হজরত উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা
🖋মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ
.........................................................................
নতুন মুসলমানদের উপর কুরায়েশ কাফেরদের অত্যাচার বেড়েই চললো। দরিদ্র, সম্ভ্রান্ত সকল বিশ্বাসীর উপর তাদের অত্যাচার প্রায় একই রকম নিষ্ঠুর। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন অন্যাপেক্ষা কিছুটা নিরাপদ। পিয় পিতৃব্য গোত্রপতি আবু তালেব ছিলেন তাঁর দৃশ্যমান রক্ষক। বরং স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই ছিলেন তাঁর প্রত্যক্ষ ও প্রধান সহায়। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সাহাবীগণকে অত্যাচার বিমুক্ত অবস্থায় দেখতে চাইতেন। কিন্তু পারতেন না। অত্যাচারের মাত্রা যখন সীমা ছাড়িয়ে গেলো তখন তিনি সাহাবীগণকে হিজরতের (দেশত্যাগের) অনুমতি দিলেন। বললেন, আবিসিনিয়া শান্তির দেশ। সেখানকার নাজ্জাশী (রাজা) হৃদয়বান ও ন্যায়বিচারক। তোমরা সেখানে যেয়ে বসবাস করতে পারো, যতোদিন আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে অধিকতর উত্তম ব্যবস্থা না হয়।
আবিসিনিয়ায় হিজরত সংঘটিত হয় দু’বার। প্রথম বার অল্প সংখ্যক সাহাবী হিজরত করেন। দ্বিতীয়বার হিজরত করেন সাহাবীগণের বড় একটি দল। ওই দলে ছিলেন জননী যয়নাব বিনতে জাহাশের দুই ভাই— আবু আহমদ ইবনে জাহাশ এবং উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশ। মক্কাবিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত যিনি কাফের কুরায়েশদের নেতা ছিলেন, সেই বিখ্যাত আবু সুফিয়ানের দুই কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন তাঁরা। আবু আহমদ ইবনে জাহাশ ফারিয়াকে এবং উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশ রামলাকে।
উবায়দুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও রামলার সংসার ছিলো সুখের। অন্যান্য মুহাজিরদের মতো তাঁরাও একনিষ্ঠ ইবাদত-বন্দেগীর সঙ্গে সংসার করে যাচ্ছিলেন। সেখানে তাদের ঘরে এলো দুটি সন্তান— বড়টি মেয়ে এবং ছোটটি ছেলে। যখন মেয়ের নাম হাবীবা রাখা হলো, তখন থেকে তাঁর মায়ের রামলা নামটি ঢাকা পড়ে গেলো। সবাই রামলাকে ডাকতে লাগলো উম্মে হাবীবা (হাবীবার মা) বলে।
উম্মে হাবীবার সুখের সংসার হঠাৎ একদিন কেমন যেনো হয়ে গেলো। এক অজানা আতঙ্ক এবং বিষাদ ঘিরে ফেললো তাঁকে। ভিতরে ভিতরে শুরু হলো অশান্তির ঝড়। এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন, উবায়দুল্লাহ বীভৎস আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকালে স্বপ্নের কথা বলতে যাবেন, কিন্তু তার আগে উবায়দুল্লাহই বলতে শুরু করলো, শোনো হাবীবার মা! ধর্মবিষয়ে আমি গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করতে যেয়ে দেখলাম, সবচেয়ে ভালো ধর্ম হচ্ছে খ্রিস্টানধর্ম। আমি খ্রিস্টান ধর্মকেই মনেপ্রাণে গ্রহণ করলাম। উম্মে হাবীবা শিউরে উঠলেন। স্বপ্নের কথা জানালেন। উবায়দুল্লাহ যে পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছেন, সেকথা অনেক করে বোঝালেন। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। উবায়দুল্লাহ চির হতভাগ্যতাকেই গ্রহণ করলো। ধর্মত্যাগ করলো। মুরতাদ হয়ে গেলো।
মুরতাদ হলে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। সুতরাং বিশ্বাসবতী উম্মে হাবীবাও চিরদিনের জন্যপৃথক হয়ে গেলেন। একাকী হওয়ার পর উবায়দুল্লাহ বেশী দিন বাঁচলো না। অত্যধিক মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো সে। সে কারণেই হয়তো অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হলো।
হজরত উম্মে হাবীবা কিসের আশায় যেনো উন্মুখ হয়ে রইলেন। একমাত্র সহায় আল্লাহ। তিনি এবার তাঁর জীবনের তরী কোন দিকে ঘুরিয়ে দিবেন, উম্মে হাবীবা তা জানেন না। শিশু সন্তান দুটোর কী গতি হবে, তা-ও তিনি বলতে পারেন না।
তিনি নিজে বলেছেন, এক রাতে স্বপ্নে দেখলাম, কে যেনো আমাকে ডেকে চলেছে ‘ইয়া উম্মুল মুমিনীন’! স্বপ্ন ভেঙে গেলো। আমার মন বললো, আল্লাহর রসুল আমাকে বিবাহ করবেন।
অল্প কিছুদিন পরেই শুভবিবাহের প্রস্তাব উপস্থিত হলো। বাস্তবের মৃত্তিকা স্পর্শ করতে চললো হজরত উম্মে হাবীবার স্বপ্ন। সুদূর মদীনা থেকে শুভপরিণয়ের প্রস্তাব নিয়ে আবিসিনিয়া এলেন হজরত আমর ইবনে উমাইয়া আদ দামরী। রাজদরবারে উপস্থিত হলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর চিঠিখানি হস্তান্তর করলেন। নাজ্জাশী মহান পত্রটি পাঠ করলেন। লেখা আছে— উম্মে হাবীবার সঙ্গে আমার বিবাহের কাজ আপনাকেই সমাধান করতে হবে।
নাজ্জাশী বিলম্ব করলেন না। তাঁর বিশিষ্ট দাসী অবরাহাকে হজরত উম্মে হাবীবার কাছে পাঠালেন। বললেন, বলে দিয়ো, রসুলুল্লাহর সঙ্গে আপনার শুভ বিবাহ সম্পন্ন করার দায়িত্ব এখন আমার। আপনি শুধু আপনার পক্ষের উকিল নিযুক্ত করুন। হজরত উম্মে হাবীবা মহান প্রস্তাব পেয়ে এতো খুশী হলেন যে, শরীরের গহনাগুলো খুলে দাসীকে উপহার দিলেন— দুটো রুপার চুড়ি, কানের দুল এবং একটি নকশাখচিত আঙটি। তারপর নিজের উকিল নিযুক্ত করলেন হজরত খালেদ ইবনে সাঈদ ইবনে আসকে।
নাজ্জাশী নিজে সকলকে বিবাহের নিমন্ত্রণ জানালেন। যথাসময়ে বিবাহ মজলিসে উপস্থিত হলেন। উপস্থিত হলো প্রবাসী মুসলিম জনতা। দলনেতা হজরত জাফর ইবনে আবু তালেব। শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হলো। নাজ্জাশী নিজে বিবাহের মোহরস্বরূপ চারশত স্বর্ণমুদ্রা কন্যাপক্ষের উকিল হজরত খালেদ ইবনে সাঈদের হাতে তুলে দিলেন। তারপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন— সমস্ত প্রশংসা প্রশস্তি আল্লাহর জন্য, যিনি সর্বাধিপতি ও শান্তি ও নিরাপত্তা বিধায়ক, মহারক্ষক, মহাপরাক্রমশালী ও মহাপ্রবল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং মোহাম্মদ তাঁর দাস ও রসুল, যাঁকে তিনি প্রেরণ করেছেন হেদায়েত ও এমন সত্যধর্মসহকারে, যে ধর্ম অন্য সকল ধর্মের উপরে অবশ্যই বিজয়ী হবে— যদিও অংশীবাদীরা তা পছন্দ করবে না। উপস্থিত জনতা! আল্লাহর রসুল আমাকে এই মর্মে আজ্ঞা করেছিলেন যে, আমি যেনো তাঁর সঙ্গে পরম শ্রদ্ধেয়া উম্মে হাবীবার বিবাহ সুসম্পন্ন করি। আলহামদুলিলাহ! আজ আমি তাঁর মহা আজ্ঞা পালন করতে পারলাম।
এরপর ভাষণ দিলেন হজরত খালেদ ইবনে সাঈদ। বললেন, আমি কেবল মহাপ্রভুপালক আল্লাহর প্রশংসা-প্রশস্তি, স্তব-স্তুতি বর্ণনা করছি। সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি কেবল তাঁর। আর আমি এমতো সাক্ষ্যও প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু-উপাস্য নেই— তিনি এক, একক ও অদ্বিতীয় এবং মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দা ও বাণীবাহক। এই শুভসমাবেশ মহামহিম আল্লাহর রসুল এবং মহাসম্মানিতা জননী উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ানের পবিত্র বিবাহের।
আল্লাহ পাক এই পবিত্র পরিণয় অনন্ত বরকতময় করুন। ভাষণদানপর্ব শেষ হলো। শুরু হলো ভোজনপর্ব। হজরত খালেদ ইবনে সাঈদ বললেন, সকলে বসুন। ওলীমায় অংশগ্রহণ করুন। বিয়ের পর আহার করানো নবী-রসুলগণের রীতি।
পানাহার পর্বের পরক্ষণে দাসী আবরাহার মাধ্যমে জননী উম্মে হাবীবার কাছে মোহরের অর্থ চারশত দীনার পৌঁছানো হলো। তিনি পঞ্চাশ দিনার দাসীকে দিতে গেলেন। দাসী বললেন, না। নাজ্জাশী আমাকে কোনোকিছু নিতে নিষেধ করেছেন। এই বলে দাসী তাঁর আগের দেওয়া গহনাগুলোও ফেরত দিয়ে দিলো। 
তারপর বললো, হে রসুলসঙ্গিনী! আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি। আপনি যখন রসুলসঙ্গ লাভ করবেন, তখন অনুগ্রহ করে তাঁকে আমার মুসলমান হওয়ার কথা জানাবেন এবং বলবেন, আমি তাঁকে সালাম নিবেদন করেছি।
নাজ্জাশী মুমিনজননী হজরত উম্মে হাবীবাকে উপঢৌকন হিসেবে দিলেন অনেক মেশক আম্বর সুগন্ধি এবং মূল্যবান তৈজসপত্র। তারপর মহা জাঁকজমে কর সাথে তাঁর মদীনাযাত্রার ব্যবস্থা করলেন। সফরসঙ্গী হিসেবে তাঁর সঙ্গে চললো হজরত জাফর ইবনে আবু তালেবের নেতৃত্বে একদল মুহাজির সাহাবী। জননী মহোদয়ার জাহাজ যথাসময়ে যাত্রা শুরু করলো আবিসিনিয়ার বন্দর থেকে। নির্বিঘ্ন জাহাজযাত্রা শেষ হলো মদীনার নিকটতম কোনো এক বন্দরে। সেখান থেকে মদীনায় যখন পৌঁছলেন, তখন মদীনা রসুলশূন্য। জানতে পারলেন, আল্লাহর রসুল এখন অনেক দূরে— খায়বরের যুদ্ধক্ষেত্রে।
হজরত ইবনে আব্বাস বললেন, রসুলুল্লাহ যখন হজরত উম্মে হাবীবাকে বিবাহ করেন, তখন অবতীর্ণ হয় এই আয়াতখানি— ‘যাদের সঙ্গে তোমাদের শশ্রুতা রয়েছে সম্ভবত আল্লাহ তাদের ও তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দিবেন, আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (সুরা মুমতাহিনা,আয়াত-৭)।
হজরত উম্মে হাবীবার পিতা আবু সুফিয়ান তখন ইসলামের শশ্রুপক্ষের প্রধান। তবে ইতোমধ্যে সম্পাদিত হয়েছে হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি। যুদ্ধের উন্মাদনা আর নেই। কিন্তু উভয়পক্ষকে অত্যন্তসতর্কতার সঙ্গে সন্ধির শর্তসমূহ মেনে চলতে হয়।
মক্কায় যখন তাঁর আদরের কন্যার সঙ্গে রসুলুল্লাহর বিবাহের সংবাদ পৌঁছলো, তখন তিনি খুশীই হলেন। মন্তব্য করলেন, এমন এক সম্ভ্রান্ত সম্পর্ক যা প্রত্যাখ্যান করা যায় না। আবু সুফিয়ান একথা ভেবেও পুলকিত বোধ করলেন যে, রামলা নিশ্চয়ই মোহাম্মদকে প্রভাবিত করতে পারবে। কারণ সে রূপবতী। আবু সুফিয়ান এরকম কথা বলেও বেড়াতেন সকলের কাছে। বলতেন, আমার তো মনে হয় উম্মে হাবীবা আরবের সেরা সুন্দরী, শ্রেষ্ঠ রূপসী।
হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির একটি ধারা ছিলো এরকম— আরবের গোত্রগুলো তাদের পছন্দমতো যে কোনো পক্ষে (মুসলমান অথবা কাফের) যোগ দিতে পারবে। এমতোক্ষেত্রে ধর্ম-অধর্মের কথা আসবে না। এরকম ঘোষণা দেওয়ার ফলে বহুসংখ্যক জনপদের লোকেরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। এভাবে সকলে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানকে মেনে নেয়।
খুজআ গোত্র বাস করতো মক্কার সন্নিকটে। কিন্তু তারা যোগ দিয়েছিলো মদীনার মুসলমানদের সঙ্গে। কাফের কুরায়েশরা হঠাৎ একদিন তাদেরকে আক্রমণ করে বসে। তারা সাহায্য চেয়ে পাঠায় মিত্রশক্তি মুসলিমবাহিনীর কাছে।
কুরায়েশরা ভুল বুঝতে পারে। আতঙ্কিত হয় এই ভেবে যে, চুক্তিভঙ্গের কারণে আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় কিনা। আবু সুফিয়ান ভাবেন মদীনায় গিয়ে এর একটা বিহিত করতেই হবে। চুক্তির এই ধারাটি হয় বদলাতে হবে, নয়তো আশ্বস্ত করতে হবে এই মর্মে যে, ভবিষ্যতে আর কখনো এরকম হবে না। অন্য কোনো অসুবিধাও তো নেই। তিনি তো গিয়ে উঠবেন তাঁর কন্যাগৃহে। কন্যার কোনো সুপারিশ কি তিনি পাবেন না? মদীনায় পৌঁছে তিনি প্রথমে প্রবেশ করলেন কন্যার ঘরে। হজরত উম্মে হাবীবা তাঁকে স্বাগত জানালেন ঠিকই, কিন্তু বসতে বললেন না। তিনি নিজেই বিছানায় বসতে গেলেন। হজরত উম্মে হাবীবা সঙ্গে সঙ্গে বিছানা গুটিয়ে নিলেন।
বিস্মিত হলেন আবু সুফিয়ান। বললেন, বিছানা গুটিয়ে নিলে কেনো? আমি কি বিছানার উপযুক্ত নই, না বিছানা আমার উপযুক্ত নয়। হজরত উম্মে হাবীবা একটুও বিব্রত না হয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, পিতা! আপনি মুশরিক, অপবিত্র আপনাকে আমি রসুলুল্লাহর পবিত্র শয্যায় উপবেশন করতে দিতে পারি না। আবু সুফিয়ান বিস্মিত হলেন। রাগত স্বরে বললেন, আমাকে পরিত্যাগ করার পর থেকে তোমার মধ্যে অনেক মন্দ স্বভাব ঢুকেছে। একথা বলেই তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে গিয়ে বসলেন।
খায়বর থেকে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসেই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নতুন স্ত্রীর সঙ্গে বাসর যাপন করেছিলেন। তারপর থেকেই তাঁরা একে অপরের ঘনিষ্ঠতর হতে থাকেন। ভালোবাসা, উপাসনা ও দায়িত্ববোধ এই নিয়ে আবর্তিত হতে থাকে তাঁদের পৃথিবীপ্রসক্তিহীন সংসার। আবিসিনিয়ার দাসী আবরাহার কথাও তিনি ভুলেননি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়েই তাঁর কথা বলেছিলেন।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও দূরবর্তী ওই বিশ্বাসিনীর সালামের প্রত্যুত্তর দিয়ে মৃদু হেসে বলেছিলেন, ওয়া আ’লাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুলাহি ওয়া বারাকাতুহু।
তাঁর মেয়ে হাবীবা এবং ছেলে আবদুল্লাহ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর গৃহেই বড় হতে থাকেন। পরে হাবীবার বিয়ে হয় সাকিফ গোত্রের এক বড় নেতার সঙ্গে।
রসুলপ্রেমে পূর্ণ নিমজ্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ পরিপূর্ণ বিশ্বাসবান অথবা বিশ্বাসবতী হতে পারে না। আর এ কথা উল্লেখ না করলেও চলে যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সকল জীবনসঙ্গিনীই ছিলেন তাঁর প্রেমে আসত্তা নিমজ্জিতা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সর্বক্ষণের ভাবনা, বেদনা, মনোভাব ও স্বভাব সারাক্ষণ দ্যুতি বিকিরণ করতো তাঁদের কথায়, কর্মে ও অভিব্যক্তিতে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতিটি কথা তাঁরা আত্মস্থ করতেন। বিবরণ দিতেন তাঁর প্রতিটি অভিব্যক্তির। এভাবে গড়ে উঠতো ধর্মবিধানচর্চার এক আলোকিত পৃথিবী। ৬৫টি হাদিস বর্ণনা করেছেন তিনি। তাঁর সূত্রে হাদিস বর্ণনাকারীগণের সংখ্যা কম নয়। তাঁদের মধ্যে সাহাবী ও সাহাবীয়া যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন অনেক প্রথিতযশা তাবেয়ীনও। উল্লেখ্য জনদের মধ্যে রয়েছেন— হজরত হাবীবা (কন্যা), হজরত মুয়াবিয়া, উতবা (আবু সুফিয়ানের দুই ছেলে), আবু সুফিয়ান ইবনে সাঈদ সাকাফী, সালেম ইবনে সাওয়ার, আবুল জাররাহ, সাফিয়া বিনতে শায়বা, যয়নাব বিনতে উম্মে সালমা, ওরওয়া ইবনে যোবায়ের, আবু সালেহ আস-সাম্মান, শাহর ইবনে হাওশাব, আনবাসা, শুতাইব, ইবনে সাকাল, আবুল মালীহ, আমের আল হুজালী প্রমুখ।
ইসলামের জন্য তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। ধর্মরক্ষার জন্য হিজরত করতে পশ্চাৎপদ হননি। স্বজন-বন্ধনহীন বিদেশ বিভুঁয়ে গিয়েও শান্তি পাননি। দুটি অবুঝ শিশুকে নিয়ে হয়েছিলেন দিশাহারা। তবুও ধৈর্যচ্যুত হননি। আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ নির্ভরতার কারণে আল্লাহপাক তাঁকে দুনিয়া আখেরাতে উভয় জগতে দিয়েছেন প্রভূত সম্মান। করে দিয়েছেন বিশ্বাসী জনতার মহাসম্মানিতা ও মহাপুণ্যবতী মা— জননী।
ইমান ও অংশীবাদিতার পার্থক্য কী ধরনের তা তিনি কতো সুন্দর ও সঠিক ভাবেই না বুঝেছিলেন। আল্লাহপাক বলেছেন ‘ইন্নামাল মুশরিকূনা নাজাসুন’ (নিশ্চয় অংশীবাদীরা অপবিত্র)। তিনি পিতার প্রতিও এতোটুকু দুর্বলতা প্রদর্শন করেননি। স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, মুশরিকেরা অপবিত্র। পিতৃসম্পর্ক মূল বিবেচ্য বিষয় নয়। মূল বিষয় হচ্ছে ইমান ও কুফর। বিশ্বাস ও অবিশ্বাস। মানুষের সঙ্গে মানুষের মূল চিরস্থায়ী সম্পর্ক নির্ণীত হতে হবে এই নিরিখেই।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কথা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। উল্লেখ্য, মক্কাবিজয়ের পর তাঁর পিতা গোত্রপতি আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরও দেখা গেলো, তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নির্দেশ অনুসারে আমল করছেন। তিন দিন শোক পালন করেছিলেন তাঁর জন্য। তারপর সুগন্ধি চেয়ে নিয়ে কপালে মাখতে মাখতে বলেছিলেন, আমি রসুলুল্লাহকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে, এমন নারী স্বামী ছাড়া অন্যদের জন্য শোক করতে পারবে তিন দিন। কেবল স্বামীর জন্য চল্লিশ দিন।
 
একবার তিনি রসুলুল্লাহকে বলতে শুনলেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন বারো রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে, তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানানো হবে। জননী উম্মে হাবীবা বলেন, ওই কথা শোনার পর থেকে আমি প্রতিদিন বারো রাকাত করে নফল নামাজ পড়ি। উল্লেখ্য, তাঁর অনুসরণে ওই নামাজ পড়তেন অনেকে।যেমন— তাঁর ছাত্র ও ভাই উতবা, উতবার ছাত্র আমর ইবনে উওয়াইস এবং আমরের ছাত্র নোমান ইবনে সালেম প্রমুখ।
একবার তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনি আমার বোনকে বিয়ে করুন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি কি এরকম পছন্দ করো। তিনি বললেন, কেনো করবো না। যা উত্তম, তা আমি আমার বোনের জন্য চাইতে পারবো না কেনো? বলাবাহুল্য, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরকম করেননি। কারণ, তা ধর্মসম্মত ছিলো না।
আল্লামা জাহাবী তাঁর মর্যাদার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, বংশীয় নৈকট্যের দিক থেকে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অন্য কোনো স্ত্রী হজরত উম্মে হাবীবার চেয়ে অগ্রগামিনী ছিলেন না। অন্য পবিত্র স্ত্রীগণের মোহরানাও এতো বেশী ধার্য করা হয়নি। আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এভাবে অনেক দূরদেশে থেকেও কাউকে বিবাহ করেননি।
আনন্দ ও বেদনা— পৃথিবীতে কোনোটাই স্থায়ী হয় না। বিশ্বাস ও ভালোবাসার অনন্ত আনন্দ নিয়ে আর্ভিভূত হয়েছিলেন শেষ ও শ্রেষ্ঠ রসুল মহাবিশ্বের মহামমতার অপার পারাবার হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জেগে উঠেছিলো সুবর্ণ আলোর জোয়ার।
সুসজ্জিত ও সুবাসিত হয়েছিলো পথ-প্রান্তর-পৃথিবী। মহাসত্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে জীবন, সম্পদ ও সময় উৎসর্গ করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন তাঁর সহচরবৃন্দ। ভেবেছিলেন, ত্যাগের মহিমা প্রচারের সংঘর্ষ ও শান্তিময় এই আনন্দোৎসব কোনোদিন শেষ হবে না। প্রিয়তম রসুল তাঁদেরকে কখনোই ছেড়ে যাবেন না। কিন্তু তা তো হলো না। তিনি তো চলেই গেলেন। বলে গেলেন, দুঃখ না করতে। সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন, সকলের পৃথিবীর পরমায়ু এক সময় শেষ হবেই। মহামিলন সংঘটিত হবে ওই সময়েই। যতোদিন তা না হয়, ততোদিন একনিষ্ঠ ইবাদত সুসম্পন্ন করে যেতে হবে। আর পালন করে যেতে হবে সত্যধর্ম ইসলামের প্রচার দায়িত্ব।
চলে গেলেন প্রেমের মহাসম্রাট। আকাশ কাঁদলো। বাতাস কাঁদলো। চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্র-নিহারিকা, নিসর্গের সকল মোড় ও মহলা ভরে গেলো শোকে ও রোদনে। রসুলশূন্য মদীনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হলো বিষাদময়, বিশৃঙ্খল ও বিপর্যস্ত। হজরত বেলাল আর আজান দিতে পারলেন না। মনের দুঃখে মদীনা ছেড়ে গেলেন।
তুফান কবলিত নিমজ্জমান তরীর হাল ধরলেন সর্বঘনিষ্ঠ রসুল-সহচর হজরত আবু বকর। আল্লাহর বাণী আবৃত্তি করে শোনালেন। মর্মস্পর্শী ভাষণ দিয়ে সবাইকে দায়িত্বসচেতন করে রাখতে সক্ষম হলেন। সকলে সম্বিত ফিরে পেলেন। সুকঠিন বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই রইলো না।
উম্মতজননীগণও তাঁদের বিরহবিধুরতাপিষ্ঠ অস্তিত্বকে পরিধান করালেন ধৈর্যের পোশাক। বুঝলেন, শেষ ডাক আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁদেরকে এই পরিচ্ছদেই সতত আবৃত থাকতে হবে। যাত্রার সময় তো সুনির্ধারিত। সে অমোঘ নিয়মের এতোটুকুও অগ্র-পশ্চাৎ হয় না।
তাঁদের অপেক্ষার অবসান হতে থাকে। ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকেন মমতাময়ী, মর্যাদাময়ী ও মহাপুণ্যবতী মাতা মহোদয়াগণ। প্রথমে জননী যয়নাব বিনতে জাহাশ। তারপর একে একে অন্যরা।
জননী উম্মে হাবীবাকে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়। তাঁর সৎ ভাই আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) তখন মুসলিম জাহানের খলিফা। হিজরী ৪৪ সন। উম্মে হাবীবা বুঝতে পারলেন, মহামিলনের সময় সন্নিকটবর্তী। পেছনে দৃষ্টিপাত করলেন ক্ষণকালের জন্য। ৩৬ বৎসর বয়সে বক্ষলগড়বা হয়েছিলেন মহাসৃষ্টির সুন্দরতম পুরুষের। এখন বয়স ৭৩।
তিনি হজরত আয়েশা এবং হজরত উম্মে সালমাকে শয্যাপাশে ডাকলেন। তাঁরা এলেন। অন্তিম পথযাত্রী সুন্দর সপত্নীটির দিকে তাকালেন। হজরত উম্মে হাবীবা বললেন, তোমাদের সঙ্গে আমি তো সেরকম আচরণই করেছি, যেরকম করেছো তোমরা। সপত্নীদের মধ্যে এরকম তো হয়েই যায়। এখন আমার চলে যাবার সময়। তোমরা আমার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করো। তাঁরা দোয়া করলেন, জননী উম্মে হাবীবা অত্যন্তআনন্দিত হলেন। বললেন, তোমরা আমাকে খুশী করেছো। আল্লাহপাক তোমাদেরকে খুশী করুন।
চলে গেলেন শেষ উম্মতের মমতাময়ী মা-জননী। গোসল শেষে জানাযা প্রস্তুত করা হলো। জানাযার নামাজ পড়ালেন মদীনার প্রশাসক মারওয়ান। তাঁকে কবরে নামালেন তাঁর ভাই ও বোনের ছেলেরা।
অনেক পরের ঘটনা। ইমাম যয়নাল আবেদীন একবার মদীনায় এলেন। তাঁদের বাড়ী ছিলো বহুদিন ধরে পরিত্যক্ত। তিনি বলেন, কী মনে করে আমি আমাদের বাড়ির একটা কোণ খনন করলাম। পেলাম একটি শিলালিপি। তাতে লেখা— এটা রামলা বিনতে সাখরের কবর।
সাখর ছিলো তাঁর পিতা আবু সুফিয়ানের আসল নাম। আর তার আসল নাম রামলা। সুতরাং ইমাম যয়নাল আবেদীনের এই বিবরণটির মাধ্যমে জানা যায়, জননী উম্মে হাবীবাকে সমাহিত করা হয়েছিলো তাঁর পিতামহ হজরত আলী (রাঃ) এর গৃহাঙ্গণে।

Top