যাকাত দেওয়া যাবে না যাদেরকে ও কোন খাতে যাকাত দিবে
কোন কোন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে না?
নিম্নের ব্যক্তিদেরকে যাকাত দেওয়া যাবে না :
ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় অথবা ভুলক্রমে তাদেরকে যাকাত দিলেও যাকাত আদায় হবে না। বরং জানার পর পুনরায় নির্দিষ্ট খাতে যাকাত দিতে হবে।
১. ধনী ব্যক্তির জন্য যাকাত খাওয়া বা ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়। এমনকি ধনীদের নাবালেগ সন্তানদেরকেও যাকাত দেওয়া যাবে না।
২. আপন দরিদ্র পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, তথা ঊর্ধ্বস্থ সকল নারী-পুরুষ।
৩. ভরণ-পোষণে নির্ভরশীল পুত্র-কন্যা এবং স্বামী-স্ত্রীকে যাকাত প্রদান করা জায়েয নাই। কেননা যাকাত বহির্ভূত সম্পদের দ্বারাই তাদেরকে ভরণ-পোষণ করা ওয়াজিব।
৪. মুহাম্মাদ ﷺ এর প্রকৃত বংশধরদের সম্মান ও মর্যাদার কারণে যাকাতের অর্থ দ্বারা তাঁদেরকে সাহায্য করা জায়েয নয়। একমাত্র দানের অর্থ দ্বারাই তাঁদের খেদমত করা জরুরী।
৫. মসজিদ, মাদ্রাসা, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি নির্মাণের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা নিষেধ।
৬. সাধারণ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করাও জায়েয নয়। তবে আশ্রয় কেন্দ্রে দুরাবস্থা সম্পন্ন আশ্রয় প্রার্থীদের ব্যক্তি মালিকানাধীন ঘর-বাড়ী নির্মাণ করে দেয়া জায়েয।
৭. মনে রাখতে হবে যাকাত পরিশোধ হওয়ার জন্য ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেওয়া শর্ত। সুতরাং যাকাতের অর্থে মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করাও জায়েয নয়। যাকাত দেওয়া যেমন শরীয়তের বিধান, অনুরূপভাবে যাকাত পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকেই যাকাত দেওয়া শরীয়তের বিধান। সঠিক পাত্রে যাকাত প্রদান না করলে যাকাত পরিশোধ হবে না। তাই যাকাত দাতার উচিত যাকাত দেওয়ার পূর্বে নিশ্চিত হওয়া যে, এটি যাকাত পাওয়ার সঠিক খাত কি না।
যাকাত প্রদানের খাতসমূহ কি কি? খাতসমূহ ব্যতীত অন্য কোনো খাতে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হবে কি না?
কোন কোন খাতে যাকাতের সম্পদকে ব্যয় করতে হবে তা স্বয়ং মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। নির্ধারিত খাতসমূহ ব্যতীত অন্য খাতে যাকাত দিলে তা যাকাত হিসেবে আদায় হবে না। যাকাতের খাতে যাকাত ব্যয়ের গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ ﷺ ইরশাদ করেছেন-
عَنْ زٍيَادِبْنِ الْحَارِثِ الصَّدَ ائِيْ قَالَ اَتَيْتُ النَّبِيَّ ﷺ فَبَايَعْتُهُ فَذَكَرَ حَدِيْثًا طَوِيْلاً فَاَتَاهُ رَجُلٌ فَقَالَ اَعْطِنِيْ مِنَ الصَّدَ قَةِ فَقَالَ لَهُ رَسُوْلُ اللّٰهُ ﷺ اِنَّ اللّٰهَ لَمْ يَرْضَ بِحُكْمِ نَبِيٍّ وَلاَ غَيْرِهٖ فِي الصَّدَقَاتِ حَتّٰي حَكَمَ فِيْهَا هُوَ فَجَزَّا هَا ثَمَا نِيَةَ اَجْزَاءٍ فَاِنْ كُنْتَ مِنْ تِلْكَ الاْ جْزاءِ اَعْطَيْتُكَ – (رَوَاهُ اَبُوْدَاوُدَ)-
[যিয়াদ ইবনে হারেস ছুদায়ী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- আমি নবী করিম ﷺ এর খেদমতে এসে তাঁর নিকট বায়আত গ্রহণ করলাম। অতঃপর তিনি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন এবং বলেন- রাসূলুল্লাহ্ ﷺ এর নিকট এক ব্যক্তি এসে বললো আমাকে যাকাতের কিছু সম্পদ দান করুন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ ﷺ তাকে বললেন মহান আল্লাহ যাকাতের খাত নির্ধারণে কোন নবী কিংবা অন্যকারো নির্দেশের অধীনে না রেখে স্বয়ং নিজেই তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং একে তিনি আট প্রকারের হকদারদের জন্যে আট ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। অতএব তুমি যদি ঐ আট খাতের অন্তর্ভূক্ত হও তাহলে আমি তোমাকে দিব। (আবু দাউদ, মেশকাত পৃষ্ঠা নং-১৬১)]
যাকাতের খাতসমূহের বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلْفُقَرَآءِ وَالْمَسٰکِیْنِ وَ الْعٰمِلِیْنَ عَلَیْہَا وَالْمُؤَلَّفَۃِ قُلُوْبُہُمْ وَ فِی الرِّقَابِ وَالْغٰرِمِیْنَ وَفِیْ سَبِیْلِ اللہِ وَابْنِ السَّبِیْلِ ؕ فَرِیْضَۃً مِّنَ اللہِ ؕ وَاللہُ عَلِیْمٌ حَکِیْمٌ-
[যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের মন আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরের জন্য। (সূরা তওবা, আয়াত নং-৬০)]
নিম্নে খাতসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:
১. ফক্বির: অর্থাৎ যার সামান্য সম্পদ আছে কিন্তু তা দ্বারা সারা বছরের ব্যয় নির্বাহ হয় না। মোট কথা নিছাব পরিমানের চেয়ে নিতান্ত কম সম্পদের মালিক যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত।
২. মিসকীন: যার কিছুই নেই, একেবারে নিঃস্ব তাকে মিসকীন বলে। তাকে যাকাত দেওয়া যাবে।
৩. আমিল: অর্থাৎ জনগণ হতে যাকাত সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি। প্রাপ্ত যাকাত হতে আমিল বা কর্মচারীর জন্য নির্ধারিত বেতন-ভাতা প্রদান করা যাবে।
৪. মন আকৃষ্টকরণ: ইসলামের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কোন অমুসলিমকে অথবা দ্বীন ও ইসলামের উপর অটল থাকার জন্য কোন নও মুসলমানকে যাকাতের অর্থ প্রদান করা। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ খাতটি পরিপূর্ণভাবে প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মের ব্যাপকতার ফলে কেবল নও মুসলিমকে দেয়ার বিধান রয়েছে। অমুসলিমকে যাকাত দেওয়ার বিধান রহিত হয়ে গেছে।
৫. দাস মুক্তি: মালিকের সাথে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে নিজেকে মুক্ত করে নেয়ার শর্তে চুক্তিবদ্ধ গোলাম বা দাসকে দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত করতে যাকাতের সম্পদ ব্যয় করা যাবে।
৬. ঋণ মুক্তি: যার সঞ্চিত সম্পদ দিয়ে ঋণ পরিশোধে অক্ষম এমন ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিকে ঋণমুক্ত করতে যাকাতের সম্পদ দিয়ে সহায়তা করা যাবে।
৭. আল্লাহর পথে: যুদ্ধ সামগ্রী শূন্য ইসলামী যোদ্ধা, যারা সাজ-সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় বাহনের অভাবে জিহাদে অংশ নিতে পারছেনা তাদেরকে যাকাত থেকে সাহায্য করা যাবে।
৮. মুসাফির: নিজ বাসস্থানে ধনী, কিন্তু সফরে এসে ঘটনাক্রমে পাথেয় শেষ হয়ে গেছে। চলার মত কোন ব্যবস্থা নেই। এ ধরনের মুসাফিরকে যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে।
অসহায় এতিম, গরীব, মিসকীন, আশ্রয়হীন, গরীব বাস্তুহারা, দরিদ্র শিক্ষার্থী প্রভৃতি দুঃখী জনগোষ্ঠি যাকাতের প্রকৃত হকদার। এদের মধ্যে গরীব আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশী অধিক হকদার। কর্মঠ গরীবদেরকে আত্ম-কর্মসংস্থানে সহায়তা করে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়। দ্বীনের প্রসারে ও দ্বীনী শিক্ষার বিস্তারে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়।
ইসলামী গবেষণা বিভাগ
বাগদাদী ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা- ৩৫০০, বাংলাদেশ।