হজরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রাঃ)
🖋মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ
----------------------------------------------------
 
এখানকার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় খুব কম। বলতে গেলে হয়ই না। নির্বাক, নীল, সুবিশাল ও সুবিস্তৃত মহাকাশ তাই সারাক্ষণ সুপ্রকাশিত। দিবস সূর্যকরোজ্জ্বল। তপ্ত, তীব্র ও তীক্ষ্ণ। আর রাতে কোটি কোটি নক্ষত্রের কোমল আলোয় সিক্ত, স্নিগ্ধ ও শীতল। এখানে প্রকৃতি তার রুক্ষ ও কোমল দুই রূপই দেখায় স্পষ্ট করে। নিয়মিত আসে যায় নিশীথ, উষাশেষের দিবস, সায়াহ্ন। জেগে থাকে মহাকাল। বয়ে যায় মহানগরী মক্কার উপর দিয়ে।
মক্কা। মক্কাশরীফ। বিশ্বাসীগণের বিশ্বতীর্থ। এখানেই রয়েছে পৃথিবীর প্রথম উপাসনালয়। কাবাশরীফ। নির্মাণ করেছিলেন প্রথম মানুষ, প্রথম নবী হজরত আদম (আঃ)। বেহেশত থেকে নেমে এসে তিনি বসবাস করতেন ভারতে। সেখান থেকে মক্কার আরাফা প্রান্তরে উপস্থিত হয়ে জাবালে রহমত পাহাড়ের পাদদেশে সাক্ষাত পেয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তমার। তাঁদের ওই মিলনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই সকল হজ্বযাত্রীকে আরাফা প্রান্তরে উপস্থিত হতে হয়।
হজরত আদমই কাবাগৃহের প্রথম নির্মাতা। প্রথম জিয়ারতকারী ও হজ্বযাত্রী। বহু বছর ধরে তাঁর বংশধরগণ জারী রাখেন হজ্ব ও জিয়ারতের বিধান। তারপর এক সময় শয়তানের প্ররো নায় তারা হয়ে যায় মুশরিক, মূর্তিপূজক। তাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করতে আবির্ভূত হন মহানবী নূহ (আঃ)। প্রায় নয়শত বছর অক্লান্ত চেষ্টা সাধনার পর তাঁর বিশ্বাসী অনু রগণে5tর সংখ্যা দাঁড়ায় চল্লিশে। অংশীবাদের অপবিত্রতা থেকে পৃথিবীকে পবিত্র করবার জন্য তিনি প্রার্থনা জানান। শুরু হয় সর্বগ্রাসী ও ভয়াবহ মহাপ্লাবন। পৃথিবীর সকল জনপদ নিমজ্জিত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। রক্ষা পান কেবল তিনি এবং তাঁর নৌকায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিশ্বাসী ও বিশ্বাসবতীগণ।
        
বিলুপ্ত হয়ে যায় কাবাগৃহের নিশানা। বয়ে চলে সময়। অতীতের উদরে বিলীন হয়ে যায় শতাব্দী। শতাব্দীর পর শতাব্দী। একসময় বাবেল নগরে আবির্ভূত হন আল্লাহর বন্ধু (খলিল) হজরত ইব্রাহীম (আঃ)। তিনি তাঁর প্রিয়তমা দ্বিতীয়া স্ত্রীকে নির্বাসন দেন এখানে। তখন এস্থান ছিলো জনমানবহীন— শুধুই শূন্যতা।
ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতেম ও বায়হাকী বলেছেন, মহাপ্লাবনের সময় আল্লাহ কাবাঘরটি উঠিয়ে নিয়েছিলেন। পরে হজরত ইব্রাহীম তা পুনঃনির্মাণ করতে চাইলে আল্লাহ্পাক তাঁকে কাবার স্থান দেখিয়ে দেন এভাবে— হিজুজ নামে এক পশু পাঠানো হলো। সেই পশুটি মাটি উঠিয়ে কাবা শরীফের ভিত্তি চিহ্নিত করে দিলো। ওই ভিত্তির উপরেই হজরত ইব্রাহীম কাবা শরীফ পুনঃনির্মাণ করলেন। হিজুজ পশু, কিন্তু তার পাখির মতো দুটি ডানা ছিলো। আর আকৃতি ছিলো সরীসৃপের মতো।
নির্মাণকর্ম সমাপনের পর পিতাপুত্রের প্রার্থনার কথা পবিত্র বাণীসম্ভারে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে— ‘যখন ইব্রাহীম ও ইসমাইল কাবাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিলো তখন তারা বলেছিলো, হে আমাদের প্রভুপালক! আমাদের এই কাজ গ্রহণ করো। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাতা। হে আমাদের প্রভুপালক! আমাদের উভয়কে একান্ত অনুগত করো এবং আমাদের বংশধর হতে তোমার অনুগত এক উন্নত কর। আমাদেরকে ইবাদতের নিয়মকানুন দেখিয়ে দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাপরবশ হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু। হে আমাদের প্রভুপালনকর্তা! তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রসুল প্রেরণ কর, যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকটে আবৃত্তি করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’
যে মহান রসুলের জন্য ছিলো হজরত ইব্রাহীমের এই আর্তি, সেই রসুল অবশেষে এসেছিলেন। তিনিই রহমাতুলিল্ল আলামীন। হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি এরশাদ করেছেন, আদম যখন পানি ও মাটিতে তখনও আমি নবী। আমি নবী ইব্রাহীমের প্রার্থনা, রসুল ঈসার ভবিষ্যদ্বাণী এবং আমার মাননীয়া মায়ের স্বপ্নফল। আমার জন্মের সময় আমার মা দেখেছিলেন একটি দিগন্তবিস্তৃত নূর। তিনি বলেছেন, আমার মধ্যথেকে এমন একটি জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে যার আলোকচ্ছটায় পরিদৃশ্যমান হচ্ছে সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ।
 
সেই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিশ্রুত প্রত্যাদেশবাহকের মহাআবির্ভাবের সময় সমাগত হলো। অংশীবাদের অমারজনীর শেষ প্রহর। প্রত্যুষ প্রত্যাসন্ন। আলোর অপেক্ষায় অধীর মহামানবতা, মহানিসর্গ ও মহাইতিহাস।
পূর্বাহ্নেই প্রস্তুত হয়ে রইলেন তাঁর সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান জীবনসঙ্গিনী, প্রাণের প্রিয়তমা পবিত্রতার প্রতিরূপিনী মহাসম্মানিতা উম্মতজননী হজরত খাদিজা। জন্মগ্রহণ করলেন তাঁর পিতা খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদের গৃহে। তিনি ছিলেন মক্কার কুরায়েশ বংশের বনী আসাদ শাখার সন্তান। পিতৃবংশের ঊর্ধ্বপুরুষ কুসাই পর্যন্ত গিয়ে তাঁর বংশপরম্পরা মিলিত হয়েছে রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বংশপরম্পরার সঙ্গে এভাবে— খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উয্যা ইবনে কুসাই।
পিতা-মাতার স্নেহচ্ছায়ায় এবং স্বজন-পরিজনের আদরযত্নে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠলেন হজরত খাদিজা। তাঁর মাতা ফাতেমা বিনতে জায়েদও ছিলেন কুরায়েশ কুলোদ্ভবা। সকলেই লক্ষ্য করলো, খাদিজা সাধারণ মেয়েদের মতো নন। তাঁর চাল-চালন, কথা-অভিব্যক্তি, ধারণা-ভাবনা, স্বভাব-চরিত্র সবকিছুই শুদ্ধ, সুন্দর, শুভ্র ও পবিত্র। তাই সকলে তাঁকে ডাকতে লাগলো ‘তাহেরা’ বলে। তাহেরা অর্থ পবিত্রা।
বাদশাহ্ আবরাহা যখন কাবা শরীফ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তার বিশাল হস্তি বাহিনী নিয়ে মক্কার সন্নিকটে উপস্থিত হলো, তখন তাঁর বয়স ১৫ বছর। আবরাহার ভয়াবহ পরিণতির কথা পবিত্র বাণীসম্ভারে বলা হয়েছে এভাবে— ‘তুমি কি দেখনি তোমার প্রভুপালক হস্তি অধিপতিদের প্রতি কী করেছিলেন। তিনি কি তাদের কৌশল ব্যর্থ করে দেননি? তাদের বিরুদ্ধে তিনি ঝাঁকে ঝাঁকে পক্ষী প্রেরণ করেন, যারা তাদের উপর প্রস্তর কংকর নিক্ষেপ করে। অতঃপর তিনি তাদেরকে ভক্ষিত তৃণসদৃশ করেন।’
হাকীম ইবনে হিযাম বলেন, আমার ফুফু খাদিজা আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। হস্তিবছরে আমার বয়স হয়েছিলো ১৩ বছর।
খুওয়াইলিদ ছিলেন সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত। তিনি মক্কায় এসে তাঁর চাচাতো ভাইয়ের হালীফ ( চুক্তিবদ্ধ) হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। বিবাহ করেন ফাতেমা বিনতে জায়েদকে। ফিজার যুদ্ধে তিনি ছিলেন তাঁর গোত্রের অধিনায়ক। তাঁর সংসারজীবন ছিলো সফল ও বর্ণাঢ্য। বহু সন্তানের জনক ছিলেন তিনি। প্রথম পুত্র হিযাম—    এই হিযামের পুত্র ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী হাকীম। মূর্খতার যুগে মক্কার দারুল নাদ্ওয়ার পরিচালক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয় সন্তান খাদিজা। তৃতীয় সন্তান আওয়াম ছিলেন স্বনামধন্য সাহাবী হজরত যোবায়েরের পিতা। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ফুফু এবং হজরত হামযা (রাঃ) এর বোন হজরত সাফিয়্যা বিনতে আবদুল মুত্তালিব ছিলেন আওয়ামের স্ত্রী, অর্থাৎ হজরত যোবায়েরের মা হজরত খাদিজা (রাঃ) এর ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। চতুর্থ সন্তান হালা। তিনি ছিলেন রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কন্যা হজরত যয়নাবের শ্বাশুরি। অর্থাৎ আবুল আস ইবনে রবীর মা। আর আবুল আস ছিলেন রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বড় জামাই। পঞ্চম সন্তান রুকাইয়া। খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ বালাজুরী লিখেছেন, তাঁর আরো দু’জন কন্যা সন্তান ছিলো— খালেদা ও রাকীকা। খালেদার বিবাহ হয় ইলাজ ইবনে আবী সালমার সঙ্গে। আর রাকীকার পাণিগ্রহণ করেন আবদুল্লাহ্ ইবনে বিজাদ। উল্লেখ্য, হজরত খাদিজার ভাই বোনদের মধ্যে কেবল হালা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সৌভাগ্যশালিনী হয়েছিলেন।
 
খাদিজা (রাঃ) যৌবনবতী হলেন। পিতা ও অন্যান্য অভিভাবকগণ তাঁকে পাত্রস্থ করবার জন্য নিজেদের মধ্যে আলাপ আলো না শুরু করে দিলেন। পুতঃপবিত্র স্বভাবসম্পন্না রূপবতী খাদিজা (রাঃ) এর পাণিপ্রার্থী ছিলো অনেকেই। কিন্তু অভিভাবকগণ তাদের কাউকে তেমন উপযুক্ত মনে করলেন না। পছন্দ করলেন কেবল তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলকে। কারণ তিনি ছিলেন বিশুদ্ধিচিত্ত, ধর্মপরায়ণ। ইঞ্জিল ও তওরাত কিতাবে ছিলো তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। বিবাহ নিয়ে পাত্রপক্ষ ও কন্যাপক্ষ উভয়পক্ষের সাগ্রহ মতবিনিময় চললো কিছুকাল ধরে। তারপর কী এক অজ্ঞাত কারণে সে বিয়ে আর হলো না। অভিভাবকগণ শেষে তাঁর বিবাহ দিলেন আবু হালা হিন্দা ইবনে সুরারা আত্তামিমির সঙ্গে।
হজরত খাদিজা সংসার জীবনে প্রবেশ করলেন। একসময় মাতা হলেন দুই সন্তানের— এক ছেলে ও এক মেয়ে। নাম হিন্দা ও হালা। শিশু বয়সেই ইন্তেকাল করেন হালা। আর হিন্দা বেঁচে ছিলেন বহুদিন। ইসলাম ধর্ম প্রচারের শুরুতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। লাভ করেছিলেন সম্মানিত সাহাবীর মর্যাদা। মহানবী মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহাতিরোধানের পরেও বেঁচে ছিলেন তিনি। শেষে শহীদ হয়েছিলেন জামাল যুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ হজরত আলী (রাঃ) এর পক্ষে লড়াই করতে গিয়ে।
হজরত খাদিজা (রাঃ) এর সংসার ভেঙে গেলো অল্প কয়েক বছরের মধ্যে। বিধবা হলেন তিনি। বৈধব্যের বিষণ্নতায় ম্রিয়মাণ হয়ে পড়লেন। ভাগ্যের সিদ্ধান্তকে মেনে নিলেন নীরবে। এভাবে তাঁর জীবনের অভিঘাতসমূহকে বেষ্টন করে বয়েচললো সময়। দিবস-রজনী। রজনী-দিবস।
এভাবেই এগিয়ে চললো জীবন। এক সময় অশান্ত শোক-দুঃখ মিলিয়ে গেলো দূরের স্মৃতিময় অতীতে। জীবনধর্মের নিয়মে ফিরে এলো স্বাভাবিকতা। হজরত খাদিজা তখনো যৌবনবতী। তদুপরি বিদুষী, সতী-সাধ্বী, বিত্তবান ব্যবসায়ীর কন্যা। পুনঃবিবাহের প্রস্তাব আসতে লাগলো একে একে। হজরত খাদিজা সবগুলোই প্রত্যাখ্যান করলেন। শেষে কী মনে করে সম্মতি দান করলেন বুদ্ধিদীপ্ত ও বিচক্ষণ আতিক ইবনে আবিদের প্রস্তাবে। যথাসময়ে শুভবিবাহ সম্পন্ন হলো। কিন্তু তাঁর এ সংসারও ভেঙে গেলো অল্পকিছুদিনের মধ্যে। এক কন্যা সন্তান রেখে চিরতরে চলে গেলেন আতিক। কন্যাটির নাম হিন্দা।
এরপর আরো বিবাহের প্রস্তাব পেলেন তিনি। কিন্তু কোনো প্রস্তাবে সাড়া দিলেন না। সংসারের প্রতি হয়ে পড়লেন অনাসক্ত। প্রবীণা রমণীদের মতো কেবল সারাক্ষণ ধর্মভাবে নিমজ্জিত রাখতে চাইলেন নিজেকে।
খুওয়াইলিদ তখন বৃদ্ধ। তবুও ব্যবসা বাণিজ্য নিজেকেই দেখতে হয়। আগে তিনি সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে সহজে সম্পন্ন করতে পারতেন। কিন্তু এখন বয়সের ভার বহন করতে হয়। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুভার ক্লেশকর মনে হতে থাকে। পুত্র সন্তান জীবিত নেই। দ্বিতীয় পুত্র আওয়ামও অনেক আগেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। খুওয়াইলিদ তাই তাঁর বিশাল বাণিজ্যের বোঝা বিদুষী ও বুদ্ধিমতী কন্যা খাদিজা (রাঃ) এর স্কন্ধে অর্পণ করলেন। তিনি আগেও ছিলেন তাঁর পিতার বাণিজ্যসহকারী। এবার হলেন সর্বেসর্বা। পিতার উপরোধ তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না।
তীক্ষ্ণ ধীসম্পন্ন ছিলেন তিনি। কীভাবে বাণিজ্য ব্যবস্থাপনাকে সুনিয়ন্ত্রিত ও সচল করতে হয়, তা তাঁর অজানা ছিলো না। বাল্যবেলা থেকেই তিনি তাঁর পিতার বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা ও কর্মচারী পরিচালনার নিয়মনীতি তীক্ষ্ণকম্বলাবৃত পর্যবেক্ষণ করে আসছিলেন। তাই সবকিছু সাহসিকতা ও শৃঙ্খলার সাথে সম্পন্ন করতে গিয়ে বিব্রত হলেন না মোটেও। ব্যবসা-বাণিজ্য উত্তরোত্তর প্রসারিত হতে লাগলো। তাঁর সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও সদয় ব্যবহার দেখে বাণিজ্যকর্মীরাও প্রীত ও তুষ্ট হলো খুব। তখনকার প্রধান দু’টি বাণিজ্যকেন্দ্র ছিলো ইয়েমেন ও সিরিয়া। উভয়স্থানে তাঁর বাণিজ্য চলতে লাগলো মহাআড়ম্বরে। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়ালো যে, তিনি একা যেনো আর পারছিলেন না। প্রয়োজনবোধ করলেন এমন এক সক্রিয় পুরুষের, যার উপরে তিনি সকল দায়ভার অর্পণ করে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন। সেরকম সক্রিয়, সজ্জন ও বিশ্বস্ত কে আছেন? কোথায় আছেন?
কুরায়েশ দলপতি হজরত আবু তালেবও মক্কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। বাণিজ্য ব্যপদেশে তিনি কখনো কখনো সিরিয়ায় যাওয়া আসা করতেন। সঙ্গে নিতেন একান্ত আদরের ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে। তাঁর জন্মের পূর্বে পিতা আবদুল্লাহ্ পরপারে চলে যান। মা আমেনা তাঁকে প্রতিপালন করেন। জুরহাম গোত্রের বিবি হালিমাকে তাঁর দুধমাতা নিযুক্ত করেন। এভাবে তাঁর সুন্দর ও শুদ্ধ ভাষাভঙ্গিমা ও বাগ্মিতা অর্জিত হয় অতি কৈশোরেই। কারণ সবেচেয়ে বিশুদ্ধ আরবী ভাষার চর্চা ছিলো ওই জুরহাম গোত্রেই।
পিতৃহারা মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরপর তাঁর মাতাকেও হারালেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র পাঁচ বৎসর। পিতামহ আবদুল মুত্তালিব তখন বৃদ্ধ। পরিবার পরিজনের মধ্যে তিনি সবেচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন তাঁর এই পিতৃহারা পৌত্রকে। এরপর মাতৃহারা হওয়াতে তাঁর প্রতি আবদুল মুত্তালিবের স্নেহ-মমতা আরো অধিক উদ্বেল হয়ে উঠলো। এবার তিনিই নিলেন তাঁর লালনপালনের ভার।
 
কিন্তু না। তিনিও বেশীদিন প্রিয় পৌত্রকে স্নেহ-মমতার আওতায় রাখতে পারলেন না। পরপারের ডাক এসে পড়লো। যাবার সময় হলে সকলেই যায়।যেতে হয়। তিনিও চলে গেলেন।
এবার এগিয়ে এলেন তাঁর প্রিয় পিতৃব্য আবু তালেব। মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন কিশোর। এ বয়সের কাউকে লালনপালন করতে বেগ পেতে হয় না। শিথিল পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানই কিশোরদের প্রতিপালনের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আবু তালেব তা করেন না। তীব্র তীক্ষ্ণ ও প্রগাঢ় মমতার মধ্যে সারাক্ষণ নিমজ্জিত রাখেন তাঁর এই প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্রকে।
ব্যবসায়ী তিনি। কিন্তু হজরত খাদিজার মতো অতবড় ব্যবসায়ী নন। তিনি তাঁর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রকে ব্যবসায়ী হিসেবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা আর হলো না। হঠাৎ উপস্থিত হলো দুর্ভিক্ষ। অল্প মূলধনের ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়লেন। বাণিজ্যযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনে টান পড়লো তাঁরও। বাধ্য হয়ে তিনি বললেন, মোহাম্মদ! এবার তো কোনো কর্মগ্রহণ করতে হয়। খাদিজার কাছে কর্মগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রিয় পিতৃব্যের ইঙ্গিত বুঝতে পারলেন। কিন্তু উপযাচক হয়ে কর্মের আবেদন জানাতে দ্বিধান্বিত হলেন।
সুব্যবস্থা হলো আল্লাহপাকের পক্ষ থেকেই। তিনি তাঁর হাবীব (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে উপযা কের ভূমিকায় দেখতে চাইলেন না মনে হয়। মাঝামাঝি ব্যবস্থা হয়ে গেলো একটা। হজরত আবু তালেবের বাড়িতে উপস্থিত হলেন তাঁর বোন আতিকা। ভাইকে চিন্তিত দেখে তিনি তার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। হজরত আবু তালেব বললেন, সে কথা পরে বলবো। আগে তোমার আগমনের কারণটা খুলে বলো। আতিকা বললেন, আমি তো মোহাম্মদের বিবাহের বিষয়ে আলাপ করতে এসেছিলাম। এবার তো সে পঁচিশে পড়লো। আর বিলম্ব করা কি ঠিক? হজরত আবু তালেব বললেন, না, তা ঠিক নয়। কিন্তু তার উপার্জনের একটা ব্যবস্থা হওয়া তো দরকার।
ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো নয়। আতিকা পিতৃমাতৃহীন মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তিনি ভেবে দেখলেন, খাদিজার বাণিজ্যবহরই সবেচেয়ে বড়। আর চলো­কমুখে একথাও হয়তো তিনি জানতে পেরেছিলেন, নির্ভরযোগ্য একজন বাণিজ্যব্যবস্থাপকের জন্য তিনিও অপেক্ষা করছেন। অনুসন্ধানে আছেন।
খাদিজাগৃহে উপস্থিত হলেন তিনি। হজরত খাদিজা তাঁকে অতি সমাদরে গ্রহণ করলেন। কুশল বিনিময়ের পর মূল বিষয়ে আলো না শুরু হলো। হজরত খাদিজা বললেন, আমিতো ওই যুবকের অনেক সুনাম শুনেছি। চলো­কে তাকে আল-আমিন বলে। আপনার প্রস্তাব আমি সাগ্রহে গ্রহণ করলাম। আগামীকাল আমাদের বাণিজ্যবহর সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। কাফেলার অধিপতি হিসেবে আপনি তাঁকে আজই তাঁর দায়িত্ব বুঝে নিতে বলুন। তাঁকে বেতন দেওয়া হবে অন্যদের চেয়ে দ্বিগুণ।
সেদিনই কাফেলার কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার বুঝে নিলেন তিনি। সাক্ষাত করলেন খাদিজা তাহেরার সঙ্গে। প্রথম সন্দর্শনেই পরস্পরের প্রতি মুগ্ধ ও অভিভূত হলো শুভ্রশুদ্ধ দুটি হৃদয়। আল-আমীন ও তাহেরা। ভিতরে ভিতরে সম্ভবত হজরত খাদিজাই চঞ্চলা হলেন অধিক। কারণটি অসাধারণ। তিনি জানতেন, সর্বশেষ নবী আবির্ভূত হবেন এই মক্কায়। ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে একথাও জানতে পেরেছিলেন যে, তওরাত গ্রন্থে তাঁর পবিত্র অবয়ব ও স্বভাববৈশিষ্ট্যের কথা লিপিবদ্ধ আছে। তিনিই কি মোহাম্মদ! জ্যোতির ঝড় যেনো বয়ে যাচ্ছে বুকের ভিতরে। কিন্তু বাইরে তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, দায়িত্বসচেতন।
 
পরদিন শুভযাত্রা। যাত্রার কালে হজরত খাদিজা তাঁর বিশিষ্ট পরিচারককে উপদেশ দিলেন এভাবে— মনে রেখো মায়সারা! এ যাত্রায় তোমাদের কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে যাচ্ছেন মান্যবর আবু তালেবের প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ। তোমাকে পাঠানো হচ্ছে তাঁর খাস সেবক হিশেবে। তাঁর সেবা-শুশ্রূষায় কোনো ত্রুটি কর না। তাঁকে কখনো কোথাও একা থাকতে দিয়ো না।
মান্যবর আবু তালেব হৃদয়ে ধারণ করে আছেন স্বস্তি ও শোক দুটোই। প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের সম্মানজনক কর্মসংস্থান হওয়াতে তিনি খুশী। খুশী খাদিজা তাহেরার প্রতিও। খাদিজাও যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেছেন তাঁর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রতি। কর্মগ্রহণকারী হিসেবে তাঁকে দেখেননি। দেখেছেন আপনতম জন হিসেবে। কিন্তু প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের বিচ্ছেদ তাঁর হৃদয়কে যাতনা দিচ্ছে। পরদিন তাঁকে বিদায় জানাতে তিনি নগর তোরণ পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। আতিকাও তাঁর সঙ্গী হলেন। সঙ্গী হলো হাশেমী বংশের আরো অনেকে। সকলের চোখ অশ্রুসজল। আতিকা কেঁদে ফেললেন। চোখ মুছলেন মান্যবর আবু তালেবও। কেউ কেউ অভিমানাহত কন্ঠে বললেন, বাপ মা বেঁচে থাকলে কি তাঁরা মোহাম্মদকে এভাবে অন্যের কর্মচারী হতে দিতেন।
যে দিকে দৃষ্টি যায়, ধু ধু মরুভূমি। দিগন্তের সকল সীমানা অসীম আকাশকে স্পর্শ করে আছে। মরুভূমির বুক চিরে পথ চলে গেছে দূরে। বহুদূরে। কখনো পথপাশে ছোট বড় পাথুরে পাহাড়। কখনো অল্পস্বল্প কাঁটাগাছ— বাবলা বৃক্ষ।
এগিয়ে চলেছে মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বাণিজ্য কাফেলা। সহযাত্রী হিসেবে যথাদায়িত্ব পালন করছে উষ্ট্রচালক কর্ম চারীবৃন্দ এবং ভৃত্য মায়সারা। দিনের অতি উত্তপ্ততা এবং রাতের অবাধ স্নিগ্ধতা পেরিয়ে মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় যাত্রাবিরতি ও বিশ্রাসহ চলেছে বাণিজ্যের বরকতময় বহর। যেতে হবে সিরিয়ার বসরা বন্দরে। পথিমধ্যে একস্থানে যাত্রাবিরতি দিতে হলো। সে স্থানে ছিলো খ্রিস্টানদের একটি উপাসনালয় গীর্জা। গীর্জার অধ্যক্ষের নাম নাস্তুরা। তিনি দূর থেকে লক্ষ্য করলেন উট থেকে নেমে মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উপবেশন করলেন একটি পত্রপুষ্পহীন বৃক্ষের নিচে । সঙ্গে সঙ্গে সবুজ পাতায় ভরে গেলো বৃক্ষটি। নাস্তুরা বিস্মিত ও পুলকিত হলেন। মায়সারা ছিলো তাঁর পূর্বপরিচিত। তিনি তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, বৃক্ষচ্ছায়ায় উপবিষ্ট চলো­কটি কে? মায়সারা বললেন, মক্কার হারামবাসী কুরায়েশ কুলোদ্ভব এক ব্যক্তি। নাস্তুরা বললেন, নবী ছাড়া অন্য কেউ ওই বৃক্ষতলে উপবেশন করে না। নবী ঈসা ওখানে বসেছিলেন। আর বসলেন ইনি। সুতরাং ইনি যে নবী, সে বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নেই। নাস্তুরা আরো জানতে চাইলেন, তাঁর চোখ দুটি কি লালাভ? মায়সারা বললেন, হ্যাঁ। ওই লাল আভা কখনো দূর হয় না। নাস্তুরা বললেন, তিনি নবী। তিনিই সর্বশেষ নবী।
বিশ্রাম ও বিরতি শেষে কাফেলা পুনরায় চলতে শুরু করলো। গন্তব্যস্থান খুব বেশী দূরে নয়। সেদিনই বসরা বন্দরে উপস্থিত হলো কাফেলা। কেনা-বেচা শুরু হলো সেদিন থেকেই। পণ্য বিক্রয়ের সময় একচলো­কের সঙ্গে হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কিছুটা বাদানুবাদ হলো।চলো­কটি বললো, আপনি লাত ও উয্যার নামে শপথ করে বলুন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি ওগুলোর নামে কখনোই শপথ করি না। ওগুলোর ধ্বংস কামনা করি। চলো­কটি আশ্চর্য ও ভীত হলো। সে মায়সারাকে লক্ষ্য করে বললো, আল্লাহরকসম! ইনি অবশ্যই নবী।
কেনা-বেচা উভয় কাজেই প্রভূত বরকত-রহমত প্রত্যক্ষ করা গেলো। সবকিছুর মধ্যেই পরিলক্ষিত হতে লাগলো প্রফুল্লতা, প্রসন্নতা ও প্রশান্তি। এবার ফেরার পালা। সকল বাণিজ্যবহর এবার পথ ধরলো মক্কার।
মায়সারা তাঁর মনিবের সেবাযত্নে কোনো ত্রুটি করেন না। তাঁর পর্যবেক্ষণ যোগ্যতাও ছিলো সুতীক্ষ্ণ। বিভিন্ন জনের মন্তব্য তাঁর হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিলো। তিনি যে একজন অসাধারণ পুরুষের পবিত্র সান্নিধ্য লাভ করে সৌভাগ্যশালী হয়েছেন, সে সম্পর্কে তিনি ছিলেন নিঃসন্দিগ্ধ। তিনি সবকিছু নিখুঁত দৃষ্টিতে দেখেন। দেখেন আর অবাক হন। মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতি হন অধিক, অধিকতর মুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ। কখনো দেখেন প্রখর রৌদ্রকিরণের সময় আল্লাহরনবীকে ছায়া দিচ্ছে মেঘমালা। কখনো আবার ছায়া দিচ্ছে দু’জন ফেরেশতা।
কাফেলা এসে পৌঁছলো জাহরান নামক স্থানে। সেদিনের মতো যাত্রাবিরতি দেওয়া হলো। রাতে বিশ্রামের সময় মায়সারা বললেন, মান্যবর মোহাম্মদ! এখান থেকে মক্কা তিন দিনের পথ মাত্র। আমি সবিনয়ে প্রস্তাব করছি, আপনি আগে মক্কায় উপস্থিত হন। মালিকান খাদিজাকে সফল বাণিজ্যের কথা জানান। আমাদের জন্য ভাববেন না। আমরা একদিন অথবা অর্ধদিন পরে সহজেই চলে আসতে পারবো।
হজরত খাদিজা পথ চেয়ে থাকেন। প্রতিদিন দুপুরের পর ঘরের ছাদে উঠে যান। যে পথ সিরিয়ার দিক থেকে এসেছে, সে দিকেই তাকিয়ে থাকেন সারাক্ষণ। রাত নামবার আগে নেমে আসেন। বাণিজ্যের লাভচলো­কসানের কথা তাঁর তেমন মনেই হয় না। মনে পড়ে কেবল সৌম্য-শান্ত-শুভ্র পুরুষ মোহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কথা। আল্লাহ্তায়ালা হৃদয়ের আবর্তন-বিবর্তনকারী। তিনি তাঁর হৃদয়ের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দিয়েছেন ওই মহাপুরুষের দিকে। তিনি ভালোভাবেই পরীক্ষা করে দেখেছেন, এ আকর্ষণ প্রবৃত্তির (নফসের) নয়— হৃদয়ের। তাঁর প্রবৃত্তি তো পবিত্র। তাই তোচলো­কে তাঁকে নাম দিয়েছে তাহেরা। কিন্তু আত্মা তো তাঁর ইচ্ছানুসারে চলে না। পবিত্র সৌন্দর্যের দিকে পবিত্র হৃদয় তো আকর্ষণবোধ করবেই।
দ্বিপ্রহর বিগতপ্রায়। সেদিনও হজরত খাদিজা প্রতীক্ষারতা। হঠাৎ দেখতে পেলেন এক উষ্ট্রারোহী অস্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে আসছে। ক্রমে স্পষ্ট, স্পষ্টতর হচ্ছে। তিনি দেখলেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। দেখলেন, দু’জন ফেরেশতা তাঁকে ছায়াদান করছে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহচরীগণ। তিনি তাদেরকেও দৃশ্যটি দেখালেন। সকলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন।
হজরত খাদিজার মনে পড়ে অনেক আগের এক ঘটনার কথা। মেয়েদের একটি অনুষ্ঠান চলছে। সকলে আনন্দমুখরা। হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলো এক অপরিচিত ব্যক্তি। সে সুউচ্চ কন্ঠে বললো, ওহে মক্কাররমণীকুল! শোনো- অতি শীঘ্র তোমাদের এই মক্কা নগরীতে এক নবী আবির্ভূত হবেন। তাঁর নাম হবে আহমদ। তোমাদের মধ্যে যে পারবে, সে যেনো তাঁর সহধর্মিণী হয়।
হজরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উটটি ছিলো অস্বাভাবিক দ্রুতগতিসম্পন্ন। তাই অনতিবিলম্বে তিনি উপস্থিত হতে সক্ষম হলেন খাদিজা (রাঃ) সকাশে। জানালেন ব্যবসার অভূতপূর্ব সফলতার কথা। হজরত খাদিজা অত্যন্ত প্রীত হলেন। পথবাহক উটটিকে তিনি তৎক্ষণাৎ দান করলেন তাঁকে। আলআমিন উপাধিধারী এই মানুষটি সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে ফিরে এসে তাঁর অন্তরের পবিত্র বিরহযন্ত্রণাকে প্রশমিত করেছেন, এটাই ছিলো তাঁর আনন্দের প্রধান কারণ। ব্যবসার লাভ সে আনন্দের একটি অংশ মাত্র। মূলের কিছু নয়।
পরদিন এসে উপস্থিত হলো পুরো বাণিজ্যবহরটি। মায়সারার মুখমণ্ডল মুগ্ধতা ও প্রফুল্লতায় ভরা। তিনি উচ্ছ্বাসভরে অনর্গল মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে অনেক কিছু বলে গেলেন। ধর্মবেত্তা নাস্ত্তুরার কথা, পণ্যক্রেতার কথা, ফেরেশতাদের এবং মেঘমালার ছায়াদানের কথা—     কোনোকিছুই তাঁর বিবরণবহির্ভূত রইলো না। আরো বললেন, তিনি হচ্ছেন মহানুভবতা, উদারতা, সততা, বিশ্বস্ততা ও সহিষ্ণুতার প্রতীক। তাঁর বরকতময় সাহচর্যে ছিলাম বলে আমাদেরকে কোনো রকম দুর্ভোগে পড়তে হয়নি। মুনাফাও হয়েছে দ্বিগুণ। যে তাঁকে দেখে সেই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়। প্রদর্শন করে সশ্রদ্ধ আনুগত্য।
হজরত খাদিজা নির্বাক হয়ে শুনে গেলেন সবকিছু। মহাপুরুষের স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের পবিত্র বিবরণ যেনো স্থায়ীভাবে জমা হয়ে গেলো তাঁর পবিত্রতাপিয়াসী অন্তরের গভীরতম কেন্দ্রে। কিন্তু বাইরে তিনি তাঁর মনোভাব প্রকাশ করলেন না। সবাইকে বিদায় দিলেন যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে। প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিলেন পরবর্তী যাত্রার জন্য।
যথাসময়ে প্রস্তুত হলো পরবর্তী কাফেলা। এবারও লাভ হলো প্রচুর। এভাবে আরো দুই এক বার চললো সর্বশেষ নবীর হালাল ব্যবসা। তিনি ও তাঁর বাণিজ্য সহকারীরা বিত্তবান হলেন না বটে, কিন্তু ঘুরে গেলো সকলের আর্থিক অনটন।
শেষে হজরত খাদিজা তাঁর হৃদয়ের আর্তিকে গোপন রাখতে পারলেন না। তাঁর বোন হালার সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। তাঁর নৈকট্যভাজনা ও নাফিসাকেও খুলে বললেন সব। নাফিসা বললেন, আপনার অন্তরের অবস্থা কিছুটা হলেও আমি অনুমান করতে পেরেছিলাম। এখন তবে বলুন, কী করতে হবে?
 
মহানবী মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর গৃহে উপস্থিত হয়ে নাফিসা প্রথমে কুশল বিনিময় করলেন। সাধারণ কিছু কথা বিনিময় হলো। মূল প্রসঙ্গের অবতারণা করা হলো অল্পক্ষণ পরেই। নাফিসা বললেন, আপনি তো এখন পূর্ণ যুবক। সংসার শুরু করছেন না কেনো? মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তেমন অর্থ সম্পদ তো আমার নেই। তেমন মেয়ে কোথায় যে, আমার মতো স্বল্পবিত্তকে গ্রহণ করবে?
নাফিসা বললেন, তেমন কেউ যদি থাকে, যে কুরায়েশ বংশের, শুদ্ধ রিত্রিনী, রূপবতী এবং বিত্তশালিনী, তবে আপনি তাঁকে গ্রহণ করতে সম্মত কিনা বলুন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সে কে? নাফিসা বললেন, যদি তিনি হন মাননীয়া খাদিজা? মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সে-ও কি সম্ভব? তিনি তো অগাধ সম্পদের মালিক। আর আমার অবস্থা তো জানোই। নাফিসা বললেন, সে দায়িত্ব আপনি আমার উপর অর্পণ করুন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। নীরবে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন।
 
নাফিসা মহাআনন্দে খাদিজার কাছে গেলেন। হজরত খাদিজা সেদিন তাঁর চাচা আমর বিন আসাদ এবং চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেলকে বিষয়টি জানালেন। তাঁরা একটু বিস্মিত হলেন। কিন্তু খুশী হলেন খুব। তাঁরা ভেবেছিলেন, খাদিজা (রাঃ) ও বয়সে আর সংসারে জড়াবেন না। বিস্ময়ের কারণ ছিলো, তিনি তাঁর মনোভাব বদলেছেন। আর আনন্দের কারণ হচ্ছে, তিনি এমন একজনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছেন, যিনি শুদ্ধ পবিত্র একজন অসাধারণ পুরুষ। আল আমীন।
কথা পৌঁছানো হলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রিয় পিতৃব্য এবং অভিভাবক হজরত আবু তালেবের কাছে। তিনি খুশী হলেন সবেচেয়ে বেশী। আল আমীনের উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী যে কেবল তাহেরাই হতে পারেন, সে সম্পর্কে তিনি যেনো নিঃসংশয় ছিলেন।
শুভবিবাহের দিন তারিখ ধার্য করা হলো। খাদিজা ভবন হলো আলোকমালায় সজ্জিত। নতুন বসন ভূষণে অলংকারে সুসজ্জিতা হলেন তাঁর নিকটাত্মীয়গণ। দাস-দাসীগণও সজ্জিত হলো নতুন পোশাকে। শুরু হলো মেয়েদের নৃত্য-গীত, বিবাহসঙ্গীত।
বর এবং বরপক্ষের চলো­কজন যথাসময়ে বিবাহ আসরে উপস্থিত হলেন। সাদর অভ্যর্থনা শেষে সকলেই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করলেন। হজরত খাদিজার পিতা খুওয়াইলিদ তখন পরলোকগত। তাই কন্যা পক্ষের অভিভাবক হলেন চাচা আমর। তাঁর সহকারী হলেন চাচাতো ভাই ওয়ারাকা।
বিবাহ একটি পবিত্র অনুষ্ঠান। প্রথম মানব-মানবীর বিবাহ হয়েছিলো বেহেশতে। তাঁদের সন্তান-সন্তুতিদের প্রতিটি বিবাহে তাই ওই বেহেশতি বরকত ও নূর বর্ষিত হয়। আর আল আমীন ও তাহেরার বিবাহ অনুষ্ঠান শুধু পবিত্র নয়, মহাপবিত্র। আর তাঁরা তো হবেন ভবিষ্যতের মহামানবতার আত্মিক জনক- জননী। সুতরাং তাঁদের বিবাহ উৎসব মানে অনন্ত নূর ও অসীম বরকতের মিলনমেলা— এতে সন্দেহ মাত্র নেই।
হজরত আবু তালেব মহাপবিত্র এই বিবাহে মোহরানা নির্ধারণ করলেন চারশত দীনার এবং কুড়িটি উষ্ট্রী। ভাষণ দান করলেন দাঁড়িয়ে। বললেন, সকল প্রশংসা-প্রশস্তি, স্তব-স্তুতি কেবলই আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে ইব্রাহীমের বংশধর এবং ঈসমাইলের ফসলের অন্তর্ভূত করেছেন। আমাদেরকে দয়া করে দান করেছেন মহামর্যাদাভূষিত এই শহর এবং মানুষের লক্ষ্যস্থল একটি পবিত্র গৃহ। আমাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করেছেন মানবমণ্ডলীর উপর। মোহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ কল্যাণময়, মহান ও ন্যায়নিষ্ঠ। যে কোনো যুবকের তুলনায় সে শ্রেষ্ঠ। অবশ্য বিত্তবৈভবে সে পশ্চাৎপদ। কিন্তু একথাও মনে রাখতে হবে, পার্থিব সম্পদ তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। ওগুলো ক্ষণস্থায়ী, ছায়া বা স্মৃতির মতো অপসৃয়মাণ।
 
আমি মনে করি মোহাম্মদ ও খাদিজা সারাজীবন পরস্পরের প্রতি গভীর আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে। আর উপস্থিত জনমণ্ডলীর উদ্দেশ্যে বলছি, অভিভাবক হিসেবে মোহরানা পরিশোধের দায় আমার।
এভাবে পঁচিশ বছরের পবিত্রতম এক যুবকের সঙ্গে চচল্লিশ বছরের এক পূত পবিত্রা নারীর শুভবিবাহ সম্পন্ন হলো নির্বিঘ্নে। আনন্দিত ও ধন্য হলো মক্কার মানুষ। নিসর্গ। মহা নিসর্গ।
শুরু হলো ভোজনপর্ব। নিমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ ভোজন শেষে হৃষ্টিচিত্তে ফিরে গেলেন নিজ নিজ আবাসে। হজরত আবু তালেব নবদম্পতিকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। হজরত খাদিজা তাঁর দাস দাসীদের অনেককে মুক্ত করে দিলেন। দরিদ্র জনতার মধ্যে বিতরণ করলেন অনেক অর্থ। সকলেই তুষ্ট হলেন। সুখময় জীবনের জন্য প্রার্থনা করলেন প্রাণভরে।
 
 
হজরত আবু তালেবের গৃহে নববধূর শুভপদার্পণ ঘটলো। কিন্তু কয়েকদিন মাত্র। আবার ফিরে আসতে হলো স্বগৃহে। কারণ তাঁকে চালাতে হয় বিরাট ব্যবসা। সামলাতে হয় বড় সংসার। তাঁর পূর্বস্বামীর সন্তান-সন্তুতিরা তাঁরই গৃহে প্রতিপালিত হচ্ছিলেন। তাদেরকে দেখা শোনা করতে হয়। কর্মচারী, দাস-দাসীদের সংখ্যাও কম নয়। তাদের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। কিন্তু তিনি এখন আর আগের কর্তৃত্ব করতে চান না। চান কেবল মহাপুরুষ    মোহাম্মদের কর্মসহচরী হতে। তাঁরই সেবা-যত্নে ভালোবাসায় পূর্ণনিবেদিতা হতে। তাই করলেন তিনি। বিষয়-সম্পত্তি ব্যবসা এবং সাংসারিক সকল দায়িত্ব মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে বুঝিয়ে দিলেন। স্বামীকেই দিলেন সকল কিছুর ভার। আর নিজে ভার নিলেন কেবল একজনের। মহাকালের মহানতম পুরুষের।
সময় বয়ে চললো তার নিজস্ব নিয়মে নীরবে নিভৃতে। পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা মমতায় সারাক্ষণ নিমজ্জিত থাকেন নবদম্পতি। তাঁরা যেনো সকল অবিশ্বাস, বচসা-কলহ, অনাবশ্যক মান-অভিমানের ঊর্ধ্বে। সকল নবীর মতো মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও বৈভববিমুখ। সুতরাং তিনি কিছুকালের মধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিষয়-সম্পত্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। নিজের সঙ্গে রাখলেন কেবল অপার্থিব ভাবনা-বেদনাকে।
 
হজরত খাদিজাও স্বামীর মনোভাব বুঝতে পারলেন। বুঝতে পারলেন, মহান ভাবনাবেদনার সাথে বিষয় সম্পত্তির সখ্য কোনোকালে হয়নি। এখনো হবে না। তিনি একে একে দরিদ্র মিসকিনদের মধ্যে দান করে দিলেন অলংকার, অর্থবিত্ত সবকিছু। এভাবে মিলিত হলেন— স্বামীর মহান ও পবিত্র ভাবনা-চি ন্তার অগাধ সাগরে। সেখানেই হারিয়ে গেলেন। পেলেন অফুরন্ত শান্তির সাক্ষাত। অপেক্ষাগুলোকে জাগ্রত রাখলেন অনাগত কালের অবিনাশী কোনো আয়োজনের জন্য। তার প্রকৃতি ও স্বরূপ কী— তা তিনি জানেন না। কিন্তু বিশ্বাস করেন, সেদিন নিশ্চয়ই আসবে, যখন তাঁর প্রিয়তম স্বামীর দ্বারা সাধিত হবে মহাকল্যাণ। মহাকাল, মহাবিশ্ব ও মহামানবতা তাঁকে তাদের শিরোভূষণরূপে সাদরে স্বীকার করে নিবে।
জনক-জনকী হন তাঁরা। একে একে লাভ করেন ছয়জন সন্তান-সন্তুতি— দুই পুত্র এবং চার কন্যা। দুই পুত্র— কাসেম ও তৈয়ব। দু’জনেই শিশুকালে পরপারে চলে যান। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে অনেকে আবুল কাসেম বলে ডাকতে থাকেন। দ্বিতীয়পুত্র তৈয়বের আর এক নাম ছিলো তাহের।
মক্কাবাসী সকলেই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে ভালবাসতো। কিন্তু তাঁর সন্তান বিয়োগের পর এই প্রথম কতিপয় ব্যক্তি তাঁর নিন্দা করতে শুরু করলো। তাদের একজনের কথা তাফসীরে মাযহারীতে লিপিবদ্ধ রয়েছে এভাবে— বাগবী লিখেছেন— একবার রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাবাপ্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। তখন সেখানে প্রবেশ করছিলো আস ইবনে ওয়াইল। বনী সাহাম তোরণে দু’জনের দেখা হলো। কিছু বাক্য বিনিময়ও হলো। কাবাপ্রাঙ্গণে বসে ছিলো কুরায়েশদের হোমরা চোমরারা। আস তাদের কাছে পৌঁছলে একজন বললো, কী নিয়ে আলাপ করলে? আস বললো, আলাপ করে আর কী হবে। সে তো নির্বংশ। তখন জননী খাদিজার সন্তান সদ্যবিগত হয়েছেন।
নির্বংশ গালি শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মনোকষ্ট পেলেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। কেননা তিনি তো তাদের মতো নন। অন্যায়ের প্রতিশোধ তিনি অন্যায়ভাবে নিতে পারেন না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তো অশুভ কামনা থেকে পবিত্র।
চার কন্যার মধ্যে তিন কন্যা হচ্ছেন যয়নাব, রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুম। তাঁরা সকলেই ছিলেন রূপসী ও গুণবতী। বিবাহের বয়স হতে না হতেই তাঁদের সকলের বিয়ে হয়ে গেলো।
যয়নাবের বিয়ে হলো হজরত খাদিজার ছোটবোন হালার পুত্র আবুল আসের সঙ্গে। রুকাইয়া ছিলেন আরো অধিক রূপবতী। প্রাপ্তবয়স্কা হওয়ার আগেই তাঁর বিয়ে হলো আবু লাহাবের পুত্র উতবার সঙ্গে। কিছুদিন পরেই উতবার ছোটভাই উতাইবার সঙ্গে বিবাহ হলো উম্মে কুলসুমের। পরে ইসলামবিদ্বেষী আবু লাহাব মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ঘোর শত্রু হয়। সে তখন নবী কন্যাদ্বয়কে তালাক দিতে বলে। উতবা ও উতাইবাও ছিলো তাদের পিতার মতো কট্টর কাফের। তারা পিতার কথা নির্বিবাদে মেনে নেয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর এই দুই কন্যা পরে তাঁর সাথে মদীনায় গিয়ে মিলিত হন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রুকাইয়াকে হজরত ওসমান (রাঃ) এর সঙ্গে বিবাহ দেন। তিনি বেশী দিন বাঁচেননি। হজরত ওসমান ছিলেন রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উম্মে কুলসুমকেও হজরত ওসমানের সঙ্গে বিবাহ দেন। তখন থেকে হজরত ওসমানকে সকলে ডাকতে থাকে জিন্নূরাঈন (দুই নূরের অধিকারী) বলে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নবুয়তের গুরুদায়িত্ব লাভের এক বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর চতুর্থ ও শেষ কন্যা হজরত ফাতেমা যাহরা (রাঃ)। তাঁর বিবাহ হয় পরে, হিজরতভূমি মদীনায়। হজরত আলী (রাঃ) এর সঙ্গে।
নিজগৃহে বসবাস করলেও হজরত খাদিজা তাঁর শ্বশুর গোষ্ঠীরলোকদেরকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। কুশল কামনা করতেন সকলের। কেউ এলে তাঁদেরকে অত্যন্ত সমাদর করেন। আপ্যায়ন করেন যথারীতি। হজরত আলী ইবনে আবু তালেব তখন বালক। তাঁকে নিয়ে আসেন নিজ সংসারে। প্রতিপালন করতে থাকেন পুত্রস্নেহে।
একবার এলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দুধমাতা হালিমা। হজরত খাদিজা তাঁকে আপন শ্বাশুরির মতো সম্মান ও সমাদর জানালেন। সেবা যত্নে করলেন। হালিমা দুগ্ধপুত্র ও পুত্রবধুকে জানালেন, আমাদের ওদিকে চলছে খরা। বৃষ্টি নেই। পানির অভাবে পশুপাখিরা মরে যাচ্ছে। অভাব অনটনে কষ্ট পাচ্ছে মানুষ। হজরত খাদিজা তাঁর স্বামীর মতামত নিয়ে তাঁকে দান করলেন চচল্লিশটি ছাগল ও একটি উট।
আবু লাহাবের ক্রীতদাসী সুওয়ায়বাও ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দুধমাতা। তিনিও মাঝে মাঝে আসতেন। তিনি তাঁকেও ভালোবাসতেন খুব। আদর আপ্যায়ন করতেন হৃদয় দিয়ে। তাঁকে মুক্তিদানের উদ্দেশ্যে তিনি তাঁকে ক্রয় করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আবু লাহাব কিছুতেই তাঁকে বিক্রয় করতে সম্মত হয়নি। হাকীম ইবনে হিযাম ছিলেন তাঁর ভাইয়ের ছেলে। ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়ার বাজারে গমনাগমন করতেন তিনি। একবার কিনে আনলেন কয়েকজন ক্রীতদাসকে। তাদেরকে নিয়ে তিনি হজরত খাদিজার কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ফুফু আম্মা! এদেরকে আমি সিরিয়া থেকে কিনে এনেছি। এদের মধ্যে আপনি যাকে ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারেন। তিনি পছন্দ করলেন যায়েদ নামের এক দাসকে। তাঁকে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে উপস্থিত করালেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যায়েদকে দেখে খুশী হলেন। হজরত খাদিজা বললেন, একে আমি উপহার স্বরূপ দিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো খুশী হলেন। তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দিলেন। গ্রহণ করলেন পালকপুত্র রূপে।
যায়েদ ছিলেন অভিজাত বংশের ছেলে। দাসব্যবসায়ীরা তাঁকে ক্রীতদাসরূপে বিক্রি করে দেয়। পরে তাঁর পিতা তাঁর সন্ধান পান। তাঁকে মুক্ত করতে উপস্থিত হন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সকাশে। কিন্তু যায়েদ তখন পিতার চেয়ে বেশী ভালোবেসে ফেলেছেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে। তাঁকে ছেড়ে যেতে তিনি রাজী হলেন না। থেকে গেলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বিশেষ সেবক হয়ে। এভাবে এক মহাপ্রশান্তির মধ্য দিয়ে সাংসারিক দায়িত্ব পালন করে যান হজরত খাদিজা। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর স্বামী সাধারণ ব্যক্তি নন। তিনি সংসার করেন বটে, কিন্তু সংসারাসক্ত নন। তাঁর সংসার বিশ্বসংসার। বিশ্বের সকল মানুষকে নিয়ে তিনি ভাবেন। ভালোবাসেন দরিদ্র দুস্থ জনতাকে। দুঃখ দূর করতে পছন্দ করেন এতিম ও বিধবাদের। অত্যাচারিত, অবহেলিত যারা, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান।
শৈশবে তিনি সচক্ষে যুদ্ধ দেখেছিলেন। নিস্পৃহ অংশগ্রহণ করেছিলেন ফিজার যুদ্ধে। সেটি ছিলো এক ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। জিঘাংসা ও নিষ্ঠুরতার রক্তপিপাসু রূপ দেখে খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন তিনি। তখন থেকে তিনি কামনা করে আসছিলেন, কীভাবে স্থায়ী শান্তি, সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা যায়।
সেই যুদ্ধ আবার শুরু হতে যাচ্ছিলো। তখন কুরায়েশদের প্রবীণ নেতারা এক সভা আহবান করলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর চাচা হজরত যোবায়েরও ছিলেন তাদের অন্যতম। আর তরুণদের মধ্যে ছিলেন মহানবী মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং। তিনিই প্রস্তাব করলেন প্রতিজ্ঞাপত্র প্রস্তুত করতে হবে। শান্তির পক্ষে স্বাক্ষর করতে হবে সকলকে। নাম হবে ‘হিলফুল ফুজুল’ (শ্রেষ্ঠ প্রতিজ্ঞাপত্র)। 
শর্ত থাকবে এরকম—
১. দুস্থ ও বিপন্ন জনতার সেবা করতে হবে ।
২. দমন করতে হবে অত্যাচারীদেরকে ।
৩. অত্যাচারিতের পক্ষে দাঁড়াতে হবে ।
৪. বিভিন্ন গোত্রেরচলো­কদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সদ্ভাব ।
৫. স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে এতিম ও বিধবাদের ।
৬. সব সময় থাকতে হবে শান্তি ও শৃঙ্খলার অনুকূলে।
হজরত খাদিজা শান্তির সপক্ষে এই ঐতিহাসিক সংঘকে প্রায়শঃই অর্থ সাহায্য করেন। বলাবাহুল্য, এর পর থেকে যুদ্ধ আর সম্প্রসারিত হতে পারেনি।
কুরায়েশেরা কাবাগৃহের সংস্কার করতে চাইলো। দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে ফাটল সৃষ্টি হয়েছিলো। তাই সবিশেষ প্রয়োজন পড়লো পুনঃনির্মাণের । রোম থেকে আনা হলো এক নির্মাণ বিশেষজ্ঞকে। নাম তার ইয়াকুস। সে তার কাজ শুরু করলো। সকলে সহযোগী হলো তার। পাথর এনে জমা করতে লাগলো তার কাছে। নিজেদের পরনের লুঙ্গি খুলে কাঁধের উপরে রেখে তার উপরে রাখলো পাথর। এভাবে উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফ কিংবা কাবাগৃহের কোন কাজ করাকে তারা দূষণীয় মনে করতো না। ইসলামের যুগে এ অপপ্রথাটির মূলোচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখনও এরকম অপকর্ম থেকে দূরে থাকতেন। তাঁকে এরকম করতে দেখে তাঁর চাচা হজরত আব্বাস তাঁকে স্নেহসিক্ত কণ্ঠে কাবার সম্মানে নির্বস্ত্র হতে বললেন। কিন্তু তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লুঙ্গি খোলার উদ্যোগ নিতেই বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। জ্ঞান ফিরে পেতেই লুঙ্গি লুঙ্গি বলে চীৎকার শুরু করলেন। এমন সময় অদৃশ্য থেকে আওয়াজ ভেসে এলো— ‘খম্মির আওরাতাকা’ (সতর ঢাকাকে অপরিহার্য করে নাও)।
নির্মাণ কর্মশেষে আর একটি বিপত্তি দেখা দিলো— হাজারে আসওয়াদ (কৃষ্ণপ্রস্তর) দেয়ালগাত্রে স্থাপন করবে কে? প্রত্যেক গোত্রই দাবীদার হলো। এমতো মহান কর্মে অংশগ্রহণ করে সম্মানিত হতে চাইলো সকলেই। শুরু হলো বাদানুবাদ, বচসা, কলহ। দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ উপস্থিত হবার উপক্রম হলো। এক পর্যায়ে সকলে এই মর্মে একমত হলো যে, আগামী কাল ভোরে সর্বপ্রথম কাবাপ্রাঙ্গণে যাকে দেখা যাবে, তাকেই সালিশ নিযুক্ত করা হবে। পরদিন সকালে সর্বপ্রথম কাবা প্রাঙ্গণে দেখা গেলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে। তাঁকে দেখে সকলে প্রসন্ন হলো। বললো, আল আমীনকেই এবার সিদ্ধান্ত দিতে হবে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর উত্তরীয় খানি মাটিতে বিছিয়ে দিলেন। হাজারে আসওয়াদ নামের পাথরটিকে মাঝখানে রাখলেন। বললেন, প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে এগিয়ে আসুন। চাদরের কিনারা ধরুন। প্রতিনিধিগণ চাদরের কিনারা ধরলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এবারচলুন দেয়ালের দিকে। তারা নির্দেশ পালন করলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন স্বহস্তে পাথরটি নিয়ে যথাস্থানে স্থাপন করলেন।
এই ঘটনা যখন ঘটে, তখন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বয়স হয়েছে পঁয়ত্রিশ বছর। তখন থেকেই তাঁর অভ্যন্তরীণ সংসার আসক্তির প্রভাব বাইরে প্রকাশ পেতে শুরু করলো। সকলে দেখলো, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সংসারসম্পৃক্ত থেকেও পৃথক। সারাক্ষণ, সারাবেলা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যেনো কার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। কিসের জন্য যেনো তাঁর সতত প্রতীক্ষা। আশা ও অপেক্ষা।
গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হন মাঝে মাঝে। আশে পাশের পাহাড়ের পাদদেশে কিংবা চূড়ায় নির্জনে বসে থাকেন। শেষে নির্বাচন করেন নিভৃততম এক ঠিকানা— হেরা পর্বতশৃঙ্গের নির্জনতম একটি গুহা। সেখানে তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে যান। চেষ্টা করেন নিজের সীমানা অতিক্রম করতে। স্পর্শ পেতে অসীমের। অনুভব করতে চান তাঁকে, যিনি দৃশ্যের অতীত। উপস্থিত হতে চান সেখানে, যেখানে সময় ও সীমানা বলে কিছু নেই। এই যে পৃথিবী, মহাপৃথিবী— কার জন্য? কেনো? মানুষ আসছে। চলে যাচ্ছে। কার কাছে যাচ্ছে? নিসর্গ মহানিসর্গ জুড়ে সৃজন-নির্মাণের এই মেলা, খেলা, লীলা-রহস্য কেনো এতো নিখুঁত, নিয়মাবদ্ধ। কে এর নিয়ন্ত্রয়িতা? মহাজীবন কী? মহাসত্য কী?
হেরা পর্বতে তাঁর যাতায়াত চলতেই থাকে। কয়েকদিনের খাদ্য ও পানীয় সঙ্গে নিয়ে যান। সেগুলো ফুরিয়ে গেলে ঘরে ফিরে আসেন। কখনো আবার আসেনও না। তখন পর্বতগুহায় খাদ্য পানীয় নিয়ে উপস্থিত হন হজরত খাদিজা। তিনিও সর্বোতভাবে চান এই মহান পুরুষের সাধনা-আরাধনায় ছেদ না পড়ুক। আর অন্তর দিয়ে কামনা করেন, তিনি যেনো সফল হন। যা চান, তা যেনো পান।
নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার ছয় মাস আগে থেকে নতুন একটি বিষয়ের অবতারণা ঘটলো। প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। শুভ ও সত্য স্বপ্ন। যা দেখতেন, বাস্তবে তা-ই প্রতিফলিত হতো। এভাবে ছয় মাস অতিবাহিত হলো।চরমজান মাস এসে গেলো। ২৭চরমজানের রাত্রি। হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। সহসা গুহামধ্যে প্রকাশিত হলো সুপ্রখর জ্যোতিচ্ছটা। ধ্যানভঙ্গ হলো তাঁর। দেখলেন, সামনেই আবির্ভূত হয়েছেন এক জ্যোতিষ্মান ব্যক্তিত্ব। তিনি বললেন, আমি জিব্রাইল। আল্লাহ্তায়ালা আপনাকে এই শুভ সংবাদটি জানাতে বলেছেন যে, আপনি আল্লাহর রসুল। সুতরাং আপনি জ্বিন ও মানুষকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ কলেমার দাওয়াত দিন। এর পর তিনি বেহেশতি রেশমী বস্ত্রসদৃশ কোনোকিছুতে লিখিত বাণী বের করলেন, যা ছিলো মোতি ও ইয়াকুত দ্বারা কারুকর্মখচিত। বললেন, পাঠ করুন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি তো (অন্যদের মতো) পাঠক নই, (আমি তো অক্ষরের অমুখাপেক্ষী)। জিব্রাইল তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, এবার পড়ুন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি (অসাধারণ, তাই সাধারণদের মতো করে) পাঠ করতে পারি না। জিব্রাইল তাঁকে আবারও বুকে চেপে ধরলেন। অল্পক্ষণ পরেই ছেড়ে দিয়ে বললেন, এবার পড়ুন। অক্ষরের অমুখাপেক্ষী নবী এবার রসুলসুলভ নিয়মে উ”চারণ করে গেলেন প্রথম প্রত্যাদেশ ‘পাঠ করো তোমার প্রভুপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন- সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। পাঠ করো, আর তোমার প্রভুপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন- শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানতো না।
জিব্রাইল এবার মাটিতে পদাঘাত করলেন। মাটি ফুঁড়ে ঝরনা বের হলো। ঝরনার পানি দিয়ে তিনি ওজু করলেন। কুলি করলেন, নাকে পানি দিলেন, মুখমণ্ডল ধৌত করলেন, মস্তক মসেহ্ করলেন। দুই হাত ও দুই পা ধৌত করলেন। এভাবে রসুলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে ওজু করতে বললেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওজু করলেন। এরপর জিব্রাইল এক আঁজলা পানি নিয়ে রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র চেহেরার উপরে ছিটিয়ে দিলেন এবং সামনে অগ্রসর হয়ে দু’রাকাত নামাজ পড়লেন। রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হলেন তাঁর অনুগামী। নামাজ শেষে বললেন, এভাবে ওজু করবেন এবং নামাজ পড়বেন। একথা বলেই তিনি অসীম আকাশের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
নির্বাক নবী সেদিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। প্রত্যাদেশের ভারে তিনি অবসন্ন। সমগ্র সত্তা জুড়ে বয়ে যাচ্ছে আনুরূপ্যবিহীন শিহরণ ও বিস্ময়। অনন্ত জ্যোতির অভিঘাতে কাঁপছে অন্তর বাহির। স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার চেষ্টা করলেন। মনে পড়লো প্রিয়তমা ভার্যার কথা। এখন প্রয়োজন কেবল তাঁর সান্নিধ্য।
সারাটা পথ জুড়ে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পেলেন উদার প্রকৃতির প্রেমময় সম্বর্ধনা। চারিদিক থেকে উচ্চারিত হতে লাগলো, আংতা রসুলাল্লাহ(তুমি আল্লাহর রসুল)। বৃক্ষরাজি ও প্রস্তরখণ্ডগুলো বলতে লাগলো, আস্সালামু আলাইকা ইয়া রসুলাল্লাহ্।
গৃহে প্রবেশের সাথে সাথে হজরত খাদিজা তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। চিরচেনা স্বামী যে আজ ভিন্নরূপে জ্যোতিষ্মান। তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে নূর। শুধু নূর। তিনি বিস্মিত ও বিমোহিত হলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যাম্মিলুনী, যাম্মিলুনী (আমাকে কম্বলাবৃত করো, কম্বলে ঢেকে দাও)। হজরত খাদিজা তৎক্ষণাৎ তাঁকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন। চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলেন ঠাণ্ডা পানি। কিছুটা সুস্থির হওয়ার পর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর প্রিয়তমা সহধর্মিণীকে সবকিছু খুলে বললেন। শেষে প্রশ্ন করলেন, আমার ভয় হচ্ছে। আমি কি বিপদকবলিত? হজরত খাদিজা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, তা কেনো হবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আল্লাহ্ আপনাকে বিপদে ফেলবেন না। নিশ্চয়ই তিনি আপনার মঙ্গল করবেন। আপনি মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। অনাথদের প্রতিপালন করেন। অতিথিদের সমাদর করেন। আরাধনা করেন কেবল আল্লাহর। নিরন্নদের অন্ন যোগান এবং সাহায্য করেন শ্রমজীবিদেরকে। সদাচারণ ও কল্যাণকামিতা আপনার স্বভাব। মানুষকে শুভকাজ করতে বলেন। বিরত থাকতে বলেন অশুভ কাজ থেকে। আপনি পিতৃমাতৃহারাদের আশ্রয়। আপনি সত্যবাদী। আমানতদার।
হজরত খাদিজার সান্ত্বনা, শুশ্রƒষা ও অনুপ্রেরণায় ধীরে ধীরে কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। কিন্তু অজানা এক বিহ্বলতা ও শঙ্কা থেকে কিছুতেই যেন মুক্তি পাওয়া যাচ্ছিলো না। হজরত খাদিজা তাঁকে নিয়ে গেলেন ধর্মবিশেষজ্ঞ ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে। বললেন, মান্যবর ভ্রাতঃ! আপনার এই ভ্রাতুষ্পুত্রের কথা একটু শুনে দেখুন তো।
ওয়ারাকা তখন বয়োবৃদ্ধ। কুরায়েশদের পৌত্তলিক বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কছিলো না। নবী ঈসা (আঃ) এর ধর্মমতানুসারে জীবনযাপন করতেন তিনি। ছিলেন ইঞ্জিল শরীফের পণ্ডিত। ইবরানী ভাষা জানতেন। আরবী ভাষায় ইঞ্জিল তরজমা করে শোনাতেন। সব শুনে ওয়ারাকা আবেগ ও উচ্ছ্বাসভরে বলে উঠলেন, নামুস! নামুস! নবী ঈসার নিকটেও তিনি প্রত্যাদেশসহ আবির্ভূত হয়েছিলেন। হে মোহাম্মদ! আপনাকে অভিনন্দন। আল্লাহ্পাক আপনাকে তাঁর প্রত্যাদেশবাহক বানিয়েছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি ওই রসুল, হজরত ঈসা যাঁর সুসংবাদ দিয়েছেন। বলেছেন, আমার পরবর্তী রসুলের নাম হবে মোহাম্মদ। এবার শুনুন অচিরেই আপনাকে সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে। হায়! আমি যদি তখন জীবিত থাকতাম। অস্ত্রধারণ করতাম আপনার পক্ষে। আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা তো আপনাকে এখান থেকে বের করে দিবে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সত্যিই কি এরকম ঘটবে? ওয়ারাকা বললেন, হ্যাঁ। আপনি যা নিয়ে এসেছেন, ইতোপূর্বে কেউই তা আনেননি। হায়! তবুও আপনাকে শত্রু মনে করা হবে। আপনাকে অনেক দুঃখ-কষ্ট দেওয়া হবে। আল্লাহরবিধান যে এরকমই। সকল নবীর সঙ্গে এভাবেই বিরুদ্ধাচরণ করা হয়।
উল্লেখ্য, ওয়ারাকার শুভ আশা পূরণ হয়নি। অল্পকাল পরেই তাঁকে পাড়ি জমাতে হয়েছিলো পরবর্তী পৃথিবীতে।
উতবা ইবনে রবীয়ার ক্রীতদাস আদ্দাস ছিলেন খ্রিষ্টান। ছিলেন ধার্মিক ও জ্ঞানী। তাঁর জন্মস্থান ছিলো নিন্ওয়া (নিনেভ) নামক শহরে, যেখানে আবির্ভূত হয়েছিলেন নবী ইউনুস (আঃ)। কৌতূহল নিবারণের জন্য হজরত খাদিজা তাঁর কাছেও গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, জিব্রাইল সম্পর্কে তুমি কি কিছু জানো? তিনি বললেন, কুদ্দুস! কুদ্দুস! (পবিত্র! পবিত্র!) হজরত খাদিজা বললেন, তাঁর সম্পর্কে আর কী জানা আছে বলো? তিনি জবাব দিলেন, জিব্রাইল হচ্ছেন আল্লাহ্ ও তাঁর নবীগণের সংযোগরক্ষক পরম বিশ্বাসী সত্তা। তিনি মুসা ও ঈসা নবীদ্বয়ের কাছেও এসেছিলেন।
হজরত খাদিজা আরো অধিক নিশ্চিতির জন্য বিষয়টিকে পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন। একদিন একান্তে বললেন, হে আমার পিতৃব্যপুত্র! আপনার সাথী জিব্রাইল হয়তো আবার আসবেন। এলেই আমাকে জানাবেন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিব্রাইল আমীনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। কিন্তু না। তিনি আর আসেন না। বেশকিছুদিন কেটে গেলো এভাবে। পাহাড়- পর্বতে নির্জনে বসে থাকেন তিনি। ভাবনার অতল সাগরে নিমজ্জিত হয়ে থাকেন। একদিন মক্কার আজইয়াদ নামক পাহাড়ে বসে আছেন। অকস্মাৎ দেখলেন দিগন্ত রেখা জুড়ে এক পায়ের উপরে আরেক পা উঠিয়ে বসে আছেন এক অলৌকিক আকৃতি। তিনি উচ্চকণ্ঠে বলছেন, হে মোহাম্মদ! আমি জিব্রাইল। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভীতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। তৎক্ষণাৎ বাড়িতে গিয়ে হজরত খাদিজাকে বললেন, জিব্রাইল এসেছেন। ওই যে আকাশে। হজরত খাদিজা আকাশের দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে তাঁর ডান উরুর উপরে বসালেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি তাঁকে এখনো দেখতে পাচ্ছেন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। এবার তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে বসালেন তাঁর বাম উরুর উপর। জিজ্ঞেস করলেন, এখন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। এখনও দেখতে পাচ্ছি। হজরত খাদিজা এবার শিথিলবসনা হলেন। খুলে ফেললেন বুকের ওড়না। তারপর বললেন এবার? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, না। তিনি এখন অন্তর্হিত। হজরত খাদিজা বললেন, নিশ্চয় তিনি ফেরেশতা। শয়তান নয়। কারণ ফেরেশতারা লজ্জাবান, আর শয়তান নির্লজ্জ।
নতুন প্রত্যাদেশের আশায় ব্যাকুল হয়ে থাকেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। কিন্তু না। প্রত্যাদেশ আর আসেই না। ব্যর্থতার গায়ে বার বার বাড়ি খেতে থাকে তাঁর আবেগ, আশা ও অপেক্ষাগুলো। মনোকষ্টে জর্জরিত হতে থাকেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, এরকম নিষ্ফল জীবন আর রেখে কী হবে। জীবনাবসান না হওয়া পর্যন্ত শান্তির সাক্ষাৎ হয়তো আর পাওয়া যাবে না। পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করলেই ভালো। তিনি যখন আত্মহননের উদ্যোগ নেন তখন আবির্ভূত হন জিব্রাইল আমীন। বলেন, মোহাম্মদ! নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রসুল। আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমি আপনার ভ্রাতা।
 
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হন। প্রভুপালকের মহাবাণী লাভের আশাগৃহে আবার আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর প্রতীক্ষাগুলোও প্রতীক্ষা করতে থাকে। এভাবে অতিবাহিত হয়ে যায় পুরো তিনটি বছর। মাদারেজুন্ নবুওয়াত গ্রন্থে আছে, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বয়স চল্লিশ বছর হওয়ার পর তাঁর উপর ওহী নাযিল হয়। তারপর তাঁর সাথে একটানা তিন বছর অবস্থান করেন ইস্রাফিল ফেরেশতা। তিনি তাঁকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিছু কথা ও কতিপয় বিষয় শিখিয়ে দেন। তখন তাঁর উপরে কোরআন অবতীর্ণ হচ্ছিলো। এভাবে তিন বছর অতিবাহিত হলো। এবার স্থায়ীভাবে তাঁর সঙ্গ গ্রহণ করলেন জিব্রাইল ফেরেশতা। এরপর বিশ বছর ধরে তাঁর কাছে ওহী নাযিল হতে থাকে।
এর মধ্যে ঘটে যায় একটি বিশেষ ঘটনা। একদিন হজরত খাদিজা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর খোঁজে নিকটস্থ পাহাড়গুলোর দিকে গমন করলেন। হঠাৎ দেখলেন সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন শ্বেতশুভ্র বসন পরিহিত এক অপরিচিতচলো­ক। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মোহাম্মদের খোঁজ করতে যাচ্ছেন? হজরত খাদিজা ভয় পেলেন।চলো­কটির কথার কোনো জবাব দিতে পারলেন না। রহস্যময়চলো­কটির সহসা অন্তর্ধান ঘটলো। তিনি কিছুদূর এগিয়ে যেতেই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাক্ষাত পেলেন। তাঁকে খুলে বললেন সব। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ভয়ের কিছু নেই। জিব্রাইল দেখা করেছিলেন তোমার সঙ্গে। একটু আগে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে গেলেন। বলে গেলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! কিছু খাদ্য ও পানীয় নিয়ে একটু পরই আপনার কাছে আসবেন খাদিজা। আপনি তাঁকে আমাদের প্রভুপালক ও আমার পক্ষ থেকে সালাম বলবেন। আর এই সুসংবাদটি জানাবেন যে, আল্লাহ্ জান্নাতে তাঁর জন্য মণিমুক্তা খচিত একটি মহামর্যাদামণ্ডিত বাসভবন প্রস্তুত করে রেখেছেন।
সুসংবাদ শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন মহাপুণ্যবতী খাদিজা। প্রত্যুত্তরে বললেন, ইন্নাল্লহা হুয়াস্ সালাম ওয়া আ’লা জিবরিলিস্ সালাম ওয়া আ’লাইকাস্ সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ্।
এক সময় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর তিক্ত প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো। প্রত্যাদেশপ্রবাহ শুরু হলো পুনরায়। অবতীর্ণ হলো ‘হে বস্ত্রাচ্ছাদিত! ওঠো, আর সতর্ক করো, এবং তোমার প্রভুপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। তোমার পরিচ্ছদ পবিত্র রাখো, পৌত্তিলকতা পরিহার করে চলো­, অধিক পাওয়ার প্রত্যাশায় দান কর না। এবং তোমার প্রভুপালকের উদ্দেশ্যে ধৈর্যধারণ করো।’
‘সতর্ক করো’ এই নির্দেশানুসারে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর মহান ধর্মমত ইসলাম প্রচার শুরু করলেন। প্রথমে আহবান জানালেন প্রাণের প্রিয়তমা সুখ-দুঃখের সাথী হজরত খাদিজা তাহেরাকে। বললেন, আমার ধর্মাদর্শে বিশ্বাস স্থাপন করো। বলো, লা ইলাহা ইল্লালহু মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ।    মহাসত্যের প্রথম আলো সর্বপ্রথম হজরত খাদিজার হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো। তিনি বললেন, বিশ্বাস করলাম আল্লাহছাড়া উপাস্য কেউ নেই, আর মোহাম্মদ নিশ্চয় আল্লাহর বাণীবাহক। তাঁর বয়স তখন ৫৫ বছর।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নিকটজনদেরকে ইসলামের প্রতি আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁরাও সাড়া দিলেন। নতুন এই ধর্মমতে বিশ্বাস স্থাপন করলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সবেচেয়ে ঘনিষ্ঠ সাথী প্রিয় বাল্যবন্ধু হজরত আবু বকর। ইমান আনলেন হজরত আলী। তিনি তখন দশ বছরের বালক। পালকপুত্র যায়েদও নির্দ্বিধায় গ্রহণ করলেন ইসলাম।
হজরত আবু বকরও হলেন প্রচারকর্মের সক্রিয় সহযোগী। তাঁর শুভপ্রে ষ্টার ফলে ইসলাম গ্রহণ করলেন সর্বহজরত ওসমান ইবনে আফ্ফান, যোবায়ের ইবনে আওয়াম, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস ও তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ­।
এভাবে ধীরে ধীরে মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে যেতে লাগলো। মুসলমান হলেন আরো কিছুসংখ্যক সত্যান্বেষী ব্যক্তিত্ব। যেমন আবু উবায়েদ, আমের ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে জাররাহ্, আবু সালামা ইবনে আবদুল্লাহ্। এই মহান কাফেলায় আরো শরীক হলেন আরকাম ইবনে ওসমান ইবনে মাযউন, আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ, সাঈদ ইবনে যায়েদ। ক্রীতদাসগণের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করলেন হজরত বেলাল। আর মেয়েদের মধ্যে হজরত আব্বাসের স্ত্রী উম্মে ফজল এবং হজরত আবু বকর তনয়া আসমা।
নতুন প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হলো ‘যা কিছু করতে হুকুম দেওয়া হয়েছে তা প্রকাশ্যে করো। আমন্ত্রণ জানাও প্রকাশ্যে। আর মুশরিকদের দিক থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করো।’ এবার মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রকাশ্যে ও সুদৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মপ্রচার শুরু করলেন। বলতে শুরু করলেন, প্রতিমা ও প্রতিমাপূজারীরা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।
ক্ষিপ্ত হলো কুরায়েশেরা। প্রতিমাপূজার নিন্দা তারা সহ্য করতে পারলো না। কিন্তু তেমন কিছু করতেও পারলো না এজন্য যে, হজরত আবু তালেব তাঁর পক্ষ অবলম্বন করেছেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন না বটে, কিন্তু তাঁর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের ক্ষতি হোক— তাও কামনা করলেন না।
একদিন প্রতিমাপূজারীরা দল বেঁধে হজরত আবু তালেবের সঙ্গে দেখা করতে এলো। সেখানে উপস্থিত মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান জানালেন। তারা ক্ষেপে গেলো। বললো, আবু তালেব! মোহাম্মদের পক্ষ অবলম্বন করছেন কেনো? সে তো ধর্মদ্রোহী। পিতৃপুরুষদের ধর্ম অস্বীকারকারী। তাকে আমাদের হাতে তুলে দিন। হজরত আবু তালেব বললেন, উটনী যদি তার বাচ্চা ছেড়ে থাকতে পারতো, তাহলে আমিও মোহাম্মদকে তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারতাম। তিনি একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন, যার অর্থ এরকম— মোহাম্মদ! তোমার প্রতিপক্ষীয়রা তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি নির্ভয়ে তোমার প্রচারকর্ম চালিয়ে­ যাও। তোমার চোখ চিরশীতল থাকুক। তুমি তো মানুষকে কল্যাণের দিকেই ডাকছো। নিশ্চয়ই তুমি সত্যবাদী, বিশ্বস্ত। তুমি এমন এক ধর্মের প্রচারক, যে ধর্ম নিঃসন্দেহে সকল ধর্মাপেক্ষা উত্তম। মানুষের নিন্দা ও তিরস্কারের ভয় যদি আমার না থাকতো, তবে আমিও প্রসন্ন অন্তকরণে তোমার ধর্মমত গ্রহণ করতাম।
কিছুদিন পর পর প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হতে লাগলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ক্রমাগত হতে লাগলেন অধিক, অধিকতর উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত। তাঁর জ্যোতির্ময় ও সুবলিষ্ঠ বক্তব্য বার বার আঘাত করতে লাগলো পৌত্তলিক মতাদর্শের কঠিন দেয়ালে। কুরায়েশ কাফেররা তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করলো বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন উপায়ে। কেউ বললো, মোহাম্মদ তো যাদুকর। কেউ বললো, কবি। আবার কেউ বললো, গণক, যাদুকর। কেউ কেউ আবার মন্তব্য করলো, মোহাম্মদের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে।
কোনো কোনো হতভাগা তাঁর শরীরে ময়লা নিক্ষেপ করতো। তাঁর ঘরের দরজায় রক্ত মাখিয়ে রাখতো। তাঁর চলাচলের পথে বিছিয়ে রাখতো কাঁটা। কখনো কখনো তাঁর প্রতি নিক্ষেপ করতো পাথর। কাবাপ্রাঙ্গণে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন কোরআন আবৃত্তি করতেন, তখন দুই কান বন্ধ করে রাখতো তারা। কখনো হাততালি দিয়ে, শিস বাজিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতো।
একদিনের ঘটনা। কাবাপ্রাঙ্গণে একদিন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেজদা দিয়ে ছিলেন। এক দুর্ভাগা তাঁর গলায় এমন চাপ দিলো যে, তাতে করে তাঁর দুচোখে কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন হজরত আবু বকর। দুর্বৃত্তটিকে বাধা দিলেন। সে ক্ষিপ্ত হয়ে আক্রমণ করে বসলো হজরত আবু বকরকে। তাঁর দাড়ি ধরে সজোরে টান দিলো। ফলে উৎপাটিত হলো কয়েকগাছি চুল। এরপর সে মাথায় আঘাত করলো। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। বললেন, তোমরা কি এমন একজনকে হত্যা করতে চাও, যিনি বলেন, আল্লাহই আমার প্রভুপালক। তিনি তো তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুপালকের দলিল প্রমাণসহই আগমন করেছেন।
আর একদিনের ঘটনা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাবা শরীফের সন্নিকটে নামাজ আদায় করছিলেন। কাফের কুরায়েশদের একজন বললো, তোমরা কি ওকে দেখতে পাচ্ছো। তোমরা কেউ কি যবেহকৃত উটের নাড়িভুঁড়ি এনে মোহাম্মদ যখন সেজদায় যাবে, তখন তার কাঁধের উপরে চাপিয়ে দিতে পারো? একথা শোনার সাথে সাথে উকবা ইবনে আবী মুঈত উঠে চলে গেলো। একটু পরেই উটের নাড়িভুঁড়ি নিয়ে হাজির হলো। চাপিয়ে দিলো সেজদারত নবীর কাঁধের উপরে।
 
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেজদা থেকে মাথা ওঠাতে পারলেন না। এই দেখে তারা শুরু করলো হাসি তামাশা। সংবাদ পেয়ে ছুটে এলেন নবীনন্দিনী হজরত ফাতেমা। তিনি তখন বালিকা। তিনি কাঁদতে কাঁদতে নাড়িভুঁড়ি সরিয়ে দিলেন। গালমন্দ করলেন কাফেরদেরকে। পিতার হাত ধরে ফিরে এলেন বাড়িতে।
এভাবে দিন যায়। রাত যায়। কাফেরদের অত্যাচার বাড়তে থাকে। কিন্তু ইসলামের নূর তাতে নির্বাপিত হয় না। বরং অধিকতর প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নতুন নতুন প্রত্যাদেশের মাধ্যমে এক আল্লাহরপ্রতি বিশুদ্ধ বিশ্বাসের স্বরূপ হয়ে ওঠে অধিকতর প্রকট। অবতীর্ণ হয়— ‘বলো, তিনিই আল্লাহ্, এবং অদ্বিতীয়, আল্লাহকারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেওয়া হয়নি এবং তাঁর সমতুল্য কেউই নেই’।
হজরত খাদিজা কষ্ট পান সবেচেয়ে বেশী। প্রতিটি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও অত্যাচার তাঁর হৃদয়কে রক্তাক্ত করে দেয়। আঘাতে আঘাতে তিনি পাথর হয়ে যান। কিন্তু ভেঙে পড়েন না। প্রিয়তম নবী ও স্বামীকে সান্ত্বনা দেন। বলেন, আপনি সত্যাধিষ্ঠিত। আপনি আল্লাহরবাণীবাহক। আপনার পূর্বের বাণীবাহকগণ সকলেই অত্যাচারিত হয়েছেন। কিন্তু কখনোই পশ্চাৎপদ হননি। আপনিও হবেন না। নিশ্চয় সম্মুখে রয়েছে সাহায্য ও বিজয়।
হজরত খাদিজাও তাঁর গোত্রের লোকদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান জানান। তাঁর আহবানে সাড়া দেন অনেকেই। তাঁর পিতৃকুল বনী আসাদ ইবনে আবদিল উয্যার পনেরো জন প্রভাবশালী ব্যক্তি জীবিত ছিলেন তখন। তাঁদের মধ্যে দশজনই ইসলাম গ্রহণ করেন। এরকম ঘটে প্রধানতঃ তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবের কারণে। তিনি ছিলেন বহুলোকের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্রী।
অতি ধীরে হলেও মুসলমান জনতার সংখ্যা বাড়তেই থাকে। তাঁদের মধ্যে প্রভাবপ্রতিপত্তিহীন যাঁরা, তাদের উপর চলতে থাকে অকথ্য নির্যাতন। তারা বলতে থাকে, ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করো। হজরত বেলালের মনিব উমাইয়া ইবনে খালফ প্রায়শঃ তাঁকে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকারাশির উপরে খালি গায়ে শুইয়ে দিয়ে বুকের উপর বড় পাথর চাপা দিয়ে রাখতো। তাঁর শরীরে উত্তপ্ত শলাকা দিয়ে দাগ দিতো। কখনো প্রহার করতো লাঠি দ্বারা। হজরত বেলাল উচ্চারণ করতেন, আহাদ আহাদ।
হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসার এবং তাঁর পিতামাতাকেও বিভিন্নভাবে নির্যাতন করলো কাফেরেরা। একদিন তারা হজরত আম্মারকে প্রখর রোদে গরম বালির উপরে শুইয়ে নির্যাতন চালাচ্ছিলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সে দিক দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে ইয়াসারের পুত্র! সবর করো। তাঁর মাতা হজরত সুমাইয়াকে নির্যাতিতা হতে দেখে বললেন, সুমাইয়া! তোমাকে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। একদিন মাতা-পুত্র দুজনকেই হত্যা করলো তারা। তাঁরা লাভ করলেন ইসলামের প্রথম শহীদানের মর্যাদা।
নির্যাতন-অত্যাচারের সকল সংবাদই হজরত খাদিজা (রাঃ) এর কানে পৌঁছে। তাঁর অন্তরে জ্বলতে থাকে দুঃখ-কষ্টের অসহনীয় আগুন। কিন্তু সে আগুনকে তিনি বাইরে প্রকাশ করেন না। ধৈর্য-সহিষ্ণুতার নীরব পর্বত হয়ে যান। ব্যথিত রসুলের পাশে গ্রহণ করেন সার্বক্ষণিক অবস্থান। হয়ে যান শান্তিবাণী, সান্ত্বনা ও অনুপ্রেরণা। বিশ্বাস করেন এবং মুগ্ধ হয়ে শোনেন মহান আল্লাহ্তায়ালার সুন্দর ও শক্তিময় বাণী— ‘ওরা কি বলে, আমরা সংঘবদ্ধ অপরাজেয় দল? এই দলতো শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে, অধিকন্তু কিয়ামত তাঁদের শাস্তির নির্ধারিত কাল এবং কিয়ামত হবে কঠিনতর ও তিক্ততর, নিশ্চয় অপরাধীরা বিভ্রান্ত ও বিকারগ্রস্ত। যেদিন তাদেরকে উপুড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে; সে দিন বলা হবে ‘জাহান্নামের আস্বাদন গ্রহণ করো’। আমি সকল কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে। আমার আদেশ তো একটি কথায় নিষ্পন্ন, চোখের পলকের মতো। আমি ধ্বংস করেছি তোমাদের মতো দলগুলোকে। অতএব, এ থেকে উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?’
 
সাহাবীগণের উপরে জুলুম-নির্যাতন যখন চরম আকার ধারণ করলো, তখন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদেরকে হিজরতের আদেশ দিলেন। এগারো জন পুরুষ ও পাঁচজন নারীর হিজরতকারী দলটি মক্কা থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন সঙ্গোপনে। সমুদ্র তীর পর্যন্ত পদব্রজে গেলেন তাঁরা। তারপর নৌকাযোগে যাত্রা করলেন আবিসিনিয়ার দিকে।
সেখানকার সম্রাটের উপাধি ছিলো নাজ্জাশী। তাঁর আসল নাম ছিলো আসমাহা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রিয় কন্যা রুকাইয়া ও তাঁর স্বামী হজরত ওসমানও ছিলেন ওই দলে। হজরত খাদিজা গোপনে চোখের জল ফেললেন। কন্যা জামাতাকে সমর্পণ করলেন আল্লাহর কাছে। অনেক আশীর্বাদ করলেন বেদনাময় হৃদয় থেকে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আল্লাহর নবী লুতের পরে সস্ত্রীক হিজরতকারী ওসমান ইবনে আফ্ফান।
আবিসিনিয়ায় হিজরতের কথা প্রকাশ হয়ে পড়লো অচিরেই। মুশরিকেরা ক্ষিপ্ত হলো খুব। মুসলমানদের উপরে আরো অধিক অত্যাচার শুরু হলো। কিন্তু এবার ঘটলো আশ্চর্য কিছু ঘটনা। ইসলাম গ্রহণ করলেন বীরশ্রেষ্ঠ হজরত ওমর ও শহীদশ্রেষ্ঠ হজরত হামযা। মুসলমানেরা আনন্দিত হলেন। মুশরিকেরা হলো বিষণ্ণ। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং হজরত খাদিজা আল্লাহ্পাকের দরবারে জানালেন অসংখ্য কৃতজ্ঞতা। এবার প্রচারকর্ম চললো আরো জোরে সোরে। মুশরিকের দল প্রথম প্রথম একটু হতোদ্যম হলো বটে, কিন্তু পরে বিরোধিতা শুরু করলো পূর্বাপেক্ষা কয়েকগুণ বেশী উৎসাহভরে।
এভাবে বহু বিপদ-মুসিবতের মধ্য দিয়ে কেটে গেলো সাতটি বছর। কুরায়েশ কাফেরেরা দেখলো, হজরত হামযা ও হজরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের ফলে নতুন এই ধর্মমতটির সম্মান ও শক্তি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। সাহাবীগণ আবিসিনিয়ায় চলে যাচ্ছেন। এভাবে আরব দেশের বাইরেও ধর্মপ্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। তারা হিংসার আগুনে জ্বলতে লাগলো। ঠিক করলো, এবার একটা স্থায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে হত্যা করার জন্য তারা উঠে পড়ে লাগলো। মান্যবর আবু তালেবের সঙ্গে চূড়ান্ত বোঝাপড়া করতে চাইলো তারা। দলবদ্ধভাবে তাঁর কাছে গিয়ে বললো, আপনার ভাতিজাকে আমাদের হাতে তুলে দিন। অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। তাকে বলে দিন, সে যেনো আমাদের পরম পূজনীয় প্রতিমাগুলোর সমালোচনা আর না করে। তারা চলে যাওয়ার পর তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে ডেকে বললেন, তোমার গোত্রের লোকেরা এসেছিলো। তারা আমাকে এভাবে হুমকি দিয়ে গেলো। এবার তুমি তোমার জীবনের প্রতি একটু সদয় হও। আমরা তো তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখি না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, প্রিয় খুল্লতাত! আপনি কি এরকম ভাবেন যে, আমি আপনার উপর ভরসা করে ইসলাম প্রচার করছি? কখনোই নয়। আমার প্রিয়তম প্রভুপালকই আমার প্রকৃত সাহায্যকারী। আমি তাঁরই উপরে নির্ভর করি। পরিচালিত হই তাঁরই নির্দেশে। সত্যের প্রচার পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে একাজ চালিয়ে­ যেতেই হবে। আপনি যদি ইসলাম কবুল করেন এবং আমার অনুগামী হয়ে যান, তবে হবেন মহাসৌভাগ্যশালী। আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট।
হজরত আবু তালেব তাঁর এই পুত্রাধিক প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রটির কথা শুনে আনন্দিত হলেন। তবুও ইসলাম গ্রহণ করলেন না। কিন্তু বললেন, কাজ চালিয়ে­ যাও। কাবার প্রভুর কসম! আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, কেউ তোমাকে অবনত করতে পারবে না। তোমাকে প্রতিহত করে এমন সাধ্য কারো নেই।
হজরত খাদিজাও একইভাবে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেন। এতো ভীতিপ্রদ হুমকি শুনেও দুঃশ্চিন্তিত হন না। মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, আল্লাহ্পাক তাঁর নবীকে সফল করবেনই। সেদিন হয়তো বেশী দূরে নয়, যেদিন মহাসত্যের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করবে বহুসংখ্যক মানুষ। আর শত্রুরা হবে পরাভূত। হবেই।
 
আবু লাহাব ছিলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর গোত্রের— হাশেমী বংশের। কিন্তু সে হয়ে গেলো চরমতম শত্রু। সে আবু জেহেল ও অন্যান্য কুরায়েশ সরদারদের নিয়ে শলাপরামর্শ করতে বসলো। একটি অশুভ ও অপবিত্র সভায় সকলে এই মর্মে এক সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, বনী মুত্তালিব ও হাশেমী গোত্রকে পরিত্যাগ করতে হবে। তাদের সাথে কেউ বিবাহ-শাদী, ক্রয়-বিক্রয়, মেলা-মেশা ও ওঠা-বসা করতে পারবে না। কথাবার্তাও বলতে পারবে না। এরকম শর্তের উপর তারা লিখিতভাবে     চুক্তিবদ্ধ হলো। চুক্তিনামাটি ঝুলিয়ে দিলো কাবাগৃহের দরজায়। প্রধান শর্তটি লিপিবদ্ধ ছিলো এভাবে— বনী হাশেম ও বনী আবদুল মোত্তালিবের সঙ্গে কোনো সম্পর্কথাকবে না, যতদিন না মোহাম্মদকে হত্যা করা হবে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর প্রিয়তম ভার্যা হজরত খাদিজা, প্রিয় পুত্রী ফাতেমা, সকল মুসলমান ও ভক্ত অনুরক্তদের নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন শিয়াবে আবু তালেব নামক উপত্যকায়। হজরত আবু তালেব মুসলমান না হয়েও মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পক্ষাবলম্বন করলেন। চরম দুঃখ-কষ্টে জীবন কাটতে লাগলো তাঁদের।
ইবনে ইসহাকের বিবরণে এসেছে, রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জন্য খাদিজা (রাঃ) ছিলেন সত্য ও উপযুক্ত মন্ত্রণাদাত্রী। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সকল বিপদ-আপদে তাঁর কাছে মনের কথা খুলে বলতেন। পরামর্শ ও সান্ত্বনা কামনা করতেন। তাঁর নবুওয়াতের প্রচার দায়িত্বের সপ্তম বছরে মুহররম মাসে কুরায়েশেরা মুসলমানদের সঙ্গে স úর্কচ্ছেদ করে। তাঁরা শিয়াবে আবু তালেবে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হজরত খাদিজা (রাঃ) ও সেখানে অন্তরীণ হন। প্রায় তিনটি বছর বনী হাশেম দারুন অভাব ও দুর্ভিক্ষগ্রস্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করেন। বেশীর ভাগ সময় তাঁদেরকে গাছের পাতা খেয়ে থাকতে হতো। স্বামীর সাথে খাদিজা (রাঃ) সেখানে হাসিমুখে সব কষ্ট সহ্য করেন। কখনো নিজের প্রভাব খাটিয়ে নানা উপায়ে কিছু খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারতেন। কখনো পারতেন না। তাঁর তিন ভ্রাতুষ্পুত্র— হাকীম ইবনে হিযাম, আবুল বুখতারী ও যুমআ ইবনে আসওয়াদ ছিলেন কুরায়েশদের নেতৃস্থানীয়। অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তারা কখনো কখনো একঘরে করা মুসলমানদের কাছে খাদ্যশস্য পাঠাতে সক্ষম হতেন।
একদিন হাকীম ইবনে হিযাম চাকরের মাথায় কিছু গম উঠিয়ে নিয়ে তার ফুফুজান হজরত খাদিজার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। পথে দেখা হলো নরাধম আবু জেহেলের সঙ্গে। সে রাগতঃ কণ্ঠে বললো, খাদ্য নিয়ে তুমি বনী হাশেমের কাছে যাচ্ছো? আল্লাহরকসম! আমি তোমাকে খাদ্য নিয়ে সেখানে যেতে দিবো না। যদি যাও, তবে আমি তোমাকে মক্কায় লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবো।
এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন আবুল বুখতারী ইবনে হাশেম। বললেন কী ব্যাপার! তোমরা ঝগড়া করছো কেনো? আবু জেহেল বললো, সে বনী হাশেমের কাছে খাদ্য নিয়ে যাচ্ছে। আবুল বুখতারী বললো, এ খাদ্য তো তার ফুফুর। ওর কাছে জমা ছিলো। ফুফুর খাদ্য সে দিতে যাচ্ছে। আর তুমি তাতে বাধা দিচ্ছো। ছাড়ো। পথ ছাড়ো। আবু জেহেল সরে দাঁড়ালো না। বচসা-কলহ শেষে মারামারি পর্যন্ত পৌঁছলো। এরকম বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও হাকীম কখনো কখনো খাদ্য পাঠাতে সক্ষম হতো।
একদিনের ঘটনা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে অন্তরীণ তাঁর প্রিয় পিতৃব্য হজরত আব্বাস খাদ্যসংগ্রহের আশায় শিয়াবে আবু তালেব থেকে বের হয়ে এলেন। আবুজেহেল তাঁর উপর আক্রমণ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু আল্লাহ্ তাঁকে রক্ষা করলেন। একথা হজরত খাদিজা জানতে পেরে তাঁর চাচা যুমআ ইবনে আল আসাদকেচলো­ক মারফত বলে পাঠালেন, আবু জেহেল খাদ্যক্রয়ে বাধা দিচ্ছে। তাকে শাসিয়ে দিনতো। যুমআ হজরত খাদিজার কথায় সাড়া দিলেন। আচ্ছা করে তাকে শাসালেন। তখন থেকে সে কিছুটা সংযত হতে বাধ্য হয়।
সুদীর্ঘ তিনটি বৎসর অতীতের গর্ভে হারিয়ে গেলো। সময়ের প্রভাবে পরিস্থিতির অদল বদল হলো কিছুটা। অবতীর্ণ হলো— ‘তারা চায় আল্লাহর নূরকে মুখের ফুৎকারে নিভিয়ে ফেলতে, আর আল্লাহ্ চান তাঁর নূরকে পূর্ণতা দান করতে, যদিও সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীরা তা অপছন্দ করে।’
কুরায়েশ নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলো। তাদের কারো কারো মনকে আল্লাহপাক নরম করে দিলেন। তারা মন্তব্য করতে লাগলো চুক্তিনামাটি ছিঁড়ে ফেলা হোক। শুরু হলো পক্ষীয়-বিপক্ষীয়দের তর্ক-বিতর্ক। শেষে সকলে সিদ্ধান্ত নিলো, ঠিক আছে চুক্তিনামাটি উপস্থিত করা হোক। তখন হজরত আবু তালেব বললেন, মোহাম্মদ কী বলেছে শোনো। বলেছে, আল্লাহ্ ওই চুক্তিনামার উপরে ঝি ঝি পোকাকে নিয়োজিত করেছেন। পোকাগুলো আল্লাহও তাঁর রসুলের নাম ছাড়া সকল বিবরণ খেয়ে ফেলেছে। চুক্তিনামাটি সকলের সামনে আনা হলো। সকলে দেখলো, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কথাই ঠিক। তারা লজ্জিত হলো। কিন্তু আবুজেহেল ও তার অনুসারীরা শুরু করে দিলো হৈ চৈ । হজরত আবু তালেব তাঁর সাথীদেরকে সঙ্গে নিয়ে কাবা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে দোয়া করলেন। হে আল্লাহ! যারা আমাদের উপরে জুলুম করেছে এবং রক্ত সম্পর্কছিন্ন করেছে, তাদের উপর আমাদেরকে সাহায্য করো। এরপর আবু জেহেলের বিরুদ্ধমতাবলম্বীরা তাঁদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী ও নিকটাত্মীয়দেরকে আপন আপন ঘরবাড়িতে ফিরিয়ে আনলেন।
বন্দী ও বন্দিনীগণ তখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। হজরত আবু তালেবের স্বাস্থ্য পুরোপুরি ভেঙে পড়ছে। হজরত খাদিজার অবস্থাও ততো ভালো নয়। তিনিও দুর্বল ও পরিশ্রান্ত।
শিয়াবের বন্দীজীবন শেষে স্বগৃহে ফিরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন হজরত আবু তালেব। কিন্তু শরীরে বল পেলেন না। শয্যাশায়ী হলেন। বয়সও হয়েছে অনেক। সাতাশি বছর। শীর্ণ শরীর নিয়ে তিনি হলেন মৃত্যুর মুখোমুখি।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, প্রিয় খুল্লতাত! লা ইলাহা ইলা­ লাহু­     মোহাম্মদুর
রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কলেমা পাঠ করুন। তিনি কলেমা পাঠ করলেন না। বললেন, বৎস মোহাম্মদ! তোমার কামনা আমি পূর্ণ করতাম। কিন্তু কুরায়েশেরা আমাকে মন্দ বলবে যে। বলবে, আবু তালেব মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে কলেমা পড়েছে। যথাসময়ে সাঙ্গ হলো তাঁর পৃথিবীর জীবন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে চিরতরে ছিন্ন হলো তাঁর পিতৃসম মমতার বন্ধন। আল্লাহর রসুলের জীবনে নেমে এলো শোক ও শঙ্কা। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আশ্রয় নিলেন ধৈর্যের সুউচ্চ শৃঙ্গে। কিন্তু ওখানেও আঘাত লাগলো। তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রিয়তমা পত্নী, সুদীর্ঘ পঁচিশ বছরের সুখ-দুঃখের সাথী, ছায়াসঙ্গিনী, অর্ধাঙ্গিনী খাদিজা তাহেরা শেষশয্যা গ্রহণ করলেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে দুনিয়া আখেরাতের সবেচেয়ে প্রিয়জন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে শোকের অকুল দরিয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে লাভ করলেন মহাবিশ্বের মহাপ্রভুপালকের নিষ্ক্ষয় আশ্রয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওই বৎসরকে আখ্যা দিলেন ‘আমুল হুযন’ (শোকবৎসর)।
তখন নামাজ ফরজ হয়নি। জানাযার নামাজের নিয়মও প্রবর্তিত হয়নি। হজরত খাদিজার ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন, আমরা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে হাজুন কবরস্থানে নিয়ে গেলাম। কবর খোঁড়া হয়েছিলো আগেই। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে তাঁকে কবরে শুইয়ে দিলেন। জানালেন চিরবিদায়।
 
হজরত খাদিজা (রাঃ) মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ভালোবাসা এবং সঙ্গ পেয়েছেন সবেচেয়ে বেশী। তিনিই নবীপ্রিয়াগণের মধ্যে প্রথম ও প্রধান। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের সুখ-দুঃখ তিনি সমান ভাগে ভাগ করে নিয়েছিলেন। অন্তরের গভীর ভালোবাসা ও সমবেদনা দিয়ে খেদমত করেছেন স্বামীর। যত্নে নিয়েছেন স্বামীর প্রিয়জনদের। এরকম বিরল সৌভাগ্যের অধিকারিণী আর কেউ নেই।
 
তিনি ওহী অবতরণের আগেই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে অসাধারণ ব্যক্তি হিসেবে জানতেন। নবীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে কখনোই কোনো মলিনতা স্পর্শ করতে পারেনি। যখন ওহী অবতীর্ণ হলো, তখন তিনিই হলেন প্রথম বিশ্বাসিনী। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে প্রথম নামাজ পাঠ করার সৌভাগ্যও তাঁর। তাঁর জীবদ্দশায় নামাজ ফরজ হয়নি বটে, কিন্তু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাজ পড়তেন। আর তিনিও হতেন তাঁর সঙ্গী। কখনো গৃহমধ্যে এবং কদাচিৎ কখনো কাবাপ্রাঙ্গণেও। যেমন এক বর্ণনায় এসেছে, আফীফ আল কিন্দি কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে মক্কায় এলেন।
মেহমান হলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর চাচা হজরত আব্বাসের গৃহে। একদিন সকালে তিনি দেখলেন, এক সুন্দর যুবক কাবাগৃহের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তাকালো আকাশের দিকে। একটি বালক দাঁড়ালো তাঁর পাশে। তাঁদের পিছনে দাঁড়ালো এক মহিলা। তারা নামাজ পড়লো। আফীফ হজরত আব্বাসকে ডেকে বললেন, বড় একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে মনে হয়। হজরত আব্বাস বললেন, হ্যাঁ। আমারও তাই মনে হয়। যুবকটি আমার ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ। কিশোরটি আমার আর এক ভ্রাতুষ্পুত্র, নাম আলী। আর মহিলাটি মোহাম্মদের স্ত্রী। মোহাম্মদের ধারণা, তার ধর্ম মহাবিশ্বপালকের ধর্ম। আর সে যা কিছু করে, তা আল্লাহর নির্দেশেই করে। এই নতুন ধর্মের অনুসারী এখন পর্যন্ত এই তিনজনই।
ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় এসেছে, একদিন আলী (রাঃ) দেখতে পেলেন, তাঁরা দু’জন (হজরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও হজরত খাদিজা) নামাজ পাঠ করছেন। নামাজ শেষে তিনি এ প্রসঙ্গে যখন জানতে চাইলেন, তখনই পেলেন ইসলামের দাওয়াত।
ইবনুল আসীর বলেন, এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্য এই যে, হজরত খাদিজা আল্লাহরসৃষ্টিজগতের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলিম।
জুহুরী, কাতাদা, মূসা ইবনে উকবা, ইবনে ইসহাক আল ওয়াকিদি ও সাঈদ ইবনে ইয়াহ্ইয়া বলেছেন, আল্লাহ্ ও রসুলের উপর সর্বপ্রথম ইমান আনেন খাদিজা, আবু বকর ও আলী (রদ্বিআল্লাহু আনহুম)।
সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব বলেছেন, নারীদের মধ্যে খাদিজা প্রথম মুসলিম। হজরত হুজাইফা থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ্ ও তাঁর রসুলের উপর ইমান আনার ব্যাপারে খাদিজা বিশ্বের সকল নারীর অগ্রণী।
এক বর্ণনায় এসেছে, রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, কামেল পুরুষ তো বহুসংখ্যক।
তবে কামেল রমণী কেবল চারজন- আসিয়া বিনতে মাযাহিম, মরিয়ম বিনতে ইমরান, খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ এবং ফাতেমা বিনতে মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।
হজরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, সারা পৃথিবীর সকল রমণীর মধ্যে উত্তমা হচ্ছেন মরিয়ম, খাদিজা, ফাতেমা ও আসিয়া।
 
হজরত আলী (রাঃ) বলেছেন, আমি স্বয়ং শুনেছি, রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, নারীদের মধ্যে মরিয়ম বিনতে ইমরান সর্বোত্তমা। আর আমাদের যুগের নারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ। বোখারী, মুসলিম।
হজরত ইবনে আব্বাস থেকে আবু দাউদ, নাসাঈ এবং হাকেম বর্ণনা করেছেন, বেহেশতিনীগণের মধ্যে সবেচেয়ে বেশী মর্যাদাশালিনী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ এবং ফাতেমা বিনতে মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হৃদয়পটে হজরত খাদিজার স্মৃতি ছিলো অম্লান। ইমাম যাহাবী তাঁর অবস্থান ও মর্যাদা নির্ণয় করতে গিয়ে বলেছেন, তাঁর ফযীলত অনেক। তিনি তাঁর সময়ের সকল নারীর নেত্রী। যে সকল নারী পূর্ণ মর্যাদা লাভ করেছেন, তিনি তাঁদের অন্যতমা। তিনি ছিলেন বুদ্ধিমতী, সম্মানিতা, ধর্মপরায়ণা ও নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারিণী একজন পুতঃপবিত্র রমণী। তিনি জান্নাতিনী। রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর অনেক প্রশংসা করেছেন। তাঁর অন্য স্ত্রীগণের চেয়ে তাঁকে দিয়েছেন অধিকতর প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব। তাঁর প্রতি প্রদর্শন করেছেন প্রভূত সম্মান। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর পূর্বে ও জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বিবাহ করেননি। ছিলেন রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একাধিক সন্তানের জননী। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে ছিলেন সর্বোত্তমা। তাঁকে হারিয়ে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শোকাতুর হয়ে পড়েন।
মোহাম্মদ ইবনে সালামা থেকে বর্ণিত হয়েছে, হজরত খাদিজা (রাঃ) এর ইন্তে কালের পর রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এতো অধিক শোকার্ত হয়ে পড়েন যে, তাঁর জীবনাশংকা দেখা দেয়। অবশেষে তিনি পুনঃবিবাহ করেন।
উম্মতজননী হজরত আয়েশা বলেছেন, খাদিজার বোন হালা একদিন রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সাক্ষাতপ্রার্থিনী হলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিলো হজরত খাদিজা (রাঃ) এর কণ্ঠস্বরের মতো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলেন। একটু পরেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে বললেন, ইয়া আল্লাহ্! এতো দেখছি হালা। হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, এতে আমার ভারী ঈর্ষা হলো। (অভিমান ভরে) বললাম, লাল গালের ওই প্রবীণা গত হয়েছেন কবে? এখনো তাঁকে মনে করতে হবে? আল্লাহ্তো আপনাকে তাঁর চেয়ে উত্তমরমণী দান করেছেন।
মাতা মহোদয়া আয়েশা (রাঃ) আরো বলেছেন, আমি খাদিজাকে দেখিনি। তবু তাঁর প্রতি অন্তর্জ্বালা অনুভব করতাম। তাঁর অন্য স্ত্রীদের প্রতি এরকম করতামনা। কারণ, রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর কথা খুব বেশী বলতেন। গৃহে ছাগল জবেহ করা হলে বলতেন, তোমরা কিছু গোশত খাদিজার বান্ধবীদের বাড়িতে পাঠাও। আমি (খাদিজার জন্যই) তার বান্ধবীদেরকে ভালোবাসি। মাতা মহোদয়া আরো বলেন, খাদিজার প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর কোনো না কোনো গুণের কথা বলতেন। তাঁর সম্পর্কে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হতেন না। একদিন আমি রাগান্বিত হলাম। বললাম, ওই অধিক বয়স্কা নারী তো বিগত হয়েছেন কবেই। আপনার ঘরে তো এখন রয়েছে অধিকতর উত্তমাগণ। আমার একথা শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও রেগে গেলেন। আমি অনুতপ্ত হলাম। মনে মনে বললাম, হে আমার আল্লাহ! তোমার রসুলের রাগ দূর করে দাও। আমি আর কখনো এরকম বলবো না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার মনোভাব বুঝতে পেরে বললেন, আয়েশা! তুমি এভাবে আর কথা বোলো না। মানুষ যখন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, সে তখন আমাকে দিয়েছে আশ্রয়। আল্লাহই তার ভালোবাসা আমার অন্তরে স্থাপন করেছেন। তাঁর মাধ্যমেই আমি সন্তান লাভ করেছি।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রথম কন্যা যয়নাব ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বামী আবুল আস তখনো ছিলেন অমুসলমান। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদীনায় হিজরত করলেন। কিন্তু যয়নাব রয়ে গেলেন স্বামীগৃহে। কিছুকাল পরে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হলো। আবুল আস মুসলিমবাহিনীর হাতে বন্দী হলেন। অন্যান্য বন্দীর সঙ্গে তাঁকেও আনা হলো মদীনায়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন মুক্তিপণের বিনিময়ে বন্দীদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হবে। বন্দীদের স্বজনেরা মক্কা থেকে মুক্তিপণের অর্থ পাঠালো। যয়নাব স্বামীর মুক্তিপণ বাবদ একটি সোনার হার পাঠালেন। ওই হার দেখে রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কেঁদে ফেললেন। চিনতে পারলেন, হারটি খাদিজার। বিবাহের সময় তিনি হারটি যয়নাবকে উপহার দিয়েছিলেন। ভারাক্রান্ত অন্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে বললেন, খাদিজার এই স্মৃতিনিদর্শনটি ছাড়াই কি তোমরা আবুল আসকে মুক্তি দিতে পারো না? তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দুঃখে সাহাবীগণের অন্তরও ব্যাথায় ভরে গেলো। তাঁরা ছিলেন সকল অবস্থায় আল্লাহর রসুলের সন্তোষকামী। তাঁরা তৎক্ষণাৎ হারটি ফেরত দিয়ে আবুল আসকে মুক্ত করে দিলেন। হজরত খাদিজার বিচ্ছেদব্যথা রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কখনোই ভুলতে পারেননি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তো ছিলেন মহাবিশ্বের মহামমতার অপার পাথার। রহমাতাল্লিল আ’লামীন।
সবাইকে ভালোবাসতেন তিনি। কিন্তু হজরত খাদিজার জন্য তাঁর পবিত্র বিশাল হৃদয়ে ছিলো এক বিশেষ স্থান, যেখানে অংশী ছিলেন না কেউ। ছিলেন শুধু খাদিজা। শুধুই খাদিজা।
তিনি আমাদের জননী। আল্লাহ্পাক স্বয়ং বলেছেন, ‘নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর এবং তাঁর পত্নীগণ তাদের মাতা।’ সকল বিশ্বাসী তাঁকে এবং রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অন্যান্য সহধর্মিণীকে মা বলেই ডাকেন। বলেন উম্মাহাতুল মু’মিনীন। কখনো বলেন উম্মতজননী। কখনো শুধুই জননী।
হজরত খাদিজা তাঁদের মতোই মহাসম্মানিতা। বরং তাঁদের চেয়ে অধিক। আল্লাহস্বয়ং তাঁকে সালাম জানিয়েছেন। সালাম জানিয়েছেন ফেরেশতাদের প্রধান হজরত জিব্রাইল। আর আমাদের প্রিয়তম রসুলের অন্তরের সালাম তিনি মুহুর্মুহু পেয়ে চলেছেন নিশ্চয়। আমরাও বলি, হে আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় জননী! আমাদের অন্তহীন সালাম দয়া করে গ্রহণ করুন।
 

Top