Latest News

হজরত যয়নব বিনতে খুজাইমা রদ্বিয়াল্লাহু আনহা
🖋মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ
.....................................................................
বদরযুদ্ধে মুশরিকবাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিলো। এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো তারা। পরের বছর অনেক সৈন্য ও রণসম্ভার নিয়ে উপস্থিত হলো মদীনার উপকন্ঠে— উহুদ প্রান্তরে।
মুসলিমবাহিনীও প্রস্তুত হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভাষণ দিলেন — হে জনমণ্ডলী! আমি তোমাদেরকে ওই সকল বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি, যেসকল নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন তাঁর কিতাবে। সেগুলো হচ্ছে — তাঁর নির্দেশাবলী এবং নিষেধাজ্ঞা-সমূহকে মেনে চলবে। তোমরা আজ এক মহাপুরস্কারপ্রাপ্তির স্মরণযোগ্যক্ষণে দণ্ডায়মান।
তোমরা ধৈর্যশীল, প্রত্যয়ী, শ্রমতৎপর ও উদ্যমী হও। কেননা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ কঠিন ও কষ্টসাধ্য। যারা শুভপথে অবিচলিত, তারা ছাড়া অন্যেরা রণক্ষেত্রে ধৈর্য প্রদর্শন করতে পারে না। আল্লাহ তাদের সাথে আছেন, যারা তাঁর অনুগত। আর যারা অবাধ্য, তাদের সাথে রয়েছে শয়তান। অতএব, জেহাদে ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে তোমরা সাফল্যাভিলাষী হও। হও সাহায্য ও বিজয়ের অঙ্গীকারানুকূল। আমার নির্দেশ মেনে চলো। আমি তোমাদের সুপথকামী। মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব ও পলায়নপরতা হচ্ছে এক ধরনের দুর্বলতা। আল্লাহ এগুলো পছন্দ করেন না। এধরনের অপস্বভাববিশিষ্টদেরকে সাহায্য ও বিজয় দান করেন না।
হে জনতা! আমার হৃদয়ে এই মর্মে প্রত্যাদেশ প্রক্ষিপ্ত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি পুণ্যলাভের প্রত্যাশায় কোনো হারাম কাজকে পরিত্যাগ করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমান বা অমুসলমানের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে, সে প্রতিদান পায় দুনিয়ায় ও আখেরাতে। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। সকল প্রশংসা তাঁর। সাহাবীগণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে উহুদ প্রান্তরে উপস্থিত হলেন। শাহাদত কামনাই সকলের ইচ্ছা।
সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ফুফাতো ভাই। যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে স্ত্রীর কাছে বিদায় নিয়ে চললেন রণপ্রান্তরে। প্রার্থনা জানালেন, হে আমার পরম প্রভুপালক আল্লাহ! আমাকে রণনিপুণ কোনো কাফেরের সম্মুখীন করে দিয়ো। আমি যেনো তার সাথে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যাই। আর সে যেনো কর্তন করে আমার ওষ্ঠ, নাসিকা ও কর্ণ।এরকম অবস্থায় তোমার সাথে মিলিত হতে চাই। তুমি বলবে, হে আবদুল্লাহ! তোমার ওষ্ঠ, নাসিকা ও কর্ণ কর্তিত কেনো? আমি বলবো, তোমার এবং তোমার রসুলের জন্য।
যুদ্ধ করতে করতে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রিয় পিতৃব্য হজরত হামযা শহীদ হলেন। হজরত আবদুল্লাহ যুদ্ধ করতে করতে হঠাৎ থেমে গেলেন। ভেঙে গেলো তাঁর তলোয়ার। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তৎক্ষণাৎ একটি শুকনো খেজুরের ডাল এগিয়ে দিলেন তাঁর দিকে। বললেন, যুদ্ধ করো। শুকনো ডালটি মুহূর্তেই তীক্ষ্ণ তরবারীতে পরিণত হলো। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ যুদ্ধ করতে করতে শত্রুনিধন করতে লাগলেন। শেষে প্রকাশ পেলো তাঁর প্রার্থনার ফল। শহীদ হলেন তিনি। শত্রুরা তাঁর নাক কান কেটে ফেললো।
সত্তর জন শহীদ হলেন। সত্তরটি পরিবার অভিভাবকহীন হয়ে পড়লো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শহীদদের জন্য অনেক কাঁদলেন। দোয়াও করলেন। জীবন তো থেমে থাকে না। এগিয়েই চলে। শোক-দুঃখ সরে যায়। জেগে ওঠে প্রয়োজন। ভাঙা জীবনকে জোড়া লাগাতে হয় আবার।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে বিধবাবিবাহের জন্য উৎসাহিত করেন। অভিভাবক হতে বলেন এতিম শিশুদের। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজেও অংশগ্রহণ করেন শুভপরিণয়ের পরিকল্পনায়। বিবাহ করেন শহীদ আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশের বিধবা স্ত্রী হজরত যয়নবকে। মোহরানা হিসেবে দেন চার শত দিরহাম। বিবাহের মধ্যস্থতা করেন কুবায়সা ইবনে আমর আল হিলালী।
তাঁর পূর্ণ নাম যয়নাব বিনতে খুযাইমা আল হিলালিয়া। মায়ের নাম হিন্দ বিনতে আউফ। উম্মুল মুমিনীন মায়মুনা ছিলেন তাঁর বৈপিত্রেয় বোন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত মায়মুনাকে বিবাহ করেন অনেক পরে।
খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি পিতৃ-মাতৃহারা শিশুদের এবং দরিদ্র- মিসকিনদেরকে ভালোবাসতেন। তাঁর পিতা-পিতামহরা ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী।তাঁদের কাছ থেকে তিনি হাত খরচের অর্থ হিসাবে যা পেতেন, তা-ই দিয়ে আদর করে ডেকে খাওয়াতেন তাদেরকে। একারণে তাঁকে সবাই ডাকতো ‘দরিদ্রদের জননী’ বলে।
ইবনে হিশাম বলেছেন, গরীব মিসকিনদের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত দয়ামমতা ছিলো বলে তাঁকে বলা হতো উম্মুল মাসাকীন (মিসকিনদের মা)। হাফেজ ইবনে হাজর বলেছেন, তিনি বিত্তহীনদের আহার যোগাতেন, তাদেরকে দান-খয়রাত করতেন। তাই তাঁর নাম হয়েছিলো ‘উম্মুল মাসাকীন’। আর আবদিল বার এবং বালাজুরী বলেছেন, জাহেলী যুগেই তাঁকে এ নামে ডাকা হতো। অনেক সময় এমনও ঘটেছে যে, তিনি খেতে বসেছেন। এমন সময় ক্ষুধার্ত ভিক্ষুক গৃহদ্বারে উপস্থিত হয়েছে। আর তিনি নিজের খাবার তুলে দিয়েছেন ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকের মুখে।
 তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন বাল্যবেলাতেই। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন তাঁকে বিয়ে করে ঘরে আনেন তখন তাঁর বয়স তিরিশ। আর রসুলুল্লাহর বয়স ছাপ্পান্ন।
জীবন কখনো হয় সংকুচিত। কখনো প্রসারিত। সবই আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায়ভূত। মহাপূণ্যবতী মুমিনজননী হয়ে তিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুলের সংসারে এলেন। কিন্তু দুনিয়া-আখেরাতের মহাসৌভাগ্যের জ্যোতির্ময়তার কেন্দ্রে তাঁর অবস্থানকে দীর্ঘতর করতে পারলেন না। মাত্র তিন মাস পরেই সাড়া দিলেন পরম প্রেমময় প্রভুপালকের আহবানে।
মাত্র তিরিশ বছরের জীবন। কিন্তু তিনি অসফল নন। কারণ তিনি এর মধ্যেই অর্জন করেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর গভীর ভালোবাসা, হন নবীপ্রেয়সী। আরো অধিকার করে নেন ‘বিশ্বাসীদের জননী’ হবার অক্ষয় মহিমা।
 উম্মতজননী হজরত খাদিজার মতোই তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পৃথিবীবাসের সময়ে পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে এই দুজন উম্মত জননীর কাফন-দাফনের কাজে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে দুটি দিক থেকে তিনি অনন্য —
১. এত কম বয়সে পরলোকগমনকারিণী নবীজায়া কেবল তিনিই।
২. কেবল তিনিই পেয়েছেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইমামতশোভিত নামাজে জানাযা।

Top