খ্রিস্টধর্মের পোপ যে মাদ্রাসায় পড়েছিলেন সে মাদ্রাসার প্রভাব এবং বিশ্বের প্রাচীণতম মেডিক্যাল ডক্টরেট সার্টিফিকেট...
জামিয়া আল আযহার ১,০৫০ বছর আগে, ৯৭১ সালে মিশরের কায়রোতে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীণতম বিশ্ববিদ্যালয়, যা এখনো চলছে। প্রাচীণত্বের দিক দিয়ে ইতালির বলোগনা বিশ্ববিদ্যালয় আল আযহারের ১০৭ বছর পরের। অক্সফোর্ড ১১৫ বছর পরের। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯ বছর পর। এটা কিন্তু আল আযহার বিষয়ক লেখা নয়। স্রেফ তুলনা দেয়ার জন্য আযহারের কথা বলছি।
আল আযহারেরও ১১১ বছর আগে একটা মসজিদভিত্তিক মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় মরক্কোর ফেযে।
মরক্কো বা আল মাগরিবে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ও গিনিজ বুক অভ রেকর্ডস অনুসারে বিশ্বের প্রাচীণতম বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত।
এটাই কারাউইন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়।
কুরাইশ বংশীয় ফাতিমা আল ফিহরি ও তাঁর বোন মারইয়াম আল ফিহরি- এই দুই মহীয়সী জ্ঞানী নারী পৃথিবীর সবচে প্রাচীণ বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়াতু কারাউইনের প্রতিষ্ঠাতা।
তাঁরা দু বোন ফিক্বাহ ও হাদিসের স্কলার ছিলেন। তখন স্পেনের রিকনকোয়েস্তার কারণে মুসলিম জ্ঞানী গুণী গবেষকরা সাগরপাড়ি দিয়ে নিকটতম অঞ্চল, আটলান্টিক ঘেঁষা উত্তর আফ্রিকার মরক্কোয় আশ্রয় নেন।
ফাতিমা ও মারইয়াম এই উলামাদের জন্য শুধু একাধিক মাদ্রাসা (মসজিদ, যেখানে দ্বিনি দরস দেয়া হয়) প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হন না, তাঁরা দ্বিনি উলুম শিক্ষার জন্য নানামুখী ব্যবস্থাও গ্রহণ করেন। নিজে হাজির থেকে মসজিদ বড় করার জন্য জমি কিনে সেই জমিতে নির্মাণকাজ ব্যবস্থাপনা করেন। নির্মাণের জন্য মাটি খুঁড়ে হলুদ বালি, প্লাস্টার-উপাদান ও নুড়ি পাথর উত্তোলন করা হয়।
নির্মাণকাজে আঠারো বছর সময় লাগে।
নবম শতাব্দী থেকেই সেখানে হালাকাত (তৎকালীন প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা) শুরু হয়।
১,৬০০ সালেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে গবেষণাপত্র ও দুর্লভ গ্রন্থের সংখ্যা ছিল ৩২,০০০।
জামিয়া কারাউইনের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ১,২০৭ সালের একটা মেডিক্যাল ডিগ্রির সার্টিফিকেট এখনো আছে। এতে প্রমাণিত হয়, ১,২০০ সালের আগেই সেই জামিয়ায় মেডিক্যাল কলেজ হিসাবে ফ্যাকাল্টিও ছিল।
সার্টিফিকেটকে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম শিক্ষাকেন্দ্রে বলা হতো ইজাজাহ বা অনুমতিপত্র। এই হরিণের চামড়ায় লেখা ইজাজাহর মাধ্যমে নতুন একজন ডাক্তারকে ডাক্তারি করার ইজাজত (অনুমতি) দেয়া হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন প্রফেসর ডাক্তার এবং সরকারি কাযির উপস্থিতিতে সত্যায়নের মাধ্যমে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ম্যাপগুলো ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও বিশ্ব-বিজয়ে বিরাট অবদান রাখে। হায়, ঐতিহাসিক হোসে পন্তেলেমিও বলেছেন, কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক অমুসলিম এমনকি খ্রিস্টানও পড়ালেখা করেছেন। তিনি বলেছেন, খ্রিস্টানদের পোপ দ্বিতীয় সিলভেস্টারও এখানে পড়েছেন।
এখানে ঐতিহ্যগতভাবেই নারী শিক্ষার্থীরাও পড়ালেখা করতে পারতেন, তাঁদের জন্য আলাদা বসা ও পড়ালেখার ব্যবস্থা ছিল।
বিভিন্ন জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার কারণে একথা মনে করার কারণ নেই যে, এখানে দ্বিনি জ্ঞানচর্চা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। বরং দ্বিনি জ্ঞানচর্চার মহাবিষ্ফোরণকেন্দ্রেই সাধারণত অন্যান্য জ্ঞানচর্চা হতো। ঐতিহাসিকভাবে কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয় মালিকি মাযহাবের উপর প্রতিষ্ঠিত।
এ বিশ্ববিদ্যালয় অগুণতি ফক্বিহ, মুহাদ্দিস, কাযি, ইতিহাসবেত্তার পাশাপাশি ইসলামের সব শাখায় অসংখ্য সিনিয়র আলিমের জন্ম দিয়েছে, যাঁরা আরো হাজার বছর আগেই সারা পৃথিবীকে দ্বিনের আলোয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আলোয় এমনভাবে আলোকিত করেছেন যে, একদিকে সেই আলোকায়ন ইউরোপকে বিজ্ঞানময় করেছে আর মুসলিম জাতিকে বিজ্ঞানময় করার পাশাপাশি উলুমুল ইসলামে করেছে লক্ষ পথে সমৃদ্ধ।
আমরা কখনোই তাঁদের অবদানকে এককভাবে চিত্রিত করতে পারব না, কারণ তাঁদের ছাত্ররা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিলেন হাজার বছর আগেই।
শুধু একজনের নাম বললেই বিষয়টা স্পষ্ট হতে পারে। ইবনু খালদুন ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্কলার। কে ইবনু খালদুন? হায়, তিনি ইতিহাসবিদ্যার জনক, বৈজ্ঞানিক ইতিহাসবিদ্যার জনক, সমাজবিজ্ঞানের জনক এবং এমনকি অর্থনীতিরও জনক। তাঁর আল মুকাদ্দিমা জগৎবিখ্যাত বই। আল মুকাদ্দিমাকে ডেমোগ্রাফির উপরে প্রথম বৈজ্ঞানিক মেথডোলজির গ্রন্থ বলা হয়। এটা সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ্যার উপরও প্রথম বই।
এ বইতে কী নেই?
ইসলামি ধর্মতত্ত্ব আছে, আছে হিস্টোরিওগ্রাফি, আছে ইতিহাসের দর্শন। অবহেলিত যে বিষয়টি খালদুনের রচনায় বেশি উঠে এসেছে, তা হলো রাজনৈতিক তত্ত্বের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণনির্ভর বয়ান। আল মুকাদ্দিমাকে মনো-সামাজিক বাস্তববাদের প্রথম নিদর্শনও বলা হয়।
চমকটা এখানেই, আল মুকাদ্দিমা কিন্তু আসলে কোন আলাদা বই ছিল না। বরং তাঁর বি-শা-ল গ্রন্থের ভূমিকা ছিল। কী ছিল সেই বিশাল গ্রন্থটা? আল কিতাবুল ইবার। আহ, শিক্ষাগ্রন্থ। যে গ্রন্থে ইতিহাসের নিরাবেগ বাস্তবানুগ শিক্ষার মূলরস নিয়ে দারুণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ইবনু খালদুন সূফি ছিলেন, সূফির পুত্র ছিলেন, আলিম ছিলেন, আলিমের পুত্র ছিলেন, বিচারপতি বা কাযি ছিলেন, ধর্মতত্ত্ব বিশ্লেষক ছিলেন, কী ছিলেন না তিনি?
তিনি ছিলেন বহু বহু দেশে রাষ্ট্রদূত, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান পরিকল্পনামন্ত্রী... একের পর এক দেশের রাজা বাদশাহ সুলতানরা তাঁকে পাওয়ার জন্য মরীয়া হয়ে উঠতেন।
আমাদের লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ইবনু খালদুন ছিলেন জামিয়া কারাউইনের মধ্যযুগের লাখো ছাত্রের মধ্যে একজন ছাত্র। হাজার হাজার স্কলারের মধ্যে একজন স্কলার। প্রতিষ্ঠান এতই শক্তিমান। প্রতিষ্ঠানের শক্তি আমাদের অন্তরকে আন্দোলিত করে তোলে।
আমাদের অতীত এত বেশি আলোকিত যে, আমাদের বর্তমানও সেই গর্বে শুধু উচ্ছ্বসিত হতে পারে না, বরং নতুন করে পথচলা শুরু করতে পারে।
ছবিঃ হরিণের চামড়ায় লেখা সেই আদি মেডিক্যাল ডিগ্রি