- আমিরে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর আলোচনা কেন করতে হবে?
- কৃতঃ রাফীহান
এ বিষয়ের আলোচনাকে আমরা তিনটা ভাগে ভাগ করবো।প্রথমত সাহাবায়ে কিরাম রিযওয়ানুল্লাহি আলাইহিমগণের মর্যাদা,এরপর উনাদের প্রতি আমাদের কিরূপ ধারণা থাকা উচিত সেটা এবং সবশেষে আমরা আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ এর মানাকিব/জীবনাদর্শ তুলে ধরার যৌক্তিকতা তুলে ধরবো।
মাকামে সাহাবিয়ত বা সাহাবিয়তের পদমর্যাদা কি?
রাফেযীয়ত রদ বিষয়ক জগৎবিখ্যাত কিতাব “আস-সাওয়ায়িক আল মুহরিকা ফি রদ্দে আলাল বিদ’আ ওয়া যিন্দীকাত’ কিতাবের সূচনা লাইনে আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী মক্কী র. শুরু করেন এভাবে,
“আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাযিখতাসসা নাবিয়্যাহু মুহাম্মাদান ﷺ বি আসহাবিকান নুজুম”।
বা, সেই আল্লাহর জন্য হামদ,যিনি তার নবীকে খুসুসিয়ত(বিশেষত্ব) প্রদান করেছেন (নুজুম, বা) তারকাতূল্য সাহাবীগণের (সঙ্গের) মাধ্যমে।
নবীপাকের সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারে প্রশ্নতোলার ধৃষ্টতা কোনো আহলুস সুন্নাহপন্থী করতে পারেনা।সেটা ভদ্র ভাষায় হোক,কিংবা কুজন্মাদের ভাষায় হোক।সাহাবীয়তের মকাম অতিউচ্চ।
যেমন আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন,
{مُحَمَّدٌ رَّسُوۡلُ اللّٰہِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ مَعَہٗۤ اَشِدَّآءُ عَلَی الۡکُفَّارِ رُحَمَآءُ بَیۡنَہُمۡ تَرٰىہُمۡ رُکَّعًا سُجَّدًا یَّبۡتَغُوۡنَ فَضۡلًا مِّنَ اللّٰہِ وَ رِضۡوَانًا ۫}।(সূরা ফাতহ,অন্তিম আয়াত)
অর্থাৎ,মুহাম্মদ ﷺ আল্লাহর রসুল এবং তার সাথে যারা আছে,কাফিরদের উপর কঠোর এবং পরস্পরের মধ্যে দয়াশীল।তুমি তাদেরকে দেখবে রুকুকারী এবং সাজদারত।
কোরানুল করীমের উক্ত আয়াত দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে,আল্লাহর দ্বীনের খাতিরে,সাহাবায়ে কিরাম রিযওয়ানুল্লাহি আলাইহিম ওয়া আজমাঈন ছিলেন পরস্পর পরস্পরের ঢালস্বরূপ এবং কাফিরদের বিরুদ্ধেই তারা ছিলেন কেবলমাত্র কঠোর এবং সংঘবদ্ধ।
➤আল্লামা কাযী সানাউল্লাহ উসমানী হানাফি মাযহারী নকশবন্দী পানিপাথী র.(1225 হি) ‘তফসিরে মাযহারী’ তে উল্লেখ করেন ,ইমাম মুহিউসসুন্নাহ বাগাবী বলেন, আল্লাহ পাক ইঞ্জিল শরীফে সাহাবীগণ সম্পর্কে বলেন শুরুতে তারা হবে স্বল্প সংখ্যক। তারপর ক্রমান্বয়ে সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে তাদের। হযরত কাতাদাহ র. বলেছেন, রসুল ﷺ ও তাঁর সাহচর্যধন্যগণের সম্পর্কে ইঞ্জিলে বলা হয়েছে তাদের বর্ধিষ্ণুতা হবে জমির ফসলের চারার মতো। তারা সৎকাজের আদেশ দিবে এবং নিষেধ করবে মন্দ কাজ করতে। কারো কারো কাছে এখানকার ‘চারাগাছ’ অর্থ রসুলﷺ স্বয়ং এবং সেই গাছের ফুলকলি হচ্ছেন তাঁর অনুচরবর্গ ও অন্যান্য বিশ্বাসীগণ।
মুবারক ইবনে ফাদ্বালাহ সূত্রে ইমাম হাসান বসরী র. বলেছেন, এখানে
→’আল্লাযিনা মা’আহু’ অর্থ হযরত আবু বকর ,
→’’আশিদ্দাউঁ আলাল কুফ্ফার” অর্থ হযরত ওমর,
→’রুহামাউ বাইনাহুম’ অর্থ হযরত ওসমান
→ ‘তারাহুম রুককাআন সুজজ্বাদান অর্থ হজরত আলী আলাইহিমুস সালাম এবং⁽¹⁾[1.তফসিরে খাযেন,৪/১৭৩,আল্লামা আলাউদ্দিন বাগদাদী খাযেন]
→’ইয়াবতাগুনা ফাদ্বলাম মিনাল্লহি ওয়া রিদ্বওয়ানা” এর অন্তর্ভূত আশারা মুবাশশারাগণ (দশজন বেহেশতের সুসংবাদ প্রাপ্ত সাহাবী)।
অর্থাৎ আলোচ্য আয়াতে সাহাবীগণের যে সকল গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে, সে সকল গুণাবলীর অগ্রনায়ক হচ্ছেন আশায়েরা মুবাশ্শারাগণ। মানে, রসুল ﷺ একটি বীজ বপণ করেছেন, হযরত আবু বকর রাঃ ঘটিয়েছেন তার অঙ্কুরোদগম। হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাঃ তাকে শক্তি যুগিয়েছেন এবং হযরত আলী রাঃ 'র সাহায্যে সে গাছ স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে শক্ত কাণ্ডের উপর।
‘তফসিরে মাদারিক’ রচয়িতা লিখেছেন, হযরত আবু বকরের কারণে ইসলাম বৃক্ষের অঙ্কুরোদগম ঘটতে পেরেছে। ইমাম বাগবী লিখেছেন, হযরত ওমর ইসলাম গ্রহণের পরক্ষণেই বলেছেন, এখন থেকে আল্লাহর ইবাদত আর গোপনে করা হবে না।
এখানকার ‘লিইয়াগীজা বিহিমুল কুফফার (কাফেরদের প্রতি কঠোর) এর ‘বিহিম’ সর্বনাম দ্বারা ‘আল্লাযিনা মাআ’হুম (যারা তাঁর সাহচর্য পেয়েছেন) কে বুঝায় কিংবা অর্থের দিক দিয়ে এর দ্বারা ‘শাত্বআহ’ (ফসলের ক্ষেত) কে বুঝানাে হয়েছে। কেননা এখানে ‘যা থেকে উদ্গত হয় কিশলয়’ অর্থ এখানে তাঁরা, যাঁরা ইমান এনেছিলেন ইসলামের সূচনালগ্নে। এভাবে তাদেরকে এবং পরবর্তীকালে সকল সাহাবীগণকেই আল্লাহ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভুতিশীল এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যটি দান করেছিলেন।
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাঃ বলেছেন, এখানে যারা সাহাবীবিদ্বেষী, তাদেরকে লক্ষ্য করেই বলা হয়েছে এভাবে আল্লাহ মুমিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা কাফেরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন।
—এতটুকু পর্যন্ত তফসিরে মাযহারীর উদ্ধৃতি সমাপ্ত।
➤সাহাবীদের মর্যাদা এতই উচ্চ যে, উনারা যেনো একেকজন ধ্রুবতারা।
রাসূল(ﷺ) ইরশাদ করেন, “আমার সাহাবারা হল তারকা সদৃশ। অতএব তোমরা তাদের যে কোন এক জনের অনুসরণ করলেও হেদায়াত লাভ করবে।’’⁽²⁾
[2.★আল মাদখাল,১/১৬৩,#১৫২ ইমাম বায়হাক্বী
★তালখীসুল খাবীর,৪/৪৬২,ক্রম ২০৯৮, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী]
➤আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ (জান্নাতে) সর্বোচ্চ সম্মাননায় আসীন লোকদেরকে অবশ্যই তাদের নীচের মর্যাদার লোকেরা দেখতে পাবে, যেমন তোমরা আসমানের দিগন্তে উদিত তারকা দেখতে পাও। আবূ বাকর ও উমার তাদেরই দলভুক্ত, বরং আরো বেশি রহমাত ও মর্যাদার অধিকারী।⁽³⁾
[3.★সুনানু তিরমিযী,#৩৬৫৮,ইমাম হাকিম তিরমিজী
★সুনানু আবু দাউদ,#৯৬,ইমাম আবু দাউদ]
➤ইমামুল হেরেম আল্লামা মুহিবউদ্দীন ত্বাবারী র. উনার রিয়াদুন নাদারা গ্রন্থে,১/১৮,উল্লেখ করেন,হযরত জাবের রাঃ থেকে বর্ণিত,নবীজী বলেন, “ঐ মুসলিমকে দোযখের আগুন স্পর্শ করবেনা যে আমাকে দেখেছে(সাহাবী) এবং যে আমাকে দেখেছে তাকে দেখেছে(তাবী’য়ুন)।⁽⁴⁾
[4.★তিরমিযী,#৩৮৫৮,প্রাগুক্ত।
★সাওয়ায়িকে মুহরিকা,৫০পৃষ্ঠা,ইমাম ইবনে হাজার হায়থামি মাক্কি।
★কানযুল ‘উম্মাল,#৩২৪৮০,ইমাম মুত্তাকিউল হিন্দী]
আর সুসংবাদ সেই সকল কিসমত ধারীদের যাদের অন্তরে হুব্বে সাহাবা বা সাহাবীরপ্রতি ভালবাসা স্থান পেয়েছে।
➤কেননা নবীজী ﷺ বলেন,
“ আল্লাহ যদি কারো মঙ্গল কামনা করেন,তবে তিনি ঐ ব্যক্তির অন্তরে/ক্বলবে আমার সাহাবীদের প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন।“⁽⁵⁾
[5.★সাওয়ায়িক,৪৭পৃষ্ঠা।প্রাগুক্ত।
★কানযুল উম্মাল,#৩২৪৮২,প্রাগুক্ত
★জামেউস সগীর, #১৩৪০,ইমাম সূয়ুতি।
★তারিখে আসবাহান,৯২৯পৃষ্ঠা,ইমাম আবু নইম আসবাহানী]
সাহাবীদের ব্যাপারে কি আক্বিদা থাকা উচিতঃ—
সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারে আমাদের কেমন আক্বিদা রাখতে হবে সে সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
সূরাতুল আম্বিয়া আয়াত নং ১০১,আল্লাহ বলেন,
“নিশ্চয় যাদের জন্য আমাদের কাছ থেকে পূর্ব থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে তাদেরকে তা থেকে দূরে রাখা হয়েছে।“
➤তফসিরে ইবনে কাছীর এ এই আয়াতে নু’মান বিন বাশিরের সূত্রে উল্লেখ আছে,আলী রাঃ বলেন,এই আয়াতের অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে আমি, আবুবকর, উমর , উসমান,তালহা,জুবায়ের,আব্দুর রহমান বিন আউফ এবং সা’দ আছি।(6)
[6.★তফসিরে দুররে মনসুর,৪/৩৩৯,ইমাম সুয়ুতী
★তাখরিজে আহাদীসিল কাশশাফ,২/৩৭১,আল্লামা যামাখশারী মুতাযেলী
★আল কামিল,৩/৯৭৬,ইমাম ইবনে আদী]
ঐ কিতাবে শু’বার সূত্রে বর্ণিত,আলী রাঃ বলেন, এখানে উসমান রাঃ এবং তার সাথিদের বুঝানো হয়েছে।(7)
[7.★মুসান্নাফ,১২/৫১_৫২,ইবনে আবি শায়বা
★তাফসিরে তাবারী,১৬/৪১৬,ইমাম জারির আত-তাবারী]
এই আয়াতের উপরোক্ত দুটি তাফসির দ্বারা স্পষ্ট হয় যে,আশারায়ে মুবাশশিরা সহ, সকল সাহাবী,বিশেষত হযরত উসমানের বন্ধুবর নবীজীর সাহাবীগণ [উদাহরণ স্বরূপ,হযরত আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ,যিনি হযরত উসমানের চাচাতো ভাই ছিলেন] উনারা দোযখ হতে দূরে অর্থাৎ জান্নাতে থাকবেন।
আল্লাহ রব্বুল আলামিন আরো বলেন,
“আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন”। (সুরাতুল বারা’আত- ১০০)
এই আয়াতের তাফসিরে জমহুর/বড় এক জামাত মুফাসসির একত্রিত হয়েছেন,এটা সাহাবীদের শানে উল্লেখিত আয়াত। এটা থেকে স্পষ্ট হলো,আল্লাহ রব্বুল আলামিন সাহাবায়ে কেরামের উপর রাযি হয়েছেন।
➤হাফেয ইমাম ইবনে আব্দিল বার মালেকী উনার ‘ইস্তিয়াব ফি মারিফাতিল আসবাব’ গ্রন্থের ভুমিকায় উল্লেখ করেন,”আল্লাহ একবার যাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন,ইন শা আল্লাহ তাদের প্রতি কখনো অসন্তুষ্ট হবেন না”।(8)
[8.★এই রেফারেন্সটি আমরা পাকিস্তানের মুফতী শফি সাহেবের(দেওবন্দী আলেম) সাহেবের ‘মকামে সাহাবা’ গ্রন্থে হতে নিয়েছি।]
➤ফিকহুল আকবর কিতাবে উল্লেখ আছে,
“নবীদের (আ) পরে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা),তারপর হযরত উমর ইবন আল-খাত্তাব আল ফারূক (রা), তারপর হযরত উসমান ইবন আফফান যুননূরাইন (রা),তারপর হযরত আলী ইবন আবু তালিব আল মুরতাজা (রা)। এরা সবাই ছিলেন ইবাদতকারী, সত্যের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং সর্বদা অবিচল।এদের সবাইকে আমরা ভালবাসি। রাসূলুল্লাহ্ ﷺএর সাহাবীদের কাউকে আমরা উত্তম ছাড়া খারাপ বলিনা।“
➤একই ভাবে,ইমাম আবু জাফর ত্বাহাবী র. সাহাবীদের ব্যাপারে যে আকিদা আমাদের থাকা উচিত,সে ব্যাপারে উনি উনার আকিদার কিতাবে উল্লেখ করেন,
→”আমরা আল্লাহ তা’আলার রাসূল মুহাম্মদ ﷺ এর সাহাবীদেরকে ভালোবাসি।
→ভালোবাসার ক্ষেত্রে তাদের কাউকে নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করি না।
→আবার কারো ব্যাপারে অসম্ভুষ্টিও প্রকাশ করি না।
→যারা তাদেরকে কটাক্ষ করে আমরা তার প্রতি বিদ্বেষ রাখি এবং যারা তাদেরকে অসতভাবে স্মরণ করে আমরা তাদেরকে ঘৃণা করি।
→আমরা তাদের উত্তম আলোচনাই করবো“।
এরপর উনি আরো লিখেন,”সাহাবায়ে কেরাম রাঃ এর প্রতি ভালোবাসা দীন,ঈমান ও ইহসানের বহিঃপ্রকাশ।তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা কুফরি,কপটতা ও অবাধ্যতারই নামান্তর।“
এই কথাটা খুবই প্রয়োজনীয় এই যুগের জন্য।কারণ একদল লোক আহলুসসুন্নাহ দাবি করে,কিন্তু ভদ্র ভাষায় আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ কে গালি দেয়।অথচ হানাফী মাজহাবের ইমাম বলছেন,এটা কুফরি,মুনাফেকী।
➤ইমাম কাযী আয়্যায ‘শিফা শরীফ’ এ উল্লেখ করেন,’ইমাম মালেক বিন আনাস র. বলেন,যে ব্যক্তি হযুর ﷺএর সাহাবাদের মধ্যে যেকোনো এক সাহাবাকে গালি দেবে বা এরূপ বলবে যে,
→হযরত আবু বকর, উমর, ওসমান, মুয়াবিয়া, আমর বিন আস রাঃ প্রমুখ কুফর ও ভ্রষ্টতায় লিপ্ত হয়েছে (নাউযুবিল্লাহ), এ ধরণের লোকদের হত্যা করে ফেলতে হবে। যদি এ ধরণের কথা না বলে, কেবল তাদের সম্পর্কে এ কথা বলে গালমন্দ করে যেমন সাধারণ লোককে করা হয়, তখন তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।(9)
[9.আশশিফা বি তা’রিফে হুকুকিল মোস্তফা,২য় খন্ড,বাব আল হুকমু ফি সাব্বা আলে বায়তি ওয়া আযওয়াজি ওয়া আসহাবি;কাযী আয়্যায বিন মুসা আল-মালেকী আন্দালুসি র.]
➤ইমাম মুসলিম র. উনার ‘সহিহ মুসলিম’ এ ‘কিতাবু ফাযায়িলুস সাহাবা’ অধ্যায়ে ‘বাব তাহরিমি সাব্বিস সাহাবা’ বা ‘সাহাবিদের গালি দেয়া হারাম’ মর্মে একটি তরজুমাতুল বাব বা পরিচ্ছেদ রচনা করেছেন।এখানে একটি হাদীস তিনটি ভিন্ন সনদে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যেখানে নবীজি বলেন,”তোমরা আমার সহাবীদের কাউকে গাল-মন্দ করবে না। কারণ, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পর্বতের সমতুল্য স্বর্ণ খরচ করে তবুও তাদের এক মুদ অথবা অর্ধ মুদের ন্যায় হবে না।“
➤তাবারানি তার মধ্যম মু’জাম,৭/৬ হাদীস নং ৬৬৮৭,এ উল্লেখ করেন,ইবনে আব্বাস রাঃ বর্ণনা করেন,নবিজি ﷺ তাঁর পবিত্র মাথা মুবারক আকাশের প্রতি উত্তোলন করলেন।বললেন, “তারকারাজি আকাশবাসীদের জন্য নিরাপত্তার কারণ।আমি আমার সাহাবীদের জন্য নিরাপত্তার কারণ,আর আমার সাহাবীরা আমার উম্মতের জন্য নিরাপত্তার কারণ।"(10)
[10.★মুজমাউয যাওয়ায়েদ,১০/১৭,ইমাম হায়সামী
★আল আমালিউল মুতালাকা,৬২পৃষ্ঠা,ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী র.]
➤ইবনে মাজাহর ভুমিকায়,বাব ফাদ্বলে আহলে বদর বা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের ফজিলত পরিচ্ছদে উল্লেখ,ইবনু উমার (রাঃ) বলতেন, তোমরা নবীজী ﷺ এর সাহাবীদের গালি দিও না। অবশ্যই তাদের কারো এক মুহূর্তের সৎকাজ তোমাদের কারো সারা জীবনের সৎকাজের চেয়েও উত্তম।(11)
[11.সুনানু ইবনে মাজাহ,#১৬২]
আদনা বা নিচু পর্যায়ের একজন সাহাবীর মর্যাদা কোটি গাউস কুতুব অপেক্ষা আফজল।খায়রুত তাবেয়ীন বা উত্তম তাবেয়ী ওয়াইস করনী রাঃ এর মর্যাদা সাহাবীদের নিচে।আর বর্তমান কালে দেখা যায় নিজেকে স্কলার ভাবা কিছু লোকজন,মুয়াবিয়া রাঃ কে গালি দেয়াকে তাদের শিল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে।
এই সমস্ত লোকের অবস্থা হযরত উমর রাঃ বেঁচে থাকলে কি করতেন তা কাযী আয়্যায উল্লেখ করেন।
➤হযরত উমর রাঃ সম্পর্কে বর্ণিত, তিনি ওবায়দুল্লাহ বিন আমরের জিহ্বা কেটে দেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। কারণ সে হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ রাঃ কে গালি দিয়েছিলেন হযরত উমর রাঃ বললেন, অপেক্ষা করো আমি তার জিহ্বা কেটে দেবো যাতে তারপর আর কেউ হুযুর ﷺ এঁর কোনো সাহাবাকে গালি দেয়ার দুঃসাহস না করে।(12)
[12.★নাসিমুর রিয়াদ্ব- শরহুর শিফা গ্রন্থে একই অধ্যায়ে ইমাম শাহাবুদ্দিন খাফফাযি হাদীসটি উল্লেখ করেছেন।
★শরহুশ শিফা গ্রন্থে,ইমাম সুলতান মুল্লা আলী ক্বারী র. উল্লেখ করেন।]
আমিরে মুয়া'বিয়া রাঃ এর আলোচনা কেনো জরুরিঃ—
➤আমরা কেনো আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ এর যিকর বা আলোচনা করবো?
✪কারণ,পৃথিবীর বুকে কুরানুল কারীমের পর সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য গ্রন্থটি,সহিহ বুখারী,এতে আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ ‘র আলোচনা করা হয়েছে।নাম দেয়া হয়েছে,”বাব-উয-যিকরে মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু”।(কিতাবুল মানাকিব)
➤আমরা কেনো মুআবিয়ার জীবনাদর্শ তুলে ধরবো?
✪কারণ,ইমাম তিরমিযী,আমিরে মুয়াবিয়ার জীবনে আদর্শ খুজে পেয়েছেন।আবওয়াবুল মানাকিব বা জীবনাদর্শের অধ্যায়ে তাঁর জীবনাদর্শ/মানাকিব তুলে ধরেছেন।নাম দিয়েছেন,”বাব-মানাকিবিল মুআবিয়া বিন আবু সুফিয়ান রাঃ”।
➤আমরা কেনো আমিরে মুয়াবিয়ার ফযিলত বা মর্যাদা আলোচনা করবো?
✪কারণ,ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাঃ উনার বিশ্বকোষ মুসনাদের পাশাপাশি আরো একখানা কিতাব লিখেছেন।এর নাম “ফাদ্বায়িলুস সাহাবা”। এর ২য় খন্ডে “ফাদ্বায়িলে মুআবিয়া বিন আবি সুফিয়ান রাঃ'' নামে অধ্যায় রচনা করা হয়েছে।
➤আমরা কখনোই আলীর সাথে মুয়াবিয়ার তুলনা করিনা।কারণ হায়দারে কাররার আলী (আলাইহিস সালাম/কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুল কারীম) এর মর্যাদার সমকক্ষ কখনো আমিরে মু’আবিয়া হতে পারবেন না।উনি আশারায়ে মুবাশশিরা বা বদরী সাহাবীর সম্মানেও সম্মানিত বা ফজিলতপূর্ণ হতে পারবেন না।তবে হ্যাঁ,উনার নিজস্ব মকামে উনার যে ফজিলত তা আর কারো নেই।এবং সেটাই আমাদের আলোচনার বিষয়,সমালোচনার নয়।
লক্ষকোটি গাউস-কুতুব-আবদাল এমনকি খায়রুত্তাবিয়ুন ওয়াইসে করণির সম্মানও আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ এর নিচেই।
➤আমিরুল মুমেনীন(13)হযরত মু’আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম ছিলেন মু’আল্লাফাতুল ক্বুলুব শ্রেণির সাহাবী।(14) উনি একজন ফকিহ এবং রসুলুল্লাহ ﷺ এর সাহচার্য লাভকারী সাহাবী ছিলেন।(বুখারী,বাব উয যিকরে মু’আবিয়া)।
[13.বুখারী, কিতাবুল মানাকিব, #৩৭৬৫ নং হাদীস।
14.মাদারেজুন নবুয়ত,কিতাবের শেষভাগে আক্বা-মওলা ﷺ এর লেখকগণের তালিকায় উনার বর্ণনা অংশে।শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহঃ]
আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ এর পরিবারের সাথে মুসলিম দের যে শত্রুতা ছিল, আল্লাহ তা সমাধান করে দিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করে দিয়েছেন যেখানে আর দ্বিতীয় কথার কোনো সু্যোগ নেই। আল্লাহ বলেন,
“যাদের সাথে তোমাদের শক্ৰতা রয়েছে, আশা করা যায়, আল্লাহ তাদের ও তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন।“— মুমতাহিনাঃ ৭
➤হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন, “আসাল্লহু আঁইইঁয়াজ’আলা......মিনহুম মাওয়াদ্দাহ” — এই আয়াতে মাওয়াদ্দা বা সম্প্রীতি/ভালোবাসা দ্বারা নবীজীর স্ত্রী আম্মাজান উম্মে হাবিবা সালামুল্লাহিআলাইহা এর সাথে নবীজীর বিবাহ মুবারক এর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।(বিবাহের ফলে)উনি মুমিনদের আম্মাজান হয়ে গেলেন,এবং আমিরে মু’আবিয়া রাঃ মুমিনদের মামা হয়ে গেলেন (ওয়াখালাল মুমিনিন)।(15)
এ থেকে বুঝা গেলো আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ এর ফযিলত উনার স্থানে অনেক সমুন্নত।
[15. ★তফসিরে দুররে মনসুর,৬/২০৫,ইমাম সূয়ুতি
★আল কামিল লিদ্ব-দ্বু’আফা,২/২১২৯,ইমাম ইবনে আদী
★দালায়েলুন নবুয়ত,৩/৪৫৯,ইমাম বায়হাক্বী
★তারিখে দামেষ্ক,৩/২০৭,ইমাম ইবনে আসাকির.]
➤ইমাম বুখারী উনার তারিখুল কবিরে সেই বিখ্যাত দোয়াখানি লিপিবদ্ধ করেছেন যা নবীজি আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ এর জন্য করেন,”হে আল্লাহ!আপনি তাকে হেদায়েতকারী এবং হেদায়েত প্রাপ্ত করুন।“(16)
[16.★তারিখুল কাবির,৫/২৪০,ইমাম বুখারী
★মুসনাদ, ৪/২১৬ বা ১৭৯২৯নং, ইমাম আহমদ
★জামে তিরমিজী,#৩৮৪৩
★আহাদীসিল মাছানী,#৩১২৯,ইমাম ইবনে আসেম।
★আল হিলইয়াতুল আউলিয়া,৮/৩৫৮,ইমাম আবু নইম আসবাহানী]
➤আরো বলেছেন,”হে আল্লাহ! আপনি মুয়াবিয়াকে কিতাব এবং গণিতের ইলম দিন।তাকে আযাব হতে সুরক্ষিত করুন।“(17)
ইমাম জওরকানি দ্বিতীয় দোয়াটি উল্লেখ করে বলেন, “হাযা হাদীসুন মশহুর”। বা এই হাদীসটি প্রসিদ্ধ।
[17.★কিতাবুল আবাত্বিল,১৮১নং হাদীস(দার ইবনে হাযাম),ইমাম জওরকানী।
★মুসনাদু আহমদ,৪/১২৭,ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল]
➤খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আযিয রহঃ কে আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ এর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে উনি বলেন,মুয়াবিয়া রাঃ নবীজী ﷺ এর সাহাবী,উঁনার শ্যালক,উঁনার দরবারের লেখক এবং উনি আল্লাহর ওহীর আমানতদার।উনি বলেছেন,নবীজী বলেন, “যে আমার সাহাবীকে গালি দিবে, তার উপর আল্লাহ,ফেরেশতা,সমস্ত ইনসান সবার লানত।“(18)
ইমার জওরকানী বলেন এই হাদীসটিও মশহুর।
[18.★কিতাবুল আবাতিল,#১৮৪ নং,প্রাগুক্ত।]
➤বুখারীতে , ২৯২৪ এ, উল্লেখ,‘উমাইর (রহ.) বলেন, উম্মু হারাম (রাঃ) আমাদের নিকট বর্ণনা করেন, তিনি আল্লাহর রাসূল ﷺ-কে বলতে শুনেছেন যে, আমার উম্মাতের মধ্যে প্রথম যে দলটি নৌ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবে তারা যেন জান্নাত অবধারিত করে ফেলল।
ইমাম ইবনু হাজার আসকালনী এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন এটা কেবল মুয়াবিয়ার মানাকিবেই। কেননা তিনিই প্রথম সমুদ্র অভিযান করেন। (ফতহুল বারী ৬/১২৭)।ইমাম বদরুদ্দিন আইনী বলেন,এটি মুয়াবিয়ার ফজিলত। (উমদাতুল ক্বারী ১০/৮৯)
➤নবীজী তো আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ এর জন্য ভবিষ্যদ্বাণি করেই গিয়েছেন।উনি ﷺ বলেন-
“এ দ্বীনের নবুওয়াতের যুগটি হবে রহমতের,এরপর খিলাফত আসবে সেটিও রহমত এরপর রাজত্বের(আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ) যুগ আসবে সেটিও হবে রহমতের(এরপর ফিতনার কথা উল্লেখ আছে)।(19)
[19.★মুস্তাদতাকে হাকেম ৪/৫২০ হাঃ ৮৪৫৯।ইমাম হাকেম নিশাপুরী
★কিতাবুল ফিতান, আবু নুয়াইম ইবনু হাম্মাদ পৃঃ২৩৬।
★জামেউল মাসায়েল, ইবনু তাইমিয়্যাহ ৫/১৫৪।
★হাদিসটির সনদ সহীহ। ইমাম হাইসামী তার মাজমাউয যাওয়ায়েদে বলেন এ হাদিসটি তাবারানী বর্ণনা করেছেন এর সকল রাবী সিক্বাহ।(আলবানির সহিহা ৩২৭০)]
➤একদিন নবীজী ﷺ উনার নখ মুবারক কাটলেন এবং তা সাহাবীদের মধ্যে বিলি করে দিলেন।(20)
[20.★মুসনাদ,১৬৪৭৪ ১৬৪৭৫ নং হাদীস
★যিকরে জামিল,৩৪০পৃষ্ঠা(ইংলিশ ভার্সন), আল্লামা মুফতি শফী উকাড়বি]
➤এবং এই নখের কিছু অংশ হযরত আমিরে মুয়াবিয়া রাঃ এর নিকট ও ছিল।যেগুলো উনি উনার ওফাতের পর উনার চোখ এবং মুখে দেয়ার জন্য অসিয়ত করে যান।(21)
[21.উসুদুল গাবা ফি মা'আরিফাতিস সাহাবা ,৪/৩৮৭,ইমাম ইবনে আছীর।]
➤➤সর্বশেষে গাউছুসসাক্বালাইন রাঃ এর একটি উক্তি দ্বারা শেষ করতে চাই।আল গুনিয়াহ কিতাবের ১৭৫ পৃষ্ঠায় লিখেন:
“ হযরত আলী রাঃ এর সাথে হযরত তালহা, যুবাইর, আয়েশা, মুয়াবিয়া রাঃ যুদ্ধের ব্যাপারে হযরত ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন, তাদের কোন সমালোচনা করা যাবে না। তাদের মধ্যে যা হয়েছে এগুলী আল্লাহ কিয়ামতের দিন সমাধান করে দিবেন। কুরআনে পাকে রাব্বুল আ’লামীন ঘোষণা দিয়েছেন জান্নাতীদের অন্তরে একে অপরের প্রতি যে বিদ্ধেষ ছিল (দুনিয়াতে) এগুলোকে দূরীভূত করে দিবেন।
কেননা, হযরত আলী রাঃ ছিলেন হকের উপর। ঐ সমস্ত সাহাবীদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করা উনার জন্য জায়েজ ছিল, যে কেউ উনার অনুগত্য থেকে সরে যাবে তার বিরূদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে। তিনি তাই করেছিলেন।
আর যারা হযরত আলী রাঃ এর বিরূদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন হযরত তালহা, যুবাইর, মুয়াবিয়া রাঃ ইনারা আসলে খলিফায়ে বরহক হযরত উসমান রাঃ এর হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কারণ ঐ হত্যাকারীরা হযরত আলী রাঃ দলের ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন। এভাবে বিশুদ্ধ তাভীল/ব্যাখ্যার প্রয়োজন। “