল মারফুআ: ১/২৯৫ পৃ. হা/৩৮৫

গ. আল্লামা শায়খ ইউসূফ নাবহানী, জাওয়াহিরুল বিহার, ৪/১৬০ পৃ.

ঘ. ইমাম জুরকানী, শারহুল মাওয়াহেব, ১/৮৬ পৃ.

ঙ. মুত্তাকী হিন্দী, কানযুল উম্মাল, ১১/৪৩১ পৃ. হা/৩২০২৫


সনদ পর্যালোচনা:


এ হাদিসটির সনদ ‘হাসান’ পর্যায়ের। 


❏ এ হাদিসটির সনদ স্বয়ং আহলে হাদিস আলবানী দায়লামী শরীফ থেকে এভাবে সংকলন করেন-

عبيد الله بن موسى القرشي حدثنا الفضيل بن جعفر بن سليمان عن عبد الصمد بن علي بن عبد الله ابن عباس عن أبيه عن ابن عباس به.

-‘‘উবাইদুল্লাহ বিন মূসা কুরশী তাকে হাদিস বর্ণনা করেছেন ফযাইল বিন জাফর বিন সুলাইমান তিনি হাদিস বর্ণনা করেছেন আব্দুস সামাদ বিন আলী বিন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে তিনি তার পিতা আলী ইবনে আব্দুল্লাহ হতে তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন।.....।’’ (আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদিসিদ দ্বঈফাহ ওয়াল মাওদ্বুআহ, ১/৪৫১ পৃ. হা/২৮২)


আলবানী এই সনদটিকে জোর করে উসূলে হাদিসের নিয়মকে উপেক্ষা করে যঈফ প্রমাণের অনেক অপচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এতে সর্বশেষে দাবী করেছেন যে, 


✦ সনদের অন্যতম রাবী আব্দুস সামাদের হাদিসের বিষয়ে ইমাম উকাইলী (رحمة الله) বলেছেন-غير محفوظ ولا يعرف الا به. “তার হাদিস সংরক্ষিত নয়, তার এ সূত্র ছাড়া আর অন্য কোনো ভাবে তাকে চেনা যায় না।” ৬৯

৬৯. আলবানী, সিলসিলাতু আহাদিসুদ্-দ্বঈফাহ, ১/৪৫১ পৃ. হা/২৮২


যদি আলবানী বর্তমানে জীবিত থাকতো তাহলে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতাম যে, ইমাম উকায়লীর এই উক্তি কোথায় হতে নকল করেছেন!

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) উকাইলীর শুধু غير محفوظ অভিমত উল্লেখ করেছেন; কিন্তু আলবানী দেখুন আরেকটু তার নামে সংযোজন করে দিলেন। আমি বর্তমান আহলে হাদিসদেরকে বলবো যে, আপনারা ইমাম উকাইলীর একক উক্তি ছাড়া আর কোন মুহাদ্দিসের অভিমত পেশ করুন যে, কেউ তাকে দুর্বল বলেছেন। 


✦ ইমাম সাখাভী (رحمة الله) তার একটি সনদকে এক স্থানে শুধু গরীব বলেছেন, কোন দুর্বলতা আছে বলে উল্লেখ করেননি। ৭০

৭০. ইমাম সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, ১৪৪ পৃ. হা/১৫৪


✦ ইমাম আবু হাতেম (رحمة الله) তার জীবনী উল্লেখ করে কোন সমালোচনা করেননি। ৭১

৭১. ইমাম আবু হাতেম, জারহু ওয়া তা’আদীল, ৬/৫০ পৃ. ক্রমিক: ২৬৬


✦ আল্লামা ছালাহ উদ্দিন খালীল ছাফকী (ওফাত ৭৬৪ হি.) তার জীবনীতে উল্লেখ করেন- وكان كبير القدر معظمًا-‘‘তিনি ছিলেন বড় সম্মানিত, মর্যাদাবান ব্যক্তিদের একজন।’’  ৭২

৭২. ছাফকী, (ناكث الهميان) নাকসুল হামীয়ান, ১/১৭৬ পৃ.


✦ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) তার জীবনীতে লিখেন- 

وما عبد الصمد بحجة ولعل الحفاظ

-‘‘আব্দুস সামাদ তিনি হুজ্জাত (চার লক্ষেরও বেশী হাদিসের হাফেয) পর্যায়ের রাবী নন, সম্ভবত তিনি হাফেজ (১ লক্ষ হাদিসের মুখস্তকারী) ছিলেন।’’ ৭৩

৭৩. ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, লিসানুল মিযান, ৫/১৮৭পৃ. ক্রমিক. ৪৭৮৭


সুবহানাল্লাহ! এটা রাবীর গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে এটাই অনেক কিছু।


এ বিষয়ের দ্বিতীয় বর্ণনা : 


❏ ইমাম দায়লামী (رحمة الله) আরেকটি সনদ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন-

يَقُول الله عز وَجل وَعِزَّتِي وَجَلَالِي لولاك مَا خلقت الْجنَّة ولولاك مَا خلقت الدُّنْيَا

-“আমার মহান আল্লাহ্ তা‘য়ালা বলেন, আমার ইজ্জত ও জালালিয়াতের শপথ! যদি আপনি না হতেন তাহলে আমি না জান্নাত সৃজন করতাম না দুনিয়া।” ৭৪

৭৪. ইমাম দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ৫/২২৭ পৃ. হা/৮০৩১, মুসনাদিল ফিরদাউস, ২/২২ পৃ. হা/৮০৩১


এই হাদিসটির সনদ নিয়ে আলবানী থেকে শুরু করে কেহই কলম ধরার সাহস করেনি। 


পঞ্চম ও ৬ষ্ঠ হাদিস:


প্রথম সূত্র: ইমাম ইবনে আসাকীর (رحمة الله) দীর্ঘ হাদিস সনদসসহ হযরত সালমান ফারসী (رضي الله عنه) হতে সংকলন করেন, হাদিসের শেষের অংশ হল- 

وَلَقَدْ خَلَقْتُ الدُّنْيَا وَأَهْلَهَا لأُعَرِّفَهُمْ كَرَامَتَكَ عَلَيَّ وَمَنْزِلَتَكَ عِنْدِي وَلَوْلاكَ يَا مُحَمَّدُ مَا خَلَقْتُ الدُّنْيَا

-“আমি পৃথিবী এবং পৃথিবীবাসীকে সৃষ্টি করেছি আমার নিকট আপনার মর্যাদা ও সম্মান কতটুকু তা দেখানোর জন্য। হে আমার হাবিব! যদি আপনি না হতেন তাহলে আমি এ দুনিয়া বানাইতাম না।” ৭৫

৭৫. ইমাম ইবনে আসাকীর, তারিখে দামেস্ক, ৩/৫১৮ পৃ. ক্রমিক: ৮০১, ইমাম ইবনে জাওযী, কিতাবুল মাওদ্বুআত, ১/২৮৯ পৃ. ইমাম সুুয়ূতি, লা-আলিল মাসনূূ, ১/২৪৯ পৃ. কিতাবুল মানাকেব, আল্লামা শায়খ ইউসূফ নাবহানী : আনোয়ার-ই-মুহাম্মাদিয়া : পৃষ্ঠা নং : ১১, ইমাম ইবনে আসাকীরঃ তারীখে দামেস্ক ৩/৫১৭ পৃষ্ঠা, আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী, আসরারুল মারফুআ, ১০১ পৃষ্ঠা, আল্লামা ইমাম জুরকানী, শরহে মাওয়াহেব, ১/১২১ পৃ. এবং ৭/১৮৬ পৃ., ইমাম কাস্তাল্লানী, মাওয়াহেবেল্লাদুনিয়্যাহ, ১/৫৫ পৃ., শায়খ ইউসূফ নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ১/২৮৯ পৃষ্ঠা, ইমাম আবূ সা‘দ খরকুশী নিশাপুরী, ৪/৩৩১ পৃ., ইমাম ইবনে সালেহ শামী, সবলুল হুদাদ ওয়ার রাশাদ, ১/৭৫ পৃ., ইমাম সুয়ূতি, খাসায়েসুল কোবরা, ২/৩৩০ পৃ., ইমাম কাজী আয়াজঃ শিফা শরীফঃ ২/১০৫ পৃ.


সনদ পর্যালোচনা: আহলে হাদিস আলবানী ইমাম ইবনুল জাওযীর কট্টর ভুল সিদ্ধান্তের অনুসরণ করে হাদিসটিকে জাল বলেছেন। ৭৬

৭৬. আলবানী, সিলসিলাতু আহাদিসুদ্-দ্বঈফাহ, ১/৪৫১ পৃ. হা/২৮২


যারা ইলমে হাদিস নিয়ে গবেষণা করেন তারা অনেকেই জানেন যে, ইমাম ইবনুল জাওযী  (رحمة الله) হাদিস সমালোচনায় কট্টর। উনার অভিমত যাচাই বাছাই ছাড়া গ্রহণ করা বৈধ নয়। তাই এবার দেখবো তিনি কোন দৃষ্টিকোনে এই সনদকে জাল বানোয়াট বলেছেন। 


✦ ইমাম ইবনুল জাওযী (رحمة الله) এই হাদিস প্রসঙ্গে লিখেন-

هَذَا حَدِيثٌ مَوْضُوعٌ لَا شَكَّ فِيهِ، وفى إِسْنَاده مَجْهُولُونَ وضعفاء والضعفاء أَبُو السكين وَإِبْرَاهِيم من اليسع. قَالَ الدَّارَقُطْنِيُّ: أَبُو السكين ضَعِيف وَإِبْرَاهِيم وَيحيى الْبَصْرِيّ مَتْرُوكَانِ.

-“এই হাদিসটি জাল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই সনদে অপ্রসিদ্ধ ও যঈফ রাবী আবুল সাকীন এবং ইবরাহিম ইবনে আল ইয়াছাঈ দুর্র্বল রাবী। ইমাম দারাকুতনী বলেন, আবুল সাকীন যঈফ রাবী। ইবরাহিম এবং ইয়াহইয়া বসরী দুজন পরিত্যাক্ত রাবী।” ৭৭

৭৭. ইমাম ইবনুল জাওযী, কিতাবুল মাওদ্বুআত, ২/২৮৯ পৃ. কিতাবুল ফাযায়েল ওয়াল মানাকিব। 


সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! তিনি যে আপত্তি এ হাদিসের সনদের বিষয়ে করেছেন তাতে এই সনদ যঈফ প্রমাণ হয় জাল নয়। এবার তিনি এই সনদের যে ৩ জন রাবীকে দোষী করেছেন আসলে আসমাউর রিজালবিদগণ তাদের বিষয়ে বা তাদের হাদিস গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে কী বলেছেন আমরা এখন তা গবেষণা করে দেখবো। 


প্রথম আপত্তিকর রাবী: 


এই সনদের প্রথম আপত্তিকর রাবী দাবী করা হয়েছে محمد بن عيس بن حيان (মুহাম্মদ বিন ঈসা বিন হাইয়্যান) নামক রাবী যার উপনাম হল আবুল সাকীন। 


✦ ইমাম যাহাবী (رحمة الله) তার জীবনীতে শুরুতেই লিখেন- المحدث المقرئ الامام -“তিনি একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন, ক্বারী ছিলেন, হাদিসের ইমাম ছিলেন।”৭৮

৭৮. ইমাম যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৩/২১ পৃ. ক্রমিক: ১২ এবং তারিখুুল ইসলাম, ৬/৬১৭ পৃ. ক্রমিক: ৪০৫, ইবনে হাজার আসকালানী, লিসানুল মিযান, ৭/৪২৮ পৃ., ক্রমিক: ৭২৮৬


✦ তিনি আরও উল্লেখ করেন- قال البرقانى لا بأس به -‘‘ইমাম বারকানী (رحمة الله) বলেন, তার হাদিস গ্রহণ করতে কোন অসুবিধা নেই।’’ ৭৯

৭৯. ইবনে হাজার আসকালানী, লিসানুল মিযান, ৭/৪২৮ পৃ., ক্রমিক: ৭২৮৬


✦ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) তার জীবনীতে উল্লেখ করেন-

وكذا ذكره ابن حبان فى الثقات-

-“ইমাম ইবনে হিব্বান (رحمة الله) তাকে সিকাহ রাবীর তালিকায় স্থান দিয়েছেন।’’ ৮০

৮০. ইবনে হাজার, লিসানুল মিযান, ৭/৪২৮ পৃ. ইবনে হিব্বান, কিতাবুস-সিকাত, ৯/১৪৩ পৃ. ক্রমিক: ১৫৬৫১


✦ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইমাম লালকায়ী (رحمة الله) বলেন- صالح তিনি হাদিস বর্ণনায় সৎ ব্যক্তি ছিলেন।  ৮১

৮১. ইবনে হাজার, লিসানুল মিযান, ৭/৪২৮ পৃ. ইবনে হিব্বান, কিতাবুস-সিকাত, ৯/১৪৩ পৃ. ক্রমিক: ১৫৬৫১


তবে তিনি কেরাতের প্রতি বেশী মনযোগের কারণে অনেকে তাকে দুর্বলতার ইঙ্গিত করেছেন যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তাই একক ইমাম দারাকুতনীর অভিমত দিয়ে তাকে যঈফ বলা মানে অধিকাংশ মুহাদ্দিসের অভিমতকে হেয় করা। 


দ্বিতীয় আপত্তিকর রাবী: 


এই সনদের দ্বিতীয় আপত্তিকর রাবী হিসেবে ইমাম ইবনুল জাওযী ابراهيم بن اليسع (ইবরাহিম বিন আল-ইয়াছঈ) যার উপনাম হল ইবনে আবি হায়াত। তার হাদিস ‘হাসান’ পর্যায়ের। 


✦ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رحمة الله) তার জীবনীতে লিখেন-

ونقل عثمان بن سعيد الدارمى عن يحيى بن معين أنه قال شيخ ثقة كبير

-“উসমান বিন সাঈদ দারেমী (رحمة الله) তিনি ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন (رحمة الله) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, উক্ত রাবী হাদিসের শায়খ, উঁচু মানের বিশ্বস্ত মুহাদ্দিস ছিলেন।” ৮২

৮২ ইবনে হাজার, লিসানুল মিযান, ১/২৭১ পৃ. ক্রমিক: ১১৬


✦ ইমাম মুগলতাঈ (رحمة الله) বলেন, 

وفى قول المزى: ذكره ابن حبان فى كتاب الثقات

ইমাম মিয্যী (رحمة الله) তার আসমাউর রিজাল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম ইবনে হিব্বান তাকে বিশ্বস্ত রাবীদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ৮৩

৮৩. মুগলতাঈ, ইকমালু তাহযিবুল কামাল, ১২/৩০২ পৃ. ক্রমিক: ৫১১৮, ইবনে হিব্বান, কিতাবুস্-সিকাত, ৭/৫৯৭ পৃ. ইমাম মিয্যী, তাহজিবুল কামাল, ৩১/২৮৯ পৃৃ. 


✦ তবে যা তার জীবনী থেকে বুঝা যায় তা হল তিনি তাদলিস করতেন বলেই তাকে অনেকে কেউ কেউ দুর্বলতার ইঙ্গিত করেছেন।  ৮৪

৮৪. মুগলতাঈ, ইকমালু তাহযিবুল কামাল, ১২/৩০২ পৃ. ক্রমিক: ৫১১৮, ইবনে হিব্বান, কিতাবুস্-সিকাত, ৭/৫৯৭ পৃ. ইমাম মিয্যী, তাহজিবুল কামাল, ৩১/২৮৯ পৃৃ.


✦ তবে ইমাম ইবনে হিব্বান বলেন-

 كان يدلس على الثقات -

‘‘তিনি সিকাহ রাবীর নামে তাদলিস করতেন।’’ ৮৫

৮৫. মুগলতাঈ, ইকমালু তাহযিবুল কামাল, ১২/৩০২ পৃ. ক্রমিক: ৫১১৮


তাই অন্যান্যের তাদলিসের ন্যায় তার তাদলীস অবস্থা নয়। যেমনঃ


✦ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া যুহালী তিনি ইয়াযিদ ইবনে হারুন থেকে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেছেন

-كان صدوقا ولكن يدلس 

-‘‘তিনি সত্যবাদী ছিলেন, তবে তিনি তাদলীস করতেন।’’৮৬

৮৬. ইমাম মিয্যী, তাহজিবুল কামাল, ৩১/২৮৬ পৃ. ক্রমিক: ৬৮১৭


✦ ইমাম মিয্যী (রহ.) আরও উল্লেখ করেন- 

قال أبو نعيم: كان ثقة وكان يدلس

-‘‘ইমাম আবু নুয়াইম বলেন, তিনি সিকাহ রাবী, তবে তিনি তাদলীস করতেন। ৮৭

৮৭. ইমাম মিয্যী, তাহজিবুল কামাল, ৩১/২৮৬ পৃ. ক্রমিক: ৬৮১৭


✦ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবনে মাঈন (رحمة الله) বলেন- صدوق তিনি সত্যবাদী ছিলেন। তিনি অন্য বর্ণনায় এনেছেন ليس به بأس -তার হাদিস গ্রহন করতে কোন অসুবিধা নেই।’’ ৮৮

৮৮. ইমাম মিয্যী, তাহজিবুল কামাল, ৩১/২৮৬ পৃ. ক্রমিক: ৬৮১৭


✦ ইমাম ইজলী (رحمة الله) তাকে সিকাহ রাবীর তালিকায় স্থান দিয়েছেন এবং বলেছেন, كان يدلس لا بأس به -‘‘তিনি তাদলীস করতেন। তার হাদিস গ্রহণে কোনো অসুবিধা নেই।’’ ৮৯ 

৮৯. ইমাম ইজলী, তারিখুস্-সিকাত, ২/৩৫০ পৃ. ক্রমিক: ১৯৭৩


তাই বুঝতে পারলাম এই রাবীকে যঈফ বলা মানে অসংখ্য ইমামদের অভিমতকে হেয় করা। 


তৃতীয় আপত্তিকর রাবী: 


ইমাম ইবনুল জাওযী (رحمة الله) এই সনদের তৃতীয় আপত্তিকর রাবী হিসেবে ইয়াহইয়া বসরী রাবীকে দায়ী করেছেন। যার মূূল নাম হল (يحيى بن ميمون بن عطاء) ইয়াহইয়া ইবনে মায়মুন বিন আতা। 


✦ বিখ্যাত হাদিসের ইমাম ইবনে হিব্বান তাকে সিকাহ রাবীর তালিকায় স্থান দিয়েছেন। ৯০

৯০. ইমাম ইবনে হিব্বান, কিতাবুস্-সিকাত, ৭/৬০৩ পৃ., আল্লামা মুগলতাঈ, ইকমালু তাহযিবুল কামাল, ১২/৩৭২ পৃ. ক্রমিক: ৫২০৮


তবে তাকে ইমাম আহমদ থেকে শুরু করে আরও অনেকে যঈফ রাবী বলেছেন। তাই সর্বোপরি আমরা বলতে পারি যে, উক্ত হাদিসটি ‘হাসান’ পর্যায়ের, কখনই জাল হতে পারে না। অপরদিকে উপরের আরেক সনদ দ্বারা এই হাদিস শাহেদ প্রমাণিত হওয়ায় এই হাদিস গ্রহণযোগ্য তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই আমাদের দেশের কাট মোল্লা যারা এই হাদিসকে জাল বলেন, বুঝতে হবে যে, তারা আসমাউর রিজাল কখনই পড়েইনি।


পর্যালোচনা:


এ হাদিস থেকে বুঝা গেল যে, আমরা যে দুনিয়ায় বসবাস করছি সে দুনিয়াও সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর পিয়ারা হাবীবের উসিলায়।


দ্বিতীয় সূত্র: 


❏ ইমাম দায়লামী (رحمة الله) এ শব্দে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন-

يَقُول الله عز وَجل وَعِزَّتِي وَجَلَالِي لولاك مَا خلقت الْجنَّة ولولاك مَا خلقت الدُّنْيَا

-‘‘মহান আল্লাহ বলেন, আমার ইজ্জত ও জালালিয়াতের শপথ! হে আমার পিয় হাবীব! যদি আমি আপনাকে সৃষ্টি করতাম না বানাতাম জান্নাত, না বানাতাম দুনিয়া।’’ (ইমাম দায়লামী, আল-ফিরদাউস, ৫/২২৭ পৃ. হা/৮০৩১, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।)


পর্যালোচনা:


এ হাদিস থেকে বুঝা গেল যে, আমরা যে দুনিয়ায় বসবাস করছি সে দুনিয়া এবং যে জান্নাতের আশায় ইবাদতের মগ্ন থাকি সে জান্নাতও সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর পিয়ারা হাবীবের উসিলায়। রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি যাদের প্রেম নেই এ কথা তাদের কানে বিষের চেয়েও ভয়ংকর লাগবে এটাই স্বাভাবিক। 


সপ্তম হাদিস


❏ ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله)সহ একজামাত ইমামগণ সংকলন করেন-

ويرى أنه لما خلق الله تعالى آدم، ألهمه أن قال: يا رب، لم كنيتني أبا محمد، قال الله تعالى: يا آدم ارفع رأسك، فرفع رأسه فرأى نور محمد في سرادق العرش فقال: يا رب، ما هذا النور؟ قال: هذا نور نبي من ذريتك اسمه في السماء أحمد، وفي الأرض محمد، لولاه ما خلقتك ولا خلقت سماء ولا أرضًا.

-‘‘হযরত আদম (عليه السلام) আল্লাহ্ পাকের দরবারে আবেদন করেছিলেন, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে ‘আবূ মুহাম্মদ’ উপনামে কেন ভূষিত করেছেন? আল্লাহর পক্ষ হতে হুকুম আসলো,  হে হযরত আদম (عليه السلام)! তোমার মাথা তুলে দেখ। আদম (عليه السلام) মাথা উঠিয়েই দেখতে পেলেন তাঁর চোখের সামনে আরশের পর্দায় নূরে মুহাম্মদী ভেসে ওঠল। হযরত আদম (عليه السلام) আরজ করলেন,  হে আমার প্রতিপালক! এই নূর মোবারক কার? জবাবে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, এই নূর হলো ঐ নবীর যিনি তোমার বংশধরে নবী হিসেবে আগমন করবে, আসমানে যার নাম হবে আহমদ, আর যমীনে মুহাম্মদ। যদি তিনি না হতেন, তাহলে আমি না তোমাকে সৃষ্টি করতাম, না আসমানকে, আর না যমীন কে।’’ ৯১

৯১. ইমাম শিহাবুদ্দীন কাস্তাল্লানী, মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়া, ১/৩৩ পৃ., আল্লামা জুরকানী, শরহুল মাওয়াহেব, ১/৭৮ পৃ., আল্লামা শফী উকাড়ভী, যিকর ই হাসীন, ৩১ পৃ., আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন ইসমাঈল নাবহানী, জাওয়াহিরুল বিহার, ৩/৩৫২ পৃ.


পর্যালোচনা: 


❏ ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) লিখেন-

ويشهد لهذا، ما رواه الحاكم في صحيحه أن آدم عليه الصلاة والسلام رأى اسم محمد مكتوبًا على العرش

-‘‘এ হাদিসটির শাহেদ পাওয়া যায় যা ইমাম হাকেম (رحمة الله) সহীহ সূত্রে সংকলন করেছেন, নিশ্চয়ই হযরত আদম (عليه السلام) আরশের পায়ায় হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নাম মোবারক লিপিবদ্ধ দেখতে পেয়েছিলেন।’’(ইমাম কাস্তালানী, মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যাহ, ১/৪৭ পৃ.)


❏ ইমাম জুরকানী (رحمة الله) এ হাদিস প্রসঙ্গে লিখেন-

أي: يقويه، ما رواه الحاكم في صحيحه المستدرك عن عمر رفعه

-‘‘এ হাদিসকে আরও শক্তিশালী করেছে ইমাম হাকেম (رحمة الله) এর আল-মুস্তাদরাকের সহীহ সূত্রের হযরত উমর (رضي الله عنه)-এর বর্ণনা (যা আমি ইতোপূর্বে প্রথম হাদিস হিসেবে উল্লেখ করেছি)।’’ (ইমাম জুরকানী, শারহুল মাওয়াহেব, ১/৮৬ পৃ.) বুঝা গেল এ হাদিসটি শাওয়াহেদ থাকায় শক্তিশালী বলে প্রমাণিত।

অষ্টম হাদিস


অষ্টম হাদিস


❏ ইমাম বুরহানুদ্দীন হালাবী (رحمة الله)সহ আরও অনেকে সংকলন করেন-

وذكر صاحب كتاب شفاء الصدور في مختصره عن علي بن أبي طالب ؓ عن النبي ﷺ عن الله عز وجل أنه قال: يا محمد وعزتي وجلالي لولاك ما خلقت أرضي ولا سمائي، ولا رفعت هذه الخضراء، ولا بسطت هذه الغبراء . وفي رواية عنه ولا خلقت سماء ولا أرضا ولا طولا ولا عرضا

-‘শিফাউস সুদূর কিতাবের লিখক তার ‘মুখতাসার’ কিতাবে হযরত আলী ইবনে আবী তালেব (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন। তিনি নবি করীম (ﷺ) হতে বর্ণনা করেন, মহান রব তা‘য়ালা ইরশাদ করেন, হে মুহাম্মদ (ﷺ)! আমার ইজ্জত ও জালালিয়াতের শপথ, যদি আমি আপনাকে সৃজন না করতাম, না সৃজন করতাম এ যমিন, না আসমান। আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি উঁচু করতাম না উর্ধ্বের ঐ নীল বর্ণের ছাদ এবং নিম্নের এ ধূসর বর্ণের পৃথিবী। উক্ত সাহাবী থেকে অপর এক বর্ণনায় এসেছে, আপনাকে সৃজন না করলে করতাম না এ আকাশ, না যমীন, না উঁচু এবং নিচু।’’ ৯২

৯২. 

ক. ইমাম বুরহানুদ্দীন হালাবী, সিরাতে হালবিয়াঃ ১/৩১৭ পৃ.

গ. আল্লামা ইবনে হাজর হায়সামী : আল-ওসায়েল, ১/১১৫ পৃ.

ঘ. আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন ইসমাঈল নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ২/১১৫ পৃ:

ঙ. ইমাম ইবনে সালেহ শামী, সবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ১/৭৫ পৃ.


নবম হাদিস:


❏ আল্লামা আব্দুর রহমান ছাফুরী (رحمة الله) সংকলন করেন-

وعن علي ؓ قلت يا رسول الله مم خلقت قال لما أوحى إلى ربي ما أوحى قلت يا رب خلقتني قال وعزتي وجلالي لولاك ما خلقت أرضا ولا سماء

-‘‘হযরত আলী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি নবীকে সম্বোধন করে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! আপনাকে কি জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে? প্রিয় নবী (ﷺ) তাঁর জবাবে ইরশাদ করলেন, আল্লাহ্ পাক আমার কাছে যখন ওহী প্রেরণ করছিলেন তখন আমি আরজ করেছিলাম, ইয়া রাব্বুল আলামীন! আপনি আমাকে কি জন্য সৃষ্টি করেছেন? তখন মহান রব তা‘য়ালা ইরশাদ করেন, আমার ইজ্জত ও জালালীয়াতের শপথ! আপনাকে যদি সৃষ্টি না করতাম, তাহলে আমি না সৃষ্টি করতাম জমিন, না আসমান।’’ ৯৩

৯৩. 

ক. আল্লামা আব্দুর রহমান ছাফুরী শাফেয়ী : নুযহাতুল মাযালিস : ২য় খণ্ড ৭৪ পৃ.

খ. আল্লামা ইমাম মারযুক : শরহে কাসীদায়ে বুরদা : পৃ নং : ৭১


দশম হাদিস:


❏ আল্লামা আজলূনী (رحمة الله) একটি হাদিস সংকলন করেন-

(أَتَانِي جِبْرِيلُ فَقَالَ يَا مُحَمَّدُ لَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ الْجَنَّةَ وَلَوْلَاكَ مَا خَلَقْتُ النَّارَ) رواه الديلمي عن ابن عمر.

-‘‘(একদা আমার নিকট হযরত জিব্রাঈল (عليه السلام) এসে বললেন, মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেছেন, হে মুহাম্মদ! আপনাকে যদি আমি সৃষ্টি না করতাম বানাতাম না বেহেশত, আর  না দোযখ।) এ হাদিসটি ইমাম দায়লামী (رحمة الله) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেছেন।’’ (আল্লামা আজলূনী, কাশফুল খাফা, ১/৫৪ পৃ. হা/৯১)


উপরের আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, শব্দগতভাবে হাদিসটি প্রমাণিত না হলেও মমার্থ বিশুদ্ধতার পক্ষে অনেক সূত্রে হাদিসে পাক বর্ণিত থাকায়, এ বিষয়ক হাদিসকে মুতাওয়াতির বলা যায়। এ ধরনের হাদিসে পাককে অস্বীকার করা কুফুরীর ন্যায়।


বিভিন্ন মুহাদ্দিস, মুফাস্সিরদের মমার্থ বর্ণনা:


এখন আমি উপরের দশটি হাদিসের মমার্থ হাদিস (لَوْلَاكَ لَمَا خَلَقْتُ الْأَفْلَاكَ) ‘আপনাকে সৃজন না করলে কিছুই সৃষ্টি করতাম না’ মমার্থ বর্ণনার স্বপক্ষে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস, ফুকাহা, মুফাসসিরগণের বক্তব্য এবং এটিকে তাদের গ্রন্থে মমার্থ হাদিস হিসেবে উল্লেখ করেছেন কিনা তার তথ্য সূত্র উল্লেখ করবো।


১. ইমাম শরফুদ্দীন বুছুরী (رحمة الله) এর লিখিত ‘কাসীদায়ে বুরদায়’ লিখেছিলেন,  

لولاه لم تخرج الدنيا من العدم

-‘‘যদি তিনি [রাসূল (ﷺ)] না হতেন দুনিয়া নাস্তির অন্ধকার হতে অস্তির আলোতে আসতো না।’’ 


উক্ত কাসিদার ব্যাখ্যায় আল্লামা ইমাম খরপূতী (رحمة الله) ‘শরহে কাসীদায়ে বুরদা’ নামক গ্রন্থের ৭১-৭২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,

فى هذا البيت تلميح الى ما نقل فى الحديث القدسى لَوْلَاكَ لَمَا خَلَقْتُ الْأَفْلَاكَ  والمراد من الافلاك جميع المكنونات اطلاقا لاسم الجزء على الكل واشارة على ما وقع له صلى الله ﷺ فى ليلة الاسراء فانه عليه السلام لما سجد لله تعالى فى سدرة المنتهى قال الله تعالى له عليه الصلوة و السلام انا و انت و ما سوى ذلك خلقته لاجلك-

-‘‘এই চরণে ইঙ্গিত হল এ হাদিস-ই-কুদসীর প্রতি যা হল لَوْلَاكَ لَمَا خَلَقْتُ الْأَفْلَاكَ আর الْأَفْلَاكَ এর মমার্থ হল আল্লাহর সমগ্র জগৎ। কেননা অংশ দ্বারা সমষ্টিকে বুঝানো হয়েছে। এতে শবে-ই-মি‘রাজে সংঘটিত ঘটনার প্রতিও ইঙ্গিত বর্তমান। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহার নিকট আল্লাহর দরবারে সিজদায় পতিত হলেন, তখন আল্লাহ্ তাকে বললেন, এখানে আমি ও আপনি, এ ছাড়া যা কিছু আছে, সমুদয়কে আমি সৃষ্টি করেছি আপনারই নিমেত্তে।’’৯৪

৯৪.আল্লামা খরপূতি: শরহে কাসীদায়ে বুরদা, ৭১ পৃ.


২. আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) ‘মাদারেজুন নবুয়ত’ সিরাত গ্রন্থে ১ম খণ্ডে উল্লেখ করেন, 

مخلوق كا ظهور روح مظهر محمد كے واسط سے هے اگر روح محمدى نه هوتى خدا تعالى كو كوئى نه جانتا كيونكه كسى كا وجود هى نه هوتا- مدرج النبوة: جلد الاول 

-“সৃষ্টি জগতের বিকাশ হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এর পবিত্র রূহ মুবারকের ওসীলায় হয়েছে। যদি রূহে মুহাম্মদী (ﷺ) না হতেন তবে আল্লাহ্ তা‘য়ালাকে কেউ জানত না। কেননা তিনি না হলে সৃষ্টির মধ্যে কারো অস্তিত্বও হত না।


৩. বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) এর শ্রদ্ধেয় বাবা ও উস্তাদ আল্লামা শাহ আব্দুর রহিম মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) ‘আনফাসে রহিমিয়্যা’তে উল্লেখ করেন,  

از عرش تا بفرش وملائكة علوى و جنس سفلى همہ ناشى ازاں حقيقته محمديہ صلى الله عليہ وسلم  است وقول رسول مقبول اول ما خلق نورى وخلق الله من نورى وقول الله تعالى لو لاك لما خلقت الافلاك وقوله لولاك لما اظهرت الربوبيتى- 

-‘‘আরশ থেকে ফরশ পর্যন্ত উর্ধ্ব জগতের সকল নূরানী ফেরেশতা,  নিম্নজগতের সকল সৃষ্টি হাকিকতে মুহাম্মাদিয়্যা থেকেই সৃষ্টি করা হয়েছে। নবী করীম (ﷺ)  বাণী,  সর্ব প্রথম আল্লাহ্ তা‘য়ালা আমার নূরকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমার নূর থেকেই সকল বস্তুকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ তা‘য়ালা প্রিয় মাহবুব (ﷺ)  কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেছেন,  (হে মাহবুব)! আপনি না হলে আমি কোনো কিছুই সৃষ্টি করতাম না এবং আপনি না হলে আমি আমার প্রভুত্ব প্রকাশ করতাম না।’’ ৯৫

৯৫. আল্লামা শাহ আব্দুর রহিম মুহাদ্দিস দেহলভী : আনফাসে রহিমিয়্যাহ-১৪০ পৃ.


অতএব এতবড় একজন সম্মানিত মুহাদ্দিস উক্ত হাদিসটিকে হাদিসে কুদ্সী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করলেন। আল্লামা শাহ আব্দুর রহিম মুহাদ্দিস দেহলভী (رحمة الله) এর উপরে খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ভারতীয় উপমহাদেশে আর হবে কী না সন্দেহ আছে। শাহ আব্দুর রহিম (رحمة الله) এর চেয়ে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, মাওলানা মুতীউর রহমান, মাওলানা জাকারিয়া হাসনাবাদী এবং মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী সবাই কি বড় মুহাদ্দিস! হাদিস বিশারদ!  বাহ্! বাহ!


৪. ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمة الله) তাঁর বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ ‘কাসীদায়ে নুমানে’ একটি কাসীদা বর্ণনা করেন এভাবে- 

انت الذى لولاك ما خلق امرء●  كلا و لا خلق الورى لولاك-

-‘‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! আপনি না হলে কোন ব্যক্তিই সৃষ্টি হতো না কখনই এবং আপনি না হলে কোন মালূককে সৃষ্টি করা হতো না।’’ (কাসীদায়ে নু‘মান) দেখুন ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) একজন তাবেয়ী ও হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি নিজে নবীর রওযা মোবারকের সামনে এই কাসীদাটি সহ কাসীদায়ে নুমানের সবগুলো কাসীদা শুনিয়েছিলেন রাসূল (ﷺ) কে। আর তিনি ১৮ জন সাহাবীর দর্শন লাভ করেছেন। লক্ষ্য করুন ইমাম আযমের মত ইমামের আক্বীদা হল কি, আর তথাকথিত নামধারী আলেমদের আক্বিদা কি। তাহলে কি তারা ইমামে আযমের চেয়ে বড় ইমাম সেজে গেলেন?


৫. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) উল্লেখ করেন- 

كما قال تعالى: لولاك لما خلقت الافلاك

-‘‘যেমন মহান আল্লাহ্ তা‘য়ালা ইরশাদ করেন, হে হাবিব! আপনাকে সৃষ্টি না করলে কোন কিছু সৃষ্টি করতাম না।’’৯৬

৯৬. মোল্লা আলী ক্বারী, শরহে শিফা: ২/১২৭পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।


৬. বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম ফার্সী (رحمة الله) তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘মাতালিউল মুর্সারাত ফি শরহে দালায়েলুল খায়রাতে’র ২৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেন- 

كذالك هو صلى الله عليه و سلم روح الاكوان و حياتها وسر وجودها ولولاه لم يكن لها نور ولا دلالة لذهبت و تلاشت ولم يكن لها وجود-

-‘‘এরূপে নূরে খোদা (ﷺ) সকল রূহ এর জীবনী শক্তি ও সকল অস্তিত্বের নিগুঢ় তত্ত্ব। তিনি যদি না হতেন বা না থাকতেন সকল সৃষ্টিই অস্তিত্বহীন হয়ে যেত। ’’


৭. বিখ্যাত মুফাসসির, মুহাদ্দিস এবং ফকীহ, সূফী আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (رحمة الله) তাফসীরে রুহুল বয়ানে লিখেন,  

وقال حكاية عن الله (لولاك لما خلقت الكون)

-‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালার বাণী, আপনাকে সৃষ্টি না করলে কুল কায়েনাত সৃষ্টি করতাম না।’’ ৯৭

৯৭. আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী : তাফসীরে রুহুল বয়ান, ৩/২৫৫ পৃ, সূরা আরাফ, আয়াত নং-১৫৬


৮. বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন,  

كما روى لولاك لما خلقت الافلاك فانه صحيح-

-‘‘যেমন বর্ণিত আছে আল্লাহর বাণী, রাসূল (ﷺ) কে সৃষ্টি না করলে কোন কিছুই সৃষ্টি হত না,  কথাটি অবশ্যই বিশুদ্ধ।’’ ৯৮

৯৮. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : শরহে শিফা : ১/১৩ পৃ, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, তারা কিছু লেখক মোল্লা আলী ক্বারী (রহ.) এর নামে মিথ্যা অপবাদ রটানোর চেষ্টা করেছেন। মোল্লা আলী ক্বারী নাকি জাল বলেছেন। তাই তাঁদের উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা দেখার জন্য অনুরোধ রইলো।


৯. আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন ইসমাঈল নাবহানী (رحمة الله) তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেন,  

قوله تعالى : ولولاه لم  تخلق الافلاك و لا الاملاق

-‘‘মহান ‘‘আল্লাহ্ বলেন, হে প্রিয় হাবীব! আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি কোন কিছুই করতাম না। এমনকি কোন রাজ্য সৃষ্টি করতাম না।’’ ৯৯

৯৯. আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন ইসমাঈল নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার, ৩/৩৬৩ পৃ.


১০. আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (رحمة الله) তাফসীরে ‘রুহুল বায়ানে’ সূরা সফ এর ৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় এক পর্যায়ে লিখেন, 

القوله تعالى: لولاك لما خلقت الافلاك

-‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা বলেন,  হে হাবীব আপনাকে সৃষ্টি না করা হলো কিছুই সৃষ্টি করতাম না।’’ ১০০

১০০. আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী : রুহুল বায়ান, :১০/৮৮০ পৃ.


১১. কুতুবে রব্বানী, ইমাম শেখ মুজাদ্দেদ আলফে সানী আহমদ ফারুক সেরহন্দী (رحمة الله) ৪৪ নং মাকতুবাতে বলেন,  

ولولاه صلى الله عليه و سلم لما خلق الله سبحانه الخلق و لما اظهر الربوبية و كان و ادم بين الماء و الطين -

-‘‘যদি হুযূর (ﷺ) কে সৃষ্টি না করা হতো তাহলো আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালা কোন সৃষ্টিকেই সৃষ্টি করতেন না এবং তাঁর রবুবিয়্যাত প্রকাশ হতো না,  আর রাসূল (ﷺ) তখনও ছিলেন যখন আদম (عليه السلام) মাটি ও পানির মাঝখানে ছিলেন।’’ ১০১

১০১. আল্লামা শায়খ ইউসূফ নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ২/২০৮ পৃ.


১২. আল্লামা শরীফ সৈয়দ আহমদ বিন আব্দুল গণী বিন উমর দামেস্কী (رحمة الله) বলেন,  

كما قال تعالى فى الحديث القدسى لولاك ما خلقت الافلاك

-‘‘যেমন আল্লাহ্ তা‘য়ালা হাদিসে কুদসীতে বলেন, হে হাবীব! আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি কোনো কিছুই সৃজন করতাম না।’’ ১০২

১০২. আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন ইসমাঈল নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ৩/৩৯৮ পৃ.


১৩. ইমাম আরিফ বিল্লাহ সায়্যেদ শরীফ আব্দুল্লাহ মীরগীনানী (رحمة الله) তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ الاسئلة النفيسة এর ৩২ তম প্রশ্নের জবাবে  বলেন,  

كما صرح بذلك الحديث فى الخطاب الحضرة لادم عليه السلام، ولولاه ما خلقتك ولا خلقت سماء ولا ارضا...الخ 

-‘‘হযরত আদম (عليه السلام) এর খিতাব তথা ভূষণের হাদিস দ্বারা এই কথা স্পষ্ট হয়েছে যে,  আল্লাহর বাণী হে আদম! মুহাম্মদ (ﷺ) কে সৃষ্টি না করা হলে তোমাকে সৃষ্টি করতাম না, তিনি না হলে না সৃজন করতাম আসমান না যমিন।’’ ১০৩

১০৩. আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ৪/১১৪, পৃ.   


১৪. আল্লামা ইমাম আরিফ বিল্লাহ শায়েখ আলী দুদাহ বুসূনবী (رحمة الله) তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থكتاب خلاصة الاثر  এর ১৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেন-

ان اصل الكون نبينا محمد صلى الله عليه و سلم لقوله تعالى فى الخبر القدسى: لولاك لما خلقت الافلاك، فهو اولى ان يكون اصلا- 

-‘‘নিশ্চয় রাসূল (ﷺ) সকল সৃষ্টির মূল হওয়া আল্লাহ্ তা‘য়ালার এই হাদিসে কুদসীই যথেষ্ট যেমন বর্ণিত আছে, হে হাবীব (ﷺ)! আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি কোনো কিছুই সৃজন করতাম না। আর এটিই রাসূল (ﷺ)! এর সকল সৃষ্টির মূল হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’’ ১০৪

১০৪. আল্লামা শায়খ ইউসূফ নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ৪/১৯৮ পৃ.


১৫. ইমাম শায়খ আব্দুল করিম জলিলী (رحمة الله) (ওফাত ৮০৫ হি.) তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ رسالته المسماة مدارج الوصول এ লিখেন, 

وقد ورد عنه صلى الله عليه وسلم انه قال : ان الله تبارك و تعالى قال له فى ليله المعراج لولاك لما خلقت الافلاك-

-‘‘যেমন বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘য়ালা মিরাজের রজনীতে আমাকে বলেন, হে হাবীব! আপনাকে সৃষ্টি না করলে আমি কোনো কিছুই সৃজন করতাম না।’’ ১০৫

১০৫. আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন ইসমাঈল নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার : ৪/২৫৮ পৃ.


১৬. আল্লামা মুহাম্মদ জামালিদ্দীন বিন মুহাম্মদ সাঈদ বিন কাসেম আল হালাক আলকাসেমী (رحمة الله) তাঁর উসূলে হাদিসের কিতাবقواعد التحديث من فنون مصلح الحديث  গ্রন্থের (যা দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত হতে প্রকাশিত) ১/১৫৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,

كحديث:لولاك ما خلقت الافلاك

-‘‘যেমন হাদিসে কুদসীতে রয়েছে-হে হাবিব!  (ﷺ) আপনাকে সৃষ্টি না করলে কিছুই সৃষ্টি করতাম না।’’


১৭. ইমাম আবুল কাসেম আব্দুর রহমান বিন সুহাইলি (رحمة الله) (ওফাত. ৫৮১ হি.) তার কিতাব الروض الانق فى السيرة النبوية এর ১/১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-

ان الله قال لمحمد لولاك ما خلقت الافلاك

-‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা তাঁর হাবিব (ﷺ) কে লক্ষ্য করে বলেন, আপনাকে সৃষ্টি না করা হলে কিছুই সৃষ্টি করতাম না।’’


১৮. আল্লামা মাহদী আল ফাসী (رحمة الله) (ওফাত. ১২২৪ হিজরী.) বলেন, 

لولاك ما خلقت الكون

-‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা তাঁর হাবিব (ﷺ) কে সৃষ্টি না করলে কোন জগতই সৃষ্টি করতেন না।’’ (মাতালিউল মার্সারাত)


১৯. আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (رحمة الله) তাঁর তাফসীরে উল্লেখ করেন, 

ورد بلسان القدس ( لولاك لما خلقت الافلاك)

-“মহান আল্লাহর কুদরতের জবানের কথা, হে মাহবুব! আপনাকে সৃষ্টি না করলে কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না।’’ (তাফসীরে রূহুল বায়ান,১/২৭ পৃ. সূরা বাক্বারা,আয়াত ১) 


✦ তিনি তাফসীরের অন্য স্থানে বর্ণনা করেন এভাবে-

ان الله العظيم هو فضل الله عليك ورحمته كما انك فضل الله ورحمته على العالمين ولهذا قال (لولاك لما خلقت الافلاك)  

-“দয়াময় ‘আল্লাহ্ তাঁর হাবিব সর্ম্পকে বলেন হে হাবিব! আপনাকে সৃষ্টি না করা হলে কিছুই সৃষ্টি করতাম না। (তাফসিরে রূহুল বায়ান,  ২/২৮৩ পৃ. সূরা নিসা,  আয়াত নং-১১৩ ও ব্যাখ্যা) 


✦ আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেন-

ان اصل الكون كان النبي عليه السلام لقوله لولاك لما خلقت الكون

-“নিশ্চয় রাসূল হলেন সমস্ত সৃষ্টি জগতের মুল এজন্যই মহান ‘‘আল্লাহ্ হাদিসে কুদসীতে বলেন,  হে হাবিব! আপনাকে সৃষ্টি না করা হলে কিছুই সৃষ্টি করতাম না।’’ (তাফসীরে রূহুল বায়ান, ৫/১৯৯ পৃ. সূরা বনি ইসরাইল আয়াত-৮৫) 


✦ অন্যত্র তিনি বর্ণনা করেন-

كما قال عليه السلام (انا من الله والمؤمنون من فيض نورى) فهو الغاية الجليلة من ترتيب مبادى الكائنات كما قال تعالى (لولاك لما خلقت الافلاك)

-‘‘রাসূল  বলেন, আমি আল্লাহ্ হতে আর মু‘মিনগণ আমার নূরের ফয়জ থেকে সৃষ্টি .....মহান আল্লাহ্ তাঁর হাবিব সর্ম্পেকে বলেন, হে হাবিব! আপনাকে সৃষ্টি না করা হলে কিছুই সৃষ্টি করতাম না।’’ (তাফেিসর রূহুল বায়ান, ৫/৫২৯ পৃ., সূরা আম্বিয়া, আয়াত নং ২১) 


উক্ত তাফসীরে আরও উল্লেখ করেন, 

قوله تعالى فى الحديث القدسي خطابا للنبى عليه السلام (لولاك لما خلقت الافلاك)

-‘‘মহান আল্লাহ্ হাদিসে কুদসীতে তার রাসূল (ﷺ) কে খেতাব করে বলেন,  হে হাবিব! আপনাকে সৃজন না করা হলে কিছুই সৃজন করতাম না। (তাফেিসর রূহুল বায়ান,  ৬/১৫৪ পৃ. সূরা নুর আয়াত-৩৫) 


উক্ত তাফসীর কারক তার তাফসীরে অন্য স্থানে উল্লেখ করেন, 

ذكر النبي عليه السلام والله تعالى خاطبه بقوله :لولاك يا محمد ما خلقت الكائنات

-“মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূল (ﷺ)‘র দিকে খেতাব করে বলেন, হে হাবিব ! আপনাকে সৃষ্টি না করা হলে আমি কুল কায়েনাত সৃষ্টি করতাম না।’’ (তাফেিসর রূহুল বায়ান,  ৬/১৯২ পৃ. সূরা ফুরকান আয়াত, ৮)


২০. দেওবন্দীদের বড় মুহাদ্দিস মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী ছাহেব তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আশ শিহাবুছ ছাকিব’ কিতাবে ২৭০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন- 

غرضيكہ حقيقت محمد صلى الله عليہ وسلم التحية واسطہ جملہ كمالات عالم عالميان ہے يہ هی معنى لولاك لما خلقت الافلاك اور اول ما خلق الله نورى اور انا نبى الانبياء كے ہیں -

-‘‘মোট কথা হলো সমস্ত কায়েনাত বা আলম হাকীকতে মুহাম্মদী (নূরে মুহাম্মদী) থেকে সৃষ্ট। এর অর্থ এই, যে আল্লাহর কথা যদি আপনাকে না সৃজন করতাম তাহলে আসমান যমীন কোন কিছুই সৃজন করতাম না। রাসূলের বাণী, সর্ব প্রথম আল্লাহ্ আমার নূর মোবারক সৃষ্টি করেছেন এবং আরও বলেছেন, আমি নবীদেরও নবী।’’ তাই দেওবন্দীদেরকে বলছি নিজেদের মুরব্বীদের কথাটা একটু চিন্তা করুন তিনি উক্ত রেওয়ায়েতকে হাদিসে কুদসী বলেছেন।


২১. মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী তার “প্রচলিত জাল হাদীস” গ্রন্থে উক্ত হাদিসটিকে মিথ্যুকদের বানানো কথা বলে উল্লেখ করেছেন। অথচ তার উস্তাদ ও মুরব্বীব মাওলানা আহমদ শফী তার “সুন্নাত বিদআতের সঠিক পরিচয়” নামক গ্রন্থের ১৬৪ পৃষ্ঠায় উক্ত হাদিসটিকে তাগিদ দিয়ে বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলেই গ্রহণ করেছেন। তিনি লিখেন-‘‘ওহাবীগণ নবী (ﷺ) এর শানে নিতান্ত গোস্তাখি ও বেয়াদবী মূলক শব্দ ব্যবহার করেন এবং নিজেকে স্বয়ং ঐ সত্ত্বার [রাসূল (ﷺ)] এর সমকক্ষ ধারণা করেন। অথচ তিনি না হলে সমগ্র সৃষ্টি জগত অস্তিত্ব লাভ করত না।’’

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আহমদ শফীর উক্ত বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় তিনি নিজে সম্পূর্ণ বিশ্বাস নিয়েই এই কথা দৃঢ়ভাবে লিখেছেন। মহান রব তা‘য়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবের শান-মান অস্বীকারকারীদের খপ্পর থেকে আমাদেরকে হিফাজত করুন, আমিন।

Top