কিছু কিছু হাদীসে মুবারাকা আছে যেগুলো পরিবেশ-পরিস্থিতিতে প্রকাশ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে।সেরকম কিছু একটা প্রকাশ করতে যাচ্ছি।জান্নাতের সর্দার এর ব্যাপারে আমরা কমবেশি সবাই জানি যে,সৈয়্যদুনা ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন عليهم السلام হলেন জান্নাতের যুবকদের সরদার,সৈয়্যদুশ শাবাবি আহলিল জান্নাহ!এবং সেটা বর্ণিত আছে অসংখ্য কিতাবে।যেমন:—
১।তিরমিযী ৩৭৬৮।(৪১০১ মুয়াসসাসাতুর রিসালা)
২।সুনানু কুবরা লিন নাসায়ী ৮১৬৯ ও ৮৫২৫
৩।মুসনাদ আহমদ ১০৯৯৯,১১৫৯৪
৪।সহীহ ইবনে হাব্বান ৬৯৫৯
৫।তারিখে দামেষ্ক ৪/২৫৭
৬।ফাযায়েলুস সাহাবা,১৩৮৪,১৩৬৮ নং হাদীস,ইমাম আহমদ বিন হাম্বল
৭।মুজামুল কাবীর লিত-তাবারানী ৩/২৬,২/২৮
৮।আখবারে আসবাহান ২/৩৪৩,আবু নুয়াইম ইস্পাহানী
৯।তারিখে বাগদাদ,১১/৯০,৪/২০৮ খাতিবে বাগদাদী
১০।শরহুস সুন্নাহ লিল বাগাভী ১৪/১৩৮
১১।মাআরিফাতিল সাহাবা ১/১৪৪
১২।মুসান্নাফে আবি শায়বা ১২/৯৬
১৩।হিলইয়াতুল আওলিয়া ৫/৭১,আবু নুয়াইম ইস্পাহানী
১৪।মা'আরিফাতুত তারিখ,২/৬৪৪,আল্লামা ফাসাওয়ী
১৫।মুশকিলুল আছার,২/৩৯৩,ইমাম ত্বাহাবী
১৬।মুস্তাদরাক লিল হাকেম, ৩/১৬৬
১৭।কাশফুল আসতার,৩/২৩৪,ইমাম নুরুদ্দীন হায়সামী
১৮।আল কামিল লিদ্ব দ্বুয়াফা,২/৬৩৮,ইমাম ইবনে আদী
'ফয়যুল ক্বদীর শরহে জামেউস সগীর' এ ৩/৪১৫ তে উল্লেখ আছে, ইমাম সূয়ুতী বলেন,হাদীসটি মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এবং এর সাথে একটা কথা জুড়ে দেয়া আছে যে,"তাঁদের পিতা (অর্থাৎ আলী عليه السلام) তাদের চেয়ে উত্তম বা আফদ্বল।" ইমাম হায়সামী মাজমাউয যাওয়াইদের ৯ম খন্ডে ১৭২ পৃষ্ঠায় কয়েকটি হাদীস এনে প্রমাণ করে দিয়েছেন হাদীসটা সহিহ।
তবে কেউ যখন এই হাদীসগুলোর শব্দ নিয়ে খেলতে থাকে এবং আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুল কারীম এর সর্বোপরি ফযিলতকে বাড়াতে গিয়ে শায়খাইনের উপরে তুলে ফেলে তখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তা তাফদ্বীলির (আলীকে অন্য সাহাবীদের উপর প্রাধান্য দেয়া) দিকে যায়।তখন ব্যালেন্স করার জন্য সিদ্দিক-ফারুকের মানাকিব/জীবনাদর্শগুলোকে সামনে নিয়ে আসাই লাগে।
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে,ইমাম জালালউদ্দিন সুয়ুতি ব্যাপারে বলেন—
وقال النووي في فتاويه وقال المُظهَّري معناه هما أفضل من مات شابا في سبيل الله من أصحاب الجنة
—"ইমাম নববী তার ফতোয়ার কিতাবে উল্লেখ করেন,মুযাহহারী বলেছেন,হাদীসটির অর্থ হলো সে সকল যুবক যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছেন, জান্নাতের তাদের চেয়েও (হাসান-হুসাইন) মর্যাদাপূর্ণ হবেন।
আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলা হচ্ছে—
أو أنهما سيدا أهل الجنة سوى الأنبياء، والخلفاء الراشدين وذلك لأن أهل الجنة كلهم في سن واحد، وهو الشباب وليس فيهم شيخ ولا كهل،
— অথবা এও হতে পারে যে উনারা (হাসান-হুসাইন عليهم السلام) নবীগণ এবং খুলাফায়ে রাশেদুনগণ ব্যতীত সবার সর্দার হবেন,যেহেতু বেহেশতে সবার বয়স একই হবে এবং সেখানে কোনো বয়স্ক থাকবে না।
[আল-ক্বুওতুল মুগতাযী আলা জামেউত তিরমিযী,১০১৯ পৃ:,ইমাম সূয়ুতি]
➤➤➤অন্যদিকে মুসনাদু আহমদ এর ৬০২ নং হাদীসে,মুয়াসসাসাতুর রিসালা হতে প্রকাশিত,বর্ণিত আছে—
«
حَدَّثَنَا عَبْدُ اللهِ، حَدَّثَنِي وَهْبُ بْنُ بَقِيَّةَ الْوَاسِطِيُّ، حَدَّثَنَا عُمَرُ بْنُ يُونُسَ يَعْنِي الْيَمَامِيَّ، عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ الْيَمَامِيِّ، عَنِ الْحَسَنِ بْنِ زَيْدِ بْنِ حَسَنٍ، حَدَّثَنِي أَبِي، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَلِيٍّ، قَالَ: كُنْتُ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَقْبَلَ أَبُو بَكْرٍ، وَعُمَرُ، فَقَالَ: " يَا عَلِيُّ، هَذَانِ سَيِّدَا كُهُولِ أَهْلِ الْجَنَّةِ، وَشَبَابِهَا بَعْدَ النَّبِيِّينَ وَالْمُرْسَلِينَ
— আলী (রাঃ) বলেছেন,আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর কাছে ছিলাম। সহসা আবু বকর ও উমার رضي الله عنهم এলেন। তিনি ﷺ বললেন,হে আলী, এরা দু’জন নবী ও রাসূলগণের পর জান্নাতের যুবক ও প্রৌঢ়দের দুই নেতা।»
আল্লামা শায়খ শো'আইব আরনাউত্ব হানাফী রহ. বলেন,"হাদীসটি বিশুদ্ধ এবং এর সনদ সুন্দর।" সবচাইতে মজার বিষয় হচ্ছে এই হাদীসটির সনদে আহলে বায়ত রয়েছেন,হযরত হাসান তার পিতা হযরত যায়েদ হতে,হযরত যায়েদ তার পিতা হযরত হাসানে মুজতাবা হতে এবং হাসান উনার পিতা হযরত আলী عليهم السلام হতে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আবার তিরমিযীতে ৩৬৬৪,৩৬৬৫,৩৬৬৬ এর দ্বারা বিশুদ্ধ হিসেবে প্রমাণিত হয় যে নবীজী বলেন—
«هَذَانِ سَيِّدَا كُهُولِ أَهْلِ الْجَنَّةِ مِنَ الأَوَّلِينَ وَالآخِرِينَ إِلاَّ النَّبِيِّينَ وَالْمُرْسَلِينَ يَا عَلِيُّ لاَ تُخْبِرْهُمَا
—অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ (হযরত আবুবকর ও হযরত উমরকে দেখিয়ে) বললেন:—এরা দুজন জান্নাতে নবী-রাসূলগণ ছাড়া পূর্বাপর (সৰ্বকালের) পূর্ণ বয়স্কদের নেতা হবেন। হে ‘আলী!এটা তাদেরকে জানাবে না।»
এরমধ্যে ৩৬৬৬ হাদীসটি ইমাম জয়নুল আবিদীন عليه السلام এর সূত্রে বর্ণিত।
এই হাদীসটা আরো অনেক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
১.আসসুন্নাহ,১৩২০নং হাদীস,ইমাম ইবনে আবী আসেম
২.আওসাত,৬৮৬৯নং,ইমাম ত্ববারানী
৩.শরহে মুশকিলুল আছার,১৯৬৩ এবং ১৯৬৬নং,ইমাম ত্বহাবী
৪.মুসনাদু বায্যার,২৩৯২নং হাদীস।
৫.ইবনে মাজাহ, ৯৫ নং
৬.মুসনাদু আহমদ,৬০২নং(মুয়াসসাসাতুর রিসালা)
৭.সহিহ ইবনে হিব্বান,৬৯০৪নং হাদীস
৮.মাজমাউয যাওয়াইদ,৯/৫৩,ইমাম নুরুদ্দীন হায়সামী
৯.খাতিবে বাগদাদী,১০/১৯২
➤এই 'কুহুল' বা 'বয়স্ক'দের হাদীস এর ব্যাপারে শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাক্কিক আলাল ইত্বলাক মুহাদ্দিসে দেহলভী বলেন—
ووصفهما بالكهولة باعتبار ما كانـوا في الدنيـا وإلا فلا كهل في الجنة فالمعنى: سيدا من مات كهلاً من المسلمين، وإذا كانا سيدي الكهول فأولى أن يكونا سيدي الشباب، كذا قالوا وقيل:أراد به ههنا الحليم العاقل، أي:يدخلهما الله الجنة حلماء وعقلاء
— 'কুহুল' বা বয়স্ক বলার দ্বারা এটা বুঝানো উদ্দেশ্য ঐ সকল মুসলমান যারা পৃথিবীতে (মরার আগে) বয়স্ক ছিল (মানে,বয়স্ক হয়ে মারা গিয়েছে)।কেননা জান্নাতে কোনো বয়স্ক ব্যক্তি নেই।সুতরাং শায়খাইনদের প্রতি 'বয়স্কদের সর্দার' শব্দের ব্যবহার দ্বারা বুঝা যায় যে,যে সকল মুসলিম বয়স্ক হয়ে মারা গিয়েছেন (শায়খাইনরা) তাদের সর্দার হবেন।আর উনারা যদি বয়স্কদের নেতা হোন তবে তারা যুবকদের সর্দার ও হবেন।একইভাবে বলা যায়,'বয়স্ক' দ্বারা পরিপূর্ণ আক্বলমান্দ (আক্বলসম্পন্ন বুঝায়), অর্থাৎ আল্লাহ সবাইকে আক্বলবান এবং হিলম (জ্ঞানে পরিপূর্ণতা) বানিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন (তাদের সর্দার হবেন শায়খাইন)।
[লুমআতুত তানকীহ ফী শরহে মিশকাতুল মাসাবিহ,৯/৬৩১,শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী]
➤ইমাম আব্দুর রউফ আল মানাভী বলেন—
أن المراد بالكهل هنا الحليم الرئيس العاقل المعتمد عليه. يقال: فلان كهل بني فلان وكاهلهم، أي: عمدتهم في المهمات، وسيدهم في الملمات.
— 'কুহুল বা বয়স্ক' এর অর্থ হলো 'হালিম' ব্যক্তি, উচ্চ পর্যায়ের বিবেকবান ব্যক্তি।কোনো সম্প্রদায়ের 'কুহুল' গণের মধ্যে 'কুহুল' এর অর্থ হল তাদের কর্মকান্ডে সর্বোত সাহায্যকারী,তাদের পক্ষে বিপদাপদে ছত্রধারী তথা মুখপাত্র।
[ফয়যুল ক্বদীর শরহে জামেউস সগীর মিন আহাদীছিল বাশিরিন নাযির,৬৮ নং হাদীসের ব্যাখ্যা]
➤ইমাম সূয়ুতি উল্লেখ করেন —
وقيل أراد بالكهل هنا الحليم العاقل أي أن الله يدخل أهل الجنة حلماء وعقلاء
— 'কুহুল' বা বয়স্ক দ্বারা উদ্দেশ্য সেই সকল মানুষ যাদের আক্বল/বিবেক 'হালিম' পর্যায়ে পৌঁছেছে।
[আল-ক্বুওতুল মুগতাযী আলা জামেউত তিরমিযী,৯৮৭ পৃ:,ইমাম সূয়ুতি এবং
মুসনাদু আহমদ,৬০২নং হাদীসের হাশিয়ায় আল্লামা শোয়াইব আরনাউত্ব 'ফয়যুল ক্বদীর লিল মানাভী' এর উদ্ধৃতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন,মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ]
অর্থাৎ সর্বোচ্চ অধিষ্ঠানে থাকবেন নবী রসুলগণ,এরপর খুলাফায়ে রাশেদুনের গণ,এরপর সৈয়্যদুশ শাবাবি আহলিল জান্নাত ইমামাঈনিল হুমামাইন গণ।
আমি এ বিষয়গুলো আনার একটাই উদ্দেশ্য। বর্তমানের কিছু তথাকথিত তাসাউফপন্থীরা তাফযিলীর দিকে এতো দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে যে,তারা এটা সহজে মেনেই নিতে চায়না যে শায়খাইন عليهم السلام উনারাও রূহানি ভাবে সমৃদ্ধ। একটা ছোটো উদাহরণ দিয়ে শেষ করি,কেবল সিদ্দিকের ব্যাপারে—
হযরত আব্দুল্লা ইবনে আব্বাস রাঃ এর ছাত্র হযরত মুজাহিদ রাঃ বলেন,«ইন্নাল্লাহা ওয়ামালা ইকাতাহু……»"আয়াতটি নাযিল হওয়ার পর আবু বকর (রা.) আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ আমাকে সম্পৃক্ত না করে আল্লাহ তা'আলা আপনার জন্য কোনো আয়াত নাযিল করেননি, শুধু এ আয়াত ছাড়া। এ প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হয়—«তিনিই যিনি তোমাদের প্রশংসা করেন এবং দো'আ ও ক্ষমা চান তোমাদের জন্য তাঁর ফিরিশতাগণ; যেন তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আনেন আলোর দিকে। আর তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু(আহযাব ৪২)।»
[তারিখুল খুলাফা,১২৭পৃষ্ঠা,ইমাম সূয়ুতি]
এই হাদীসটি সিদ্দিকে আকবর রাঃ এর রুহানিয়ত বুঝার জন্য মোর দ্যান এনাফ।
আহলে বায়ত এবং সাহাবীদের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় তুলনা করা এবং অমুক বড় সমুক ছোট এগুলা আমাদের মধ্যে আক্বিদার ব্যাঘাত ঘটায়।জান্নাতের সর্দার হিসেবে যেই হোক,আমরা চাই উনাদের সোহবত-সংস্পর্শে থাকতে।আমরা না সাহাবীর রশি ছাড়বো,না আহলে বায়তের!দুটৈ প্যারালালি চালাতে না পারলে আপনার তাসাউফ আপনার বদ আক্বিদা/বদ মাযহাবের কারণ হবে।