অনুবাদ ও সম্পাদনা
মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
অনুবাদকের কথা
نحمده ونصلى على رسوله الكريم
আমাদের শায়েখ ও মুর্শিদ মাহবুবুলওলামা হযরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদী দা. বা.। একজন বিশ্বমানের আলেমেদীন হওয়ার পাশাপাশি আধ্যাত্মিকজগতে অত্যন্ত পরিচিত নামও। তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ারও বটে। সুলূক তথা তাঁর আধ্যাত্মিক খেদমতের গ্রহণযোগ্যতা, গভীরতা ও বিস্তৃতির তুলনা বর্তমান বিশ্বের ওলামায়েকেরাম নকশবন্দি-তরিকার প্রাণপুরুষ খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দী রহ. এর সঙ্গে করে থাকেন। হৃদয়ের গভীর থেকে উতলে ওঠা দরদমাখা প্রতিটি কথা তাঁর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ এতটাই প্রভাববিস্তারকারী হয় যে, পাঠক অভিভূত হন, নিজেকে সংশোধন করার চিন্তায় আলোকিত হন। উভয় শিক্ষায় সমৃদ্ধ হওয়ায় তিনি সমাজে অবস্থান করা রোগগুলোর নাড়িতে একজন দক্ষ চিকিৎসকের মত হাত রাখতে সক্ষম হন। যুহুদ, তাকওয়া, লিল্লাহিয়াত, ইনাবাত ইলাল্লাহর গুণগুলো তাঁর চোখের পানিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বিধায় উম্মতের প্রতি তাঁর দরদ কী পরিমাণ; যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তারাই তা কিছুটা অনুধাবন করতে পারেন। প্রকাশের ভাষা অধমের নেই। মহান আল্লাহর দরবারে শুধু এই দুআ করি যে, হে দয়াময় আল্লাহ! আপনি আমাদের হজরতজীর বরকতময় ছায়াকে এ এতিম-উম্মতের জন্য আরো সুদীর্ঘ করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
বক্ষমান পুস্তিকাটি হযরতজীর একটি বহুল প্রচলিত বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ। বর্তমান উম্মতের কাছে অবহেলিত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ‘পর্দা’ সম্পর্কে এখানে আলোচিত হয়েছে। বিষয়টির ব্যাপক আবশ্যকতা অনুধাবন করে অধম এর তরজমা করে আপনাদের খেদমতে পেশ করেছি। দুআ করি, দুআ চাই। আল্লাহ যেন ইখলাস দান করেন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
ভুলত্রুটি হওয়াটা স্বাভাবিক। যা কিছু ভুল পাবেন, তা অধমের দুর্বলতা; মূল লেখকের নয়। তাই শুধরে দিলে দুআ করব। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সকলকে গুনাহমুক্ত জীবন দান করুন। আমীন। ছুম্মা আমীন।
সূচিপত্র
সতরের প্রেক্ষাপট
হিজাবের প্রেক্ষাপট
সতর ও হিজাবের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য
হিজাবের পক্ষে প্রমাণসমূহ
এক. কুরআনমজিদ থেকে প্রমাণাদি
দুই. হাদীসেপাক থেকে প্রমাণাদি
তিন. যৌক্তিক প্রমাণাদি
শরঈ পর্দার তিনটি স্তর
এক. উত্তম স্তর : ঘরে অবস্থান করা
দুই. মধ্যমস্তর : বোরকা দ্বারা পর্দা
তিন. নিম্নস্তর : ঠেকার পরিস্থিতির পর্দা
চেহারার পর্দা
কিছু অভিযোগ
পর্দাহীনতার করুণ পরিণতি
পাতলাপোশাকের ব্যবহার
পর্দাহীন নারীর সাজা
পর্দাপালনের বরকত
الله الله الله
بسم الله الرحمن الرحيم
আল্লাহতাআলা মানবজাতিকে সৃষ্টির সেরা বানিয়ে বুদ্ধির আলো দান করেছেন। এই সুস্থবুদ্ধির কারণেই মানুষ এবং জীবজন্তুর জীবনের মাঝে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। পানাহার ও জৈবিকচাহিদাজাত কাজে মানুষ এবং জীবজন্তু অভিন্ন। ঘর বানিয়ে বসবাস করার ক্ষেত্রেও বিশেষ কোনো ব্যবধান নেই। মানুষের প্রয়োজন বেশি তাই তাদের দরকার হয় বসবাস করার সুযোগসমৃদ্ধ আকাশচুম্বি ইমারতের। পক্ষান্তরে জীবজন্তুর জীবন সাদামাঠা। এজন্য তাদের বসবাসের স্থান হয় অতিসাধারণ। চড়ুইপাখি নীড় তৈরি করে বসবাস করে। সাপ বাস করে গর্তে। বাঘ থাকে গুহায়।
বাকি থাকে একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাসের প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রে জীবজন্তু মানুষ থেকে পিছিয়ে নয়। পিঁপড়ার জীবনে ঐক্য ও সমতার চমৎকার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। মৌমাছির জীবনে রাজকীয় ঠাঁটবাট অসমান্য। পাখির জীবনে আছে যিকির ও ইবাদত। কিন্তু একটি বিষয় এমন আছে, যার কারণে অন্যান্য প্রাণির তুলনায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে। তা হল, লজ্জা ও শালীনতাবোধের গুণ। এই গুণের কারণে মানুষ পবিত্র জীবনযাপন করে। পদে পদে আপন ¯্রষ্টার আনুগত্য করে। গুণটির দাবী হল মানুষ অন্যের সামনে আসবে লজ্জাস্থান আবৃত করে। মানুুুষসৃষ্টির ইতিহাসও এই বাস্তবতার প্রতি ইঙ্গিত করে। হযরত আদম আলাইহিসসালাম ও তাঁর স্ত্রীকে জান্নাতে পোশাক দেওয়া হয়েছিল। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তাঁদের জান্নাতি-পোশাক খুলে নেওয়া হয়েছিল। তখন তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের গোপনাঙ্গ গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে নিয়েছিলেন। আল্লাহতাআলা বলেন,
وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَّرَقِ الْجَنَّة
‘এবং তারা জান্নাতের পাতা দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। (সূরাআরাফ : ২২)
সতরের প্রেক্ষাপট:
শরীরের গোপন অংশ আবৃত করার জন্য আরবিতে ‘আওরাত’ ফার্সিতে ‘সতর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। আদমসন্তানেরা সেই পাথরযুগ থেকেই নিজেদের সতর ঢেকে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যখন বুদ্ধি ও অনুভূতিতে সমৃদ্ধতা এসেছে এবং মানুষ সামাজিকতা ও শিষ্টাচারের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেছে তখন পাশাপাশি তাদের পোশাকেও আরও বেশি শালীনতা ও শিষ্টাচার প্রস্ফুটিত হয়েছে। এমনকি পৃথিবীর সকল ধর্ম মানুষকে শালীন পোশাক পরিধানের শিক্ষা দিয়েছে। খৃস্টধর্মের প্রতি একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই ধর্ম নারীদেরকে কেবল সতরঢাকারই নির্দেশ দেয় নি, বরং এ ধর্মের নারীরা হাত-পা ও চেহারা ছাড়া শরীরের অবশিষ্ট পুরা অংশ কাপড় দ্বারা আবৃত করে রাখত। গির্জায় জীবনযাপনকারী খৃস্টাননারীদেরকে আজও এ জাতীয় পোশাকে আচ্ছাদিত দেখা যায়। বোঝা গেল, দেহের স্পর্শকাতর অংশসমূহ ঢেকে রাখা স্বভাব, বিবেক ও শরিয়ত সবদিক থেকেই জরুরি। সকল নবী-রাসূলের শরিয়তে এটাকে ফরজবিধানের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
হিজাবের প্রেক্ষাপট:
ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এ জন্য ইসলাম লজ্জাশীলতাকে ঈমানের অংশ হিসাবে সাব্যস্ত করেছে। লজ্জাশীলতার দাবি হল, সমাজ থেকে নগ্নতা ও অশ্লীলতা একেবারে মিটিয়ে দেয়া। ইসলাম ব্যভিচারকে হারাম সাব্যস্ত করে বলেছে, وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না।’
শরিয়তেমুহাম্মাদী কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতিকে নিজের স্বচ্ছ ঝর্ণধারা থেকে পরিতৃপ্ত করবে। তাই এখানে যেসব কাজ হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে, তার মাধ্যমসমূহকেও নিষিদ্ধ করে শয়তানের অনুপ্রবেশের দরজা-জানালা এমনকি ছিদ্রও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ-
-মদ ইসলামে হারাম। এজন্য তা তৈরি কেনা-বেচা ও কাউকে দেয়াও হারাম করা হয়েছে।
-সুদ হারাম। এ জন্য নিষিদ্ধপদ্ধতিতে উপার্জিত মুনাফাও সুদের মত ‘নাপাক’ বলা হয়েছে।
-শিরক হারাম করা হয়েছে। তাই ছবি ও মূর্তি বানানোও হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।
-ব্যভিচার হারাম। এ কারণে পরনারীকে দেখা, স্পর্শ করা, তার সঙ্গে যৌনালাপ করা এবং মনে মনে তার কল্পনা করাকেও হারাম হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
প্রমাণিত বাস্তবতা হল, পর্দাহীনতার কারণেই ব্যভিচার হয়। এ জন্যই ইসলাম নারীদেরকে হিজাব তথা পর্দার নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র আত্মার অধিকারীরা তো পর্দার গুরুত্ব নিজেরাই অনুভব করেছেন। পঞ্চম হিজরীতে হযরত উমর রাযি. নবীজী ﷺ-এর কাছে নিবেদন করলেন,
يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ اِنَّ نِسَآءَكَ يَدْخُلُ عَلَيْهِنَّ الْبِرُّ وَ الْفَاجِرُ فَلَوْ حَجَبْتَهُنَّ فَاَنْزَلَ اللهُ ايَةَ الْحِجَابِ.
‘ওগো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার স্ত্রীদের কাছে ভালো-মন্দ সব ধরনের লোক আসে। যদি তাদেরকে পর্দার বিধান দিতেন! এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহতাআলা পর্দার আয়াত নাযিল করেন।’ (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)
মুফতি শফী রহ. মাআরিফুলকুরআনে লিখেছেন, পর্দা সম্পর্কে কুরআনে সাতটি আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সত্তরটি হাদীস রয়েছে। পর্দা পালনের দ্বারা উদ্দেশ্য হল, নারীরা যথাসম্ভব ঘরে থাকবে। বিশেষ প্রয়োজনে বের হতে হলে শরীর ও সৌন্দর্য বোরকা ও ওড়না দ্বারা এমনভাবে ঢেকে রাখবে যাতে কোনোভাবেই পরপুরুষের সামনে প্রকাশ না পায়।
সতর ও হিজাবের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য:
সুতরাং সতর অর্থাৎ গোপনাংশ আবৃত রাখা এবং হিজাব তথা পর্দাপালন করা দু’টি ভিন্ন বিষয়। উভয়ের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য হল-
- সতর ঢেকে রাখার বিধান সকল শরিয়তে ফরজ বা অবশ্যপালনীয়। পক্ষান্তরে পর্দার বিধান উম্মতেমুহাম্মাদির জন্য পঞ্চম হিজরিতে দেয়া হয়েছে।
- সতর ঢেকে রাখা লোকচক্ষুর আড়ালে ও সামনে সর্বাবস্থায় জরুরি। পক্ষান্তরে পর্দা নারীর জন্য পরপুরুষের সামনে জরুরি।
- সতর ঢেকে রাখা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য জরুরি। পক্ষান্তরে পর্দার বিধান শুধু নারীদের জন্য ফরজ।
- সতর ঢেকে রাখা লজ্জাশীলতার প্রথমস্তর। পক্ষান্তরে নারীদের পর্দা লজ্জা ও শালীনতার চূড়ান্তধাপ।
হিজাবের পক্ষে প্রমাণসমূহ:
বর্তমানের যুগটা বিজ্ঞানের যুগ। একদিকে বস্তুবাদের উৎকর্ষ তুঙ্গে পৌঁছেছে, অপরদিকে নগ্নতা ও অশ্লীলতার তুফান চলছে। পাশ্চাত্যসভ্যতার দাপটে ফ্যাশনপূজা ও বেহায়াপনা ব্যাপক হয়ে পড়েছে। ইউনিভার্সিটি ও কলেজপড়–য়া মেয়েরা পর্দাকে গুরুত্বহীন ভাবতে শুরু করেছে। এজন্য পর্দার গুরুত্ব ও আবশ্যকতা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পেশ করা প্রয়োজন।
এক. কুরআন মজিদ থেকে প্রমাণাদি:
এক. আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى
‘আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে এবং জাহিলিয়াতযুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’(সূরাআহযাব : ৩৩)
আয়াতটিতে নারীদেরকে সাধারণ অবস্থায় ঘরে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঘরের চারদেয়ালে অবস্থান করে নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করবে। শরীয়ত নারীদের ওপর এমন দায়িত্ব আরোপ করে নি, যার কারণে তাদের চারদেয়ালের বাইরে যেতে হয়। প্রয়োজনের সময় তো ‘অপরাগতা’ কিংবা ‘ঠেকায় পড়া’র মধ্যে পড়ে। তাছাড়া নারীরা যত বেশি ঘরে থাকে তত বেশি আল্লাহতাআলার ঘনিষ্ঠ হতে পারে। হাদীসে আছে,
اَقْرَبُ مَا تَكُوْنُ مِنْ وَجْهِ رَبِّهَا وَهِىَ فِىْ قَعْرِ بَيْتِهَا
‘নারী নিজ প্রভুর সবচে’ নিকটতম তখন হয় যখন সে নিজের ঘরের মাঝে লুকিয়ে থাকে।’ (ইবনু খুযাইমা, ইবনু হিব্বান)
তাবারানী শরীফের এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
لَيْسَ لِلنِّسآءِ نَصِيْبٌ فىْ الْخُرُوْجِ اِلَّا مُضْطَرَّةٌ
‘নারীরা কেবল শরঈ-প্রয়োজন দেখা দিলে বাইরে বের হবে।’ (তাবারানী, আলজামিউসসগির)
সুতরাং খুব বেশি প্রয়োজন পড়লে নারীদের ঘর থেকে বের হওয়া জায়েয। আরবীতে প্রবাদ আছে,لَا تُحْفَظُ الْمَرْأَةُ اِلَّا فِىْ بَيْتِهَا‘নারীরা আপন ঘর ছাড়া কোথাও নিরাপদ নয়।’
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পবিত্র স্ত্রীগণ সাধারণ অবস্থায় ঘরের চারদেয়ালের ভেতরে থাকতেন, সফরের সময় অবস্থানগ্রহণ করতেন তাবুতে। ‘ইফকের’ ঘটনা ঘটার অন্যতম কারণ ছিল, সাহাবায়েকেরাম ভেবেছিলেন হযরত আয়েশা রাযি. উটের হাওদার ভেতরে আছেন। অথচ তিনি ছিলেন হারানো হারের খোঁজে প্রাকৃতিকপ্রয়োজন পূরণ করার স্থানে। আলোচ্যে আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, প্রথম জাহিলিয়াতযুগের মত পর্দাহীনতার প্রদর্শন করবে না। আশ্চর্যের বিষয় হল, ইসলামের সূচনাকালে প্রথম জাহিলিয়াত তথা অন্ধকারযুগের কারণে পর্দাহীনতা ছিল। বর্তমান যুগ দ্বিতীয় জাহিলিয়াত। দ্বিতীয় অন্ধকারযুগ। এযুগের কারণেও পর্দাহীনতার প্রচার-প্রসার ব্যাপকহারে আছে। কিছু ইংরেজিশিক্ষায় শিক্ষিত নারী তো পর্দার বিরোধিতা করে নিজেদেরকে ‘শিক্ষিতমূর্খ’ হিসাবে প্রমাণ দেয়।
দুই. আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرآءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ.
‘যখন তোমরা তাঁদের কাছে কিছু চাও, পর্দার অন্তরাল থেকে চাও। এই বিধান তোমাদের ও তাঁদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র।’ (সূরা আহযাব : ৫৩)
আলোচ্য আয়াতে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, সাহাবায়েকেরাম নবীজীর স্ত্রীদের কাছ থেকে কিছু চাওয়ার প্রয়োজনে তাঁদের কাছে গেলে যেন পর্দার আড়াল থেকে চায়। অর্থাৎ মনে করুন, যদি দেয়ালের পর্দা না থাকে তাহলে অন্তত চাদরের পর্দা যেন থাকে। সামনাসামনি জায়েয নেই। এখানে একটি বিষয় নেহায়েত গুরুত্বপূর্ণ। তাহল, একদিকে সাহাবায়েকেরামের মত হৃদয়প্রাচুর্যের অধিকারী মহান পুরুষগণ, অপরদিকে রয়েছে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পবিত্র স্ত্রীগণের মত সতী-সাধবী নারীগণ। তা সত্তেও পর্দার আড়াল থেকে কথাবার্তা ও কিছু দেয়া নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পরিষ্কার ভাষায় বলা হচ্ছে, এটা তোমাদের ও তাঁদের অন্তরের পবিত্রতার জন্য উত্তম।
তিন. আল্লাহ তাআলা বলেন,
يآ أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسآءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ
‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলে দিন, তারা যেন নিজেদের চাদর টেনে নেয়।’ (সূরা আহযাব : ৫৯)
جَلَابِيب শব্দটি আরবিভাষায় جِلْبَاب এর বহুবচন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ওই চাদর যা মহিলারা বক্ষদেশ ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহার করে। مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ দ্বারা উদ্দেশ্য চাদরের কিছু অংশ দ্বারা চেহারাও ঢেকে নিবে। ফলে লোকেরা বুঝতে পারবে যে, ইনি ভদ্রমহিলা। একে উত্যক্ত করা যাবে না। অর্থাৎ কোনো মুনাফিক ও বখাটে তার প্রতি চোখ তুলে দেখবে না।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. বলেন, ‘মুসলিমনারীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা নিজেদের মাথা ও চেহারা চাদর দ্বারা ঢেকে নেয়। শুধু চোখ খোলা রাখবে, যাতে হাঁটাচলায় কোনো সমস্যা না হয়।’ বর্তমানের প্রচলিত বোরকা উক্ত চাদরেরই স্থলাভিষিক্ত।
চার. আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
‘তারা (নারীরা) যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত নিজেদের আবরণ প্রকাশ না করে।’ (সূরা নূর : ৩১)
অর্থাৎ নারীরা নিজেদের সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটাবে না, তবে যে অংশটুকু ঠেকাবশতঃ খোলা রাখতে হয়। زِيْنَةٌ দ্বারা উদ্দেশ্য ওই বস্তু যা দ্বারা মানুষ নিজেকে সজ্জিত করে। (অর্থাৎ অলঙ্কার ও পোশাক) اِلَّا مَا ظَهَرَ দ্বারা উদ্দেশ্য আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযি. এর মতে তৈরি পোশাক। এর প্রমাণ কুরআনের অন্য আয়াতে পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ
‘নাও তোমাদের সৌন্দর্য প্রত্যেক নামাযের সময়।’
আয়াতটিতে زِيْنَةٌ তথা সৌন্দর্য দ্বারা উদ্দেশ্য পোশাক। مَسْجِدٌ দ্বারা উদ্দেশ্য নামায। এই মর্মার্থ অনুযায়ী নারীরা নিজেদের পোশাক ও অলঙ্কার পরপুরুষের সামনে প্রদর্শনী করতে পারবে না। এ অবস্থায় মর্মার্থ পরিষ্কার। সাধারণ পোশাকের ওপর ব্যবহৃত ওড়না, চাদর, বোরকা ইত্যাদি উক্ত নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। এর দ্বারা প্রতীয়মান হল, দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রকাশ করা আরো শক্তভাবে নিষেধ। সুতরাং নারীদের সব ধরনের পোশাক পরপুরুষের সামনে থেকে আড়ালে রাখতে হবে। তবে বোরকাজাতীয় পোশাক পরপুরুষ দেখলে কোনো সমস্যা নেই।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. زِيْنَةٌ তথা সৌন্দর্য দ্বারা উদ্দেশ্য নিয়েছেন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সৌন্দর্য। সুতরাং আয়াতটির মর্মার্থ হবে, বিশেষ প্রয়োজন যেমন চিকিৎসার প্রয়োজনে ডাক্তারের সামনে অথবা পরিচয়প্রদানের প্রয়োজনে কিংবা সাক্ষীদানের প্রয়োজনে বিচারকের সামনে সৌন্দর্যের অংশ খোলার নিতান্ত প্রয়োজন হলে এটা হবে অপারগতা কিংবা ঠেকায় পড়া। এজাতীয় পরিস্থিেিত চেহারা ও হাতের কবজি পর্যন্ত খোলা জায়েয। উল্লেখ্য, এখানে ‘সৌন্দর্যের স্থান’ বলতে কেবল চেহারা ও কবজি উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, কোনো নারীর চেহারার দিকে তাকালে যদি কামশিহরণ সৃষ্টি হয় তখন ওই নারীর জন্য চেহারা ঢেকে রাখা এবং পুরুষের জন্য তার দিকে না তাকানো ফরজ।
পাঁচ. আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ اللَّاتِي لَا يَرْجُونَ نِكَاحًا فَلَيْسَ عَلَيْهِنَّ جُنَاحٌ أَنْ يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِينَةٍ وَأَنْ يَّسْتَعْفِفْنَ خَيْرٌ لَهُنَّ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ.
‘বৃদ্ধা নারী, যারা বিয়ের আশা রাখে না, যদি তারা সৌন্দর্যপ্রদর্শন না করে বহির্বাস (নেকাব) খুলে রাখে; তাদের জন্য কোনো অপরাধ নেই। তবে এ থেকে তাদের বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা নূর : ৬০)
যারা বিয়ের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে, যাদের দিকে তাকালে যৌনকামনা সৃষ্টি হয় না, এমন বৃদ্ধনারীর পর্দার ব্যাপারে শরিয়ত ছাড় দিয়েছে। যেসব পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হারাম তাদের সামনে যেসব অঙ্গ খোলা রাখার অনুমতি আছে, বৃদ্ধমহিলারা পরপুরুষের সামনে সেসব অঙ্গ খোলা রাখতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে আয়াতটিতে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে যে, যদি তারা সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। এটাও বলা হয়েছে, পরপুরুষের সামনে আসা থেকে বিরত থাকাটাই তাদের জন্য উত্তম। প্রসিদ্ধ প্রবাদ আছে, لِكُلِّ سَاقِطٍ لَاقِطٌ‘প্রতিটি পরিত্যক্তবস্তু ওঠানোর লোক কেউ না কেউ থাকে।’
ভাবনার বিষয় হল, বৃদ্ধমহিলার ক্ষেত্রে যদি এতটা সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়, তবে যুবতীদের পর্দার ক্ষেত্রে কী পরিমাণ সতর্ক ও সচেতন থাকা জরুরি।
ছয়. আল্লাহ তাআল বলেন,
الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
‘সম্পদ ও ছেলেসন্তান পার্থিবজীবনের সৌন্দর্য।’ (সূরা কাহফ)
আয়াতটিতে সম্পদ ও ছেলেসন্তানকে দুনিয়ার সৌন্দর্য বলা হয়েছে। মেয়েসন্তানকে এ থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। কারণ, মেয়ে গোপন রাখার জিনিস, প্রদর্শনী করার জিনিস নয়। এ থেকেও নারীদের পর্দায় থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং মুসলিমনারীদের উচিত পর্দাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। অন্তরে ভালোভাবে বসিয়ে নিন,
اَلْحِجَابُ! اَلْحِجَابُ!! قَبْلَ الْعَذَابِ
‘পর্দা! পর্দা!! শাস্তি আসার আগে।’
দুই. হাদীসেপাক থেকে প্রমাণাদি:
হাফেজ ইবনু কাসীর রহ. তাঁর তাফসিরগ্রন্থে লিখেছেন, সতী ও ব্যক্তিত্বমান নারীদের নিদর্শন হল, ঘোমটা। যাতে করে দুষ্টুপ্রকৃতির ফাসেকরা তাকে উত্যক্ত ও বিরক্ত করতে না পারে। হযরত ইবনু আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত,
اَمَرَ اللهُ نِسآءَ الْمُؤْمِنِيْنَ اِذَا خَرَجْنَ مِنْ بُيُوْتِهِنَّ فِىْ حَاجَتِهِنَّ اَنْ يُّغَطِّيْنَ وُجُوْهَهُنَّ مِنْ فَوْقِ رُءُوْسِهِنَّ بِالْجَلَابِيْبِ وَيُبْدِيْنَ عَيْنًا وَاحِدَةً
‘আল্লাহতাআলা মুমিননারীদের নির্দেশ দিয়েছেন, যখন তারা ঘর থেকে প্রয়োজনে বের হবে, তখন যেন নিজেদের চেহারা মাথার দিক থেকে চাদর-ওড়না দ্বারা ঢেকে নেয় এবং একটিমাত্র চোখ খোলা রাখে।’ (তাফসিরে ইবনুকাসীর ৩/ ৫১৯)
এর দ্বারা বোঝা গেল, পর্দাহীনতা ভদ্র, সতী ও আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন নারীর কাজ নয়।
এক. হাদীসে এসেছে,اَلْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ ‘নারী গোপনে থাকার জিনিস।’ সুতরাং পরপুরুষ থেকে আড়ালে রাখা নারীদের দায়িত্ব। যদি ঘরে অবস্থান করে আড়ালে থাকে তাহলে এটা সবচাইতে উত্তম। যাতে কোনো পরপুরুষ তার চালচলন ইত্যাদি মোটেই না দেখে। শরিয়তসমর্থিত প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে দেহ ও পোশাকের সাজসজ্জা চাদর ও বোরকা ইত্যাদি দ্বারা ঢেকে রাখবে। যাতে প্রবৃত্তির পূজারী কোনো পুরুষের দৃষ্টি না পড়ে এবং যেন সে এই নারীর ইজ্জত নষ্ট করার প্রোগ্রাম করতে না পারে।
দুই. হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবারের ঘটনা। আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ সাহাবায়েকেরামকে প্রশ্ন করলেন, مَا خَيْرٌ لِلنِّسآءِ؟ ‘নারীদের জন্য কোন জিনিস উত্তম?’ সাহাবায়েকেরাম চুপমেরে থাকলেন। কোনো উত্তর দিলেন না। ইত্যবসরে আমি ঘরে গিয়ে ফাতেমার কাছে অনুরূপ প্রশ্ন করলাম। তিনি উত্তর দিলেন, خَيْرٌ لَّهُنَّ اَنْ لَا يَرَيْنَ الرِّجَالَ وَلَا يَرَوْهُنَّ‘মহিলাদের জন্য উত্তম হল, তারা পুরুষদের দেখবে না এবং পুরুষরাও তাদের দেখবে না।’ আমি উত্তরটি নবীজীকে শোনালাম। তখন তিনি খুশি হয়ে বললেন,اِنَّهَا بِضْعَةٌ مِّنِّىْ ‘সে (ফাতেমা) তো আমার দেহের অংশ।’ (মাআরিফুল কুরআন ৭/ ১৬)
তিন. রাসূল ﷺ বলেছেন, اَلْحَيآءُ مِنَ الْاِيْمَانِ. ‘লজ্জা ঈমানের অংশ।’ পর্দার উদ্দেশ্য হল, লজ্জা। নারীপ্রকৃতিতেই লজ্জা আছে। নারী যখন প্রকৃতির পরিপন্থী কাজ করে তখন লজ্জাহীন হয়ে পড়ে। তখন সে লজ্জা-শালীনতাকে একপাশে রেখে দেয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, اِذَا لَمْ تَسْتَحْىِ اِعْمَلْ مَا شِئْتَ‘লজ্জা না করলে যা ইচ্ছে তা-ই করবে।’ (মিশকাত ৩/৩০৭)
এর দ্বারা বোঝা গেল, লজ্জাহীনতাই পর্দাহীনতার কারণ। আল্লাহ তাআলা কাউকে লজ্জার মত মহান নেয়ামত থেকে বিমুক্ত না করুন। আমীন।
চার. রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, اِنَّ الْمَرْأَةَ عَوْرَةٌ فَاِذَا خَرَجَتْ اِسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ‘নারী গোপনজিনিস, যখন সে ঘর থেকে বের হয় শয়তান তাকে চুপিসারে দেখে।’ (ইবনু কাসীর ৩/৪৮২)
শয়তান চুপিসারে দেখার দুই অর্থ হতে পারে। এক. শয়তান তাকে ঘর থেকে বের হতে দেখলে এই ভেবে আনন্দিত হয় যে, এখন তাকে পরপুরুষের প্রতি এবং পরপুরুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট করা সহজ হবে। শয়তান ওই নারীকে কুদৃর্ষ্টির জালে এবং পরপুরুষকে ওই নারীর জালে এভাবেই ফাঁসিয়ে ফেলে। দুই. কিছু লোক শয়তানপ্রকৃতির; প্রবৃত্তির পূজার মধ্যে জীবনযাপন করে। এরা নারীকে ঘর থেকে বের হলে কুদৃষ্টি দেয়। এই টাইপের দুষ্টু ও বখাটে লোকগুলো শয়তানের প্রতিনিধি হয়ে থাকে। এদের চুপিসারে দেখাটাকেই শয়তানের চুপিসারে দেখা বলা হয়েছে।
পাঁচ. প্রিয় নবী ﷺ বলেছেন, مَا تَرَكْتُ بَعْدِىْ فِتْنَةً اَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ مِنَ النِّسَآءِ‘আমার চলে যাওয়ার পর পুরুষদের জন্য নারীদের চেয়ে বড় ফেতনা আমি দেখি নি।’ (মুত্তাফাক আলাইহি, মিশকাত, কিতাবুননিকাহ)
এর দ্বারা বোঝা গেল, পুরুষদের জন্য সবচে’ বড় পরীক্ষার নাম হল ‘নারী’। ফকিহগণ লিখেছেন, পর্দা ফরজ হওয়ার ভিত্তি হল ফেতনা, এজন্য বৃদ্ধনারী যাদেরকে দেখলে যৌনকামনা সৃষ্টি হয় না, তাদের চেহারার পর্দার ব্যাপারে ছাড় দেয়া হয়েছে। সৃষ্টিজাত কারণেই যুবতীদের প্রতি পুরুষদের আকর্ষণ বেশি প্রবল হয়, সুতরাং যুবতীদের পর্দা করা বেশি জরুরি। কোনো মহিলা বিশেষ কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে চাইলে পর্দার সাথে বের হওয়া আবশ্যক, যাতে শয়তান পরপুরুষকে ফেতনায় ফেলতে না পারে।
ছয়. ইমাম আহমাদ রহ. হযরত আয়েশা রাযি. সূত্রে বর্ণনা করেন,
كُنْتُ اَدْخُلُ بَيْتِىَ الَّذِىْ فِيْهِ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ وَ اِنِّىْ وَاضِعٌ ثَوْبِىْ وَاَقُوْلُ اِنَّمَا هُوَ زَوْجِىْ وَاَبِىْ (مَدْفُوْنَانِ فِيْهِ)
‘নবীজী ﷺ-কে যে কক্ষে দাফন করা হয়েছে, আমি যখন সেখানে প্রবেশ করতাম, তখন আমার চাদর রেখে দিতাম। ভাবতাম, এখানে তো শুধু আমার স্বামী ও বাবা (দাফনকৃত) রয়েছেন। কিন্তু যখন উমর রাযি.কে দাফন করা হল, তখন আল্লাহর শপথ! তাঁকে লজ্জার কারণে খুব ভালোভাবে পর্দা করে নিতাম।’
এ থেকে পর্দার গুরুত্ব অনুমান করা যায়। হযরত আয়েশা রাযি. তো কবরে দাফনকৃত ব্যক্তি থেকেও পর্দা করেছেন। অথচ বর্তমানের পর্দাহীন নারীরা জ্যান্ত-পুরুষের সামনেও পর্দা করে না। ধার্মিকনারীদের জন্য আয়েশা রাযি. এর আমলটিতে রয়েছে আলোর মিনার।
সাত. হাদীস শরীফে রয়েছে,
وَكَانَتْ حَفْصَةُ وَعَائِشَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا يَوْمًا عِنْدَ النَّبِىِّ ﷺ جَالِسَتَيْنِ فَدَخَلَ اِبْنُ أُمِّ مَكْتُوْمٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ فَقَالَ النَّبِىِّ صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِحْتَجِبَا مِنْهُ. فَقَالَتَا يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ اَلَيْسَ هُوَ اَعْمى لَا يُبْصِرُنَا وَلَا يَعْرِفُنَا فَقَالَ اَفَعَمْيَاوَانِ اَنْتُمَا اَلَسْتُمَا تُبْصِرَانِه.
‘একবার উম্মত জননী হাফসা ও আয়েশা রাযি. নবীজী ﷺ-এর কাছে বসা ছিলেন। ইত্যবসরে আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মেমাকতুম রাযি. প্রবেশ করলেন। তিনি অন্ধ সাহাবী ছিলেন। নবীজী ﷺ উভয়কে বললেন, পর্দা কর। তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল ﷺ! ইনি কি অন্ধ নন? আমাদেরকে দেখেন না, চেনেনও না। তখন নবীজী ﷺ বললেন, ‘তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখছ না?’ (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, যাহাবীকৃত আলকাবাইর, পৃষ্ঠা : ১৮৮)
পর্দার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এরচেয়ে স্পষ্ট ও বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে!
তিন. যৌক্তিক প্রমাণাদি:
এক. জনৈক বুযুর্গ লাহের থেকে জ্যাকববাদে রেলপথে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে স্যুট-কোট পরা এক যুবক ওঠল। কিছুক্ষণপর যুবকটি বুযুর্গকে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি একজন দীন- ইসলামের আলেম। অনুমতি হলে আপনাকে প্রশ্ন করতে পারি কি? বুযুর্গ উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, প্রশ্ন কর। যুবক প্রশ্ন করল, ইসলাম নারী-পুরুষকে একসাথে কাজ করার অনুমতি দেয় না কেন? বুযুর্গ কুরআন-হাদীসের আলোকে প্রশ্নটির বেশ কয়েকটি উত্তর পেশ করলেন, কিন্তু যুবকটির মন আশ্বস্ত হল না। সে বলল, আপনি আমাকে যুক্তি দিয়ে বিষয়টি বোঝান। তখন বুযুর্গ বোঝালেন, নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করলে একে অপরের প্রতি আসক্ত হবে। যার কারণে অনেক আনন্দঘন সংসার ভেঙ্গে যাবে। কুমারীমেয়েরা বিয়ে ছাড়াই মা হয়ে যাবে। সমাজের কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে। যুবক বলল, যদি মানুষ নিজের মনকে কন্ট্রোল করে চলে তাহলে সহশিক্ষা ও একসঙ্গে চাকরির মধ্যে সমস্যা কোথায়? যুবকের কথায় বুযুর্গ বুঝে নিলেন, সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠবে না। আঙ্গুল বাঁকা করতে হবে। যুবক তো দেখি বুদ্ধির দিক থেকে অন্ধ। বিবেকে তালা পড়ে আছে। সুতরাং একে অন্যভাবে বোঝাতে হবে। বুযুর্গের ব্যাগে লেবু ছিল। লেবুটি বের করে চার টুকরো করলেন এবং চুষতে লাগলেন। তখন ছিল গ্রীস্মকাল। যুবক প্রচÐ গরমে হাঁপিয়ে ওঠেছিল এবং বুযুর্গের লেবুচোষার দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। বুযুর্গ বললেন, কী দেখছ? যুবক উত্তর দিল, লেবু দেখে মুখে পানি চলে এসেছে। এবার বুযুর্গ বললেন, এখন তোমার মন কন্ট্রোল করার বিষয়টির কী হয়েছে? যেমনিভাবে লেবু দেখলে মুখে পানি চলে আসে, অনুরূপভাবে যুবকরা পরনারীকে দেখলে তাদের অন্তরে গুনাহর চিন্তা চলে আসে। এটাই ব্যভিচারের কারণ হয়। ইসলামধর্ম এই মন্দপথটিকে বন্ধ করে দেয়ার লক্ষে নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছে, প্রথমত ঘরেই অবস্থান কর। দ্বিতীয়ত একান্ত প্রয়োজনে বাইরে যেতে হল পর্দাসহ যাও। যেন পরপুরুষের দৃষ্টি না পড়ে এবং কোনো বিপদে পড়তে না হয়। বুযুর্গের কথা শুনে যুবক লজ্জায় মাথা নত করে নিল।
দুই. যদি কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয় এক লাখ টাকা একশহর থেকে অন্যশহরে কারো কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তখন সে প্রথমত পটেকমারের ভয় করবে যে, আমার পকেট থেকে টাকাগুলো উধাও হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া চোর-ডাকাত জানতে পারলে টাকা তো যাবেই, পাশাপাশি প্রাণ হারানোর আশঙ্কাও আছে। সুতরাং ব্যাংক ইত্যাদির মাধ্যমে ট্রান্সফার করে দিলেই ভালো হয়, যাতে কেউ টের না পায়। এরপরও যদি সে সশরীরে পৌঁছিয়ে দিতে বাধ্য হয় তাহলে টাকাগুলো সে গোপন পকেটে বা স্থানে রেখে গোটা রাস্তায় টেনশনে থাকবে। এমনটি মোটেও হবে না যে, সে টাকাগুলো বের করে স্টেশনের মানুষগুলোর সামনে নাচাবে। কারণ, এটা হবে বোকামিপূর্ণ আহŸান যে, আসো, আমার টাকাগুলো লুটে নাও।
অনুরূপভাবে একজন সতীনারী ঘরের বাইরে যাওয়ার আগে প্রথমত শঙ্কাবোধ করে যে, আমি খামোখা বাইরে যাব কেন। এরপরেও যদি সে ঠোকাবশতঃ বাইরে যায় তাহলে পর্দার সঙ্গে যায় এবং সারাপথ দুশ্চিন্তায় থাকে যে, কোনো দুষ্টপ্রকৃতির লোক আমার পেছনে যেন না লাগে। এটা মোটেও হতে পারে না যে, সে পরপুরুষদের সামনে নিজের রূপ-সৌন্দর্য প্রকাশ করবে এবং নিজের ইজ্জত হুমকির মুখে ফেলে দিবে। যদি কোনো বখাটেলোকের কুদৃষ্টি পড়ে তাহলে যেন সম্ভ্রমের ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করতে না পারে। যেসব মেয়ে ফ্যাশন করে পর্দাহীনভাবে বাজারে মার্কেটে ঘুরঘুর করে তাদের সম্ভ্রমহানির ঘটনা প্রতিদিনের সংবাদপত্রগুলোর ‘চাটনি’ হয়। তারা অন্যদেরকে তামাশা দেখাতে দেখাতে নিজেরাই অন্যদের তামাশার পাত্র বনে যায়।
তিন. কসাইয়ের দোকান থেকে কয়েক কেজি গোশত কেনার পর তা থলের ভেতরে ঢুকিয়ে বাড়িতে নেয়া হয়। প্লেটে কিংবা মাথায় করে গোশত নেয়ার ঘটনা কখনও ঘটে না। কারণ এতে চিল, কাক গোশত ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনুরূপভাবে পঞ্চাশ কেজি ওজনের একটি মেয়ে যদি ঘর থেকে বেপর্দা অবস্থায় বের হয়, তাহলে মানুষরূপী হায়েনাগুলো তার আশেপাশে ঘুরঘুর শুরু করে। অনেক সময় তো এরা গোটা পঞ্চাশ কেজিকেই গায়েব করে দেয়। এজন্য সতীনারীরা পর্দায় আবৃত হয়ে বের হন। যাতে তার জান-মাল, ইজ্জত-আব্রæর ওপর কোনো হায়েনা হামলে পড়তে না পারে। ভাবনার বিষয় হল, যারা নিজেদের মেয়েদেরকে বেপর্দা অবস্থায় ছেড়ে দেয় তাদের কাছে মেয়ের মূল্য কি কয়েক কেজি গোশতের সমানও নয়! দুঃখজনক ব্যাপার হল, পাখি গোশত নিয়ে গেলে ক্ষতি হয় অতিসামান্য, যার ক্ষতিপূরণ অসম্ভব নয়। পক্ষান্তরে মেয়ের ইজ্জত নিয়ে গেলে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া আদৌ সম্ভব নয়। তখন হয়ত মনে মনে বলে ওঠবে,
اب پچهتاۓ كيا ہوت
جب چڑ يا ں چك گئ كهيت
‘এখন আফসোস করে লাভ কী,
চড়ুইগুলো ক্ষেততো উজাড় করে ফেলেছে।’
চার. আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মানুষকেই আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছেন। পরপুরুষ তার ঘরের মহিলাদের প্রতি কুদৃষ্টি দেয়াকে সে একদম সহ্য করতে পারে না। কোনো পরপুরুষ তার আপন কোনো নারীকে উত্যক্ত করতে দেখলে সে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। নখ-দাঁত খিচিয়ে মারামারি করার জন্যও উদ্যত হয়। এমনও ঘটনা ঘটে যে, এর জের ধরে স্বামী স্ত্রীকে, পিতা মেয়েকে, ভাই বোনকে, ছেলে মাকে হত্যা করে বসে। এ জাতীয় ঘটনা আমরা প্রতিদিনই সংবাদপত্রে পড়ি। সুতরাং একজন নারীর পর্দাহীনতা কয়েকটি পরিবারের সম্মানকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারে। অতএব মানুষের সৃষ্টিজাত ও ঈমানী আত্মমর্যাদাবোধের দাবি হল, নারী পর্দার সঙ্গে বের হবে এবং পুরুষ নিজের দৃষ্টিকে নামিয়ে রাখবে, যেন সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে না পড়ে।
পাঁচ. রাসূলুল্লাহ ﷺ নারীদের সম্পর্কে বলেছেন, نَاقِصَاتُ الْعَقْلِ وَالدِّيْنِ‘বুদ্ধিমত্তা ও দীনের দিক থেকে অসম্পূর্ণ।’ (মিশকাত ১/১৪)
নারীদের স্বভাব হল, তারা সাধারণত ফেঁসে যায় তাড়াতাড়ি, ফাঁসিয়েও দেয় তাড়াতাড়ি। নারী অনেক নামি-দামি, জ্ঞানী-গুণীর বিবেকেও সহজেই আবরণ ফেলে দিতে পারে। নারীরা আবেগপ্রবণ হওয়ার কারণে তড়িৎগতিতে তাদের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসে। এ জন্য পবিত্র শরিয়ত তালাকের অধিকার পুরুষদেরকে দিয়েছে। ধরে নেয়া যাক, যদি এ অধিকার নারীকে দেয়া হত, তাহলে দিনে সত্তরবার তালাক পড়ত, আবার সত্তরবার তা ফেরত নেয়া হত। নারীরা কারো ওপর সন্তুষ্ট হলে সবকিছু তার জন্য বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হয় না। আবার অসন্তুষ্ট হলে তার জিন্দামুখও দেখতে চায় না। ঘরের ভেতরে বাড়াবাড়িও নিজে করে, আবার বাইরে নিজেকে নির্যাতিত হিসাবে পেশ করে। একটা কাজ করতে মনে মনে আগ্রহী থাকে, কিন্তু যবানে ‘না-না’ বলে। পান থেকে চুল খসলে স্বামীর সারাজীবনের মায়া-মমতার ওপর পানি ঢেলে দেয়। বলে বসে, আমি তোমার সংসারে এসে কী-ই বা দেখেছি, সব নিজের জন্য করছ, আমার জন্য কিছুই না। মামুলি বিষয়েও অভিশাপের ঝাঁপি খুলে বসে। দুর্বল হলে নিজের মরার প্রার্থনা শুরু করে। সম্পদের প্রতি ভালোবাসা অতিরিক্ত প্রবল। গোস্বা ও হিংসার আগুনে জ্বলে-পুড়ে ভূনা-কাবাব হয়ে যায়। এতটাই ফ্যাশনপ্রিয় যে, নিজের পোশাকের মত আরেকজনের পোশাক না হওয়ার কামনা করে। প্রশংসা শুনলে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। শত্রæকে বন্ধু এবং বন্ধুকে শত্রæ মনে করে বসে। স্বভাবের এহেন অস্থিরতার কারণে বলা হয়, নারীর বুদ্ধিমত্তা পরিপূর্ণ নয়; অপূর্ণ। সুতরাং তার জন্য ঘরের চারদেয়ালেই শ্রেয়। বাইরে বের হতে চাইলে পর্দার সাথে বের হবে। মাহরামের সঙ্গে বের হবে। যাতে সে কারো ঈমান নষ্ট না করে এবং কেউ তার সম্ভ্রম নষ্ট না করে।
শরঈ পর্দার তিনটি স্তর:
কুরআন মজিদের বিভিন্ন আয়াত মন্থন করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শরঈ পর্দার তিনটি স্তর রয়েছে। প্রথমটি সবচে’ উত্তম স্তর। দ্বিতীয়টি মধ্যম স্তর। তৃতীয়টি নিম্নস্তর। বিভিন্ন নারীর জন্য বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এর কোনো না কোনোটির ওপর আমল করা অপরিহার্য। শরিয়ত মানুষের অবস্থার কথা বিবেচনা করে এক্ষেত্রে কিছু অবকাশ বা সুযোগ রেখেছে। পর্দার মূল বুনিয়াদ হল, ফেতনা নির্মূল করা। পর্দার ব্যাপারে যতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করলে ফেতনা থেকে বাঁচা যায় ততটুকু অবলম্বন করাই অধিক নিরাপদ।
এক. উত্তম স্তর-ঘরে অবস্থান করা :
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وَقَرْنَ فِىْ بُيُوْتِكُن‘তোমরা নিজেদের ঘরে অবস্থান কর।’ সুতরাং নারীদের জন্য পর্দার সবচে’ উত্তম পদ্ধতি হল, ঘরের চারদেয়ালের ভেতরে সময় অতিবাহিত করবে। নিজের ঘরকে জান্নাত মনে করবে। নারীরা ঘরকন্নার কাজ, যিকির ও ইবাদত থেকে ফারেগ হওয়ার পর ঘরের বারান্দায় খেলাধুলা করতে পারে। মেয়েরা কানামাছি, দড়ি লাফালাফি, দোলনায় দোল খাওয়া, টুকটাক ব্যায়াম, ট্রেডমল মেশিনে দৌড়জাতীয় খেলাধুলা করতে পারে। বারান্দা ছোট হলে ছাদে পর্দার ব্যবস্থা করে এগুলো করা যেতে পারে। এতে একটু ব্যায়ামের সুযোগও হবে এবং নিজেদের রমণীয়জগতে মগ্নও থাকতে পারবে। এতে কোনো ভয় নেই, টেনশন নেই। শরঈসীমানায় থেকে শরীরচর্চার প্রয়োজনও পূরণ করতে পারবে। বেশিরভাগ মহিলাই ঘরদোড় ঝাড়– দেয়া, গোছগাছ করা, কাপড়-চোপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, রান্নাবান্না করা, পয়-পরিষ্কার ইত্যাদি গৃহস্থালি কাজগুলো করার পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত ব্যায়ামের প্রয়োজনই অনুভব করে না। সুতরাং বোঝা গেল, ঘরে অবস্থান করেই তাদের অধিকাংশ প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায়। যেসব নারী সবকাজ পর্দাপালনের নিয়তে ঘরের ভেতরেই সেরে নেয়, এরা ওলির মর্যাদা ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুযোগ লাভকারী হয়।
দুই. মধ্যম স্তর-বোরকা দ্বারা পর্দা:
ঠেকাবশতঃ বাইরে যেতে হলে বোরকা বা চাদর দ্বারা ভালোভাবে আচ্ছাদিত হয়ে বের হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, يُدْنِيْنَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيْبِهِنَّ‘তারা যেন নিজেদের চাদর জড়িয়ে নেয়।’
এই যুগের পর্দানশীন নারীরা বোরকা পরে শরীর ঢেকে নেয়। মোজা পরিধান করে হাত-পায়ের সৌন্দর্য ঢেকে নেয়। কিছু কিছু এলাকায় শাটলককের বোরকা ব্যবহার করা হয়। এগুলো সবই আলোচ্য আয়াতে উল্লেখিত ‘জিলবাবের’র অন্তর্ভুক্ত। এরূপ বোরকা পরিধানের কারণে গঠনাকৃতি, অবয়ব পরপুরুষ কিছুটা অনুমান করতে সক্ষম হলেও যেহেতু রূপ-সৌন্দর্য গোপন থাকে, তাই ফেতনার আশঙ্কা কম থাকে। এক্ষেত্রে একটি সতর্কতা জরুরি তা হল, বোরকা এতটা ডিজাইনেবল যেন না হয় যে, কেউ দেখলে মনে করবে, ভেতরে হয়ত ‘হূরের সন্তান’ আছে। বর্তমানের পুরুষদের লোভাতুর দৃষ্টি শরীরের কোথাও না পড়লেও হাত-পা দেখেই সৌন্দর্যের পরিমাপ করে ফেলে। এজন্য হাত-পা ঢেকে রাখার প্রয়োজন আছে। এটা পর্দার মাধ্যমস্তর। এ স্তরের ওপর যারা আমল করে তাদেরকেও তাকওয়ার ওপর আমলকারীণী হিসাবে গণ্য করা হবে।
তিন. নিম্নস্তর-ঠেকার পরিস্থিতির পর্দা:
পর্দার সর্ব নিম্নস্তর হল, নারী ঠেকায় পড়ে ঘর থেকে বের হওয়া এবং চাদর বোরকা ওড়না এমনভাবে পরিধান করা যে, অপারগতার কারণে তার হাত-পা চেহারা খোলা থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا يُبْدِيْنَ زِيْنَتَهُنَّ اِلَّا مَاظَهَرَ مِنْهَا‘তারা নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। তবে যা এমনিতেই প্রকাশ পেয়ে যায়।’
নারীদের জন্য জায়েয নেই তাদের সৌন্দর্যের কোনো কিছু পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করা। তবে এমনিতেই প্রকাশ পেয়ে গেলে ভিন্ন কথা। অর্থাৎ কাজকর্ম, চলফেরা ইত্যাদির সময় যা কিছু সাধারণত খুলে যায় এবং এ জাতীয় পরিস্থিতিতে যা ঢেকে রাখাটা সমস্যার কারণ হয়, তা দেখা গেলে কোনো গুনাহ নেই। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, হাতের তালু ও চেহারা। তবে তা কেবল ওই সময় যখন ফেতনার আশঙ্কা থাকবে না। যদি ফেতনার আশঙ্কা থাকে তাহলে ফকিহগণ এ ব্যাপারে একমত যে, চেহারা ও হাতের তালু খোলা রাখাও জায়েয নেই।
সুতরাং আয়াতটি দ্বারা এটা প্রমাণ হয় যে, লেনদেনের প্রয়োজনে নারী নিজের হাত-পা ও চোখ খোলা রাখলে কোনো গুনাহ হবে না। তবে আয়াতটি থেকে এটা মোটেও প্রমাণ হয় না যে, পুরুষের জন্য এসব অঙ্গ দেখা জায়েয। দৃষ্টি সংযত রাখার বিধান পুরুষদের বেলায় সবসময়ের জন্য। শরিয়তসমর্থিত প্রয়োজন ছাড়া নারীর হাত-পা চেহারা পুরুষরা দেখতে পারবে না।
চেহারার পর্দা:
বর্তমানে তথাকথিত কিছু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিদের পক্ষ থেকে এই অপপ্রচার করা হচ্ছে যে, ইসলামে পর্দার বিধান আছে, তবে চেহারার পর্দা এই বিধানের আওতায় পড়ে না। অথচ রূপ-সৌন্দর্যের মূল কেন্দ্রবিন্দুর নাম চেহারা। বর্তমান যুগ ফেতনা ফ্যাসাদ ও নৈতিকঅবক্ষয়ের যুগ। এই যুগে তো চেহারা ঢেকে রাখার প্রয়োজন বেশি। চিকিৎসা, আদালতে সাক্ষী দেয়া, পরিচিতি পেশ করাÑ এজাতীয় শরিয়তসম্মত জরুরত ছাড়া চেহারা খোলার অবকাশ নারীদের ক্ষেত্রে মোটেও নেই। এবিষয়ে কিছু প্রমাণ নিম্নে পেশ করা হল–
এক. কুরআন মজিদে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছেفَاسْئَلُوْهُنَّ مِنْ وَّرَآءِ حِجَابٍ ‘তাদের কাছে কিছু চাওয়ার থাকলে পর্দার আড়াল থেকে চাও’। এর মাধ্যমে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, চেহারা ঢেকে রাখাও জরুরি। চেহারা প্রকাশ করার সুযোগ যদি থাকত তাহলে পর্দার আড়াল থেকে কথাবার্তা বলার এই নির্দেশ অর্থহীন হত।
দুই. যখন يُدْنِيْنَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيْبِهِن ‘তারা যেন মাথার দিক থেকে নিজেদের ওপর ওড়না-চাদর টেনে দেয়।’ পর্দার এ আয়াত নাযিল হল, তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র স্ত্রীগণকে শিখিয়ে দেয়া হল, তারা যেন সাহাবায়েকেরামের কাছ থেকে নিজেদের চেহারা ঢেকে রাখেন। এটা কে বলতে পারবে যে, তাঁরা খোলা মাথায় (নাউযুবিল্লাহ) চলাফেরা করতেন, আর পর্দার আয়াত দ্বারা তাদেরকে মাথা ঢাকার নির্র্দেশ দেয়া হয়েছে! এটা কেউই বলতে পারবে না।
ইবনু আব্বাস রাযি. উক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন, আল্লাহ তাআলা মুসলিম নারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যখন তারা প্রয়োজনের তাগিদে বাইরে যাবে তখন তারা যেন মাথার ওপরের চাদর টেনে দিয়ে চেহারাও ঢেকে নেয়। (তাফসিরে ইবনু জারীর)
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু সীরিন রহ. উবাইদা ইবনু ফিয়ান ইবনুল হারেছকে জিজ্ঞেস করেছেন, উক্ত বিধানের ওপর আমল করার পদ্ধতি কী? তিনি চাদর জড়িয়ে বলে দিলেন এবং তখন তিনি নিজের কপাল, নাক ও একচোখ ঢেকে শুধু এক চোখ খোলা রেখেছিলেন। (প্রাগুক্ত)
তিন. আবু দাউদ, তিরমিযি, মুয়াত্তা প্রভৃতি হাদীসগ্রন্থে লেখা আছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ ইহরাম অবস্থায় মহিলাদেরকে চেহারা ঢাকা ও মোজা পরিধান থেকে নিষেধ করেছেন। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, ওই পবিত্রযুগে চেহারা ঢাকার জন্য নেকাব ও হাত ঢাকার জন্য হাতমোজা ব্যবহারের প্রচলন ব্যাপক ছিল।
চার. হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, আমরা নারীরা যখন ইহরাম অবস্থায় রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সঙ্গে থাকতাম এবং পুরুষরা আমাদের পাশ দিয়ে যেত তখন আমরা নিজেদের চাদর মাথার দিক থেকে চেহারার দিকে টেনে দিতাম। পুরুষরা চলে যাওয়ার পর মুখ খুলতাম। (আবু দাউদ)
পাঁচ. যাওয়াজিরগ্রন্থে ইবনু হজর মক্কী রহ. ইমাম শাফিঈ রহ.-এর রায় উল্লেখ করেন যে, যদিও নারীদের চেহারা, হাতের কবজি ঢেকে রাখা ফরজবিধানের আওতায় পড়ে না; এগুলো খোলা রেখেও নামায হয়ে যায়। তবে পরপুরুষের জন্য শরিয়তসিদ্ধ কোনো প্রয়োজন ছাড়া এগুলো দেখা বৈধ নয়। অর্থাৎ নারীরা বিনাকারণে এগুলো পরপুরুষকে দেখাতে পারবে না।
ছয়. ইমাম মালিক রহ.-এর প্রসিদ্ধ রায় এটাই যে, পরনারীর চেহারা ও হাতের কবজি শরিয়তসম্মত ওযর ছাড়া দেখা নাজায়েয।
সাত. আল্লামা শামী রহ. নিজের ফতওয়াগ্রন্থে লিখেছেন,
وَالْمَعْنَى تُمْنَعُ مِنَ الْكَشْفِ بِخَوْفِ اَنْ يَّرَى الرِّجَالُ وَجْهَهَا فَتَقَعُ الْفِتْنَةُ لِاَنَّهُ مَعَ الْكَشْفِ قَدْ يَقَعُ النَّظْرُ اِلَيْهَا بِشَهْوَةٍ.
‘নারীদেরকে চেহারা খোলা থেকে নিষেধ করা হবে। যাতে পুরুষরা দেখতে না পারে। কেননা, চেহারা খোলা রাখলে পুরুষদের কামদৃষ্টি পড়বে।’ (দুররেমুখতার ১/২৪৮)
আট. ইংরেজীভাষায় প্রবাদ আছে, ‘চেহারা মস্তিষ্কের ইনডেক্স হয়ে থাকে।’ এ কারণেই ব্যক্তির চেহারা দেখে তার ব্যক্তিত্বের অনুমান করা যায়। লজ্জা-শরম, ভালো-মন্দ, আনন্দ-নিরানন্দ চেহারা দেখেই অনুমান করা যায়। সুতরাং চেহারা ঢেকে রাখা জরুরি।
নয়. বিয়ের জন্য কোনো মেয়েকে পছন্দ করার সময় তার চেহারা দেখা হয়। চেহারা ছাড়া অন্যঅঙ্গ দেখে তার ব্যক্তিত্ব পরিমাপ করা যাবে কি! এতে বোঝা যায়, চেহারার পর্দা অত্যন্ত জরুরি।
দশ. পরপুরুষ ও পরনারীর মাঝে ভালোবাসার সূচনা পরস্পরের চেহারা দেখেই হয়। অনেক সময় কথাবার্তার আগেই শুধু দেখেই ভালোবেসে ফেলে। কবির ভাষায়-
آنكهو ں آنكهو ں ميں اشار ے ہو گئے
ہم تمہار ے تم ہمار ے ہو گئے
‘চোখে-চোখে ইশারায়,
আমি তোমার, তুমি আমার হয়ে গেলাম।’
বোঝা গেল, চেহারাই ফেতনার সবচে’ শক্তিমান স্থান। সুতরাং চেহারাকে পর্দার বাইরে রাখা মুর্খতা ও ভ্রষ্টতার প্রমাণ।
কিছু অভিযোগ:
ওয়াজ-মাহফিলে পর্দা সম্পর্কে একটু জোরালো ভাষায় বলা হলে অনেক সময় বেপর্দানারীরা অস্থির হয়ে ওঠেন। পর্দাহীনতাকে বৈধ প্রমাণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অভিযোগ করে থাকেন। এভাবে পর্দাহীনতা তো বৈধ হয়ে যায় না, তবে গুনাহর দিকটা আরো জঘন্য হয়ে ওঠে। গুনাহকে গুনাহ মনে করে যে ব্যক্তি গুনাহ করে তার কৃতগুনাহ তাওবা দ্বারা তড়িৎ মাফ হয়ে যায়। কিন্তু গুনাহকে জায়েয মনে করে করলে ওই ব্যক্তির ব্যাপারে আশঙ্কা থাকে কুফরির সীমানাতেও ঢুকে পড়ার। এজন্য পর্দার যুক্তি-প্রমাণগুলোকে পূর্ণাঙ্গতাদানের উদ্দেশে কিছু অভিযোগ উত্তরসহ পেশ করা হচ্ছে–
অভিযোগ-০১ : চাদর বা বোরকা পরলে কী আর হয়? মূলত পর্দা তো চোখের হয়।
উত্তর : যারা বলে, মূলপর্দা চোখের, তাদের উচিত উলঙ্গ হয়ে ঘোরাফেরা করা। কাপড় পরিহিত থেকে লাভ কী! বস্ত্রহীন হয়ে নিজের ঘরের মহিলাদের সামনে একটু এসে দেখো না; তখনই বুদ্ধি সঠিক ঠিকানা পেয়ে যাবে। এ জাতীয় প্রশ্ন ওইসব নারীই করে যাদের বুদ্ধির ওপর তালা ঝুলে আছে কিংবা যাদের পুরুষদের বিবেকের ওপর পর্দা পড়ে গেছে।
بے پرده نظر آئيں مجهے چند بيبيا ں
اكبر زميں ميں غيرت قومى سے گڑ گيا
پوچها جو ان سے آ پكا پرده وه كيا ہوا
كہنے لگيں كہ عقل پہ مردو ں كى پڑ گيا
‘আমার দৃষ্টির আওতায় কিছু পর্দাহীননারী পড়ল,
(যা দেখে) জাতির আত্মমর্যাদাবোধের কারণে আকবর জমিনের সাথে লেপ্টে গেল ।
যখন জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের পর্দার কী হল?
বলল, আমাদের পর্দা পুরুষদের বিবেকে পড়ে গেল ।’
আমার ধারণা এ টাইপের চিন্তা তখনই তৈরি হয়, যখন অন্তরে উদাসীনতার আবরণ পড়ে যায়। পর্দা প্রথমে চোখ থেকে খসে পড়ে তারপর চেহারা থেকে।
অভিযোগ ০২ : পর্দা শিক্ষার প্রতিবন্ধক।
উত্তর : আমরা বলব, পর্দা শিক্ষার অন্তরায় নয়; বরং সহযোগী। সহশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিন নতুন পরিস্থিতি জন্ম নেয়। মেয়েরা সেজেগুজে নিজেদের রূপ-সৌন্দযের জানান দিতে আসে, আর ছেলেরা তাদের রমণীয়জাদুতে মুগ্ধ হয়ে নিজেদের অধিকারের বাগডোরে তাদেরকে আবদ্ধ করার নেশায় থাকে। ছেলেমেয়ে কারোই মনোযোগ পড়ালেখার প্রতি থাকে না। বেচারা-বেচারিদের অবস্থা অনেকটা এমন হয়-
كتاب كهول كے بيٹهو ں تو آنكھ روتى ہے
ورق ورق تيرا چہره دكهائى ديتا ہے
‘বই খুলে বসলেই চোখ কান্নায় ভিজে ওঠে,
প্রতিটি পৃষ্ঠায় শুধু তোমার মুখখানা দেখা যায়।’
অনেক জায়গা তো প্রফেসররাও মেয়েদের জন্য যেন প্রাণ দিয়ে দেয়।
جب مسيحا دشمن جا ں ہوتو كياہو زند گى
كون ره بتلاسكے جب خضر بهكانے لگے
‘রক্ষকই যদি ভক্ষক সাজে, জীবনের তখন কী হবে?
খিযিরই যদি ভুলপথ দেখায় তবে রাস্তা দেখাবে কে?’
এসব সমস্যার উত্তম সমাধান তো এটাই যে, ছেলেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা হবে। তখন ছেলেমেয়ে পরস্পর দৃষ্টিবিনিময় নয়; বরং বইয়ের দিকে মনোযোগ দিতে সক্ষম হবে।
অভিযোগ ০৩ : পর্দা প্রগতির পথে বাঁধা। কারণ, এতে সমাজের অর্ধাংশ অচল হয়ে পড়ে। যারা সমাজউন্নয়নে নিজেদের কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
উত্তর : আগে বুঝতে হবে, আমরা প্রগতি বলতে কী বুঝি? নারীকে ঘর থেকে বের করে অফিসে, ক্লাবে, পাবলিক-প্লেসে দাঁড় করিয়ে দেয়ার নামই কি প্রগতি! না তাদের নিজস্ব ভুবনে একাগ্রতার সঙ্গে নিজেদের দায়িত্বপালন করার নাম প্রগতি বা উন্নতি। সৃষ্টিগতভাবে তাদের প্রকৃত উন্নতি তো এরই মধ্যে বিদ্যমান।
তাদের আসল দায়িত্ব তো হল, তারা সমাজের জন্য উত্তম প্রজন্ম তৈরি করবে। এমন প্রজন্ম যারা আলোকিত-ভবিষ্যত রচনা করতে সক্ষম হবে। আর এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন নারী আপন সংসারে অবস্থান করে নিজের সন্তানদের উত্তম প্রতিপালনের দায়িত্ব একাগ্রতার সাথে আদায় করবে।
পশ্চিমাদের উদরে জন্ম নেয়া প্রগতি ও উন্নতি এবং প্রকৃত প্রগতি-উন্নতি এক নয়। সুতরাং প্রগতি ও উন্নতিকে পশ্চিমাদের চশমা লাগিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই। বরং ওই মাপকাঠিতে দেখতে হবে যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ স্থাপন করেছেন।
অভিযোগ ০৪ : পর্দা নারীদের জন্য একপ্রকার বন্দিশালা।
উত্তর : শব্দ ও তাৎপর্যবিচারে পর্দা ও বন্দিত্ব এক বিষয় নয়। বন্দিত্ব বলা হয়, কাউকে তার লক্ষ্য ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোথাও আবদ্ধ করে দেয়া। আর পর্দা হল, সন্তুষ্টচিত্তে নিজেকে পরপুরুষের আড়ালে রাখা। বন্দিত্বে উদ্দেশ্য হল, লোকেরা যেন তার অনিষ্ট থেকে বাঁচতে পারে। পক্ষান্তরে পর্দার উদ্দেশ্য হল, নারী যেন পরপুরুষের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে পারে। মানুষ পোশাক পাল্টানোর সময় কোনো রুমে কিংবা দেয়ালের আড়ালে গিয়ে পাল্টায়। কারণ, সে এটা চায় না যে, তার সতর কেউ দেখে ফেলুক। এটাকে বন্দিত্ব বলা যায় না। বরং এটার নাম পর্দা। বন্দিত্ব হয় জোরপূর্বক। আর পর্দাপালন করা হয় নিজের ইচ্ছায়। বন্দিত্ব হয় অপকর্মের সাজা হিসাবে। অথচ পর্দা হয় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার লাভের তামান্নায়। সুতরাং নারী পর্দাপালন করলে বন্দি হয় না; বরং অনেক অনেক বিপদ থেকে বেঁচে যায়।
অভিযোগ ০৫ : বোরকা তো কেবল শরীর ঢাকে। বোরকাধারী-নারীও তো অপকর্ম করে।
উত্তর : এটা অন্তরে গেঁথে নিন যে, পর্দাপালনকারীদের মাঝেও পর্দাহীনতার কারণেই গোলমাল হয়। কেউ পর্দাহীনতা থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকলে তার পদস্খলনের কোনো আশঙ্কা নেই। ভাবনার বিষয় হল, পর্দাপালনকারীরাও যদি একটু পর্দাহীনদের মত চলে তাহলে গÐগোল দেখা দেয়, সুতরাং যেসব নারী মোটেই পর্দা করে না, না জানি তাদের জীবনে কত কী ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য দেখা যায়, বেপর্দানারীর বেশিরভাগ সময় কেটে যায় নিজের অপকর্মের ওপর পর্দা টাঙ্গানোর পেছনে।
অভিযোগ ০৬ : কিছু মহিলা বলে থাকেন, আমরা তিনসন্তানের মা হয়ে গেছি, এখন আমাদের দিকে কে তাকাবে?
উত্তর : যারা খারাপচোখে তাকায় তারা তিনসন্তানের মায়ের প্রতিও তাকায়। এবার তিনসন্তানের মায়েরা কী বলবেন? অভিযোগকারীনী কিভাবে এ সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আপনাকে কেউ মন্দদৃষ্টিতে দেখে না? আমি বলব, মনে করুন, যদি কেউ দেখে তাহলে দুর্ভাগ্য তো আপনিই ডেকে আনলেন। এজাতীয় অর্থহীন বাহানা ধরে বেপর্দায় থাকবেন। এর মোটেও অবকাশ নেই। বলুন তো, আপনি তিনসন্তানের মা হয়েছেন বলে কি নিজের স্বামীকে আকর্ষণ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন? যদি স্বামীর প্রয়োজন আপনাকে দিয়ে পূরণ হয় তাহলে পরপুরুষের ক্ষেত্রে বাঁধা কোথায়? আরবিভাষায় প্রবাদ আছে- لِكُلِّ سَاقِطٍ لَاقِطٌ.‘প্রতিটি পরিত্যক্তবস্তু উঠিয়ে নেয়ার লোক থাকে।’
অভিযোগ ০৭ : পর্দা করলে পরপুরুষ বেশি আগ্রহসহ দেখে।
উত্তর : আপনি নিজেই চিন্তা করুন, পর্দানশীলনারীর প্রতি যদি পরপুরুষ এতটা আগ্রহের দৃষ্টিতে তাকায়, তাহলে পর্দাহীননারীর প্রতি কতটা লোভ-লিপ্সাঘেরা দৃষ্টিতে তাকাবে? আমাদের কাছে তো মনে হয়, কসাই বকরির দিকে যে দৃষ্টিতে তাকায়, সে দৃষ্টিতেই বখাটেরা বেপর্দানারীর প্রতি তাকায়। এর প্রমাণ হল, পর্দাপালনকারী নারীর প্রতি তাকালে তো কালোকাপড় ছাড়া কিছু দেখা যায় না, কিন্তু বেপর্দা নারীর সবকিছু চোখ ধাঁধিয়ে ভেসে ওঠে। এমন কি অনেক ক্ষেত্রে এটাও অনুমান করা যায় যে, গোশত কত কেজি, চর্বি কত কেজি!
পর্দাহীনতার করুণ পরিণতি:
পশ্চিমা সমাজে আপন-পর ও পর্দা-বেপর্দা বলতে কিছু নেই। নগ্নতা ও অশ্লীলতা একেবারে তুঙ্গে। লেখাপড়াজানা কথিত লোকগুলো দীনের সাথে পরিচিত না হওয়ার কারণে দু’পাবিশিষ্ট জন্তুতে পরিণত হয়েছে। বাসায় মা-বাবা বেডরুমের ভালোবাসা ছেলে-মেয়ের সামনে দেখায়। নারী-পুরুষ সবাই বাসায় শর্টপোশাক পরে। নারী-পুরুষ স্বেচ্ছায় ব্যভিচার করলে তা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ মনে করা হয় না। তাদের চারিত্রিকঅবক্ষয়ের এপিট-ওপিঠ নি¤েœাক্ত ঘটনার মাধ্যমে অনুমান করতে পারেন।
এক অমুসলিম বাসার জন্য মুসলিম ড্রাইভার রেখেছিল। কয়েকবছর পর ওই অমুসলিমকে অফিসিয়াল কাজের উদ্দেশ্য বাইরে যেতে হল। যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে খুব গুরুত্ব দিয়ে বলে গেল, যেন সে ঠিকভাবে ডিউটি পালন করে এবং বাসার প্রতি খুব খেয়াল রাখে। ড্রাইভার নির্দেশমাফিক প্রতিদিন ডিউটিতে চলে আসত এবং বাসার জন্য কিছু আনার দরকার হলে এনে দিত। বাসার মেম সাহেব বাইরে যেতে বললে নিয়ে যেত। পনের বিশদিন পর একদিন মেম সাহেব ড্রাইভারকে তার বেডরুমে ডেকে পাঠাল এবং বলল, আমার যৌনক্ষুধা নিবারণ কর। ড্রাইভার ভাবল, আমি মালিকের সঙ্গে খেয়ানত করব কিভাবে? তাই সে রাজি হল না। এতে মেম সাহেব ক্ষেপে গেল এবং তাকে রুম থেকে বের করে দিল। তিনমাসের মধ্যে অন্তত আট-দশবার মেম সাহেব একই চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রতিবারই ড্রাইভার ‘না’ করে দিয়েছিল। তিনমাস পর মালিক ফিরে এল এবং পরের দিন ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, আমার স্ত্রী তোমার সাথে যৌনকর্ম করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল কিÑনা? ড্রাইভার উত্তর দিল, হ্যাঁ, করেছিল, তবে আমি রাজি হয় নি। কারণ, আমি আমার মালিকের সঙ্গে খেয়ানত করতে পারি না। এবার মালিক বলল, আরে বোকা! খেয়ানত আবার কোন্ বস্তুর নয়! আগে বলো, যদি দুঃখ পাওয়ার কারণে আমার স্ত্রীর কিছু একটা হয়ে যেত তাহলে এর দায়ভার কে নিত? তোমার উচিত ছিল তার কথা শোনা। আমি তোমার মত অবাধ্যকে বাসার চাকর হিসাবে রাখতে পারি না। সুতরাং আজ থেকে তোমার ছুটি। তোমাকে চাকরি থেকে বের করে দেয়া হল।
অমুসলিম সমাজে সম্মতিতে-ব্যভিচার কোনো পাপ নয়। উক্ত ঘটনা তার প্রমাণ। তাদের খাহেশ হল, মুসলমানদের সমাজে ব্যভিচার ব্যাপক হোক। মুসলমানদের থেকে লজ্জা ও শালীনতাবোধ বিদায় নিয়ে যাক। এ লক্ষেই পপ গান ও নগ্নফ্লিমের মাধ্যমে তারা মুসলিম সমাজে সংস্কৃতিকআগ্রাসন চালু করেছে। যে মুসলমান ইংরেজস্টাইলের জীবনযাপনে সন্তুষ্ট হয়, পর্দাহীনতাকে গ্রহণ করে, নিজ সন্তানদের সাথে বসে যৌনসুড়সুড়িজাত ফ্লিম দেখে, তাদের সংসারজীবন খুবই ভয়াবহ হয়।
ناطقہ سر بگريبا ں ہے اسے كيا كہے
‘বাকশক্তিসম্পন্ন মাথাটা জালে ধরা পড়েছে, এটাকে কী বলা হবে!’
পাতলাপোশাকের ব্যবহার:
আল্লাহ তাআলা বলেন,غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ بِزِيْنَةٍ‘নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে ফিরো না।’
উক্ত আয়াত দ্বারা মুফাসসিরগণ প্রমাণ পেশ করেছেন যে, সৌন্দর্য-ঝলক বোঝা যায় এমন পাতলা-পিনপিনে কাপড় পরার অনুমতি নারীদের জন্য নেই।
ইবনুল আরাবি রহ. আহকামুল কুরআনে লিখেছেন, وَمِنَ التَّبَرُّجِ اَنْ تَلْبَسَ الْمَرْأَةُ ثَوْبًا رَقِيْقًا يَصِفُهَا ‘নারীরা পাতলাকাপড় পরিধান করা যার কারণে তার সৌন্দর্য বোঝা যায়; এটাও প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।’ (আহকামুলকুরআন ২/১১৪)
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
رُبَّ نِسَاءٍ كَاسِيَاتٍ عَارِيَاتٍ مَائِلَاتٍ مُمِيْلَاتٍ لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يَجِدْنَ رِيْحَهَا
‘কিছু নারী, যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ, পরপুরুষকে আকৃষ্ট করে, নিজেরাও পরপুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়, এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না।’ (মিশকাত)
হাদীসটিতে كَاسِيَاتٍ (পোশাকপরিহিত) শব্দের পর عَارِيَاتٍ (উলঙ্গ) শব্দটি এসেছে এটা বোঝানোর জন্য যে, এরা পোশাক বা শাড়ি পরবে কিন্তু ভেতরটা বোঝা যাবে, সুতরাং এরা উলঙ্গ। সকল আলেম এব্যাপারে একমত যে, মহিলাদের জন্য এমন কাপড় পরিধান করা হারাম, যা দ্বারা দেহ স্পষ্ট দেখা যায়। সতর ঢেকে রাখা ফরজ। যদি কোনো মহিলা এমন ওড়না দ্বারা নামায পড়ে যার দ্বারা মাথার চুল স্পষ্ট দেখা যায়, তাহলে তার নামায হবে না। বর্তমানে কিছু মহিলা মোটাকাপড়ের সেমিজের ওপর পাতলা জামা পরে, তাকওয়ার দাবি হল, এ জাতীয় পোশাকও পরিধান না করা।
উম্মে আলকামা রাযি. বলেন, আয়েশা রাযি.-এর ভাতিজি হাফসা বিনতে আবদুররহমান রাযি. তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছেন, তখন তাঁর গায়ে ছিল পাতলা কাপড়ের একটি ওড়না। এটা দেখে আয়েশা রাযি. ওড়নাটি ছিঁড়ে ফেলেন এবং এর পরিবর্তে তাকে দু’টি মোটা ওড়না দেন। (মিশকাত, পোশাক অধ্যায়)
মুসলিম শরীফের এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,خُذْ عَلَيْكَ ثَوْبَكَ وَلَا تَمْشُوْا عُرَاةً ‘গায়ে কাপড় জড়িয়ে নাও, উলঙ্গ চলাফেরা করো না।’ (মিশকাত )
এর দ্বারা প্রতীয়মান হল, এমন পাতলাকাপড় যার দ্বারা সতর আবৃত হয় না, বরং সতরের অঙ্গগুলো দেখা যায়, তা পরিধান করা হারাম।
পর্দাহীন নারীর সাজা:
এক. হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এবং আমার স্ত্রী ফাতেমা রাযি. গেলাম রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দরবারে। আমরা দেখলাম, তিনি কাঁদছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওগো আল্লাহর রাসূল ﷺ! আপনার জন্য আমার মা-বাবা কুরআন হোক। আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন, আলী! আমি মিরাজের রাতে আমার উম্মতের নারীদেরকে দেখেছি, তাদেরকে বিভিন্নপদ্ধতিতে সাজা দেয়া হচ্ছে। আজ সে দৃশ্য আমার মনে পড়ে গেল, তাই মায়া ও দয়ার কারণে আমার কান্না এসে গেছে।
আমি কিছু নারীকে দেখলাম, তাদেরকে মাথার চুলে সঙ্গে বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের মগজ টগবগ করছে।
আরো কিছু নারীকে দেখলাম, তাদেরকে জিহবার সঙ্গে বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং গরম পানি তাদের গলার ভেতরে ফেলা হচ্ছে।
তৃতীয় একশ্রেণীর নারীকে দেখলাম, তাদের দুই পা দুই স্তনের সঙ্গে এবং দুই হাত কপালের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে।
চতুর্থপ্রকার কিছুনারীকে দেখলাম, তাদেরকে স্তনের সঙ্গে বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণীর নারীগুলোকে দেখলাম, তাদের মাথা শূকরের মত, অবশিষ্ট দেহ গাধার মত।
ষষ্ঠপ্রকার কিছু নারীকে দেখলাম, তাদের চেহারা কুকুরের মত এবং আগুন তাদের মুখে ঢুকছে, বের হচ্ছে পায়খানার রাস্তা দিয়ে। ফেরেশতারা আগুনের মুগুর দিয়ে তাদের মাথায় আঘাত করে যাচ্ছে।
এই বিবরণ শুনে ফাতেমা রাযি. বসে থাকতে পারলেন না, দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, প্রাণপ্রিয় আব্বাজান! আমার চোখের শীতলতা আপনি। দয়া করে বলুন, এসব নারীর অপরাধ কী, যার কারণে এত ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হচ্ছে?
রাসূলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, প্রথমশ্রেণীর নারী যাদেরকে মাথার চুল দ্বারা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, এরা পরপুরুষের সামনে নিজেদের চুল ঢেকে রাখত না। (খালি মাথায় বাজারে মার্কেটে ঘুরাঘুুরি করার অভ্যাস ছিল।)
দ্বিতীয়প্রকার নারী যাদেরকে জিহŸার সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছেÑ এরা নিজেদের স্বামীকে কষ্ট দিত। (স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করার অভ্যাস ছিল।)
তৃতীয়শ্রেণীর নারী যাদেরকে দুই পা স্তনের সঙ্গে এবং দুই হাত কপালের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে, এরা ঋতু¯্রাব ও সহবাসের পর ভালোভাবে গোসল করে পবিত্র হত না। আর নামাযের ব্যাপারে উপহাস করত।
চতুর্থপ্রকার নারী যাদেরকে স্তন দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এরা ওই সকল অসতী ছিল যারা পুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হত।
পঞ্চমশ্রেণীর নারী যাদের মাথা শূকরের মত এবং দেহ গাধার মত। এরা মানুষের বদনাম করত এবং মিথ্যা বলত।
ষষ্ঠপ্রকার নারী যাদের চেহারা কুকুরের মত এবং আগুন মুখ দিয়ে ঢুকিয়ে পায়খানার রাস্তা দিয়ে বের করা হচ্ছে। এরা লোকদের হিংসা করত। এবং উপকার করে খোঁটা দিত। (ইমাম যাহাবিকৃত আলকাবাইর, পৃষ্ঠা : ১৭৭)
দুই. ইমাম যাহাবী রহ. একটি ঘটনা লিখেছেন,
وَقَدْ حُكِىَ اَنَّ اِمْرَأَةً كَانَتْ مِنَ الْمُتَبَرِّجَاتِ فِى الدُّنْيَا وَكَانَتْ تَخْرُجُ مِنْ بَيْتِهَا مُتَبَرِّجَةً. فَمَاتَتْ فَرَاهَا بَعْضُ اَهْلِهَا فِى الْمَنَامِ وَقَدْ عُرِضَتْ عَلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ فِىْ ثِيَابٍ رِقَاقٍ، فَهَبَّتْ رِيْحٌ فَكَشَفَتْهَا فَاَعْرَضَ اللهُ عَنْهَا وَقَالَ خُذُوْابِهَا ذَاتَ الشِمَالِ اِلَى النَّارِ فَاِنَّهَا كَانَتْ مِنَ الْمُتَبَرِّجَاتِ فِى الدُّنْيَا.
‘এক মহিলা ছিল। দুনিয়ার জীবনে দেহপ্রদর্শনী করে চলত। সাজগোজ করে চোখ ধাঁধিয়ে বাড়ি থেকে বের হত। সে মারা গেল। তখন তার এক আত্মীয় তাকে স্বপ্নে দেখল। আল্লাহতাআলার দরবারে তাকে পাতলা পিনপিনে কাপড় পরিয়ে পেশ করা হয়েছে। আচমকা এক পশলা ঝড়োবাতাস এসে তাকে উলঙ্গ করে দিল। আল্লাহ তাআলা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন, একে জাহান্নামের বামদিকে ফেলে আসো। কেননা এ দুনিয়াতে পর্দাহীন হয়ে সেজেগুজে বেড়াত।’
হযরত মাজযূব রহ.-এর কয়েকটি পঙক্তি–
يہى دهن ہے تجهكو رہو ں سب سے بالا
ہو زينت نرالى اور فيشن نرالا
تجهے حسن ظاهر نے دهوكے ميں ڈالا
جيا كرتا ہے يونہى مر نے والا
جگہ جى لگا نے كى دنيا نہيں ہے
يہ عبرت كى جا ہے تماشہ نہيں ہے
‘সকলের ঊর্ধ্বে থাকাটাই তোমার আকর্ষণ,
(তোমার) সৌন্দর্য হবে নিরব, ফ্যাশন হবে ঘরোয়া।
(কিন্তু) বাহ্যিক সৌন্দর্য তোমাকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে,
মৃত্যুপথের যাত্রী এভাবেই কি জীবন কাটায়!
মন গেঁথে রাখার মত স্থান এজগত নয়,
এটা শিক্ষাগ্রহণের জায়গা, খেল-তামাশার নয়।’
ফলাফল : পর্দাহীনতার সাজা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। এর ভয়াবহতা বিশাল এবং এর ফলাফল খুবই মন্দ।
পর্দাপালনের বরকত:
ইমাম ইবনুল আরাবী রহ. বলেন, আমি ‘নাবলিস’ দেশের প্রায় একহাজার এলাকায় গিয়েছি। এসব এলাকার কোনো একটিতে হযরত ইবরাহীম আলাইহিসসালামকে আগুনে ফেলা হয়েছিল। আমি নাবলিসের মহিলাদের চেয়ে সতী-সাধবী মহিলা কোথাও দেখি নি। আমি এলাকাগুলোতে বহুদিন থেকেছি। দিনেরবেলায় কোনো মহিলাকে বের হতে দেখি নি। হ্যাঁ, জুমআরদিন মহিলারা আসত। তাদের জন্য নির্ধারিত স্থান ওইদিন ভরে যেত। নামাযশেষে তারা প্রত্যেকে নিজেদের ঘরে চলে যেত। পরবর্তী জুমআ পর্যন্ত অলি-গলিতে একজন নারীও চোখে পড়ত না। (তাফসীরে কুরতুবী ১৪/১১৬)
অধমের তাবলিগের সুবাদে কয়েকবছর থেকে চতরালে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। সেখানকার একজন বুযুর্গ আলেম আমাকে জানিয়েছেন, এখানে হত্যা-গুম-সন্ত্রাস হয় না বললেই চলে। জিজ্ঞেস করলাম, এমন শান্তি ও নিরাপত্তার সমাজ কিভাবে তৈরি হল? তিনি উত্তর দিলেন, আমাদের নারীরা পর্দার প্রতি পুরোপুরি যতœশীল। কয়েকমাসেও অলি-গলিতে পর্দাহীননারী দেখবেন না। এই পর্দার বরকতে ব্যভিচার ও অশ্লীলতার দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে মারামারি-হানাহানি নেই। সবদিকেই আছে শান্তি, নিরাপত্তা, ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য। একমুসলমানকে অপরমুসলমানের হিতাকাক্সক্ষী হিসাবেই এখানে পাবেন।
আমেরিকার একযুবতী মুসলিম হয়ে যথারীতি নেকাবি-বোরকা পরা শুরু করল। তাকে বেশকিছু মহিলা জিজ্ঞেস করল, তুমি তো খোলামেলা পরিবেশে উন্মুক্তদেহে বিচরণকারী আধুনিকমেয়ে ছিলে। এখন তোমার এই পরিবর্তন! এত কঠিন পর্দাপালন করতে তোমার অসুবিধা হয় না? নিঃশ্বাস বের হয়ে যাওয়ার মত বিরক্তিকর লাগে না? নিজেকে কি বন্দি-টাইপের মনে হয় না? যুবতী উত্তর দিল, আমি আমার বহু রাত নাইটক্লাব ও নাচের আসরগুলোতে কাটিয়েছি। আমি দেখেছি, প্রতিটি পুরুষ আমার প্রতি কামুকদৃষ্টিতে তাকাত। যখন মার্কেটে যেতাম, তখন পুরুষগুলোকে আমার দিকে লোভীচোখে তাকাতে দেখেছি। মনে সবসময় ভয় কাজ করত। আশঙ্কায় ভুগতাম, কোনো বখাটে অসভ্যযুবক আমার ওপর হামলে পড়ে কিÑনা? কোনো হায়েনা আমার ইজ্জত নষ্ট করে কিনা? প্রাণ কেড়ে নেয় কিনা? এখন আর এসব ভয়-ভীতি নেই। কারণ, যেদিন থেকে আমি পর্দা শুরু করেছি, সেদিন থেকে পুরুষরা আমাকে দেখতে পায় না। আমার রূপ-সৌন্দর্য কেউ দেখে না। আমার অন্তরে কোনো আশঙ্কা ও ভীতি নেই। পর্দাপালন করেই আমি সুখী ও নিরাপত্তাপূর্ণ জীবনের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি। এখন আমার হৃদয় সুখপ্রাচুর্যে এতটাই তৃপ্ত ও পরিপূর্ণ যে, আমার অন্তরের সুখগুলো পর্দাহীননারীদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হলে সম্ভবত তারা সুখ-শান্তির ছোঁয়া পেয়ে যেত। উক্ত যুবতী ইবযরহফ ঃযব াবরষ নামক একটি বই রচনা করেছে।
ফাতেমা। আমেরিকার এক যুবতী মুসলিম। নেকাবি-বোরকা পরে ধীরে ধীরে বাসার দিকে যাচ্ছিল। তার হাত-পায়েও ছিলা মোজা। জনৈক পুলিশঅফিসার দেখে সন্দেহ করল যে, এভাবে আপাদমস্তক আবৃত হয়ে যাচ্ছে কে? তাই সন্দেহবশতঃ তাকে পুলিশের পাঁচ-ছয়জন সদস্য গ্রেফতার করার উদ্দেশে পথ আগলে দাঁড়াল এবং বলল, চেহারা থেকে কাপড় সরাও, আমরা দেখতে চাই যে, তুমি কে? ফাতেমা উত্তর দিল, কোনো মহিলাপুলিশ ডাকো, সেই আমার চেহারা দেখতে পারবে। তোমরা মোটেও দেখতে পারবে না। পুলিশেরা বলল, তুমি কাপড় না সরালে আমরা তোমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাব। কারণ ১৯৬৩ সালে আমেরিকাতে একটি আইন পাশ করা হয়েছে যে, কেউ শরীরের শতভাগ ঢেকে চলতে পারবে না। যেহেতু এর দ্বারা বড় বড় অপরাধীরাও পার পেয়ে যেতে পারে। ফাতেমা বলল, আমি এদেশে জন্ম নিয়েছি। এখানেই আমার বেড়ে ওঠা। এখানেই আমার শিক্ষা-দীক্ষা। আমি জানি, আমার দেশের আইন সকলকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়। আমি কোনো চাপে নয়; বরং আল্লাহর বিধান হিসাবেই এই পর্দা করেছি। এটা আমার আইনগত অধিকার। ফাতেমার কথা শুনে পুলিশ তাকে পুলিশস্টেশনে নিয়ে গেল। একমহিলার মাধ্যমে তাকে যাচিয়ে-খতিয়ে দেখা হল। অবশেষে তাকে একটি কার্ড বানিয়ে দেয়া হল। বলে দেয়া হল, যদি ভবিষ্যতে কোনো পুলিশ ধরে তাহলে কার্ডটি দেখালেই চলবে। এভাবে ফাতেমা এখনও পর্দাপালন করে চলাফেলা করে। তার সম্ভ্রম ও প্রাণ নিয়ে নিজের মাঝে কোনো ভয় নেই, ভীতি নেই। তার জীবন যেন لَا خَوفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ. ‘তাদের কোনো ভয় নেই ও পেরেশানি নেই’-এর বাস্তব নমুনা।
…..