আমাদের দেশে বাবা শব্দটা শুধু নিজের জন্মদাতার জন্যই নির্ধারিত! আর কারো ক্ষেত্রে বলা যাবেনা। এমনই ধারণা আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে আজব প্রানীরা। রাসুল ﷺ সাহাবিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন,
"আমি তোমাদের বাবার মতো যেহেতু, আমি তোমাদের শিক্ষা প্রদান করি"
(ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, খন্ড ০১, পৃষ্ঠা ০৩, হাদিস নং ০৮)
ইমাম আব্দুর রউফ মানাভী (রহঃ) বলেন, "যিনি মানুষকে শিক্ষা দেন তিনিই উত্তম বাবা।কারণ, তিনি হলেন রুহানী বাবা,দৈহিক বাবা নন"
(তাইসির ১/৩৬১ পৃঃ)
এখন আশা করি বুঝতে পারছেন পিতা শব্দটা জন্মদাতার জন্য খাস নয়। পিতৃতুল্য যেকেউকে আমরা বাবা সম্বোধণ করতে পারি। এটাই আদবে মুহাম্মদী ﷺ। যাকগে, আজ আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই এক মহান মানবকে। যার কথা আমাদের প্রায়ই অজানা। নাম শায়খ হামিদ-ই- ওয়ালি। তবে তিনি সমুঞ্জি বাবা নামেই বেশি প্রসিদ্ধ।
সমুঞ্জি বাবা ছবিটি সামুঞ্জি বাবা / শায়খ হামিদ-ই- ওয়ালি (রহঃ)'র সমাধী
১৩৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মস্থান কাইসেরি। তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন বেশি। তাই তাঁর সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। যতদূর জানা যায়, তিনি অনেক বড় একজন আল্লাহর ওলি এবং বিদগ্ধ আলেমে দ্বীন। কেননা চতুর্দশ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া বড় বড় ওলামাগণ উনারই ছাত্র। সেই বিষয়ে পরেও আসা যাবে। তার আগে জেনে নেই তাঁকে সমুঞ্জি বাবা কেন বলা হয়? তুর্কি ভাষায় 'সমুঞ্জি' অর্থ রুটি। তিনি বুরসা নগরীর অলিতে-গলিতে রুটি বিক্রি করতেন বলেই এই পরিচয়। একজন বড় মাপের আলেম সাধারণ বেশে চলে দেখে অবাক হচ্ছেন তাই না? এবার উনার শিক্ষাজীবন নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। তিনি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে শাম,তিব্রিজ ও ইরানের আর্দবেল শহর সফর করেন। তাঁর সম্মানিত ওস্তাদদের ব্যাপারে কিছু জানা যায় নি। তবে এতটুকু জানা গেছে, তিনি আর্দবেল শহরের প্রসিদ্ধ শায়খ আলাউদ্দিন আর্দবেলির হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। অল্প সময়ে তাসাউফ তথা আধ্যাত্নিক জগতে বিরাট যায়গা দখল করে নেন। হয়ে উঠেন আল্লাহর ওলি। এরপরে বুরসায় আসেন। আগের মতোই জীর্ণ-শীর্ণ কুঠিরে বসবাস করতে থাকেন। এই কুঠিরেই রুটি বানিয়ে খাঞ্জায় ভরে বিক্রির জন্য বুরসার অলি-গলিতে ঘুরতেন। শিশুরা তাঁকে দেখা মাত্রই বলে উঠত- সমুঞ্জি বাবা এসেছেন...সমুঞ্জি বাবা এসেছেন...। খুব তাড়াতাড়ি শিশুরা তার আশেপাশে জমায়েত হয়ে জটলা পাকিয়ে নিতো, তাঁর কাছ থেকে রুটি কিনে নিত। রুটিগুলো যেমনই নরম তেমনই সুস্বাদু। নগরীর সব শিশু-কিশোর ও অধিবাসীরা এই উজ্জ্বল চেহারার মানুষটিকে খুবই ভালোবাসত। তিনিও তাদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি অত্যন্ত আকর্ষনীয় চেহারার অধিকারী ছিলেন। যেন এক অলৌকিত জ্যোতিতে জ্যোতির্ময়।
যাইহোক, তখন বুরসা নগরী ছিল উসমানীয়্যা সালতানাতের রাজধানী। মসনদে সুলতান বায়েজিদ 'ইয়ালদ্রিম'। নিয়ত করেছিলেন নিকোপলিসের যুদ্ধে বিজয়ী হলে বুরসায় একটি মসজিদ করে দিবেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করলেন। বিরাট জয় হলো উসমানীদের। এখন বুরসায় মসজিদ নির্মাণ করার পালা। সুলতান আদেশ দিলেন মসজিদ নির্মাণ করার জন্য। বিরাট অংকের টাকা খরচ করা হলো মসজিদ বানানোর জন্য। মসজিদের নাম দেওয়া হল 'উলু জামে মসজিদ'। নির্মাণ কাজ চলাকালীন মসজিদের নির্মাণ শ্রমিকেরা সমুঞ্জি বাবার কাছ থেকে রুটি কিনে খাওয়া শুরু করল। এভাবে নিয়মিত রুটি কিনতে কিনতে সমুঞ্জি বাবার সাথে তাদের একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। দেখতে দেখতে উলু জামে মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ হল। ইসলামী অট্টলিকার অনন্য নির্দশন হিসেবে মসজিদটি এখনো মানুষের নজর কাড়ে। যাইহোক, এবার মসজিদের উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঠিক হল। নামাজ শুরু হবে জুমআর নামাজের মাধ্যমে। জুমআর দিন সুলতান বায়েজিদ মন্ত্রীবর্গ,উলামা ও বুরসার জনগনকে নিয়ে নবনির্মিত এই মসজিদে আসলেন। প্রশস্ত আঙ্গিনার মসজিদটি তখন কানায় কানায় ভরা। সুলতান বামে তাকিয়ে আমির সুলতানকে দেখে বলে উঠলেন, " আপনিই নামাজ পড়ান"। আমির সুলতান মিম্বরের কাছে এসে দাড়ালেন। চারিদিকে তাকাচ্ছেন। কাউকে যেন খুঁজছেন। সমুঞ্জি বাবার দিকে চোখ পড়ার সাথে সাথেই আঙ্গুল প্রদর্শন করে বলতে লাগলেন, 'এ মসজিদে খুতবা প্রদানের জন্য এই ব্যাক্তির চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই!' সবাই অবাক! তারা সমুঞ্জি বাবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতে আরম্ভ করল! এতে তিনি অস্বস্থি বোধ করছিলেন। কেননা এতদিন নিজেকে গোপন রাখতে পারলেও এখন আর পারলেন না। আমির সুলতান সব ফাঁস করে দিলেন। এতোদিন মানুষ তাঁকে রুটিওয়ালা ছাড়া আর কিছু জানতো না। এখন সব জানাজানি হয়ে গেল!
বাধ্য হয়ে তিনি দাড়ালেন। মিম্বরের দিকে এগিয়ে গেলেন। জনাকীর্ণ বিশাল চোখগুলো তাঁর দিকে এক অবাক দৃষ্টীতে তাকিচ্ছিল! মিম্বরে আরোহনের আগে তিনি একটু ঝুঁকে আমির সুলতানের কানে কানে একটু অনুযোগের সুরে বললেন, "একি করলেন ভাই! সব মানুষের সামনে আমায় ফাঁস করে দিলেন?"
আমির সুলতানও কানে কানে উওর দিল, "এ মসজিদে খুতবা প্রদানের জন্য আপনিই উপযুক্ত!"
ছন্মবেশী ওলি অবশেষে মিম্বরে আরোহন করলেন, আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুল ﷺ এর উপর সালাম পাঠ করলেন, এরপর সুরা ফাতিহা তিলওয়াত করলেন। এরপর ৭ টি পন্থায় সুরা ফাতিহার তাফসির করতে শুরু করলেন।