বিষয় নং-১৭: নবি প্রেমে হরিণী আর্তনাদ:
এক হরিণী রাসূল (ﷺ) কে সালাম দেন এবং তাঁর সাথে কথা বলেন মর্মে একটি ঘটনা সমাজে খুবই প্রসিদ্ধ। ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার লিখিত ‘‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’’ গ্রন্থের ৩৫৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘‘এসকল কথার কোনো নির্ভরযোগ্য ভিত্তি পাওয়া যায় না।’’
“প্রচলিত জাল হাদিস” এর ১৮৪ পৃষ্ঠায় (জুনায়েদ বাবুনগরী সম্পাদিত) গ্রন্থে লিখেন-‘‘আমাদের দেশের প্রচলিত একটি গল্প রয়েছে যা বিভিন্ন ওয়ায়েজের মুখে এবং বিভিন্ন ক্যাসেটে শোনা যায়।’’ তারপর রীতিমত তিনি এ ঘটনাটি বানোয়াট ও মিথ্যা প্রমাণের অপচেষ্টা করেন, কিন্তু নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! এবার আমরা দেখবো এ ঘটনা কি শুধু ওয়ায়েজের মুখে আর ক্যাসেটেই আছে না হাদিসে আছে। তারপর না হয় আপনারাই সিদ্ধান্ত নিবেন কাদের বক্তব্য সঠিক।
বর্ণনা নং-১
বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেয আবদুর রহমান সাখাভী (رحمة الله) স্বীয় দরূদ শরীফের ফযিলতের উপরে লিখিত কিতাব ‘আল কওলুল বদী’ এর ১৪৮ পৃষ্ঠায় ঘটনাটি এভাবে উল্লেখ করেন,
وفي حلية الأولياء لأبي نعيم عن ابى سعيد الخدرى رضى الله تعالى عنه قال: أن رجلاً مر بالنبي - صلى الله عليه وسلم - ومعه ظبي قد اصطاده فأنطلق الله سبحانه الذي لأنطق كل شيء الظبي فقالت يارسول الله أن لي أولادناً وأنا أرضعهم وأنهم الآن جياع فأمر هذا أن يخليني حتى أذهب فأرضع أولادي وأعود قال فإن لم تعودي قالت إن لم أعد فلعنني الله كمن تذكر بين يديه فلا يصل عليك، أو كنت كمن صلى ولو يدع فقال النبي - صلى الله عليه وسلم - أطلقها وأنا ضامنها فذهبت الظبية ثم عادت فنزل جبريل عليه السلام وقال يا محمد الله يقرئك السلاة ويقول لك وعزتي وجلالي (لق) أنا أرحم بامتك من هذه الظبية بأولادها وأنا أردهم إليك كما رجعت الظبية إليك –
-‘‘হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رحمة الله) হতে বর্ণিত। এক ব্যক্তি হরিণী শিকার করল। আর সেটা নিয়ে যখন লোকটি হুযূর করীম (ﷺ) এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন আল্লাহ্ পাক হরিণীকে কথা বলার শক্তি দান করলেন। হরিণী আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমার ছোট ছোট দুগ্ধপায়ী বাচ্চা আছে। এখন তারা ক্ষুধার্ত। অতএব আপনি শিকারীকে বলুন, সে যেন আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি বাচ্চা দুটিকে দুধ পান করিয়ে ফিরে আসব। নবীয়ে রহমত (ﷺ) ইরশাদ করলেন, যদি তুমি ফিরে না আসো? হরিণী বলল, আমি ফিরে না আসলে তখন আমার উপর আল্লাহর অভিশাপ। যেমন ওই ব্যক্তির উপর অভিশাপ যার সামনে আপনার যিক্র করা হল, আর সে আপনার উপর দরূদ শরীফ পড়ল না। অথবা ওই ব্যক্তির উপর অভিশাপের মত যে ব্যক্তি নামায পড়ল আর পরক্ষণে হাত উঠিয়ে দুআ করল না। অতঃপর সরকারে দুআলম (ﷺ) ওই শিকারীকে বললেন, সেটাকে ছেড়ে দাও। আমি তার যিম্মাদার হলাম। সে হরিণীকে ছেড়ে দিল। হরিণী বাচ্চাদের দুধ পান করিয়ে ফিরে আসল। তখন জিবরাঈল (عليه السلام) এসে হাযির হলেন, আর আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আল্লাহ্ আপনাকে সালাম বলেছেন এবং ইরশাদ করেছেন, আমার (আল্লাহ) সত্তার ও ইজ্জতের শপথ! আমি (আল্লাহ) আপনার উম্মতের জন্য তার চেয়ে বেশী অনুগ্রহশীল যেমন এ হরিণী স্বীয় বাচ্চাদের সাথে মায়া মমতা দেখিয়েছে। আমি (আল্লাহ)তাদেরকে আপনার দিকে ফিরিয়ে দেব, যেমনি হরিণী আপনার দিকে ফিরে এসেছে।’’ ২৫৩
২৫৩ .আল্লামা ইমাম হাফেজ শামসুদ্দীন সাখাভী : আল কওলুল বদী, ১/১৫৩ পৃ :
উক্ত ঘটনাটি অনেক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্যে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র উল্লেখ করা হল।
বর্ণনা নং-২
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللهِ ﷺ فِي الصَّحْرَاءِ فَإِذَا مُنَادٍ يُنَادِيهِ يَا رَسُولَ اللهِ فَالْتَفَتَ، فَلَمْ يَرَ أَحَدًا، ثُمَّ الْتَفَتَ فَإِذَا ظَبْيَةٌ مُوَثَّقَةٌ، فَقَالَتْ: ادْنُ مِنِّي يَا رَسُولَ اللهِ فَدَنَا مِنْهَا، فَقَالَ: حَاجَتَكِ؟ قَالَتْ: إِنَّ لِي خَشَفَيْنِ فِي ذَلِكَ الْجَبَلِ فَحُلَّنِي حَتَّى أَذْهَبَ، فَأُرْضِعَهُمَا، ثُمَّ أَرْجِعُ إِلَيْكَ، قَالَ: وَتَفْعَلِينَ؟ ، قَالَتْ: عَذَّبَنِي اللهُ بِعَذَابِ الْعِشَارِ إِنْ لَمْ أَفْعَلْ، فَأَطْلَقَهَا فَذَهَبَتْ، فَأَرْضَعَتْ خَشَفَيْهَا، ثُمَّ رَجَعَتْ، فَأَوْثَقَهَا وَانْتَبَهَ الْأَعْرَابِيُّ، فَقَالَ: لَكَ حَاجَةٌ يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: نَعَمْ تُطْلِقُ هَذِهِ، فَأَطْلَقَهَا فَخَرَجَتْ تَعْدُو، وَهِيَ تَقُولُ: أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّكَ رَسُولُ اللهِ
-‘‘হযরত উম্মে সালমা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, একবার রাসূলে করীম (ﷺ) মরু (সাহারা মরুভূমি) এলাকায় যান। সেখানে তিনি শুনতে পেলেন কে যেন বলছে ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! তিনি পেছন ফিরে তাকালেন। কিন্তু কেউ নেই। পুনরায় তাকিয়ে একটি হরিণীকে বাধা অবস্থায় দেখতে পেলেন। হরিণী বলছিল ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমার নিকটে আসুন। রাসূল (ﷺ) তার কাছে চলে গেলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, কী প্রয়োজন? হরিণী বললো : পাহাড়ের পাদদেশে আমার দুটি শিশু আছে। আপনি আমাকে বন্ধনমুক্ত করে দিন, আমি শিশুদ্বয়কে দুধ পান করিয়ে আসি। হুযূর (ﷺ) বললেন, তুমি দুধ পান করিয়ে ফিরে আসবে? সে বলল, হ্যাঁ। যদি ফিরে না আস তাহলে? জবাবে হরিণী বলল, আল্লাহ্ যেন আমাকে দশ মাসের গর্ভবর্তী উটনীর মত শাস্তি দেন। হুযূর (ﷺ) হরিণীকে ছেড়ে দিলেন। সে গিয়ে উভয় বাচ্চাকে দুধ পান করানোর পর ফিরে এল। রাসূল (ﷺ) তাকে বেঁধে দিলেন। জনৈক বেদুঈন কিছু দূরে নিদ্রিত ছিল। সে জাগ্রত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আপনার কোনো প্রয়োজন আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ! প্রয়োজন এই যে, তুমি এই হরিণীকে মুক্ত করে দাও। বেদুঈন তৎক্ষণাৎ হরিণীকে ছেড়ে দিলেন। হরিণী দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছিল আর বলছিল : আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্নাকা রাসূলাল্লাহ।’’ ২৫৪
২৫৪.
(ক) তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর, ২৩/৩৩১ পৃ. হাদিস, ৭৬৩
(খ) ইমাম কাযি আয়াজ, শিফা শরীফ, ১/৩১৪পৃ. ও ১/৬০৩ পৃ.
(গ) মুকরিজী, ইমতাউল আসমা, ৫/২৩৮পৃ.
(ঘ) কাস্তাল্লানী, মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়া, ২/২৮০ পৃ.
(ঙ) ইমাম জালাল উদ্দিন সূয়তী : খাসায়েসুল কোবরা : ২/১০৩ পৃ., হা/১৭৯৭
(চ) আল্লামা ইবনে হাজার হায়সামী : মাযমাউয যাওয়াইদ : ৮/২৯৫ পৃষ্ঠা
(ছ) ইবনে কাসীর, মু‘যিজাতুন্নবী, ১/১৬৬ পৃ. ও বেদায়া ওয়ান নিহায়া, ৬/১৪৮ পৃ.
(ঝ) হুমাইরী হাদ্বরামী, হাদায়েকুল আনওয়ার, ১/১৫২ পৃ.
(ট) জুরকানী, শরহুল মাওয়াহেব, ৬/৫৫৯ পৃ.
(ঠ) ইবনে সালেহ শামী, সবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৯/৫১৯ পৃ.
সনদ পর্যালোচনা:
❏ উক্ত হাদিসের ঘটনাটি সম্পর্কে বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ূতি (رحمة الله) বলেন,
فِي إِسْنَاده أغلب بن تَمِيم ضَعِيف لَكِن للْحَدِيث طرق كَثِيرَة تشهد بِأَن للقصة أصلا
-‘‘উক্ত হাদিসের সনদে ‘আগলাব বিন তামীম’ দুর্বল রাবী। তবে উক্ত হাদিসটি একাধিক সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে উক্ত ঘটনাটির ভিত্তি আসে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।’’২৫৫
২৫৫. ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতি : খাসায়েসুল কোবরা : ২/১০১ পৃ.
তাই ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) এর বক্তব্য দ্বারা বুঝা গেল যে, মূল ঘটনাটি অবশ্যই বিশুদ্ধ।
❏ অপরদিকে আল্লামা ইবনে হাজার হাইসামী (رحمة الله) বলেন,
رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ، وَفِيهِ أَغْلَبُ بْنُ تَمِيمٍ وَهُوَ ضَعِيفٌ
-‘‘উক্ত হাদিসটি ইমাম তাবরানী তার “মু’জামুল কবীর” গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদিসে শুধুমাত্র একজন রাবী ‘আগলাব বিন তামীম’ দুর্বল।’ ২৫৬
২৫৬.
(ক) ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতি : খাসায়েসুল কোবরা : ২/১০৩, হা/১৭৯৭
(খ) আল্লামা ইবনে হাজার হায়সামী : মাযমাউয যাওয়াইদ : ৮/২৯৪ পৃ. হা/১৪০৮৭
(গ) ইমাম তাবরানী : মু‘জামুল আওসাত: ৫/৩৫৮ পৃ. হা/৫৫৪৭০
(ঘ) ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী : দালায়েলুন নবুওয়াত : ১/৩৭৬ পৃ. হা/২৭৪
(ঙ) ইবনে কাছির : বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ৬/১৫৭ পৃ.
ইমাম নাসাঈ (رحمة الله) বলেন- بَصرِي ضَعِيف -‘‘তিনি বসরার অধিবাসি, হাদিস বর্ণনায় যঈফ।’’ (ইমাম নাসাঈ, দ্বুআফা ওয়াল মাতরুকুন, ১/২০ পৃ. ক্রমিক. ৬১) বুঝা গেল এ সনদটি যঈফ, কিন্তু বিষয় বস্তুটি নয়!
বর্ণনা নং-৩
এ প্রসঙ্গে আরো হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যেমন-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ؓ قَالَ: مَرَّ رَسُولُ اللَّهِ - ﷺ - عَلَى قَوْمٍ قَدْ صَادُوا ظَبْيَةً، فَشَدُّوهَا إِلَى عَمُودِ فُسْطَاطٍ فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنِّي وَضَعْتُ وَلَدَيْنِ خَشْفَيْنِ فَاسْتَأْذِنْ لِي أَنْ أُرْضِعَهُمَا ثُمَّ أَعُودُ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ - ﷺ-: خَلُّوا عَنْهَا حَتَّى تَأْتِيَ خَشْفَيْهَا فَتُرْضِعُهُمَا وَتَأْتِي إِلَيْكُمَا . قَالُوا: وَمَنْ لَنَا بِذَلِكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: أَنَا . فَأَطْلَقُوهَا فَذَهَبَتْ فَأَرْضَعَتْ ثُمَّ رَجَعَتْ إِلَيْهِمْ فَأَوْثَقُوهَا. قَالَ: تَبِيعُوهَا . قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، هِيَ لَكَ، فَخَلُّوا عَنْهَا فَأَطْلَقُوهَا فَذَهَبَتْ
-‘‘হযরত আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) একটি গোত্রের পাশে দিয়ে অতিক্রম করছিলেন আর গোত্রের লোকেরা একটি হরিণকে তাবুর খুঁটির সাথে বেঁধে রেখেছিল। এমন সময় হরিণী বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমি বাধা অবস্থায় রয়েছি অথচ আমার দুটি বাচ্চা রয়েছে, আমাকে অনুমতি দেন আমি যেন তাদেরকে দুধ পান করিয়ে আসতে পারি। রাসূল (ﷺ) ঐ কওমকে বললেন, তোমরা তাকে ছেড়ে দাও, সে তার দুই বাচ্চাকে দুধ পান করাবে তারপর তোমাদের নিকট ফিরে আসবে। তারা বলল, আমাদের নিকট জামিনদার হবে কে? রাসূল (ﷺ) বললেন, আমি। অতঃপর তাকে ছেড়ে দেওয়া হল, তারপর কিছুক্ষণ পর দুধ পান করিয়ে সেটা ফিরে আসলে তাকে বাধা হল। রাসূল (ﷺ) তাদেরকে বললেন, তোমরা তার নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ বা অনুসরণ করেছ? রাসূল (ﷺ)-কে তারা বলল এটা আপনার জন্য। অতঃপর রাসূল (ﷺ) তাদেরকে বললেন, তোমরা তাকে ছেড়ে দাও, অতঃপর তারা হরিণীটিকে ছেড়ে দিল সে তার গন্তব্য স্থানে চলে গেল।’’ ২৫৭
২৫৭.
(ক) ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি : খাসায়েসুল কোবরা : ২/১০৩, হা/১৭৯৮
(খ) ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী : দালায়েলুন নবুওয়াত : ৩২১ পৃ.
(গ) ইমাম তাবরানী : মু‘জামুল আওসাত :
(ঘ) ইবনে কাসির : বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ৬/১৫৭ পৃ.
(ঙ) ইমাম ইবনে হাযার হায়সামী : মাযমাউয যাওয়াইদ : ৮/২৯৫ পৃ.
বর্ণনা নং-৪
ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) সংকলন করেন-
عَنْ عَطِيَّةَ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، قَالَ: مَرَّ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِظَبْيَةٍ مَرْبُوطَةٍ إِلَى خِبَاءٍ، فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ، حُلَّنِي حَتَّى أَذْهَبَ فَأُرْضِعَ خِشْفِي، ثُمَّ أَرْجِعَ فَتَرْبِطَنِي، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ : صَيْدُ قَوْمٍ وَرَبِيطَةُ قَوْمٍ ، قَالَ: فَأَخَذَ عَلَيْهَا فَحَلَفَتْ لَهُ، فَحَلَّهَا، فَمَا مَكَثَتْ إِلَّا قَلِيلًا حَتَّى جَاءَتْ وَقَدْ نَفَضَتْ مَا فِي ضَرْعِهَا فَرَبَطَهَا رَسُولُ اللهِ ﷺ، ثُمَّ أَتَى خِبَاءَ أَصْحَابِهَا فَاسْتَوْهَبَهَا مِنْهُمْ فَوَهَبُوهَا لَهُ، فَحَلَّهَا–
-‘‘ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) তার ‘দালায়েলুল নবুয়ত’ গ্রন্থে তাবেয়ী আতিয়্যাহ (রহ.) থেকে তিনি হযরত আবু সাঈদ খুদরী (رضي الله عنه) থেকে রেওয়ায়েত করেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক হরিণীর কাছ দিয়ে গেলেন। হরিণীটি তাবুতে বাধা ছিল। সে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! আপনি আমার বাধন খুলে দিন, আমি বাচ্চাদেরকে দুধ পান করিয়ে আসি। রাসূল (ﷺ) বললেন, তুমি একদল লোকের নিকট বাঁধা বা শিকার। তাই তোমাকে ফিরে আসার ওয়াদা করতে হবে। হরিণী কসম খেয়ে ওয়াদা করলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ছেড়ে দিলেন। সে চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এল। তখন তার স্তন খালি ছিল। তিনি তাকে বেঁধে দিলেন। এরপর দলের লোকজন এলে রাসূল (ﷺ) বললেন, এই হরিণীটি আমাকে দিয়ে দাও। তারা দিয়ে দিলে রাসূল (ﷺ) বাঁধন খুলে হরিণীকে মুক্ত করে দিলেন।’’ ২৫৮
২৫৮.
(ক) বায়হাকী : দালায়েলুন নবুওয়াত : ৬/৩৪ পৃ. হা/২২৭৩, দারুল হাদিস কায়রু
(খ) ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তী : খাসায়েসুল কোবরা : ২/১০৩ : হা/১৭৯৯
(গ) ইবনে কাসির, মু‘যিজাতুন্নবী, ১/১৬৬ পৃ.
(ঘ) মুকরিজী, ইমতাউল আসমা, ৫/২৪০ পৃ.
(ঙ) ইবনে সালেহ শামী, সবলুল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৯/৫১৯ পৃ.
(চ) বুরহানুদ্দীন হালবী, সিরাতে হালবিয়্যাহ, ৩/৩৯৯ পৃ.
বর্ণনা নং-৫
عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ، قَالَ: كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ ﷺ فِي بَعْضِ سِكَكِ الْمَدِينَةِ، فَمَرَرْنَا بِخِبَاءِ أَعْرَابِيٍّ فَإِذَا ظَبْيَةٌ مَشْدُودَةٌ إِلَى الْخِبَاءِ، فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنَّ هَذَا الْأَعْرَابِيَّ اصْطَادَنِي وَلِي خِشْفَانِ فِي الْبَرِيَّةِ، وَقَدْ تَعَقَّدَ اللَّبَنُ فِي أَخْلَافِي، فَلَا هُوَ يَذْبَحَنِي فَأَسْتَرِيحُ، وَلَا يَدَعَنِي فَأَرْجِعُ إِلَى خِشْفَيَّ فِي الْبَرِيَّةِ، فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنْ تَرَكْتُكِ تَرْجِعِينَ؟ قَالَتْ: نَعَمْ، وَإِلَّا عَذَّبَنِي اللهُ عَذَابَ الْعَشَّارِ، فَأَطْلَقَهَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمْ تَلْبَثْ أَنْ جَاءَتْ تَلَمَّظُ، فَشَدَّهَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الْخِبَاءِ، وَأَقْبَلَ الْأَعْرَابِيُّ وَمَعَهُ قِرْبَةٌ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَتَبِيعُنِيهَا؟ قَالَ: هِيَ لَكَ يَا رَسُولَ اللهِ، فَأَطْلَقَهَا رَسُولُ اللهِ ﷺ . قَالَ زَيْدُ بْنُ أَرْقَمَ: فَأَنَا وَاللهِ رَأَيْتُهَا تَسِيحُ فِي الْبَرِيَّةِ، وَتَقُولُ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ-
-‘‘হযরত যায়দ ইবনে আরকাম (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) এর সঙ্গে মদীনার গলি পথে জনৈক বেদুঈনের তাবুতে পৌঁছে আমরা একটি হরিণীকে বাঁধা দেখলাম। হরিণী বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! এই বেদুঈন আমায় শিকার করেছে, অথচ জঙ্গলে আমার দুটো বাচ্চা ক্ষুধায় কষ্ট করছে। আর স্তনে দুধ জমে যাওয়ার কারণে আমিও নিদারুন যাতনা অনুভব করছি। বেদুঈন আমাকে যবেহ করে ফেললেও আমি এই যাতনা থেকে রেহাই পেতাম কিংবা আমাকে ছেড়ে দিলে আমি বাচ্চাদের কাছে চলে যেতাম, কিন্তু সে কিছুই করছে না। রাসূল (ﷺ) হরিণীকে জিজ্ঞাস করলেন, যদি আমি তোমাকে ছেড়ে দেই, তবে তুমি ফিরে আসবে? সে বলল, হ্যাঁ, আমি ফিরে আসবো। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হরিণীকে ছেড়ে দিলেন। সে কিছুক্ষণের মধ্যে জিহবা চাটতে চাটতে ফিরে এল। রাসূল (ﷺ) তাকে বেধে দিলেন। ইতিমধ্যে বেদুঈন এসে গেল। তার সাথে ছিল পানির একটি মশক। হুযূর (ﷺ) বললেন, তুমি হরিণীটি বিক্রি করবে? সে বলল, হরিণীটি আপনারই। সে মতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে মুক্ত করে দিলেন।’’ ২৫৯
২৫৯. ইমাম বায়হাকী : দালায়েলুন নবুওয়াত : ৬/৩১ পৃ. হা/২২৭৪, ইমাম আবু নুয়াইম ইস্পাহানী : দালায়েলুন নবুওয়াত :১/৩২০ পৃ. হাদিস:২৭৩, মুকরিজী, ইমতাউল আসমা, ৫/২৩৮ পৃ., বুরহানুদ্দীন হালবী, সিরাতে হালবিয়্যাহ, ৩/৩৯৯ পৃ., ইমাম জালালুদ্দীন সূয়তী : খাসায়েসুল কোবরা : ২/১০৩ : হা/১৮০০, ইমাম কাস্তাল্লানী : মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়া : ২/১৪২ পৃ:, জুরকানী : শরহুল মাওয়াহেব : ৫/১৫০ পৃ., আল্লামা আব্দুর রহমান জামী : শাওয়াহিদুন নবুওয়াত,
হানাফী মাযহাবের ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله) এই ঘটনাটি সত্যায়ন করেছেন ছোট একটি কাসীদার মাধ্যমে। যেমন : ইমাম আযম আবু হানিফা (رحمة الله) বলেন,
والذئب جاءك والغزالة قد اتت✧ بك تستجير وتحتمى بحماك-
-‘‘নেকড়ে বাঘ আপনার কাছে এসে আপনার সত্যায়ন করেছে, হরিণী বন্দী অবস্থায় আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করেছে এবং সে (আপনার করুনায় মুক্তি পেয়ে) আনন্দ প্রকাশ করছিল।’’ (কাসীদায়ে নুমান)
সামগ্রীকভাবে এ বিষয়ক হাদিসের মান
১. উক্ত হাদিসের মূল ঘটনাটি সত্য এবং বাস্তব সম্মত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইমাম সামসুদ্দীন সাখাভী (رحمة الله) ও আল্লামা আজলূনী (رحمة الله) লিখেন-
ولكن قد ورد الكلام في الجملة في عدة أحاديث يتقوى بعضها ببعض
-‘‘তবে উক্ত ঘটনা বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থাবলীতে বিভিন্ন সূত্রসহ পাওয়া যায়, আর এ সূত্রগুলো পরস্পর মিলালে এক প্রকার শক্তি অর্জিত হয় তথা হাদিসটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়।’’ ২৬০
২৬০.
ক. সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, ১৮৪ পৃ. হা/৩৩২
খ. আজলূনী, কাশফুল খাফা, ১/২৭৪ পৃ. হা/৯৮৯
গ. মোল্লা আলী ক্বারী, আসারুল মারফূআ, ১/১৬০ পৃ.
২. উক্ত হাদিসটি বা ঘটনাটি সম্পর্কে আল্লামা আজলূনী (رحمة الله) বলেন,
وذكر ابن السبكي أن تسليم الغزالة رواه أبو نعيم والبيهقي في الدلائل, وكذا ذكره الدارقطني والحاكم وشيخه ابن عدي.
-‘‘উক্ত ঘটনাটি অর্থাৎ হরিণী রাসূল (ﷺ) কে সালাম দেয়া ইমাম তকী উদ্দিন সুবকী (رحمة الله) উল্লেখ করেন। ইমাম আবু নুয়াইম (رحمة الله) ও ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) উভয়ে তাদের দালায়েলুল নবুয়ত গ্রন্থদ্বয়ে বর্ণনা করেন। আরো যাঁরা উক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন তারা হলেন, ইমাম দারাকুতনী, ইমাম হাকিম নিশাপূরী এবং শায়খ ইমাম ইবনে আদী (رحمة الله)।’’ ২৬১
২৬১. আজলূনী, কাশফুল খাফা, ১/২৭৪ পৃ. হা/৯৮৯
৩. উক্ত হাদিসের ঘটনাটি সম্পর্কে বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ূতি (رحمة الله) বলেন,
لَكِن للْحَدِيث طرق كَثِيرَة تشهد بِأَن للقصة أصلا
-‘‘তবে উক্ত হাদিসটি একাধিক সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে ঘটনাটির যে ভিত্তি আছে তা প্রমাণিত।’’ ২৬২
২৬২. ইমাম জালাল উদ্দিন সূয়তী : খাসায়েসুল কোবরা : ২/১০১ পৃ.
তাই ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) এর বক্তব্য দ্বারা বুঝা গেল যে, মূল ঘটনাটি অবশ্যই বিশুদ্ধ। কিন্তু তারপরও কতিপয় ধোঁকাবাজ মৌলভীগণ তা অস্বীকার করছেন প্রতিনিয়ত।
৪. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) ইবনে কাসিরের একক অভিমতকে উল্লেখ করে লিখেন-
ذَكَرَهُ ابْنُ الدَّيْبَعِ وَذَكَرَ الْقَسْطَلَّانِيُّ مَقُولَ ابْنِ كَثِيرٍ ثُمَّ قَالَ لَكِنَّهُ وَرَدَ فِي الْجُمْلَةِ فِي عدَّة أَحَادِيث يتقوى بَعْضهَا بِبَعْض
-‘‘আল্লামা ইবনে দায়বাঈ এবং আল্লামা কাস্তালানী (رحمة الله) ইমাম ইবনে কাসির (رحمة الله)-এর বক্তব্য নকল করেছেন, তারপর বলেন, তবে উক্ত ঘটনা বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থাবলীতে বিভিন্ন সূত্রসহ পাওয়া যায়, আর এ সূত্রগুলো পরস্পর মিলালে এক প্রকার শক্তি অর্জিত হয় (কম পক্ষে হাসান স্তরে উপনীত হয়েছে) তথা হাদিসটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়।’’ (মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফুআ, ১৬০ পৃ. হা/১৩৭)
তিনি আরও লিখেন-
قُلْتُ وَكَذَا رَوَاهُ الدَّارَقُطْنِيُّ وَالْحَاكِمُ وَشَيْخُهُ ابْنُ عَدِيٍّ كَمَا ذَكَرَهُ الدَّمِيرِيُّ فِي حَيَاةِ الْحَيَوَانِ وَاللَّهُ الْمُسْتَعَانُ
-‘‘আমি (মোল্লা আলী ক্বারী) বলি, এমনিভাবে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম দারাকুতনী, হাকেম, ইবনে আদী (رحمة الله)। এমনিভাবে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন আল্লামা দামেরী (رحمة الله) তার হায়াতুল হায়ওয়ান নামক কিতাবে।’’ (মোল্লা আলী ক্বারী, আসরারুল মারফুআ, ১৬০ পৃ. হা/১৩৭)
তিনি তার আরেক পুস্তকে লিখেন-
لكن طرقه يقوي بعضها بعضا
-‘‘তবে এ বিষয়ক হাদিসটি পরস্পর সূত্রগুলো মিলে শক্তিশালী (কমপক্ষে ‘হাসান’ স্তরে উপনীত) হয়েছে, কেননা এক সূত্র অপর সূত্রকে শক্তিশালী করে।’’ (মোল্লা আলী ক্বারী, শরহে শিফা, ১/৬৪২ পৃ.)
৫. এ বিষয়ে ইমাম কাস্তালানী (رحمة الله) লিখেন-
لكن طرقه يقوى بعضها بعضا.
-‘‘তবে এ বিষয়ক হাদিসটি পরস্পর সূত্রগুলো মিলে শক্তিশালী (কম পক্ষে হাসান স্তরে উপনীত) হয়েছে, কেননা এক সূত্র অপর সূত্রকে শক্তিশালী করে।’’ (কাস্তালানী, মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যাহ, ২/২৭৯ পৃ.)
তিনি আরও একটু সামনে অগ্রসর হয়ে লিখেন-
لكنه في الجملة وارد في عدة أحاديث يتقوى بعضها ببعض
-‘‘তবে উক্ত ঘটনা বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থাবলীতে বিভিন্ন সূত্রসহ পাওয়া যায়, আর এ সূত্রগুলো পরস্পর মিলালে এক প্রকার শক্তি অর্জিত হয় তথা হাদিসটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়।’’ (ইমাম কাস্তালানী, মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যাহ, ২/২৮০ পৃ.)
৬. ইমাম জুরকানী (رحمة الله) লিখেন-
لكن له طرق يقوي بعضها بعضًا؛ لأن الطرق إذا تعددت وتباينت مخارجها، دلَّ ذلك على أن للحديث أصلًا، فيكون حسنًا لغيره لا لذاته
-‘‘তবে এ বিষয়ক হাদিসটি পরস্পর সূত্রগুলো মিলে শক্তিশালী হয়েছে, কেননা এক সূত্র অপর সূত্রকে শক্তিশালী করে, হাদিসটি যখন অধিক পদ্ধতিতে বর্ণিত হয়েছে ইমামগণ সংকলন করেছেন, সেহেতু এ বিষয়টির যে ভিত্তি আছে তা বুঝা যায়, অতএব এ হাদিসটি ‘হাসান লিগাইরিহি’ তবে হাসান লিজাতিহী নয়।’’ (আল্লামা জুরকানী, শারহুল মাওয়াহিব, ৬/৫৫৭ পৃ.)
তাই বিজ্ঞ ইমামদের অভিমত অনুসারে উক্ত হাদিসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ায় এই ঘটনাটি যে সত্য তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না।
সম্মানিত পাঠকগণ! আপনারাই বলুন, আমরা কী রাসূল (ﷺ) এর হাদিস এবং বিজ্ঞ ইমামদের কথা মানবো নাকি এই বিভ্রান্তিকর আলেমদের