ইস্তিঞ্জার সময় কী কী আদাবের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে, সে সম্পর্কে ফিকহের কিতাবসমূহে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ প্রবন্ধে সবগুলো আদাবের আলোচনা করা উদ্দেশ্য নয়। এখানে উদ্দেশ্য দুইটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

এক. কাযায়ে হাজতের (পেশাব-পায়খানা করার) পর পবিত্রতা অর্জন করার পদ্ধতি।

দুই. ইস্তিবরা অর্থাৎ পেশাব করার পর অবশিষ্ট পেশাব থেকে পরিপূর্ণভাবে পবিত্রতা অর্জন করার হুকুম ও তরীকা।

 

প্রথম মাসআলা : কাযায়ে হাজতের পর পবিত্রতা অর্জন করার পদ্ধতি

পেশাব-পায়খানার পর পবিত্রতা অর্জন করার তিনটি পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে।

 

প্রথম পদ্ধতি : শুধু ঢিলা ব্যবহার করা

কাযায়ে হাজতের পর শুধু ঢিলা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা জায়েয। এ বিষয়ে বহু হাদীস ও আছার বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি বর্ণনা উল্লেখ করা হল।

১. মুসলিম রাহ. বর্ণনা করেন, আব্দুর রহমান বিন ইয়াযীদ রাহ. বলেন, সালমান ফারসী রা.-কে বলা হল, তোমাদের নবী তোমাদের সবকিছু শিক্ষা দিয়েছেন; এমনকি শৌচাগার ব্যবহারের পদ্ধতিও! আব্দুর রহমান বিন ইয়াযীদ রাহ. বলেন, সালমান রা. বললেন, ‘হাঁ, অবশ্যই! তিনি আমাদেরকে নিষেধ করেছেন, আমরা যেন ডান হাত দ্বারা ইস্তিঞ্জা না করি, ইস্তিঞ্জার সময় তিন পাথরের কম ব্যবহার না করি এবং গোবর বা হাড্ডি দ্বারা ইস্তিঞ্জা না করি।’ বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

عَنْ عَبْدِ الرّحْمَنِ بْنِ يَزِيدَ، عَنْ سَلْمَانَ، قَالَ: قِيلَ لَهُ: قَدْ عَلّمَكُمْ نَبِيكُمْ كُلّ شَيْءٍ حَتى الْخِرَاءَةَ قَالَ: فَقَالَ: أَجَلْ لَقَدْ نَهَانَا أَنْ نَسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةَ لِغَائِطٍ، أَوْ بَوْلٍ، أَوْ أَنْ نَسْتَنْجِيَ بِالْيَمِينِ، أَوْ أَنْ نَسْتَنْجِيَ بِأَقَلّ مِنْ ثَلَاثَةِ أَحْجَارٍ، أَوْ أَنْ نَسْتَنْجِيَ بِرَجِيعٍ أَوْ بِعَظْمٍ.

-সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬২

আরো দেখুন : জামে তিরমিযী, হাদীস ১৬; সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস ৭; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৭১৯

২. আবু দাঊদ রাহ. বর্ণনা করেন, আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য পিতার মত, আমি তোমাদের শিক্ষা দিই। তোমাদের কেউ শৌচাগারে গেলে কিবলার দিকে মুখ করে বা পিঠ করে বসবে না, ডান হাত দিয়ে ইস্তিঞ্জা করবে না।’ (আবু হুরায়রা রা. বলেন,) এবং তিনি আমাদেরকে তিন ঢিলা ব্যবহার করার নির্দেশ দিতেন এবং গোবর ও হাড্ডি ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: إِنمَا أَنَا لَكُمْ بِمَنْزِلَةِ الْوَالِدِ، أُعَلِّمُكُمْ فَإِذَا أَتَى أَحَدُكُمُ الْغَائِطَ فَلَا يَسْتَقْبِلِ الْقِبْلَةَ، وَلَا يَسْتَدْبِرْهَا وَلَا يَسْتَطِبْ بِيَمِينِهِ، وَكَانَ يَأْمُرُ بِثَلَاثَةِ أَحْجَارٍ، وَيَنْهَى عَنِ الرَّوْثِ وَالرِّمَّةِ

-সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস ৮

আরো দেখুন : সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২, ৩১৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৩৬৯, ৭৪০৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৪৩১, ১৪৪০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ৮০

৩. আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ শৌচাগারে গেলে সে যেন তিনটা ঢিলা নিয়ে যায়। কারণ তিনটা ঢিলা পবিত্রতা অর্জন করার জন্য যথেষ্ট।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِذَا ذَهَبَ أَحَدُكُمْ إِلَى الْغَائِطِ، فَلْيَذْهَبْ مَعَهُ بِثَلَاثَةِ أَحْجَارٍ يَسْتَطِيبُ بِهِنَّ، فَإِنَّهَا تُجْزِئُ عَنْهُ.

-সুনানে আবু দাঊদ, হাদীস ৪০

আরো দেখুন : সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৪; সুনানে দারাকুতনী ১/৫৪; সুনানে বায়হাকী ১/১০৩

ইমাম দারাকুতনী রাহ. হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন,  إسناده صحيح  এর সনদ সহীহ।

৪. ইমাম বুখারী রাহ. বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৌচাগারে যাওয়ার সময় আমাকে তিনটি ঢিলা নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। আমি দুইটি পাথর পেয়েছি। আরেকটা পাথর তালাশ করেছি, কিন্তু পাইনি। তাই আরেকটা গোবর-টুকরা নিয়ে এসেছি। তিনি পাথরদুটো নিয়েছেন, আর গোবর-টুকরাটা ফেলে দিয়েছেন এবং বলেছেন, গোবর নাপাক।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

حَدّثَنَا أَبُو نُعَيْمٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا زُهَيْرٌ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، قَالَ: - لَيْسَ أَبُو عُبَيْدَةَ ذَكَرَهُ - وَلَكِنْ عَبْدُ الرّحْمَنِ بْنُ الأَسْوَدِ، عَنْ أَبِيهِ، أَنّهُ سَمِعَ عَبْدَ اللّهِ يَقُولُ: أَتَى النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ الغَائِطَ فَأَمَرَنِي أَنْ آتِيَهُ بِثَلاَثَةِ أَحْجَارٍ، فَوَجَدْتُ حَجَرَيْنِ، وَالتَمَسْتُ الثّالِثَ فَلَمْ أَجِدْهُ، فَأَخَذْتُ رَوْثَةً فَأَتَيْتُهُ بِهَا، فَأَخَذَ الحَجَرَيْنِ وَأَلْقَى الرّوْثَةَ وَقَالَ: هَذَا رِكْسٌ.

-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫৬ 

আরো দেখুন : সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪২; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৯৬৬

এসব হাদীস ছাড়াও আরও বহু হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাযায়ে হাজতের পর ঢিলা ব্যবহার করতেন এবং ঢিলা ব্যবহার করার নির্দেশ দিতেন। ইমাম নববী রাহ. বলেন-

قد تظاهرت الأحاديث الصحيحة بإجزاء الأحجار.

অর্থাৎ শুধু ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা যথেষ্ট- এ বিষয়টি বহু সহীহ হাদীসে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। -শরহুল মুহায্যাব ২/১০৩ 

ইমাম আবু বকর জাস্সাস রাহ. বলেন-

وقد تواترت الأخبار عن النبي صلى الله عليه و سلم بالاستنجاء بالأحجار قولا وفعلا.

ঢিলা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও কর্ম সম্বলিত হাদীস মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। -আহকামুল কুরআন ৩/২২৯

এসব হাদীসের একটিতেও এ কথা নেই যে, পানি না পাওয়া গেলে ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা যাবে, আর পানি পাওয়া গেলে ঢিলা ব্যবহার করা যাবে না। সুতরাং পানি পাওয়া যাক বা না যাক ইস্তিঞ্জার সময় শুধু ঢিলা ব্যবহার করা জায়েয।

 

সাহাবা-তাবেয়ীগণের আমল ও ফতোয়া

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্ত আমল ও বাণী মুতাবেক অনেক সাহাবা ও তাবেয়ীনের আমল ছিল। তাঁরা পানি থাক বা না থাক শুধু ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন। এ সংক্রান্ত কয়েকটি বর্ণনা লক্ষ করুন :

১. আবু বকর ইবনে আবী শায়বা রাহ. বর্ণনা করেন, হাম্মাম রাহ. বলেন, হুযায়ফা রা.-কে কাযায়ে হাজতের পর পানি ব্যবহার করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, তাহলে (পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করলে) তো আমার হাতে দুর্গন্ধ লেগে থাকবে।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

عَنْ هَمَّامٍ، عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ: سُئِلَ عَنِ الِاسْتِنْجَاءِ بِالْمَاءِ، فَقَالَ: إِذًا لَا تَزَالُ يَدَي فِي نَتِنٍ.

-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৬৪৬

২. আবু বকর ইবনে আবী শায়বা রাহ. বর্ণনা করেন, মুআযা রাহ. বলেন, আয়েশা রা. (মহিলাদের) বলেছেন, তোমরা আপন স্বামীদের নির্দেশ দাও, তারা যেন (ঢিলা ব্যবহারের পর) পানি দ্বারা পেশাব-পায়খানার বাকি চিহ্ন ধুয়ে ফেলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই করতেন। আমি তাদের (তোমাদের স্বামীদের) বলতে লজ্জাবোধ করছি।

عَنْ مُعَاذَةَ، عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: مُرْنَ أَزْوَاجَكُنَّ أَنْ يَغْسِلُوا أَثَرَ الْغَائِطِ وَالْبَوْلِ فَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَفْعَلُهُ وَأَنَا أَسْتَحْيِيهِمْ.

-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৬২৯

আরো দেখুন : জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৬; সুনানে বায়হাকী ১/১০৬; কিতাবুল ইলাল, ইবনে আবী হাতেম ১/১৭০ (৯১); আল-ইসতিযকার ১/২০৫

ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন, حديث حسن صحيح এটি সহীহ হাদীস। ইমাম নববী রাহ. বলেন,  حديث صحيح  এটি সহীহ হাদীস। -আল-মাজমূ শরহুল মুহায্যাব ২/১০১

এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, বহু সাহাবা পানি থাকা সত্ত্বেও ইস্তিঞ্জায় শুধু ঢিলা ব্যবহার করতেন, পানি ব্যবহার করতেন না। তাই আয়েশা রা. মহিলা সাহাবীদের মাধ্যমে তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, ঢিলা ব্যবহারের পর তারা যেন পানি ব্যবহার করেন।

৩. ইমাম মালেক রাহ. বর্ণনা করেন,  সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব (প্রখ্যাত তাবেয়ী) রাহ-কে কাযায়ে হাজতের পর পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে ইয়াহইয়া বিন সাঈদ রাহ. তাঁকে বলতে শুনেছেন যে, এটা তো মহিলাদের পবিত্রতা।

عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ، أَنَّهُ سَمِعَ سَعِيدَ بْنِ الْمُسَيَّبِ يُسْأَلُ عَنِ الْوُضُوءِ مِنَ الْغَائِطِ بِالْمَاءِ. فَقَالَ سَعِيدٌ: إِنَّمَا ذلِكَ وُضُوءُ النِّسَاءِ.

 -মুয়াত্তা মালেক ১/ ১১

আরো দেখুন : আল-ইস্তিযকার ১/২০৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস : ১৬৪৮

ইমাম আবু উমর ইবনে আব্দুল বার রাহ. বলেন,

هذا مذهب المهاجرين في الاستنجاء بالأحجار والاقتصار عليها، وابن المسيب من أبنائهم وفقهائهم.

পানি ব্যবহার না করে শুধু ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা মুহাজির সাহাবায়ে কেরামের মাযহাব। আর ইবনুল মুসায়্যিব রাহ. মুহাজিরগণের বংশধর এবং তাদের বংশের ফকীহ। (এ জন্য তিনি ঐ নিয়মের অনুসারী ছিলেন।) প্রাগুক্ত ১/২০৫

তিনি আরো বলেন,

وهو مذهب معروف عن المهاجرين.

অর্থাৎ পানি ব্যবহার না করে শুধু ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা মুহাজির সাহাবায়ে কেরামের  প্রসিদ্ধ মাহযাব। প্রাগুক্ত ১/১৪২

 ইমাম নববী রাহ. বলেন, (সার-সংক্ষেপ) কুবার আনসারী সাহাবীগণ ঢিলা ও পানি উভয়টা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন। তারা ব্যতীত অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম শুধু ঢিলা দ্বারা তহারাত অর্জন করতেন। -শরহুল মুহায্যাব ২/১০০

 

উম্মাহর ইমামগণের ফতোয়া

এ অনুযায়ীই উম্মাহর ইমামগণের ফতোয়া। ইবনে হাবিব মালেকী রাহ. ব্যতীত সকল ইমামের মত হল, পানি থাকুক বা নাই থাকুক সর্বাবস্থাই শুধু ঢিলা দ্বারা তহারাত হাসিল করা জায়েয। দেখুন : আলইসতিযকার ১/১৪৩; শরহে মুসলিম, নববী ১/১৩২ হাদীস নং ২৭০ ও ২৭১-এর ব্যাখ্যা; উমদাতুল কারী ২/৪৮০ হাদীস নং ২১৭-এর ব্যাখ্যা।

সুতরাং ‘পানি থাকা অবস্থায় কুলুখ নেওয়া শরী‘আতসম্মত নয়।’ বলে যে মত প্রচার করা হচ্ছে তা ইবনে হাবীব মালেকী রাহ.-এর শায ও উম্মাহ-বিচ্ছিন্ন মত, যা বহু সহীহ হাদীস বিরোধী। ইমাম নববী রাহ.-এর ভাষায়-

هذا خلاف ما عليه العلماء من السلف والخلف وخلاف ظواهر السنن المتظاهرة. والله أعلم.

এ মত সালাফ ও খালাফ সকল আলেমগণের মতের বিপরীত এবং বাহ্যিক বহু হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। -শরহে মুসলিম ১/১৩২    

 

দ্বিতীয় পদ্ধতি : পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা

কাযায়ে হাজতের পর পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করার বিষয়ে সাহাবা ও তাবেয়ীন-যুগে দু-একজনের ভিন্নমত থাকলেও পরবর্তীতে এ বিষয়ে কোনো ইমামের মতবিরোধ নেই যে, কাযায়ে হাজতের পর পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা যাবে; বরং উলামায়ে কেরাম বলেন, পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করাই উত্তম। তাই এ বিষয়ের দলীল পেশ করে আলোচনা দীর্ঘ করতে চাচ্ছি না।

 

তৃতীয় পদ্ধতি : ঢিলা ও পানি উভয়টা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা

কাযায়ে হাজতের পর ঢিলা ব্যবহার করে পানি দ্বারা ধোয়া কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফে সালেহীনের আমল দ্বারা প্রমাণিত। নিম্নে এ সম্পর্কে কয়েকটি দলীল পেশ করা হল-

১. আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فِیْهِ رِجَالٌ یُّحِبُّوْنَ اَنْ یَّتَطَهَّرُوْا  وَ اللهُ یُحِبُّ الْمُطَّهِّرِیْنَ .

তাতে (কোবায়) এমন লোক আছে, যারা অধিকতর পবিত্রতা পছন্দ করে। আর আল্লাহ তাআলা অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদের পছন্দ করেন। -সূরা তাওবা (৯) : ১০৮

এখানে আল্লাহ তাআলা কোবা এলাকার সাহাবীদের প্রশংসা করেছেন যে, তারা পাক-পবিত্রতা পছন্দ করেন। তাদের সে পবিত্রতা কী ছিল? এ সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা উদ্ধৃত করছি-

(ক) ইমাম বায়হাকী রাহ. বর্ণনা করেন, আবু আইয়ূব রা., জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. ও আনাস বিন মালেক রা.-এই আনসারী সাহাবীগণ বলেন,

فِیْهِ رِجَالٌ یُّحِبُّوْنَ اَنْ یَّتَطَهَّرُوْا  وَ اللهُ یُحِبُّ الْمُطَّهِّرِیْنَ.

আয়াতটি নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আনসারীদের দল! আল্লাহ তোমাদের পবিত্রতার উত্তম প্রসংশা করেছেন। তোমাদের ঐ পবিত্রতা কী? তারা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা নামাযের জন্য অযু করি এবং গোসল ফরয হলে গোসল করি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর সাথে কি আরো কোনো বিষয় আছে? তারা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আর কোনো বিষয় নেই, তবে শৌচাগার থেকে বের হলে আমাদের প্রত্যেকেই পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতে পছন্দ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটাই সেই পবিত্রতা (আল্লাহ যার কারণে তোমাদের প্রসংশা করেছেন)। সুতরাং এটাকে তোমরা গুরুত্বের সাথে ধরে রাখবে।

আরবী পাঠ-

عَنْ طَلْحَةَ بْنِ نَافِعٍ أَنَّهُ حَدَّثَهُ قَالَ: حَدَّثَنِي أَبُو أَيُّوبَ، وَجَابِرُ بْنُ عَبْدِ اللهِ، وَأَنَسُ بْنُ مَالِكٍ الْأَنْصَارِيُّونَ أَنَّ هَذِهِ الْآيَةَ لَمَّا نَزَلَتْ "فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا وَاللهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ" فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَا مَعْشَرَ الْأَنْصَارِ، إِنَّ اللهَ قَدْ أَثْنَى عَلَيْكُمْ خَيْرًا فِي الطُّهُورِ، فَمَا طُهُورُكُمْ هَذَا؟ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ نَتَوَضَّأُ لِلصَّلَاةِ وَنَغْتَسِلُ مِنَ الْجَنَابَةِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: "فَهَلْ مَعَ ذَلِكَ غَيْرُهُ. قَالُوا: لَا غَيْرَ أَنَّ أَحَدَنَا إِذَا خَرَجَ مِنَ الْغَائِطِ أَحَبَّ أَنْ يسْتَنْجِيَ بِالْمَاءِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : هُوَ ذَاكَ فَعَلَيْكُمُوهُ.

-সুনানে কুবরা, বায়হাকী ১/১০৫

আরো দেখুন- মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৫৫৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৫৫

ইমাম নববী রাহ. হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন-

إسناد هذه الرواية و رواية ابن ماجه وغيره إسناد صحيح إلا أن فيه عتبة بن أبي حكيم، وقد اختلفوا في توثيقه, فوثقه الجمهور, ولم يبين من ضعفه سبب ضعفه، والجرح لايقبل إلا مفسرا، فيظهر الاحتجاج بهذه الرواية.

এই বর্ণনার সনদ সহীহ। এতে উতবা বিন আবী হাকীম নামে একজন রাবী আছেন। তার তাওছীকের বিষয়ে ইখতিলাফ আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুহাদ্দিসগণ তার তাওছীক (বর্ণনায় নির্ভরযোগ্য হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান) করেছেন। যারা তাযঈফ (বর্ণনায় দুর্বল হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান) করেছেন তারা এর কারণ উল্লেখ করেননি। আর কারণ উল্লেখ না করলে র্জহ (দোষ-বর্ণনা) গ্রহণযোগ্য হয় না। সুতরাং এই বর্ণনা দলীলযোগ্য। -শরহুল মুহায্যাব ২/৯৯

হাকেম রাহ. হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন,

هذا حديث كبير صحيح في كتاب الطهارة.

এই হাদীসটি সহীহ এবং তহারাতের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাদীস। ইমাম যাহাবী রাহ. হাকেম রাহ.-এর সমর্থন করেছেন। দেখুন- মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৫৫৪

সুনানে ইবনে মাজাহ্র সনদ সম্পর্কে হাফেয যায়লায়ী রাহ. ও ইমাম ইবনুল হুমাম রাহ.বলেন, وسنده حسن. এর সনদ হাসান। -নসবুর রায়াহ ১/২১৯; ফতহুল কাদীর ১/২১৬

লক্ষ করুন, যে পবিত্রতার জন্য আল্লাহ তাআলা কোবার সাহাবীগণের প্রশংসা করেছেন তা হল, তারা শৌচাগার থেকে বের হয়ে পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন। বলাই বাহুল্য যে, পেশাব-পায়খানার পর ঢিলা বা পানি ব্যবহার না করে কেউ শৌচাগার থেকে বের হয় না। তাই ইমাম নববী রাহ. বলেন-

قولهم "إذا خرج أحدنا من الغائط أحب أن يستنجي بالماء", فهذا يدل على أن استنجاءهم بالماء كان بعد خروجهم من الخلاء. والعادة جارية بأنه لايخرج من الخلاء إلا بعد التمسح بماء أو حجر.

কাবাবাসীদের বক্তব্য- ‘আমাদের প্রত্যেকেই শৌচাগার থেকে বের হলে পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতে পসন্দ করে।’- প্রমাণ করে যে, তারা শৌচাগার থেকে বের হয়ে পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন। আর মানুষের অভ্যাস হল, পেশাব-পায়খানার পর ঢিলা বা পানি ব্যবহার না করে কেউ শৌচাগার থেকে বের হয় না। -শরহুল মুহায্যাব ২/১০০

মোটকথা এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, কোবাবাসী সাহাবায়ে কেরাম শৌচাগারে ঢিলা ব্যবহার করে বের হয়ে অন্যত্র পানি দ্বারা তহারাত অর্জন করতেন। তাই ইমাম বায়হাকী রাহ. এ হাদীসকে ঢিলা ও পানি, উভয়টা দ্বারা ইস্তিঞ্জা জায়েয হওয়ার দলীল দিয়েছেন এবং এই হাদীসের শিরোনাম দিয়েছেন-

باب الجمع في الاستنجاء بين المسح بالأحجار والغسل بالماء

(অধ্যায় : ইস্তিঞ্জার সময় ঢিলা দ্বারা মুছে পানি দ্বারা ধৌত করা।) -সুনানে কুবরা ১/১০৫

তা ছাড়া কুবার সাহাবায়ে কেরাম যে ঢিলা ব্যবহারের পর পানি ব্যবহার করতেন একটি হাদীসে তা ষ্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, কোবাবাসীদের সম্পর্কে

فِیْهِ رِجَالٌ یُّحِبُّوْنَ اَنْ یَّتَطَهَّرُوْا  وَ اللهُ یُحِبُّ الْمُطَّهِّرِیْنَ.

(এখানে এমন লোক আছে, যারা অধিক পাক-পবিত্রতা পছন্দ করে। আর আল্লাহ তাআলা পাক-পবিত্র লোকদের পছন্দ করেন।) আয়াতটি নাযিল হয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তারা বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা ঢিলা ব্যবহারের পর পানি দ্বারা ধৌত করি।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

حدثنا عبد الله بن شبيب, ثنا أحمد بن محمد بن عبد العزيز,قال: وجدت في كتابي أبي عن الزهري, عن عبيد الله بن عبد الله, عن ابن عباس قال: نزلت هذه اللآية في أهل قباء فِيْهِ رِجَالٌ يُحِّبُوْنَ أَنْ يَتَطَهَّرُوْا, وَاللُه يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِيْنَ. فسألهم رسول الله صلى الله عليه و سلم فقالوا: إنا نتبع الحجارة الماء.

-মুসনাদে বায্যার : নসবুর বায়াহ ১/২১৮; আল-বদরুল মুনীর ২/৩৭৪

এ হাদীস দ্বারাও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায় যে, কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা কোবাবাসী সাহাবাদের যে পবিত্রতার প্রশংসা করেছেন তা হল, তাঁরা ঢিলা ব্যবহারের পর পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন। হাঁ, হাদীসটির সনদে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযীয নামে একজন রাবী আছেন। তিনি যয়ীফ (দুর্বল) রাবী, তাই সনদটি যয়ীফ। তবে উপরের সহীহ হাদীসে এ হাদীসের সমর্থন পাওয়া যায়। তাই এর সনদ যয়ীফ হলেও মূল বিষয়টি প্রমাণিত।

কাযী ইয়ায রাহ. বলেন-

إن الاستنجاء بالماء أفضل من الاقتصار على الأحجار، وهو مذهب الأنصار، وبه أثنى الله عليهم بالطهارة وأنه يحب المتطهرين.

শুধু ঢিলা ব্যবহারে সীমাবদ্ধ না থেকে ঢিলার পর পানি ব্যবহার করা উত্তম। এটাই আনসারী সাহাবীগণের মাযহাব। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা কুবাবাসীর প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন, তিনি অধিকতর পবিত্রতা অর্জনকারীর লোকদের পসন্দ করেন। -ইকমালুল মু‘লিম ২/৭৮

সৌদি আরবের প্রসিদ্ধ আলেম মসজিদে নববীর ওয়ায়েয শায়খ আবু বকর জাবের জাযায়েরী রাহ. বলেন,

كانوا يجمعون في الاستنجاء بين الحجارة والماء. فأثنى الله تعالى عليهم بذلك.

কুবাবাসীগণ ঢিলা ও পানি উভয়টা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন। তাই আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেছেন। -আইসারুত তাফাসীর ১/৭০৬

বাকি রইল অধিকাংশ বর্ণনায় ঢিলা ব্যবহারের কথা স্পষ্ট শব্দে আসেনি। তো এর কারণ হল, আল্লাহ তাআলা কোবাবাসীর এমন বিষয়ের প্রশংসা করেছেন, যাতে তাদের স্বাতন্ত্র্য আছে, যে বৈশিষ্ট্য অন্যদের ছিল না। তখনকার যুগে আরবের সকলেই ঢিলা ব্যবহার করত। ঢিলা নেওয়ার ক্ষেত্রে কুবাবাসীর বিশেষ কোনো বিশেষত্ব নেই। এজন্য সাহাবায়ে কেরাম তা বর্ণনা করার প্রয়োজন মনে করেননি। ইমাম নববী রাহ. বলেন-

إن الاستنجاء بالحجر كان معلوما عندهم، يفعله جميعهم. وأما الاستنجاء بالماء فهو الذي انفردوا به، فلهذا ذكر ولم يذكر الحجر، لأنه مشترك بينهم وبين غيرهم، ولكونه معلوما. فإن المقصود بيان فضلهم الذي أثني الله تعالى عليهم بسببه.

 ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করার বিষয়টি তাদের সকলের জানা ছিল। তারা সকলেই ঢিলা ব্যবহার করতেন। আর (ঢিলার পর) পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা, এটা শুধু কুবার সাহাবীদের একক বৈশিষ্ট্য। তাই বর্ণনায় শুধু পানির উল্লেখ করা হয়েছে, ঢিলার উল্লেখ করা হয়নি। কারণ এখানে উদ্দেশ্য তাদের ঐ বিশেষত্বের বিবরণ দেওয়া, যার কারণে আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেছেন। আর ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করার ক্ষেত্রে তারা এবং অন্যরা সমান। তাছাড়া তারা যে ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন, তা তো সকলেরই জানা ছিল। -আল-মাজমূ শরহুল মুহায্যাব ২/১০০ 

২. ইবনুল মুনযির রাহ. বর্ণনা করেন, আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বাগানে দাখিল হলেন এবং হাজত সারলেন। তখন আমাদের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ লোকটি পানির পাত্র নিয়ে নবীজীর কাছে আসল। তিনি পাত্রটা নিলেন এবং পানি ব্যবহার করে ফিরে এলেন।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

عَنْ أَنَسٍ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَخَلَ حَائِطًا، وَقَضَى حَاجَتَهُ، فَأَتَاهُ رَجُلٌ مِنْ أَصْغَرِنَا بِدَلْوِهِ أَوْ مَيْضَاةٍ، فَأَخَذَهَا، ثُمَّ جَاءَ وَقَدِ اسْتَنْجَا بِالْمَاءِ.

-আলআওসাত, ১/৩৬৫ হাদীস ৩২০

আরো দেখুন- সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭০

স্পষ্ট কথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাযায়ে হাজত করার পর তাঁকে পানি দেওয়ার জন্য ঐ সাহাবী পানি নিয়ে বাগানের ভেতর প্রবেশ করেননি; বরং পানি নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজত সেরে বাগান থেকে বের হলে তাঁকে পানির পাত্রটি দিয়েছেন। আর তিনি এ পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করেছেন। বলাই বাহুল্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঢিলা দ্বারা তহারাত অর্জন না করে বাগান থেকে বের হননি। বরং ঢিলা নেওয়ার পরই তিনি ঐ সাহাবীর কাছে এসেছেন। তখন তাঁকে পানি দেওয়া হয়েছে, তিনি সে পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করেছেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঢিলা ও পানি উভয়টা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করেছেন। তাই  ইমাম নববী রাহ. এ হাদীস এবং সামনে ৩নং দলীলের হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন-

أما فقه هذه الأحاديث، ... وفيها جواز الاستنجاء بالماء واستحبابه ورجحانه على الاقتصار على الحجر.

এসব হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়... পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা জায়েয। বরং শুধু ঢিলার উপর সীমিত না থেকে ঢিলা নেওয়ার পর পানি ব্যবহার করা মুস্তাহাব ও অগ্রগণ্য। -শরহে মুসলিম ১/১৩২

কাযী ইয়ায রাহ.ও এসব হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন-

وجاء في هذه استنجاء النبي صلى الله عليه و سلم بالماء. وأحاديثه في ذلك كثيرة صحيحة، وكان النبي صلى الله عليه و سلم يأتي من الأمور أفضلها ومعاليها، فدل أن الاستنجاء بالماء أفضل من الاقتصار على الأحجار، وهو مذهب الأنصار، وبه أثنى الله عليهم بالطهارة وأنه يحب المتطهرين، ومن ذهب إلى الجمع بينه وبين الأحجار جاء بأتم الأمور.

এসব হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পানি ব্যবহারের কথা এসেছে। আর এ বিষয়ে বহু সহীহ হাদীস রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক বিষয়ের শ্রেষ্ঠতম ও উচ্চতম পন্থা অবলন্বন করতেন। অতএব তাঁর আমল প্রমাণ করে শুধু ঢিলা ব্যবহারে সীমাবদ্ধ না থেকে ঢিলার পর পানি ব্যবহার করা উত্তম। আর এ কারণেই আল্লাহ তাআলা কোবাবাসীর প্রশংসা করেছেন এবং বলেছেন, তিনি অধিকতর পবিত্রতা অর্জনকারীদের পসন্দ করেন। অতএব যে ঢিলা ও পানি উভয়টা ব্যবহার করল সে পরিপূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করল। -ইকমালুল মু‘লিম ২/৭৮

৩. (ক) ইমাম বুখারী রাহ. বর্ণনা করেন, আনাস বিন মালেক রা. বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কাযায়ে হাজতের জন্য যেতেন তখন আমি এবং এক যুবক তাঁর সাথে যেতাম। আমাদের সাথে একটি লাঠি এবং একটি পানির পাত্র থাকত। তিনি কাযায়ে হাজত হতে ফারেগ হলে তাঁকে পানির পাত্রটি দিতাম।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

عَنْ عَطَاءِ بْنِ أَبِي مَيْمُونَةَ، قَالَ: سَمِعْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ، قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا خَرَجَ لِحَاجَتِهِ، تَبِعْتُهُ أَنَا وَغُلاَمٌ وَمَعَنَا عُكَّازَةٌ أَوْ عَصًا أَوْ عَنَزَةٌ، وَمَعَنَا إِدَاوَةٌ، فَإِذَا فَرَغَ مِنْ حَاجَتِهِ نَاوَلْنَاهُ الإِدَاوَةَ.

-সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০০, ২১৭ 

(খ) ইমাম বুখারী রাহ. বর্ণনা করেন, আনাস বিন মালেক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৌচাগারে দাখেল হতেন। তখন আমি এবং এক যুবক একটি পানির পাত্র এবং একটি লাঠি নিয়ে যেতাম। তিনি পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

عَنْ عَطَاءِ بْنِ أَبِي مَيْمُونَةَ، سَمِعَ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ، يَقُولُ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدْخُلُ الخَلاَءَ، فَأَحْمِلُ أَنَا وَغُلاَمٌ إِدَاوَةً مِنْ مَاءٍ وَعَنَزَةً، يَسْتَنْجِي بِالْمَاءِ.

-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২

আরো দেখুন- সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭১

এ হাদীসের প্রথম বর্ণনা থেকে বুঝে আসে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাযায়ে হাজতের জন্য শৌচাগারে দাখেল হলে আনাস রা. ও আরেক যুবক সাহাবী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তিনি কাযায়ে হাজত থেকে ফারেগ হয়ে তাদের কাছে আসলে তারা পানির পাত্রটি এগিয়ে দিতেন। আর দ্বিতীয় বর্ণনা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করতেন। বলাই বাহুল্য যে, তিনি ঢিলা ব্যবহার না করে তাদের কাছে আসতেন না। সুতরাং এ হাদীসও প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঢিলা নেওয়ার পর পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন। সহীহ বুখারীর ২১৭নং বর্ণনায় এ হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেয বদরুদ্দীন আইনী রাহ. বলেন-

بيان استنباط الأحكام :

الأول : أن فيه استحباب التباعد من الناس لقضاء الحاجة. الثاني : أن فيه الاستتار عن أعين الناس. الثالث : أن فيه جواز استخدام الصغار. الرابع : أن فيه جواز الاستنجاء بالماء واستحبابه ورجحانه على الاقتصار على الحجر.

এ হাদীস থেকে আহরিত বিধান : ১. মানুষ থেকে দূরে গিয়ে কাযায়ে হাজত করা মুস্তাহাব। ২. লোকচক্ষুর আড়ালে কাযায়ে হাজত করা। ৩. ছোটদের থেকে খেদমত নেয়া জায়েয। ৪. পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা জায়েয; বরং শুধু ঢিলার উপর সীমিত না থেকে ঢিলা নেওয়ার পর পানি ব্যবহার করা মুস্তাহাব ও অগ্রগণ্য। -উমদাতুল কারী ২/৪৮০

উপরের হাদীসের আলোচনায় দেখেছি যে, কাযী ইয়ায রাহ. এবং ইমাম নববী রাহ.ও হাদীসটি থেকে এ বিধান আহরণ করেছেন।

৪. (ক) ইবনে আবী শায়বা রাহ. বর্ণনা করেন, ইবনে সীরীন রাহ. বলেন, আয়েশা রা. মহিলাদের বলতেন, তোমরা আপন স্বামীদের বল, তারা যেন শৌচাগার থেকে বের হলে পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করে।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

حَدَّثَنَا هُشَيْمٌ، قَالَ أنا مَنْصُورٌ، عَنِ ابْنِ سِيرِينَ أَنَّ عَائِشَةَ، كَانَتْ تَقُولُ لِلنِّسَاءِ: مُرْنَ أَزْوَاجَكُنَّ أَنْ يَسْتَنْجُوا بِالْمَاءِ إِذَا خَرَجُوا مِنَ الْغَائِطِ.

-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৬৩০

(খ) ইবনে আবী শায়বা রাহ. আরো বর্ণনা করেন, মুআযা রাহ. বলেন, আয়েশা রা. (মহিলাদের) বলেছেন,  তোমরা নিজেদের স্বামীদের নির্দেশ দাও, তারা যেন পেশাব-পায়খানার চিহ্ন ধুয়ে ফেলে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনি করতেন। তাদেরকে (তোমাদের স্বামীদের) বলতে আমার লজ্জা লাগে।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحِيمِ بْنُ سُلَيْمَانَ، عَنْ سَعِيدٍ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ مُعَاذَةَ، عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: مُرْنَ أَزْوَاجَكُنَّ أَنْ يَغْسِلُوا أَثَرَ الْغَائِطِ وَالْبَوْلِ فَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَفْعَلُهُ وَأَنَا أَسْتَحْيِيهِمْ.

-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৬২৯

আরো দেখুন : জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৬; সুনানে বায়হাকী ১/১০৬; কিতাবুল ইলাল, ইবনে আবী হাতেম ১/১৭০ (৯১); আল-ইস্তিযকার ১/২০৫

ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন, حديث حسن صحيح এ হাদীসটি সহীহ । ইমাম নববী রাহ. বলেন,  حديث صحيح  হাদীসটি সহীহ । -আলমাজমূ শরহুল মুহায্যাব ২/১০১

‘ক’ নং বর্ণনায় পাওয়া যাচ্ছে যে, আয়েশা রা. নির্দেশ দিচ্ছেন, ঢিলা ব্যবহারের পর নাপাকির যে চিহ্ন বাকি থাকে তা যেন পানি দ্বারা ধুয়ে ফেলা হয়। ‘খ’ নং বর্ণনায় আরো বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনি করতেন।

সুতরাং এ হাদীস থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঢিলা নেওয়ার পর পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন।

আহমদ বিন হাম্বল রাহ বলেন-

إن جمعهما فهو أحب إلي

ঢিলা ও পানি উভয়টা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা আমার নিকট উত্তম। এরপর তিনি দলিল হিসেবে আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত এই হাদীসটি পেশ করেন। -আলমুগনী ১/১৯৪

৫. ইবনে আবী শায়বা রাহ. বর্ণনা করেন, আলী রা. বলেছেন, তোমাদের পূর্বের লোকেরা পশুর মত (শক্ত) মল ত্যাগ করত। আর তোমরা পাখির মত (নরম) মল ত্যাগ কর। তাই তোমরা ঢিলা ব্যবহারের পর পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করবে।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

قَالَ عَلِيٌّ: إِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَبْعَرُونَ بَعْرًا وَإِنَّكُمْ تَثْلِطُونَ ثَلْطًا فَأَتْبِعُوا الْحِجَارَةَ بِالْمَاءِ.

 -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৬৪৫  

আরো দেখুন : সুনানে কুবরা, বায়হাকী ১/১০৬, হাদীস ৫১৭; মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক : নসবুর রায়াহ ১/২১৯

হাফেয যায়লায়ী রাহ. এ আছার সম্পর্কে বলেন, أثر جيد এটি জায়্যিদ (হাসানের স্তরের) বর্ণনা। ইবনে হাজার রাহ. বলেন-

أخرجه ابن أبي شيبة و البيهقي بإسناد حسن.

ইবনে আবী শায়বা ও বায়হাকী হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন। ইউসুফ বিন্নূরী রাহ. বলেন-  هو أثر جيد এটি জায়্যিদ বর্ণনা। -নসবুর রায়াহ ১/২১৯; আদ্ দিরায়াহ ১/৭৯; মাআরিফুস সুনান ১/১৩৩

 

হাদীস ও ফিকহের ইমামগণের ফতোয়া

এসব দলীলের প্রতি লক্ষ করে উম্মাহর ইমামগণের ফতোয়া হল ইস্তিঞ্জায় ঢিলা ও পানি উভয়টা ব্যবহার করা শুধু জায়েয নয়; বরং উত্তম। ইমাম নববী রাহ. বলেন-

فالذي عليه الجماهير من السلف والخلف وأجمع عليه أهل الفتوى من أئمة الأمصار أن الأفضل أن يجمع بين الحجر والماء، فيستعمل الحجر أولا لتخف النجاسة، وتقل مباشرتها بيده، ثم يستعمل الماء.

সালাফে সালেহীন ও তাদের উত্তরসূরীগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের মত এবং মুসলিমবিশ্বের সকল ইমামগণের ইজমা হল, পানি ও ঢিলা উভয়টা ব্যবহার করা উত্তম। প্রথমে পানি ব্যবহার করবে, যাতে নাপাকি কমে যায় এবং হাতে নাপাকির মিশ্রণ কম হয়। এরপর পানি ব্যবহার করবে। -শরহে মুসলিম ১/১৩২

হাফেয বদরুদ্দীন আইনী রাহ.ও একই বিবরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন-

ومذهب جمهور السلف و الخلف والذي أجمع عليه أهل الفتوى من أئمة الأمصار أن الأفضل أن يجمع بين الحجر والماء، فيقدم الحجر أولا ثم يستعمل الماء فتخف النجاسة، وتقل مباشرتها بيده، ويكون أبلغ في النظافة.

সালাফে সালেহীন ও তাদের উত্তরসূরীগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের মত এবং মুসলিমবিশ্বের সকল ইমামগণের ইজমা হল, পানি ও ঢিলা উভয়টা ব্যবহার করা উত্তম। প্রথমে ঢিলা ব্যবহার করবে। এরপর পানি ব্যবহার করবে। যাতে নাপাকি কমে যায় এবং হাতে নাপাকির মিশ্রণ কম হয়। তাহলে পবিত্রতার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে। -উমদাতুল কারী ২/৩০৪ হাদীস ১৫০-এর ব্যাখ্যা।

 

দ্বিতীয় মাসআলা : ইস্তিবরা

ইস্তিবরার পরিচয়, হুকুম ও তরীকা আলোচনা করার আগে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তা হল, ইসলামে পবিত্রতার গুরুত্ব অনেক। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, والله يحب المطهرين আল্লাহ তাআলা পাক-পবিত্র লোকদের পছন্দ করেন। [সূরা তাওবা (৯) : ১০৮] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, الطهور شطر الإيمان পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৩) বিশেষ করে পেশাব থেকে পবিত্রতার বিষয়ে হাদীস শরীফে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

إن عامة عذاب القبر في البول، فتنزهوا من البول.

কবরের অধিকাংশ আযাব হবে পেশাবের কারণে। তাই পেশাব থেকে বেঁচে থাক। -মুসনাদে আব্দ ইবনে হুমায়দ, হাদীস. ৬৪২; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৬৫৪        

ইমাম নববী রাহ. বলেন, حديث حسن হাদীসটি হাসান। [খুলাসাতুল আহকাম ১/১৭৪ (৪০৩)]। হাফেয ইবনে হাজার রাহ. বলেন,  إسناده حسن  এর সনদ হাসান। -আত-তালখীসুল হাবীর ১/১১৩ (১৩৫)

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

اتقوا البول، فإنه أول ما يحاسب به العبد في القبر.

পেশাব থেকে বেঁচে থাক। কারণ কবরে বান্দাকে সর্বপ্রথম পেশাব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। -মুজামে কাবীর, তবারানী ৮/১৫৭

হায়সামী রাহ. বলেন,  رجاله موثقون. এর রাবীগণ সিকাহ। -মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১/২০৯   আল্লামা মুনাবী রাহ. বলেন,

مز المصنف لحسنه، وهو أعلى من ذلك.

সুয়ূতী রাহ. হাদীসটি হাসান হওয়ার আলামত দিয়েছেন। বাস্তবে হাদীসটির মান হাসানেরও ঊর্ধ্বে। -ফয়যুল কাদীর ১/১৩০ (১৩১)

সুতরাং পেশাব থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা শরীয়তে কাম্য। যুগের পরিবর্তনের কারণে মানুষের দৈহিক অবস্থা পরিবর্তন হয়। দেখুন না, মুহাজির সাহাবীগণ শুধু ঢিলা দ্বারা ইস্তিঞ্জা করতেন। আলী রা. মুহাজির সাহাবীদের অন্যতম। তিনি মুহাজিরদের তুলনায় তাবেয়ীদের দৈহিক অবস্থার দুর্বলতা দেখে তাবেয়ীদের লক্ষ করে বললেন, তোমাদের পূর্বের লোকেরা পশুর মত (শক্ত) মল ত্যাগ করত। আর তোমরা পাখির মত (নরম) মল ত্যাগ কর। তাই তোমরা ঢিলা ব্যবহারের পর পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা কর। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৬৩৪

আলী রা. যেমন তাবেয়ীদের অবস্থার প্রতি লক্ষ করে তাদের বললেন, তোমাদের জন্য শুধু ঢিলা ব্যবহার করলে চলবে না; বরং ঢিলার পর পানিও ব্যবহার করতে হবে, তদ্রূপ উম্মাহর ইমামগণ উম্মতের অবস্থার প্রতি লক্ষ করে দেখলেন যে, পেশাবের পর যদি উহ-আহ, উঠা-বসা, হাঁটা-হাঁটি ইত্যাদি না করে তাহলে অনেকের পেশাব থেকে পূর্ণরূপে পবিত্রতা অর্জন হয় না। তাই উম্মাহর ইমামগণ নায়েবে নবী হিসেবে তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, পেশাবের গতি বন্ধ হওয়ার পর উহ-আহ, উঠা-বসা, হাঁটা-হাঁটি ইত্যাদি করা অথবা কিছুক্ষণ জায়গায় বসে থাকা জরুরি, যেন পরে পেশাব ঝরে শরীর বা কাপড় নাপাক হওয়ার আশঙ্কা না থাকে।

হাঁটা-হাঁটি, উঠা-বসা, উহ-আহ এখানে মাকসাদ নয়। উদ্দেশ্য হল অবশিষ্ট পেশাব বের করে পূর্ণরূপে পবিত্রতা অর্জন করা।  এগুলো পবিত্রতার পরিপূরক। তাই এসব কাজ পবিত্রতারই অংশ। সুতরাং এসবের জন্য ভিন্ন দলীলের প্রয়োজন হয় না। বরং এর দলীল হিসেবে পবিত্রতার গুরুত্ব এবং বিশেষ করে পেশাব থেকে বেঁচে থাকার তাকিদ সম্পর্কে উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহই যথেষ্ট। তা সত্ত্বেও এ সম্পর্কে আলাদা দলীলও আছে। আমরা এবার সে দলীলগুলো লক্ষ করি।

 

ইস্তিবরার পরিচয় ও হুকুম

ইমাম নাসায়ী রাহ. বর্ণনা করেন, ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার অথবা মক্কার এক বাগানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তখন দুই ব্যক্তির আওয়ায শুনতে পেলেন যাদেরকে কবরে আযাব দেওয়া হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাদেরকে আযাব দেওয়া হচ্ছে। (এমন) বড় কোনো কারণে আযাব দেওয়া হচ্ছে না (যা থেকে বাঁচা খুব কঠিন)। এরপর বললেন, হাঁ, (তবে বড় গুনাহ)। তাদের একজন পেশাব থেকে ইস্তিবরা করত না, আরেকজন পরনিন্দা করত।

বর্ণনাটির আরবী পাঠ-

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: مَرَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِحَائِطٍ مِنْ حِيطَانِ مَكَّةَ أَوِ الْمَدِينَةِ سَمِعَ صَوْتَ إِنْسَانَيْنِ يُعَذَّبَانِ فِي قُبُورِهِمَا، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ، ثُمَّ قَالَ: بَلَى، كَانَ أَحَدُهُمَا لَا يَسْتَبْرِئُ مِنْ بَوْلِهِ، وَكَانَ الْآخَرُ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ...

-সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২০৬৮, ২০৬৯

আরো দেখুন : মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১২১৬৪ শরহু মুশকিলিল আসার, তহাবী, হাদীস ২১৩

হাদীসটি কয়েকটি শব্দে বর্ণিত হয়েছে : يستبرئ -এর স্থলে সহীহ মুসলিমের এক বর্ণনায় يستتر এবং অন্য বর্ণনায়  يستنزه শব্দ এসেছে। ইমাম নববী রাহ. বলেন, হাদীসটি তিন শব্দে বর্ণিত হয়েছে : يستتر - يستنزه  ও  يستبرئ। এরপর তিনি বলেন,

وهذه الثالثة في البخاري وغيره، وكلها صحيحة.

এ তৃতীয় শব্দটি (يستبرئ) সহীহ বুখারী ও হাদীসের অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। এই সব বর্ণনাই সঠিক। হাফেয বদরুদ্দীন আইনী রাহ. সুনানে আবু দাউদের ভষ্যগ্রন্থে এ শব্দতিনটি সম্পর্কে বলেন, يستبرئ শব্দটি সহীহ বুখারী ও হাদীসের অন্যান্য কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। এ সব বর্ণনাই সঠিক। সহীহ বুখারীর ২১৬ নং হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ও হাফেয আইনী রাহ. বলেন, ইবনে আসাকিরের বর্ণনা অনুযায়ী সহীহ বুখারীর এই হাদীসের শব্দ হল يستبرئ। হাফেয মুগলাতাঈ রাহ. বলেন, وفي لفظ للبخاري لا يستبرئ  সহীহ বুখারীর এক বর্ণনা হল لا يستبرئ  । হাফেয ইবনুল মুলাক্কিন রাহ.ও বলেন,... সহীহ বুখারীর এক বর্ণনা হল لايستبرئ। দেখুন- শরহে মুসলিম ১/১৪১; শরহু আবী দাঊদ, আইনী; ১/৮৩; ফতহুল বারী ১/৩৭৯; উমদাতুল কারী ২/৪৭১; শরহে ইবনে মাজাহ, মুগলাতাঈ ১/১৫৫; আলবদরুল মুনীর ২/৩৪৬

মোটকথা, لايستبرئ শব্দে হাদীসটি সহীহ। সহীহ বুখারীসহ অন্যান্য বহু হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

 لايستبرئ -এর অর্থ হল সে ইস্তিবরা করত না। ইস্তিবরার অর্থ হল স্বাভাবিক পেশাব বের হওয়ার পর অবশিষ্ট পেশাব বের করা।

ইবনুল আছীর রাহ. বলেন,

وهو أن يستفرغ بقية البول، وينقي موضعه ومجراه، حتى يبرئهما منه.

ইস্তিবরা হল পেশাব করার পর অবশিষ্ট পেশাব বের করা। পেশাবের স্থান ও মুত্রনাল পেশাব থেকে পরিষ্কার করা। -আননিহায়া ফী গরীবিল হাদীসি ওয়াল আছার ১/১১২

ইমামুল লুগাহ ইবনে মানযূর রাহ.ও এভাবেই ইস্তিবরার অর্থ করেছেন। দেখুন : লিসানুল আরব ১/৩৬৭

ইবনে বাত্তাল রাহ. সহীহ বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থে  لايستبرئ (একজন পেশাব থেকে ইস্তিবরা করত না) এর ব্যাখ্যায় বলেন-

لا يستفرغ البول جهده بعد فراغه منه، فيخرج منه بعد وضوءه، فيصلى غير مطهر.

অর্থাৎ, তাদের একজন পেশাব করার পর চেষ্টা করে অবশিষ্ট পেশাব বের করত না। ফলে অযু করার পর তা বের হত। তখন সে অপবিত্র অবস্থায় সালাত আদায় করত। -শরহুল বুখারী ১/৩২৫ (২১৬ নং হাদীসের ব্যাখ্যা)

 সহীহ বুখারীর আরেক ভাষ্যকার আল্লামা কিরমানী রাহ. لايستبرئ (একজন পেশাব থেকে ইস্তিবরা করত না) এর ব্যাখ্যায় বলেন,

لا يستفرغ البول جهده بعد فراغه منه، فيخرج منه بعد وضوءه.

পেশাব করার পর চেষ্টা করে অবশিষ্ট পেশাব বের করত না। ফলে অযু করার পর তা বের হত। -আলকাওয়াকিবুদ্ দারারী ৩/৬৬ (২১৬ নং হাদীসের ব্যাখ্যা)

আলোচ্য হাদীসে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তিকে কবরে এই জন্য শাস্তি দেওয়া হচ্ছে যে, সে ইস্তিবরা করত না। অর্থাৎ সে পেশাব করার পর যে পেশাব বাকি থাকে তা বের করত না। সুতরাং এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় ইস্তিবরা অত্যন্ত জরুরি। তাই ইমাম নববী রাহ. সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে এ হাদীসের শিরোনাম দিয়েছেন-

باب الدليل على نجاسة البول ووجوب الاستبراء منه

অধ্যায় : পেশাব নাপাক এবং পেশাব থেকে ইস্তিবরা করা ওয়াজিব। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. বলেন-

قوله صلى الله عليه وسلم: أما أحدهما فكان لايستبرئ من البول الحديث، أقول: فيه أن الاستبراء واجب.

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইস্তিবরা করা ওয়াজিব। - হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/৩০৮

মোটকথা, এ হাদীস প্রমাণ করে ইস্তিবরা (বাকি পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন) করা জরুরি। অন্যথায় পরে পেশাব ঝরে অযু নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং শরীর ও কাপড় নাপাক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

 

ইস্তিবরার তরীকা

উল্লিখিত হাদীস থেকে প্রমাণিত হল যে, ইস্তিবরা তথা স্বাভাবাকি পেশাবের পর অবশিষ্ট পেশাব বের  ফোটা পেশাব বের করা জরুরি। তবে ইস্তিবরার জন্য কোন্ পন্থা অবলম্বন করা হবে, সে সম্পর্কে হাদীসটিতে কিছু বলা হয়নি। অতএব যার জন্য যে পদ্ধতি উপকারী সে সে পদ্ধতি অবলম্বন করবে। যেমন :

হাঁটা-হাঁটি, উঠা-বসা ইত্যাদি। আলমাওসূআতুল ফিকহিয়্যা আলকুওয়ায়তিয়্যায়  ইস্তিবরার পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে-

طلب البراءة من الخارج بما تعارفه الإنسان من مشي أو تنحنح أو غيرهما إلى أن تنقطع المادة.

ইস্তিবরা হল পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন করার জন্য প্রত্যেকের অভ্যাস অনুযায়ী এই পর্যন্ত হাঁটা-হাঁটি, গলা খাকরি ইত্যাদি করা যে, পেশাবের কিছুই বাকি না থাকে। (খ. ৪ পৃ. ১১৩) ইবনে আবেদীন রাহ.ও ইস্তিবরার একই পরিচয় দিয়েছেন। দেখুন : রদ্দুল মুহতার ১/৫৫৮

খোলাসা হল, পেশাবের পর ইস্তিবরা করা আবশ্যক। তবে এর জন্য কোন্ পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে, তা নির্ধারিত নেই। হাদীস ও আছারে বিভিন্ন পদ্ধতি পাওয়া যায়। সবই মুবাহ। কোনটাই বিদআত বা শরীয়ত পরিপন্থি নয়। (দ্র. মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদীস নং ৫৮; ১৭০৯; আল আল আওসাত, ইবনুল মুনযির ১/৩৪৩; হুজ্জাতুল্লাহিল বাগিলগাহ ১/৩৮) নির্দিষ্টভাবে এর কোনোটাই জরুরি নয়; জরুরি হল ইস্তিবরা। সুতরাং ইস্তিবরার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ অভ্যাস অনুযায়ী যে পন্থা কার্যকর মনে হয় সে পন্থা গ্রহণ করবে। একই সাথে পেশাবের ব্যাপারে ওয়াসওয়াসা বা সংশয় গ্রস্ততার শিকার হয়ে যায়। এ রকম বাড়াবাড়িও কাম্য নয়। একথাগুলোই বলেছেনইমামুল হারামাইন রাহ.।

তাঁর বক্তব্যের আরবী পাঠ নিম্নরূপ :

وَالْمُخْتَارُ أَنّ هَذَا يَخْتَلِفُ بِاخْتِلَافِ النّاسِ وَالْمَقْصُودُ أَنْ يَظُنّ أَنّهُ لَمْ يَبْقَ فِي مَجْرَى الْبَوْلِ شئ يُخَافُ خُرُوجُهُ فَمِنْ النّاسِ مَنْ يَحْصُلُ لَهُ هذا،الْمَقْصُودُ بِأَدْنَى عَصْرٍ وَمِنْهُمْ مَنْ يَحْتَاجُ إلَى تَكْرَارِهِ وَمِنْهُمْ مَنْ يَحْتَاجُ إلَى تَنَحْنُحٍ وَمِنْهُمْ مَنْ يَحْتَاجُ إلَى مَشْيِ خُطُوَاتٍ وَمِنْهُمْ مَنْ يَحْتَاجُ إلَى صَبْرِ لَحْظَةٍ وَمِنْهُمْ مَنْ لَا يحتاج إلى شئ مِنْ هَذَا وَيَنْبَغِي لِكُلِّ أَحَدٍ أَنْ لَا يَنْتَهِيَ إلَى حَدِّ الْوَسْوَسَةِ

-আলমাজমূ ৩/৩৪

Top