সাম্প্রতিক নজদী প্রবণতা
এ কথা সর্বজনবিদিত যে নজদী সংস্কারক মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব বনূ তামিম গোত্রভুক্ত ছিল। তার নাম বহনকারী এই আন্দোলনের সাথে যে সহিংসতা ও ‘তাকফির’ (মুসলমানদেরকে কাফের ফতোওয়া) সম্পৃক্ত রয়েছে, তা নিশ্চিতভাবে প্রাচীন নজদের তামিমী খারেজী নীতি ও মানসিকতার সাথে কাকতালীয় মিলের চেয়েও বেশি কিছু হবে। যেমন বিবেচনা করুন, এপ্রিল ১৮০১খৃষ্টাব্দে কারবালায় সংঘটিত শিয়া গণহত্যা, যা জনৈক ওহাবী ইতিহাসবিদ বর্ণনা করেছে:
❏ “সউদ তার বিজয়ী সৈন্যবাহিনী, উন্নত জাতের ঘোড়া এবং নজদের সকল স্থায়ীভাবে বসবাসকারী মানুষ ও বেদুঈন (যাযাবর)-কে সাথে নিয়ে কারবালা গমন করে।....মুসলমানরা (অর্থাৎ, ওহাবীরা) কারবালা ঘেরাও করে এবং ঝড়ের বেগে শহরটির দখল নেয়। বাজার ও বাসা-বাড়িতে তারা বেশির ভাগ মানুষকে হত্যা করে। সেখানে লুণ্ঠনকৃত মালামালের সংখ্যা কেউ গুণে শেষ করতে পারবে না। তারা শুধু একটি সকাল সেখানে কাটিয়েছিল, এবং দুপুরে সমস্ত মালামাল নিয়ে স্থান ত্যাগ করেছিল। কারবালায় প্রায় দুই হাজার মানুষকে ওই সময় হত্যা করা হয়।”[৩৭.]
৩৭. উসমান ইবনে বিশর কৃত ‘উনওয়ান আল-মাজদ ফী তারিখে নজদ’, মক্কা ১৩৪৯ হিজরী, ১ম খ-, ১২১-১২২ পৃষ্ঠা।
এই হামলা ও এটি অর্জনে সংঘটিত নৃশংসতা এবং এক হাজার বছর আগে একই এলাকায় পরিচালিত খারেজী আক্রমণের মধ্যে পার্থক্য করা দুষ্কর। মোহাম্মদ ফিনাতি নামে এক ধর্মান্তরিত ইতালীয় মুসলমান, যিনি ওহাবীদের ওপর বিজয়ী উসমানীয় তুর্কী খেলাফতের সৈন্যবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, তিনি সীমাহীন নজদী বর্বরতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর একখানা বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। উদাহরণস্বরূপ, তাতে তিনি লিখেন:
❏ “আমাদের মধ্যে কিছু সৈন্য জীবিতাবস্থায় এ সব নিষ্ঠুর ধর্মান্ধের হাতে আটক হন; তাঁদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হাত-পা তারা (নজদীরা) এমন পৈশাচিকভাবে কেটে বিকৃত করে এবং সেই অবস্থায় মরতে ফেলে রেখে যায় যে আমি স্বচক্ষে দেখেছি, আমরা যখন (যুদ্ধশেষে) ফিরে আসছিলাম তখন এই (অসহায়) মানুষগুলোর আমাদের কাছে একমাত্র চাওয়া-পাওয়া ছিল যেন আমরা তাঁদের জীবনাবসান ঘটাই।”[৩৮.]
৩৮. জি, ফিনাতি প্রণীত ‘ন্যারেটিভ অফ দ্য লাইফ এ্যান্ড এ্যাডভেনচারস অফ জিওভানি ফিনাতি’ (আত্মজীবনী ও অভিযানের বর্ণনা), ল-ন, ১৮৩০ইং, ১ম খ-,২৮৭ পৃষ্ঠা।
❏ এ কথা কখনো কখনো দাবি করা হয় যে, ‘নজদের সব অ-যাযাবর ও যাযাবর (বেদুঈন) লোক’দের দ্বারা খুশি মনে এই ধরনের গণহত্যা সংঘটনের দিনগুলো অনেক পেছনে ফেলে আসা হয়েছে এবং ওহাবীবাদ এখন আরও উদারনৈতিক। কিন্তু আরও সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ এর বিপরীত কথাই বলছে। ওহাবী সৈন্যবাহিনী ১৯২৪ সালে তায়েফ নগরী দখল করে তিন দিন যাবত লুঠপাট চালায়। এই সময় প্রধান কাজী (বিচারক) ও উলেমাবৃন্দকে তাঁদের বাসা থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনা হয় এবং হত্যা করা হয়; কয়েক’শ সাধারণ নাগরিককেও একইভাবে হত্যা করা হয় ।[৩৯.]
৩৯ . ইবনে হিযলুল রচিত ‘তারিখে মুলূক আল-সউদ’, রিয়াদ, ১৯৬১, ১৫১-৫৩ পৃষ্ঠা।
হেজাযের সুন্নী জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদের একখানা শিক্ষা দিয়ে ‘বৃটেনের মৌন সমর্থনে ইবনে সউদ মক্কা দখল করে নেয়’।[৪০.]
৪০ . আলেক্সেই ভ্যাসিলিয়েভ প্রণীত ‘সউদী আরবের ইতিহাস’, ল-ন, ১৯৯৮, ২৬৪পৃষ্ঠা।
উপসংহার
সালাফ আস্ সালেহীনের (প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের) সময়কাল থেকেই নজদ ও তামিম গোত্র সম্পর্কে বিস্তর দলিলপত্র সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমরা যদি নজদীদের অনুসৃত পদ্ধতি বর্জন করি, যে পদ্ধতিটি কিছু বেছে নেয়া হাদীসের উদ্ধৃতির পাশাপাশি মধ্যযুগের শেষলগ্নের কতিপয় ব্যাখ্যাকারীর ব্যক্ত মতামতের অন্ধ অনুসরণ ছাড়া কিছু নয়, তাহলে আমরা মধ্যআরব অঞ্চল ও এর অধিবাসীদের সম্পর্কে কিছু যৌক্তিক ও দলিলভিত্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে সক্ষম হবো। কুরআন মজীদ, সহীহ (বিশুদ্ধ) হাদীস ও সালাফ আস্ সালেহীনের অভিজ্ঞতা একচেটিয়াভাবে প্রমাণ করে যে মধ্য আরব অঞ্চল একটি ফিতনা-ফাসাদের এলাকা। ইসালামের সর্বপ্রথম ফিতনা সেখান থেকেই জাগ্রত হয়, যা ছিল যুল-খোয়াইসারা ও তার মতো লোকদের ঔদ্ধত্য; আর এ ছাড়াও ভণ্ড নবীদের গোমরাহী ও তাদের প্রতি ভক্তি হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه)'র খেলাফতের জন্যে কঠিন সময় ছিল। এর অব্যবহিত পরেই নজদী শেকড় থেকে গজানো খারেজী গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা) ইসলামী ইতিহাসের সূচনালগ্নে মুসলমানদের মাঝে বিভক্তির কালো ছায়া ফেলে, যার দরুন তাঁদের সৈন্যবাহিনী বিজিনটিন সাম্রাজ্য জয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পারে নি; অধিকন্তু, এই ফিতনা প্রাথমিক যুগের মুসলমান প্রজন্মগুলোর মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ, সন্দেহ ও তিক্ততার বীজ বপণ করে। এই প্রামাণ্য দলিল, যেটি নির্মল ও খাঁটি সালাফবৃন্দ বর্ণনা করেছেন, তাকে এড়িয়ে যেতে পারে একমাত্র একগুঁয়ে, চোখে ঠুলি বসানো ও দায়িত্বজ্ঞানহীন সেই সব নজদী সমর্থক, যারা বারংবার এই প্রতারণার আশ্রয় নিতে চায় যে নজদ ও তার পথভ্রষ্টতা, বাহ্যিক ধর্মপালনে কঠোরতা যা ওই অঞ্চলে পুনঃপুনঃ সংঘটিত হয়ে চলেছে, তা কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত এলাকা।
আল্লাহ-ই সবচেয়ে ভালো জানেন। তিনি এই উম্মাহকে ধর্মীয় একগুঁয়েমি প্রত্যাখ্যানকারী সালাফ আস্ সালেহীনের প্রতি মহব্বতের মাধ্যমে একতাবদ্ধ করুন। আল্লাহতা’লা আমাদেরকে খারেজী মতবাদের ফাঁদ থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের এই যুগে যারা এই ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে তাদেরকেও হেফাযত করন, আমীন।
সমাপ্ত