তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ
ইলম গায়বের বিপক্ষে ফকীহগণের বিবিধ উদ্ধৃতির বিবরণ
১নং আপত্তিঃ
❏ ‘ফাত্ওয়ায়ে কাযী খাঁ, এর মধ্যে আছে-
رَجُلُّ تَزَوَّجَ بِغَيْرِ شُهُوْدٍ فَقَالَ الرَّجُلُ وَالْمَرْءَةُ خدا اور رسول
راه گواه كرديم قَالُوْا يَكُوْنُ كُفْرًا لِاَنَّهُ اِعْتَقَدَ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَعْلَمُ الْغَيْبَ وَهُوَ مَاكَانَ يَعْلَمُ الْغَيْبَ حِيْنَ كَانَ فِى الْحَيَوةِ فَكَيْفَ بَعْدَ الْمَوْتِ
-‘‘কোন এক ব্যক্তি সাক্ষী ছাড়াই বিবাহ করলো-বর ও কনে উভয়ে বললো, ‘আমরা আল্লাহ ও রাসূলকে সাক্ষী করেছি’ লোকে বলে এ উক্তি কুফর। কেননা তারা (বর-কনে) এ আকীদা পোষণ করেছে যে রাসূলুল্লাহ আলাইহিস সালাম অদৃশ্য বিষয়াদিতে জ্ঞাত; অথচ তাঁর জীবিতাবস্থায়ও এ জ্ঞান ছিল না, মৃত্যুর পরে এ জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
{ইমাম কাযী খাঁন, ফতোয়ায়ে কাযী খাঁন, ৪/৮৮৩}
২নং আপত্তিঃ
❏ ‘শরহে ফিকহে আকবরে’ মোল্লা আলী কারী (رحمة الله) বলেনঃ
وَذَكَرَ الَّحَنْفِيَّةُ تَصْرِيْحًا بِالتَّكْفِيْرِ بِاِعْتِقَادِ اَنَّ النَّبِىَّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَعْلَمُ الَغَيْبَ لِمُعَارِ ضَةِ قَوْلِهِ تَعَالَى قُلْ لاَيَعْلَمُ مَنْ فِى السَّمَوَتِ وَالْاَرْضِ الْغَيْبِ اِلاَاللهُ
-‘‘হানাফীগণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, নবী করীম আলাইহিস সালাম অদৃশ্য বিষয়াদিতে জ্ঞাত এ বিশ্বাস পোষণ করাটা কুফর।
❏ কেননা এ ধরনের বিশ্বাস আল্লাহ তা’আলার ফরমানঃ
قُلْ لاَيَعْلَمُ مَنْ فِىْ السَّمَوَتِ وَ الْاَرْ ضِ الْعْيْبَ اِلاَ اللهَُ
-‘‘বলে দিন যে আসমান সমূহ ও যমীনের অদৃশ্য বিষয়াদি খোদা ছাড়া অন্য কেউ জানে না) এর পরিপন্থী।’’
{মোল্লা আলী ক্বারীঃ শরহে ফিকহুল আকবরঃ ১৮৫ পৃ.}
উল্লেখিত দু’টো ভাষ্য থেকে বোঝা গেল যে, হুজুর আলাইসি সালামকে ইলম গায়বের অধিকারী বলে মনে করাটা কুফর।
উত্তরঃ
উপরোক্ত উদ্ধৃতিদ্বয়ের মোটামুটি ও অভিযোগ খন্ডনোপযোগী উত্তর হচ্ছে, ভিন্ন মতাবলম্বীগণও রাসূল (ﷺ)-এর আংশিক অদৃশ্য জ্ঞানের বিশ্বাসী। সুতরাং, তারাও কাফির বলে গণ্য হলেন। কেননা, উক্ত উদ্ধৃতিসমূহকে সার্বিক ও আংশিক কথাটির উল্লেখ নেই। শুধু এ কথাই উক্ত হয়েছে যে, যে কেউ হুযুরের ইলমে গায়ব স্বীকার করে, সে কাফির। তাই একটি বিষয়ে হোক কিংবা একাধিক বিষয়ে হোক সর্বাবস্থায় সে কাফির। যাক সে কথা নাইবা বললাম,
❏ কিন্তু মওলবী আশরাফ আলী থানবী যে তাঁর রচিত ‘হিফজুল ঈমান’ কিতাবে ছেলেপিলে, পাগল ও জন্তুদের সম্বন্ধেও আংশিক অদৃশ্য জ্ঞান স্বীকার করেছেন;
❏ মওলবী খলীল আহমদ সাহেব ও তাঁর রচিত ‘বারাহীনুল কাতিআ’ কিতাবে শয়তান ও মৃত্যুর ফিরিশতার (মলাকুল মউত) ব্যাপক ইলমে গায়েবের কথা স্বীকার করেছেন।
❏ মওলবী কাসেমসাহবের ‘তাহযীরুন নাস’ কিতাবে এ ব্যাপারে আরও অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন- সৃষ্টিকূলের জ্ঞানরাশির তুলনায় রাসূল (ﷺ)-এর জ্ঞান অধিক বলে স্বীকার করেছেন।
এখন এ তিন স্বনামধন্য মহাবিদ্বানদের ব্যাপারে কি ফাত্ওয়া দেওয়া যাবে? এটি হলো সংক্ষিপ্ত উত্তর। এখন বিস্তারিতভাবে উত্তর শুনুন।
❏ ‘ফাতওয়ায়ে কাযীখাঁনে উল্লেখিত ইবারতে قَالَوْا (জনগণ বললে) শব্দটি উল্লেখিত আছে। কাযী খাঁ ও অন্যান্য ফকীহগণের একটা নিয়ম হচ্ছে, তাঁরা قَالُوْا শব্দটা সে সবক্ষেত্রেই ব্যবহার করেন, যেখানে বর্ণিত উক্তিটা তাঁদের মনঃপুত নয়।
❏ ‘ফাতওয়ায়ে শামীর’ পঞ্চম ও খন্ডের ৪৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখিত আছেঃ
لَفْظَةُ قَالُوْاتُذْكَرُ فِيْمَا فِيْهِ خِلاَفُ -‘‘ قَالُوْا
শব্দ সে ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়, যেখানে মতানৈক্য থাকে।’’
❏ ‘গুনিয়াতুল মুসতামলী শরহে মুনয়াতুল মুসাল্লী’ কিতাবে قنوت (কুনুত) এর বর্ণনায় উল্লেখিত আছেঃ
كَلاَمُ قَاضِى خان يُشِيْرَ اِلَي عَدَمِ اِخْتَيَارِهِ لَهُ حَيثُ قَالَ قاَلُوْا لاَ يُصَلِّىْ عَلَيْهِ فِى الْقَعْدَةِ الْاَخِيْرَةِ فَفِىْ قَوْلِهِ قَالُوْا اِشَارَةٌُ اِلَىٍ عَدَمِ اِسْتِحْسَا ِنِه َلُه َوِاَلى اَنَّهُ غَيْرُ مَرْوِىِّ عَنِ الْاَئِمَّةِ كَمَا قُلْنَاهُ فَاِنَّ ذَلِكَ مُتَعَارَفَّ فِىْ عِبَارَاتِ لِمَنِ اَسْتَقَرَء هَا
-‘‘কাযীখাঁর বর্ণিত উক্তিটাই তাঁর না পছন্দ হওয়ার ইঙ্গিত প্রদান করে। কেননা, তিনি বলেছেনঃ- قَالُوْ لاَيُصَلِّىْ তাঁর قَالُوْا বলার মধ্যে একথার প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, বর্ণিত উক্তিটা তাঁর পছন্দনীয় নয় এবং তা বিদগ্ধ ধমীয় ইমামগণ থেকেও বর্ণিত নয়। যেমন আমি প্রসঙ্গক্রমে পূর্বেই বর্ণনা করেছি। কেননা এ রীতি ফকীহগণের বিভিন্ন ইবারাতে প্রচলিত। যিনি অনুসন্ধান করেছেন, তিনিই জানেন।
{ইব্রাহীম হালাবীঃ গুনিয়াতুল মুসল্লী, বিতির নামায অধ্যায়, পৃ. ৩৬৩}
❏ সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘দুররুল মুখতারের ‘কিতাবুন নিকাহ’ এ উল্লেখিত আছেঃ
تَزَوَّجَ بِشَهَادَةِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ لَمْ يَجُزْ، بَلْ قِيلَ يَكْفُرُ
-‘‘কোন ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসূলকে সাক্ষী করে বিবাহ করলো, এটা না জায়েয বরং বলা হয়েছে যে সে কাফির হায়ে যাবে।’’
{আলাউদ্দিন হাস্কাফীঃ দুররুল মুখতারঃ ৩/২৭পৃ. কিতাবুন্-নিকাহ, দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, দ্বিতীয় প্রকাশ.১৪১২হি.}
❏ এ ইবাদতের প্রেক্ষাপটে আল্লামা শামী ‘তা’তারখানিয়া’ গ্রন্থ থেকে নিম্নবর্ণিত অংশটুকু উদ্ধৃত করেছেন -
قَالَ فِي التَّتَارْخَانِيَّة: وَفِي الْحُجَّةِ ذَكَرَ فِي الْمُلْتَقَطِ أَنَّهُ لَا يَكْفُرُ لِأَنَّ الْأَشْيَاءَ تُعْرَضُ عَلَى رَوْحِ النَّبِيِّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - وَأَنَّ الرُّسُلَ يَعْرِفُونَ بَعْضَ الْغَيْبِ قَالَ تَعَالَى - {عَالِمُ الْغَيْبِ فَلا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا} [الجن: ২৬] {إِلا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ} [الجن: ২৭] قُلْت: بَلْ ذَكَرُوا فِي كُتُبِ الْعَقَائِدِ أَنَّ مِنْ جُمْلَةِ كَرَامَاتِ الْأَوْلِيَاءِ الِاطِّلَاعَ عَلَى بَعْضِ الْمُغَيَّبَاتِ.
-‘‘মুলতাকাত’ গ্রন্থে আছে যে, সে ব্যক্তি কাফির হবে না। কেননা সমস্ত বস্তু বা বিষয় রাসূল (ﷺ)-এর রূহ পাকের কাছে পেশ করা হয়। আর রাসূলগণ আংশিকভাবে অদৃশ্য বিষয়াদিতে জ্ঞাত। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন “পছন্দনীয় রাসূল ছাড়া কারো নিকট তাঁর নিজের অদৃশ্য বিষয়াদি প্রকাশ করেন না।”
আমি বলছি, আকাইদের কিতাবসমূহে উল্লেখিত আছে যে, কোন কোন অদৃশ্য বিষয়ে অবগতি হওয়াও আল্লাহর ওলীগণের অন্যতম কারামত হিসেবে গণ্য।’’
{ইমাম ইবনে আবেদীন শামীঃ রুদ্দুল মুখতারঃ কিতাবুন্-নিকাহঃ ৩/২৭পৃ.}
❏ আল্লামা শামী (رحمة الله) আল মুরতাদ্দিন’ المرتدين শীর্ষক অধ্যায়ে মাসআলায় বাজ্জাজিয়া’ এর উল্লেখ করার পর বলেছেনঃ
وَحَاصِلُهُ أَنَّ دَعْوَى عِلْمِ الْغَيْبِ مُعَارِضَةٌ لِنَصِّ الْقُرْآنِ فَيَكْفُرُ بِهَا، إلَّا إذَا أُسْنِدَ ذَلِكَ صَرِيحًا أَوْ دَلَالَةً إلَى سَبَبٍ مِنْ اللَّهِ تَعَالَى كَوَحْيٍ أَوْ إلْهَامٍ
-‘‘সার কথা হলো- ইলমে গায়বের দাবী করাটা কুরআনের সু্পষ্ট আয়াতের পরিপন্থী এবং এর ফলে কাফির হয়ে যাবে। কিন্তু যদি এটাকে সুস্পষ্টভাবে বা রূপকভাবে ইলমে গায়ব অর্জনের উৎস যেমন ওহী কিংবা ইলহাস প্রভৃতির সহিত সম্বন্ধিত করা হয়, তাহলে কুরআনের আয়াতের বরখেলাফ হবে না।’’
{ইমাম ইবনে আবেদীন শামীঃ রুদ্দুল মুখতারঃ কিতাবুত-জিহাদঃ পরিচ্ছেদঃ মুরতাদঃ ৪/২৪৩ পৃ.দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, দ্বিতীয় প্রকাশ.১৪১২হি.।}
❏ ‘মাআদেনুল হাকায়েক’ শরহে কনযুদ দাকায়েক ও ‘খযানাতুর রিওয়ায়াত’ কিতাবে উল্লেখ আছেঃ
وَفِى الْمُضْمِرَاتِ وَالصَّحِيِحِ اَنَّهُ لاَ يَكْفُرَ لِاَنَّ الْاَنْبِيَاءَ يَعْلَمُوْنَ الْغَيْبَ وَيُعْرَضُ عَلَيْهِمُ الْاَشْيَاَءُ فَلاَيَكُوْنَ كُفْرًا
অর্থাৎ- মুযমারাত’ গ্রন্থে আছে সঠিক মত হলো সে ব্যক্তি কাফির হবে না। কেননা নবীগণ অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত। তাঁদের কাছে বস্তু বা বিষয়সমহ পেশ করা হয়। সুতরাং, তা কুফর হিসেব গণ্য হবে না।
উল্লেখিত ইবারত সমূহ থেকে বোঝা গেল যে, অদৃশ্য জ্ঞানের আকীদা পোষণ করার উপর কুফরের ফাত্ওয়া দেয়াটা ভুল। বরং ফকীহগণও এ আকীদা পোষণ করেন যে, রাসূল (ﷺ)কে ইলমে গায়ব দেয়া হয়েছে।
লক্ষ্যণীয় যে,
(অত্র পরিচ্ছেদের ২নং আপত্তির বর্ণনায় উদ্ধৃত বক্তব্যে)
❏ আল্লামা মোল্লা আলী কারী (رحمة الله) এর পুরো ইবারতটুকু আপত্তি উত্থাপনকারীরা উদ্ধৃত করেন নি। আসল ইবারত নিম্নে দেয়া গেল,
❏ যা মূলভাবকে প্রকাশ করছে-
ثَمَّ اِعْلَمَ اَنَّ الْاَنْبِيَاءَ لَمْ يَعْلَمُوْا الْمُغَيِّبَاتِ مِنَ الْاَشْيَاءِ اِلاَّ مَا اَعْلَمَ هُمُ اللهُ وَذكَرَ الْحنَفِيَّةَ تَصْرِيْحًا بِالتَّكْفِيْرِ الَخ
-‘‘জেনে রাখুন যে, নবীগণ আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক জ্ঞাত করানো ব্যতিরেকে অদৃশ্য বিষয়াদিতে জ্ঞাত হন না।
❏ হানাফীগণ সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ করেছেন যে, যে ব্যক্তি নবী (عليه السلام) কে সত্ত্বাগতভাবে ইলমে গায়বের অধিকারী রূপে বিশ্বাস করে সে কুফরী করল।’’
{মোল্লা আলী ক্বারীঃ শরহে ফিকহুল আকবারঃ পৃ. ১৮৫}
এখন পূর্ণ বক্তব্যটা বোঝা গেল যে,
❏ মোল্লা আলী কারী (رحمة الله) নবী আলাইহিস সালামকে সত্ত্বাগতভাবে ইলমে গায়বের অধিকারীরূপে মেনে নেওয়াটাই ‘কুফর’ বলছেন, যা প্রদত্ত জ্ঞানের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়। কেননা, খোদার প্রদত্ত জ্ঞানের কথাতো তিনিও স্বীকার করেছেন। তাঁর যে সমস্ত ইবারত আমি ইলমে গায়বের সমর্থনে পেশ করেছি, সেখানে তিনি রাসূল (ﷺ)কে পূর্বাপর যাবতীয় জ্ঞানের অধিকারীরূপে স্বীকার করেছেন।