ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর সাথে মক্কা ও মদীনার মধ্যকার এক স্থানে সফর করছিলাম। আমরা একটি উপত্যকা অতিক্রম করছি, রাসূলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, এটি কোন উপত্যকা? সঙ্গীগণ উত্তর করলেন, আযরাক উপত্যকা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আমি যেন এখনো মূসা (আঃ) কে দেখতে পাচ্ছি, তিনি তাঁর কর্ণদ্বয়ের ছিদ্রে অঙ্গুলি রেখে উচ্চস্বরে তালবিয়াহ্ পাঠ করে এ উপত্যকা অতিক্রম করে যাচ্ছেন। বর্ণনাকারী বলেন, এখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ মূসা (আঃ) এঁর দেহের বর্ণ ও চুলের আকৃতি সম্পর্কে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু রাবী দাউদ তা স্মরণ রাখতে পারেননি।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, তারপর আমরা সামনে আরো অগ্রসর হলাম এবং একটি গিরিপথে এসে পৌছলাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, এটি কোন গিরিপথ? সঙ্গীগণ বললেন, হারশা কিংবা লিফত।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আমি যেন এখনো ইউনুস (আঃ) কে দেখতে পাচ্ছি তালবিয়াহ পাঠ করা অবস্থায় তিনি গিরিপথে গিরিপথ অতিক্রম করে যাচ্ছেন। তাঁর গায়ে একটি পশমী জুব্বা, আর তিনি একটি লাল উটের পিঠে আরোহিত। তার উটের রশিটি খেজুর বৃক্ষের ছাল দ্বারা তৈরি।
(সহীহ মুসলিম ৩১০)
হ্যাঁ এভাবেই হাদিসে পাকে আরো বর্ণিত হয়েছে,
হযরত আদম আ. ও মূসা আ. এঁর মধ্যেকার সাক্ষাতের কথা, মিরাজ রজনীতে বায়তুল মুকাদ্দাসে আমাদের প্রিয় নবী ﷺ এঁর ইমামতিতে সমস্ত নবীগণের নামাজ আদায়ের কথা, প্রতিটি আসমানে অন্যান্য নবীগণ কর্তৃক আমাদের নবীকে অভিবাদন জানানোর কথা, মূসা আ. এঁর অনুরোধে নামাজের ওয়াক্ত পঞ্চাশ হতে পাঁচে নামিয়ে আনতে আল্লাহর কাছে আবেদন করার কথা, মূসা আ. কে তাঁর রওজা শরীফে নামাজরত অবস্থায় দেখতে পাওয়ার কথা....(এগুলোর সাথে সাথে প্রিয় নবী ﷺ এঁর ওফাতের পর তাঁর এবং তাঁর আশেকদের মধ্যেকার ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা তো আছেই)
হাদিসে পাকে বর্ণিত হয়েছে, নবীগণের দেহ ভক্ষণকে মাটির জন্য হারাম করে দেয়ার কথা, নবীগণ জীবিত, নামাজরত, রিযিকপ্রাপ্ত হওয়ার কথাও। তাই বিখ্যাত ফকিহ ও হাদিস বিশারদ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহঃ উল্লেখ করেন,
তাঁদের ইহকালীন জীবনের অবস্থা এবং পরকালীন জীবনের অবস্থার মাঝে কোন পার্থক্য নাই, এজন্য বলা হয় আল্লাহর ওলীগণ (প্রিয় বান্দাগণ, সাধারণদের মত) মৃত্যুবরণ করেন না বরং (মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে, দুনিয়া হতে পর্দা করে) তারা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবর্তন হন মাত্র। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ইমাম বায়হাকী রহঃ বলেন, নবীগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হতে পারেন এটা আকল দ্বারাও বৈধ, যেমনিভাবে হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত। (মিশকাতের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মেরকাতের ৩য় খন্ড, ৪১৪-৪১৫ পৃষ্ঠা)
তেমনিভাবে মুফতিয়ে বাগদাদ আল্লামা সাইয়্যেদ মাহমুদ আলুসী আল বাগদাদী রহঃ তদীয় তাফসীরে রুহুল মায়ানীতে উল্লেখ করেন- (সূরা আহযাবের ৪৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যায়)
"নিশ্চয় নবীয়ে রহমত রাসূলুল্লাহ ﷺ শারীরিক ও রুহানী উভয় ভাবে জীবিত এবং আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতায় পৃথিবী ও জগতসমূহে ক্ষমতা প্রয়োগ ও পরিভ্রমণ করতে পারেন যেভাবে ওফাত শরীফের পূর্বে করতেন। তাঁর কোন কিছুই পরিবর্তন হয়নি শুধু বাহ্যিক চোখের আড়াল হয়েছেন যেমনি ফেরেস্তাগণের উপস্থিতি স্বত্বেও চোখের আড়াল বা অদৃশ্য হয়ে আছেন।"
এ প্রসঙ্গে আলা হযরত, ইমাম আহমদ রেজা রহঃ এঁর সেই বিখ্যাত কালামটি উল্লেখ না করলেই কেমন জানি লাগে!
তু জিন্দা হ্যায় ওয়াল্লাহ, তু জিন্দা হ্যায় ওয়াল্লাহ,
মেরে চশমে আলম ছে ছুপ জানে ওয়ালে
বঙ্গানুবাদঃ
আল্লাহর কসম হে নবীﷺ! আপনি জিন্দা।
কিন্তু আপনি আমার চোখের আড়াল হয়ে আছেন।
কবরজীবনে আল্লাহ ওয়ালাদের অবস্থাঃ
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেনঃ কোন এক সময় রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর এক সাহাবী একটি কবরের উপর তার তাবু খাটান। তিনি জানতেন না যে, তা একটি কবর। তিনি হঠাৎ বুঝতে পারেন যে, কবরে একটি লোক সূরা আল-মূলক পাঠ করছে। সে তা পাঠ করে সমাপ্ত করলো। তারপর তিনি নবী ﷺ এঁর নিকটে এসে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ! আমি একটি কবরের উপর তাঁবু খাটাই। আমি জানতাম না যে, তা কবর। হঠাৎ বুঝতে পারি যে, একটি লোক সূরা আল-মুলক পাঠ করছে এবং তা সমাপ্ত করেছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ এ সূরাটি প্রতিরোধকারী, নাজাত দানকারী। এটা কবরের আযাব হতে তিলাওয়াতকারীকে নাজাত দান করে।
(সূনান আত তিরমিজী ২৮৯০)
আহ! না জানি মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে এবং তাঁর নবীগণকে কত উত্তম অবস্থায় রেখেছেন!
আমার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা পবিত্র কুরআনুল কারীমেও কত সুন্দর করেই না ঘোষণা করলেনঃ
"বলুন, তোমরা কাজ (আমল) করতে থাক। আল্লাহ তো তোমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করবেন এবং তাঁর রাসূল ও মুমিনগণও (লক্ষ্য করবে)। আর অচিরেই তোমাদেরকে অদৃশ্য ও প্রকাশ্য বিষয়ের জ্ঞাতা (আল্লাহর) দিকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তোমাদের সকল কৃতকর্ম জানিয়ে দেবেন।" [সূরা আত তাওবাহঃ ১০৫]
তিনি আরো বলেন,
"তখন কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো এবং হে মাহবুব! আপনাকে তাদের সবার উপর সাক্ষী এবং পর্যবেক্ষণকারীরুপে উপস্থিত করবো?"
[সূরা নিসা, আয়াত ৪১]
"হে নবী আমি আপনাকে সাক্ষ্য প্রদানকারী, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁরই দিকে আহ্বানকারী এবং একটি উজ্জ্বল প্রদীপরূপে প্রেরণ করেছি।”
[সূরা আহযাব, আয়াত ৪৫-৪৬]
উক্ত আয়াতের তাফসীরে মুফাসসির ইমাম সৈয়দ আলূসী বাগদাদী (রহ.) ও ইমাম সৈয়দ আবুস সাউদ (রহঃ) আরো বলেন- ‘যাদের প্রতি আপনাকে রাসূল করে প্রেরণ করা হয়েছে, তাদের সকলের জন্যে আমি (আল্লাহ) আপনাকে ‘শাহিদ’ করে পাঠিয়েছি। প্রিয় নবী (ﷺ) কে উম্মতের নিম্নবর্ণিত বিষয়াবলীর সাক্ষী বানানো হয়েছে-
(১) অবস্থাসমূহ পর্যবেক্ষণ করা।
(২) তাদের আমলসমূহ প্রত্যক্ষ করা ।
(৩) তাদের সত্যায়ন ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করার সাক্ষ্য প্রদান।
(৪) তাদের হেদায়াত ও গোমরাহী সম্পর্কে সাক্ষ্য প্রদান।
এসব বিষয়ে তিনিই কিয়ামতে সাক্ষ্য প্রদান করবেন।’’
{আলূসী, রুহুল মা‘য়ানী, ১১/২২২পৃ. আবুস সাউদ, তাফসীরে আবুস্-সাউদ, ৭/১০৭-১০৮পৃ.}