ইয়াজিদের ব্যাপারে শরীয়তের ফয়সালা- 

অধ্যক্ষ আল্লামা মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান


এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইয়াজিদ ছিল একজন কুখ্যাত স্বৈর-শাসক। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলেমগণ ঐকমত্য হয়েছেন যে, ইয়াজিদ ছিল মিথ্যাবাদী, প্রতারক, ফাসেক-ফাজের এবং কবিরা গুনাহ্গার। তবে কাফের বলা ও লা’নত বর্ষণ করা/অভিশাপ দেয়ার ব্যাপারে কোন কোন ইমাম সতর্কতা অবলম্বন তথা (তাওয়াক্কুফ) করেছেন। কিন্তু ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম তাফতাযানী (رحمة الله) সহ অনেকেই ইয়াজিদকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছেন এবং তার উপর, তার অনুসারী ও সমর্থকদের উপর লা’নাতুল্লাহি বলেছেন। দলিল হিসেবে যে আয়াতে করিমা তারা পেশ করেছেন তা হল-

فهل عسيتم ان توليتم ان تفسدوا فى الارض وتقطعوا ارحامكم والئك لعنهم الله فاصمهم واعمى ابصارهم-

অর্থাৎ এটাই কি তোমাদের উচিত যে, তোমরা রাজ্যের মালিক হয়ে আল্লাহর জমীনে অন্যায় ও ফ্যাসাদ শুরু করে দেবে এবং আপন আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে দেবে? এরাইতো সেসব লোক যাদের উপর আল্লাহ্ লা’নত বর্ষণ করেছেন, তাদেরকে বধির এবং তাদের অন্তর্দৃষ্টিকে অন্ধ করে দিয়েছেন। [সূরা মুহাম্মদ: আয়াত-২২-২৩]


এ আয়াতের আলোকে বলা যায় যে, ইয়াজিদ বাদশাহ্ হয়েই আল্লাহর জমীনে বিশেষত: পবিত্র মক্কা ও মদিনায় উভয় হেরেমে ফাসাদ সৃষ্টি ও সীমালঙ্ঘন করেছিল। সে কারবালার ময়দানে নবী বংশের উপর নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে নিস্পাপ মাসুম বাচ্চাসহ অনেক জনকে শহীদ করেছে। পবিত্র মক্কা এবং মদিনা শরীফকেও অপবিত্র করেছিল। তার সৈন্যদের ঘোড়ার পায়খানা ও পেশাব দ্বারা মসজিদে নববীর মিম্বার শরীফকে অপবিত্র করেছিল। মসজিদে নববীতে তিন দিন পর্যন্ত আযান-ইকামাত, নামায জামাআত বন্ধ করে দিয়েছিল। তার নির্দেশে তার জালেম বাহিনী মদিনা পাকের অসংখ্য সাহাবী ও তাবেয়ীদের শহীদ করেছিল। মূলত এসব জঘন্য অপরাধের পেছনে ছিল সরাসরি ইয়াজিদের ভূমিকা। নবীজির কলিজার টুকরা ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে শহীদ করে তাঁর উপর এবং কারবালার অন্যান্য শহীদগণের উপর তার জালিম বাহিনীর ঘোড়া দৌঁড়িয়েছিল। শির মোবারক বর্শায় গেঁথে ইয়াজিদ সৈন্যরা উল্লাসে মেতেছিল। অথচ ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট কত যে প্রিয় ছিলেন তার বর্ণনা অসংখ্য হাদীসে পাকে উল্লেখ রয়েছে।


বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি হযরত হাসান-হোসাইনের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল সে মূলত আমার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল, তার সাথে আল্লাহ্ তা‘আলা বিদ্বেষ পোষণ করবেন। আর যার সাথে আল্লাহ্ তা‘আলা বিদ্বেষ পোষণ করবেন, তাকে আল্লাহ্ আগুনে তথা জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। [হাকেম: আল্ মুসতাদরাক আলাস্ সহীহাইন, ৩য় খণ্ড, ১৮১ পৃষ্ঠা, হাদীস- ৪৭৭৬] উক্ত হাদীসে আল্লাহ্ তা‘আলা বিদ্বেষ পোষণ করার অর্থ অসন্তুষ্ট ও নারাজ হওয়া।

তাই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله), ইমাম তাফতাযানী ও ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী সহ ইমামগণের অনেকেই তাকে কাফের ও মালউন বলে ফতোয়া দিয়েছেন।


আর যে ইয়াজিদের কুকর্ম ও প্রকাশ্য কবিরা গুনাহ্ করাকে অস্বীকার করে এবং মজলুমে কারবালা ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে দোষারোপ করে, ইয়াজিদকে নির্দোষ মনে করে বিশেষত: ইয়াজিদ এর মত ফাসেক ও শরাবীকে রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলে অবশ্যই সে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত তথা জান্নাতী দল হতে খারিজ হয়ে গোমরাহ ও পথ ভ্রষ্টদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। ফাসিকের প্রশংসা করলে আরশ আজীমে জলজলা সৃষ্টি হয় যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যার অন্তরে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং নবী বংশের তথা আহলে বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মহব্বত-ভালোবাসা বিন্দুমাত্র রয়েছে সে এমনটা চিন্তাই করতে পারে না। সহীহ বোখারী শরীফে যে হাদীস খানা বর্ণিত আছে তা ‘‘কসতুনতুনিয়া যুদ্ধে’’ অংশ গ্রহণ নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- ‘‘যারা সর্বপ্রথম মদিনা কায়সার তথা কসতুনতুনিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে তারা ক্ষমা প্রাপ্ত হবে।’’


সহীহ ও বিশুদ্ধ অভিমত অনুযায়ী সে যুদ্ধে ইয়াজিদ অংশগ্রহণ করেনি। কারণ কসতুনতুনিয়া প্রথম যুদ্ধ হয়েছে হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু-এর খেলাফতের সময় ৩২ হিজরিতে আর ইয়াজিদ কসতুনতুনিয়ার যে যুদ্ধে শরীক হয়েছিল তা আরো পরে। সুতরাং ইয়াজিদ ক্ষমা প্রাপ্তির শুভ সংবাদ সক্রান্ত হাদীসে অন্তর্ভুক্ত নাই। ইয়াজিদ কসতুনতুনিয়ার যে যুদ্ধে শরীক ছিল তার পূর্বে কসতুনতুনিয়ায় মুসলিম সেনা বাহিনী ৩/৪ বার হামলা করেছিলেন। নির্ভরযোগ্য ইতিহাস দ্বারা এটাই প্রমাণিত।

[নুজহাতুলকারী শরহে সহীহ বোখারী ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩০ কৃত: মুফতি শরিফুল হক আমজাদী ইত্যাদি]


তদুপরি ৬১ হিজরিতে ইসলামের ইতিহাসে ইয়াজিদ কারবালায় যে হৃদয় বিদারক ঘটনা সংঘটিত করেছে যেখানে কুখ্যাত ইয়াজিদের নির্দেশে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও আহলে বাইতে রাসূল সহ ইমাম হোসাইনের অনুসারী ৭২ জন সদস্যকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়েছে। এই নিষ্ঠুর পাপের অভিশাপ হতে ইয়াজিদ এবং তার দোসররা মুক্তি পেতে পারে না। অথচ আহলে বাইতে রাসূলের পবিত্রতা, মান-মর্যাদা পবিত্র ক্বোরআনে আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেছেন। যেমন-

انما يريد الله ليذهب عنكم الزجس اهل البيت ويطهركم تطهيرا- (سورة احزاب-৩৩)

‘‘হে প্রিয় নবীর খান্দান্ আল্লাহ্ তো এটাই চান যে, তোমাদের থেকে প্রত্যেক যাবতীয় অপবিত্রতা দূরীভূত করে দেবেন এবং তোমাদেরকে পুতঃপবিত্র করে অতীব পরিচ্ছন্ন করে দেবেন। [সূরা আহযাব: আয়াত ৩৩, পারা ২২] আর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসার নির্দেশ প্রদান করে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন-

قل لااسئلكم عليه اجرا الا المودة فى القربى-

অর্থাৎ-‘‘হে প্রিয় হাবীব, আপনি আপনার উম্মতকে বলে দিন, আমি সেটার জন্য অর্থাৎ (ঈমান, ইসলাম ও আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদেরকে (ক্বোরআন) দান করার জন্য তোমাদের নিকট থেকে কোন বিনিময় চাই না, কিন্তু চাই আমার নিকটাত্মীয়দের প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা।’’

[সূরা আশ্শুরা: আয়াত ২৩]


সুতরাং যাদের প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা ঈমানের দাবী, আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবীবের নির্দেশ, তাদেরকে অর্থাৎ সে আহলে বাইতে রাসূল-এর সাথে ইয়াজিদের কারবালার ময়দানে যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে শহীদ করেছে, নবী বংশের প্রতি যে অপমান-অসম্মান পৃথিবীর বুকে সে করেছে তা মূলত আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আদেশকে অমান্য ও অপমান করেছে। অপর দিকে হযরত খাতুনে জান্নাত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ও হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সর্বপোরি রাসূলে আকরম নবীয়ে দোজাহান সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অন্তরে মারাত্মক আঘাত দিয়েছে। আর যে বদবখত জালেম প্রিয় নবীকে কষ্ট/আঘাত দিয়েছে সে মূলত স্বয়ং আল্লাহকেও কষ্ট দিয়েছে আর যে আল্লাহকে কষ্ট দিয়েছে তার ঠিকানা জাহান্নাম। যা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এ ব্যাপারে রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা- ‘‘নিশ্চয় যারা আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় রাসূলকে কষ্ট দেয় তাদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত করবেন এবং তাদের জন্য কষ্টদায়ক-লাঞ্চনার আযাব আল্লাহ্ তা‘আলা তৈরি করে রেখেছেন। [সূরা আহযাব: আয়াত ৫৭]


এখানে আল্লাহকে কষ্ট দেয়ার অর্থ হলো তাঁর প্রিয় বান্দাদের কষ্ট দেয়া। ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং তাঁর সঙ্গীদের উপর পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের নির্দেশে তার বাহিনীরা যে তলোয়ার চালিয়েছিল তাতে আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় হাবীব নবীয়ে দো’জাহা হযরত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অবশ্যই সীমাহীন কষ্ট পেয়েছেন। সুতরাং ইয়াজিদকে নির্দোষ ও (رحمة الله) ইত্যাদি বলা মূলত আল্লাহ্ জাল্লাজালালুহু ও তাঁর প্রিয় হাবীবকে কষ্ট দেয়া। তাই ইসলামী জগতের অন্যতম আকিদার কিতাব শরহে আকায়িদে নসফীতে ব্যাখ্যাকারী ইমাম তাফতাযানী (رحمة الله) ইয়াজিদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পর সর্বশেষ ফয়সালা দিয়েছেন- ‘ইয়াজিদ, তার দোসর ও তার সাহায্যকারী সকলের উপর আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ। সুতরাং যারা এ কথা বলে সরল প্রাণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত করে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইয়াজিদকে জান্নাতের টিকেট দিয়েছেন এবং ইয়াজিদ ক্ষমাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত, তারা জঘন্যতম মিথ্যুক। বরং সহীহ হাদিস দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যা বলেন নাই তা যদি কেউ রাসূলে পাকের দিকে সম্পর্কিত করে বলে যে, আল্লাহর রাসূল এটা বলেছেন- তবে তার ঠিকানা জাহান্নাম এবং সে মিথ্যুক ও ভণ্ডনবীদের অন্তর্ভুক্ত।

[সহীহ মুসলিম ও সুনানে ইবনে মাজাহ্ ইত্যাদি]


ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী (رحمة الله) ইয়াজিদ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ্ বিন হানজলাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন- انه رجل ينكح امهات الاولاد والبنات والاخوات ويشرب الخمر ويدعو الصلوة-

অর্থাৎ ইয়াজিদ এমন দুষ্ট ও লম্পট প্রকৃতির লোক ছিল যে, ইসলামী শরিয়তে যেসব নারী বিবাহ করা হারাম এসব মুহরিমাতকে বিবাহ করত শরাব পান করত এবং নামায ছেড়ে দিত। [তারিখুল খোলাফা (আরবী): ১৭৪ পৃষ্ঠা] হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ও আহলে বাইতে রাসূলের শাহাদতের ঘটনা বর্ণনার পর ইমাম সুয়ূতী (رحمة الله) বলেন-  لعن الله قاتله وابن زياد معه ويزيد ايضًا

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা ইমাম হোসাইনের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হত্যাকারী, ইবনে জিয়াদ এবং ইয়াজিদের উপর লা’নত/অভিশাপ বর্ষণ করুন।

[শরহে আকায়েদে নসফী, নিবরাস (শরহে আকায়েদে নসফীর ব্যাখ্যা), তারিখুল খোলাফা কৃত: ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রাহ. ইত্যাদি] আল্লামা ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহু বলেন, মদীনা মুনাওয়ারাহ্ থেকে একটি দল দামেশকে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার সাথে সাক্ষাতের জন্য আগমন করলেন। সে তাদেরকে ভালভাবে আপ্যায়ণ করাল এবং অনেক উপহার প্রদান করল। এ দলের আমীর ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ্ বিন হানযালা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। হযরত হানযালা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন যাকে ফেরেশতারা আসমানে গোসল দিয়েছিলেন। দামেশকে অবস্থানকালে তাঁরা ইয়াজিদের সীমালঙ্ঘন ও ফিসক নিজ চোখে দেখেছিলেন যা তাদেরকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছিল।


অতঃপর তাঁরা মদীনায় ফিরে আসলেন, মদীনা মুনাওয়ারার সবাইকে জানিয়ে দিলেন ইয়াজিদের নানা অপকর্মের কাহিনী। বিশেষ করে মদ পান করা, মাতাল হয়ে নামায ছেড়ে দেয়া ছাড়াও আরো বিভিন্ন অপকর্মের কথা। মসজিদে নববীর মিম্বররের সামনে সবাই এসে উপস্থিত হলেন। ইয়াজিদকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করলেন। তার নিকট বাইআত করতে অস্বীকৃতি জানালেন। এ সংবাদ পৌঁছে গেল ইয়াজিদের নিকট। ইয়াজিদ (ক্ষিপ্ত হয়ে) মুসলিম বিন উকবার অধীনে একটি সেনাদল প্রেরণ করল। যখন ইয়াজিদ বাহিনী মদীনা মুনাওয়ারায় পৌঁছল, মুসলিম বিন উকবাহ্ তার বাহিনীকে মদীনা মুনাওয়ারা তিন দিনের জন্য হালাল ঘোষণা দিল। (অর্থাৎ তিন দিনে তারা মদীনা মুনাওয়ারায় ইচ্ছেমত যা কিছু করার করতে পারবে, কোন বাধা থাকবে না।) এ তিন দিনে ইয়াজিদের বাহিনী অনেক মানুষ হত্যা করেছিল। মসজিদে নববীতে আযান-নামায বন্ধ করে দিয়েছিল। তার বাহিনীরা মসজিদে নববীতে ঘোড়া-গাদা বেঁেধছিল। চতুষ্পদ জন্তু দ্বারা পায়খানা-প্র¯্রাব করিয়ে মসজিদে নববী ও রওজা শরীফ নাপাক করেছিল।

ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহু বলেন, এ সময় ইয়াজিদের বাহিনী ৭০০ জন হাফিজে ক্বোরআনকে শহীদ করেছিল। এর মধ্যে সাহাবায়ে রাসূলও ছিলেন। এ ঘটনাকে ইতিহাসে র্হারার ঘটনা বলে অভিহিত করা হয়েছে।

[আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্: অধ্যায় ইখবারু ওয়াকেআতিল হাররাহ্]


এ ঘটনাকালে ইয়াজিদ বাহিনী মানুষ হত্যা, সম্পদ লুন্ঠন এবং নারী ধর্ষণ সহ সব কিছুই করেছিল। জালিম ইয়াজিদের নির্দেশে তার বাহিনী কর্তৃক পবিত্র মদীনায় জুলুম-অত্যাচারের বিবরণ আত্ তাবারী-৫/৪৮৪, আল্ কামিল: ৪/১১২ কৃত: ইবনে আসীর, আল্ বিদায়া ওয়ান নেহায়া: ৮/২১৮- কৃত: ইমাম ইবনে কাছির এ বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।

এ ঘটনাকালে মুসলমানদের রক্তে মদীনার রাস্তাগুলো লাল হয়েছিল গড়িয়ে গড়িয়ে প্রিয় নবী রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওজা মোবারক পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মসজিদে নববী রক্তে ভরে গিয়েছিল। হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল।

[আত্ তাযকিরাহ্: কৃত ইমাম আবদুর রহমান ইবনুল জাওযী]


শাইখুল ইসলাম হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন, ঐতিহাসিকগণ হাররার তথা পবিত্র মদীনার ঘটনার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, এ ঘটনায় অনেক সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনার পর আর কোন বদরী সাহাবী জীবিত ছিলেন না।

[সহীহ বোখারীর প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফতহুল বারী: ৮/৬৫১ কৃত- ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী রাহ.]


পাঠকদের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি হাদিস প্রদত্ত হল:

হুযূর পুরনূর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘হে আল্লাহ্, যে ব্যক্তি মদীনা বাসীর উপর অত্যাচার করে এবং তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করে, তুমি তাকে ভয় প্রদর্শন কর। এমন ব্যক্তির উপর আল্লাহ্, ফেরেশতা এবং সকল মানুষের লা’নত বর্ষিত হোক। [মু’জামুল আওসাত লিত তাবারানী: ২/১২৫/১, আস সিললিাতুস্ সাহীহাহ লিল আলবানী: ১/৬২০, ১/৩৫১ আলা মাজমা’ লিল হাইসামী: ৩/৩০৬]


উক্ত হাদীসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনা শরীফ আক্রমণকারীর উপর লা’নত দিয়েছেন। ইতিহাসবিদগণ ঐকমতের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন যে, ইয়াজিদের নির্দেশে ৬৩ হিজরিতে মদীনা শরীফে হত্যা, লুঠ, ধর্ষণ হয়েছিল।

হযরত সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মদীনাবাসীর প্রতি মন্দ আচরণ করার ইচ্ছা পোষণ করবে, (কিয়ামতের দিন) আল্লাহ্ তাকে (তার শরীরকে) এমনভাবে গলিয়ে ফেলবেন, যেমনভাবে পানিতে লবণ গলে যায়। [সহীহ বুখারী ফাদাইলিল মাদীনাহ্: ৩/২৭, হাদীস নম্বর- ১৭৭৮] সহীহ মুসলিম শরীফে বলা হয়েছে, তার দেহ শীশা দ্বারা গলিয়ে দেয়া হবে। [মুসলিম, কিতাবুল হজ্ব: ৪/১১৩]


আর হাফিয ইবনে হাজারের কথা অনুসারে সকল ঐতিহাসিকগণ একমত হয়েছেন যে ইয়াজিদ শুধু মন্দ আচরণই করে নাই, তার নির্দেশে মদীনা মুনাওয়ারাতে সাহাবীদেরকে এবং উম্মতের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শহীদ করা হয়েছে। এবার চিন্তা করুন এবং আল্লাহ্-রাসূলের উপর পরিপূর্ণ ঈমান রেখে বলুন যদি কোন ইমাম বা ব্যক্তি ইয়াজিদ (যে শারাবী, মদ খোর, নামায তরককারী, নবীজির কলিজার টুকরা আওলাদ, শুহাদায়ে কারবালা বিশেষত: জান্নাতের সরদার ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার নির্দেশ দাতা নবীজির পবিত্র মদীনার মান-সম্মান-ইজ্জত লুন্ঠনের এবং মদীনা বাসীদের হত্যা, ধর্ষণ ও জুলুম-অত্যাচার করার নির্দেশ দাতা তদুপরি তার জালেম বাহিনী মক্কা শরীফের পবিত্র খানায়ে কাবায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল ও পাথর নিক্ষেপ করেছিল। যা নির্ভরযোগ্য অধিকাংশ ঐতিহাসিকগণের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। (যার উদ্ধৃতি পূর্বে প্রদত্ত হয়েছে) তাকে (رحمة الله) বলে সম্মান করে বা ইয়াজিদের পক্ষ অবলম্বন করে সে মূলত ইয়াজিদের জঘন্যতম যাবতীয় নাফরমানী শারাব পান সহ নবীজির আওলাদকে নির্মমভাবে শহীদ করা, পবিত্র হেরেমাইন তথা মদীনা মুনাওয়ারা ও খানায়ে কা’বায় তার বাহিনী দ্বারা জুলুম অত্যাচার করাকে সমর্থন করার নামান্তর। এ ধরনের ইমামের পেছনে নামায শুদ্ধ হওয়া দূরের কথা বরং তার ঈমানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। ইয়াজিদ মার্কা এ ধরনের ইমাম ও খতিবের খপ্পর থেকে মুসলিম মিল্লাতকে আল্লাহ্ তা‘আলা হেফাযত করুন।



Top