ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সাইন্টিফিক মেথডোলজি অত্যন্ত প্রয়োজন
- গোলাম দস্তগীর লিসানি


প্রথমে আমাদের বলা দরকার সাইন্টিফিক মেথডোলজি বলতে আমরা কি বুঝি?

সাইন্টিফিক মেথডোলজি মানেঃ
ফিজিকস নয়, ক্যামিস্ট্রি নয়, বায়োলজি নয়।

সাইন্টিফিক মেথডোলজি মানে এই নয় যে আমাদেরকে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান রসায়ন বিজ্ঞান বা জীব বিজ্ঞান অনুসারে ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করতে হবে।

বরং সাইন্টিফিক মেথডোলজি মনে হচ্ছেঃ
যেকোনো বিষয়ে-
ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়ে -
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সময় ধরে -
গাণিতিক পদ্ধতিতে-
মনোযোগ দিয়ে-
কোন একটা তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ তুলে আনা।

সাইন্টিফিক মেথডোলজি কে আমরা বিভিন্ন কঠিন কঠিন সংজ্ঞা দিয়ে দাড় করানোর চেষ্টা করার চেয়ে ভালো হয় দুইটা উদাহরণ দিলেঃ

100 বছরেরও আগের কথা, দক্ষিণ আফ্রিকায় এক ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী একটা পাম জাতীয় বা খেজুর গাছের কাছাকাছি গাছের দেখা পেলেন।
যে গাছ পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা ওই গাছের ফসিল মাটির নিচে প্রচুর পান। ওই বিজ্ঞানী করলেন কি, গাছটাকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ডে নিয়ে এলেন। সেই গাছটা আজও ইংল্যান্ডে অসম্ভব যত্ন করে রাখা আছে। গাছটাকে আনার পর থেকে এখন পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে 100 বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। অথচ ওই প্রজাতির আর কোন গাছ পাওয়া যায়নি।

দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এই মূল গাছটা একটা পুরুষ গাছ। ফলে সে মারা গেলে এই প্রজাতি টা চিরতরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

এবার আসুন সাইন্টিফিক মেথদলজি বলতে আমরা কি বুঝিঃ এই একটা গাছের পেছনে হাজার হাজার বিজ্ঞানী সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা চষে বেড়িয়েছেন গত 100 বছরেরও বেশি সময় ধরে। এই যে একটা বিষয়ের দিকে খুবই গভীরভাবে, একমুখীভাবে মনোযোগ দেয়া, এবং পৃথিবীতে চষে ফেলা, এবং যে এ কাজ করছে তার এ আপাতক্ষুদ্র কাজটাকেই প্রফেশন মনে করা- এটাই সাইন্টিফিক মেথডোলজি।

সাইন্টিফিক মেথদলজি কেমন জিনিস সেটা আমরা বুঝতে পারবো গাছটার যত্ন তারা কিভাবে নিচ্ছে ইংল্যান্ডে এবং কেন নিচ্ছে এত যত্ন, তা থেকে।

এমনকি গাছটার যেন বিন্দুমাত্র ক্ষতি না হয়,
যেন ঝড়, বাতাস, বৃষ্টি, বজ্রপাত, তাপমাত্রা, জলীয়তা, বরফপাত বা এমনকি পাখি, পোকামাকড়, ভাইরাসের জন্য গাছটা নষ্ট না হয়, সে উদ্দেশ্যে সেটাকে বিশাল বড় একটা গ্রীনহাউজ বা কাচের ঘরের ভেতরে রাখা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল সারা পৃথিবীর সব উদ্ভিদ বিজ্ঞানী কি এই একটা গাছ নিয়ে গবেষণা করছেন?

না আরো লক্ষ লক্ষ উদ্ভিদবিজ্ঞানী এরকম আরো লক্ষ লক্ষ আলাদা প্রজাতি নিয়ে কাজ করছেন?
তেমনি লক্ষ লক্ষ প্রাণীবিজ্ঞানী আরও লক্ষ লক্ষ প্রাণী নিয়ে একই ভাবে কাজ করছেন।

যেমন দেখুন একজন বিজ্ঞানী ও তার দল গত কয়েক বছর যাবৎ একটামাত্র স্পেসিফিক গবেষণা করছেন। সেটা হল, গোখরা সাপ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায় এবং সেসব গোখরা সাপ এর মধ্যে কিছু কিছু প্রজাতি আছে যারা শত্রুর মুখের দিকে বিষ থুতু দেয়ার মত করে ছুঁড়ে মারে।
এখন ওই বিজ্ঞানী ও তার দলের দায়িত্ব হল পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গোখরা সাপ নিয়ে আসা, সেগুলোর মধ্যে যারা যারা শত্রুর মুখের দিকে বিষ থুতু ছুড়ে মারে তাদের ছুড়ে মারার প্যাটার্ন গবেষণা করা। এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করা। এবং তাদের সেই বিষগুলোর মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করা।

এই গবেষণাটা, এই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কাজটা, অর্থাৎ বিষ ছুঁড়ে মারা বিভিন্ন ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের সাপ এর মধ্যে মিল ও অমিল খুঁজে বের করা এবং তারা একই বিষ ছুড়ে মারা সাপের বংশধর কিনা সেটা খুঁজে পাওয়া- এটাই তার সমস্ত গবেষণার লক্ষ। এবং তার দলের সমস্ত গবেষণার লক্ষ্য।

তাই আমরা বুঝতে পারি, ইসলামিক পড়ালেখার মধ্যে এই ধরনের সাইন্টিফিক মেথডোলজির বড়ই অভাব রয়েছে। আমাদের কী হয়? যিনি একজন আলিম হোন তিনি যা শেখেন, অন্য প্রতিটি আলেম হুবহু তাই শেখেন।

আমাদের পড়ালেখার মধ্যে কোন ধরনের খুজে বের করার প্রচেষ্টা নেই। আমাদের ইসলামিক পড়ালেখা হচ্ছে হুবুহু একই জিনিস লক্ষ লক্ষ মানুষের ভেতরে কপি করে দেয়া!

ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্ট হোকঃ

যারা সুফি পন্থী আলিয়া মাদ্রাসায় পড়েন, তারা সবাইঃ

হুবুহু একই জিনিস পড়ে আসেন
হুবুহু একই জিনিস শিখে আসেন
হুবুহু একই জিনিস পারেন এবং
হুবুহু একই জিনিস বলেন

অর্থাৎ, দশ লক্ষ সুফিপন্থী আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র আসলে একজন আরেকজনের কার্বন কপি ছাড়া কিছুই নয়!

এবার আসুন কওমি মাদ্রাসায়। কওমি মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস করা 10 লক্ষ ছাত্র সবাই একজন আরেকজনের কপি ছাড়া কিছুই নন!

আবার আসুন জামাতে ইসলামী, বা শিয়া, বা আহলে হাদিস, বা সালাফি, বা এই উপমহাদেশের বাইরের সুফিপন্থী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায়ঃ

এরাও কিন্তু সবাই জাস্ট পড়ে আসা কার্বন কপি বানাচ্ছেন।

বাংলাদেশের জামাত ঘরানার একজন আলেম যা জানেন, 10 হাজার আলেম তাই জানেন। একজন আলেমের যেটুকু দক্ষতা আছে, 10 হাজার আলেমের সেটুকুই দক্ষতা আছে। একজন আলেম যা পড়েছেন, 10 হাজার আলেম তাই করেছেন।

ঠিক একই কথা আহলে হাদীস সালাফী এবং অন্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

এখন একটা প্রশ্ন আসতে পারে, আমি কি বলতে চাই যে এক ঘরানার দশ লক্ষ আলিম ভিন্ন ভিন্ন জিনিস পড়বেন? না। সেটা বলতে চাই না।

বলতে চাই, এই আলেমদের ভেতরে স্রেফ শিক্ষাক্রম এর হুবহু একই বই হুবুহু একই ভাবে হুবুহু একই ক্লাসে পড়ে এসে হুবহু একই ভাবে নোট বই থেকে পড়ে মুখস্ত করে একেবারে একই কথা একই ধরনের পরীক্ষার হলে একই ভাবে লিখে সে যখন বাস্তব দুনিয়ায় আসে তখন সে কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় ওই বইয়ের ভেতর থেকে প্রশ্ন পায়না।

বাস্তব দুনিয়ার প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর কিন্তু তাকে কোন বইয়ে লিখে দেয়া হয়নি।

বাস্তব দুনিয়ায় প্রতিটা বিষয় সম্পর্কে কিন্তু তার ক্লাস টিচার এখন কোন কিছু বলে দিবে না। তার ক্লাসটিচার এর জন্যও বাস্তব দুনিয়ার প্রতিটা বিষয়ে কোন বইতে লেখা নেই।

ফলে কি হয়?

একজন আলিম খুব ভালোভাবে মাদ্রাসা বা বিভিন্ন জামেয়া মাদ্রাসায় বা বিভিন্ন ইসলাম ভিত্তিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করে আসলেন। খুবই ভালো রেজাল্ট করলেন। খুবই অনুগত ছাত্র হলেন। চমৎকারভাবে যা শেখা দরকার তার সব কিছুই শিখলেন। কিন্তু তিনিঃ

কর্মক্ষেত্রে এসে,
প্রান্তিক পর্যায়ে এসে,
  তৃণমূল পর্যায়ে এসে,
  ইন্টারফেইথ পর্যায়ে এসে,
  ক্রস ফিরকা  কমিউনিকেশনের পর্যায়ে এসে,
ইংরেজি শিক্ষিত মানুষের কাছে  কোন কিছুর সমাধান নিয়ে এসে,
  যারা ইসলাম নিয়ে  কিছুটা  চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছেন তাদের কাছাকাছি এসে,
বা যারা মাদ্রাসা শিক্ষিতদেরকে  বিন্দুমাত্র মূল্যায়ন করেন না তাদের কাছাকাছি এসে- 

তারা কিন্তু মোটেও  সঠিকভাবে ফাংশন করতে পারছেন না।

কারন কী?
কারন তিনি পড়ে এসেছেন  নিজের ঘরানায়। সেখানে কেউ তার ঘরানাকে প্রশ্ন করেনি।  সেখানকার আদব-আখলাক নিয়ম-কানুন এক রকম ছিল।  কিন্তু তিনি যে সমাজগুলোর সাথে ইন্টারেক্ট করছেন  সে সমাজগুলোর নিয়ম-কানুন আদব-কায়দা চিন্তাধারা মূল্যায়ন পদ্ধতি, শংকা ও পারসেপশন  আরেক রকম।

ফলে তিনি মানুষের সাথে কমিউনিকেটিভ না হয়ে খুব নিগেটিভ হয়ে পড়ছেন। দেখা যাচ্ছে যে একজন মাদ্রাসা থেকে ভালোভাবে পড়ে আসা আলেম মানুষকে কোন একটা সূক্ষ্ম বিষয়ে বিস্তারিত এবং সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধান দিতে পারছেন না। এবং যে বিস্তারিত সহজভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধানে জানে তার ঠিকানা টা পর্যন্ত তিনি জানেন না!

এই সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার পথ একটাই। আর সেটা হল, সবাই তো শ্রেণীর পড়ালেখা করবেনই। পাশাপাশি সবারই ডিগ্রী বা অনার্স লেভেলে একটা 4 থেকে 6 মাসের গভীর সাইন্টিফিক মেথডোলজির রিসার্চ করা প্রয়োজন। সেই রিসার্চ' এমন হতে হবে যেটা খুবই ক্ষুদ্র বিষয়, কিন্তু খুবই বিস্তারিত। এরপর আবার মাস্টার্সের পর্যায়ে তাকে আরও অন্তত একটি রিসার্চ করতে হবে।

এখন ধরুন, প্রতিবছর  10000 ছাত্র-ছাত্রী  অনার্স বা ডিগ্রী বা  ফাজিল শ্রেণী পাস করে  তাহলে যদি  এই পদ্ধতিটা এপ্লাই করা হতো  দেখা যেত  প্রতিবছর  10000 টা  মৌলিক গবেষণা হচ্ছে।

  ইসলামের 10 হাজার ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে  আবার প্রতিবছর যদি  10000  ছাত্র-ছাত্রী  কামিল  তাকমিল  মাস্টার্স  দাওরা  ইত্যাদি করেন  তাহলে সব মিলিয়ে দেখা যাবে শুধু বাংলাদেশ থেকেই  প্রতিবছর  20000 গভীর গবেষণা হচ্ছে। 20000 অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ের উপরে!  এবং এই 20000 গবেষণাপত্র  এই 20,000 গবেষণার থিসিস পেপার এবং  গবেষণার সংক্ষিপ্ত  ফলাফল পত্রগুলো  অনলাইনে  প্রকাশিত হবে।

এরপর দেখা যাবে প্রতিবছর অন্তত এক হাজার ছাত্র এম ফিল করছেন অর্থাৎ তিনি এক থেকে তিন বছর সময় একাধারে ব্যয় করছেন একটা ক্ষুদ্রতর বিষয় নিয়ে গবেষণা করার জন্য।

আবার দেখা যাবে প্রতি বছর 100 জন পিএইচডি করছেন অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং ক্ষুদ্র কোন একটা বিষয় নিয়ে।  তিন থেকে ছয় বছর সময়ব্যাপী।  এবং এই গবেষণাকালে  তারা অন্য কোন কিছুই  করছেন না। শুধু একটা বিষয় সবচেয়ে গভীর ভাবে  সবচেয়ে দক্ষ ভাবে ফোকাস করছেন।

এইযে 1100 জন এমফিল গবেষক এবং পিএইচডি গবেষক এদের সামনে কিন্তু অসংখ্য গবেষণাপত্র থাকবে।  কারণ 15 বছরে অনার্স, মাস্টার্স, ফাজিল, কামিল, তাকমিল, দাওরা এবং এমফিলের মোট গবেষণাপত্রের সংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে 4 লাখ থেকে পৌনে 5 লাখ!

এই যে এমফিল ও পিএইচডি নতুন গবেষকরা তারা তাদের গবেষণার বিষয় দেখা যাবে যে 100 থেকে 1000 গবেষণাপত্র পেয়ে যাচ্ছেন তারা কি করবেন?

সেই গবেষণাপত্রগুলো থেকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও গভীর গবেষণাপত্র আরো ভালোভাবে দীর্ঘসময় গবেষণা করে তৈরি করবেন। তখন সেই গবেষণাপত্রগুলো  একটা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হবে।  যেকোনো দুনিয়াবি সমস্যার  বা যেকোনো প্রশ্নের ক্ষেত্রে।

  একজন আলেম খুব সহজে খুঁজে বের করতে পারবেন যে প্রশ্নটা করা হলো সে প্রশ্নটা নিয়ে অপর কোন্ আলিম ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন? তিনি সেই আলীমের  কাছে এই সমস্যাটা কে রেফার করে দিতে পারতেন। কারণ, যে এই বিষয়ে অনার্স লেভেলের ছয় মাস বা মাস্টার্স লেভেলে এক বছর এমফিল লেভেলে এক থেকে তিন বছর পিএইচডি লেভেলে তিন থেকে ছয় বছর একাধারে  গবেষণা করেছে সেই তো এই বিষয়ে জবাব সবচেয়ে ভালোভাবে দিতে পারবে!

কারণ সে তো এই গবেষণাটা একা করেনি বরং দীর্ঘ বছরের পর বছর মাসের পর মাস মাস ধরে এই গবেষণাটি করেছে তার টিমের আরো পাঁচজন। এবং তার টিমের টিচারও করেছে।  তাই একটা প্রশ্ন এলোমেলোভাবে প্রত্যেকটা আলিমকে করার চেয়ে যেকোনো প্রশ্ন একজন আলেমকে করার পরে , সেই আলিম যদি খুঁজে বের করেন, কোন্ আলিম ওই ক্ষুদ্র প্রশ্নটা নিয়ে ছয় মাস গবেষণা করেছেন?

  তখন তিনি শুধু একজন আলেমকে পাবেন না। তিনি পাবেন 5-10 জন আলীমের একটা টিম। এবং সেই 5-10 জন আলেমের  গাইড টিচারকে। এবং তাদের সায়েন্টিফিক রিসার্চ পেপারগুলোকে।

যখন একজনের কাছে রেফার করে দেয়া হবে তখন সে রেফারেন্সটা চলে যাবে একটা টিমের হাতে। গ্লোবালি পরস্পর পরিচিত একটা সোসাইটির হাতে, যারা গবেষণার খাতিরে আগেই পরিচিত ও ঘনিষ্ট ।

এবং জবাবটা সেই টিম দিবে।  সমাধান দিবে।

স্রেফ ক্লাসের পড়া পড়ে পাশ করা প্রত্যেক আলীমের পক্ষে প্রত্যেক বিষয় জানা সম্ভব নয়!
  এবং সঠিক জবাব দেয়াও কখনো সম্ভব নয়! টেম্পার মেইনটেইন করাই সম্ভব নয়!

সাইন্টিফিক মেথডোলজিতে গবেষণা করতে পারাটা অনেক সূক্ষ্ম বিষয়। পুরোটা সময়ঃ
গাণিতিক পদ্ধতিতে গবেষণা তৈরি করতে হয় এবং
গাণিতিক পদ্ধতিতে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করতে হয় এবং
গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনের সময় কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া যায় না বরং
শুধু ফলাফলটা চাপিয়ে দেয়া যায় তাই
সাইন্টিফিক মেথড যে আলিম গবেষণা করবেন তখন তিনি বলতে পারবেন না যে এটাই ঠিক আর ওটাই ভুল বরং
তিনি বলতে পারবেন যে এইভাবে এই ক্ষেত্রেই ফলাফল পাওয়া গেছে আমাদের গবেষণার এই পরিবেশের এবং এই উৎস থেকে,
আর ভুলের ক্ষেত্রে এই ফলাফল পাওয়া গেছে আমাদের গবেষণার এই পরিবেশ এবং এই কারণে এই পদ্ধতির কারণে ফলে,

একটা নৈর্বক্তিক নিরাবেগ গঠনমূলক দলবাজিবিহীন সবচেয়ে বড় কথা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একটা ইসলামিক জ্ঞান ও সমাজের উন্মেষ ঘটবে।

এটাতো গেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভেতরের কথা এখন যদি বাংলাদেশের মাদ্রাসা বোর্ড বা বাংলাদেশের কওমি শিক্ষা বোর্ড এই শিক্ষা পদ্ধতি চালু না করে তাহলে কি আমরা সব সময় পিছিয়ে যেতেই থাকবো?

আমরা কি বন্ধ করে বসে থাকব? তা তো হতে পারে না এই উদ্যোগ আমাদের নিজেদের নিতে হবে বরং আমি তো মনে করি যে প্রথাগত অনার্স-মাস্টার্স ফাজিল কামিল তাকমিল পড়ালেখার জায়গাগুলোতে এখনই সাইন্টিফিক মেথডোলজি আনা সম্ভব নয়। কেননা আমাদের অনার্স-মাস্টার্স লেভেলের শিক্ষকরা অর্থাৎ হুজুররা নিজেদেরকে অনেকটা দেবতার আসনে বসিয়ে রাখেন। যেহেতু তারা সর্বোচ্চ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদেরকে সর্বোচ্চ শ্রেণীর শিক্ষাদান করেন তাই তাদের যে অনমনীয়তা, পুরনো দিনের মানুষ হওয়ার কারণে গোঁড়ামি, অচলাবস্থা, ঘৃণাবাদের চর্চা -
এই সমস্যাগুলো থেকেই যায়।

তাদের কাছ থেকে হঠাৎ করে সাইন্টিফিক মেথডোলজি তে উন্মুক্ত গবেষণা আশা করা বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়।
বরং আমরা মনে করি যারা যেকোনো মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থায় অনার্স মাস্টার্স লেভেলের ছাত্র এবং অনার্স মাস্টার্স পাশ করে ফেলেছেন তারা বরং শুধুমাত্র গবেষণামূলক কোন ইনস্টিটিউটের অধীনে এই গবেষণাগুলো করতে পারেন।
তাতে করে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের দিকে চেয়ে থাকতে হবে না কওমি শিক্ষা বোর্ডের দিকে চেয়ে থাকতে হবে না। বিশেষত পুরনো ভাবধারার শিক্ষকদের চেহারার দিকে চেয়ে থাকতে হবে না। বরং তারা ছাত্র থাকাকালীন অথবা ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পর পর অথবা শিক্ষক হওয়ার পরপর কোন একটা আদিল আদালত সম্পন্ন নিরপেক্ষ গাণিতিক ইনস্টিটিউটের অধীনে 6 মাস 1 বছর করে এক একটা গবেষণা করলে এই কুল ওকুল দুকুল রক্ষা হবে।

বিশেষ করে আমরা যে এতক্ষণ আলোচনা করলাম আলেমদের জবাব দেয়ার জন্য সাইন্টিফিক মেথদলজি দরকার এই কথাটা কিন্তু আংশিক সত্য । আলিমদের সাধারণ মানুষকে বা বিভিন্ন মতের মানুষকে জবাব দেয়ার জন্য সাইন্টিফিক মেথদলজি যতটা দরকার ঠিক ততটাই দরকারঃ
তার চিন্তা-চেতনা, এবং
তার যে কোন কিছুকে খুঁজে বের করে আনার দক্ষতা, এবং
যেকোনক্ষেত্রে গবেষকের মত করে যে কোন কিছুকে বুঝতে পারার এবং
যেকোনো মানুষের সাথে কমিউনিকেট করতে পারার দক্ষতা -

শুধুমাত্র গবেষণা করেই আসবে। আদারওয়াইজ কখনোই আসবেনা। আপনি যদি হাতেনাতে  সাঁতার শেখেন তারপরেই সাঁতরাতে পারবেন, বই পড়ে  সাঁতরাতে পারবেন না।

তেমনি আপনি যদি শুধুমাত্র বই থেকে দেখে গাইড বই থেকে জবাব দেখে লিখে অভ্যস্ত হন আপনি যদি শুধুমাত্র একই বই থেকে ক্লাসরুমে টিচার সারা জীবন যাপন গেছেন সেই পড়া দেখেই জবাব দিতে অভ্যস্ত হন প্রশ্নের উত্তর লিখতে অভ্যস্ত হন মাসআলা দিতে অভ্যস্ত হন তাহলে আপনি কখনোই একটা ক্রিটিকাল পয়েন্টে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো জবাব দিতে পারবেন না।

কারণ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য জবাব দিতে পারতে হলে আগে আপনাকে গবেষণার মেথডোলজিতে অভ্যস্ত হতে হবে। আপনি পড়ালেখা করে পাস করে আসলেন তারপরে বিভিন্ন বই ঘেঁটে একটা জবাব দিতে পারলেই সেটা গবেষণায় অভ্যস্ততা না! সেটা হচ্ছে বই থেকে উত্তর লিখতে পারার অভ্যস্ততা!

বই থেকে উত্তর লিখতে পারার অভ্যস্ততা বা ওস্তাদকে প্রশ্ন করে একটা উত্তর জেনে সেটা বলে দিতে পারা এক জিনিস, আরঃ
সাইন্টিফিক মেথডোলজি নিজের মাথার ভিতরে ঢুকিয়ে রেখে
সেই মেথডোলজি তে চিন্তা করতে পারা
সেই মেথডোলজি তে কথা বলতে পারা
সেই মেথডোলজি তে উত্তর বের করতে পারা- সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

আসমান ও জমিন পার্থক্য।
এই আসমান ও জমিন পার্থক্যটা কে গুটিয়ে নিতে পারতে হলে অর্থাৎ একজন গ্রহণযোগ্য মানুষ হিসেবে, একজন গ্রহণযোগ্য ধর্ম সিদ্ধান্ত সহায়ক হিসেবে, একজন গ্রহণযোগ্য আলিম হিসাবে উঠে দাঁড়াতে হলে- আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে সাইন্টিফিক মেথড থাকতেই হবে।

এবং সেই সাইন্টিফিক মেথড থাকার উপায় একটাই, সেটা হচ্ছে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটা বিষয় নিয়ে অন্ততপক্ষে 6 মাস এবং তারপর আবারো একবার অন্ততপক্ষে 6 মাস সাইন্টিফিক পদ্ধতিতে গবেষণা প্র্যাকটিক্যালি করা এর ফলে আসলে সেই গবেষক যে শুধুমাত্র ওই একটা বিষয়ে দক্ষ হবেন তাই না। তিনি যা নিয়ে গবেষণা করছেন সেটা নিয়ে তো তিনি দক্ষ হবেনই।

পাশাপাশি তিনি নতুন পদ্ধতিতে চিন্তা করতে,
নতুন পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান করে আনতে,
শিখবেন। অর্থাৎ তিনি মানুষটাই বদলে যাবেন। তার লেভেলটাই বদলে যাবে।

এখন আমার প্রশ্ন এটুকু,
সকল ঘরানার সকল ফিরকার মুসলিমদের গবেষণা করার জন্য এবং গবেষণাপত্র প্রকাশ করার জন্য একটা সাইন্টিফিক মেথডোলজি গবেষণা ইনস্টিটিউট আপনারা করবেন কিনা? কে করবেন? কখন করবেন? কীভাবে করবেন?


Top