আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রকার শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে রমজান মাসকে মহিমান্বিত করেছেন। কিন্তু এই শ্রেষ্ঠত্বকে আমরা ক’জন অনুভব করি। একটি রমজান জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া মানে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হওয়া। আবার একটি রমজান লাভ করা মানে জীবনে বিশাল কিছু অর্জন করা।

রমজানের ফজিলত

১. আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)।

২. এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে তা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আল্লাহ বলেন, ‘শবেকদর সমন্ধে আপনি কি জানেন? শবেকদর হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ (সুরা কদর : ২,৩)।

৩. রমজান এলে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানগুলোকে শিকলবন্দি করে দেওয়া হয় এবং এই মাসের প্রতি রাতে অসংখ্য জাহান্নামিকে মুক্তি দেওয়া হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন রমজান মাসের প্রথম রাত আসে, তখন শয়তান ও অভিশপ্ত জিনদের শৃঙ্খলিত করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, তার একটি দরজাও খোলা হয় না, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, এর একটি দরজাও বন্ধ হয় না এবং একজন ঘোষক ডেকে বলেন, হে সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তি! অগ্রসর হও, হে অসৎকর্মপরায়ণ! থেমে যাও। আল্লাহ (রমজানের) প্রতিটি রাতে অসংখ্য লোককে জাহান্নাম থেকে নাজাত দেন।’ (বোখারি : ১৮৯৮)।

রোজাদারের ফজিলত

১. রোজাদারের প্রতিদান আল্লাহ নিজ হাতে দেবেন। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, বনি আদমের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্যই। শুধু সওম ব্যতীত; তা আমার জন্য, আমি নিজেই তার পুরস্কার দেব। (বোখারি : ৫৯২৭)।

২. রোজাদারের জন্য জান্নাতে স্পেশাল গেট থাকবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জান্নাতের একটি প্রবেশদ্বার রয়েছে, যার নাম ‘রাইয়ান’। কেয়ামতের দিন ওই দ্বার দিয়ে সিয়াম পালনকারীরা প্রবেশ করবে। তারা ছাড়া আর কেউই ওই দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে না। সিয়াম পালনকারীরা প্রবিষ্ট হয়ে গেলে দ্বাররুদ্ধ করা হবে। ফলে সে দ্বার দিয়ে আর কেউই প্রবেশ করবে না।’ (বোখারি : ১৮৯৬)।

৩. রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশক আম্বরের চেয়েও অধিক প্রিয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ওই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন, সাওম পালনকারীর মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ তায়ালার কাছে মিশকের সুগন্ধি থেকে বেশি পছন্দনীয়। (নাসায়ি : ২২১৩)।

৪. রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দময় মুহূর্ত রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সিয়াম পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে। একটি হলোÑ যখন সে ইফতার করে তখন আনন্দিত হয়, অপরটি হলোÑ যখন সে মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তখন সে আনন্দিত হবে।’ (মুসলিম : ২৫৯৮)।

৫. রোজাদার শয়তানের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘রোজা (সব ধরনের অশ্লিল ও মন্দ কাজের) ঢালস্বরূপ।’ (বোখারি : ১৯০৪)।

৬. কেয়ামতের দিন রোজা স্বয়ং রোজাদারের জন্য সুপারিশ করবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সিয়াম এবং কোরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে।’ সিয়াম বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তাকে পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আর কোরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাত্রে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন।’ নবীজি বলেন, ‘অতএব, ওদের উভয়ের সুপারিশ গৃহীত হবে।’ (আহমাদ : ৬৬২৬)।

৭. রোজা রাখার মাধ্যমে আগের সব গোনাহ মাফ হয়ে যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানে সিয়াম পালন করবে, তারও অতীতের সব গোনাহ মাফ করা হবে।’ (বোখারি : ১৯০১)।

রমজান আগমনের উদ্দেশ্য

১. রমজানের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো, তাকওয়া অর্জন করা। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেজগারি অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)।

ওমর (রা.) ইবনে কা’ব (রা.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাকওয়া কি জিনিস? তিনি বললেন, ‘আপনি যদি কাঁটাযুক্ত কোনো পথ দিয়ে হেঁটে যান, তাহলে কীভাবে যাবেন? তিনি বললেন, খুবই সতর্কতার সঙ্গে চলব, যাতে শরীরে কাঁটা না ফুটে। তিনি বললেন, এটাই তাকওয়া।’ সুতরাং খুবই সতর্কতার সঙ্গে নিজের চোখে, কান, জিহ্বাসহ অন্য সব অঙ্গকে আল্লাহর নাফরমানি থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জাবের (রা.) বলেন, তুমি যখন রোজা রাখো, তোমার কান, চক্ষু ও জিহ্বাও যেন রোজা রাখে। (ইবনে আবি শাইবা : ৮৮৫২)।

২. ধৈর্যধারণ করতে শেখা। অন্য অর্থে সংযমী হওয়া। ধৈর্য তিন প্রকার : ১. সৎকাজ পালনে ধৈর্য ধারণ। ২. অসৎকাজ থেকে বিরত থাকতে ধৈর্য ধারণ ৩. বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ। রোজার মাধ্যমে তিন প্রকার ধৈর্যের অনুশীলন করে নিজের জীবনে প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করা।

৩. কৃত গোনাহগুলো মাফ করিয়ে নেওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার কাছে জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, যে ব্যক্তি রমজান পেল, অথচ তার গোনাহ মাফ হয়নি, সে জাহান্নামে প্রবেশ করুক, আল্লাহ তাকে দূরে ঠেলে দিক। বলুন, আমিন। আমি বললাম, আমিন। (তারগিব : ১৬৭৯)।

রমজানে করণীয়

১. সবগুলো রোজা গুরুত্বের সঙ্গে যথাযথভাবে পালন করার ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প করা।

২. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা।

৩. তারাবির নামাজ গুরুত্ব সহকারে আদায় করা। রাসুল (সা.) বলন, ‘যে ব্যক্তি রমজানে ঈমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় তারাবির সালাতে দাঁড়াবে তার পূর্ববর্তী গোনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বোখারি : ২০০৯)।

৪. কোরআনুল কারিম শিখা-শেখানোর কাজে ব্যস্ত থাকা। হাদিসে এসেছে, রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরাঈল (আ.) রাসুল (সা.) এর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবীজি তাঁকে কোরআন শোনাতেন। (বোখারি : ৬)।

৫. অধিক পরিমাণে দান করা। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সবার চেয়ে দানশীল ছিলেন। রমজানে জিবরাঈল (আ.) যখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরও অধিক দান করতেন। রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরাঈল (আ.) তার সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী তাকে কোরআন শোনাতেন। জিবরাঈল যখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি রহমতসহ প্রেরিত বায়ুর চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন। (বোখারি : ১৯০২)।

৬. রোজাদারকে ইফতার করানো। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করায়, সে ব্যক্তি রোজাদারের সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করে। কিন্তু এর ফলে রোজাদারের সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র কমানো হবে না। (তিরমিজি : ৮০৭)।

৭. বেশি বেশি দোয়া করা। বিশেষ করে ইফতারের আগে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিন ধরনের লোকের দোয়া কখনও ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ১. রোজাদার যতক্ষণ ইফতার না করে...। (তিরমিজি : ৩৫৯৮)।

৮. শেষ দশকে ইতিকাফ করা এবং লাইলাতুল কদর তালাশ করা। পরিপূর্ণ রূপে ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক প্রবেশ করত, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতে নিজে জাগতেন, নিজ পরিজনদেরও জাগাতেন, কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং কোমরে লুঙ্গি বেঁধে নিতেন।’ (মুসলিম : ১১৭৪)।

৯. সামাজিকভাবে রমজানের গুরুত্ব ও পবিত্রতা বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলা।

রমজানে বর্জনীয়

১. রোজাকে বোঝা কিংবা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর না ভাবা। বরং মনেপ্রাণে এ কথা বিশ্বাস করা যে, রমজান ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র; এমনকি পুরো পৃথিবীর জন্য কল্যাণের বাহক।

২. অলসতা পরিত্যাগ করা। সুতরাং সাহরিতে উঠতে অলসতা না করা। আগে আগে মসজিদে গমন করা। সতেজ হৃদয় ও সতেজ শরীর নিয়ে প্রতিটি আমল পূর্ণ করা।

৩. সব ধরনের হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিষিদ্ধ ও হারাম জিনিস থেকে বেঁচে থাক, তাহলে তুমি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় আবেদ (ইবাদতকারী) গণ্য হবে।’ (আহমাদ : ৮০৯৫)।

৪. মিথ্যা পরিত্যাগ করা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি : ১৯০৩)।

৫. ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সিয়াম ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার।’ (বোখারি : ১৯০৪)।

৬. গিবত না করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। (সুরা হুজুরাত : ১২)।

৭. হিংসা করা থেকে বিরত থাকা। রমজানে বিনিদ্র রাত্রিযাপন করে এবং অনাহারে দিনাতিপাত করে যদি কেউ হিংসায় লিপ্ত হয়, তার চেয়ে হতভাগা আর কেউ হতে পারে না। কারণ হিংসা সব নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা অবশ্যই হিংসা পরিহার করবে। কারণ আগুন যেভাবে কাঠ বা ঘাসকে খেয়ে ফেলে, তেমনি হিংসাও মানুষের নেক আমলকে খেয়ে ফেলে।’ (আবু দাউদ : ৪৯০৩)।

সবশেষে, রোজার যে মহৎ উদ্দেশ্য; তাকওয়া, ধৈর্য-সংযম ও মাগফিরাত তা যদি অর্জন হয় তবেই আমাদের জীবনে রমজানের আগমন সার্থক। অন্যথায় রাসুল (সা.) এর সেই বাণী কতই না যথার্থ! ‘কত রোজাদার আছে যাদের রোজার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। কত সালাত আদায়কারী আছে, যাদের রাত জাগরণ ছাড়া আর কিছুই জোটে না।’ (ইবনে মাজাহ : ১৬৯০)।

লেখক : আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ, বাংলাদেশ
Top