তাঁর স্মরণ
- আবুল হাসান মুহাম্মদ বায়েজীদ
[১০ রমজান. নবীপত্নী উম্মুল মোমেনীন হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার ওফাত উপলক্ষে নিবেদিত]
-------------------------
যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ হিসেবে তাদের আপনজনরা সোনা-রূপা-অর্থ যে যা পারছে দিয়ে বন্দীদের নিয়ে যাচ্ছিল। প্রিয়নবী ﷺ বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছিলেন। হঠাৎ একটি গলার হার তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। মনে হয় চেন চেনা লাগছে! স্মৃতির গহ্বর থেকে একটি অনিন্দ্য সুন্দর ও পূত মুখশ্রী হৃদয়ের আয়নায় ভেসে উঠলো। আরে এটা তো তাঁর প্রিয়তমা খাদিজার গলার হার! এখানে আসলো কেমনে? তাঁর কথা মনে হতেই প্রিয় রাসূল ﷺ এর নূরানী নয়নযুগল থেকে কপোল বেয়ে অঝোরে অশ্রুপাত হতে থাকলো। তিনি বলতে লাগলেন এটা খাদিজার গলার হার, এটা খাদিজার গলার হার! তিনি তাঁর এতটাই প্রিয় ছিলেন যার কথা স্মরণ হলেই নবীজী ﷺ আবেগপ্রবণ, অশ্রুসজল হয়ে যেতেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদয় গহীনে স্মৃতির পাতা উল্টাতেন।
ঘটনাটি হলো- বদরযুদ্ধে কাফির যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে হুজুর পাক ﷺ এর প্রিয় ও জ্যোষ্ঠকণ্যা হযরত যয়নব আলাইহাস সালামের স্বামী আবুল আসও ছিলেন। ইসলামপূর্ব যুগে তাদের বিবাহ হয়েছিল। আবুল আস ইসলাম গ্রহণ করেন নি। (পরে তারা পৃথক হয়ে যান) কাফিরদের সহযোগী হয়ে বদর ময়দানে আসলে তিনিও মুসলমানদের হাতে বন্দী হন। স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে হযরত যয়নব আলাইহাস সালাম বিবাহের রাতে তার মা খাদিজা আত তাহেরা সালামুল্লাহে আলাইহা যে নেকলেসটা তাকে দিয়েছিলেন তা পাঠান। প্রিয়নবী ﷺ আবেগাপ্লুত হয়ে সাহাবাদের বলেন- তোমরা কি বল, আমি আমার জামাতা আবুল আসকে মুক্ত দিয়ে দেই, সাথে এই নেকলেসটাও ফেরত দিয়ে দেই। কারন এটা খাদিজার স্মৃতি বহন করছে। নবীক্বদমে নিবেদিতপ্রাণ সাহাবাগণ বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনি যেটা ভাল মনে করেন তাই করবেন। আমাদের কোন আপত্তি নাই। অতঃপর তিনি আবু আল আসকে ডাকলেন এবং বললেন, "যায়নাবকে বলবে, এই নেকলেসটি যেন সে সযতনে রাখে এবং এটা যেন কখনো হারিয়ে না ফেলে।"
[সূত্র : বিভিন্ন সীরাত ও হাদিসের কিতাব]
পৃথিবী যতদিন থাকবে, চন্দ্র-সূর্য যতদিন আলো দিবে খাদিজাতুল কুবরা রাদিয়াল্লাহু আনহার নাম, ইসলামের জন্য তার অশেষ কুরবানীর কথা উম্মতের হৃদয়মুকুরে ততদিন জ্বলজ্বল করবে।
কেন নয়? তিনি ছিলেন আরবের সেরা ধনী, ব্যবসায়ী সম্পদশালী রমণী। পরপর দু’স্বামী হারানোর পরও তার রূপ-মাধূর্য-পূত্র চরিত্র ইত্যাদির কারণে মক্কার শীর্ষস্থানীয় ধনকুবেররা তার কাছে প্রায়ই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতেন। কিন্তু তাঁর সু-কমোল হৃদয় অপেক্ষা করছিল অন্য কারও জন্য। ব্যবসায়িক কাজের দায়িত্ব কোন বিশ্বস্ত লোকের হাতে দেয়ার জন্য চেষ্টা করছিলেন। এক সময় তাঁর কানে আল আমিন আস সাদিক প্রিয়নবী ﷺ এর সংবাদ পৌঁছল। তাঁকেই এই দায়িত্ব অর্পন করলেন। দাসী মাইসারাকে সাথে দিলেন সার্বিক বিষয়াদী পর্যবেক্ষণের জন্য। অভূতপূর্ব সফলতার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করে ফিরে আসলে, খাদিজা সালামুল্লাহে আলাইহা মাইসারাকে প্রিয় রাসূল ﷺ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। মাইসারা তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
তিনি সত্যবাদী, তিনি অতীব বিনয়ী, তিনি সদা হাস্যমুখ, পরিশ্রমী, তাঁর কোন তুলনা হয় না ইত্যাদি অনর্গল বলতে লাগলেন। সাথে এও বললেন- আশ্চর্যজনক বিষয় হলো তিনি যখন মরুভূমির তপ্তরোদে হৃদয়কাড়া পদবিক্ষেপে হেঁটে চলেন তখন তাঁর মাথার উপর মেঘমালা ছায়া দেয়। সব বৃত্তান্ত শুনে খাদিজা হৃদয় অন্দরে পুলক অনুভব করলেন। এমন কাউকেই তো এ মনপ্রাণ খুঁজছিল বহুদিন! দেরি না করে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। যথানিয়মে সামাজিকতায় উভয়ের বিয়ে হয়ে গেল। সেই থেকে নিয়ে টানা ২৫/২৬ বছর সুখে-দু:খে তাঁদের দাম্পত্যজীবন। যেখানে ছিল ভালোবাসা, ত্যাগ, ধৈর্য, স্বামীভক্তি,
বিশ্বস্ততা, কষ্ট স্বীকার ইত্যাদি। নবুওয়াত প্রকাশের পর নিজের বিলিয়ন বিলিয়ন সম্পত্তি সব প্রিয়নবী ﷺ এর ক্বদমে উৎসর্গ করে দেন। রাসূল ﷺ দ্বীন প্রচারের কাজে, গরীব-দু:খি-অনাথ, অসহায়দের তরে অকাতরে খরচ করতে থাকেন। একসময় সম্পদ শেষ হয়ে তারা নি:স্ব-রিক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু এতেও কোন অভাব-অনুযোগ-অভিযোগ ছিল না। ছিল না কোন আফসোস কিংবা অভিমান। বরং তাঁরা গড়ে তোলেন সবরের সুউচ্চ পর্বত। রাসূলে পাক ﷺ এর পুত্র-কণ্যাগণ প্রায় সবাই আগমন করেন আম্মাজান খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার গর্ভ থেকে। তিনি রাসূলে আকরাম ﷺ এর এতটাই প্রিয় ছিলেন তার জীবদ্দশায় হুজুর অন্য কোন বিবাহ করেন নি।
হেরা পর্বতে যখন দোজহানের সরদার প্রিয়নবী ﷺ মুরাকাবা রত থাকতেন, তখন এই খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহাই প্রৌঢ়া বয়সে উঁচু পাহাড়ের কন্টকময় বন্ধুর পথ মাড়িয়ে প্রিয়তমের জন্য খাদ্য-পানীয়-রসদ নিয়ে যেতেন। প্রাণপতির প্রতি এত মায়া এবং কষ্ট স্বীকারের কারণে আল্লাহ এতই খুশী হয়ে যান যে, খোদ জিব্রাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে নিজের পক্ষ থেকে সালাম পাঠান। জিব্রাঈল এসে বলেন- فَاقْرَأْ عَلَيْهَا السَّلَامَ مِنْ رَبِّهَا، وَمِنِّي، وَبَشِّرْهَا بِبَيْتٍ فِي الْجَنَّةِ مِنْ قَصَبٍ لَا صَخَبَ فِيهِ وَلَا نَصَبَ"
তাঁকে (খাদিজাকে) তাঁর রবের পক্ষ থেকে সালাম পাঠান, এবং আমার পক্ষ থেকেও। আর তাকে জান্নাতে একটি মণিমুক্তোর প্রাসাদের সুসংবাদ দিন যাতে কোন দু:খ-কষ্ট থাকবে না। [সহিহ মুসলিম]
আমার প্রিয় রাসূল বলেছেন- নারীদের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন খাদিজা। [সহিহ মুসলিম]
১০ রমজান উম্মুল মোমেনীন খাদিজাতুল কোবরা রাদিয়াল্লাহু আনহার পবিত্র ওফাত দিবস। রাসূল ﷺ এর নবুওয়াতের ১০ম বছর তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর বিয়োগ ব্যথায় হুজুরে আকদাস ﷺ এতটাই বেদনাহত হয়েছিলেন যে সে বছরের নাম দেয়া হয় ‘আমুল হুজন’ বা দু:খ-কষ্ট ও শোকের বছর।
মহান আল্লাহ আজকের নারীজাতিকে আম্মাজান খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার আদর্শ মেনে চলার তওফীক দান করুন। হাশরের ময়দানে
তাঁকে আমাদের জন্য সুপারিশকারী হিসেবে কবুল করুন। আমিন।