রমজানের ফযিলতঃ

মাওলানা সালমান হুসাইন (গোপালগঞ্জ)
রমজান মাস মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস। এ মাস হলো কোরআন নাযিলের মাস। আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঐশীবাণী পবিত্র কুরআন এ মাসেই অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআন অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে পবিত্র কালামে পাকের মধ্যে এরশাদ করেনঃ

شهر رمضان الذي انزل فيه القران

রমযান হলো এমন মাস ,যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।
(সুরা বাকারা আয়াত নং-১৮৫)

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ

انا انزلناه في ليلة مباركة

নিশ্চয়ই আমি তাকে (কোরআনকে) একটি বরকত পূর্ণ রজনীতে অবতীর্ণ করেছি।
(সূরা দুখান, আয়াত নং-০৩)

অপর এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনঃ

انا انزلناه في ليلة القدر

আমি তাকে (কোরআনকে) “লাইলাতুল কদর” বা ভাগ্য রজনীতে অবতীর্ণ করেছি।
(সূরা কদর, আয়াত নং ১)

আর এ মাসেই রয়েছে মহিমান্বিত ও ফজিলতপূর্ণ রজনী “লাইলাতুল কদর” বা ভাগ্য রজনী। যে রজনীতে ইবাদত করাকে আল্লাহ হাজারো মাস ইবাদত করা অপেক্ষা উত্তম বলে আখ্যায়িত করেছেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছেঃ

ليله القدر خير من الف شهر

“লাইলাতুল কদর” বা ভাগ্য রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।
(সূরা কদর আয়াত নং- ০৩)

যেহেতু আল্লাহ তায়ালা এ মাসে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কুরআনুল কারীম অবতীর্ণ করেছেন এবং এ মাসেই “লাইলাতুল কদর” রেখেছেন তাই কোরআন-হাদীসে এ মাসের বিভিন্ন ফজিলত বর্ণিত হয়েছেঃ

  • ১) বরকত পূর্ণ মাসঃ

عن ابي هريرة رضي الله عنه قال لما حضر رمضان قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يبشر اصحابه اتاكم رمضان شهر مبارك فرض الله عز وجل عليكم صيامه

হযরত আবু হুরায়রাহ রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত (রমজান মাস আসলে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে এ বলে সু-সংবাদ দিতেন যে, তোমাদের সামনে রমযান মাস উপস্থিত, যা বরকত পূর্ণ মাস । আল্লাহ তোমাদের উপর রমজানের রোজাকে ফরয করেছেন।
(সুনানে নাসায়ী হাদিস নং ২১০৬, মুসনাদে আহমদ হাদিস নং ৭১৪৮, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হাদিস নং৮৮৬৭)

  • ২) জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয়ঃ

    প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ

اذا جاء رمضان فتحت ابواب الجنه و غلقت ابواب النار و صفدت الشياطين

যখন রমজান মাস আসে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানকে আবদ্ধ করা হয়।
(সহিঃ মুসলিম হাদিস নং ১০৭৯, সহি বুখারি হাদিস নং১৮৯৮, সহি ইবনে খুযাইমা হাদীস নং১৮৮২, সুনানে নাসাঈ হাদিস নং২০৯৭,২০৯৮)

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস কাজী ইয়াজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, রমজান মাসের মর্যাদা ও তাৎপর্যের কারণে আল্লাহ তাআলা জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেন এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেন। এবং মুমিনদেরকে শয়তানের ধোকা ও অনিষ্ট থেকে হেফাজতে রাখার জন্য শয়তানকে আবদ্ধ করে রাখেন।
(আল মিনহাজ খন্ড (৭) পৃষ্ঠা ১৪১)

অপর এক হাদীসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ

اذا كان اول ليله من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن وغلقت ابواب النار فلم يفتح منها باب وفتحت ابواب الجنة فلم يغلق منها باب

যখন রমজান মাসের প্রথম রজনী হয় তখন আল্লাহ শয়তান এবং অবাধ্য জিনদের আবদ্ধ করে রাখেন, এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে রাখেন। তাই( রমজান মাসে) জাহান্নামের কোন দরজা খোলা হয় না। আর জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেন তাই জান্নাতের কোন দরজা বন্ধ করা হয় না।
(সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নং ১৬৪২)

  • ৩) আল্লাহর রহমতের দ্বারসমূহকে উন্মুক্ত করে দেনঃ

    এ মর্মে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

اذا دخل شهر رمضان فتحت ابواب السماء

যখন রমজান মাস আসে তখন আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেওয়া হয়।
(সহি: বুখারী হাদিস নং ১৮৯৯)

  • ৪) কল্যাণের দিকে আহবানঃ

    এ মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ

وينادي مناد يا باغي الخير اقبل ويا باغي الشر أقصر

একজন (ফেরেশতা) ঘোষণা করতে থাকে হে সৎকাজে আগ্রহী ,অগ্রসর হও। হে অন্যায় কাজে আগ্রহী, ক্ষান্ত হও।
(সুনানে তিরমিজি হাদিস নং ৬৮২, সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নং ১৬৪২)

 মর্মে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

اذا كان رمضان فتحت ابواب الرحمه

যখন রমজান মাস আসে তখন রহমতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
(সহিঃ মুসলিম হাদিস নং১০৭৯)

  • ৫) গুনাহ মাফ হয়ে যায়ঃ

    এ ব্যপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ

ورمضان الى رمضان مكفرات ما بينهما اذا اجتنب الكبائر

যদি রোজাদার কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকে তাহলে এক রমযান থেকে পরবর্তী রমযান পর্যন্ত মধ্যবর্তী গোনাহসমূহের কাফ্ফারা হয়ে যায়।
(সহিঃ মুসলিম ২৩৩)

  • ৬) প্রতিদিন অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তিঃ

    প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ

ان لله عند كل فطر عتقاء و ذلك في كل ليلة

নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য মানুষকে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি দেন।
(সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নং ১৬৪৩)

  • ৭) সবরের মাসঃ

    “সবর করা” বা ধৈর্য ধারণ করা মুমিনের অন্যতম গুন। আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন ধৈর্য ধারণ করার অনেক ফজিলত রয়েছে তন্মধ্যে একটি হল জান্নাত প্রাপ্তি। এ মর্মে হাদীসে এসেছেঃ

وهو شهر الصبر والصبر ثوابه الجنه

ইহা সবর বা ধৈর্য ধারণের মাস। আর “সবর” বা ধৈর্য ধারণের প্রতিদান হলো জান্নাত।
(সহীহ ইবনে খুযাইমা হাদিস নং১৮৮৭)

  • ৮) মুমিনের রিযিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়ঃ 

এ ব্যাপারে এরশাদ হয়েছে

شهر المواساة وشهر يزاد فيه رزق المؤمن فيه

ইহা সহানুভূতির মাস। আর এ মাসে মুমিনদের রিজিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
(সহীহ ইবনে খুযাইমা হাদিস নংঃ১৮৮৭)


এছাড়াও রমজানের ফজিলত এর ব্যাপারে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

রোযাদারের বিশেষ ফজিলতঃ

ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ এবং ইসলামের মৌলিক পাঁচটি রুকন বা স্তম্ভের অন্যতম একটি রুকন বা স্তম্ভ হলো রোজা। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ

بني الاسلام على خمس شهاده ان لا اله الا الله وان محمدا رسول الله واقام الصلاه وايتاء الزكاه والحج و صوم رمضان

ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের উপর, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নাই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলা রাসূল এই সাক্ষ্য প্রদান করা, নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, হজ করা, রমজানের রোজা রাখা।
(সহি: বুখারী হাদিস নং ৮ সহি মুসলিম হাদিস নং ১৯-২২)

তাই একদিকে রমজানের রোজা যেহেতু ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন অপরদিকে তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বান্দার উপর ফরয বা আবশ্যকীয় বিধান। আল্লাহ তায়ালা সুস্থ সবল মূকীম (তিনি সফররত অবস্থায় নেই তার) উপর রোজা রাখা ফরজ করেছেন। পবিত্র কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেনঃ

فمن شهيد منكم الشهر فليصمه

তোমাদের মধ্যে যে রমজান মাস পায় সে যেনো রমজান মাসের রোজা রাখে।
(সুরা বাকারা আয়াত নং১৮৫)

তাই একজন মুমিন যেমনিভাবে রোজা পালনের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার বিধান পালন করে তেমনিভাবে উক্ত রোজা রাখার মাধ্যমে সে আল্লাহ তাআলার নিকট নৈকট্য প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়।

  • ১) একজন রোজাদার আল্লাহর পছন্দনীয় মানুষ হতে পারেঃ

    পবিত্র কুরআনুল কারীমে সুরা বাকারার ২৮৩ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন

يا ايها الذين امنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون

হে মুমিনগণ ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়।
(সুরা বাকারা আয়াত ১৮৩)

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন

إن الله يحب المتقين

নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকী বা খোদাভীরুকে ভালোবাসেন।
(সুরা তাওবা আয়াত নং- ০৭)

واعلموا أن الله مع المتقين

তোমরা জেনে রাখ আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে থাকেন।
(সুরা বাকারা আয়াত নং ১৯৪, সূরা তাওবা আয়াত নং ৩৬,১২৩)

  • ২) আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট সুসংবাদঃ

পবিত্র কুরআনুল কারীমে সুরা আহযাবের ৩৫ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
নিশ্চয় মুসলমান পুরুষ ও মুসলমান নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোজা পালনকারী পুরুষ ও রোজা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হেফাজতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী, ইহাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কার।
(সূরা আহযাব আয়াত নং ৩৫)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

من صام رمضان ايمانا واحتسابا غفر له ماتقدم من ذنبه

ঈমানের সহিত আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির আশায় যে রোজা রাখে আল্লাহ তার পূর্ববর্তী গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দিবেন।
(সহি: বুখারী হাদিস নং ১৮৯৪)

অন্য এক হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন

من صامه وقامه ايمانا واحتسابا خرج من الذنوب كيوم ولدته امه

যে ব্যক্তি ঈমানের সহিত প্রতিদান প্রাপ্তির আশায় রমজানের রোজা রাখবে এবং (ইবাদাতে) রাত্রি জাগরন করবে সে ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় যাবতীয় গুনাহ থেকে নিষ্পাপ হয়ে যাবে।
(সহীহ ইবনে খুযাইমা হাদিস ২২০১, মুসনাদে আবু ইয়ালা হাদিস নং ৮৬৩)

  • ৩) রোজাদারের প্রতিদান আল্লাহ নিজেই দিবেনঃ

অন্যান্য আমলের থেকে রোজাদারের রয়েছে বিশেষ ফজিলত । রোজাদারের প্রতিদান আল্লাহ তায়ালা নিজেই দেওয়ার কথা বলেছেন

يترك طعامه وشرابه و شهوته من أجلي الصيام لي و أن اجزي به

রোজাদার আমাকে রাজি খুশি করার জন্য পানাহার এবং যৌন চাহিদা পরিহার করেছে। এবং আমার জন্যই রোজা রেখেছে আমিই আর প্রতিদান দিব।
(সহি বুখারী হাদিস নং ১৮৯৪)

  • ৪) রোজাদারের জন্য রয়েছে বিশেষ দুটি খুশির সময়ঃ

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন

للصائم فرحت يفرحهما أذا أفكر فرح وإذا لقي ربه فرح بصومه

রোজাদারের জন্য রয়েছে দুটি খুশির সময়, ইফতারের সময়, এবং তার প্রতিপালকের নিকট রোজার বিনিময় প্রাপ্তির সময়।
(সহি বুখারী হাদিস নং১৯০৪ সহিঃ মুসলিম হাদিস নং ১১৫৭)

  • ৫) রোজাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয়ঃ

সারাদিন না খেয়ে থাকার কারণে রোজাদারের মুখে যে ঘ্রাণ সৃষ্টি হয় তা আল্লাহ তাআলার নিকট অত্যন্ত প্রিয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,

والذي نفس محمد بيده لخلوف فم الصائم أطيب عند الله من ريح المسك

শপথ ঐ সত্তার যার হাতে মুহাম্মদ (ﷺ) এর জীবন, রোজাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহ তাআলার নিকট মেশকের সুগন্ধির চেয়েও অধিক সুগন্ধিময়।
(সহি: বুখারী হাদিস নং ১৮৯৬, সহিঃ মুসলিম হাদিস নং১১৫১, তিরমিজি হাদিস নং ৭৬৪, সুনানে নাসায়ী হাদিস নং২২১৮,২২১৯)

নোটঃ
উক্ত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তায়ালার নামে শপথ করেছেন। আরবী ব্যাকরণ এর নিয়ম অনুযায়ী কোন বিষয়ের গুরুত্ব ও বড়ত্ব বোঝানোর জন্য এমন কসম করা হয়।

  • ৬) রোজাদারের দোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করেনঃ

হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

ثلاثه لا ترد دعوتهم الامام العادل الصائم حتى يفطر و دعوة المظلوم

তিন শ্রেণীর মানুষ আছে যাদের দোয়া আল্লাহ তাআলা ফিরিয়ে দেন না (কবুল করে নেন) ন্যায়পরায়ণ বাদশার দোয়া, ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত রোজাদারের দোয়া এবং অত্যাচারিত ব্যক্তির দোয়া।
(সহীহ ইবনে হিব্বান হাদিস নং ৭৩৮৭মুসনাদে আহমাদ হাদীস নং৮০৪৩ সুনানে তিরমিজি হাদিস নং৩৫৯৮ সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নং ১৭৫২)

একটি গুরুত্বপূর্ণ নোটঃ
উপরোক্ত হাদীসের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তায়ালার রোজাদারের দোয়া কবুল করেন তবে এজন্য অবশ্যই রোজাদার হালাল জিনিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে এবং হারামকে পরিহার করতে হবে।
কেননা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন

ثم ذكر الرجل يطيل السفر أشعث أغير يمد يديه الى السماء يا رب يا رب ومطعمه حرام ومشربه حرام و ملبسه حرام وغذي بالحرام قأنى يستجاب لذلك

অতঃপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত দীর্ঘ সফর করে ফলে সে ধুলি ধূসরিত রুক্ষ্ণ কেশধারী হয়ে পড়ে। অতঃপর সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, “হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং আহার্যও হারাম। কাজেই এমন ব্যক্তির দু’আ তিনি কবুল না করে কি পারেন?”
(সহি: মুসলিম হাদিস নং- ১০১৫)

  • ৭) রোজাদারের জন্য রয়েছে জান্নাতের বিশেষ দরজাঃ

আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় অনেক বান্দাদের জন্য জান্নাত তৈরি করেছেন। আর আল্লাহ তায়ালার তৈরিকৃত জান্নাতের একটি বিশেষ প্রবেশদ্বার রোজাদারের জন্য নির্বাচন করেছেনঃ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন

ان في الجنه بابا يقال له الريان يدخل منه الصائمون يوم القيامة لا يدخل معهم احد وغيرهم يقال اين الصائمون فيدخلون منه فاذا دخل اخرهم أغلق فلم يدخل منه احد

নিশ্চয়ই জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। কিয়ামতের দিন তা দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবেন। রোজাদার দের সাথে রোজাদার ব্যতীত অন্য কেউ উক্ত প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে রোযাদারগণ কোথায়? তখন রোযাদারগণ উক্ত প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করবেন অতঃপর যখন সর্বশেষ রোজাদার প্রবেশ করবে তখন উক্ত প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দেয়া হবে। ফলে আর কেউ উক্ত প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
(সহিঃ মুসলিম হাদিস নং-১১৫২, সহি বুখারী হাদিস নং-১৮৯৬, সুনানে তিরমিজি হাদিস নং-৭৬৫, সুনানে নাসায়ী হাদীস নং২২৩৬-২২৩৭, সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নং১৬৪০)

  • ৮) রোজাদারের জন্য রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুসংবাদঃ

দুনিয়াতে একজন মুমিনের প্রকৃত সফলতা হল সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে যাওয়ার সংবাদ প্রাপ্ত হওয়া বা জান্নাতে প্রবেশের অধিকার লাভ হওয়া। রোজা এমন একটি ইবাদত, যে ইবাদতের মধ্যে যেমনিভাবে জান্নাত প্রাপ্তির সুসংবাদ উপরোক্ত হাদিসের মাধ্যমে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়েছে তেমনি ভাবে রোজা পালনকারীর জন্য রোজা জাহান্নাম থেকে মুক্তির ঢালস্বরূপ। এ মর্মে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন

الصيام جنة من النار كجنة أحدكم من القتال

তোমাদেরকে তোমাদের ঢাল যেমনিভাবে শত্রু আক্রমণ থেকে যুদ্ধের ময়দানে রক্ষা করে তেমনি ভাবে রোজা রোজাদারকে জাহান্নাম থেকে ঢাল হিসাবে রক্ষা করে।
(সহীহ ইবনে খুযাইমা হাদিস নং ১৮৯১, ২১২৫, ইবনে হিব্বান হাদিস নং৩৬৪৯, মুসনাদে আহমদ হাদিস নং ১৬২৭৩,১৬২৭৮,১৭৯০২,১৭৯০৯, সুনানে নাসাঈ হাদিস নং ২২৩০,২২৩১, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা হাদিস নং ৮৮৯১, সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নং ১৬৩৯)

অপর এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু এরশাদ করিয়াছেন

الصوم جنه وحصن حصين من النار

রোজা জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য ঢাল ও মজবুত দুর্গের সমতুল্য।
(মুসনাদে আহমদ হাদিস নং ৯২২৫)

এছাড়াও কোরআন হাদিসে রোজাদারের ব্যাপারে অসংখ্য ফজিলত এর কথা রয়েছে। তবে এ সকল ফজিলত পাওয়ার জন্য রোজাদারকে কতিপয় কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা অনেকগুলো বিষয় এমন আছে রোজাদার সেগুলো করলে তার রোজা প্রতিদান এবং ফজিলত শূন্য হয়ে যায়। অর্থাৎ সে উক্ত রোযার কোন প্রতিদান ও ফযিলত পায় না ।প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন

و رب صائم حظه من صيامه الجوع و العطش و رب قائم حظه من قيامه السهر

অনেক রোজাদার এমন রয়েছে যারা তাদের রোজার কারণে ক্ষুধার্ত ও (রোজা যথাযথ পালন না করায়) অভিশপ্ত হওয়া ব্যতীত অন্য কোন প্রতিদান প্রাপ্ত হয়না। অনেক রাত্রি জাগরণ করে, অথচ রাত্রি জাগরণের কষ্ট ছাড়া আর কোন প্রতিদান পায় না।
(সহীহ ইবনে খুযাইমা হাদিস নং ৬৫৫১ সহীহ ইবনে হিব্বান হাদিস নং ৩৪৮১, সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নং ১৬৯০)


রোজাদার যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকাঃ


১) 
রোজাদার যাবতীয় ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকবেঃ

ঝগড়া-বিবাদ যেমনিভাবে মানুষের সম্পর্ক এবং পরিবেশকে নষ্ট করে তেমনি ভাবে তা আমলের প্রতিদান নষ্ট করে দেয়। তাই প্রতিটি রোজাদারের জন্য অপরিহার্য যে, কখনোই সে উক্ত জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়বে না। এ মর্মে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

واذا كان يوم صوم احدكم فلا يرفث ولا يصخب فان سابه احد او قاتله فليقل اني إمرؤ صائم

যখন তোমাদের কোন ব্যক্তি রোজা রাখে তখন সে যেন কোন অশ্লীল কথাবার্তা বা ঝগড়া বিবাদ না করে। যদি অন্য কোন ব্যক্তি তাকে গালি দেয় তাহলে সে (রোজাদার) যেন (তার উত্তরে গালি না দেয় বরং সে বলবে) আমি রোজাদার।
(সহি: বুখারি হাদিস নং-১৯০৪, সহিঃ মুসলিম হাদিস নং-১১১৫, সুনানে আবু দাউদ হাদিস নং-২৩৬৩, সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস ৬৮২,৬৮৩)

নোটঃ
ঝগড়া বিবাদ করা সর্বদাই খারাপ কাজ। রমজান মাসে অধিক নিকৃষ্ট উক্ত হাদিসে এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। 
(ফাতহুল বারী খন্ড ৪পৃষ্ঠা ১৪২)

২) মিথ্যা কথা বলা এবং অন্যায় কাজ পরিহার করাঃ

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন

من لم يدع قول الزوج و العمل به فليس لله حاجةأن يدع طعامه وشرابه

যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা এবং অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত থাকবে না তাহলে তার সারা দিন পানাহার থেকে বিরত থাকা আল্লাহ তায়ালার কোন প্রয়োজন নেই।
(সহি: বুখারী হাদিস নং-১৯০৪, সুনানে তিরমিজি হাদিস নং-৭০৭, সুনানে আবু দাউদ হাদিস নং-২৩৬২, সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নং-১৬৮৯)

নোটঃ
এমন ব্যক্তির পানাহারে আল্লাহতায়ালার কোন প্রয়োজন নেই এ কথাটি বলার উদ্দেশ্য হল এমন ব্যক্তি রোজা আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না। তাই এমন বিষয় পরিহার করার জন্য উক্ত হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। একথা উদ্দেশ্য নয় যে, এমন ব্যক্তিদেরকে রোজা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে বরং উদ্দেশ্য হল তাদের এই মন্দ কাজকে পরিহার করতে বলা হয়েছে। (ফাতহুল বারী খন্ড ৪পৃষ্ঠা ৪১)

Top