মহিলাদের মসজিদে যাওয়া কি জায়েজ?

মহিলাদের মসজিদে যাওয়া যদি না জায়েয হয় তাহলে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বাণী لاَتَمْنَعُوْا نِسَاءَكُمْ (তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদ হতে বাধা দিওনা) বলার উদ্দেশ্য কি?
ইসলামের প্রথম যুগে বিভিন্ন কারণে মহিলারা মসজিদে যাওয়া জায়েয ছিল বিধায় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ মহিলাদের অভিভাবকদেরকে পরামর্শমূলক বলেছেন যে, তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদে যাওয়া হতে নিষেধ করিও না। যেমন আবু দাউদ শরীফ ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা নং ৮৪, হাদীস নং ৫৬৬ এ আছে- عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ لاَتَمْنَعُوْا اِمَاءَ اللّٰهِ مَسَا جِدَ اللّٰهِ

[ইবনে ওমর (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এরশাদ করেছেন- তোমরা আল্লাহর বাদীদেরকে তথা মহিলাদেরকে আল্লাহর মসজিদসমূহে নিষেধ করিও না।] উপর্যুক্ত হাদীস শরীফটি ইসলামের প্রথম যুগের যখন মহিলাদের জন্য পর্দার হুকুম নাযিল হয়নি। অপর দিকে মহিলারা শরীয়তের জ্ঞানার্জনের জন্যেও মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল।

তাই কোন প্রকার শর্ত বিহীনভাবে তাদেরকে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি ছিল। অত:পর সুগন্ধি ও সুন্দর্য বর্জনের শর্তযুক্ত করে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। যেমন হাদীস শরীফে আছে- عَنْ اَبِيْ هُرَيْرَهَ اَنَّ رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ قَالَ لاَ تَمْنَعُوْا اِمَاءَ اللّٰهِ مَسَا جِدَ اللّٰهِ وَ لٰكِنْ لَيَخْرُجْنَ وَ هُنَّ تَفِلاَ تٌ
[আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এরশাদ করেছেন-তোমরা আল্লাহর বাদীদেরকে আল্লাহর মসজিদসমূহে আসতে নিষেধ করিও না। কিন্তু মহিলারা সুগন্ধি ব্যবহার ও সুন্দর্য প্রদর্শন ব্যতীত মসজিদের দিকে বের হবে। (আবু দাউদ পৃষ্ঠা নং ৮৪, হাদীস নং-৫৬৫)]


 
এ প্রসঙ্গে আরো কঠোরতামূলক এরশাদ হচ্ছে- عَنْ زَيْنَبَ اِمْرَأَةِ عَبْدِ اللّٰهِ قَالَتْ قَالَ لَنَا رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ اِذَا شَهِدَتْ اِحْدَا كُنَّ الْمَسْجِدَ فَلاَ تَمَسَّ طِيْبًا
[আবদুল্লাহর স্ত্রী যয়নব (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন- রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে বলেছেন। তোমাদের কেহ যদি মসজিদে উপস্থিত হয় সে যেন সুগন্ধি স্পর্শ না করে। (মুসলিম ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং ১৮৩, হাদীস নং ৪৪৩)]

আরো এরশাদ হচ্ছে- عَنْ اَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ اَ يُّمَا اِمْرَءَةٍ اَصَابَتْ بَخُوْرًا فَلاَتَشْهَدْ مَعَنَا الْعِشَاءَ الْاٰخِرَةَ
[আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন-যে মহিলা সুগন্ধি ব্যবহার করেছে সে যেন আমাদের সাথে এশার নামাজে উপস্থিত না হয়। (মুসলিম ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং ১৮৩, হাদীস নং ৪৪৪)]

অত:পর মহিলাদেরকে সরাসরি নিষেধ না করলেও আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি মসজিদে না এসে তাদের ঘরে নামায পড়া তাদের জন্য অধিক উত্তম বলা হয়েছে। যেমন এরশাদ হচ্ছে- عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضي اللّٰه عنهما قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ لاَ تَمْنَعُوْا نِسَاءَكُمُ الْمَسَاجِدَ وَ بُيُوْتُهُنَّ خَيْرٌ لَهُنَّ

[ইবনে ওমর (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ এরশাদ করেছেন- তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদে আসতে বাধা দিওনা। আর তাদের ঘরসমূহ তাদের জন্য অধিক উত্তম স্থান। (আবু দাউদ পৃষ্ঠা নং ৮৪, হাদীস নং ৫৬৭)] এ হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে- بذل المجهود في حل ابي داود কিতাব ১ম খণ্ড ৩১৯ নং পৃষ্ঠায় আছে- بُيُوْتُهُنَّ خَيْرٌ لَهُنَّ اَيْ وَ صَلٰو تُهُنَّ فِيْ بُيُوْ تِهِنَّ خَيْرٌ لَهُنَّ مِنْ صَلٰو تِهِنَّ فِي الْمَسَاجِدِ بِالْجَمَاَ عَةِ لِاَ نَّهُ اَسْتَرُ لَهُنَّ – اَلْجُمْلَةُ الْاُ وْلٰي نَهِيٌ للِرِّ جَالِ عَنْ مَنْعِ النِّسَاءِ عَنِ الْحُضُوْرِ فِي الْمَسْجِدِوَ الْجُمْلَةُ الثَّا نِيَةُ حَثٌّ وَ تَرْغِيْبٌ للِنِّسّاءِ اَنْ يُصَلِّيْنَ فِيْ بُيُوْتِهِنَّ فَاِنَّهُ اَفْضَلُ لَهُنَّ كَمَا يَدُلُّ عَلَيْةِ حَدِيْثُ عَبْدِ اللّٰهِ بْنِ مَسْعُوْدِ الْاٰتِيْ قَرِ يْبًا

[মহিলাদের ঘরই মহিলাদের জন্য অধিক উত্তম। অর্থাৎ মহিলারা মসজিদে গিয়ে জামা’আতে নামায আদায় করার চেয়ে মহিলাদের নামায তাদের ঘরেই অধিক উত্তম। কেননা এটাই তাদের জন্য অধিক পর্দা। প্রথম বাক্য অর্থাৎ “তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদ হতে নিষেধ করিও না” বাক্যটি হল পুরুষদের জন্য নিষেধ মহিলাদেরকে মসজিদে উপস্থিত হতে বাধা না দেয়ার। আর দ্বিতীয় বাক্য অর্থাৎ “মহিলাদের ঘরই হল তাদের জন্য অধিক উত্তম” বাক্যটি হল মহিলাদের জন্য উদ্বুদ্ধকরণ ও আগ্রহকরণ যাতে তারা তাদের ঘরেই নামায আদায় করে। কেননা ঘরে নামায আদায় করাই মহিলাদের জন্য অধিক উত্তম যা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের হাদীসে বুঝা যায়।]
 
আবার দেখা যায় যে, মহিলারা দিনের বেলায় মসজিদে আসা যাওয়া তাদের জন্য নিরাপদ না হওয়ায় এবং ফিতনার ভয়ে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ রাতের বেলায় অনুমতি চাইলে অনুমতি দেয়ার জন্য বলেছেন। যেমন এরশাদ হচ্ছে- عَنِ ابْنِ عُمَرَ رضي اللّٰهُ تعالي عنهما عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ : اِذَا اسْتَأْذَنَكُمْ نِسَاؤُكُمْ بِالَّيْلِ اِلَي الْمَسْجِدٍ فَأْذَ نُوْا لَهُنَّ
[ইবনে ওমর (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি নবী করীম ﷺ হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি এরশাদ করেছেন যখন তোমাদের মহিলাগণ রাত্রের বেলা মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চায় তাহলে তাদেরকে অনুমতি দিও। (বুখারী ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং ১১৯, হাদীস নং-৮৫৭)]

[এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (রা.) বলেন- وَ فِيْهٖ اَنَّهُ يَنْبَغِيْ اَنْ يَأْذَنَ لَهَاوَ لاَ يَمْنَعَهَا مِمَّا فِيْهٖ مَنْفَعَتُهَا – وَ ذَالِكَ اِذَا لَمْ يَخُفَّ الْفِتْنَةَ عَلَيْهَا وَ لاَ بِهَا وَ قَدْكَانَ هُوَ الْاَ غْلَبُ فِيْ ذَالِكَ الزَّ مَاَنِ بِخِلاَفِ زَمَانِنَا هٰذَا – فَاِنَّ الْفَسَادَ فِيْهٖ فَاشٍ وَالْمُفْسِدُوْنَ كَثِيْرُوْنَ وَ حَدِ يْثُ عَا ئِشَةَ رضي اللّٰهُ تعالي عنها الَّذِيْ يَأْ تِي يَدُلُّ عَلٰي هٰذَا وَ عَنْ مَالِكٍ : اِنَّ هٰذَا الْحَدِيْثَ وَ نَحْوَهُ مَحْمُوْلٌ عَلَي الْعَجَا ئِزِ وَ قَالَ النَّوَوِيُّ لَيْسَ لِلْمَرْأَةِ خَيْرٌ مِنْ بَيْتِهَا وَ اِنْ كَانَ عَجُوْزًا – …. وَ كَانَ اِبْرَاهِيْمُ يَمْنَعُ نِسَاءَهُ الْجُمْعَةَ وَ الْجَمَا عَةُ ….. وَ فِيْهٖ اِ شَارَةٌ اِلٰي اَنَّ الْاِذْ نَ الْمَذْ كُوْرَ لِغَيْرِ الْوَاجِبِ لِاَ نَّهُ لَوْ كَانَ وَاجِبًا لاَ نْتَفٰي مَعْنَي الْاِ سْتِئْذَانِ لِاَنَّ ذَالِكَ اِنَّمَا يَتَحَقَّقُ اِذَا كَانَ الْمُسْتَأْذَنُ مُخَيَّرًا فِي الْاِجَابَةِ اَوِ الرَّدِّ

[এ হাদীসে ইঙ্গিত রয়েছে যে, যে কাজে মহিলার উপকার রয়েছে সে কাজে তাকে অনুমতি দেয়া এবং নিষেধ না করা। আর অনুমতি দেয়া ও বাধা না দেয়া তখন যখন মহিলার উপর বা মহিলার দ্বারা ফিতনার ভয় না থাকে। ঐ সময় তথা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময় ফিতনার ভয় না থাকাই অধিকতর সম্ভাব্য। আমাদের এই যামানায় এর ব্যতিক্রম। কেননা এ যামানায় ফেতনা ফাসাদ ব্যাপক এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারী অনেক। আয়েশা (রা:) এর হাদীসও তা বুঝায়। ইমাম মালেক (রা:) বলেছেন- এ হাদীস ও অনুরূপ অন্যান্য হাদীস বৃদ্ধাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ইমাম নববী (রা:) বলেন- মহিলার জন্য তার নিজ ঘর হতে অধিক উত্তম স্থান নেই যদিও বৃদ্ধা হয়। ইমাম ইব্রাহীম নাখয়ী (রা:) তিনি তাঁর মহিলাদেরকে জুমআ ও জমআত হতে নিষেধ করতেন। হাদীস শরীফে এ দিকে ইঙ্গিত রয়েছে যে, উল্লেখিত অনুমতি অর্থাৎ পুরুষ মহিলাকে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দেয়া ওয়াজিব নহে। কেননা ওয়াজিব যদি হয় তাহলে অনুমতি চাওয়ার অর্থ দূর হয়ে যায়। এজন্য যে, অনুমতি চাওয়া তখনই বাস্তবায়িত হবে যখন অনুমতি প্রাপ্ত ব্যক্তি সাড়া দেওয়া ও সাড়া না দেয়া উভয়ের মধ্যে ইচ্ছাধীন থাকে। (ওমদাতুল ক্বারী শরহে ছহীহুল বোখারী ৪নং খণ্ড পৃষ্ঠা নং ৬৪৭)]
 
অতএব, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বাণী “তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদ হতে নিষেধ করিও না” এর দ্বারা এটা বুঝা যায় না যে, মহিলারা তাদের ঘরে নামায না পড়ে অধিক ছাওয়াবের জন্য মসজিদে গিয়ে জমআতের সাথে নামায আদায় করা উত্তম। বরং এর অর্থ হল-ঘরে নামায পড়াই তাদের জন্য অধিক উত্তম ও অধিক ছাওয়াব। কিন্তু এর পরও যদি কোন মহিলা উত্তমতাকে ছেড়ে সম্পূর্ণ পর্দানিশী হয়ে সুগন্ধি ও সুন্দর বর্জন করে তার স্বামী বা অভিভাবকের নিকট অনুমতি চায় এমতাবস্থায় পুরুষদেরকে পরামর্শমূলক বলা হয়েছে যে, তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করিও না।

হাদীস শরীফে কোথাও এ আদেশ নেই যে, হে মহিলাগণ! তোমরা মসজিদে গিয়ে নামায আদায় কর। অথবা হে পুরুষগণ! তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদে পাঠাও। আবার কোথাও একথা নেই যে, মহিলারা ঘরে নামায আদায় করলে ছাওয়াব কম হবে এবং মসজিদে আদায় করলে ছাওয়াব বেশী হবে। তাই যেখানে হাদীস শরীফে মহিলাদের জন্য মসজিদ হতে ঘরে নামায পড়া অধিক উত্তম বলা হয়েছে সেখানে উত্তমতা বর্জন করে ঘর ছেড়ে মসজিদে যাওয়া বোকামী ও ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি করা ব্যতীত অন্য কিছু নহে। মহান আল্লাহ সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুক।

ইসলামী গবেষণা বিভাগ
বাগদাদী ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা- ৩৫০০, বাংলাদেশ।

Top