ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: শানে মুস্তাফা (দ.)ও নবীপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত 
<<<>>><<<>>><<<>>>
ড  এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী 
<<<>>><<>><<<>>><<
ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হলো বদরের যুদ্ধ। ইসলামের শান-শওকত এ যুদ্ধের মধ্যদিয়েই প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। সত্য-মিথ্যা ও হক-বাতিল সুস্পষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে করিমে এ দিনটিকে ইয়াউমুল ফুরকান অর্থাৎ হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী দিন নামে অভিহিত করেছেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে কুফর ও শিরকের শিরদাঁড়া ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। কোনো সমর-সরঞ্জাম ও বিরাট কোনো বাহিনী ছাড়াই আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের মহাবিজয় দান করেন আর কাফিরদের পরাজিত ও লাঞ্জিত করেন। এতে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাস আরো পূর্ণতা লাভ করে। তাদের ইমান মজবুত ও দৃঢতর হয়। এ যুদ্ধে প্রিয়নবীর শান-মান, মর্যদার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। 
১৩ রমযান রাসূল তিনশত ১৩ জন সাহাবি নিয়ে মদিনা থেকে বদরের দিকে যাত্রা করেন। পুরো দলে মাত্র দুটি ঘোড়া ও সত্তরটি উট ছিলো। একটি উট তিন তিনজন সাহাবির মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়েছিলো। তারা পালাক্রমে উটের উপর সওয়ার হতেন। হযরত আবু লুবাবা ও হযরত আলী রাসূলের সঙ্গে শরীক ছিলেন। যেখানে রাসূলের পায়ে হেঁটে চলার পালা আসতো সেখানে তারা আরজ করতেন, ইয়ারাসূলাল্লাহ! আপনি সওয়ার হোন। আমরা পায়ে হেঁটে চলি। রাসূল বলতেন, তোমরা তো পায়ে হেটে চলার ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী নও। আর তোমাদের থেকে আমি আল্লাহ তায়ালার সওয়াবের বেশি মুখাপেক্ষী। 
দেখুন! তিনি কেমন রাহমাতুল্লিল আলামিন, ন্যায়েরপ্রতীক ও মানবতার প্রতীক, যিনি নিজে হাটছেন তার গোলামদের চড়াচ্ছেন উটের পিঠে!
অপরদিকে একহাজার যোদ্ধা বিপুল অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আবু জাহেল ঢোলতবলা ও গায়িকাদের বিশাল বহরসহ অত্যন্ত গর্বের সাথে সদর্পে সামনে এগুতে থাকে। সব কুরাইশ সরদার এ বাহিনীতে ছিলো। উমাইয়া ইবনে খালাফ যুদ্ধে প্রথমে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করে। পরে আবু জাহেলের পীড়াপীড়িতে রাজি হয়ে যায়। এর কারণ হলো, হযরত সাদ ইবনে মুয়াজের সাথে উমাইয়ার বন্ধুত্ব ছিলো, একদা হযরত সাদ কথা প্রসঙ্গে উমাইয়াকে বললো, আল্লাহর শপথ! আমি রাসূলের কাছ থেকে শুনেছি, তুমি রাসূলের অনুসারীদের হাতে মারা যাবে। এ কথা শুনে উমাইয়া অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত ও অস্থির হয়ে পড়ে। ঘরে গিয়ে তার স্ত্রী উম্মে সাফওয়ানকে এ ঘটনা বলে এবং বলে, والله ما يكذب محمدআল্লাহর কসম মুহাম্মদ কখনো মিথ্যা বলে না। فكاد ان يحدث এ সময় ভয়ে তার পেশাব-পায়খানা হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। [ফাতহুল বারি, ৭: ১২২০।]
দেখুন অনেক আগেই রাসূল খবর দিয়েছেন উমাইয়া বিন খালাফ মারা যাবে। এ থেকে বুঝা যায় প্রিয় নবী গায়েব জানেন এবং একথাও জানেন কে কোথায় মারা যাবেন। পরবর্তী বর্ণনা থেকে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।
তাই সে যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করেছিলো। কিন্তু ভাগ্য তাকে নিয়ে গেলো। আবু জাহেলের পীড়াপীড়িতে সে যেতে বাধ্য হয়। প্রিয় নবীর ভবিষ্যত অনুাযায়ি সে যুদ্ধে মারা যায়।
যুদ্ধ শুরুর আগে নবীজি মুহাজির ও আনসাদের একত্র করে কুরাইশদের সমর শক্তি ও প্রস্তুতির কথা জানান ও তাদের পরামর্শ চান। হযরত আবু বকর উঠে দাঁড়ান। কাফেরদের মোবাবেলায় নিজের জান উৎসর্গ করার কথা তুলে ধরেন। হযরত ওমর উঠে দাড়ান। তিনিও নিজের আত্মত্যাগের কথা দৃঢ়ভাবে বর্ণনা করেন। এরপর হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ দাঁড়িয়ে আরজ করেন:
হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তায়ালা আপনাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা পালন করুন। আমরা সকলে আপনার সাথে আছি। আল্লাহর শপথ, আমরা বনীইসরাইলের মতো এ কথা বলবো না, যেভাবে তারা মুসাকে বলেছিলো- اذهب وربك فقاتلا انا ههنا قاعدون তুমি ও তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ করো আমরা এখানে বসে থাকবো। বরং আমরা বনীইসরাইলের বিপরীত বলবো- আপনি ও আপনার প্রভু যুদ্ধ করুন। আমরাও আপনার সাথে যুদ্ধ করবো। আমরা কখনো আপনাকে ফেলে পেছনে যাবো না। আমরা আপনার ডানে বামে, সামনে পেছনে থেকে যুদ্ধ করে যাবো। [বুখারি, ইবনে ইসহাক,] 
এভাবে একেকজন সাহাবা দাঁড়িয়ে রাসূলের জন্য তাদের প্রাণউৎসর্গ করার কথা বলেন। শোনে নবীজি তাদের জন্য দোয়া করেন।
আনসাদের সরদার হযরত সাদ বিন মুয়াজ দাড়িয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার উপর ইমান এনেছি। আপনাকে সত্যায়ন করেছি। আমরা এ সাক্ষ্য দিয়েছি যে, আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সত্য। আমরা আপনার কথা শ্রবণ করা এবং আপনাকে অনুসরণ করার ব্যাপারে দৃঢতার সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি। আমরা সর্বাবস্থায় আপনার সঙ্গে আছি। আপনি যদি আমাদেরকে বারাকুল গামাদে যাওয়ার নির্দেশ করেন তাহলে অবশ্যই আমরা আপনার সাথে যাবো। সেই সত্তার শপথ করে বলছি, যদি আপনি আমাদের সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়তে বলেন তাহলে আমরা অবশ্যই সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়বো। আমাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিও এর থেকে পেছনে থাকবে না। আমরা শক্রুর মোকাবেলায় পিছপা হবো না। যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করবো না। অতত্রব, আল্লাহর নামে অগ্রসর হোন। [যুরকানি, ১: ৪১৩]
রাসূলে আকরাম দ. সাহাবায়ে কেরামের এমন জজবা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং বলেন, তোমরা অগ্রসর হও। তোমাদের জন্য একটি সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমার সঙ্গে ওয়াদা করেছেন, আবু সুফিয়ান বা আবু জাহেল এই দুই দলের কোনো একটির উপর তোমাদের অবশ্যই বিজয় দান করবেন। 
হযরত আনাস হযরত ওমর থেকে বর্ণনা করেন, যেদিন সকালে ময়দান উত্তপ্ত হয়ে উঠবে সেদিন রাতে রাসূলে আকরাম দ. আমাদের যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যান। কাফেরদের কে কোথায় নিহত হবে তা আমাদের হাতে ইশারা করে দেখান। রাসূলুল্লাহ দ. বলেন, এটা আগামীকাল অমুকের ধরাশায়ী হওয়ার জায়গা। এটা আগামীকাল অমুকের ধরাশায়ী হওয়ার জায়গা। এভাবে তিনি কাফেরদের নাম উল্লেখ করে করে তাদের নিহত হওয়ার জায়গা সাহাবিদেরকে দেখাতে থাকেন। হযরত ওমর বলেন- যে আল্লাহ প্রিয় নবী মুহাম্মদ দ. কে সত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন সে আল্লাহর শপথ করে বলছি,
فما مات احدهم عن موضع يد رسول الله صلي الله عليه وسلم
একজন কাফেরও সে জায়গা থেকে অতিক্রম করে নি, যে জায়গা রাসূলুল্লাহ দ. হাতের ইশারার মাধ্যমে আমাদের দেখিয়েছেন। [মুসলিম, ২: ১০২।]
বুঝা গেল, আল্লাহর রাসূল ইলমে গায়েব জানেন। তিনি জানেন কে কোথায় মৃত্যুবরণ করবে। এটা তার আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান। 
রমযানের ১৭ তারিখ। জুমার দিন। ফজরের নামায পড়ে রাসূল ইসলামি বাহিনীকে বিন্যস্ত করেন। কাতার বিন্যাসের সময় নবীজির হাতে একটি তীর ছিলো। হযরত সাওয়াদ ইবনে গাজিয়া কাতার থেকে একটু আগে বেড়ে গিয়েছিলেন। রাসূল অনুকুম্পা হিসাবে তার পেটে তীর দিয়ে হালকা খোঁজা দিয়ে বললেন, ইস্তাউ ইয়া সাওয়াদ। সাওয়াদ সোজা হয়ে যাও। তখন তিনি আরজ করলেন, ইয়ারাসূলাল্লাহ! আপনি আমাকে ব্যথা দিয়েছেন-কষ্ট দিয়েছেন। আল্লাহ আপনাকে হক ও ইনসাফ সহকারে পাঠিয়েছেন। সুতরাং আমাকে এর প্রতিশোধ নিতে দিন। প্রিয় নবী রাসূলে আকরাম দ. তখন নিজের পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে সাওয়াদকে বললেন, তোমার প্রতিশোধ নাও। হযরত সাওয়াদ রাসূলের পেট মুবারক নিজের গলার সঙ্গে লাগান এবং চুমু খান। তারপর আরজ করলেন, আমার উদ্দেশ্যে প্রতিশোধ নেয়া নয়, আপনি তো কোনো অন্যায়ই করেন নি, আমার উপর অনুকম্পা করেছেন। আমি আপনাকে চুমু খাওয়ার জন্যই ও আপনার থেকে বরকত গ্রহণ করার জন্যই এ কাজটি করেছি আমাকে ক্ষমা করে দিন।] হতে পারে এটা আপনার সাথে আমার শেষ সাক্ষাত। রাসূল তখন আনন্দিত হন এবং সাওয়াদের জন্য দোয়া করেন। [আলইসাবা, ২: ৯৫, ইবনে হিশাম, ২: ২৭]

দেখুন পৃথিবীতে এমন কোন শাসক আছে যে খোলা ময়দানে তার শরীরের জামা খুলে দিয়ে বলে, তুমি ব্যথা পেয়ে থাকলে প্রতিশোধ নিয়ে নাও। সুবআল্লাহ! তিনি একমাত্র ন্যায় ও মানবতার একমাত্র শিক্ষক প্রিয় নবী রাহমাতুল্লিল আলামিন।
যুদ্ধ শুরু হলে সাহাবায়ে কেরাম প্রাণপণ যুদ্ধ করতে থাকেন হযরত আলী একাই আটজন কুরাইশ বীরকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন। প্রিয় নবী সাহাবায়ে কেরামকে উদ্ধুদ্দ করতে থাকেন এবং কাফিরদের আক্রমনের জন্য চুড়ান্ত নির্দেশ দিয়ে বলেন, قوموا الي جنة عرضُها السمواتُ والارضُ তোমরা ঔ জাহান্নাতের দিকে ধাবিত হও যার প্রস্থ আসমান ও জমিনের সমান। তার নির্দেশ পেয়ে তারা এক দুর্দমনীয় প্রবল আক্রমন পরিচালনা করেন। দুশমনদের সারিগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে তাদের গলাকেটে সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে লাগলেন। হযরত আওফ ইবনে হারিস স্বীয় দেহ হতে লৌহবর্ম খুলে তা ছুড়ে ফেলে দিলেন এবং স্বীয় দুশমনদের উপর ঝাপিয়ে পড়লেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাতের অমীয় সুধা পালন করলেন। এভাবে সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও প্রিয় নবীর ভালোবাসায় নিজেদের প্রাণউৎসর্গ করে চিরস্থায়ী জান্নাতের নিমাত লাভ করেছেন।
যুদ্ধ চলাকালে হযরত উকাশার তরবারি ভেঙ্গে যায়। তিনি রাসূলের খেদমতে আরজ করলে তিনি তাকে একটা কাঠের ভাঙ্গা লাঠি দিয়ে বলেন: قاتل يا عكاشة হে উকাশাহ এটা দিয়ে যুদ্ধ করো। হযরত উকাশা রাসূলের হাত থেকে নিয়ে নড়ানো মাত্রই সেটা একটা লম্বা, শক্ত, সাদা, চকচকে লৌহ নির্মিত ধারালো তরবারিতে পরিণত হয়। এটা দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। এ তরবারির নাম ছিলো আউন। হযরত সিদ্দিকে আকবরের সময়ে মুরতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করার আগ পর্যন্ত এটা তার নিকট ছিলো।
হযরত আবদুর রহমান বিন আউফ বলেন, আমি বদরযুদ্ধের দিন কাতারে দাড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়তেই দেখি আমার ডান ও বামপাশে দুইজন আনসারি কিশোর জোয়ান। একজন আস্তে আস্তে আমাকে বললো, চাচা আমাকে একটু আবু জাহেলকে দেখিয়ে দিন, আমি বললাম, ভাতিজা তুমি আবু জাহেলকে দেখে কী করবে? কিশোরটি বললো, আমি আল্লাহর সাথে ওয়াদা করেছি যদি তাকে দেখতে পাই তাহলে তাকে হত্যা করবো অথবা নিজে মারা যাবো। কারণ আমি জানতে পেরেছি, আবু জাহেল রাসূলকে গালি-গালাজ করে। আমি ইশারার মাধ্যমে আবু জাহেলকে দেখিয়ে দিলাম। আবু জাহেলের পরিচয় পেয়েই তারা তার দিকে বাজপাখির মতো ছুটে যায় এবং আবু জাহেলকে হত্যা করে। এই দুই নওজোয়ান হলেন হযরত আফরার ছেলে হযরত মুয়ায ও হযরত মুয়াওবিয। দেখুন! সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে প্রিয় নবীর প্রতি কতো ভালোবাসা আর তার দুশমনের প্রতি কতোই ঘৃণা। 
ভয়াবহ এ পরিস্থিতে প্রিয় নবী দুই রাকাত নামায আদায় করে আল্লাহর দরবারে আরজ করেন: হে আল্লাহ! আমি আপনার ওয়াদা পূর্ণ করার দরখাস্ত করছি। আয় আল্লাহ! আপনি যদি চান তাহলে আজকের এই দিনের পর আপনার ইবাদত আর কখনো হবে না। নবীজির উপর এ সময় বিনয়-নম্রতার এক বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তিনি কখনো সেজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কাকুতিবিনতি করে কান্না করতে থাকেন আবার কখনো হাত তুলে বিজয় ও সাহায্য কামনা করতে থাকেন। তিনি দোয়ায় এ পরিমাণ নিবিষ্ট ছিলেন যে, তার কাধ মুবারক থেকে চাদর পড়ে যাচ্ছিলো। হযরত আলী বলেন, আমি বদরের দিন কিছুক্ষণ যুদ্ধকরি। তারপর নবীজির নিকট এসে দেখি, তিনি সেজদায় পড়ে বলছেন, ইয়া হাইয়ু ইয়া কাইয়ুমু। আমি ফিরে গিয়ে আবার যুদ্ধে লিপ্ত হই। দেখি, তিনি আগের মতোই দোয়ায় নিমগ্ন আছেন। তিনবার রাসূলুল্লাহ কে এই অবস্থায় পাই। চতুর্থবার আল্লাহ তায়ালাকে প্রিয় নবীকে বিজয় দান করেন। [নাসাই, ফতহুল বারি]

এরপর তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করতে থাকেন:
سيهرم الجمع ويولون الدبر
অচিরেই এই দলটি শোচনীয়াবে পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালাতে থাকবে। [সুরা কামার: ৪৫]
ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় আছে, নবীজি দোয়া করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েন কিছুক্ষণ পর জাগ্রত হয়ে হযরত সিদ্দিকে আকবরকে ডেকে বললেন, আবু বকর সুসংবাদ, তোমাদের নিকট আল্লাহর সাহায্য চলে এসেছে। এই মাত্র জিবরাইল ঘোড়ার লাগাম ধরে ঘোড়া চালাচ্ছে। তার দাতে ধুলোবালি লেগে আছে। 
হযরত রবি বিন আনাস বলেন, বদরের দিন ফেরেস্তারা যাদের হত্যা করেছে আর সাহাবায়েকেরাম যাদের হত্যা করেছে তাদের আলাদাভাবে চেনা যেতো। ফেরেস্তারা যাদের হত্যা করেছে তাদের ঘাড়ে ও হাতের জোড়ায় জোড়ায় আগুনের কালো দাগ ছিলো। 
মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে আছে, এক আনসারি সাহাবি এক মুশরিককে ধাওয়া করেন। এ সময় তিনি একটি চাবুক ও সাওয়ারির আওয়াজ শুনতে পান। সওয়ারি বলে, হায়জুম! আগে বাড়ো। তারপর সাহাবি দেখেন, সেই মুশরিক যমিনে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার নাক এবং চেহারা চাবুকের আঘাতে ফেটে নীল হয়ে গেছে। আনসারি সাহাবি পুরো ঘটনা রাসূলের নিকট বণৃনা করলে তিনি বললেন, তুমি সত্য বলেছো। এটা তৃতীয় আসমানের সাহায্য ছিলো। [ফাতহুলবারি, ৭: ২৪২]

এ থেকে বুঝা গেল যে, আল্লাহর রাসূলের পবিত্র দৃষ্টি সমগ্র সৃষ্টির প্রতি রয়েছে। একজায়গায় অবস্থান করে তিনি সৃষ্টিজগতের সকল কিছু পরিদর্শন করে থাকেন।
হাদিস শরিফে আছে, যুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করে তখন রাসূল একমুষ্টি মাটি নিয়ে শাহাতিল ওজুহ তথা এ চেহারাগুলো ধ্বংসহোক বলে মুশরিকদের চেহারায় ছুড়ে মারেন। এক মুহুর্তও অতিবাহিত হয় নি, এরই মধ্যে মুশরিকদের এমন কেউ ছিলো না, যার চোখ, নাক ও মুখে এই মাটি গিয়ে পড়েনি। তাদের চেহারার উপর লাঞ্জনার ধূলি ছেয়ে যায়। তারা চোখ মলতে থাকে। তারা দিশেহারা হয়ে যায় যে, কোথায় যাবে কোন দিকে পালাবে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো কাফের বাহিনী লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ওদিকে মুসলমানেরা প্রচন্ডবেগে আক্রমন করে তাদের বন্দি ও হত্যা করতে থাকে। এভাবে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বিজয় দান করেন। সত্যের বিজয় হয়। বাতিল আস্তাকুড়ে নিক্ষিত হয়। [সীরাতে ইবনে হিশাম, ২: ১৮] 

এ যুদ্ধে চৌদ্দজন মুসলিম বীর মুজাহিদ শাহাদাতবরণ করেন। এদের মধ্যে ছয়জন মুহাজির আটজন আনসার। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জান্নাতে উচ্চমকাম দান করেছেন। বদরি সাহাবিদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তারা অবশ্যই জান্নাতি এবং তাদের পূর্বাপর সকল গুনাহ মাফ। সম্পর্কে প্রিয় নবী বলেছেন:
لن يدخل النار احد شهد بدرا অর্থাৎ যে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।
অপরপক্ষে সওরজন কাফির নিহত হয় এবং সত্তরজন বন্দী হয়। এর মধ্যে কুরাইশদের চব্বিশজন সরদারের লাশ নবীজির নির্দেশে একটা নাপাক ও দুর্গন্ধযুক্ত কুপে নিক্ষেপ করা হয়। বন্দিদের মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। দেখুন! পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা নেই যে চিরদুশমন-চিরশত্রু যারা নবীজি ও মুসলমানদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার করে নিজের ভিটেবাড়ী ও মাতৃভুমি ছাড়তে বাধ্য করেছে, সে বন্দিদের সাথে রাহমাতুল্লিল আলামিন সর্বত্তোম ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম বন্দীদেরকে নিজেরা না খেয়ে খাওয়াতেন। তারা নিজেরা কয়েকটি খেজুর খেতেন আর তাদেরকে খাওয়াতেন পেটভরে রুটি। রহমতের নবী মানবতার নবী তাদেরকেও ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাদের সামান্য মুক্তিপণ দিয়ে রেহাই দিয়েছেন। বন্দিদের মধ্যে একজন ছিলেন প্রিয় নবীর চাচা হযরত আব্বাস র. তাকে মুক্তিপণ দিতে বললে তিনি বলেন, আমার কাছে কোনো অর্থ-সম্পদ নেই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, চাচা! তাহলে সে সম্পদ কোথায় যা আপনি এবং উম্মুল ফজল অমুক জায়গায় জমিনের নিচে লুকিয়ে রেখেছেন? আর তাঁকে বলেছিলেন, যদি আমি ওখান থেকে ফিরে না আসি তাহলে এ সম্পদ আমার ছেলে ফযল, আবদুল্লাহ ও কুসুমের জন্য। [সালেহি, সুবুলূল হুদা ওয়ার রাশাদ, ৪:৬৯, নসিমুর রিয়াদ, ৪:১৯৭।]

বদরের বন্দিদের আরেকজন নাওফাল বিন হারেস। তাকে যখন মুক্তিপণ দিতে বললেন, তিনি আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার কাছে এমন কিছু নেই যা দিয়ে আমি মুক্তিপণ আদায় করবো। তখন গায়বের সংবাদাতা নবী বললেন, যে তীরগুলো তুমি জিদ্দায় লুকিয়ে রেখেছো সেগুলো বিক্রি করে আদায় করো। তখন তিনি বললেন, আমি সাক্ষী দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল।

এ হাদিস গুলো থেকে বুঝা গেলো, কোন কিছুই প্রিয় নবী থেকে গোপন নয়। তিনি মানুষের অন্তরের খবরও জানেন। সবকিছু দেখেন। 
মোটকথা, বদরের যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানদের ইমানি চেতনা বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তায়ালার শক্তি-ক্ষমতা ও প্রিয়নবীর মান-মর্যাদা সকলের নিকট স্পষ্ট হয়ে যায়।
---------------------------
 ড. এ. এস. এম. ইউসুফ জিলানী, ঢাকা। 
--------------------------
তারিখ-২৯. ০৪. ২০২১ ইং
Top