পবিত্র আশুরা উপলক্ষে কিংবা শোহাদায়ে কারবালার জন্য ঈসালে সাওয়াবের নিয়তে খাবারের আয়োজন করা যাবে কি..?
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ যে ব্যক্তি ‘আশুরার দিন নিজের পরিবার পরিজনের জন্য উদারহস্তে খরচ করবে আল্লাহ তাআ'লা গোটা বছর তাকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখবেন। সুফ্ইয়ান সাওরী রহঃ বলেন, আমরা এর পরীক্ষা করেছি এবং কথার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। [মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৯২৬]
শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রহঃ এঁর 'মা সাবাতা মিনাস সুন্নাহ ফি আইয়্যামিস সুন্নাহ' গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে রয়েছে,
"হাদীসটি সহিহ লিযাতিহী নয়। তবে এতে করে তা 'হাসান লি গায়রিহী' হতে বাধাপ্রাপ্ত নয়। আর হাসান লিগায়রিহী হল দলিলের উপযুক্ত। এমনটাই উলুমুল হাদীস বা হাদীসশাস্ত্রের মূলনীতি।"
মিশকাতের এই হাদিসের পরবর্তী হাদিসের ব্যাখ্যায় আহলে হাদিসদের বাংলা হাদিস এপ কিংবা Hadithbd ওয়েবসাইটে রয়েছে,
"আশূরার দিন নিজ পরিবারের প্রতি প্রশস্ততার সাথে খরচ করার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে ‘আলিমগণ মতানৈক্য করেছেন। ইবনুল জাওযী, ইবনু তায়মিয়্যাহ্, আল ‘উকায়লী, আয্ যারকাশী এর মতে হাদীসটি বানোয়াট। তবে বায়হাক্বী (রহঃ)-এর মতে হাদীসটি বহু সূত্রে বর্ণিত হওয়ায় এটি শক্তিশালী হয়ে ‘হাসান’ হয়েছে। লেখক বলেন, আমার মতে নির্ভরযোগ্য মত হচ্ছে ইমাম বাইহাক্বীর মত। কারণ হাদীসটির বহু সূত্র একটি অপরটিকে শক্তিশালী করেছে। য‘ঈফ সানাদগুলো একত্র হয়ে শক্তি অর্জন করেছে। আল্লাহ'ই এ ব্যাপারে অধিক জানেন।"
এছাড়াও মিশকাতের ১৭১৯ নং হাদিসকে তারা যঈফ লিখেছে। কিন্তু এর ব্যাখ্যায় লিখেছে যে, "এই হাদীস দ্বারা এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ক্ববরের উপর পানি ছিটিয়ে দেয়া যায়, আর এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। এই ব্যাপারে এ ছাড়া আরো অন্যান্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা আবূ রাফি‘র হাদীসকে শক্তিশালী করে।"
উল্লেখ্য যে, উপরোল্লিখিত আশুরা উপলক্ষে ব্যয় করার হাদিসগুলো মিশকাত শরীফের সাদকার মর্যাদা (بَابُ فَضْلِ الصَّدَقَةِ) পরিচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে এবং উক্ত হাদিসগুলোর পরেই (بَابُ أَفْضَلِ الصَّدَقَةِ পরিচ্ছেদে) বুখারী মুসলিমের বরাতে উল্লেখ রয়েছে,
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ কোন মুসলিম যখন সাওয়াবের প্রত্যাশায় তার পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করে,
এ খরচ তার জন্য সাদকা হিসেবে গণ্য হয়।
[মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৯৩০]
আবার, অনেকেই বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে শোহাদায়ে কারবালার জন্য ঈসালে সাওয়াবের ব্যবস্থা করে কিংবা "আশুরা উপলক্ষে খাবারের আয়োজনের মুস্তাহাব আমল" ও "শোহাদায়ে কারবালার জন্য ঈসালে সাওয়াব প্রেরণ" উভয়টির উপর একত্রে আমলের নিয়তে খাবারের আয়োজন করে থাকে। এসব ক্ষেত্রেও ইসলামে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। উপরে প্রমাণ করেছি আশুরা উপলক্ষে খাবারের আয়োজন জায়েজ এবং সাওয়াবের নিয়তে পরিবার-পরিজনের জন্য খাবারের আয়োজনও সাদকা হিসেবে গণ্য হবে। এবার আমি প্রমাণ করব, এই সাদকার সাওয়াব মৃত ব্যক্তির জন্যও ঈসাল করা যায় (এর সাওয়াব উপহার হিসেবে পাঠানো যায়) অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির ঈসালে সাওয়াবের নিয়তে খাবারের আয়োজন করা হলে সেটাও জায়েজ।
এক সাহাবী রসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইসলামের কোন কাজ সবচেয়ে উত্তম?’ তিনি বললেনঃ তুমি লোকদের খাদ্য খাওয়াবে এবং চেনা অচেনা সকলকে সালাম দিবে। (সহীহ বুখারী ২৮)
চলুন এখন দেখি এমন আমল কিংবা সাদকার সাওয়াব মৃত ব্যক্তির কাছে পৌছানো যাবে কি না....
এক সাহাবী রসূলুল্লাহ ﷺ কে বললেন যে, তার মা মারা গেছেন। (জিজ্ঞেস করলেন) তার পক্ষ থেকে যদি তিনি সাদকা করেন তাহলে তা কি তার উপকারে আসবে? তিনি ﷺ বললেন, হ্যাঁ। সাহাবী বললেন, আমার একটি বাগান আছে, আপনাকে সাক্ষী রেখে আমি তার পক্ষ থেকে সাদকা করলাম। (সহীহ বুখারী ২৭৭০)
এক সাহাবী রসূলুল্লাহ ﷺ কে জিজ্ঞেস করলেন, আমার পিতা ধন-সম্পদ রেখে মারা গেছেন কিন্তু ওসিয়াত করে যাননি। আমি যদি তার পক্ষ থেকে দান-খয়রাত করি তবে তা কি তার কাফফারা হবে? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ। (সূনানে ইবনে মাজাহ ২৭১৬)
এছাড়াও মৃত ব্যক্তির জন্য কুলকানি কিংবা ঈসালে সাওয়াবের জন্য বর্তমানে প্রচলিত প্রথা ইসলামের কোন মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক নয় বরং উত্তম প্রথা।
আম্মাজান আয়িশা (রঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যদি কেউ এমন কিছুর প্রচলন করল যা আমাদের দ্বীনের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যহীন তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত। (সহীহ বুখারী ২৬৯৭)
রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, "কেউ ভালো কাজের কিংবা প্রথার প্রচলন করলে এবং তার অনুসরণ করা হলে সে তার নিজের সাওয়াবও পাবে এবং তার অনুসারীদের সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে, তবে তাদের সাওয়াব থেকে একটুও কমানো হবে না। আবার কেউ মন্দ কাজের প্রচলন করলে এবং তার অনুসরণ করা হলে তার উপর নিজের গুনাহ্ বর্তাবে উপরন্তু তার অনুসারীদের সম-পরিমাণ গুনাহর অংশীদারীও হবে, কিন্তু তাতে অনুসরণকারীদের গুনাহর পরিমাণ একটুও কমানো হবে না।" (সহীহ মুসলিম ৬৬৯৩, ইফাঃ ৬৫৫৬, তিরমিযী ২৬৭৫, সুনানে ইবনে মাজাহ ২০৩)
আশা করি, বিবেকবান সত্যান্বেষীদের জন্য এই প্রসঙ্গে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
নবী করীম ﷺ ইরশাদ করেনঃ নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ-সরল। দ্বীন নিয়ে যে বাড়াবাড়ি করে দ্বীন তার উপর বিজয়ী হয়। কাজেই তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং (মধ্যপন্থার) নিকটবর্তী থাক, আশান্বিত থাক এবং সকাল-সন্ধ্যায় ও রাতের কিছু অংশে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। (সহীহ বুখারী ৩৯)
আল্লাহ পাক বলেন,
"যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে আমি কি তাদেরকে যমীনে বিপর্যয় (ফ্যাসাদ) সৃষ্টিকারীদের সমতুল্য গণ্য করব? নাকি আমি মুত্তাকীদেরকে পাপাচারীদের সমতুল্য গণ্য করব?" (সূরা ছোয়াদঃ ২৮)
"যদি তারা তোমাদের সাথে বের হত, তবে তোমাদের মধ্যে ফ্যাসাদই বৃদ্ধি করত এবং তোমাদের মাঝে ছুটোছুটি করত, তোমাদের মধ্যে ফিতনা সৃষ্টির অনুসন্ধানে। " (সূরা তাওবাহঃ ৪৭)
"আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা যমীনে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করো না’, তারা বলে, 'আমরা তো কেবল সংশোধনকারী।" (সূরা বাকারাহঃ ১১)
"এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।" (সূরা মুনাফিকুনঃ ১)
"সাবধান! এরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী, কিন্তু এরা তা অনুভব করতে পারে না।" (সূরা বাকারাহ ১২)
"আল্লাহ ও ঈমানদারদের তারা ধোঁকা দিতে চায়,আসলে তারা অন্য কাউকে ধোঁকা দিচ্ছে না বরং নিজেদেরই প্রতারিত করছে, অথচ তাদের সে অনুভূতি নেই।" (সূরা বাকারাহঃ ৯)
সাবধান!
"ওহে যারা ঈমান এনেছ! ভালো বিষয়গুলো যা আল্লাহ্ তোমাদের জন্য বৈধ করেছেন সে-সব তোমরা নিষিদ্ধ করো না, আবার বাড়াবাড়িও (সীমালঙ্ঘন) করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ ভালোবাসেন না সীমালঙ্ঘন কারীদের।" (সূরা আল মায়িদাহঃ ৮৭)