জন্মগত মর্যাদা
ইসলাম নর-নারী উভয়কে জন্মগত দিক দিয়েও সমান মর্যাদায় আসীন করেছে। পুরুষের যেভাবে পৃথিবীতে জন্ম নেয়ার অধিকার রয়েছে অনুরূপ নারীরও পৃথিবীতে আগমনের অধিকার রয়েছে। উভয়ের জন্মগ্রহণের ধরনও এক রকম। সৃষ্টিকর্তা এর মধ্যে কোন পার্থক্য রাখেন নি। পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে নিরাপত্তার সাথে বসবাস করার অধিকারও উভয়ের ক্ষেত্রে সমান এবং উভয়ের স্রষ্টাও এক। এখানে বান্দার কোন হাত নেই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
لِلّٰهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব আল্লাহ তা‘আলারই। তিনি যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছ বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল। ১৯
১৯.সূরা আশ শুরা, আয়াত: ৪৯-৫০
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সন্তানের প্রকার বর্ণনায় প্রথমে কন্যা সন্তানের উল্লেখ করেছেন, আর পরে পুত্র সন্তানের উল্লেখ করেছেন। এ ইঙ্গিত দৃষ্টে হযরত ওয়াছেলা ইবনে আসকা (رضي الله عنه) বলেন, যে নারীর গর্ভ থেকে প্রথমে নারী সন্তান জন্ম গ্রহণ করে, সে পূণ্যময়ী। ২০
২০.ইমাম কুরতুবী র. (৬৭১ হি.) তাফসীরে কুরতুবী
বিশ্বাস, ইচ্ছাবোধ, অনুভূতি, কর্মস্পৃহা, প্রজ্ঞা, মেধা, জ্ঞান, বিবেক ও সত্তার দিক দিয়ে নারী আর পুরুষের মধ্যে কোন বিভেদ করা হয়নি। এভাবে ইসলাম নারীর মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত করেছে।
দুনিয়ার সব মানুষই একজন পুরুষ ও একজন নারীর যৌন মিলনের মাধ্যমে সৃষ্ট, কেবল হযরত ঈসা (عليه السلام) ব্যতীত। তিনি শুধু আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে পিতা বিহীন মায়ের গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মানব সমাজ বিকাশে নারীর অবদানই বেশী পরিলক্ষিত হয়। কারণ পিতা ছাড়া সন্তান জন্ম হয়েছে কিন্তু মাতা ছাড়া সন্তান জন্ম হওয়ার কোন নজীর নেই।
মানব বংশ বিস্তারে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান সমান। কারণ পুরুষের শুক্রানু ও নারীর ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে ভ্রুণের সৃষ্টি হয। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى
হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয় আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। ২১
২১.সূরা হুজরাত, আয়াত: ১৩
অতএব, তারা পৃথিবীতে পুরুষের ন্যায় খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ, মতামত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার রাখে তবে দৈহিক ও সৃষ্টিগত এবং তাকওয়ার ভিত্তিতে উভয়ের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা অস্বীকার করার কারো সুযোগ নেই। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ
পুরুষ নারীদের উপর কর্তা- এ জন্য যে, আল্লাহ তাদের মধ্যে এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এ জন্য যে, পুরুষগণ নারীদের জন্য নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করেছে। ২২
২২.সূরা নিসা, আয়াত: ৩৪
জাহেলী যুগে নারীদের সমাজে কোন স্থান ছিলনা। নারী জাতি ছিল তখন বাজারের পণ্য। তাদেরকে গৃহস্থলীর সাধারণ উপকরণ মনে করা হতো। তারাও যে মানুষ একথা ভাবাই অন্যায় ছিল। পুরুষরা নারীদের উপর যখন-তখন যথায়-তথায় নির্মম নির্যাতন করতো। তারা যেন গৃহপালিত পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট ছিল। নারীদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও পুরুষের করুণার উপর নির্ভর করতো। যে কোন সময় যে কোন নারীকে যখন ইচ্ছা অপরের হাতে হস্তান্তর করতো। কন্যা সন্তান ছিল তাদের বীরত্বের কলংক। যত্র-তত্রলুণ্ঠন হতো নারীর মান-সম্ভ্রম। অন্যান্য পণ্য সামগ্রীর মতো নারীরাও মক্কার বাইরে রপ্তানী হতো। অবস্থাসম্পন্ন ধনী লোকেরা এদেরকে ক্রয় করে নিয়ে গিয়ে দাসী বানিয়ে রাখতো। প্রভুরা তাদের সাথে পশুর ন্যায় আচরণ করতো। অত্যাচার অবিচার পাওনা ছিল নারীদের নিয়মিত হোমওয়ার্ক। লাঞ্চনা ছিল তাদের কাজের পুরস্কার। মনের ইচ্ছায় বিনা কারণে তারা নারীদেরকে প্রহার করতো। প্রত্যেহ নিত্য নতুন শাস্তির সম্মুখীন হতো নারীরা। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে কঠোর পরিশ্রম করানো হতো তাদের দিয়ে। সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতে প্রচণ্ড মার-ধর সহ্য করতে হতো। প্রহারের প্রচণ্ডতায় শরীর থেকে কাপড় খুলে গেলেও ঐ পাষাণ্ডদের অন্তরে মমতাবোধ জাগ্রত হতো না। শরীর ক্ষত-বিক্ষত হলেও কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা করতো না। তাদের বর্বরতা সহ্য করতে না পারলে দু’চোখে অশ্রু বর্ষণ করতে চাইলেও পারতো না। কারণ চোখে পানি দেখলে মনিবরা আরো হিংস্র হয়ে উঠতো। দিনের বেলা পরিশ্রমের ঘানি থাকতো তাদের কাঁধে আর রাতের বেলা হতো প্রভুর শয্যাসঙ্গিনী। এমনকি প্রভুর বন্ধুদেরও প্রমোদবালা হতে হতো। পিতার মৃত্যুর পর সৎ মাকে তারা বিয়ে করতে পারতো। স্বামীর সম্পত্তি থেকে স্ত্রী, পিতার সম্পত্তি থেকে মেয়ে বঞ্চিত হতো। তাদের খাদ্য তালিকা ছিল স্বতন্ত্র। কোন কোন খাদ্য পুরুষরা খেতে পারলেও নারীরা তা খেতে পারতো না। নারীদের জন্য মৃত জন্তু হালাল বলা হতো। নারীদের মর্যাদা শূন্যের কোঠায় ছিল বলে তাদের সাথে এরূপ আচরণ করা হতো।
উক্ত আয়াতে পুরুষকে নারীর উপর দু’স্তর বেশী মর্যাদার অধিকারী করা হয়েছে। একটা হচ্ছে সত্তাগত অর্থাৎ কর্মক্ষমতা ও শক্তিশালী হওয়ার দিক থেকে আর অপরটি হলো বাহ্যিক তথা পুরুষ নারীর ভরণ-পোষণ ও যাবতীয় প্রয়োজন নিজের উপার্জন কিংবা স্বীয় সম্পদ দ্বারা পূরণ করে থাকে। প্রথমটি হলো- আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত ও নির্ধারিত আর দ্বিতীয়টি হলো নিজস্ব।
মনে রাখতে হবে যে, সাধারণভাবে পুরুষজাতি নারীজাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তবে প্রতিটি পুরুষ প্রতিটি নারী অপেক্ষা উত্তম নয়। কারণ বহু নারী আছেন যারা বহু পুরুষ থেকে উত্তম।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ
আর নিশ্চয় স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর যেমনিভাবে পুরুষদের অধিকার রয়েছে স্ত্রীদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। তবে নারীদের উপর পুরুষের মর্যাদা এক স্তর বেশী। ২৩
২৩.সূরা বাকারা, আয়াত: ২২৮
উক্ত আয়াতে নারীদের অধিকারের কথা পুরুষের অধিকারের পূর্বে বলা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে যে, পুরুষরা নিজের ক্ষমতায় ও খোদা প্রদত্ত মর্যাদার বলে নারীর কাছ থেকে স্বীয় অধিকার আদায় করে নিতে সক্ষম কিন্তু নারীরা শারিরীকভাবে ও প্রকৃতিগতভাবে পুরুষ অপেক্ষা দুর্বল হওয়ার কারণে তারা পুরুষদের কাছ থেকে অনেক সময় নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ে অক্ষম হয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের অধিকারের কথা প্রথমে উল্লেখ করেছেন। আবার সাথে নারীর উপর পুরুষের প্রাধান্যের কথাও উল্লেখ করে দিয়েছেন।