দ্বীনের পথে, সরফরাজের সাথে।
- সালমন সালমা
আবিদ এবং আরহাম। তারা দুজন একই স্কুলে পড়ে। তারা দুজনেই ভালো বন্ধু। তারা একে অপরের প্রতিবেশী। তারা প্রতিদিন বিকেলে একসাথে খেলা করে। রোজ, আরহাম খেলতে যাওয়ার সময় আবিদকে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু আজ আরহাম আবিদকে ডাকতে আসেনি। তাতে আবিদ মনে মনে কিঞ্চিত দুঃখ পেলো।
[আজ, স্কুলে আবিদের সাথে আরহাম এর ঝগড়া হয়। তাই তারা দুজন দুজনের সাথে কথা বলে না]
আবিদ কিছুসময় অপেক্ষা করে একা একাই খেলার মাঠে যায়। গিয়ে দেখে আরহাম অনেক আগেই মাঠে চলে আসছে। সবাই আবিদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। শরীরচর্চার জন্য ওরা প্রতিদিন বিকেলে ফুটবল খেলে।
যথারীতি খেলা শুরু হলো। আবিদ এবং আরহাম এর মাঝে এক ক্রোধ কাজ করছিলো। তারা দুজনেই, ফুটবল খেলা ছলে একে অপরকে আঘাত করছিলো। সকালের ঝগড়ার রেশ তাদের মধ্যে বিকেলেও গড়ালো। দলের সিনিয়র ভাই আবদুর রহমান বিষয়টি বারবার খেয়াল করলেন। তিনি বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে জানতে পারলেন, আজ সকালে আবিদ এবং আরহাম স্কুলে ঝগড়া এবং মারামারি করে। একে অপরকে আঘাত করে। তারা কেউ কাউকে এখনো ক্ষমা করতে পারেনি। যার কারনে তারা এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে খেলার ছলে।
হঠাৎ মাঠ থেকে জোরে একটি শব্দ ধেয়ে আসলো। আঃ..............
আবদুর রহমান দৌড়ে মাঠে যায়। গিয়ে দেখে আরহাম মাটিতে পড়ে আছে। আবিদ আরহামকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।
আবদুর রহমান সিদ্বান্ত নিলো এই অবস্থাই আজ আর খেলার প্রয়োজন নেই।
আবদুর রহমান: আচ্ছা সবাই শোনো, আজকে এখানেই খেলা শেষ। চলো আমরা সবাই সরফরাজ ভাইজানের বাসায় যাই।
দলের সবাই ভেবে দেখলেন আবিদ এবং আরহাম এর এই বিষয়টি সরফরাজ ভাইজানই সুরাহা করতে পারবেন।
[বলে রাখি, সরফরাজ ভাইজান একজন নম্র, ভদ্র, বিনয়ী এবং ধার্মিকএকজন মানুষ। ছোটোদের অনেক স্নেহ করেন এবং মূল্যায়ন করেন। সরফরাজ সকলের কাছে জনপ্রিয় ]
সবাই রওনা হলো সরফরাজ এর বাড়ির দিকে। ৫/১০ মিনিটের পথ। পৌঁছে গেলো সবাই। আবদুর রহমান দরজার পাশ থেকে ডাকছেন -
সরফরাজ ভাইজান বাসায় আছেন? আমি আবদুর রহমান বলছি।
সরফরাজ দরজা খুললেন -
সরফরাজ : আসসালামুআলাইকুম আবদুর রহমান ভাই।
আবদুর রহমান: ওয়ালাইকুম সালাম। আসসালামু আলাইকুম সরফরাজ ভাইজান।
সরফরাজ: ওয়ালাইকুম সালাম। কি ব্যাপার আবদুর রহমান? তোমাদের সবাইকে এতো উদিগ্ন দেখাচ্ছে কেনো? আরহাম এর কি হয়েছে? ও খুড়িয়ে দাড়িয়ে আছে যে?
আবদুর রহমান: ভাইজান সে অনেক লম্বা ঘটনা। খেলার মাঠে আবিদ আরহাম কে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। তাতে ও ব্যাথা পেয়েছে।
সরফরাজ: কি বলছো এসব? ওরা তো ভালো বন্ধু। আচ্ছা, আচ্ছা। তোমরা সবাই আগে ভেতরে আসো।
[সবাই সরফরাজ এর বাসার ড্রয়িং রুমে বসল]
সরফরাজ আবিদ এবং আরহামকে কাছে ডেকে নিলেন। তাদের দুজনের মুখ থেকে সকাল থেকে বিকেল অবধি পুরো বিস্তারিত ঘটনাটি শুনলেন।
ক্ষানিকবাদে; সরফরাজ বললেন - তোমরা সবাই আমার কথা মন দিয়ে শুনো। আজকে তোমাদের একটি ঘটনা শোনাব।
সবাই সমস্বরে বললো - ঠিক আছে সরফরাজ ভাইজান।
সরফরাজ ঘটনাটি বলতে শুরু করলেন: শোনো সবাই,
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবীদের (রাঃ) নিয়ে মসজিদে বসে ছিলেন । আলোচনা করছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে । একপর্যায়ে তিনি বললেন , তোমরা জান্নাতী দেখতে চাও? তাহলে মসজিদের এই দরজার দিকে তাকিয়ে থাকো , কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন লোক এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে এবং সে হবে জান্নাতী ।
সাহাবীরা (রাঃ) খুব উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। সবাই ভাবছিলেন কে হতে পারে এত বিপুল সৌভাগ্যের অধিকারী ? কিছুক্ষন পরে ঐ দরজা দিয়ে সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) প্রবেশ করলেন ।
পরের দিনও রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন , এই দরজা দিয়ে সবার প্রথমে যে মসজিদে প্রবেশ করবে সে জান্নাতী । এবারো সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) ঐ দরজা দিয়ে সবার আগে প্রবেশ করলেন ।
তৃতীয় দিনেও একি ঘটনা ঘটলো ।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) ছিলেন দ্বীনের ব্যাপারে একনিষ্ঠ এবং সিরিয়াস একজন যুবক । তিনি ভাবলেন, সাদ তাঁর কোন আমলের জন্য এই বিপুল সৌভাগ্যের অধিকারী হলেন তা আমাকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে । তিনি সাদ (রাঃ) এর কাছে যেয়ে বললেন , “ আমার আব্বুর সঙ্গে আমার একটু মনোমালিন্য হয়েছে । আপনি কি আমাকে আপনার বাসায় কয়েকদিন থাকতে দিবেন ? সাদ (রাঃ) বললেন , “ হ্যাঁ অবশ্যই ,কেন নয় । আমার বাসার দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা থাকবে । কাজেই আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) সাদ (রাঃ) এর সঙ্গে তার বাসায় গেলেন । আসলে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) এর আসল উদ্দেশ্য ছিল সাদ (রাঃ) এর ব্যক্তিগত প্জীবনটা খুব কাছ থেকে দেখা এবং সেই বিশেষ আমলটি খুঁজে বের করা ।
প্রথম রাত ।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) ভাবলেন , সাদ (রাঃ) বোধহয় সারা রাত তাহাজ্জুদ আদায় করবেন, বা কুরথআন তিলাওয়াত করবেন এবং পরদিন অবশ্যই রোজা রাখবেন । কিন্তু তাঁকে হতাশ করে দিয়ে সাদ (রাঃ) রাতে ঘুমিয়ে গেলেন এবং শেষ রাতে ঊঠে অল্প কিছু সময় তাহাজ্জুদ আদায় করলেন । পরদিন সকালে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) যখন দেখলেন সাদ (রাঃ) নাস্তা করছেন তখন তিনি আরো হতাশ হয়ে গেলেনঃ না, এ লোক দেখি রোজাও রাখেনি ।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) ভাবলেন আজকে হয়তো সাদ (রাঃ) অসুস্থ , তাঁর শরীরটা কিঞ্চিৎ খারাপ হয়তো আগামী কাল তিনি রোজা রাখবেন এবং সারা রাত আল্লাহ্র ইবাদাত বন্দেগীতে কাটাবেন । কিন্তু দ্বিতীয় রাতেও সাদ (রাঃ) ঘুমালেন, শেষ রাতে উঠে অল্প কিছু সময় তাহাজ্জুদ আদায় করলেন এবং রোজাও রাখলেন না ।
তৃতীয় রাতেও একি ঘটনা ঘটলো । এবার আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) অধৈর্য হয়ে সাদ (রাঃ) এর কাছে যেয়ে বললেন, “ দেখুন! আমার আব্বুর সঙ্গে আমার কোন মনোমালিন্য হয়নি , আমি আসলে আপনার কাছে থেকে আপনার সেই আমলটা বের করার চেষ্টা করছিলাম যার কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আপনাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন ।
সাদ (রাঃ) বললেন , “ দেখ আমার সেরকম কোন বিশেষ আমল নেই । তবে হ্যাঁ আমি রাতে ঘুমানোর যাবার আগে যারা আমার মনে কষ্ট দিয়েছে আমি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেই ।
সুবহানআল্লাহ । সাদ (রাঃ) এমন একজন সাহাবী যিনি বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যিনি উহুদ যুদ্ধের বীর ,যিনি তাঁর সময়কার সুপার পাওয়ার পার্সিয়ানদের পরাজিত করেছিলেন কিন্তু তাঁকে এই দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হল শুধু মানুষকে ক্ষমা করার কারণে , এবং আমরা মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়ার ব্যাপারটাকে খুবই তুচ্ছ করে দেখি ।
আমাদের নিজেদের অবস্থাটা সাদ (রাঃ) এর সঙ্গে তুলনা করে দেখি একবার । সাদ (রাঃ) প্রতি রাতে মানুষদের ক্ষমা করে দিতেন আর আমরা বছরের পর বছর চলে যাই আমরা আমাদের ভাই বোন , বাবা মা , আত্মীয়স্বজন , বন্ধু বান্ধব আমাদের যে দুঃখ কষ্ট দিয়েছেন সেগুলো ভুলে যেয়ে তাদের ক্ষমা করে দেওয়ার কথা একবারো চিন্তা করিনা । কেন ? কারণ আমরা মনে করি এবং গভীরভাবে বিশ্বাস করি আমরা যদি আর একজনকে ক্ষমা করে দেই , তাদের সামনে একটু বিনীত হই তাহলে আমাদের ইজ্জা আমাদের সম্মান কমে যাবে । অথচ আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “ কোন মানুষ যদি আর একজন মানুষকে ক্ষমা করে দেই তাহলে আল্লাহ্ (সুবহানু তা'য়ালা) ক্ষমাকারীর ইজ্জা, সম্মান বাড়িয়ে দেন, এই দুনিয়াতে এবং অবশ্যই আখিরাতেওচ্ ।
পুরো ড্রয়িংরুম থমথমে। সরফরাজ একটু থামলেন। আবিদ এবং আরহাম এর দিকে তাকালেন কিছুক্ষণ। তারা দুজনেই লজ্জিত। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। ক্ষমা করার পুরষ্কার এতো দারুন হতে পারে তাদের জানা ছিলো নাহ।
তারা দুজনেই সরফরাজ এর দিকে এগিয়ে আসলেন। বললেন -
সরফরাজ ভাইজান আমরা এখন কি করবো? কি করা উচিত?
সরফরাজ বলেছেন, শোনো আবিদ এবং আরহাম;
আল্লাহ তাআলা মানুষকে আদেশ দিয়েছেন, যেন একে-অপরকে ক্ষমা করে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা ভালো কিছু প্রকাশ করো কিংবা গোপন করো অথবা মন্দ ক্ষমা করে দাও, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল,ক্ষমতাবান। (সুরা নিসা, আয়াত: ১৪৯)
ক্ষমাকারীকে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে পুরস্কার দেবেন। পরস্পরের মধ্যে বিরোধ নিষ্পন্নকারীও আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর মন্দের প্রতিফল মন্দ। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপস নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না।থ (সুরা শুরা, আয়াত: ৪০)
ক্ষমা করলে কারও মর্যাদা কমে না। বরং বহু গুণে ক্ষমাশীল ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (ﷺ) বলেন করেছেন, সদকা করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে, তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। (মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৮)
তাহলে আবিদ এবং আরহাম তোমাদের এখন উচিত একজন আরেকজনকে ক্ষমা করে দেয়া। ক্ষমাকারীকে আল্লাহ তা'আলা পছন্দ করেন।
আর তাছাড়া আমরা মুসলমানরা একে অপরের ভাই ভাই।
ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুসলিম মুসলিমের ভাই, সে তার উপর অত্যাচার করবে না এবং তাকে অত্যাচারীর হাতে ছেড়ে দেবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কোনো এক বিপদ দূর করে দেবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বহু বিপদের একটি বিপদ দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ কিয়ামতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন।থথ [বুখারি২৪৪২, মুসলিম ২৫৮০, তিরমিযি ১৪২৬, নাসায়ি ৪৮৯৩, আহমদ ৫৩৩৪, ৫৬১৪]
আবিদ এবং আরহাম দুজন দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এবং আজকের অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইলেন।। তাদের এমন মিষ্টি আচরনে ফের সবাই খুশি হলেন।।
আমাদের ও উচিত সরফরাজ হয়ে, ইসলামের ঘটনাগুলো ছোটোদের মাঝে আলোচনা করে, শিশুদেরকে কোরআন-সুন্নাহ বুঝানোর এবং ইসলাম বুঝানোর।
তারা তো কচি ডালের মতো। যেভাবে চাইবেন ডাল সেভাবে বাকানো যাবে।। তাহলে আজ থেকেই শুরু হোক আমাদের বদলে যাওয়ার দিন।