কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:) এঁর জীবন ও কর্ম

 

পরিচিতি:

কুতুবুল আকতাব হযরত খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র (জন্ম ১১৭৩-মৃত্যু ১২৩৫) ছিলেন একজন মুসলিম সুফি সাধক। তিনি দক্ষিণ কিরগিস্তানের উশ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ১৬তম শতাব্দিতে মোগল সম্রাট আকবরের উজির আবুল ফজল ইবনে মোবারক রচিত কুতুবউদ্দিন (রা:) এঁর জীবনী ‘‘আইন-ই- আকবর”-এ উল্লেখ করা হয়, তাঁর পিতার নাম কামালুদ্দিন। তিনি খাজা কুতুবউদ্দিন (রা:) এঁর দেড় বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।


খাজা কুতুবউদ্দিন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র আসল নাম বখতিয়ার এবং পরে কুতুবউদ্দিন নামটা দেয়া হয়। তিনি হোসাইন ইবনে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়লা আনহু’র মাধ্যম হয়ে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বংশের সাথে মিলিত হয়েছেন। তার মা, যিনি নিজেই একজন শিক্ষিত মহিলা ছিলেন, তাঁর শিক্ষার জন্য শাইখ আবু হিফসকে নিয়োগ দেন।


হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রা:) তার ভ্রমণের সময় যখন আউশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার (রা:) তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন এবং তাঁর থেকে খেলাফতও গ্রহণ করেন। এভাবেই তিনি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র প্রথম খলিফা হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি চিশতিয়া ত্বরিকার সাধক ছিলেন। তার নামেই দিল্লীর বিখ্যাত কুতুব মিনার উৎসর্গ করা হয়। শিষ্যত্ব গ্রহণ করার আগেই চিশতিয়া ত্বরিকা শুধুমাত্র আজমীর এবং নাগাউর এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দিল্লীতে স্থায়ীভাবে এই ত্বরিকাকে প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দরগাহ্ (সমাধি) মেহরাউলের জাফর মহলের পাশেই অবস্থিত এবং পুরানো দরগাহ্ দিল্লিতে অবস্থিত, যেখানে তাঁর ওরশ পালিত হয়।


ভারতের অনেক বিখ্যাত শাসক তাঁর ওরশ মহা-সমারোহ উদযাপন করতেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কুতুবউদ্দিন আইবাক, ইলতুতমিশ যিনি কুতুবউদ্দিন কাকী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র জন্য “ঘান্দাক কি বাউলি” নামে এক গভীর নলকূপ স্থাপন করেন, শের শাহ সুরি যিনি একটি বড় গেইট তৈরী করেন, বাহাদুর শাহ যিনি দরগাহের পাশে মতি মসজিদ নির্মাণ করেন, ফারুক শিয়ার যিনি মার্বেলের মসজিদ নির্মাণ করেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত শিষ্য এবং খলিফা হলেন ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, যিনি আবার দিল্লির বিখ্যাত সাধক নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রা:) এঁর পীর (সূফি গুরু)। নিজাম উদ্দির আউলিয়া (রা:) এঁর শিষ্য হলেন মুসলিম সুফি সাধক কবি আমির খসরু (রা:)।



 

দিল্লী গমন:

দিল্লী সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা ইলতুতমিশের (১২১১-১২৩৬) এর অবসরের সময় নিজ পীর, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, একান্ত ইচ্ছায় খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দিল্লিতে চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:) এঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও দক্ষতা এবং মানবতার অপার মহিমা অবলোকন করে প্রচুর মানুষ প্রায় তাঁর সাক্ষাত লাভে প্রতিদিন আসা যাওয়া করতেন। তিনি এই আধ্যাত্মিক পথে সাধারণ মানুষকে বায়াত দানও শুরু করে দিয়েছিলেন।


ফলাফলের বা প্রতিদানের আশা না করে অভাব গ্রস্থদের সাহায্য করার মতার্দশের বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য, ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকার (রা:), তাঁকে কবচের (তাবিজ) বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করেন যেগুলো ছিল বির্তকিত কেননা এগুলো ইসলামে মূর্তিপূজার মত ধর্মীয় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এর উত্তরে কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:), ইচ্ছা বা বাসনার পরিপূর্ণতা হওয়া কোন কিছুর উপর নির্ভর করে না, কবচ বা তাবিজে আল্লাহর নাম এবং তাঁর কথা বা আয়াত রয়েছে এবং এগুলো মানুষকে দেয়া যাবে। সেমায় নিমগ্ন হয়ে তিনি চিশতিয়া ত্বরিকার আধ্যাত্মিক সঙ্গীতের ঐতিহ্যকে বজায় রাখেন এবং আরো সমৃদ্ধ করেন।


ধারণা করা হয় যে, হিন্দু ধর্মে ভক্তি নিবেদনের সঙ্গীতের সাথে সুরের সমন্বয় করা হয়, যাতে স্থানীয় মানুষদের সাথে সর্ম্পক স্থাপনের সহায়ক হিসেবে কাজ করে এবং দুই সম্প্রদায়ের মাঝে পারষ্পরিক সমন্বয় সহজ হয়। ১৪ রবিউল আউয়াল ৬৩৩ হিজরীতে (২৭ নভেম্বর ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দ) তিনি একটি সেমা মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন, যেখানে কবি আহমদ-এ-জাম নিম্নোক্ত পঙ্গক্তিটি গেয়ে শুনান:


যারা আত্মসমর্পণের খঞ্জরে নিহত হয়েছে,

অদৃশ্য থেকে তাঁরা প্রতিনিয়ত নব জীবন প্রাপ্ত হয়েছে।


খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:) এই আধ্যাত্মিক পঙ্গক্তি দ্বারা এতটাই পরমানন্দ লাভ করলেন যে, তিনি ততক্ষণাৎ মূর্ছা গেলেন। ঐ আধ্যাত্মিক পরমানন্দের মাঝেই চারদিন পর তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর দরগাহ, (মাজার), দিল্লির মেহরুলে অবস্থিত কুতুব মিনার কমপ্লেক্সের নিকটে জাফর মহলের পাশে অবস্থিত। তাঁর জোর নির্দেশ ছিল, ইন্তেকালের পর তাঁর নামাজে জানাজার নেতৃত্ব সে ব্যক্তিই দিবেন, যিনি কখনও কোন হারাম কাজ করেননি এবং আসরের সালাত এর সুন্নত কখনও ছাড়েননি।


কাকী উপাধির ঘটনা:

কাকি নামটি দিল্লীর একটি ঘটনার পর, তাঁর উপাধি হিসেবে যুক্ত হয়। ঘটনাসুরে, তিনি তাদের চরম দরিদ্রতা, দারিদ্র সত্ত্বেও স্থানীয় রুটিওয়ালা থেকে ঋণ না নিতে তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিষেধ করেন। পরবর্তিতে স্ত্রীকে বলেন, যখনই প্রয়োজন হবে তখন ঘরের এক কোণা থেকে যেন কাক (এক ধরনের রুটি) নেন। এরপর, যখনই প্রয়োজন হত আশ্চর্জনকভাবে তারঁ স্ত্রী ঘরের কোণা থেকে কাক পেয়ে যেত। ইতিমধ্যে রুটিওয়ালা এটা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল যে, কেন খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:) ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিল।


তিনি চিন্তা করলেন হয়ত তিনি প্রায়শ খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র সাথে রাগারাগি করতেন, সেজন্য খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:) ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে, রুটিওয়ালার স্ত্রী কুতুবউদ্দিন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র স্ত্রীর কাছ থেকে এর কারণ জানতে চাইলেন। তিনি তাকে কাক এর আশ্চর্যজনক ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। এই গোপন রহস্যটি উন্মোচিত হওয়ার পর যদিও কাক আসা বন্ধ হয়ে যায়, ঐ দিন থেকে মানুষ কুতুবউদ্দিনকে কাকি নামে সম্বোধিত করতে থাকে।



 

খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর (রা:) এঁর মতাদর্শ:

চিশতিয়া ত্বরিকার অন্যান্য সাধকদের মত খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:) কোন আনুষ্ঠানিক মতবাদ প্রণয়ন করেননি। তিনি সবসময় মজলিসের আয়োজন করতেন যেখানে তিনি ত্বরিকতের গোপন রহস্য তত্ত্ব নিজ শিষ্যদের কাছে উন্মোচিত করতেন। জনসাধারণের মধ্যে পরিচালিত এই মজলিসে যেসব বিষয়ের উপর জোর দেয়া হতো সেগেুলো হল- আত্ম-ত্যাগ ও বাসনা শূণ্য প্রেম, আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস, সকল মানুষকে একইরূপ আচরণ করা এবং যথাসাধ্য তাদের সাহায্য করাসহ ইত্যাদি। তাকে যেসব আবদার করা হত, তিনি সে দিনই ঐ আবদার পূরণ করে দিতেন। ফলাফলের বা প্রতিদানের আশা না করে অভাবগ্রস্থদের সাহায্য করার মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।


খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীর (রা:) এঁর প্রভাব:

সূফি সাধক হিসেবে খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:) মানুষের উপর প্রচন্ডভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। তিনি তখনকার সরকারের সাথে জড়িত না থাকার নীতি অব্যাহত রাখেন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার চিশতিয়া ত্বরিকার সাধকদের পরম্পরা যে, তারা মনে করেন শাসকগোষ্ঠী এবং সরকারের সাথে সম্পর্ক তাদেরকে দুনিয়াবি চিন্তা ভাবনার মধ্যে ডুবিয়ে রাখতে পারে।


খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:) এঁর উপাধি সমূহ

(১) কুতুব-উল-আকতাব। (২) মালিক-উল-মাশায়খ। (৩) রাইস-উস-সালেকীন। (৪) সিরাজ-উল-আউলিয়া।

হযরত কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইন্তেকাল করলেন। তাঁর জানাযার জন্য পঙ্গপালের মতো ছুটে এলো বহু মানুষ। বিশাল মাঠে জানাযার আয়োজন করা হলো। জনসমুদ্রে পরিণত হলো মাঠ। জানাযার সময় হলে একজন ঘোষক ঘোষণা করলেন, হযরত বখতিয়ার কাকী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইন্তেকালের পূর্বে আমাকে ওসিয়ত করে গেছেন, যার মাঝে চারটি গুন থাকবে তিনি যেন বখতিয়ার কাকী (রা:) এঁর জানাযা পড়ান।


সৈয়দ খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা:) এঁর চারটি গুণ হলো:

১. যার জীবনে কোনদিন তাকবীরে উলা ছোটেনি।

২. যার কোনদিন তাহাজ্জুদ কাযা হয়নি।

৩. যে কোনদিন গায়রে মাহরামের দিকে বদনজরে তাকাননি।

৪. এমন ইবাদতগুযার যার কোনদিন আসরের সুন্নতও ছোটেনি।


একথা শোনার পর পুরো মাঠে নিরবতা ছেয়ে গেলো। সবাই নিস্তব্ধ। কে আছেন এমন? এভাবেই কেটে গেলো বেশ কিছুক্ষণ। এরপর ভীড় ঠেলে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন একজন। সবার দৃষ্টি তাঁর দিকে। ধীরে ধীরে জানাযার দিকে এগিয়ে এলেন। লাশের মুখ থেকে চাদর সরিয়ে বললেন, কুতুবুদ্দীন ! তুমি নিজে তো চলে গেলে কিন্তু। আমাকে অপদস্ত করে গেলে। তারপর তিনি জনসম্মুখে আল্লাহ তা‘য়ালাকে সাক্ষী রেখে কসম খেয়ে বললেন, আমার মাঝে এই চারটি গুণ আছে। জনতা বিস্ময়য়ে হতবাক হয়ে গেলো। আরে !! ইনি কে?? তিনি আর কেউ নয়। তিনি হলেন তৎকালীন বাদশাহ শামসুদ্দীন আলতামাশ (রা:)। সুবহানাল্লাহ


একজন বাদশাহ যদি নিজের সকল ব্যস্ততা সত্বেও এমন আবেদের জীবন যাপন করতে পারেন । তাহলে আমরা যারা বিভিন্ন চাকরি বা ব্যবসা কিংবা অন্য কোন পেশায় নিয়োজিত আমরা কি পারিনা এভাবে নিজেকে ইবাদতে ব্যস্ত রাখতে। হে আল্লাহ! আমাদের সবাইকে বেশী বেশী ইবাদত বন্দেগী করার তৌফিক দান করুন। আমিন


ইসলামী গবেষণা বিভাগ

বাগদাদী ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা- ৩৫০০, বাংলাদেশ।


Top