হজরত জুওয়াইরিয়া বিনতে হারেছ রাদ্বিয়ালাহু আনহা
🖋মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ
..................................................................
মদীনায় সংবাদ পৌঁছলো, বনী মুস্তালিকের গোত্রাধিনায়ক হারেছ ইবনে আবু জেরার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। নিজ সম্প্রদায় এবং আরবের অন্যান্য লোককে সংঘবদ্ধ করে চলেছে। খোযাআ জনপদবাসীর একটি শাখা গোত্রের নাম বনী মুসতালিক।
সংবাদের সত্যাসত্য যাচাই করা প্রয়োজন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বনী মুসতালিক জনপদের দিকে প্রেরণ করলেন হজরত বোরায়দা (রাঃ) কে। তাঁকে বলে দিলেন জীবন বিপন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দিলে যা খুশী তাই বলতে পারবে। তিনি সাধারণ পথিকের বেশে যথাস্থানে উপস্থিত হলেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছো? উদ্দেশ্য কী? তিনি বললেন, শুনলাম যুদ্ধপ্রস্তুতি চলছে। আমিও আমার এলাকার লোকজনকে নিয়ে মোহাম্মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই। তাঁর কথা শুনে গোত্রপতি হারেছ উল্লসিত হলো। তাকে তার বাহিনীসহ যোগদান করতে বললো।
হজরত বোরায়দা মদীনায় ফিরে এসে সব ঘটনা জানালেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘোষণা দিলেন, নতুন অভিযানের জন্য সমবেত হও। সাহাবীগণ যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে এলেন। মদীনার প্রশাসকের দায়িত্ব দিলেন হজরত আবু যর গিফারীকে। যুদ্ধযাত্রা করলেন রাতের বেলায়— শাবান মাসের দ্বিতীয় তারিখে। তখন চলছে হিজরী পঞ্চম সন। সঙ্গে নিলেন মুমিনজননী হজরত আয়েশা (রাঃ) ও হজরত উম্মে দসালমা (রাঃ) কে।
পথে দেখা হলো গোত্রপতি হারেছ কর্তৃক প্রেরিত এক গুপ্তচরের সঙ্গে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে মুশরিকবাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। সে মুখ খুললো না। ইসলাম গ্রহণ করতে বললেন। সে অস্বীকার করলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নির্দেশে হজরত ওমর (রাঃ) তাকে হত্যা করে ফেললেন।
 
গুপ্তচর নিহত হবার সংবাদ শুনতে পেয়ে গোত্রপতি হারেছ ভীত ও স্তম্ভিত হলো। প্রথমেই অশুভ সংকেত! তার দলের লোকেরাও ভয় পেয়ে গেলো। দূরাগত লোকেরা অতিদ্রুত পালিয়ে গেলো। রইলো কেবল স্থানীয় জনপদবাসীরা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের নিকটবর্তী হলেন। হজরত ওমরকে বললেন, ওদেরকে লা ইলাহা ইল্লালাহু মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ স্বীকার করতে বলো। বলো, তাহলে তোমাদের জীবন-সম্পদ নিরাপদ রাখা হবে। হজরত ওমর উচ্চকণ্ঠে ইসলামের আমন্ত্রণ জানালেন। তারা কথা বললো না। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। উভয় পক্ষের তীর নিক্ষেপ চললো বেশ কিছুক্ষণ ধরে। শেষে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আক্রমণের আদেশ দিলেন। বীর মুজাহিদগণ ঝাঁপিয়ে পড়লো শশ্রুসেনাদের উপর। শশ্রুরা বেশীক্ষণ টিকতে পারলো না। তাদের পক্ষের ১১ জন নিহত হলো। অবশিষ্টরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো। পুরুষ-রমণী ও শিশু মিলে বন্দী করা হলো ছয় শত জনকে। আর গনিমত হিসেবে পাওয়া গেলো দুই হাজার উট এবং পাঁচ হাজার ছাগল।
গনিমতের তত্ত্বাবধায়ক হলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর গোলাম শোকরান (রাঃ)। আর বন্দীবণ্টনের দায়িত্ব পেলেন হজরত বোরায়দা (রাঃ)। তাদেরকে দাস-দাসীতে পরিণত করা হলো। যথানিয়মে ভাগ করে দেওয়া হলো মুজাহিদগণের মধ্যে।
গোত্রপতি হারেছ পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। কিন্তু তার কন্যার জামাতা প্রাণ হারালো। আর কন্যা হলো যুদ্ধবন্দিনী। নাম বাররা। তিনি পড়লেন হজরত সাবেত ইবনে কায়েস এবং তাঁর চাচাতো ভাইয়ের অংশে।
গোত্রাধিনায়কের কন্যা তিনি। দাসত্ব স্বীকার তাঁর কল্পনারও অতীত। বাররা অর্থের বিনিময়ে মুক্ত হওয়ার আবেদন জানালেন। হজরত সাবেত সম্মত হলেন। মুক্তিপণ হিসেবে নির্ধারণ করলেন নয় উকিয়া স্বর্ণ। বাররা খুশী হলেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি হলেন দুর্ভাবনাকবলিত। এতো অর্থ কোথায় পাবেন? ভেবে ভেবে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে তিনি নবী বলে স্বীকার করবেন। মনে প্রাণে ইসলামসমর্পিতা হবেন। আর মুক্তিপণের অর্থ চাইবেন আল্লাহর রসুলের কাছে। লোকে বলে, তিনি মমতার মহাসাগর।
তিনি তাই করলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সকাশে উপস্থিত হয়ে তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা জানালেন। মুক্তিপণের অর্থপ্রার্থিণী হলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্মত হলেন। সেইসঙ্গে বিবাহের প্রস্তাবও দিলেন। বাররা রাজী হলেন। শুভবিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নাম রাখলেন জুওয়াইরিয়া।
পুরো ঘটনাটি উম্মতজননী আয়েশা বর্ণনা করেছেন এভাবে— জুওয়াইরিয়া ছিলেন মধুকন্ঠী ও লাবণ্যময়ী। তার প্রতি যে দৃষ্টিপাত করতো, সেই অভিভূত হতো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটি পানির কূপের কাছে বসেছিলেন। এমন সময় জুওয়াইরিয়া সেখানে উপস্থিত হয়ে তার জন্য আর্থিক সহায়তা কামনা করলো। তার এভাবে এখানে আসাটা আমি মোটেও পছন্দ করলাম না। দেখলাম, রসুলুল্লাহ তার দিকে অনুরাগের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন, যে দৃষ্টিতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকান আমার দিকে। জুওয়াইরিয়া বললো, আমি বিশ্বাসবতী। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি- আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আপনি আল্লাহর রসুল। আমি গোত্রপতি হারেছের কন্যা। এখন বন্দিনী। সাবেত ইবনে কায়েস ও তার চাচাতো ভাইয়ের অধীন। তাঁরা আমাকে মুক্তি দিতে সম্মত হয়েছেন। 
কিন্তু মুক্তিপণ এতো বেশী ধার্য করেছেন, যা আমার পক্ষে পরিশোধ করা অসম্ভব। তাই আমি আপনার সাহায্য প্রার্থনা করছি। দয়া করে আমাকে উদ্ধার করুন। রসুলুল্লাহ বললেন, এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা যদি করা হয়, তবে তুমি কি তাতে রাজী হবে? জুওয়াইরিয়া বললো, বলুন। রসুলুল্লাহ বললেন, আমি তোমার মুক্তিপণের সমুদয় অর্থ পরিশোধ করবো। তারপর তোমাকে বিবাহবদ্ধ করবো। জুওয়াইরিয়া বললো, আমি রাজী। রসুলুল্লাহ সাবেত ইবনে কায়েসকে ডেকে আনালেন। তাঁকে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। সাবেত বললেন, হে আল্লাহর প্রেমাষ্পদ! আপনার উদ্দেশ্যে আমার জনক-জননী উৎসর্গীত হোক। হারেছতনয়া আপনারই। রসুলুল্লাহ চুক্তির অর্থ পরিশোধ করলেন। তারপর বিবাহবন্ধনাবদ্ধ করলেন জুওয়াইরিয়াকে।
মুসতালিক গোত্রের পুরুষ-রমণীরা দাস-দাসীরূপে মুজাহিদগণের ভাগে পড়েছিলো। রসুলুল্লাহ যখন জুওয়াইরিয়াকে বিয়ে করলেন, তখন তাঁরা বলে উঠলেন, বনী মুসতালিক গোত্র তো এখন আল্লাহর রসুলের শশুরকুল। সুতরাং তাঁদের কেউ তো আমাদের দাস-দাসী হতে পারেন না। একথা বলে তাঁরা একে একে সবাইকে মুক্ত করে দিলেন।
উল্লেখ্য, এরকম সিদ্ধান্তের ফল হলো আশাতীতরূপে বরকতময়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মূল উদ্দেশ্যই তো ছিলো অবিশ্বাসী ও অসুন্দর মানুষকে বিশ্বাসবান ও বিশ্বাসবতী বানানো। সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হলো অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে। মুক্ত বনী মুসতালিকের সকলেই চিরদিনের জন্য বক্ষাভ্যন্তরে স্থাপন করলো মহাবিশ্বাস— লা ইলাহা ইল্লালাহু মোহাম্মদুর রসুলুল্লাহ।
জননী আয়েশা আরো বলেছেন, রসুলুল্লাহ জুওয়াইরিয়াকে বিবাহ করার ফল হয়েছিলো বিস্ময়ময় ও শুভ। তার কারণে মুক্ত হয়ে গিয়েছিলো মুসতালিক গোত্রের একশত পরিবার (ছয়শত লোক)। আপন সম্প্রদায়ের জন্য জুওয়াইরিয়ার চেয়ে অধিক কল্যাণময়ী আর কেউ নেই।
সেই স্বপ্নটির প্রকৃত অর্থ কী, তা তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন। কিন্তু কাউকে বলেননি। বনী মুসতালিক জনপদে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর আগমনের কথাও তাঁকে কেউ বলেনি। আর তাঁর শুভস্বপ্নটি এতো দ্রুত বাস্তবায়িত হবে, তা-ও তিনি বুঝতে পারেননি।
তিনি নিজে বলেছেন, রসুলুল্লাহর অন্তঃপুরে আসার আগে আমি এক রাতে স্বপ্নে দেখলাম, একটি পূর্ণ আলোকিত চাঁদ ইয়াসরেবের দিক থেকে আমার কোলে এসে পড়লো। আমি স্বপ্নের কথা কাউকে জানাইনি। যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে মুক্ত করে দিয়ে বিবাহ করলেন, তখন বুঝতে পারলাম স্বপ্নটির প্রকৃত মর্ম। সম্প্রদায়ের লোকদের মুক্তির কথাও আমাকে আগে জানানো হয়নি। মুসলমানেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদেরকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। রসুলুল্লাহ যখন আমাকে এই শুভসংবাদটি জানালেন, তখন আমি মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে জানালাম প্রাণভরা কৃতজ্ঞতা।
গোত্রপতি হারেছ কিছুদিন উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালেন। আদরের কন্যাকে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁর ধারণা ছিলো, তাঁর প্রিয়পুত্রী মোহাম্মদের বন্দিনী হিসেবে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। কন্যাকে মুক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন পিতা।
এক বর্ণনায় এসেছে, জননী জুওয়াইরিয়ার পিতা হারেছ ইবনে আবু জেরার মুক্তিপণ হিসেবে কয়েকটি উট নিয়ে মদীনা অভিমুখে চললেন। আকীক নামক উপত্যকায় পৌঁছে সবচেয়ে ভালো উট দু’টি এক স্থানে লুকিয়ে রাখলেন। অবশিষ্ট উটগুলো নিয়ে মদীনায় উপস্থিত হলেন। প্রথমে কন্যার সাক্ষাত প্রার্থনা করলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ভিতরে যান। সে যদি আপনার সাথে যেতে চায়, তবে বাধা দেওয়া হবে না।
খুবই উৎফুল্ল মনে কন্যার সঙ্গে দেখা করলেন হারেছ। বললেন, মোহাম্মদ তোমাকে তোমার মর্জির উপর ছেড়ে দিয়েছেন। এখন চলো। আমাকে লজ্জায় ফেলো না। জননী জুওয়াইরিয়া বললেন, আমি তাঁর কাছেই থাকতে চাই।
গোত্রপতি হারেছ এরকম কথা শুনবেন, তা আশা করেননি। তবু তিনি হাল ছাড়লেন না। বাইরে এসে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে বললেন, মুক্তিপণ হিসেবে এই উটগুলো এনেছি। এগুলো নিয়ে আমার কন্যাকে আমার সাথে যেতে দিন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উটগুলোর দিকে তাকালেন। বললেন, ওই উট দুটো কোথায়, আকীক উপত্যকায় যে দুটোকে লুকিয়ে রেখে এসেছেন? হারেছ বললো, উট দুটোকে লুকিয়ে রাখার কথা তো আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। আপনি জানলেন কীভাবে! নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রসুল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং নিশ্চয় আপনি আল্লাহরই রসুল। এভাবে হারেছ মনে প্রাণে ইসলাম গ্রহণ করলেন। শান্তি ও আনন্দে ভরে গেলো তাঁর মন। সবচেয়ে বেশী আনন্দিত হলেন তখন, যখন জানতে পারলেন তাঁর কন্যা এখন আর বাররা নন, জুওয়াইরিয়া— আল্লাহর রসুলের প্রিয়তমা পত্নী।
 
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সকল পত্নীকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। সেই পবিত্র ও সীমাহীন ভালোবাসার মহাসমুদ্রে চিরদিনের জন্য নিমজ্জিত হলেন জননী জুওয়াইরিয়া। তাঁর মনোভাবে ও স্বভাবে ফুটে উঠলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মূল আদর্শটি— বিশুদ্ধচিত্ত উপাসনায় সতত মগ্ন থাকা। মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য তো এটাই- ‘আমি মানুষ ও জ্বিন জাতিকে আমার ইবাদত করার উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।’
একদিন সকালে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেখলেন, হজরত জুওয়াইরিয়া দোয়া-প্রার্থনায় নিমগ্ন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নীরবে স্থান ত্যাগ করলেন। দুপুরের কিছু আগে পুনঃউপস্থিত হয়ে দেখলেন, তিনি তসবী-ওজীফা করেই চলেছেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সব সময় এ অবস্থায় থাকো? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি কি তোমাকে এমন কিছু ভালো কথা শিখিয়ে দেবো না, যা তোমার এই নফল ইবাদত অপেক্ষা উত্তম? জননী নীরবে সম্মতি জানালেন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন- সুবহানাল্লাহি আদাদা খলক্বিহি (তিনবার), সুবহানাল্লাহি রিদ্বা নাফসিহি (তিন বার), সুবহানাল্লাহি জিনাতা আরশিহি (তিনবার)। সুবহানাল্লাহি মাদাদা কালিমাতিহি (তিনবার)।
তিনি ছিলেন যেমন রূপবতী, তেমনি গুণবতীও। জননী আয়েশা প্রথম দর্শনেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। একথাও তিনি বলেছিলেন যে, জুওয়াইরিয়ার রূপ ও নারীসুলভ আকর্ষণ গুণ দুটোই ছিলো। ইমাম জাহাবী বলেছেন, মাতা মহোদয়া জুওয়াইরিয়া ছিলেন শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের একজন। ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্না। পবিত্র আত্মমর্যাদাবোধের দ্যুতি সারাক্ষণ আলোকিত করে রাখতো তাঁর শুচিস্নিগ্ধ অবয়বকে। দাসত্বমুক্তির জন্য তাঁর ব্যাকুলতার মধ্যেও ফুটে উঠেছিলো তাঁর অনন্যসাধারণ মর্যাদাবোধ। আবার পার্থিব ভোগবিলাসের প্রতি ছিলেন নির্মোহ ও নিরাসক্ত। পতিতুষ্টি ও ইবাদত ছাড়া তাঁর অন্য কোনো লক্ষ্য ছিলোই না। এ সকল কারণে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতও করতেন প্রায় প্রতিদিন।
একবার তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে জিজ্ঞেস করলেন, খাবার কিছু কি আছে? জননী বললেন, আমার দাসী কিছু সদকার গোশত দিয়েছিলো ওগুলোই আছে শুধু। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তা-ই নিয়ে এসো। সদকা তো সদকার স্থানে পৌঁছে গিয়েছে। কথাটির অর্থ সদকার গোশত দাসীর কাছে পৌঁছেছে, সে হয়েছে গোশতের মালিক। এখন সে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে যা দিয়েছে, তা হাদিয়া। সদকা নয়। উল্লেখ্য, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), তাঁর পবিত্র পরিবার পরিজন এবং বংশধরদের জন্য সদকা ভক্ষণ হারাম। হারাম সচ্ছল মুসলমানদের জন্যও।
 
তাঁর কাছ থেকে শরীয়তের কিছু বিধিবিধানের কথাও এসেছে। নফল রোজা রাখতে গেলে যে পরপর দু’টি রোজা রাখতে হয়, সে কথাটি তাঁর মাধ্যমেই জানা গিয়েছে এভাবে— এক জুমআর দিনে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত জুওয়াইরিয়ার কক্ষে প্রবেশ করলেন। হজরত জুওয়াইরিয়া সেদিন রোজা রেখেছিলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, গতকালও কি তুমি রোজা রেখেছিলে? তিনি বললেন, না।
পুনঃজিজ্ঞেস করলেন, আগামীকালও কি রোজা রাখবে? তিনি বললেন, না। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তাহলে রোজা ভেঙে ফেলো।
হজরত জাবের বর্ণনা করেছেন, একবার জননী জুওয়াইরিয়া মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বললেন, আমি এই ক্রীতদাসটিকে মুক্ত করে দিতে চাই। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ওকে তুমি তোমার মামার কাছে পাঠিয়ে দাও, যিনি গ্রামে বসবাস করেন। এতে তুমি সওয়াব বেশী পাবে।
 
হজরত জুওয়াইরিয়া রসুলুল্লাহর সাতটি হাদিসের বর্ণনাকারিণী। তার মধ্যে ইমাম বোখারী বর্ণনা করেছেন একটি এবং ইমাম মুসলিম দুটি। তাঁর কাছ থেকে যাঁরা হাদিস শুনেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখেযোগ্য ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন— হজরত ইবনে আব্বাস, হজরত জাবের, হজরত ইবনে ওমর, উবাইদ ইবনে আস্ সাবাক, তোফায়েল, মুজাহিদ, কুরাইব, আবু আইয়ুব মুরাগী, কুলসুম ইবনে মুসতালিক, আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ ইবনে আল-হাদ প্রমুখ সাহাবা ও তাবেয়ীন।
পৃথিবী ও পরবর্তী পৃথিবীর সকল সৌভাগ্যের মূল মহানবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহান সান্নিধ্য তিনি পেয়েছিলেন প্রায় ছয় বছর। সপত্নীগণের সঙ্গে তাঁর অম্লমধুর দ্বন্দ্বের কথা পাওয়াই যায় না। আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহাতিরোধানের পর তাঁর অন্যসকল জীবনসঙ্গিনী যেমন হতে চেষ্টা করেছেন অধিকতর ইবাদতগুজার, দান-ধ্যানে মশগুল, তিনিও জীবন যাপন করতে থাকেন তেমনি পবিত্র নিয়মে। অপেক্ষা করতে থাকেন শুভ সমাপ্তির আশায়।
রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর জন্য খায়বরের উৎপাদিত ফসল থেকে আশি ওয়াসাক খেজুর ও বিশ ওয়াসাক যব জীবিকা হিসেবে নির্ধারণ করে দেন। পরে খলিফা ওমর তাঁর জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দেন। সকল মুমিনজননীদের জন্য বারো হাজার দিরহাম। আর হজরত জুওয়াইরিয়া ও হজরত সাফিয়ার জন্য ছয় হাজার দিরহাম করে। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এক সময় তাঁরা দাসত্বভূতা ছিলেন, সেই কারণে। কিন্তু উম্মতজননীদ্বয় তাঁর এমতো নির্ধারণ প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁরা সমতার দাবি তোলেন। অবশেষে হজরত ওমর নতি স্বীকার করেন। প্রত্যেকের জন্য নির্ধারণ করেন বারো হাজার দিরহাম করে।
মহাপুণ্যবতী উম্মতজননী যখন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অসংসারী সংসারে প্রবেশ করেন, তখন তাঁর বয়স ছিলো বিশ বছর। এরপর রসুলমিলনের জন্য তাঁকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ৬৫ বছর বয়সে মিলিত হন প্রিয়তম স্বামী এবং ততোধিক প্রিয়তম নবীর সঙ্গে। ইন্না লিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন।
জানাযার নামাজ পড়ান তখনকার মদীনার প্রশাসক মারওয়ান। আর তাঁকে সমাহিত করা হয় জান্নাতুল বাকী গোরস্থানে তাঁর অন্য সকল সখী-সহচরী-সপত্নীগেণর পাশে।
 

Top