বাংলা সাহিত্যে ওহাবী আন্দোলনের প্রভাব
আবু সাঈদ নয়ন
বঙ্গে ওহাবী আন্দোলনের সময়কাল ১৮২০ থেকে ১৮৩১—ওহাবী আন্দোলনের পটভূমি এবং ব্যর্থতা এর মধ্যেই সংঘটিত হয়েছে। এ সময়কালের পূর্বে এবং পরে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি-মুসলমানের অবস্থান নির্ণয় করি—আকাশ-পাতাল পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ওহাবী আন্দোলনের পূর্বের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি-মুসলমানের অবস্থান রীতিমতো উচ্চাসনে; ওহাবী আন্দোলনের পরে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি-মুসলমানের অবস্থান একেবারে পেছনের সারিতে! কারণটা কি?
ওহাবী আন্দোলনের একটা গভীর প্রভাব বাঙালি-মুসলিম সমাজে স্থায়ী হয়েছে এবং এ প্রভাব থেকেই সাহিত্যে বাঙালি-মুসলমানের আগমন এবং অবস্থানে ঐতিহাসিক খরা নেমেছিল। এখানে এ তত্ত্বটি জেনে রাখা আবশ্যক যে, ওহাবী আন্দোলনের পূর্বের সমস্ত বাঙালি-মুসলমান সাহিত্যিক ইসলামের অন্যতম প্রধান শাখা— সূফিধারার অনুসারী ছিলেন। বলে রাখা ভালো, ইসলামের সবচেয়ে সহজ এবং মর্মশাঁসলব্ধ উৎকৃষ্ট রূপ হচ্ছে সূফিধারা; সূফিদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে কোন জনপদের সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিকে ক্ষতিকর অর্থে বাতিল না করে উপকারী অর্থে গ্রহণ করে একে উত্তমরূপে সংস্কার করা—মানুষের উপকার করে, অন্তত অপকার করে না এমন যে কোন কিছুকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সূফিরা সদর্থে গ্রহণ করেন। একেবারে শাহ মুহম্মদ সগীর থেকে হেয়াত মামুদ বা আলী রজা পর্যন্ত তালিকাটা দেখে তাঁদের কাব্যগ্রন্থের দিকে তাকান— কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে তাঁদের সূফিরূপ বুঝতে কোনোরূপ বেগ পেতে হবে না। কাব্য-নির্মাণে তাঁদের বিষয়-নির্ধারণের দিকে তাকালেও তা সহজে বোঝা যায়! কিন্তু সূফিধারার বিরোধী ওহাবী আন্দোলনের প্রভাবে বাংলা সাহিত্যের প্রতি বাঙালি-মুসলমানের দৃষ্টি সঙ্কুচিত হয়ে যায়। সূফিধারা এবং ওহাবী আন্দোলনের ধর্মীয় পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে—কেবল সাহিত্যের প্রতি উভয়ধারার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আমাদের আলোচনা।
শাহ মুহম্মদ সগীর, দৌলত উজির বাহরাম খান, আলাওল, সাবিরিদ খানসহ ডজন-ডজন কবি পাওয়া যাবে যাঁরা প্রণয়োপাখ্যান অর্থাৎ প্রেমকাহিনী নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। প্রেম, ভালোবাসা, রোমাঞ্চের সাথে খুব স্বাভাবিকভাবেই শারীরিক ব্যাপার মানে যৌনতার অংশও তাঁদের প্রণয়োপাখ্যানে স্ব-শরীরে বিদ্যমান। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে বাঙালি-মুসলমান কবির এমন কোন প্রণয়োপাখ্যান বা প্রেমকাহিনীর কাব্যগ্রন্থ পাওয়া যাবে না যেখানে যৌনতা নেই—অস্বীকারের কোনোই সুযোগ নেই। মানে কি দাঁড়ালো?
১. প্রেমকাহিনী-সর্বস্ব কাব্যগ্রন্থ রচনাকে তাঁরা শরীয়তমতে হারাম বা নিষিদ্ধ মনে করতেন না।
২. প্রয়োজনে যৌনতাকে কাব্যে রূপান্তর করাও তাঁদের নিকট হারাম বা নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হতো না।
তথাপি তাঁরা সকলেই ছিলেন সূফিধারার অনুসারী—অনেকে তো বিভিন্ন তরিকার পীরও ছিলেন। কিন্তু তারা শরীয়তমতে স্পষ্ট সিদ্ধ নয় এমন বিষয়েও কি করে নির্দ্বিধায় কাব্যরচনা করলেন? তাঁদেরকে মধ্যযুগের কবি বললেও তাঁদের চিন্তাধারা ছিল আধুনিক। তাঁরা যখন কাব্যরচনায় বসতেন তখন তাঁরা সর্বোতভাবে নিজেকে কেবল ‘কবি’ই মনে করতেন; কবিতা লেখার সময় একজন কবিকে গোত্র, সমাজ, ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠার যে বৈশিষ্ট্য আধুনিক কাব্যবোদ্ধাগণ নির্ধারণ করেছেন তা কয়েক শত বছর পূর্বেই বাঙালি-মুসলমানের বরেণ্য কবিগণ কর্মে বাস্তবায়ন করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা অসঙ্গত হবে না যে, সূফিদেরকে যে সর্বকালীন মানানসই বা আধুনিক বলা হয় তার একটি নিদর্শন এখানে পাওয়া যায়।
মধ্যযুগের বাঙালি-মুসলমান কবিদের অসঙ্কুচিত, বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গিতে কাব্যনির্মাণের ধারা নোঙর করেছে আঠারো শতকেও—কিন্তু ওহাবী আন্দোলন তাঁদের এ চিন্তাধারাকে জোরালোভাবে রুদ্ধ করেছে। ওহাবী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, ইসলামী সমাজে শরীয়তের কঠোর প্রয়োগ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়ন করা। ওহাবী আন্দোলনের মতাদর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনায় ৯টি নিয়ম সৈয়দ আহমদ বেরলভীরা নির্ধারণ করেছিল, তন্মধ্যে ৫ নং নিয়ম হচ্ছে: “শরীয়ত বিরুদ্ধ সবরকম আচার, রীতি-নীতি ও প্রথা একেবারে বাতিল গণ্য হবে।” প্রেমকাহিনী-সর্বস্ব কাব্যরচনা এবং প্রয়োজনে যৌনতাকে কাব্যে রূপান্তর যে ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে সিদ্ধ নয় তা আগেই বলেছি। সাহিত্যকে শরিয়তের পাল্লায় মেপে তাকে ‘হারাম’ বলে সমাজে প্রচার করেছে ওহাবী আন্দোলনের সমর্থকরা। ফলে, ওহাবী আন্দোলনের পর বাংলা সাহিত্যে বাঙালি-মুসলমানের পদচারণা চরমভাবে কমতে শুরু করলো।
ওহাবী প্রভাব মুক্ত হয়ে সাহিত্যে অগ্রসর হতে বেশ সময় লেগেছে বাঙালি-মুসলমানের। ১৮২০ থেকে ১৮৭০ এ ৫০ বছরের মধ্যে একজন বাঙালি-মুসলমান সাহিত্যিক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ১৮৭০’র পর মীর মশাররফ, কবি কায়কোবাদরা ধীরগতিতে সাহিত্যে প্রবেশ করতে লাগলো। মীর মশাররফ থেকে শুরু করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রায় সকল বাঙালি-মুসলমান সাহিত্যিক সূফিধারার অনুসারী। এমনকি, বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে মুসলমানদের প্রথম প্রতিনিধি মীর মশাররফ এবং কবি হিসেবে কায়কোবাদ—উভয়েই সূফিধারার একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন। ওহাবী আন্দোলনের সমর্থকরা বাংলায় প্রচলিত মিলাদ শরিফ পাঠ করতো না, সাধারণ মুসলমানদের এ ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করতেন; অথচ মীর মশাররফ ‘মৌলুদ শরীফ’ নামে বড়সড় একটি বই লিখেছেন! ওহাবী আন্দোলনের সমর্থকরা সূফিধারাকে তেমন পছন্দ করতো না, পীর-মুরিদির স্পষ্ট বিরোধিতা করতো এবং সূফিদের চোখে মুসলমানদের মধ্যে যারা বিশেষ ব্যক্তিত্ব তাঁদের গুণগান গাওয়া পছন্দ করতো না; অথচ কবি কায়কোবাদ তাঁর পীরের নির্দেশে বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম বড়পীর আবদুল কাদের জিলানীর উপর ‘কাব্যজীবনী’ রচনা করেছেন। তৎপরবর্তী ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কাজী এমদাদুল হক, নজীবর রহমান সাহিত্যরত্ন প্রমুখ সাহিত্যিকরাও ওহাবিপ্রভাব মুক্ত হয়ে সাহিত্যে পদার্পণ করেন।
সারকথা: মধ্যযুগ শেষ করে, বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ভবনে বাঙালি-মুসলমানের প্রবেশ হয়েছিল অত্যন্ত বিলম্বে—এ বিলম্বের ফলে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি-মুসলমানের একচেটিয়া পশ্চাৎপদতা সকলের দৃষ্টিগোচর হতে লাগলো এবং বাংলা সাহিত্যের মূলভবন থেকে তাঁদেরকে উচ্ছেদ করারও একটা ষড়যন্ত্রের পথ সৃষ্টি হয়েছিল, যার কৃতিত্ব ওহাবী আন্দোলনের নিকট সোপর্দ না করলে অন্যায় হবে।
বাংলা ভাষার গতিও রুদ্ধ করে দিয়েছিল ওহাবী আন্দোলন। বাঙালি-মুসলমান আরবি-ফারসির মিশেলে যে সুমিষ্ট বাংলা ভাষা ব্যবহার করতো তা বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে উপেক্ষিত হয় —অন্তত কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ অমুসলিম সাহিত্যিকের একচেটিয়া প্রাধান্যে আধুনিক বাংলা সাহিত্য তখন আরবি-ফারসিমুক্ত—সংস্কৃতপ্রিয় ভাষায় জর্জরিত! এমনকি মীর মশাররফ হোসেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মতো বিখ্যাত লেখকরা পর্যন্ত আরবি-ফারসি শব্দ—যেগুলো বাংলা ভাষায় নিত্যব্যবহার্য সেগুলো ব্যবহারেও কুণ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের ফলে বাঙালি-মুসলমানের ঘরের ভাষা সাহিত্যে স্থান পায়— মনের ভাষা মুখে প্রকাশ করার সাহস অর্জন করে। এই যে সাহিত্যে বাঙালি-মুসলিম সমাজের ভাষার অনুপস্থিতি, তারও কৃতিত্ব নিতে হবে ওহাবী আন্দোলনকে। কারণ, যে সমাজের সাহিত্যিক নেই সে সমাজের ভাষা সাহিত্যে উপস্থিত না থাকাটাই স্বাভাবিক।
কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল ফজল, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদসহ যারা বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ভবনে বাঙালি-মুসলমানের প্রতিনিধিত্বে এগিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদেরকেও সমালোচনার বাণে বিদ্ধ করা হয়েছে, তাঁদের সাহিত্যকে শরিয়তের পাল্লায় মেপে তাঁদেরকে সস্তা ফতোয়ায় আঁটকে রাখার অপচেষ্টা হয়েছে—সাহিত্যের স্রোত রুদ্ধ করতে এ-সকল ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে ওহাবী মতবাদের প্রভাব প্রবল না হলেও সচল ছিল।
ওহাবী আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং উপমহাদেশে—বিশেষত বাঙালি মুসলমানদের জাগরণে ওহাবী আন্দোলনের প্রভাবকে অস্বীকার করার দুঃসাহস ইতিহাসের নেই। কিন্তু ওহাবী আন্দোলনের এসব দারুণ কৃতিত্বকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার সাথে সাথে এটাও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, সাহিত্যকে সাহিত্য হিসেবে না দেখে শরিয়তের দৃষ্টিতে দেখার যে অপভ্রংশতা, বাংলায় তার মূল আমদানি হয়েছে ওহাবী আন্দোলনের মাধ্যমেই। সাহিত্যের বারান্দায় শরিয়ত-সূর্যের উত্তপ্ত রোদ কখনোই সূফিধারার অনুসারিদের মাধ্যমে পড়েনি; পড়েছে ওহাবী মতাদর্শের প্রভাবে গোঁড়া শরিয়তপন্থী মুসলমানদের মাধ্যমে। ওহাবী আন্দোলনকে যদি ইতিহাস হিসেবে স্বীকার করতে হয় তাহলে এটাও স্বীকার করতে বাধ্য যে, বাংলা সাহিত্যে মৌলবাদ আমদানির প্রধান কৃতিত্ব ওহাবী আন্দোলনের।