হজরত সওদা বিনতে জামআ (রাদ্বিয়ালাহু আনহা)
🖋মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ
.......................................................................
সুখ ও শোক - এ দুটো ডানা নিয়েই জীবনপাখি ওড়ে। এভাবেই এক সময় হারিয়ে যায় মহাসময়ের অন্তহীন আকাশে। এ নিয়ম অনিবার্য, অনড়। “প্রতিটি জীবনকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়”। এই মহাবাণীটিও অলঙ্ঘনীয়। সকল ক্ষেত্রে। সর্বত্র।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একথা জানেন। মানেন। প্রচার করেন -- মহাবিশ্বের মহাপ্রভুপালকই জীবনদাতা, মৃত্যুপ্রদাতা। তাঁর কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে। উপাসনা করতে হবে কেবল তাঁর। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তো তাঁরই প্রত্যাদেশবাহক। তাঁরই প্রতি সতত সমর্পিত। তিনিই অনুগ্রহ করে খাদিজার মতো কল্যাণময়ী ও শান্তিময়ী সাথীকে দিয়েছিলেন। তিনিই তাঁকে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর একান্ত সকাশে। ধৈর্য ধরতে হবে।
মক্কার দিবস ও রজনী এখনো আগের মতোই তপ্ত ও স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। জনতা আছে। জনজীবন আছে। আছে জীবনসমর। সত্যমিথ্যার নিরবচ্ছিন্ন দ্বন্দ্ব।
নবীজীবন শুধু বেদনাবিধুর। শোকাতুর। তাঁর সংসার এখন ঝড়ে বিধ্বস্ত পাখির নীড়ের মতো। বিপর্যস্ত আর তিনি যেনো সাথীহীন পাখি। সাহাবীগণ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শোককে শান্তি ও শক্তিতে পরিণত করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু প্রথমে ভেবে পেলেন না, কীভাবে শুরু করতে হবে। আপনজনদের অনেকে এখনও শত্রু। তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রতিপত্তিশীল। কিন্তু কেউ শুনুক-- না শুনুক মহাসত্যের প্রচার তো তাঁকে করতেই হবে। একদিন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গেলেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বনী বকর ইবনে ওয়ায়েল নামক জনপদে। সেখানকার অধিবাসীদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান জানলেন।
তারা সাড়া দিলো না। সেখান থেকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গেলেন কাহাতানে। তারা অবশ্য প্রথমে তাঁর সমাদর করলো, কিন্তু পরে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলো সম্ভবতঃ কুরায়েশ গোত্রপতিদের ভয়ে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাহাতান থেকে অগ্রসর হলেন তায়েফের দিকে। হজরত যায়েদ ছিলেন সফরসঙ্গী। তায়েফের পার্শ্ববর্তী জনপদ ছাকীফে অবস্থান গ্রহণ করলেন। এক মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হলো। তিনি সেখানকার মানুষকে ইসলাম গ্রহণ করতে বললেন। তারা শুনলো।
প্রথমে উপেক্ষার মনোভাব দেখালো। পরে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলো। শেষে শুরু করলো শত্রুতা। শুরু করলো ব্যঙ্গবিদ্রুপ ও অত্যাচার। ক্রীতদাস ও শ্রমিকদেরকে তাঁর পিছনে লেলিয়ে দিলো তারা। তারা তাঁকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দিতে লাগলো। গালিগালাজ করলো। পাথর ছুঁড়ে মারলো। হজরত যায়েদ তাদেরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলেন। প্রস্তরবৃষ্টি ঠেকাতে চাইলেন হাত ও শরীর দিয়ে। কিন্তু পারলেন না। রক্তাক্ত হলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র শরীরও রক্তসিক্ত হলো।
আঘাতপ্রত্যাঘাত তাঁর অপরিচিত নয়। প্রায় দশ বছর ধরে মক্কাবাসীরা তাঁকে কষ্ট দিয়ে এসেছে। এখনো দিচ্ছে। কিন্তু আজকের মতো এতো মুসিবত আগে তো কখনো আসেনি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং বলেছেন, সবচেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছি তায়েফে। আমি সেখানে আবদ ইবনে লাইল ইবনে কেনানের কাছে সত্যধর্মের আমন্ত্রণ নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেনি। আমি ব্যথিত হৃদয়ে সেখান থেকে ফিরে এসেছিলাম। তারা পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলো ।
আমাকে রক্তাক্ত করেছিলো। আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না। জ্ঞান যখন এলো, তখন দেখলাম, একখন্ড মেঘ আমার মাথার উপরে ছায়া বিস্তার করে আছে। জিব্রাইল আবির্ভূত হলেন। বললেন, আপনার প্রভুপালক সর্বদ্রষ্টা। তিনি সবকিছুই দেখেছেন। পাঠিয়ে দিয়েছেন পর্বতের ফেরেশতাদের। তারা আপনার নির্দেশানুগত। আপনি যা চাইবেন, তারা তাই করবে। পর্বতরক্ষক ফেরেশতাদের নেতা আমার সামনে এসে আমাকে ইয়া রসুলাল্লাহ বলে সম্বোধন করলো। সালাম দিয়ে বললো, আমি পাহাড় পর্বতের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাদের নেতা। নির্দেশ দিলে মক্কার দু’পাশের দুটি পাহাড় এনে আমি তাদেরকে পিষে মারবো। আমি বললাম, আমি তো তা চাইনা। বরং কামনা করি, আল্লাহ্পাক হয়তো এদের বংশে এমন মানুষ সৃষ্টি করবেন, যারা তাঁর ইবাদত করবে এবং কাউকে বা কোনো কিছুকে তাঁর সঙ্গে শরীক করবে না।
ব্যাথাবেদনা জর্জরিত মর্মাহত নবী মক্কার পথ ধরলেন। সামান্য বিশ্রামের আশায় প্রবেশ করলেন পথিপার্শ্বের একটি ফলের বাগানে। বাগানের তত্বাবধায়ক তাঁকে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত দেখে মমতাপরবশ হলেন। আঙ্গুরের একটি ছড়া তাঁর আদাম নামক এক খ্রিস্টান ক্রীতদাসের মাধ্যমে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিসমিল্লাহ বলে আঙ্গুরের দিকে হাত বাড়ালেন। আদাম বিস্মিত হয়ে বললো, আল্লাহর শপথ! আমি তো এখানকার কোনো লোককে এমন কথা বলতে শুনিনি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি কোথাকার লোক? সে বললো, নিনওয়া (নিনেভ)। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি তো দেখছি মহাপুণ্যবান ইউনুস ইবনে মুত্বঈর এলাকার লোক। আদাম বললো, আপনি তাঁর সম্পর্কে জানলেন কীভাবে?মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তিনি আমার ভ্রাতা। আমার মতো তিনিও আল্লাহর নবী।
আদাম বললো, আপনার নাম কী? বললেন, মোহাম্মদ। সে বললো, আপনার নাম আমি তওরাত গ্রন্থে অনেকবার পাঠ করেছি। পড়েছি-- আপনি মক্কায় আবির্ভূত হবেন। মক্কাবাসীরা আপনাকে মানবে না। আপনাকে জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করবে। অবশেষে আপনাকে সাহায্য করা হবে এবং আপনার ধর্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।
আদাম মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাতে ও পায়ে চুম্বন করলো। চোখে মুখে তাঁর হাত পায়ের স্পর্শ বুলিয়ে নিলো এবং ইসলাম গ্রহণ করলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আনন্দিত হলেন। অসংখ্য কৃতজ্ঞতা জানালেন মহান আল্লাহ্ সমীপে। দোয়া করলেন, হে আমার আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে অনুযোগ করছি আমার শক্তিহীনতার, কৌশলহীনতার এবং অসহায়ত্বের।
তুমিই অসহায়ের সহায়। তুমি আমাকে এমন শত্রুর কাছে সমর্পণ করেছো, যারা আমাকে দেখলেই রাগান্বিত হয়, অথচ আমাকে করেছো তাদের শুভাকাঙ্খী ও রক্ষক। তুমি যদি আমার প্রতি অতুষ্ট না হও, তবে আমি কোনো কিছুরই পরওয়া করি না। আমি তোমার আনুরূপ্যবিহীন অবয়বের নূরের আশ্রয়প্রার্থী-- যার মাধ্যমে ঘুচে যায় সকল অন্ধকার। সকল দিক হয় আলোকিত। ঠিক হয়ে যায় পৃথিবী ও পরবর্তী পৃথিবীর সবকিছু। আমি পরিত্রাণ চাই তোমার অপরিতুষ্টি থেকে। দয়া করে আমার প্রতি তুষ্ট হও। হও করুণাপরবশ। তোমার দিক ছাড়া অন্য কোনো দিক থেকে শক্তি যেমন নেই, তেমনি নেই সাহায্যও।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উপস্থিত হলেন নাখলা নামের এক উপত্যকায়। রাতে নামাজে দাঁড়ালেন। আবৃত্তি করতে শুরু করলেন কোরআন। তখন ওই স্থান অতিক্রম করছিলো সিরিয়ার নসীবিন শহরের অধিবাসী সাতটি অথবা নয়টি জ্বিন। তারা থমকে দাঁড়ালো। উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগলো কোরআন। তাদের কথা কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে ‘বলো, আমার প্রতি ওহী প্রেরিত হয়েছে যে, জ্বিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছে ‘আমরা তো বিস্ময়কর কোরআন শুনলাম।’তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাজ শেষ করলেন। জ্বিনগুলো তাঁর সামনে প্রকাশিত হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁরা আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন।মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কর্মপরিধি বেড়ে গেলো। মানুষের সাথে সাথে জ্বিনদের মধ্যেও প্রচার কার্য শুরুকরলেন তিনি। এবার ফিরতে শুরু করলেন মক্কার দিকে।
শুনতে পেলেন অশুভ সংবাদ। মক্কার বাইরে ইসলাম প্রচার করতে গিয়েছিলেন তিনি। কুরায়েশদের অপবিত্র অন্তরে এরকম ভাবনার উদয় হলো যে, মোহাম্মদ তার দল বড় করতে চায়। এভাবে আশে পাশের লোকদেরকে দাঁড় করিয়ে দিতে চায় কুরায়েশদের পিতৃপুরুষদের ধর্মমতের বিরুদ্ধে। তারা ঠিক করলো ওই ধর্মদ্রোহীকে মক্কায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিস্মিত হলেন। বুঝতে পারলেন, প্রিয় পিতৃব্য আবু তালেব এবং প্রিয়তমা পত্নী খাদিজা নেই বলেই তারা এরকম মারমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে পারছে। তিনি স্বজনবান্ধবদের কাছে নিরাপত্বার প্রস্তাব পাঠালেন। কেউ সাড়া দিলো না। এগিয়ে এলেন কেবল একজন-- মুতঈম। তখনো তিনি ছিলেন অমুসলিম। কিন্তু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে দেখতেন শ্রদ্ধার চোখে। বলতেন, মোহাম্মদ তো কারো অনিষ্ট করে না। কাউকে মন্দ পথে ডাকে না। তবে কেনো তাকে শত্রু ভাবতে হবে। তিনি নিরাপত্বা প্রদানের অঙ্গীকার করলেন। নিজ গোত্রের লোকদের অস্ত্রসজ্জিত করে রাখলেন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কায় প্রবেশ করলেন। প্রথমে উপস্থিত হলেন কাবা প্রাঙ্গণে। হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। তওয়াফ শেষ করে দু’রাকাত নামাজ পাঠ করলেন। তারপর নিজ গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, ফাতেমা ও উম্মে কুলসুম কন্যাদ্বয় কবে থেকে তাঁর পথ চেয়ে আছে। নিতান্তই বালিকা তারা, মাতৃহারা। তাদের দিকে তাকালে শুধু খাদিজার কথাই মনে পড়ে। এইতো ক’দিন আগেই তাঁর সংসার ছিলো শান্তিও জ্যোতিতে ভরপুর। খাদিজার সূক্ষ্ণ সযত্ন তত্বাবধান সারাক্ষণ ঘিরে রাখতো গৃহবাসীদেরকে। আর এখন? শূন্যতা। কেবলই শূন্যতা।
দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহণ করবেন, এরকম ভাবনা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হৃদয়ে কখনোই স্থান পায়নি। একথাও তাঁর মনে কখনো উদয় হয়নি যে, জীবন কখনো খাদিজাবিহীন হবে। তাই তো হলো। প্রয়োজন আজ গৃহদ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে। উপরোধ জানাচ্ছে, বিধ্বস্ত বাসা পুনঃনির্মাণ করতে হবে। ঝড়ে ঘর উড়ে গেলে সে ঘরকে আবার নতুন করে গড়ে নিতে হয়।
মহাদুর্ভাবনায় পড়ে গেলেন সাহাবীগণ। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারলেন না, কী করলে বিষন্ন নবীর মুখমন্ডলে ফুটে উঠবে প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তির দ্যুতি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভাবনামগ্ন হন। কিন্তু পরিহার করে চলেন ব্যগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা। বিশ্বাস করেন, সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা মহাপ্রভুপালকের পক্ষ থেকেই আসবে শান্তিও সমাধান। তিনিই শান্তি এবং সমাধানপ্রদাতা।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মাতৃস্থানীয়া খাওলা বিনতে হাকীম এলেন একদিন। তিনি ছিলেন স্বনামধন্য সাহাবী হজরত ওসমান ইবনে মাজউনের সহধর্মিণী। সাধারণ কথাবার্তার মাধ্যমে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো। তারপর মূল প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন এভাবে-- হে আল্লাহর রসুল! সংসারকে তো সচল করতে হবে। একজন গৃহকত্রী ছাড়া এ কাজ আর কে করবে। জানি, খাদিজার মতো আর কাউকে আপনি পাবেন না। কিন্তু আপনার সংসারকে পুনর্বার সুরভিত করে তুলবে, এমন নারীও তো আছেন, তারা আপনার অনুপযুক্ত হবে না নিশ্চয়।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমার এই শৃঙ্খলাহীন সংসারকে কে আবার জোড়া লাগাতে রাজী হবে? কে আছে এমন আত্মস্বার্থত্যাগিনী? খাওলা বললেন, আছে। আপনি যেমন চান, তেমনই পাবেন। প্রবীণা, অথবা নবীনা।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলেন। খাওলা বললেন, সওদা বিনতে জামআ। আর একজন আপনার বাল্যবন্ধু ও আপনার সার্বক্ষণিক সহচরের কন্যা আয়েশা।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মৌন সম্মতি জানালেন। খাওলা আর দেরী করলেন না। তখনই গিয়ে উপস্থিত হলেন হজরত সওদার বসতবাটিতে। তাঁর পিতা তখন বয়োবৃদ্ধ। সাংসারিক কর্মতৎপরতার সঙ্গে শিথিল সম্পর্ক বজায় রেখে অপেক্ষা করছেন পরপার যাত্রার। খাওলা বললেন, আনঈম সাবাহান (সুপ্রভাত)।
বৃদ্ধ প্রতিসম্ভাষণ জানালেন। বললেন, কে তুমি? খাওলা বললেন, আমি হাকীমের মেয়ে খাওলা। বৃদ্ধ বললেন, ও, আচ্ছা। বসো, বসো। খাওলা বসলেন। বললেন, আমি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। মোহাম্মদইবনে আবদুলাহ্ ইবনে আবদুল মুত্বালিব সওদাকে বিবাহ করতে চান। বৃদ্ধ খুবই উৎফুল হলেন। বললেন, উত্তম প্রস্তাব। পাত্র তো অভিজাত বংশের। তা সওদা কী বলে?
খাওলা বললেন, মনে হয় সে অমত করবে না। আমি জিজ্ঞেস করে দেখছি। হজরত সওদা যেনো প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। কারণ, তিনি দেখেছিলেন দুটি শুভস্বপ্ন। তাঁর প্রয়াত স্বামী স্বপড়ব দু’টির কথা শুনে বলেছিলেন, তুমি আল্লাহর রসুলের গৃহিণী হবে।
খাওলা হজরত সওদার পিতার কাছে এসে বললেন, সওদা রাজী। এখন আপনি বললেই আমি শুভ বিবাহের আয়োজন করতে পারি। পাত্রপক্ষকে জানাতে পারি।হজরত সওদার পিতা ছিলেন খ্রিষ্টান। কিন্তু ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর গুণমুগ্ধ। বললেন, বিলম্ব করে কী হবে।
খাওলা খুবই আনন্দিত হলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবার সংসারী হবেন। অধিকতর প্রাণবন্ত হবে তাঁর প্রচারকর্ম। হবেন অধিকতর শুভসুন্দর। উদ্যমময়। সেদিনই বিবাহ বাসরের আয়োজন করা হলো। পালিত হলো নিতান্ত আড়ম্বরহীন একটি অনুষ্ঠান। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কন্যাগৃহে উপস্থিত হলেন। হজরত সওদার পিতা নিজে উকিল হয়ে তাঁর একান্ত আদরের কন্যাকে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুলের কাছে সমর্পণ করলেন। বেহেশতি বিবাহ সম্পাদন হলো এভাবেই।
হঠাৎ বিপদ দেখা দিলো একটা। শুভবিবাহ সম্পাদন হওয়ার পর সেখানে উপস্থিত হলেন হজরত সওদার ভাই আবদুলাহ্ ইবনে জামআ। তখন পর্যন্ত তিনি ছিলেন অমুসলিম। তিনি বিবাহের কথা শুনে ক্ষিপ্ত হলেন খুব। ক্ষোভে দুঃখে মাথা কুটতে শুরু করলেন। কিছুদিন পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। বিশুদ্ধচিত্ততার সঙ্গে জীবনের অবশিষ্ট সময় খেদমত করেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর। সেদিনেরঅপআচরণের জন্য তিনি সারা জীবন দুঃখ প্রকাশ করতেন।
অনেক দুর্লভ গুণের অধিকারিণী ছিলেন হজরত সওদা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখনই সত্যান্বেষী এই রমণী ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। স্বামীস্ত্রী একসঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন মহান ধর্ম ইসলামের সুশীতল ছায়ায়। তাঁর স্বামীর নাম ছিলো সাকরান। সকল সাহাবীর মতো তিনিও ছিলেন রসুল অন্তপ্রাণ। রসুলের নির্দেশক্রমে তিনি সস্ত্রীক হিজরত করেন আবিসিনিয়ায়। পরে তাঁরই নির্দেশক্রমে ফিরে আসেন মক্কায়।
সাকরান ছিলেন পুণ্যবান। ইসলাম গ্রহণের কারণে অন্য সাহাবীগণের মতো তিনিও কুরায়েশদের দ্বারা হন নিগৃহীত। হজরত সওদাও কাফেরদের আচরণে কম কষ্ট পাননি। এতদসত্তে¡ও তাঁরা ছিলেন সুখী দম্পতি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন তাঁদের উভয়ের জীবনাপেক্ষাও প্রিয়।
এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন হজরত সওদা। দেখলেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর কাছে এলেন। নিকটতর হলেন। একখানি পা রাখলেন তাঁর কাঁধে। একটু পরেই স্বপ্নভঙ্গ হলো। তিনি বিস্মিত হলেন। হজরত সাকরানকে স্বপ্নের কথা জানালেন।
তিনি বললেন, সওদা! তোমার স্বপেড়বর অর্থ এরকম-- অচিরেই আমার মৃত্যু হবে। আর তোমার বিবাহ হবে রসুলুলাহর সঙ্গে।
কিছুদিন যেতে না যেতেই আর একটি স্বপ্ন দেখলেন তিনি। দেখলেন, তিনি বালিশে হেলান দিয়ে আছেন। হঠাৎ আকাশ থেকে চাঁদ ভেঙে তাঁর কোলের উপর পড়লো। পরদিন সকালে তিনি এই স্বপড়বটির কথাও জানালেন হজরত সাকরানকে। তিনি বললেন, স্বপড়বার্থ এরকম-- আমার মৃত্যু খুবই নিকটে। আর তুমি হবে সর্বশেষ রসুলের সহধর্মিণী।
তাই হলো। কয়েকদিন পরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন হজরত সাকরান। ইসলামের উপরেই সমাপ্ত হলো তাঁর পরকালযাত্রা। প্রিয় সাহাবীর অন্তর্ধানে দুঃখিত হলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। সর্বপুরোধা হয়ে অংশগ্রহণ করলেন তাঁর দাফনকর্মে।
হজরত সওদা ছিলেন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও মমতাময়ী। তিনি তাঁর সম্পূর্ণ হৃদয় দিয়ে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করলেন। দিলেন প্রগাঢ়ভালোবাসা। সার্বক্ষণিক সেবা ও শুশ্রƒষা। নবীদুহিতাদ্বয় উম্মে কুলসুম ও ফাতেমাকে দিলেন অকৃত্রিম আদরসোহাগমমতা। মায়ের মতো। নবীদুহিতাদ্বয়ও অকৃত্রিম মমতার পরশ পেয়ে মোহিত হলেন। সংসারের অন্য দু’জন সদস্যহজরত আলী ও হজরত যায়েদও মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে প্রসন্ন হতে দেখে স্বস্তি ফিরে পেলেন। সকল সাহাবী হলেন দুঃশ্চিন্তামুক্ত।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উপরে মাঝে মাঝে অবতীর্ণ হতে শুরু করলো প্রত্যাদেশ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা প্রচার করতে লাগলেন। কিন্তু মক্কাবাসীরা তাঁর কথা শুনতেই চায় না।শুনলেও বিশ্বাস করে না। ব্যঙ্গবিদ্রুপ, উপহাসপরিহাস করে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভাবতে থাকেন, মক্কাবাসী নয়, হয়তো অন্য কোনো জনপদের অধিবাসীরা হবে ইসলামের প্রকৃত সেবক। তিনি মনস্থ করলেন, দাওয়াত ছড়িয়ে দিবেন মক্কার বাইরে। তিনি তো সকল মানুষের নবী।
একদিন মক্কায় উপস্থিত হলো বনী আশহাল গোত্রের কয়েকজন লোক। কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ হওয়াই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গেসাক্ষাত ঘটলো তাদের । তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে ইসলামের আমন্ত্রণ জানালেন। যুবক আয়াস ইবনে মুআজ মুগ্ধ হলেন। বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! এই লোকের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ হও। আল্লাহর শপথ! এঁর কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধ হওয়া অপেক্ষা উত্তম। তাঁর দলের লোকেরা দ্বিধান্বিত হলো। তারা মুসলমান হলো না। কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিবদ্ধও হলো না। মুসলমান হলেন কেবল আয়াস।
পরের বছর হজ্বের সময় মদীনা থেকে এলো খাজ্রাজদের একটি দল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে বললেন, মহাবিশ্বের মহাপ্রভুপালক আমাকে নবুওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তোমরা যদি ইমান আনো এবং দ্বীনের সাহায্যকারী হও, তবে পাবে দুনিয়া ও আখেরাতের মহাসৌভাগ্য। তারা তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বক্তব্য শুনে একে অপরের দিকে তাকালো। একজন বললো, ইনি তো সেই নবী, যাঁর সম্পর্কে ইহুদীরা আলোচনা করে।
একথা বলে আমাদেরকে ভয় দেখায়, আখেরী জামানার নবুওয়াতের সূর্য উদিত হবে আজ অথবা আগামীকাল। আমরা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিবো। আর একজন বললো, হে আমার সম্প্রদায়! সাবধান হও। ইমানে অগ্রগামী হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করো। তাঁরা সকলেই ইসলামের বায়াত গ্রহণ করলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে সাহায্য করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে মদীনায় ফিরে গেলেন। বায়াত গ্রহণের স্থান ছিলো মিনার সন্নিকটবর্তী আকাবা নামক স্থানে।
মদীনার ঘরে ঘরে শুরু হলো ইসলামের আলোচনা। শুরু হলো রসুল প্রশস্তি। মক্কায় বসে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সকল খবর পেলেন। আল্লাহ্পাকের প্রতি জানালেন অগণিত কৃতজ্ঞতা। প্রসন্ন হলেন এই ভেবে যে, বহুদিন ধরে মক্কায় ইসলাম হয়েআছে গতিহীন। স্থবির। এবার তার বান ডেকেছে মদীনায়। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পরের বছর হজ্বের মওসুমের অপেক্ষায় থাকেন। আশা করেন, এবার আরো অধিক সংখ্যকমানুষ আসবে সেখান থেকে।
ভবিষ্যতের সফলতার আশায় ও আনন্দে যখন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কায় সংকটতিক্ত কাল অতিবাহিত করছিলেন, তখনই একদিন মহারহস্যময় মেরাজের ঘটনা ঘটলো। আল্লাহ্পাক তাঁকে অলৌকিক বাহন বোরাকে করে গভীর রজনীতে প্রথমে নিয়ে গেলেন বায়তুল মাকদিসে। সেখান থেকে সরাসরি আকাশ জগতে।
সপ্তআকাশ ভেদ করে আল্লাহর আরশে উপস্থিত হলেন তিনি। আল্লাহ্পাকের নৈকট্যধন্য হলেন আনুরূপ্যবিহীনভাবে। মহান প্রভুপালকের সঙ্গে করলেন কথোপকথন। পেলেন চিররহস্যাচ্ছন্ন জ্ঞান, প্রেম ও ইবাদতের সুষ্ঠু বিধান। ফরজ করা হলো পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ।
এ সকল ঘটনা যখন ঘটছে, তখন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একমাত্র জীবনসঙ্গিনী হজরত সওদা। হজরত খাদিজার মতো তাঁকে একাই নতুন নতুন প্রত্যাদেশের উত্বাপ সত্বা দিয়ে গ্রহণ করতে হয়। গভীর, গভীরতর ভালোবাসা ও সমবেদনার সঙ্গে দিতে হয় সংকট উত্তরণের যথাযথ সান্তনা ও অনুপ্রেরণা। সামলাতে হয় সংসারের অন্যান্য ঝক্কিঝামেলাও।
পরের বছর মক্কায় উপস্থিত হয় আউস ও খাজরাজ উভয় গোত্রের প্রায় পাঁচশত লোক। তাঁদের মধ্যে তিয়াত্তর জন পুরুষ ও দু’জন মহিলা অতি সঙ্গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে গভীর রাতে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদের সাথে মিলিত হলেন আকাবায়। তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে ছিলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতৃব্য হজরত আব্বাস। তিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। কিন্তু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতি ছিলো তাঁর গভীর ভালোবাসা। তিনি বলেন, হে দূরাগত জনতা! তোমরা কী জানো, মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে? আমরা কিন্তু তাঁর নতুন ধর্মমতের বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি অবশ্যই সত্যাধিষ্ঠিত। এখন যদি তোমরা তাঁর কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ হও এবং সে অঙ্গীকারের উপরে যদি প্রতিষ্ঠিত থাকো তবে তোমরা অবশ্যই হবে কল্যাণাধিকারী। আর যদি অঙ্গীকার রক্ষা করতে না পারো তবে এখনই সে কথা তাঁকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দাও। অন্যথায় পরবর্তীতে আক্ষেপ করতে হবে। কারণ তখন তোমরা হবে আমাদের শত্রু।
আনসারগণের একজন বললেন, হে নেতৃপ্রবর! আপনার কথা আমরা শুনলাম। অনুধাবন করলাম। তারপর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দিকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনি যেভাবে আমাদেরকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে চান করুন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোরআনুল করীমের কতিপয় আয়াত পাঠ করলেন। তারপর বললেন,আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার হচ্ছে-- তোমরা তাঁরই ইবাদত করবে। তাঁর সঙ্গে কাউকে অথবা কোনোকিছুকে শরীক করবেনা। আর আমার সঙ্গে অঙ্গীকার হচ্ছে-- তোমরা ইসলাম প্রচারে আমার সহযোগী হবে। কাফেরদের আক্রমণ প্রতিহত করবে। প্রস্তুত থাকবে জেহাদের জন্য। আমি যা বলবো, তোমরা তা মেনে নেবে নির্বিবাদে। নির্দেশ পালন করবে সুখেদুঃখে সর্বাবস্থায়। আল্লাহর পথে উৎসর্গ করবে তোমাদের জীবন ও সম্পদ। আমি শীঘ্রই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবো।
তখন তোমরা এমনভাবে আমাকে রক্ষা করবে, যেমনভাবে রক্ষা করো তোমাদের জীবনসম্পদ ও সন্তানসন্তুতিকে। আনসার পক্ষের নেতা বললেন, হে আল্লাহর বাণীবাহক! আপনি ভালোভাবে জানেন যে, আমাদের পিতাপিতামহদের কাজ ছিলো যুদ্ধবিগ্রহ। কিন্তু আমরা মদীনার ইহুদীদের সঙ্গে কিছু বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করলাম। চির অনুগত হলাম কেবল আপনার। তবে একটি কথা-- এমন তো কখনো হবে না যে, আপনি বিজয়ী হবেন, তারপর আমাদেরকে ফেলে চলে যাবেন আপনার সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে? মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মৃদু হাসলেন। বললেন, না। সেরকম হবে না। আমি তোমাদের সাথেই থাকবো।
হজরত সাওদা তাঁর প্রিয়তম স্বামীর সান্নিধ্যে সারাক্ষণ থাকতে চান। কিন্তু, পারেন না। দায়িত্ব পালন করেন কেবল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর গৃহবাসের সময়। কিন্তু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জন্য অপেক্ষা করেন সর্বক্ষণ। তাঁর গভীর রাতের গমন ও আগমন যে সত্যধর্মের প্রচার ব্যপদেশেই, তা তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন। যা সঙ্গোপনে রাখবার, তা সঙ্গোপনেই রাখেন। শুনতে পান, ইসলামের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে, অনেক দূরে, মদীনায়। আরো ঈঙ্গিত পান, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেখানেই হিজরত করে যাবেন। হিজরতের অভিজ্ঞতা তাঁর ছিলোই। এখনও তিনি হিজরতের জ্যোতিধারায় ¯স্নাত হতে চান, যদি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নির্দেশ করেন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে নির্দেশ দিলেন, যে যেভাবে পারো হিজরত করে মদীনায় যাও। মক্কায় ইসলাম অবরুদ্ধ। সুতরাং হিজরতভূমিই হবে এবার ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র।
কাফের কুরায়েশেরা ছিলো দেশত্যাগের বিরুদ্ধে। তাই অধিকাংশ সাহাবীকে গোপনে মক্কা ত্যাগ করতে হলো। হিজরত করলেন হজরত হামযা, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, তালহা ইবনে ওবায়দুলাহ, ওসমান ইবনে আফ্ফান, যায়েদ ইবনে হারেছা, আমর ইবনে ইয়াসার, আবদুলাহ্ ইবনে মাসউদ এবং হজরত বেলাল রদ্বিআলাহু আনহুম।
হজরত আয়াস ইবনে রবীআ গেলেন বিশজন প্রধান সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে। হজরত ওমর তাঁর ভাই জায়েদ ইবনে খাত্বাবকে নিয়ে হিজরত করলেন প্রকাশ্য দিবালোকে। প্রথমে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে ভাইকে নিয়ে উপস্থিত হলেন কাবাপ্রাঙ্গণে। কাফেরদের অনেকে সেখানে বসে ছিলো। তিনি তাওয়াফ করলেন। মাকামে ইব্রাহীমে দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। বললেন, যারা পাথরের টুকরাকে মাবুদ মনে করে, তারা অপ্রসন্ন হোক। আরো বললেন, আমি মদীনায় যাচ্ছি। কেউ যদি তার সন্তানসন্তনিকে এতিম ও স্ত্রীকে বিধবা বানাতে চায়, তবে সে যেনো আমার সামনে আসে। তাঁর কথা শুনে সকলে স্তম্ভিত ও ভীত হলো। সামনে আসার সাহস পেলো না কেউ।
মক্কাশরীফে রইলেন কেবল আল্লাহর রসুল, হজরত আবু বকর এবং তাঁদের পরিবারবর্গ। হজরত আলীও ছিলেন। তিনি তখনও মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পরিবারভূত। যারা দুর্বল ও অসামর্থ্য, এরকম কিছু মুসলমানও বাধ্য হলেন মক্কায় থেকে যেতে। কুরায়েশ গোত্রপতিরা বুঝতে পারলো, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও হিজরত করবেন। সেখানে গিয়ে নেতৃত্ব দিবেন ক্রমবর্ধমান মুসলিমবাহিনীর। তারা পরামর্শ সভায় মিলিত হলো। সিদ্ধান্ত নিলো, তাঁকে হত্যা করতে হবে। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রিয়তম নবীকে প্রত্যাদেশ করলেন ‘স্মরণ করো ওই সময়ের কথা, যখন কাফেরেরা তোমার ব্যাপারে গোপনে ষড়যন্ত্র করছিলো-- তোমাকে বন্দী করবে অথবা হত্যা করবে, কিংবা দেশান্তরিত করবে। তারা ষড়যন্ত্র করছিলো, আর আল্লাহ্ ও পরিকল্পনা করছিলেন। আল্লাহ্ই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী।’
মদীনাবাসীরা উৎফুল। উচ্ছাসিত। উল্লসিত। আলোর বন্যায় পাবিত হয়েছে সমস্ত জনপদ। আজ থেকে শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবীর সংসর্গধন্য হতে পারবেন জনপদবাসীরা। ইয়াসরিব নামের এই ভূমি এখন থেকে হবে মদীনা । মদীনাতুল মুনাওয়ারা। তাঁরা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে জানালেন প্রাণঢালা সম্বর্ধনা। শুভেচ্ছা। স্বাগতম। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রথম যেখানে থামলেন, সে স্থানটির নাম কোবা। সেখানে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আবু বকর, হজরত ওমর এবং হজরত ওসমানকে সঙ্গে নিয়ে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনদিন পর পায়ে হেঁটে মক্কা থেকে এলেন হজরত আলী।
তিনিও মসজিদ নির্মাণকর্মে অংশগ্রহণ করলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সবাইকে নিয়ে জামাতবদ্ধ অবস্থায় নামাজ পড়লেন। সম্মিলিত উপাসনার প্রকাশ্য সৌন্দর্য অবলোকন করে বিমোহিত হলেন। শোকর করলেন কেবল আল্লাহর।
আরো অগ্রসর হলেন। উপস্থিত হলেন আনসার সাহাবী হজরত আবু আইয়ুব আনসারীর গৃহে। আল্লাহর নির্দেশপ্রাপ্ত তাঁর কাস্ওয়া নামের উষ্ট্রীটি সেখানেই বসে পড়লো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেখানে অবতরণ করলেন। স্থির করলেন, এস্থানে নির্মাণ করা হবে মসজিদ এবং মসজিদ সংলগ্ন বসতবাড়ি।
সকল সাহাবী নির্মাণকর্মে অংশ নিলো। প্রত্যহ পাঁচবার ধ্বনিত হতে লাগলো আজান। প্রতিষ্ঠিত হলো নামাজ। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত সওদা ও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে দীর্ঘ বিচ্ছেদের অবসান ঘটাতে মনন্থ করলেন। হজরত যায়েদ ইবনে হারেছা এবং ক্রীতদাস আবু রাফেকে পাঁচ শত দিরহাম ও দুটি উট দিয়ে মক্কায় পাঠালেন। তাঁরা যথাসময়ে হজরত সওদা, হজরত উম্মে কুলসুম, হজরত ফাতেমা, ওসামা ও তাঁর মা এবং উম্মে আয়মনকে মদীনায় নিয়ে এলেন। হজরত আবু বকরের পরিজনও নিরাপদে মদীনায় উপস্থিত হতে সক্ষম হলো।
প্রায় তিন বছর ধরে সুখ ও দুঃখের জীবনসঙ্গিনী ছিলেন একজনই-- হজরত সওদা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সম্পর্কে কখনো কোনো বিরূপতা প্রকাশ করেননি। উপরন্তু তাঁর অন্তরনিংড়ানো ভালোবাসা ও সেবাপরায়ণতার জন্য তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন প্রীত ও নিশ্চিন্ত। হজরত সওদার সমস্ত সত্বাই ছিলো আনুগত্যময়, উৎসর্গশোভিত।
হজরত সওদাকে বিবাহ করার অল্প কিছু দিন পরে হজরত আয়েশাকে বিবাহ করেছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। তখন হজরত আয়েশার বয়স ছিলো মাত্র ছয় বছর। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে পিতৃগৃহেই রেখে দিয়েছিলেন। মদীনায় যখন আনলেন, তখন তার বয়স হয়েছে নয় বছর। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাত্র নয় বছরের এই উম্মতজননীকে নিয়ে সংসার শুরু করলেন।
অন্যান্য সাহাবী ও সাহাবীয়ার মতো হজরত সওদাও মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে ভালোবাসতেন নিজের জীবনের চেয়ে বেশী। তাঁর সারাক্ষণের সাধনা ছিলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে পূর্ণ পরিতুষ্ট রাখা। তিনি লক্ষ্য করলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আয়েশার সান্নিধ্যেঅধিক সময় অতিবাহিত করতে পারলে আনন্দিত থাকেন। হজরত আয়েশাকে তিনিভালোবাসেন খুব।
হজরত আয়েশাও হজরত সওদাকে ভালোবাসেন গভীরভাবে। সপত্নীসুলভ ঈর্ষা তাদের অন্তরে কখনোই স্থান খুঁজে পায়নি। হজরত সওদা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আত্মসুখের কথা আর ভাববেনই না। ভাববেন কেবল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং আয়েশার সুখের কথা। একদিন তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আমি আমার পালার রাত্রি আয়েশাকে দান করলাম। আজ থেকে আমার অধিকারের ব্যাপারে আপনি দায়মুক্ত। পৃথিবী ও পরবর্তী পৃথিবীতে আমি আপনার স্ত্রী-- আমি এই পরিচিতিটুকুই চাই কেবল।
হজরত আয়েশা ছিলেন হজরত সওদার গুণমুগ্ধ। তাঁর মতো সুপ্রশ¯অন্ত করণের কাউকে মনে হয় তিনি আর কখনো দেখেননি। তাই কেবল তাঁর সম্পর্কেই বলতে পেরেছিলেন, সওদার শরীরে যদি আমার আত্মা স্থান পেতে পারতো। তিনি আরো বলেছেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর স্ত্রীগণের মধ্যে সওদাই ছিলেন অধিক উচ্চতাবিশিষ্ট ও স্থূলকায়। তাই তাকে লোকে সহজেই সনাক্ত করতে পারতো।
গৃহের বাইরে যাওয়ার বিষয়টি উম্মাহাতুল মু’মিনীনের জন্য শোভন নয়-- এরকম মনোভাব পোষণ করতেন হজরত ওমর। বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা তাঁদেরও মনে স্থান পেতো না কখনো। কিন্তু অতি ভোরে বা রাতে প্রকৃতির প্রয়োজনে তাঁদেরকে বাইরে যেতেই হতো।
একদিন হজরত সওদা রাতে বাইরে যাচ্ছিলেন।হজরত ওমর তাঁকে দেখে ফেললেন। বললেন, হে উম্মতজননী! আপনাকে আমিচিনে ফেলেছি।
হজরত সওদা লজ্জা পেলেন। রাগান্বিতও হলেন। তাঁর নামে নালিশও করলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সকাশে। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই অবতীর্ণ হলো পর্দা সম্পর্কীয় আয়াত।ঈষৎ উষ্ণ স্বভাব সম্পন্না ছিলেন তিনি। কিন্তু তার মধ্যেও প্রকাশ পেতো তাঁর সরলতার সৌন্দর্য। পবিত্রতার দ্যুতি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন তাঁর জ্যোতির্ময় সারল্যের গুণগ্রাহী। নবীঅন্তপ্রাণ তাঁর এই দুঃখের দিনের সহধর্মিণীর কার্যকলাপ দেখে আনন্দিত হতেন। কখনো হাসতেন। যেমন একদিনের ঘটনা-- হজরত সওদা বললেন, হে আল্লাহর বাণীবাহক! কাল রাতে আমি আপনার পশ্চাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছি। আপনি দীর্ঘ সময় ধরে রুকুতে ছিলেন। আমার অবস্থা এমন যে, মনে হচ্ছিল আমার নাক থেকে রক্ত ঝরবে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর একথা শুনে হেসে ফেললেন।
আর একদিনের ঘটনা। উম্মতজননী হজরত আয়েশা ও হজরত হাফসা তাঁকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তাঁরা রহস্য করে বললেন, আপনি কি কিছু শুনেছেন? হজরত সওদা বললেন, কোন বিষয়ে? তাঁরা বললেন, দাজ্জালের বিষয়ে। দাজ্জাল নাকি বের হবে? তাঁদের কথা শুনে তিনি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। পাশেই একটি তাঁবুর মধ্যে কিছু লোক আগুন পোহাচ্ছিলো। তিনি তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়লেন। তাঁরা দু’জন হাসতে হাসতে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে এসে সব খুলে বললেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও একটু এগিয়ে ওই তাঁবুর কাছে গেলেন। বললেন, সওদা! বের হয়ে এসো। দাজ্জাল বের হয়নি। হজরত সওদা বের হয়ে এলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেখলেন, তাঁর গায়ে লেগে রয়েছে মাকড়সার জাল।
মক্কার জীবন ছিলো দুঃখকষ্টে ভরা-- আত্মরক্ষামূলক। কাফেরেরা অত্যাচারের পর অত্যাচার করেই যেতো। মুসলমানদেরকে নীরবে সবকিছু সহ্য করতে হতো। মদীনার পরিস্থিতিতে প্রতিবাদদীপ্ত হতে পারলেন সবাই।
আল্লাহ্পাকের পক্ষ থেকে দেওয়া হলো জেহাদের অনুমতি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও সবাইকে অস্ত্রসজ্জিত হতে নির্দেশ দিলেন।
অবতীর্ণ হলো-- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা যখন সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের সম্মুখীন হবে, তখন তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না; সেদিন যুদ্ধকৌশল অবলম্বন কিংবা স্বীয় দলে স্থান গ্রহণ করা ব্যতীত কেউ তাদেরকে পৃষ্ঠপ্রর্দশন করলে সে তো আল্লাহর বিরাগভাজন হবে এবং তার আশ্রয় জাহান্নাম, আর তা কতো যে নিকৃষ্ট’ ।
বদর প্রান্তরে মুসলিমবাহিনী দাঁড়ালো বিশাল মুশরিকবাহিনীর সামনে। যুদ্ধ শুরু হলো। আবু জেহেলসহ নিহত হলো মুশরিকদের অনেক নেতা। অনেকে বন্দী হলো। তাদেরকে মদীনায় নিয়ে এলো বিজয়ী বাহিনী। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শ্রদ্ধেয় পিতৃব্য হজরত আব্বাস, বড় কন্যার জামাতা আবুল আসও ছিলেন তাদের মধ্যে।
বন্দী হয়ে এলো হজরত সওদার পূর্ব স্বামীর ভাই সুহাইল ইবনে আমর। হজরত সওদা ছিলেন তখন আফরার ছেলে আউফ ও মুয়াওজির বাড়িতে। বন্দীদের সংবাদ পেয়ে তিনি গৃহে ফিরে এলেন। দেখতে পেলেন অন্য বন্দীদের মতো তাকেও বেঁধে আনা হয়েছে। দুই হাত তার গলার সঙ্গে বাঁধা। তিনি তার এই দুরবস্থা সহ্য করতে পারলেন না। বললেন, এভাবে ধরা দিলে কেনো? মরতে পারলে না? মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সওদা! তুমি কি তাকে আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে চাও? হজরত সওদা সম্বিত ফিরে পেলেন। বললেন, আমি সুহাইলের দুরবস্থা দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। এখন আমি অনুতপ্ত। দয়া করে আমার জন্য মাগফেরাত কামনা করুন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করুন।
পরের বছর সংঘটিত হলো উহুদ যুদ্ধ। বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মুশরিকবাহিনী উপস্থিত হলো মদীনার উপকণ্ঠে, উহুদে। এ যুদ্ধে মুসলিমবাহিনী খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হলো। শহীদ হলেন শহীদশ্রেষ্ঠ হজরত হামযাসহ সত্তরজন সাহাবী। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রক্তরঞ্জিত হলেন। তাঁর এমতো অবস্থা দেখে দুঃখশোকে কাতর হয়ে পড়লেন তাঁর সহচর ও সহচরীগণ। হজরত সওদার হৃদয় হলো রক্তরঞ্জিত। প্রিয়তম নবীর সেবাশুশ্রƒষায় আত্মনিয়োগ করলেন। পরম মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে অল্পদিনেই সুস্থ করে তুললেন তাঁকে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সংসার বড় হতে লাগলো। বাড়তে লাগলো বিশ্বাসী ও বিশ্বাসিনীগণের সংখ্যা। তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘরণী হিসেবে একে একে অনেকেই এলেন। এলেন হজরত হাফসা, হজরত যয়নাব বিনতে খুযায়মা, হজরত উম্মে সালমা, হজরত যয়নাব বিনতে জাহাশ, হজরত জুওয়াইরিয়া, হজরত উম্মে হাবীবা, হজরত সাফিয়া এবং হজরত মায়মুনা (রদ্বিআলাহু তায়ালা আনহুমা)। হজরত সওদা তাঁদের সকলকেই ভালোবাসলেন। সপত্নীসুলভ কোনো হিংসা তাঁর অন্তরে কখনো ছিলোই না। কিন্তু হজরত আয়েশার সঙ্গে তাঁর ভালোবাসা ছিলো সর্বাপেক্ষা অধিক গভীর। সমবয়স্কা না হলেও তাঁরা ছিলেন পরস্পরের অন্তুরঙ্গ বন্ধু। নিঃসন্দেহে সে বন্ধুত্ব রচিত হয়েছিলো স্নেহ ও শ্রদ্ধার জ্যোতির্ময়সংশেষে।
সপত্নীসুলভ হিংসা অন্যায় নয়, বরং মানবচরিত্রের সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ এক প্রবৃত্তি। যাঁরা শুদ্ধস্বভাবিনী, তাঁদের এমতো প্রবৃত্তির মধ্যে রয়েছে একপ্রকারের সূর্য সৌন্দর্য। কারণ এর উৎপত্তি গভীরতর প্রেম থেকে। এই সূর্য প্রেমবোধটি হজরত আয়েশা সিদ্দীকাসহ অন্যান্য উম্মতজননীগণের মধ্যেও কমবেশী প্রকাশ পেতো। কিন্তু জননী সওদার মধ্যে তা একেবারেই ছিলো না। জননী আয়েশা তাই তাঁর প্রতি প্রকাশ করতেন অকৃতিম মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধা। বলতেন, আমার আত্মাটি যদি সওদার দেহাভ্যন্তরে স্থান পেতে পারতো।
জননী আয়েশা সিদ্দীকা একবার জননী সওদাকে নিয়ে একটি অম্লমধুর ঘটনার অবতারণা করলেন। তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন, রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে মাঝে মাঝে মধুর শরবত পান করতে দিতেন হাফসা। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিষ্টি ও মধু খুবই পছন্দ করতেন। তাঁর পবিত্র অভ্যাস ছিলো, সাধারণতঃ আসরের নামাজের পর তাঁর সহধর্মিণীগণের প্রকোষ্ঠে যেতেন। একদিন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আসরের পরে প্রবেশ করলেন হাফসার প্রকোষ্ঠে। সেখানে অনেকক্ষণ অবস্থান করলেন।
আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম, হাফসার এক আত্মীয়া মধু উপহার দিয়েছে। সেই মধুর শরবত বানিয়ে সে রসুলুলাহ্কে পান করতে দিয়েছে। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর শপথ! এর একটা কিছু বিহিত আমি করবোই। সওদাকে বললাম, রসুলুলাহ্ যখন তোমার কাছে আসবেন, তখন তুমি বোলো, আপনি মনে হয় মাগ্ফীর পান করেছেন। তিনি বলবেন, না তো। তুমি বোলো, তাহলে আমি গন্ধ পাচ্ছি কিসের? তুমি তো জানো মাগ্ফীরের গন্ধ তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না। তিনি যখন বলবেন, আমি তো এই মাত্র হাফসার ঘর থেকে মধুর শরবত পান করে এলাম। তুমি তখন বোলো, তাহলে মৌমাছিরা মাগফীর ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করেছে। আর শোনো, আমার কাছে এলে আমিও তাঁকে একই কথা বলবো। সাফিয়াকে বলে দিবো, সেও যেনো এমন করে বলে। এরপর রসুলুলাহ্ যখন সওদা, সাফিয়া ও আমার কাছে এলেন, তখন আমরা সাজানো কথাগুলো বললাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিব্রত হলেন। আবার হাফসার কাছে গেলেন। হাফসা বললেন, হে আল্লাহর রসুল! মধুর শরবত কি আরো পান করবেন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, না, না। মধুর শরবত আর কখনো পান করবো না। সওদা আমাকে বললেন, আয়েশা! কাজটা কি ঠিক হলো? আমি বললাম, চুপ।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হলো, ‘হে নবী! আল্লাহ্ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন, তুমি তা নিষিদ্ধ করছো কেনো? তুমি কি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি কামনা করছো; আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ এর অর্থ-- হে আমার প্রিয়তম রসুল! আল্লাহ্ আপনার জন্য যা বৈধ করেছেন, তাকে আপনি অবৈধ করতে চাইছেন কেনো? মধু তো হালাল। তবে পত্নীকে তুষ্ট করতে গিয়ে স্বেচ্ছায় নিজের জন্য তা হারাম করে নিবেন কেনো? সুতরাং আর কখনো মধুর শরবত পান করবেন না বলে যে প্রতিজ্ঞা আপনি করেছেন, তা ভঙ্গ করুন। আল্লাহ্ আপনাকে মার্জনা করবেন। প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্য দায়ী করবেন না। তিনি যে মহাক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু।
হজরত সওদা হজরত আয়েশা সিদ্দীকার প্রতি স্নেহান্ধই ছিলেন বলা যায়। এই ঘটনা এবং আরো কিছু ঘটনা দেখে সেকথাই অনুমিত হয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একবার যে তাঁর পবিত্র সহধর্মিণী (আযওয়াজে মুতাহ্হারাত) থেকে পৃথকবাসের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ওই সময়ও তিনি ছিলেন হজরত আয়েশার পক্ষে। অবশ্য সকল উম্মতজননীগণই তখন এক জোট হয়েছিলেন।
ইসলামের জয়যাত্রা এগিয়ে চললো দুর্বার গতিতে। সমগ্র আরব ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শাসন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাবা শরীফ জিয়ারতের জন্য অধীর হয়ে উঠলেন। ওমরা করতে যাবেন বলে ঘোষণা দিলেন।
সাহাবীগণকে সঙ্গে নিয়ে উপনীত হলেন মক্কার সন্নিকটবর্তী হুদাইবিয়া প্রান্তরে। মক্কাবাসীরাবাধা দিলো। প্রস্তাব দিলো আলোচনার। আলোচনা হলো। প্রণীত হলো একটিসন্ধিচুক্তি, যার শর্তগুলো ছিলো আপাতদৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য অস্বস্তিকর ও অপমানজনক। প্রথম শর্তটি ছিলো-- এখন নয়, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে ওমরা করতে আসতে হবে পরের বছরে। সাহাবীগণের অনেকের অমত সত্তে¡ও মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর আবেগকে অন্তররুদ্ধ করে রাখলেন। যুদ্ধ ও রক্তপাতকে এড়িয়ে গেলেন এভাবে। শেষে অপমানজনক সন্ধিচুক্তিই হলো চূড়ান্ত বিজয়ের কারণ। আল্লাহ্পাক ওই চুক্তিকে বিজয় বলে ঘোষণা করলেন। অবতীর্ণ হলো, নিশ্চয় আমি তোমাকে প্রকাশ্য বিজয় দান করলাম।’
দশম হিজরীতে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণের বিশাল বাহিনী নিয়ে হজ্বযাত্রা করলেন। উম্মতজননীগণের মধ্যে হজরত সওদাকেও নিলেন সঙ্গে। আল্লাহর রসুলের সঙ্গে হজ্ব করবার সৌভাগ্য তাঁর অধিকারভূত হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরাফা প্রান্তরে হাজীদের বিশাল সমাবেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। ভাষণের পর উম্মতজননীগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই হজ্ব আমাদের স্কন্ধের উপরে ছিলো।
এবার তা আমাদের কাঁধ থেকে অপসারিত হলো। এরপর থেকে ঘরের বিছানাকে গনিমত মনে করবে এবং পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হবে না। হজ্বশেষে মুযদালিফা প্রান্তরে পৌঁছলেন হাজীগণ। সেখানেই সকলের রাত্রিযাপন করার কথা। কিন্তু অত্যধিক ভীড়ের কারণে হজরত সওদা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চলার গতিও ছিলো মন্থর। তাই রাতেই তিনি মুযদালিফা ত্যাগ করার অনুমতি চাইলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও সানন্দচিত্তে অনুমতি দিলেন। তিনি ভীড় এড়িয়ে রাতারাতি চলে এলেন মিনায়।
মক্কাবিজয়ের পর সমগ্র আরব স্তম্ভিত হয়ে গেলো। লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, যে আল্লাহ্ আবরাহার হস্তিযুথকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, সেই আল্লাহ্ই মোহাম্মদকে দান করলেন মহাবিজয়। এখন তোমরাই বলো, তাঁর কর্তৃত্ব স্বীকার করা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর আছে কি? সত্যিই তিনি আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত রসুল। এরকম কথাবার্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ চলতে লাগলো বিভিন্ন গোত্র উপগোত্রগুলোর মধ্যে। শেষে সকলে দ্বিধাহীন চিত্তে একে একে এসে আশ্রয় গ্রহণ করতে লাগলো ইসলামের চির সুশীতল ছায়ায়। অবতীর্ণ হলো-- ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে, তখন তুমি তোমার প্রভুপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কোরো এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কোরো, তিনি তো তওবা কবুলকারী।’
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বুঝলেন, তাঁর অন্তিমযাত্রার সময় সন্নিকটবর্তী। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তো সতত প্রস্তুত। ত্রয়োদশ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে তিনি ‘বালির রফিকুল আ’লা’ বলে আলিঙ্গন করলেন মহাআমন্ত্রণকে। পবিত্র সহধর্মিণীগণের মধ্যে কেবল হজরত খাদিজা তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এবার তিনি চলে গেলেন তাঁর অন্যান্য সহধর্মিণীগণকে ছেড়ে। সাহাবী ও সাহাবীয়া সকলেই ছিলেন রসুল অন্তপ্রাণ। তাঁরাও অন্তিম যাত্রালগেড়বর অপেক্ষায় রইলেন। কখন যে ডাক আসবে, তা তাঁরা জানেন না।
শোকদুঃখবেদনা যতই দুর্বহ হোকনা কেনো, পৃথিবীর জীবন সাঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত তো প্রিয়তম রসুলের সঙ্গে আর মিলিত হওয়া যাবে না। উম্মতজননীগণের সকলেরই ইচ্ছা ছিলো, সবার আগে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে মিলিত হবেন।
একদিন সকলে জানতে চেয়েছিলেন কার ভাগ্যে ঘটবে প্রথম মিলন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছিলেন, ‘যার হাত লম্বা’। তাঁরা নিজেদের হাত মাপামাপি করে দেখেছিলেন এবং এ ব্যাপারে স্থির নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, প্রথম মিলিত হবেন হজরত সওদা। কারণ তিনি দীর্ঘাঙ্গিনী। কিন্তু তা হলো না। কয়েক মাসের মধ্যেই প্রথমে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন হজরত যয়নব বিনতে খুজায়মা। তখন সকলে বুঝলেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ‘যার হাত লম্বা’ কথাটির অর্থ ছিলো যিনি অধিক দানশীলা।
হজরত সওদার অপেক্ষাও শেষ হলো এক সময়। হজরত ওমরের খেলাফতের শেষ দিকে ডাক এলো। তিনি তো প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। সাড়া দিলেন সাথে সাথে। বিশ্বাসী উম্মতগণ মাতৃহারা হলেন আর একবার। শোকার্ত জনতা সমবেত হলেন। জানাজার নামাজে সারিবদ্ধ হলেন সকলে। নামাজ পড়ালেন হজরত ওমর।
হজরত সওদা ছিলেন খুবই ভাগ্যবতী। সুন্দর ও সুপ্রশͯহৃদয়ের অধিকারিণী ছিলেন তিনি। রূপবতীও ছিলেন নিঃসন্দেহে। তাঁর সমগ্র জীবন ছিলো সেবাপরায়ণতাশোভিত ও আনুগত্যময়। উন্নাসিকতার বিন্দু পরিমাণ উপস্থিতিও ছিলো না তাঁর চরিত্রমধ্যে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখনই তিনি সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেন নতুন ধর্মমতকে। তাঁর পূর্বস্বামী সাকরানও ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একনিষ্ঠ সাহাবী। তাঁরা দু’জনেই মক্কার কাফেরদের দ্বারা নিগৃহীত হন। অত্যাচার চরমে উঠেছিলো বলেই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দিয়েছিলেন। তাঁদের এক ছেলে ছিলো। নাম আবদুর রহমান। তিনিও ছিলেন শুদ্ধচিত্ত সাহাবী। অনেক পরে পারস্যের জালুলার যুদ্ধে তিনি শাহাদতবরণ করেন। প্রথম হিজরতকারিণী হিসেবে তিনি ছিলেন পুণ্যবতী। আল্লাহ্পাক তাঁর মর্যাদাকে আরো উন্নত করেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবনসঙ্গিনী করে দেন তাঁকে। ফলে তিনি হন মহাপুণ্যবতী।
হিজরতের তিন বছর আগে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে ঘরে আনেন। হজরত খাদিজা যেমন ছিলেন তাঁর পঁচিশ বছরের একক সঙ্গিনী, তেমনি সওদাও তাঁর একক সঙ্গিনী হিসেবে কাটিয়েছিলেন তিনটি বছর। বলাবাহুল্য, ওই তিনটি বছর ছিলো চরম সংকটপূর্ণ ও ঘটনাবহুল। ওই সময় অতি সংগোপনে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় আকাবার বায়াত অনুষ্ঠান। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে কাফেরেরা। সম্পন্ন হয় মহারহস্যময় মেরাজ। ফরজ করা হয় ইসলামের মূল স্তম্ভ নামাজকে। ওই সময় আতঙ্ক ও আনন্দকে একই সঙ্গে বরণ করে নিতে হয় তাঁকে।
মদীনায় এসে তিনি একে একে পান সপত্নীদেরকে। হিংসাবিমুক্ত পবিত্র অন্তঃকরণের অধিকারিণী ছিলেন বলে সকলকেই অন্তর থেকে ভালোবাসা দিতে পারতেন তিনি। সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন হজরত আয়েশাকে। এরকম ভালোবাসার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া কঠিন। আর তিনিও ছিলেন হজরত আয়েশার সীমাহীন শ্রদ্ধার পাত্রী।
বিদায় হজ্বের সময় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আজ্ঞা করেছিলেন, আমার পরে তোমরা ঘরেই থেকো। এই নির্দেশটি তিনি অত্যন্তসতর্কতা ও কঠোরতার সাথে আজীবন পালন করে গিয়েছেন। তিনি তাঁর ঘর থেকে বের হতেন না। কোথাও যেতেন না। বলতেন, আমি হজ্ব ও ওমরা দুটোই পালন করেছি। এখন আল্লাহর রসুলের নির্দেশে ঘরে বসে থাকবো।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একটি পবিত্র স্বভাব ছিলো দানশীলতা। যাচ্ঞাকারীকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কখনো বিমুখ করতেন না। উদ্বৃত্ত সকল কিছু বিলিয়ে দিতেন দুই হাতে। তাঁর পবিত্র সহধর্মিণীগণের সকলেই ছিলেন দানশীলা। হজরত সওদাও তাঁদের ব্যতিক্রম ছিলেন না। খলিফা হজরত ওমর প্রায়শঃই তাঁকে হাদিয়া পাঠাতেন। একবার তিনি তাঁর কাছে লোক মারফত একটি থলি পাঠালেন। হজরত সওদা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, কী আছে ওতে? লোকটি বললো, দিরহাম। তিনি বললেন, খেজুরের থলিতে তাহলে দিরহামও থাকে? একথা বলে তিনি সাথে সাথে দিরহামগুলো বিলিয়ে দিলেন।
বিশ্বাসী জনতার জননী-- সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে তাঁর এই পরিচয়টিই অক্ষয় হয়ে আছে। থাকবে। সাহাবীগণ তাঁকে আপন জননী অপেক্ষা অধিক ভালোবাসতেন। শ্রদ্ধা করতেন। কারণ তাঁরা জানতেন, বিশ্বাস জীবনের চেয়ে বড়। হজরত আবদুলাহ্ ইবনে আব্বাস, হজরত ইবনে যোবায়ের এবং হজরত ইয়াহ্ইয়া ইবনে আবদিলাহ আল আনসারী তাঁর নিকটে হাদিস শুনেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। হজরত সওদা সূত্রে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা পাঁচ।