হজরত যয়নাব বিনতে জাহাশ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা
🖋মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ
..............................................................
ইসলাম সূর্যের প্রথম আলোয় আলোকিত হয়ে যাঁরা চিরস্থায়ী সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন। তাঁর নাম ছিলো বাররা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নাম দেন যয়নাব। ডাক নাম হয় উম্মে হাকাম। তাঁর ঊর্ধ্বতন বংশক্রম এরকম — যয়নাব বিনতে জাহাশ ইবনে রুমাব ইবনে আমর ইবনে সাবরা ইবনে কাছীর ইবনে গনম ইবনে দাওদান ইবনে আসাদ ইবনে হোযায়মা।
মায়ের নাম উমায়মা। তিনি ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পিতামহ আবদুল মুত্তালিবের কন্যা এবং তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পিতা আবদুল্লাহর আপন বোন— এই হিসেবে হজরত যয়নাব হন রসুলুল্লাহর আপন ফুফাত বোন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রত্যক্ষ তত্ত্ববধানেই তিনি বড় হয়ে ওঠেন। আর ভাইবোনদের সাথে একত্রে ইসলাম গ্রহণ করেন। সকলে মিলে হিজরত করে চলে যান আবিসিনিয়ায়। সেখানে তাঁর এক ভাই ওবায়দুল্লাহ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু তাঁর স্ত্রী উম্মে হাবীবা (আবু সুফিয়ানের কন্যা) ইসলামের উপর অটল থাকেন। পরে হন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র জীবনসঙ্গিনী। মহাসম্মানিতা উম্মতজননী।
কিছুদিন পর আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও আবু আহমদ ইবনে জাহাশ ভ্রাতৃদ্বয় বোন যয়নাবসহ পরিবারের অন্য সকলকে নিয়ে মদীনায় হিজরত করে চলে আসেন। পরে উহুদযুদ্ধে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ শহীদ হন। মুশরিকেরা তাঁর পেট ফেঁড়ে লাশ বিকৃত করে ফেলে। তাঁর মামা শহীদশ্রেষ্ঠ হজরত হামযার সঙ্গে একই কবরে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর এই ফুফাতো বোনটিকে ছোটবেলা থেকেই অনেক স্নেহ মমতায় বড় করে তোলেন। ঘনিষ্ঠ অভিভাবক হিসেবে তাঁর বিবাহশাদীর কথাও ভাবতে থাকেন। তাঁর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন সাহাবী হজরত যায়েদের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেন।
হজরত যায়েদ ক্রীতদাস হিসেবে বাল্যবেলায় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহান সাহচর্যে আসেন। কিন্তু তিনি তাঁকে মুক্ত করে দিয়ে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। কাবা প্রাঙ্গণে সর্বসমক্ষে এমতো ঘোষণাও তিনি দেন। মানুষও তাঁকে ডাকতে থাকে যায়েদ ইবনে মোহাম্মদ বলে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পরিবারের একজন। যখন হজরত খাদিজা, হজরত আবু বকর এবং হজরত আলী ইসলাম গ্রহণ করেন, তখনই তাঁদের সাথে হজরত যায়েদও ইসলামের অন্তর্ভূত হন। হন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সর্বক্ষণের সঙ্গী। অনেক অভিযানে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। শ্রেষ্ঠ সাহাবীগণও মেনে নেন তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে ।
শ্রেষ্ঠত্বের ও অভিজাত্যের ভিত্তি হচ্ছে জ্ঞান ও আল্লাহ ভীতি (তাক্কওয়া) — ইসলাম এরকম বলে। কিন্তু মক্কার কুরায়েশেরা বংশগৌরবের কথা ভুলবে কী করে। কাবা শরীফের খাদেম হিসেবেই ছিলো তাঁদের এই অনন্যসাধারণ মর্যাদা। ইয়েমেনের বাদশাহরাও এরকম মর্যাদা দাবি করতে পারতো না। বাদশাহ আবরাহা তো কাবা শরীফ ধ্বংস করতে চেয়েছিলো একারণেই।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মনে বংশগৌরবের অসুন্দর অহমিকা ছিলোই না। কেনো থাকবে? তিনি যে শাশ্বত সত্যের প্রতিভূ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জানেন, মানেন এবং প্রচার করেন যে, সকল মানুষ একই বংশপরম্পরা সম্পৃক্ত। তাইতো তিনি তাঁর আপন ফুফাতো বোনকে দিতে পারেন মুক্ত ক্রীতদাস হজরত যায়েদের বিবাহের প্রস্তাব। উদ্দেশ্য— মূর্খতার যুগের বংশঅহমিকার অন্ধকারে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার আলোক প্রজ্জ্বলিত করা। ইবনে আসীর মন্তব্য করেছেন, রসুলুল্লাহ হজরত যায়েদের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন একারণে যে, তিনি তাঁকে কিতাবুল্লাহ ও আল্লাহর রসুলের সুন্নতের জ্ঞান দান করবেন।
হজরত যয়নাব প্রথমে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে সরাসরি বলে দিলেন, আমি তাকে আমার জন্য মানতে পারি না। তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশও বোনকে সমর্থন করলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন. ইসলামের দৃষ্টিতে যায়েদ শ্রেষ্ঠ— সুতরাং আপত্তির তো কোনো কারণ থাকতে পারে না। হজরত যয়নব বললেন. তাহলে আমি একটু ভেবে দেখি। ইত্যবসরে ওহী অবতীর্ণ হলো— ‘আল্লাহ ও তাঁর রসুল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রসুলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৩৫)।
এই আয়াত-শুনে হজরত যয়নাব ও তাঁর ভাই দুজনেই বললেন, আমরা রাজী। আমাদের কী অধিকার আছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অভিপ্রায়ের সম্মুখে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবো।
আর কোনো অন্তরায় রইলো না। বিবাহ সম্পন্ন হলো যথাসময়ে। ইবনে কাছীর বলেছেন, বিয়ের মোহরানা ছিলো দশটি দিনার (প্রায় চার তোলা সোনা), ষাট দিরহাম (প্রায় আঠারো তোলা রূপা), একটি ভারবাহী পশু এবং কিছু গৃহস্থালীর সরঞ্জাম, আনুমানিক পঁচিশ সের আটা ও পাঁচ সের খেজুর। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং এগুলো তাঁর পালকপুত্রের পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দেন। কিন্তু সংসারে সুখ এলো না। দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি, তর্ক-বিতর্ক চলতে লাগলো উঠতে বসতে। এভাবে নিরবচ্ছিন্ন অশান্তির সঙ্গে সম্পর্ক টিকে রইলো কোনো ক্রমে বছরখানেক।
একদিন হজরত যায়েদ বললেন, হে আল্লাহর হাবীব! যয়নাব কর্কশ ব্যবহার করে। কথা কাটাকাটি করে। আমি তাকে তালাক দিতে চাই। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিষেধ করলেন। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। হজরত যায়েদ তাঁকে তালাক দিয়েই দিলেন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিস্মিত হলেন না। কারণ ইতোমধ্যে তিনি আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে একথা জানতে পেরেছেন যে, যয়নাব তাঁর স্ত্রী হবেন। তবে তিনি লজ্জিত হলেন খুব। সেই সূত্রে বিব্রতও হলেন একথা ভেবে যে, কীভাবে অগ্রসর হতে হবে। আরববাসীরা তো পালকপুত্র এবং ঔরসজাত পুত্রকে সমান জ্ঞান করে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যাদেশের প্রতীক্ষায় রইলেন।
কিছুদিন পর প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবতীর্ণ হলো নবতর প্রত্যাদেশ— ‘স্মরণ করো, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছো, তুমি তাকে বলছিলে তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় করো। তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছো, আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন; তুমি লোকভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকে ভয় করাই তোমার পক্ষে অধিকতর সঙ্গত।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৩৭)।
তিনিই নবী, যিনি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে সতত পরিচালিত হন। তিনি সুরক্ষিত ও নিষ্পাপ। মহানবী মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নবীগণের নবী। নবীশ্রেষ্ঠ। সত্যবার্তা বহনকারী। বার্তাপ্রচারক। রসুল। আল্লাহপাকই হৃদয়ের আবর্তনবিবর্তনকারী।
তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হৃদয়ে ঢেলে দিলেন হজরত যয়নাবের প্রতি প্রেমানুরাগ। তিনি লজ্জিত হলেন। আর সে লজ্জার কথা আল্লাহ প্রকাশ করে দিয়ে বললেন, সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে লোকলজ্জাকে প্রশ্রয় দেওয়া সত্যবার্তাপ্রচারকদের জন্য নিতান্তই অশোভন ও অনুচিত। অন্তরে লজ্জা ও ভয় থাকতে হবে কেবল আল্লাহর জন্য। আর বৈধ অবৈধ নির্ধারণ করার অধিকার রয়েছে কেবল আল্লাহর। তিনি যা বৈধ করেছেন, মানুষ কেনো তাকে অবৈধ বলবে? কেনো অবলুপ্ত করে দিবে নিজপুত্র ও পালকপুত্রের পার্থক্য রেখা। জনমানব থেকে এমতো অপবিশ্বাসকে তো উৎখাত করতেই হবে। আর ইসলাম তো এসেছে সকল অশুভবিশ্বাসকে উৎখাত করে শুভবিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
দ্বিধা-দুর্বলতা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে গেলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। ইদ্দতকাল যখন শেষ হয়ে গেলো, তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত যয়নাবকে ঘরে আনবার জন্য আকুল হলেন। হজরত যায়েদকে বললেন, তুমিই বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে যাও। আল্লাহর রসুলের জন্য জীবন-সম্পদ-সময় উৎসর্গকারী মহান সাহাবী তৎক্ষণাৎ নির্দেশ পালন করলেন। হজরত যয়নাবের গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, তিনি আটার খামির প্রস্তুত করছেন। হজরত যায়েদ নিজে বলেছেন, তাঁকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদয়ে জাগ্রত হলো সম্ভ্রমবোধ। দৃষ্টি অবনত করতে বাধ্য হলাম। ভাবলাম, আমি সৃষ্টিশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষের বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন করতে এসেছি। তাঁর দিকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে আমি কেবল এতোটুকু বলতে পারলাম, আল্লাহর রসুল আমাকে প্রেরণ করেছেন। তিনি আপনাকে স্মরণ করেছেন। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, মহান প্রভুপালকের নির্দেশনা ব্যতিরেকে আমার করার কিছু নেই। এই বলে তিনি তাঁর ঘরে গিয়ে দণ্ডায়মান হলেন নামাজের জন্য নির্ধারিত স্থানে।
এদিকে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে নেমে এলো নতুন প্রত্যাদেশ— ‘অতঃপর যায়েদ যখন যয়নাবের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করলো, তখন আমি তাকে তোমার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করলাম, যাতে মুমিনদের পোষ্যপুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহসম্পর্ক ছিন্ন করলে সে সকল রমণীকে বিবাহ করায় মু’মিনদের কোনো বিঘ্ন না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকরী হয়েই থাকে।’
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে হজরত যয়নাবের বিবাহও কার্যকর হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে হজরত যয়নাবের কাছে গেলেন। বিনা অনুমতিতে তাঁর ঘরে প্রবেশ করলেন। বললেন, আল্লাহপাক স্বয়ং শুভবিবাহ সম্পন্ন করে দিয়েছেন। সাক্ষী করেছেন জিব্রাইল আমিনকে।
খুবই ঘটা করে বিবাহোত্তর প্রীতিভোজের আয়োজন করা হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর অন্য বিয়েগুলোতে এরকম করেননি। এবার করলেন কেবল কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে। বিশেষ প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রাপ্ত অনিন্দ্যসুন্দরী স্ত্রীরতড়ব পেয়ে। এর মধ্যে পুনঃপ্রত্যাদেশের মাধ্যমে ঘটানো হলো সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, জল্পনা-কল্পনার চিরঅবসান। বলা হলো ‘মোহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নয়, বরং সে আল্লাহর রসুল ও শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আহযাব,আয়াত-৪০)।
ওলীমার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেন প্রায় তিনশত লোক। সকলে পূর্ণপরিতৃপ্তির সঙ্গে আহার করলেন। এ সম্পর্কে হজরত আনাস (রাঃ) নিজে বলেছেন, জননী যয়নাবের বিবাহে ওলীমা করা হয়েছিলো গোশত ও রুটি। আমাকে দেওয়া হয়েছিলে লোকজনকে নিমন্ত্রণ করার দায়িত্ব। আমি লোকজনকে ডেকে আনতে শুরু করলাম। দলে দলে
আমি দেখলাম, তিনজন লোক সেখানে বসে কথাবার্তা বলেই যাচ্ছে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের উপস্থিতিতে নববধূর প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করতে পারছিলেন না। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সময়ক্ষেপণের জন্য তাঁর অন্য পত্নীদের সঙ্গে দেখা করতে লাগলেন। প্রথমে গেলেন জননী আয়েশার ঘরে। তাঁর সঙ্গে সালাম বিনিময় করলেন। জননী আয়েশা বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনার নতুন বধূটি কেমন? এভাবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর অন্য পত্নীদের সঙ্গে দেখা করতে লাগলেন। শান্তি সম্ভাষণ বিনিময় ও সৌজন্যালাপ করলেন। এরপর ফিরে এসে দেখলেন, তখনও লোক তিনটি আলাপচারিতায় মগ্ন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পুনরায় জননী আয়েশার ঘরে গেলেন। সেখান থেকে ওই তিনজনের প্রস্থান সংবাদ যখন পেলেন, তখন এসে প্রবেশ করলেন জননী যয়নাবের কামরায়। দরজায় পর্দা ঝুলিয়ে দিলেন। তখনই অবতীর্ণ হলো পর্দা সম্পর্কীয় আয়াত।
বলা হলো— ‘হে মুমিনগণ! তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়া না হলে তোমরা আহার্য প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা না করে ভোজনের জন্য নবীগৃহে প্রবেশ করো না। তবে তোমাদেরকে আহবান করলে তোমরা প্রবেশ করো। এবং ভোজন শেষে তোমরা চলে যেয়ো; তোমরা কথাবার্তায় মগ্ন হয়ে পোড়ো না। কারণ তোমাদের এই আচরণ নবীকে পীড়া দেয়, সে তোমাদেরকে উঠিয়ে দিতে সংকোচবোধ করে। কিন্তু আল্লাহ সত্য বলতে সংকোচ বোধ করেন না। তোমরা তাঁর পত্নীদের নিকট থেকে কিছু চাইলে পর্দার অন্তরাল থেকে চেয়ো। এই বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র। তোমাদের কারও পক্ষে আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেওয়া সঙ্গত নয় এবং তাঁর পরলোকগমনের পর তাঁর পত্নীদেরকে বিয়ে করা তোমাদের জন্য কখনোও বৈধ নয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা গুরুতর অপরাধ’।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত যয়নাব বিনতে জাহাশকে খুবই ভালোবাসতেন। সবসময় তাঁর মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতেন। আর হজরত যয়নাবও তাঁকে ভালোবাসতেন নিজের জীবনের চেয়ে বেশী। একথাও কখনো ভুলতেন না যে, সপত্নীগণের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশী রূপবতী। আর তিনি রসুলুল্লাহর অত্যন্তনিকটজন। আপন ফুফুর কন্যা। তাঁর সপত্নীগণও মোটামুটি মেনে নিতেন তাঁর এমতো দাবি। কিন্তু হজরত আয়েশা সম্ভবতঃ নীরবে উপেক্ষা করতেন। তাই দু’জনের মধ্যে ছিলো একটি প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা। কিন্তু কখনোই তা প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের রূপ পরিগ্রহ করতো না। আর বিদ্যাবত্তার দিক থেকে হজরত যয়নাব প্রতিদ্বন্দ্বী হতেন না। একারণে দেখা যায়, তিনি হাদিস বর্ণনা করেছেন অনেক কম। মাত্র এগারোটি। বেশী হায়াত না পাওয়াও ছিলো হয়তো বা তাঁর কম হাদিস বর্ণনা করার একটি কারণ। হতে পারে প্রধান কারণ।
নবীপ্রিয়াগণের একটি সাধারণ গুণ ছিলো সত্যভাষণ। সপত্নীসুলভ ঈর্ষা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা প্রত্যেকেই একজন আর একজনের বৈশিষ্ট্যাবলীর অকুণ্ঠ স্বীকৃতি দিতেন। একারণেই দেখা যায়, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন মিথ্যা অপবাদাহত হজরত আয়েশা সম্পর্কে তাঁকে মন্তব্য করতে বললেন, তখন তিনি নির্দ্বিধায় বলে ফেললেন, আমি তার মধ্যে ভালো ছাড়া অন্য কিছু তো দেখি না। পরে হজরত আয়েশার পবিত্রতা সম্পর্কে দশটি আয়াত-নাযিল হয়। এভাবে হজরত আয়েশা সম্পর্কে হজরত যয়নাবের সত্য ধারণাও হয় ওহী সমর্থিত।
হজরত যয়নাব (রাঃ) কখনো কখনো অন্য রসুলজায়াগণকে লক্ষ্য করে বলতেন, তোমাদেরকে বিয়ে দিয়েছেন তোমাদের অভিভাবকেরা, আর আমার বিয়ে দিয়েছেন সাত আকাশের উপর থেকে স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা। বলাবাহুল্য নবীজায়াগণ নীরবে তাঁর এমতো দাবিকে মেনে নিতেন। মেনে নিতেন তাঁর অত্যন্ত রূপবতী হওয়ার বিষয়টিকেও। অন্যরাও বিষয়টি জানতেন। সেকারণেই হজরত ওমর তাঁর কন্যা নবীজায়া হাফসাকে শাসন করতে গিয়ে বলেছিলেন, খবরদার! রসুলুল্লাহর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করো না। তোমার না আছে যয়নাবের মতো রূপ, আর না আছে আয়েশার মতো সৌভাগ্য।
প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও হজরত আয়েশা তাঁকে সমীহ করতেন। ভালোও বাসতেন। তাঁর গুণবত্তাসমূহ বর্ণনাও করতেন কুণ্ঠাহীনতার সঙ্গে। যেমন তিনি বলেছেন, রসুলবনিতাগণের মধ্যে কেবল তিনিই আমার সমকক্ষতার দাবিদার ছিলেন। আরো বলেন, আমি যয়নাবের চেয়ে বেশী দ্বীনদার, বেশী পরহেজগার, অধিক সত্যভাষী, অধিক উদার, দানশীল, সৎকর্মপরায়ণ এবং অধিক আল্লাহর পরিতুষ্টিকামী আর কাউকে দেখিনি। স্বভাবে তেজস্বিতা ছিলো ঠিকই। কিন্তু সে কারণে অতি দ্রুত লজ্জিতও হতেন।
আরো বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ যয়নাব বিনতে জাহাশের প্রতি দয়া বর্ষণ করুন। সত্যিই তিনি পৃথিবীতে অতুলনীয় সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছেন। আল্লাহ স্বয়ং তাঁর রসুলের সঙ্গে তার বিবাহ দিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে কোরআন মজীদে কিছুসংখ্যক আয়াতও অবতীর্ণ হয়েছে। আরো বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ স্বয়ং এইমর্মে তাঁকে শুভসমাচার দিয়ে গিয়েছেন যে, তিনি জান্নাতেও তাঁর স্ত্রী হবেন এবং সর্বপ্রথম তাঁর সাথে মিলিত হবেন।
হজরত উম্মে সালমা বলেছেন, তিনি ছিলেন অত্যধিক সৎকর্মপরায়ণা, খুব বেশী রোজা পালনকারিণী এবং অধিক নামাজ পাঠকারিণী।
একদিন তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহান উপস্থিতিতে হজরত আয়েশার সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হলেন। বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন যে, আয়েশা যেমন মনে করেন, সেরকম বৈশিষ্ট্য তাঁর নেই। হজরত আয়েশা নীরবে তাঁর বক্তব্য শুনে গেলেন। মাঝে মাঝে দৃষ্টিপাত করলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র চেহারার দিকে। হজরত যয়নাবের কথা শেষ হলে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। অনুমতি পেয়ে বলিষ্ঠ বাকভঙ্গিমার মাধ্যমে খণ্ডন করলেন হজরত যয়নাবের যুক্তিসমূহ। হজরত যয়নাব আর কিছু বলতে পারলেন না। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এরকম তো হবেই। ও যে আবু বকরের মেয়ে।
হজরত যয়নাব ছিলেন খুবই দানশীল, মুক্তহস্ত, সতত আল্লাহ নির্ভর এবং অল্পেতুষ্টির গুণে গুণান্বিতা। পিতৃমাতৃহারা, দুঃস্থ ও অভাবগ্রস্তদের আশা ভরসার স্থল। দরিদ্র-দুঃখীদের জন্য অশেষ মায়ামমতা ছিলো তাঁর হৃদয়ে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং তাঁকে ‘দীর্ঘহস্তধারিণী’ বলেছেন।
তিনি ছিলেন হস্তশিল্পী। নিজ হাতে নিজস্ব পক্রিয়ায় চামড়া পাকা করতে পারতেন। ওই পাকা চামড়া বিক্রয় করে যা লাভ হতো, তা বিলিয়ে দিতেন অভাবীদের মধ্যে। এক বর্ণনায় একথাটিও এসেছে যে, হজরত যয়নাব সূতা কেটে যুদ্ধবন্দীদেরকে দিতেন। তারা কাপড় বুনতো। আর রসুলুল্লাহ সেগুলো যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করতেন।
রূপসী তো তিনি ছিলেনই। তদুপরি ছিলেন বহুগুণের অধিকারিণী। ছিলেন মুত্তাকী, বিনয়িনী এবং আবেদা।
একবার হজরত ওমর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কথার সূত্র ধরে একটি কঠিন কথা বলে ফেললেন। হজরত যয়নাব সহ্য করতে পারলেন না। বলে উঠলেন, আল্লাহর রসুলের সঙ্গে কীভাবে কথা বলছেন আপনি! মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত ওমরকে নিবৃত্ত করলেন। বললেন, ওমর! ওকে কিছু বলো না। ও তো ‘আউওয়াহা’ (আল্লাহর ভয়ে ভীতা)। সেখানে উপস্থিত একজন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল! ‘আউওয়াহা’ মানে কী।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, প্রার্থনায় বিনম্র হওয়া এবং আল্লাহর নিকট কাকুতি মিনতি করা। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পাঠ করলেন— ‘ইন্না ইব্রহীমা লা আউওয়াহুন হালীম’ (নিশ্চয় ইব্রাহীম দোয়াতে বিনম্র, কাকুতি-মিনতিকারী এবং সহিষ্ণু)।
আগেই বলা হয়েছে, আল্লাহপাক যে তাঁকে বিশেষভাবে অনুগ্রহ করেছেন, সেকথা তিনি ভুলতেন না। একদিন তো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সামনেই বলে ফেললেন, হে আল্লাহর রসুল! বলুন, আমি কি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর মতো? তাদেরকে বিয়ে দিয়েছেন তাদের পিতা, ভ্রাতা, অথবা তাদের বংশের কোনো অভিভাবক। আর আমিই আপনার একমাত্র স্ত্রী, যার বিবাহ দিয়েছেন আসমান থেকে স্বয়ং আল্লাহ। জিব্রাইল আমিন হয়েছেন দূত। আবার দেখুন আপনার ও আমার পিতামহ ও মাতামহ একজন।
হজরত আনাস বলেছেন, রসুলুল্লাহ এতো ভালো এবং এতো বেশী খাবারের আয়োজন তাঁর অন্য কোনো স্ত্রীর ওলীমাতে করেননি।
ইবনে সা’দ বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ তাঁর অন্য কোনো পত্নীর ওলীমা সেভাবে করেননি, যেভাবে করেছেন হজরত যয়নাব (রাঃ) এর জন্য । তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর ওলীমা করেছিলেন ছাগলের গোশত দিয়ে। তিনি আরো বর্ণনা করেছেন, যয়নাব বিনতে জাহাশ (রাঃ) দীনার দিরহাম কিছুই রেখে যাননি। যা কিছু তাঁর কাছে আসতো, তিনি দান করতেন। তিনি ছিলেন গরীব মিসকিনদের আশ্রয়স্থল।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেন, হজরত আয়েশা ইফকের (মিথ্যা অপবাদের) ঘটনা প্রসঙ্গে হজরত যয়নাবের অনেক প্রশংসা করেছেন।
আল্লামা ইবনে আবদুল বার মন্তব্য করেছেন, ধর্মনিষ্ঠার বিষয়ে আমি হজরত যয়নাবের চেয়ে উত্তম কোনো রমণী দেখিনি।
মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় মহানতম নবী পৃথিবীর দায়িত্ব শেষ করলেন। ডাক এলো প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল কিছুর স্রষ্টা মহাপ্রভুপালকের পক্ষ থেকে। আল্লাহর হাবীব সে ডাকে সাড়া দিলেন। লাভ করলেন চিরআকাঙ্ক্ষিত মাশুকমিলন।
উম্মতজননীগণ হলেন শোকাকুলা। তাঁদের প্রিয়তম স্বামী ও রসুল আর আসবেন না। পৃথিবী পীড়িত ও বিরহদগ্ধ হতে থাকবে ততোক্ষণ পর্যন্ত, যতোক্ষণ উপস্থিত না হবে মহাপ্রলয়। ভাগ্যের অমোঘ লিখন মেনে নিতেই হবে। তিক্ত প্রতীক্ষার প্রতিটি পল ও পরত অতিক্রম করতে হবে চরম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে। বিচ্ছেদ যন্ত্রণা যতোই প্রলম্বিত হোক, একসময় তা শেষ হয়ে যাবে। এসে পড়বে মহামিলনের ক্ষণ।
খলিফা ওমর তাঁর জন্য বারো হাজার দিরহাম বাৎসরিক ভাতা হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা নিজের জন্য ব্যয় করতেন না। জীবিকা নির্বাহ করতেন নিজস্ব উপার্জন দ্বারা। আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খায়বরে উৎপন্ন ফসল থেকে তাঁর জন্য একশত ওয়াসাক শস্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।
একবার খলিফা হজরত ওমর তাঁর কাছে এক বছরের ভাতা বারো হাজার দিরহাম পাঠালেন। তিনি দিরহামগুলো একখণ্ড কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। বাযরাহ্ ইবনে রাফেকে নির্দেশ দিলেন, ওগুলো আত্মীয়স্বজন ও দরিদ্র জনতার মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দাও। বাযরাহ্ বললেন, ওগুলোতে কি আমাদেরও কিছু হক আছে? তিনি বললেন, সবগুলোইতো তোমাদের। সবকিছু বিলিয়ে দেওয়ার পর তিনি দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! এর পরে যেনো এসকল অর্থবিত্তের মুখ আমাকে না দেখতে হয়। এতো এক পরীক্ষা। বলাবাহুল্য, তাঁর প্রার্থনা কবুল হয়েছিলো।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলে গিয়েছিলেন, তোমাদের মধ্যে যার হাত বেশী লম্বা, সে-ই আমার কাছে আসবে সকলের আগে। এই মহাবাণীখানি নিয়ে উম্মতজননীগণ জল্পনা-কল্পনা করতেন। নিজেদের হাত মাপামাপি করতেন। এভাবে মোটামুটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন যে, যেহেতু জননী সওদা দীর্ঘাঙ্গিনী ও দীর্ঘহস্তবিশিষ্ট সেহেতু তিনিই প্রথমে মিলিত হবেন আল্লাহর রসুলের সঙ্গে। কিন্তু তা হলো না। দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের শাসনকালে পৃথিবী পরিত্যাগ করলেন জননী যয়নাব। সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো ‘যার হাত বেশী লম্বা’ কথাটির প্রকৃত অর্থ— যে অধিক দানশীলা।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রিয়তমা ঘরণী হয়েছিলেন আটত্রিশ বছর বয়সে। চলে গেলেন পঞ্চাশ বছর বয়সে। হিজরী ২০ সনে। ওই বছরেই সংঘটিত হয় মিসর বিজয়। নিজের কাফনের ব্যবস্থা নিজেই করে গেলেন। বলে গেলেন, খলিফা যদি কাফনের কাপড় পাঠায়, তবে যে কোনো কাফন যেনো দান করে দেওয়া হয়। তাঁর অসিয়ত প্রতিপালিত হয়। খলিফাপ্রদত্ত কাফন পরানো হলো তাঁকে। আর তাঁর নিজের কাফন দান করে দেওয়া হলো তাঁর বোন হাফসাকে।
আর একটি অসিয়ত করে গেলেন তিনি। বললেন, অন্তিম যাত্রাকালে আল্লাহর রসুলকে যে খাটিয়ায় শোয়ানো হয়েছিলো, সেই খাটিয়ায় যেনো আমাকে কবর পর্যন্ত বহন করা হয়। মহাপুণ্যবতী মায়ের এই অসিয়তখানিও পালন করা হলো। তাঁর সহচরী সপত্নীগণ তাঁকে গোসল করালেন। আর ওই বরকতময় খাটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হলো জান্নাতুল বাকী গোরস্থানে। উল্লেখ্য, ওই খাটিয়ায় রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পরে ওঠানো হয়েছিলো কেবল হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) কে।
খলিফা হজরত ওমর জানাযার নামাজ পড়ালেন। রবিয়া ইবনে আবদুল্লাহ বলেছেন, আমি ওমরকে দেখলাম তাঁর একটি স্কন্ধে দুররা ঝুলছে। তিনি সামনে গেলেন। আর চার তকবীরের সঙ্গে জননী যয়নাবের জানাযার নামাজ পড়ালেন। কবরের পাশে অপেক্ষা করলেন কবরের উপর পানি ছিটানোর কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সুলাইত বলেছেন, আমি জননী যয়নাবের ভাই আবু আহমদ ইবনে জাহাশকে দেখলাম, তিনি খাটিয়া বহন করছেন আর কাঁদছেন। তিনি তখন দৃষ্টিশক্তিরহিত। শুনলাম, ওমর তাঁকে বলছেন, খাটিয়া থেকে সরে এসো, মানুষের ভিড়ে কষ্ট পাবে। আবু আহমদ বললেন, ওমর! আমরা সকল কল্যাণ লাভ করেছি তাঁরই ওসিলায়। আর আমার কান্না সিক্ত করছে অন্তর্জ্বালাকে। করতে দাও। ওমর বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা। ঠিক আছে, ঠিক আছে। দাফনের সময় এক কুরায়েশ যুবক মিসরী রঙিন কাপড় পরে সেজেগুঁজে সেখানে উপস্থিত হলো। হজরত ওমর তাকে দেখে রেগে গেলেন। তার মাথার উপর ছড়ি উঠিয়ে বললেন, তুমি এমনভাবে এসেছো, দেখে মনে হচ্ছে এখানে আমরা খেলা করছি। আরে এখানে তো প্রবীণগণ তাঁদের মায়ের দাফনকর্ম সমাধা করছে।
দিবসটি ছিলো অত্যধিক উত্তপ্ত। তাই খলিফার নির্দেশে সেখানে শামিয়ানা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, কবরে কারা নামবে? উম্মতজননীগণ বলে পাঠালেন, পৃথিবীতে যে সকল নিকটজন তাঁর কাছে আসতো, তারা। তাঁদের পরামর্শ মোতাবেক জননী যয়নাবকে কবরে নামালেন মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ, উসামা ইবনে যায়েদ, আবদুল্লাহ ইবনে আবু আহমদ ইবনে জাহাশ এবং মোহাম্মদ ইবনে তালহা।
উত্তরাধিকার হিসেবে শুধু একটি বাড়ি রেখে গিয়েছিলেন। অনেক পরে উমাইয়া খলিফা ওলিদ ইবনে আবদুল মালেক পঞ্চাশ হাজার দিরহাম মূল্যে বাড়িটি তাঁর নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে কিনে নেন এবং মসজিদে নববীর অন্তর্ভুক্ত করেন।
মাতৃহারা মদীনার মিসকিন জনতা সেদিন শোকে আহাজারী শুরু করে দিয়েছিলো। জননী আয়েশা সিদ্দীকা দারুণ দুঃখ পেয়েছিলেন। ব্যথিত হৃদয়ের মর্মজ্বালাকে প্রকাশ করেছিলেন এভাবে— হায়! তিনি অতুলনীয় প্রশংসাসহ প্রস্থান করলেন। আর এতিম ও বিধবাদেরকে করে গেলেন অসহায়।