হজরত আয়েশা বিনতে আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়ালাহু আনহা
🖋মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ
..........................................................................
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বপ্নে দেখলেন, জিব্রাইল আমিন আ. এলেন। রেশমী বস্ত্রে মোড়ানো একটা কিছু তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, গ্রহণ করুন। ইনি হবেন পৃথিবী ও পরবর্তী পৃথিবীতে আপনার স্ত্রী। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রেশমী মোড়কটি খুলে দেখলেন, তার মধ্যে রয়েছে হজরত আয়েশা সিদ্দীকার একটি ছবি।
হজরত খাদিজা (রাঃ) তখন সদ্য গত হয়েছেন। রমজান মাসে তিনি চলে গেলেন। পরের মাসেই ঘটলো এই স্বপ্নদর্শন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবনে তখন শোক ও দুঃখের ঘনঘটা। প্রিয় পিতৃব্য ও প্রিয় পত্নী প্রায় একই সাথে তাঁকে ছেড়ে চলে গেলেন। কাফের কুরায়েশেরা দিন দিন আতঙ্ক ও আত্যাচারকে করে তুলেছে তীব্র, তীব্রতর। এরই মধ্যে এক রাতে দেখলেন এই স্বপ্ন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বুঝলেন,অন্তরের সান্ত্বনা ও শান্তিসঙ্গিনী হিসেবে আল্লাহপাক এই অনন্য উপহারটি তাঁকে দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ্।
স্বপ্নের কথা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাউকে জানালেন না। পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় রইলেন। এরই মধ্যে তাঁর গৃহে উপস্থিত হলেন হজরত খাওলা। একসঙ্গে দুটি বিবাহের প্রস্তাব দিলেন তিনি। দুটি প্রস্তাবই কবুল করলেন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। হজরত সওদা (রাঃ)কে বিয়ে করে ঘরে আনলেন। আর হজরত খাওলাকে পাঠালেন বাল্যবন্ধু ও প্রধান সহচর হজরত আবু বকর সিদ্দীকের গৃহে।
মূর্খতার যুগের রীতি ছিলো, আরববাসীরা সৎভাই, জ্ঞাতি ভাই বা পাতানো ভাইয়ের সন্তানদের বিয়ে করাকে ধর্মসম্মত মনে করতো না। তাই হজরত আবু বকর প্রস্তাব শুনে খুশী হলেও বললেন, খাওলা! আয়েশা যে রসুলুল্লাহর ভাইয়ের মেয়ে। খাওলা ফিরে এলেন। রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর কথা শুনে বললেন, আবু বকর তো আমার ধর্মসর্ম্পকীয় ভাই। তাকে বলুন, এরকম বিবাহ ধর্মসম্মত।
এরপর সামান্য একটু খট্কা দেখা দিলো। আলাহ্পাকের ইচ্ছায় তা কেটেও গেলো অতি সহজে। মুতইম ইবনে আদীর ছেলে যুবায়েরের সঙ্গে হজরত আয়েশার একটা শিথিল কথাবার্তা হয়েছিলো। সে কথা ওঠাতেই মুতইমের স্ত্রী বললো, না, না। এ মেয়ে এলে যুবায়েরকে মুসলমান বানিয়ে ছাড়বে। তারা তখন পর্যন্ত ছিলো অমুসলিম।
হজরত আবু বকর হজরত খাওলাকে বললেন, রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে নিয়ে আসুন। কোনো রকম আড়ম্বর সাজগোজ ছাড়াই রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এলেন। বিবাহ মজলিশে উপস্থিত হলেন হজরত আবু কোহাফা, হজরত আব্বাস, হজরত উম্মে ফজল,হজরত হামযা, হজরত উম্মে রুমান, হজরত খাওলা, হজরত ওসমান ইবনে মাযউন, হজরত উম্মে হানী, হজরত আতিয়াসহ আরো অনেকে।
হজরত আয়েশার বয়স তখন মাত্র ছয় বৎসর। তিনি তাঁর সখীদের সঙ্গে খেলাধুলায় মগ্ন ছিলেন। পরিচারিকা এসে তাঁকে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে দিয়ে তাঁকে কনের পোশাকে সাজানো হলো। বিবাহ কী, সে সম্পর্কে তখন তিনি কিছুই জানতেন না। পরে তিনি বলেছেন, বিয়ের সময় আমি একেবারে ছোট, এতোটুকু। ‘হাওফ’ নামক এক প্রকার পোশাক পরি। তবুও বিয়ের পর কোত্থেকে যেনো আমার কাছে লজ্জা চলে এলো।
দেনমোহর নির্ধারিত হলো পাঁচশ দিরহাম। হজরত আবু বকর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। বললেন, উপস্থিত ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াগণ! আপনারা জানেন, রসুলুল্লাহর আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত। তিনিই আমাদেরকে মূর্খতার অন্ধকার থেকে সত্যের আলোতে নিয়ে এসেছেন। জাহান্নামের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে এনে তিনিই আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন চিরমুক্তির পথের উপরে। এই আলোকে অনির্বাণ রাখার জন্য আমি একটি উপায় খুঁজছিলাম।
আল্লাহপাক তাঁর অপার করুণার মাধ্যমে এই উপায়টি বের করে দিয়েছেন। আল্লাহর রসুলকে করে দিয়েছেন আমার পরম আত্মীয়। আমার কন্যা নিতান্তই বালিকা। আমাদের সমাজে কন্যা সন্তানকে অবাঞ্ছিত মনে করা হয়। শিশু কন্যাকে জীবন্ত মৃত্তিকাপ্রোথিত করা হয়। আবার আপন ভাই না হলেও তার মেয়েকে বিয়ে করাকে অবৈধ মনে করা হয়। এরকম আরো অনেক কুপ্রথা রয়েছে আমাদের সমাজজীবনে। আজ এই বিবাহের মাধ্যমে সকল সামাজিক অন্যায়ের উৎখাতকর্মের কাজ শুরু হলো। আর আল্লাহর রসুলের সঙ্গে আমাদের এই পবিত্র আত্মীয়তা সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। আশা করি আমার বালিকা কন্যাও রসুলুল্লাহর সার্বক্ষণিক সংসর্গধন্য হয়ে তাঁর সেবা-যত্ন করতে পারবে। আর তাঁর আদর্শ ও বাণীসমূহ আত্মস্থ করে পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রচার করতে পারবে।
শুভবিবাহ সমাপ্ত হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নবপরিণীতা বধূকে পিতৃগৃহেই রেখে দিলেন। কারণ তিনি তখন নিতান্তই নাবালিকা। বয়স মাত্র ছয় বছর। মক্কায় ইসলাম অবরুদ্ধ। কাফের কুরায়েশদের বিরোধিতা ও অত্যাচার বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কার বাইরে ইসলাম প্রচারের প্রচেষ্টা চালালেন। তায়েফের অসাফল্যের পর নিরাশার মেঘে ছেয়ে গেলো ইসলামের অসীম আকাশ। কিন্তু আলাহ্পাকের অপার অনুগ্রহে ধীরে ধীরে আকাশ হতে লাগলো মেঘমুক্ত। সত্যের সূর্য উদ্ভাসিত হলো। দূরে। মদীনায়।
কাফেরেরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো, মোহাম্মদকে হত্যা করতে হবে। প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন একজন করে নেয়া হবে। তারা সকলে একসঙ্গে আঘাত হানবে। এভাবে সম্মিলিতভাবে তাঁকে হত্যা করলে সকল গোত্রই হবে হত্যাকারী। তখন হাশেমী গোত্র একা সকল গোত্রের বিরুদ্ধে লড়তে সাহস পাবে না।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সম্মুখে হজরত জিব্রাইল আবির্ভূত হলেন। তাঁকে কাফেরদের সভা এবং সভায় গৃহীত অপসিদ্ধান্তের কথা জানালেন। বললেন, রাতে নিজ শয্যায় রাত্রিযাপন করবেন না। জানালেন নতুন প্রত্যাদেশ, নতুন প্রার্থনা— ‘বলো, হে আমার প্রভুপালক! যেখানে গমন শুভ ও সন্তোষজনক, তুমি আমাকে সেখানে নিয়ে যাও এবং যেখান থেকে নির্গমন শুভ ও সন্তোষজনক, সেখান থেকে আমাকে বের করো এবং তোমার নিকট থেকে আমাকে দান করো সাহায্যকারী শক্তি। আর বলো, সত্য এসেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, মিথ্যা তো বিলুপ্তই হয়ে থাকে।’
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমার সঙ্গে হিজরত করবে কে? হজরত জিব্রাইল বললেন, আবু বকর সিদ্দীক। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আবু বকর সিদ্দীকের বাড়িতে যেতেন সকালে বা সন্ধ্যায়। হজরত আয়েশা বেশীরভাগ সময় তাঁর সখীদের নিয়ে খেলাধুলায় মত্ত থাকতেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সময় কাটাতেন হজরত আবু বকর সিদ্দীকের সঙ্গে।
সেদিন নিয়ম ভঙ্গ হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আবু বকর সিদ্দীকের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন দুপুরে। দেখলেন হজরত আয়েশা এবং তাঁর বড় বোন হজরত আসমা ঘরেই আছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সবাইকে সরে যেতে বলো। হজরত আবু বকর সিদ্দীক বললেন, হে আল্লাহর রসুল! এদের একজন তো আপনার স্ত্রী, আর একজন তার বড় বোন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আল্লাহ হিজরতের নির্দেশ দিয়েছেন। তুমি হবে আমার সঙ্গী, প্রস্তুত থেকো।
নির্ধারিত দিনে রাতের ঘোর অন্ধকারে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আবু বকরের গৃহে উপস্থিত হলেন। তাঁদের সফরের মালপত্র গোছগাছ করে দিলেন দুই বোন— হজরত আয়েশা ও হজরত আসমা। শুরু হলো মহান হিজরতের সংগোপন অভিযাত্রা।
মদীনাবাসীগণ বিপুল আনন্দ, উলাস ও ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গ্রহণ করলেন বিপুল কর্মোদ্যোগ। গভীর আলাহ্প্রেমে আপুতহয়ে সকলকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুললেন মসজিদ। নির্মিত হলো তাঁর নিজের ও মুহাজির সাহাবীগণের বাসগৃহ। পরিবার-পরিজনদেরকে মক্কা থেকে আনার ব্যবস্থা করা হলো।
হজরত আয়েশা উঠলেন পিতৃগৃহে। মদীনার নাম তখন ছিলো ইয়াস্রেব। আবহাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত ছিলো না। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হজরত আবু বকরও রোগাক্রান্তহয়ে পড়লেন। কিছুদিন রোগভোগের পর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দোয়ায় পিতা সুস্থ হয়ে উঠলেন বটে, কিন্তু শয্যাগ্রহণ করলেন কন্যা। এবার পিতা মনোযোগী হলেন কন্যার প্রতি। ব্যথিত অন্তরে প্রাণাধিক প্রিয় কন্যার শয্যাপাশে বসে রোদন করলেন। আদর করে মাঝে মাঝে তাঁর মুখে নিজের মুখ ঘষতেন। অসুখ ছিলো মারাত্নক। বেশ কিছু দিন পর তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু শারীরিকভাবে হয়ে পড়লেন অনেক দুর্বল। মাথার বেশীর ভাগ চুল খসে পড়ে গেলো।
সাত মাস কেটে গেলো এভাবে। একদিন হজরত আবু বকর বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনার স্ত্রীকে ঘরে তুলে নিচ্ছেন না কেনো ? মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, মোহর পরিশোধ করার মতো অর্থ হাতে নেই। হজরত আবু বকর বললেন, অনুগ্রহ করে আমার অর্থ গ্রহণ করুন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জানেন, আবু বকরের কাছে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রাণাপেক্ষাও প্রিয়। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অমত করলেন না। পাঁচশত দিরহাম নিয়ে মোহরানা পরিশোধ করলেন।
বধূবরণের দিন ধার্য করা হলো ২১ শাওয়াল। হজরত আবু বকরের গৃহে মদীনাবাসিনীগণ উপস্থিত হলেন নতুন বউকে বরণ করে নিতে। হজরত আয়েশা তখন বালিকা। সকলে দেখলেন হজরত আয়েশা বাড়ীর আঙ্গিনায় খেজুর গাছের তলায় অন্য মেয়েদের সাথে খেলছেন। কখনো দোল খাচ্ছেন। মা ডাক দিলেন। তিনি হাঁফাতে হাঁফাতে মায়ের কাছে এলেন। মা তাঁকে পানির মটকার কাছে নিয়ে গেলেন। হাত মুখ ধুয়ে দিলেন। চুল আঁচড়ে দিলেন। তারপর তাঁকে হাজির করলেন আনসারী মহিলাগণের সামনে। মহিলারা বললেন, আপনার আগমন শুভ হোক। কল্যাণময় হোক। তাঁরা নববধুকে সাজালেন। একটু পরে সেখানে উপস্থিত হলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং। তাঁকে আপ্যায়নের জন্য উপস্থিত করা হলো এক পেয়ালা দুধ।
আসমা বিনতে ইয়াযিদ ছিলেন হজরত আয়েশার খেলার সাথী। তিনি বলেছেন, আমি ছিলাম আয়েশার বান্ধবী। আমিই তাকে বধূবেশে রসুলুল্লাহর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। সাথে আরো অনেকে ছিলো। আমরা তখন রসুলুল্লাহর সামনে এক পেয়ালা দুধ ছাড়া অন্য কিছু উপস্থিত করতে পারিনি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পেয়ালা হাতে নিয়ে এক চুমুক পান করলেন। তারপর পেয়ালাটি এগিয়ে দিলেন আয়েশার দিকে। সে লজ্জায় অধোবদন হয়ে ছিলো। আমি বললাম, রসুলুল্লাহর দান ফিরিয়ে দিয়ো না। সে পেয়ালাটি হাতে নিলো। সামান্য পান করলো। রসুলুল্লাহর বললেন,তোমার সাথীদেরকে দাও। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসুল! পানের আগ্রহ আমাদের নেই। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, মিথ্যে বলো না। প্রতিটি মিথ্যা আমলনামায় লেখা হয়। ছোট ছোট মিথ্যা হলেও।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকার বিবাহের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি কুসংস্কার ও কুপ্রথার মূলোৎপাটন করা হয়। যেমন—
১. ভ্রাতৃসম্পর্কীয় কারো মেয়েকে তারা বিয়ে করতো না।
২. অতীতের কোনো এক সময়ের শাওয়াল মাসে পেগ দেখা দিয়েছিলো।
ওই মহামারীতে বহু লোক মারা গিয়েছিলো বলে তারা শাওয়াল মাসকে অশুভ মনে করতো।
ওই মাসে বিবাহ শাদী হতো না। আরহজরত আয়েশার বিবাহ ও পতিগৃহ যাত্রা ঘটেছিলো শাওয়াল মাসে।
৩.নববধূকে দিনের বেলা ঘরে আনার বিষয়টিও ছিলো প্রচলিত প্রথার বিপরীত।
৪. বরযাত্রীর সামনে জ্বালিয়ে রাখা হতো আগুন।
৫. নবদম্পতির প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হতো কোনো মঞ্চে। অথবা তাঁবুর অভ্যন্তরে। এ সকল কুপ্রথাও উচ্ছেদ হয়ে গেলো।
হজরত আয়েশা (রাঃ) নিজেই বলেছেন, আমার বিয়ে ও স্বামীগৃহে গমন ঘটেছিলো শাওয়াল মাসে। আর আমি ছিলাম রসুলুল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় পত্নী। সুতরাং আমার চেয়ে ভাগ্যবতী আর কে ? এ কারণেই হয়তো তিনি বিবাহ অনুষ্ঠান শাওয়াল মাসে হওয়াকেই অধিক পছন্দ করতেন।
স্বামীগৃহই নারীদের সর্বাপেক্ষা আপন বাসগৃহ। প্রত্যেক বিশ্বাসবতী এই গৃহেই পৃথিবীর জীবন সমাপ্ত করতে চায়। চায় স্বামীর একান্ত সন্তোষ। প্রেম-ভালোবাসা। সুখ-দুঃখের সমান অংশ। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা বিশ্বাসবানগণের জননী। বিশ্বাসবতীগণের মাথার মুকুট। আদর্শস্থানীয়া। তিনি জানেন এবং মানেন যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কেবল তাঁর স্বামী নন, তিনি সকল নবীর নেতা। তিনি মহাবিশ্বের মহামমতার অপার পারাবার।
মসজিদে নববী ছিলো বনী নাজ্জার মহলায়। মসজিদের চারপাশে ছোট ছোট দুই তিনটি কাঁচা ইটের ঘর তৈরী করা হয়েছিলো। প্রতিটি ঘরের দৈর্ঘ্য দশ হাত এবং প্রস্থ ছয় হাত। আর উচ্চতা মাথার কিছুটা উপরে। ছাদ খেজুর পাতার। পর্দা হিসেবে দরজায় কম্বল ঝুলানো থাকতো।
একটি ঘরে বাস করতেন উম্মতজননী হজরত সওদা। তিনি সত্তাগতভাবেই ছিলেন বিদ্বেষবিমুক্তা। তিনিই হজরত আয়েশাকে স্বাগতম জানালেন। পাশের ঘরেই তাঁর জায়গা করে দিলেন। হজরত আয়েশার ঘরখানি ছিলো মসজিদের পূর্বদিকে। তার একটি দরজা ছিলো মসজিদের পশ্চিম দিকে মসজিদের ভিতরে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওই দরজা দিয়ে মসজিদে যেতেন।
হজরত আয়েশা নিজের ঘরে প্রবেশ করে দেখলেন, ঘরে রয়েছে একটি খাট, একটি চাটাই, একটি বিছানা, একটি বালিশ, খোরমা, খেজুর রাখার দুটি মটকা, পানি রাখার একটি পাত্র, আর পানি পানের জন্য একটি পেয়ালা। এই নিয়ে তাঁর সংসার যাত্রা শুরু হলো। তিনি জ্ঞানবতী। ধৈর্যশালিনী। তিনি সহজেই বুঝলেন, ধনী ব্যবসায়ী পিতার গৃহ আর আল্লাহর রসুলের গৃহ এক নয়। বিত্তবৈভবের অযথার্থ প্রবেশাধিকার এখানে নেই। আখেরাতের কল্যাণ ছাড়া কল্যাণ নেই— এই মহান বার্তা বিশ্বমানবতার কাছে পৌঁছানো হবে তো এই গৃহ থেকেই।
রাতে ঘরে আলো জ্বলে না। অথচ এই গৃহই সকল আলোর উৎস। তিনি নিজেই বলেছেন, একাধারে প্রায় চল্লিশ রাত চলে যেতো, ঘরে বাতি জ্বলতো না। আসবাবপত্রহীন ঘর গোছগাছ ও সাজ-পরিপাটির কোনো প্রয়োজন পড়ে না। রান্না বান্নার সুযোগও আসে খুব কম। তিনি নিজে বলেছেন, নবী পরিবারের লোকেরা একাধারে তিনদিন পেটপুরে খেয়েছেন, এরকম ঘটনা কখনো ঘটেনি। মাসের পর মাস রান্নার আগুন জ্বলতো না। খেজুর ও পানির উপরেই দিন গুজরান করতে হতো।
সাহাবীগণের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আহার্যসামগ্রী হাদিয়া হিসেবে আসে। যেদিন রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আয়েশার গৃহে রাত্রিযাপন করেন, সেদিন তাঁর গৃহে হাদিয়া- তোহফা আসে বেশী। কারণ তাঁরা জানতেন, রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সর্বাধিক প্রিয়পাত্রী হজরত আয়েশা সিদ্দীকা। আবার কোনো কোনো সময় এমন হয়— তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বাইরে থেকে এসে বলেন, আয়েশা! খাবার কি আছে? তিনি বলতেন, হে আল্লাহর রসুল! কিছুই তো নেই। তখন সবাই মিলে রোজা রাখেন। আবার অধিকাংশ সময় হাদিয়া হিসেবে প্রাপ্ত দুধ পান করেই সকলকে তৃপ্ত থাকতে হয়।
নবী পরিবারের প্রধান খাদেম হজরত বেলাল (রাঃ)। তিনিই উম্মতজননীগণের ঘরে আহার্য বণ্টন করতেন। প্রয়োজন হলে ধার-কর্জ করতেন।
হজরত আয়েশা ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। কিন্তু বয়স কম হওয়ার কারণ সাংসারিক কাজে মাঝে মাঝে কিছু ভুলত্রুটি হয়ে যেতো। যেমন— একদিন তিনি নিজ হাতে আটা ছেনে রুটি তৈরী করলেন। রাত হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘরে এসেই নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। হজরত আয়েশার দুচোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। এই সুযোগে প্রতিবেশীর একটি ছাগল এসে রুটিগুলো খেয়ে চলে গেলো। আর একটি বিষয়ও ছিলো— উম্মতজননীগণের মতো তিনি রন্ধনে পটু ছিলেন না।
আল্লাহপাক এরশাদ করেন ‘আর তাঁর এক নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে মানবিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে এই পবিত্র আয়াতের প্রকৃত মর্ম সবচেয়ে বেশী বুঝতেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সংসারজীবনকে ভরে তুলেছিলেন অনাবিল আনন্দে, প্রেমে-প্রীতিতে ও ভালোবাসায়। তাঁর কিশোরী বধূকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কতোভাবে যে আনন্দ দান করতেন, তা গণনা করা দুরূহ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকটে সর্বোত্তম। আমি আমার স্ত্রীদের নিকট তোমাদের সকলের চেয়ে উত্তম।
স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উভয়কে তুষ্ট রাখবে- এটা দাম্পত্য জীবনের একটি প্রধান দায়িত্ব। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং তাঁর সকল সহধর্মিণী এ ব্যাপারে ছিলেন সদা-সচেতন। হজরত আয়েশা তাঁর অন্যান্য সপত্নীদের চেয়ে বয়সে ছোট ও কুমারী ছিলেন বলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সাথেই হাস্য-কৌতুক করতেন বেশী। তাঁর খেলাধুলাকেও প্রশ্রয় দিতেন। তাঁর কিশোরীসুলভ কথাবার্তা শুনে আনন্দিত হতেন। কখনো কখনো গল্পও শুনতেন তাঁর।
তিনি নিজে বলেছেন, আমি রসুলুল্লাহর সামনে পুতুল নিয়ে খেলতাম। আমার সখী-সহচরীরাও আমার সাথে খেলতো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হঠাৎ এসে পড়লে তারা দৌড়ে পালাতে চাইতো। তিনি নিষেধ করতেন। আমার সাথে খেলা করতে বলতেন।
একদিন তিনি পুতুল নিয়ে খেলছেন। পুতুলগুলোর মধ্যে একটি ঘোড়াও ছিলো। পাখাও ছিলো ঘোড়াটির। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেখানে উপস্থিত হলেন। সুপ্রশন্ন কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, ওটা কী? হজরত আয়েশা বললেন, ঘোড়া। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ঘোড়ার আবার পাখা থাকে নাকি? হজরত আয়েশা বললেন, থাকে, থাকে। আপনি জানেন না, নবী সুলায়মানের ঘোড়ার পাখা ছিলো?
তিনি আরো বলেছেন, একবার হাবশীরা মসজিদ প্রাঙ্গণে যুদ্ধের কলাকৌশলমূলক খেলা দেখাচ্ছিলো। আমি দাঁড়িয়ে তাদের খেলা দেখতে লাগলাম। আমি সেখান থেকে সরে না আসা পর্যন্ত রসুলুল্লাহর তাঁর চাদর দিয়ে আমাকে আড়াল করে রাখলেন। তিনি বর্ণনা করেছেন, আমার ঘরে দুজন আনসার বালিকা বু’আস যুদ্ধের গান শোনাচ্ছিলো। এমন সময় রসুলুল্লাহ (সাঃ) এলেন। কোনোকিছু না বলে শয্যায় মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে উপস্থিত হলেন আমার পিতা। তিনি আমাকে শাসালেন। বললেন, কী হচ্ছে এসব! আল্লাহর রসুলের ঘরে শয়তানের গান। রসুলুল্লাহর তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ওদেরকে গাইতে দাও।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আয়েশার মনোরঞ্জনের জন্য তাঁর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতাও করেছেন। হজরত আয়েশা এ সংবাদটিও জানিয়েছেন তাঁর এক বর্ণনার মাধ্যমে এভাবে— আমি রসুলুল্লাহর সঙ্গে এক সফরে ছিলাম। আমি তখন সদ্য তরুণী। শরীর ছিলো কৃশ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে বললেন, তোমরা এগিয়ে যাও। তাঁরা এগিয়ে গেলে বললেন, এসো দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আমি সানন্দে রাজী হলাম। দৌড় দিলাম। রসুলুল্লাহর আমার আগে যেতে পারলেন না। পরের এক সফরে তিনি আবারও সাহাবীগণকে এগিয়ে যেতে বললেন। তারপর আমাকে আহবান জানালেন দৌড় প্রতিযোগিতা করতে। আগের প্রতিযোগিতার কথা আমার মনেও ছিলো না। এবারের প্রতিযোগিতায় আমি আর প্রথম হতে পারলাম না। তিনি হেসে বললেন, এবার বদলা নিলাম।
একদিন হজরত আয়েশা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে একটি কল্পকথা শোনালেন। তিনি বলেছেন, তখন আমার পাশে ছিলেন আমার মা। তিনি বললেন, আমাদের বেশীর ভাগ হাসির গল্প এসেছে বনী কেনানা থেকে। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, না। বরং আমাদের পাড়াটাই হাসি আনন্দের প্রতীক।
একদিন ঘটলো একটি মজার ঘটনা। হজরত আয়েশা সিদ্দীকার বিবরণীতে ঘটনাটি এসেছে এভাবে— একবার আমি রসুলুল্লাহর জন্য তৈরী হারীরা (আহার্য বিশেষ) তাঁর সামনে উপস্থিত করলাম। নবিপাকের স্ত্রী সওদাও ছিলেন সেখানে। তাঁকেও খেতে বলা হলো। তিনি খাবেন না বললেন। আমি বললাম, খাও। নয়তো জোর করে হারীরা দিয়ে তোমার সারা মুখ রঙিন করে দিবো। সওদা তবুও খেলেন না। আমি তখন জোর করে তাঁর সারা মুখে হারীরা লাগিয়ে দিলাম। রসুলুল্লাহ হেসে ফেললেন। আমার হাত চেপে ধরে সওদাকে বললেন, এবার তুমি আয়েশার মুখে হারীরা মাখিয়ে দাও। সওদা সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবার হেসে ফেললেন। হঠাৎ ওমরকে আসতে দেখে বললেন, যাও। এবার তোমরা মুখ ধুয়ে নাও।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকাও মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে ভালোবাসতেন খুব। নবীপ্রেম ও স্বামীপ্রেম একাকার হয়ে সারাক্ষণ তাঁর হৃদয়কে আলোকিত করে রাখতো। স্বামীবিচ্ছেদ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে শয্যায় স্বামীকে না পেলে অস্থির হয়ে পড়তেন। অন্ধকার ঘরে খুঁজতে চেষ্টা করতেন। কখনো খুঁজে পেতেন, কখনো পেতেন না। কখনো তাঁর পায়ে হাত ঠেকাতো। হাতড়ে দেখে বুঝতেন, আল্লাহর রসুল সেজদায় পড়ে আছেন।
একবার তাঁকে হাতের কাছে না পেয়ে ভাবলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হয়তো তাঁর অন্য স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। একটু পরে তাঁর ভুল ভাঙলো। দেখলেন, আল্লাহর রসুল ঘরের এক কোণে বসে তসবিহ্ পাঠে মগ্ন। তিনি লজ্জিত হলেন। আপন মনে বলে উঠলেন, আমার পিতামাতা আল্লাহর রসুলের জন্য উৎসর্গীত হোক। আমি কী ভাবছি। আর তিনি কী করছেন।
আর এক রাতের ঘটনা। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলো হজরত আয়েশার। দেখলেন, রসুলুল্লাহ নেই। তাঁর সন্ধানে তিনি ঘর থেকে বের হলেন। কবরস্থানে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলেন, তিনি কবরবাসীদের জন্য দোয়া ও ক্ষমাপ্রার্থনায় মগ্ন। তিনি নীরবে ফিরে এলেন। সকালে একথা যখন জানালেন, তখন রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, রাতে একবার মনে হয়েছিলো, কে যেনো চলে যাচ্ছে। তাহলে তুমিই গিয়েছিলে।
এক সফরের ঘটনা— রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সফরসঙ্গিনী ছিলেন হজরত হাফসা ও হজরত আয়েশা। একদিন তাঁরা কী মনে করে যেনো নিজেদের উট বদল করে নিলেন। রাতে সফরের শুরুতে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত হাফসার উটে উঠে গেলেন।
হজরত আয়েশা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে না পেয়ে বিরহযন্ত্রণায় খুবই কষ্ট পেতে লাগলেন। পরের বিরতিস্থলে কাফেলা থামলে তিনি উট থেকে নেমে পাশের এক বনে ঘাসের জঙ্গলে পা দুটো ডুবিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! বিচ্ছু অথবা সাপ পাঠিয়ে দাও। আমাকে দংশন করুক। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।
শুরু হয় বিজয়ের পর বিজয়। বিভিন্ন জনপদের মানুষ ক্রমে ক্রমে ইসলামের অনুগত হতে থাকে। কোথাও শুরু হয় সংঘর্ষ-যুদ্ধ। উহুদযুদ্ধ হয় মদীনার উপকণ্ঠে। ওই যুদ্ধে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রিয় পিতৃব্য হজরত হামযাসহ সত্তর জন প্রধান সাহাবী শহীদ হন। কিন্তু শেষে শত্রুরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খুবই ব্যথিত হন। কিন্তু সত্যধর্ম ইসলাম প্রচারে হন পূর্বাপেক্ষা অধিক উজ্জীবিত। এভাবে কখনো শান্তি, আবার কখনো সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রসার ঘটতেই থাকে।
উম্মতজননীগণের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কেবল ইসলামের অন্তরঅঙ্গ ও বহিরঅঙ্গকে উজ্জ্বল, উজ্জ্বলতর করবার জন্যই আলাহ্পাকের নির্দেশানুসারে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে বিবাহ করতে হয়। হজরত আয়েশা ও হজরত সওদার ঘরের পাশে একই মাপের কাঁচা ইটের ঘর নির্মিত হতে থাকে।
সে ঘরগুলোতে একে একে এসে ওঠেন হজরত হাফসা, হজরত যয়নাব বিনতে খুযায়মা, হজরত উম্মে সালমা, হজরত যয়নাব বিনতে জাহাশ, হজরত জুওয়াইরিয়া, হজরত উম্মে হাবীবা, হজরত সাফিয়া এবং হজরত মায়মুনা রদ্বিআলাহু তায়ালা আনহুমা। হজরত আয়েশা তাঁদের সকলের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে চলেন। সকলেই নবীজায়া। সকলেই সাধ্বী, শুভ্র ও পবিত্র। তাই সকলেই প্রীতিময় পরিবেশে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে ঘিরে রাখেন শান্তি-সান্ত্বনা ও সুগভীর প্রেম-ভালোবাসা দিয়ে। স্ত্রীগণের প্রতি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর আচরণ যে কতো মধুর, কতো শুভ্র-সুন্দর— তা তাঁরা প্রচার করেন। বিশ্বাসী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাঁরা সবাইকে জ্ঞানের আলোকে করেন সুউদ্ভাসিত।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সবচেয়ে আদরের কন্যা হজরত ফাতেমা (রাঃ) এর সঙ্গেও তাঁর গড়ে ওঠে গভীর ভাব ও ভালোবাসা। তিনি বলেছেন, আমি ফাতেমার চেয়ে তাঁর পিতা ছাড়া অন্য কোনো ভালো মানুষ দেখিনি। আরো বলেছেন, রসুলুল্লাহর সাথে চাল-চলনে ওঠা বসায় মিলে যায়— ফাতেমা ছাড়া আর কাউকে আমি দেখিনি। ফাতেমা তাঁর পিতার সঙ্গে দেখা করতে এলে রসুলুল্লাহর দাঁড়িয়ে তাঁকে বরণ করে নিতেন। তাঁর কপালে চুমু খেতেন। নিজের স্থানে বসাতেন। আবার রসুলুল্লাহ তাঁর ঘরে গেলে তিনিও উঠে দাঁড়িয়ে পিতাকে কাছে টেনে নিতেন। কপালে চুমু খেতেন এবং নিজের স্থানে বসাতেন। অন্য তিন নবীদুলালী যয়নাব, রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিলো প্রীতিময়। হজরত ফাতেমার বিবাহের সময়ও তিনি পালন করেন সর্বাপেক্ষা উচ্ছ্বসিত আয়োজিকার ভূমিকা। আর তিনিই মানুষকে এই শুভ বিবৃতিটি জানান যে, মেয়েদের মধ্যে রসুলুল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন ফাতেমা। আর ছেলেদের মধ্যে আলী।
তিনি অন্তরে ঈর্ষাবোধ করতেন কেবল হজরত খাদিজার জন্য। কারণ তাঁর কথা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রায় প্রতিদিন বলতেন এবং বেশী বেশী করে বলতেন। এক বিবরণে বলা হয়েছে, একদিন রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনেকক্ষণ ধরে হজরত খাদিজার প্রশংসা করলেন। হজরত আয়েশা বলেন, শুনতে শুনতে আমার অন্তর্দাহ আরম্ভ হলো। আমি বলে ফেললাম, হে আল্লাহর রসুল! বহু পূর্বে গত কুরায়েশ কুলোদ্ভবা লাল ওষ্ঠধারিনী এক বৃদ্ধার প্রশংসা আপনি এতো সময় ধরে করেছেন। আল্লাহ তো আপনাকে তাঁর চেয়ে উত্তম পত্নী দান করেছেন।
রসুলুল্লাহর মুখমণ্ডলের রঙ বদলে গেলো। বললেন, যখন মানুষ আমাকে নবী বলে বিশ্বাস করতো না, তখন সে ছিলো বিশুদ্ধ বিশ্বাসিনী। মানুষ যখন আমাকে মিথ্যাবাদী মনে করতো, তখন খাদিজা প্রচার করতো আমার সত্যবাদিতার। মানুষ যখন আমাকে সাহায্য করতে চায়নি, তখন সে তার অর্থ-বিত্ত সহকারে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে আমাকে সন্তান দিয়েছেন।
বলাবাহুল্য, হজরত আয়েশার ঈর্ষা ছিলো পবিত্রতারই প্রেমময় এক রূপ। ছিলো নবীপ্রেমের সুগভীর ও সুতীক্ষ্ণ এক প্রকাশ। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে তাঁর মান-অভিমানের মাত্রা কখনোই শ্রদ্ধাময় ভালোবাসার বৃত্তবহির্ভূত হতে পারতো না। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সেবা-যতেড়বর জন্য তিনি ছিলেন সতত প্রস্তুত। ঘরে পরিচারক-পরিচারিকা থাকা সত্ত্বেও গৃহকর্ম নিজ হাতে সম্পাদন করতেন। নিজ হাতে আটা পিষতেন। খাবার তৈরী করতেন। বিছানা পাততেন। ওজুর পানি রেখে দিতেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মাথায় চিরুনী করে দিতেন। শরীরে আতর লাগিয়ে দিতেন। কাপড় ধুয়ে দিতেন। মেসওয়াক ধুয়ে রাখতেন। রাতে শোয়ার সময় মেসওয়াক ও পানি রেখে দিতেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শিয়রে।
একদিন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গায়ে কম্বল জড়িয়ে মসজিদে গেলেন। জনৈক সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনার কম্বলের এখানে তো ময়লার দাগ লেগে আছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথে সাথে কম্বলটি হজরত আয়েশার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। হজরত আয়েশা পানি দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করলেন। অতি দ্রুত শুকিয়ে আবারপাঠিয়ে দিলেন রসুলুল্লাহর কাছে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রশন্ন না অপ্রশন্ন, তা তিনি তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) চেহারা দেখেই বুঝতে পারতেন। একবার তিনি তাঁকে খুশী করবার জন্যই দরজায় একটি ছবিযুক্ত পর্দা ঝুলিয়ে দিলেন। কিন্তু তা দেখে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হলেন অতুষ্ট।
হজরত আয়েশা বললেন, হে আল্লাহর রসুল! অপরাধ কী তা জানতে ইচ্ছা করি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যে ঘরে ( জীবন্ত প্রাণীর ) ছবি থাকে, সে ঘরে (রহমতের) ফেরেশতা প্রবেশ করে না। মহানবী মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রসুল। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল। তাঁর ধ্যান- অনুধ্যান, চিন্তা- ভাবনা, কথা-বার্তা, চাল-চলন— সবকিছু থেকে সারাক্ষণ উপচে পড়ে নূর। আল্লাহ ও আখেরাতের প্রেমের নির্বর্ণনীয় ও নিরক্ষয় নূর। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, দুনিয়ার মহব্বত সকল পাপের মূল।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘরে ঢুকলে কিছুটা উচ্চকণ্ঠে প্রায়শঃই বলতে থাকেন, আদম সন্তান যদি ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ দুটি উপত্যকার মালিক হয়, তবে সে লোভ করে তৃতীয় আর একটির। তার লোভের মুখ ভরে দিতে পারে কেবল মৃত্তিকা। আল্লাহ বলেন, ধন-সম্পদ তো আমি সৃষ্টি করেছি নামাজ কায়েম ও জাকাত দানের নিমিত্তে। যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে তাকায়, আল্লাহ ও তাকান তার দিকে।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকশ্রেষ্ঠ হজরত আবু বকরের কন্যা। নিজেও সিদ্দীকাগণের নেতৃস্থানীয়া। তাই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র স্বভাব ও মনোভাবের জ্যোর্তিময়তার মধ্যে সতত নিমগ্ন থাকতে পারেন তিনি। ভালোবাসেন। ভালোবাসা পান। হন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুলের প্রাণের প্রিয়তম।
বয়ে চলে সময়ের স্রোত। জলবতী নদীর মতো। নিরিবিলি। নিরবধি। অনেক ঘটনার জন্ম দিয়ে অনেক দিন, মাস, বছর অতীত হয়ে গেলো। এসে পড়লো ষষ্ঠ হিজরী। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা চৌদ্দ বছরে পড়েছেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে মর্মবিদারক ঘটনাটি ঘটে গেলো ওই বছরেই। তিনি হলেন মুনাফিকদের অশুভ ও অপবিত্র ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যস্থল।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সংবাদ পেলেন, মুরাইসি জনপদের পার্শ্ববর্তী লোকেরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতি গ্রহণ করছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজেই সাহাবীগণকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ যাত্রা করলেন। সঙ্গী হলো মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলের অনেকে। ফেরার পথে তারা উম্মতজননী আয়েশা সম্পর্কে এক জঘন্য অপবাদ রটিয়ে দেয়। তিনি নিজে ঘটনাটির বিবরণ দিয়েছেন এভাবে— ফেরার পথে একস্থানে যাত্রাবিরতি হলো। রাত্রিযাপনের জন্য খাটানো হলো অনেক তাঁবু। রাতের শেষ ভাগ। আমি প্রকৃতির ডাকে বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এলাম যখন, তখন দেখলাম, আমার গলার হারটি নেই। হার খুঁজতে খুঁজতে তাঁবু থেকে কিছুটা দূরে চলে গেলাম। অনেক খুঁজেও হারটি পেলাম না। ফিরে এসে দেখি, কাফেলা রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। সফরের নিয়ম ছিলো আমি উটের হাওদাজে উঠে যেতাম। চারজন লোক হাওদাজটি তুলে উটের পিঠে বসিয়ে দিতো। বুঝলাম, আমি যে হাওদাজের মধ্যে নেই, লোকেরা তা বুঝতে পারেনি। শুধু হাওদাজ উঠিয়ে দিয়েছে।
ভোরের আলো ফুটে উঠলো। আমি হারটি খুঁজে পেলাম। আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বসে থাকলাম। ভাবলাম, সামনের বিরতি স্থলে গিয়ে সকলে আমার অনুপস্থিতির কথা জানতে পারবে। খুঁজতে খুঁজতে এসে পড়বে এখানে। এভাবে বসে থাকতে থাকতে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রজিউন’ শব্দ শুনে। দেখলাম, সামনে দাঁড়িয়ে সাফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আস্সুলামী। তার দায়িত্ব ছিলো কাফেলার পিছনে পিছনে আসা। কারও কোনো জিনিসপত্র ছাড়া পড়লো কি না তা পর্যবেক্ষণ করা। তিনি বিস্মিত হলেন। বললেন, আম্মাজান! আপনি! আর কোনো কথা না বলে তাঁর উটটিকে আমার সামনে এনে বসালেন। আমি উটের পিঠে উঠলাম। তিনি উটটির লাগাম ধরে আগে আগে চলতে শুরু করলেন। দুপুর বেলার কিছু আগে কাফেলার কাছে উপস্থিত হতে পারলাম। আমাকে উট থেকে নামতে দেখলো অনেকে। মুনাফিক শ্রেষ্ঠ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আমাদেরকে দেখে চিৎকার করে বলে উঠলো, আল্লাহর কসম! এই নারী নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। অন্য পুরুষের সঙ্গে রাত্রিযাপন করেছে।
মদীনায় পৌঁছে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। শয্যাশায়ী হয়ে থাকলাম একমাস ধরে। ওদিকে সমস্ত শহরে যে আমার নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে— তা আমি জানতেও পারলাম না। শুধু লক্ষ্য করলাম, রসুলুল্লাহর মুখ ভার। আমার সঙ্গে তেমন কথাও বলেন না। অন্যকে জিজ্ঞেস করেন, ও কেমন আছে ? আমার অভিমান হলো। তাঁর অনুমতি নিয়ে পিতৃগৃহে চলে এলাম। একদিন রাতের বেলা প্রকৃতির ডাকে বাইরে গেলাম। সঙ্গে ছিলেন মেসতাহ্ ইবনে উসামার মা।
তিনি ছিলেন আমার পিতার খালাতো বোন। পথ চলতে চলতে তিনি হোঁচট খেলেন। তৎক্ষণাৎ তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হলো ‘মেসতাহ্ ধ্বংস হোক’। আমি বললাম, কেমন মা আপনি? নিজের ছেলের ধ্বংস কামনা করছেন। সে তো বদরযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। তিনি বললেন, তুমি তো দেখছি কিছুই জানো না। তিনি আমাকে সব কিছু খুলে বললেন। আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেলো। আরো জানতে পারলাম, মুনাফিকদের ওই অপবাদ অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে সাহাবীগণের মধ্যে মেসতাহ ইবনে উসামা, কবি হাস্সান ইবনে সাবেত এবং উম্মতজননী যয়নাবের বোন হাসনা বিনতে জাহাশ।
ঘরে এসে আমি সারারাত ধরে কাঁদলাম। বুঝতে পারলাম, রসুলুল্লাহ ও কষ্ট পাচ্ছেন খুব। শুনতে পেলাম, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইতোমধ্যে আলী ও উসামার পরামর্শও চেয়েছেন। উসামা বলেছে, আমি তাঁর মধ্যে ভালো ছাড়া মন্দ কিছু দেখিনি। যা কিছু রটানো হচ্ছে, তার সবই মিথ্যা। আলী বলেছে, হে আল্লাহর রসুল! মেয়ের তো অভাব নেই। আপনি অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন। দাসীকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারেন। দাসীকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলেছে, আল্লাহর শপথ! যিনি আপনাকে সত্যধর্মসহ প্রেরণ করেছেন, আমি তাঁর মধ্যে কখনোই মন্দ কিছু দেখিনি। দোষ দেখেছি তো শুধু এতোটুকু— আমি আটা মেখে তাঁকে বলতাম, একটু দেখে রাখুন। এই এক্ষুণি আমি আসছি। তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন, আর ছাগল এসে আটা খেয়ে যেতো।
সেদিনই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মসজিদে সকলকে একত্র করে বক্তৃতা করলেন। বললেন, হে বিশ্বাসী জনতা! তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে অপবাদকারীর আমন্ত্রণ থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবে? আলাহর শপথ! আমি তো আমার স্ত্রীর কোনো দোষ দেখি না। ওই লোকটিও তো নিরপরাধ, যার সম্পর্কে অভিযোগ তোলা হয়েছে।
ভাষণ শুনে উঠে দাঁড়ালেন আউস গোত্রের দলপতি হজরত উসাইদ ইবনে হুদাইর, অথবা হজরত সা’দ ইবনে মুয়াজ। বললেন, হে আল্লাহর বচনবাহক! অপবাদ দানকারী যদি আমাদের গোত্রের হয়, তবে আমরা তাকে হত্যা করবো। আর খাজরাজ গোত্রের হলে আপনি যা বলবেন তাই করবো।
একথা শুনেই খাজরাজদের দলপতি সা’দ ইবনে উবাদা দাঁড়ালেন। বললেন, না। তুমি কিছুতেই খাজরাজদেরকে হত্যা করতে পারবে না। তোমার কথায় প্রকাশ পাচ্ছে বিদ্বেষ।
দুই গোত্রের লোকেরা বাদানুবাদ শুরু করলো। বাক-বিতণ্ডা হট্টগোল এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে, মনে হলো এক্ষুণি যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। হতোও তাই। কিন্তু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের মাঝখানে দাঁড়ালেন। দু’পক্ষই তাঁর সম্মানে অবনত হলো। বাদানুবাদও থেমে গেলো অল্পক্ষণের মধ্যে। প্রায় এক মাস ধরে মিথ্যা অপবাদের বাতাস মদীনা মুনাওয়ারাকে কলুষিত করে রাখলো। রসুলুল্লাহ অবর্ণনীয় মানসিক যাতনায় কষ্ট পেতে লাগলেন।
আমারও দিবস-যামিনী অতিবাহিত হতে লাগলো রোদনে ও শোকাচ্ছনড়বতায়। আমার পিতা-মাতাও অহরহ পুড়তে লাগলেন উদ্বেগের আগুনে। আর বিশ্বাসী জনতার জীবনযাত্রা হয়ে পড়লো দুঃখ ও দুর্ভাবনাময়।
রসুলুল্লাহ আমার কাছে এলেন এক মাস পর। পাশে বসলেন। একটু পরে উপস্থিত হলেন আমার পিতা-মাতা। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আয়েশা ! শুনেছো তো সবকিছু। তুমি যদি নিষ্পাপ হও, তাহলে আশা করি আল্লাহ তোমার নিষ্পাপত্ব প্রকাশ করে দিবেন। আর জেনে রেখো, অপরাধীদের জন্যও তাঁর ক্ষমা ও দয়ার দরজা সতত উন্মুক্ত। তওবাকারীকেও আল্লাহ ভালোবাসেন।
একথা শুনে আমার চোখের জল শুকিয়ে গেলো। পিতাকে বললাম, রসুলুল্লাহর কথার জবাব দিন। তিনি বললেন, কী বলবো, বুঝতে পারছি না। মাকে বললাম, আপনি কিছু বলুন। তিনি অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন, কী বলবো, জানি না। আমি বললাম, বুঝেছি। এ সকল অপবাদ আপনাদের মনের গভীরে রেখাপাত করেছে। এখন আমি যদি বলি, আমি পবিত্র, আল্লাহ জানেন আমি অবশ্যই পবিত্র— তবে আপনারা বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এই অপবাদকে স্বীকার করি, যা থেকে আমি মুক্ত, হ্যাঁ, আমি অবশ্যই মুক্ত, তবে আপনারা বিশ্বাস করবেন। আমার অবস্থা এখন নবী ইউসুফের পিতার মতো।
ধৈর্য ধারণই এখন আমার একমাত্র কর্তব্য। আমি তাই করলাম। ‘সবরুন জামিল’কে গ্রহণ করলাম। আল্লাহই আমার একমাত্র সহায়। আমার দুঃখ-কষ্টের জন্য আমি কেবল আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ করছি। একথা বলেই আমি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। শোকে দুঃখে কাতর আমার পিতা ক্রোধান্বিত হলেন। ক্রোধের লক্ষ্যস্থল করলেন আমাকেই। বললেন, আজ যে কলংকের কালিমায় আমার গোটা পরিবার কলংকময়, এরকম কলংক আরবের কোনো পরিবারে পড়েনি। মূর্খতার যুগেও আমরা ছিলাম এরকম জঘন্য অপবাদ থেকে মুক্ত। আর ইসলামের যুগে এসে আমাদের এই দুর্ভোগ!
আমার স্থির বিশ্বাস ছিলো, নিশ্চয় মহান আল্লাহ স্বপ্নের মাধ্যমে রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে আমার স্বচ্ছতা সম্পর্কে জানিয়ে দিবেন। কিন্তু আমার সম্পর্কে কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হবে— এরকম কল্পনাও আমি কখনো করিনি। তাই হলো। রসুলুল্লাহর মুখমণ্ডলের রঙ পরিবর্তিত হলো। ললাটদেশে দেখা দিলো স্বচ্ছ স্বেদবিন্দু। তাঁকে একটি চাদরে জড়িয়ে দেওয়া হলো। মাথার নিচে দেওয়া হলো চামড়ার বালিশ। তিনি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
আমি ভীত হলাম না এতোটুকুও। কিন্তু আমার পিতার অবস্থা হলো অত্যন্ত শোচনীয়। তিনি ভয়ে বিবর্ণ হলেন এই ভেবে যে, লোকে যা রটিয়েছে, এখন তা-ই বুঝি বা ওহীর মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে যায়।
রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন। উঠে বসলেন। দেখলাম, তাঁর বদনমণ্ডল হাস্যোজ্জ্বল। পবিত্র ললাটদেশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে মুক্তার মতো স্বচ্ছ ঘর্মবিন্দু। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, আয়েশা! আল্লাহ তোমাকে পবিত্রা বলে ঘোষণা করেছেন।
শোনো, তিনি এরশাদ করছেন—‘‘যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এই অপবাদকে তোমরা নিজেদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না, বরং এটাতো তোমাদের জন্য কল্যাণকর; ওদের প্রত্যেকের জন্য আছে ওদেরই কৃত পাপকর্মের ফল, এবং ওদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তার জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। একথা শুনবার পর বিশ্বাসী পুরুষ ও নারীগণ কেনো নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করেনি এবং বলেনি ‘এ তো নির্জলা অপবাদ’। তারা কেনো এব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সে কারণে তারা আল্লাহর বিধানে মিথ্যাবাদী। ইহলোকে ও পরলোকে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে, তোমরা যাতে মগ্ন ছিলে, তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করতো। যখন তোমরা মুখে মুখে এটা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে, যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিলো না এবং তোমরা একে তুচ্ছ মনে করেছিলে, যদিও আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা ছিলো গুরুতর বিষয়। এবং তোমরা যখন এটা শুনলে তখন কেনো বললেনা ‘এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদের উচিত নয়, আল্লাহ পবিত্র, মহান! এটা তো গুরুতর অপবাদ!’ আল্লাহ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, তোমরা যদি বিশ্বাসী হও, তবে কখনো এরকম আচরণের পুনরাবৃত্তি করো না। আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমুহ সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। যারা বিশ্বাসীদের মধ্যে অশ্লীলতা প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে ইহলোকে ও পরলোকে মর্মন্তুদ শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না’। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে এবং আল্লাহ দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু না হলে তোমাদের কেউই অব্যাহতি পেতো না। হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। কেউ শয়তানের পদাংক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কার্যের নির্দেশ দেয়। আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউ কখনো পবিত্র হতে পারতে না। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পবিত্র করে থাকেন, এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা নূর, আয়াত ১১-২১)।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, আমার পিতা আমার মস্তক চুম্বন করলেন। আমি অভিমানভরে বললাম, আপনি আমার পক্ষে কিছু বললেন না কেনো ? তিনি বললেন, আমি যা জানি না, তা বললে কোন্ আসমান আমাকে ছায়া দিতো ? কোন্ জমিন আমাকে বুকে করে রাখতো? আমার মা বললেন, ওঠো।
রসুলুল্লাহর সামনে দাঁড়াও। আমি বললাম, না। তাঁর সামনে আমি দাঁড়াবো না। আর আল্লাহ ছাড়া কারো প্রশংসাও করবো না। রসুলুল্লাহ আমার পরিধেয় বস্ত্রস্পর্শ করলেন। আমি তাঁর হাত সরিয়ে দিলাম। আমার পিতা রাগান্বিত হলেন। পায়ের জুতা দিয়ে আমাকে মারতে উদ্যোগী হলেন। আমি জুতা ধরে ফেললাম। রসুলুল্লাহ হেসে ফেললেন। আমার পিতাকে বললেন, আল্লাহর শপথ! এরকম করবেন না।
আর এক যুদ্ধযাত্রা সফরে হজরত আয়েশা সিদ্দীকার গলার হার হারিয়ে গেলো। হারটি ছিলো তাঁর বড় বোন হজরত আসমার। রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকেহার খুঁজতে বললেন। তখন রাত। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও হার পাওয়া গেলো না। ভোর হলো। ঘটনাক্রদমে ওই রাতে কিছুসংখ্যক সাহাবী অপবিত্র হয়ে গেলেন। নিকটে কোথাও পানি নেই। ওজু গোসল কীভাবে হবে তাই নিয়ে সকলে মহা দুশ্চিন্তায় পড়লেন। সকলে হজরত আবু বকরের শরণাপনড়ব হলেন। তিনি রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর তাঁবুতে প্রবেশ করে দেখলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আয়েশা (রাঃ) এর কোলে মাথা রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন। হজরত আবু বকর কন্যাকে লক্ষ্য করে বললেন, গোটা কাফেলাকে আটকে রেখেছো। বার বার তুমি আপদ হয়ে দাঁড়াও।
হজরত আয়েশা কোনো কথা বললেন না। তাঁর কোলে নিদ্রামগ্ন নবী। তিনি তো তাঁর বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেন না। গভীর সুপ্তিমগ্ন অবস্থাতেও তো তাঁর কাছে ওহী অবতীর্ণ হয়।
সূর্য উদিত হলো। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জাগ্রত হলেন। পানিসংকটের কথা জেনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। একটু পরেই তাঁর মুখমণ্ডলে প্রকট হয়ে উঠলো ওহী অবতরণের ভাব। অবতীর্ণ হলো—‘আর যদি তোমরা পীড়িত হও অথবা সফরে থাকো অথবা তোমাদের কেউ শৌচস্থান থেকে আসে অথবা তোমরা নারীসম্ভোগ করো এবং পানি না পাও, তবে মাটির চেষ্টা করবে এবং তা মুখে ও হাতে বুলাবে। আল্লাহ পাপমোচনকারী, ক্ষমাশীল।’ (সুরা নিসা)।
এভাবে তায়াম্মুমের বিধান পেয়ে সাহাবীগণ মহাআনন্দিত হলেন। হজরত আবু বকর উৎফুলকন্ঠে বললেন, তুমি কল্যাণময়ী। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার কণ্ঠহারে বরকত আছে। হজরত উসাইদ ইবনে হুদাইর (রাঃ) বললেন, হে উম্মতজননী! আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন। আপনার কারণে যে কোনো কষ্টদায়ক ঘটনা ঘটুক না কেনো, তার মধ্যে উদ্ধারের একটা উপায়ও থাকে। শেষ ফল হয় মঙ্গলময়।
খায়বর যুদ্ধের পর ঘটলো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উম্মতজননীগণ এক জোট হয়ে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে অধিকতর উনড়বত খোরপোষ ও কিছু বিলাস সামগ্রীর দাবী উত্থাপন করলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অপ্রস্তুত ও অতুষ্ট হলেন। তৎসত্ত্বেও উম্মতজননীগণ দাবি ছাড়লেন না। তাঁরা তখন ছিলেন সর্বমোট নয় জন। তাঁদের বোধ ও বুদ্ধি ছিলো সরলতার সৌন্দর্যমণ্ডিত। তাঁরা দেখলেন, ইসলামী রাজ্যের সীমানা এখন সুবিস্তৃত। বহু স্থান থেকে গনিমতের মাল, হাদিয়া, উপহার, উপঢৌকন অনবরত আসছে। সুতরাং তাঁরা কিছু অধিক সুবিধা চাইতেই পারেন। আর স্বামীইতো স্ত্রীর একমাত্র চাহিদা পূরণকারী। তাঁরা তাঁদের দাবিতে কোনো দোষ দেখতে পেলেন না।
কথাটা অনেকের কানেই গেলো। হজরত আবু বকর রসুলুল্লাহ অন্দরমহলে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। পেলেন না। হজরত ওমরও অনুমতি চেয়ে পেলেন না। কিছুক্ষণ পর অবশ্য অনুমতি পাওয়া গেলো। দুজনে প্রবেশ করে দেখলেন, মহামহিম রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুখ ভার করে বসে আছেন। সহধর্মিণীগণ বসে আছেন তাঁর পাশে। হজরত ওমর ভাবতে লাগলেন, কী করে আল্লাহর রসুলকে প্রশন্ন করাযায়।
বললেন, আমার স্ত্রী যদি আমার কাছে ব্যয়বহুল কিছুর জন্য আবদার করে, তবে আমি তার ঘাড় ভেঙে দেব। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর কথা শুনে হেসে ফেললেন। বললেন, দেখতেই পাচ্ছো। এরা কীরকম দলবদ্ধ। হজরত আবু বকর তাঁর কন্যার প্রতি মারমুখী হলেন। হজরত ওমরও মারতে উদ্যত হলেন তাঁর মেয়ে হজরত হাফসাকে। দুজনেই বললেন, খবরদার! রসুলুল্লাহর কাছে যা নেই, তার জন্য আবদার জুড়ে দিয়ো না।
অবস্থার কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না। রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর গৃহজীবনে নেমে এলো বিব্রতকর অস্বস্তি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কঠোর হতে বাধ্য হলেন। শপথ করলেন, এক মাস তিনি তাঁদের কারো কাছেই যাবেন না। অবস্থান গ্রহণ করলেন একাকী এক প্রকোষ্ঠে। সাহাবীগণের সঙ্গেও দেখা সাক্ষাত বন্ধ করে দিলেন। প্রচার হয়ে গেলো— রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সকল পত্নীকে পরিত্যাগ করেছেন।
হজরত ওমর সবাইকে সান্ত্বনা দিলেন। বললেন, আপনারা অপেক্ষা করুন। সত্বর আপনাদেরকে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে জানাতে পারবো। তিনি ভয়ে ভয়ে প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন। নিবেদন করলেন, হে মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়! আপনি কি আপনার বিবিগণকে পরিত্যাগ করেছেন? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, না। পুনরায় নিবেদন করলেন, হে আল্লাহর প্রিয়তম রসুল! আমি মসজিদে প্রবেশ করে জনগুঞ্জন শুনতে পেলাম। লোকেরা বলাবলি করছে, আপনি তাঁদেরকে তালাক দিয়েছেন। কথাটি যে সত্য নয়, তাকি আমি তাদেরকে জানাতে পারবো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। তুমি ইচ্ছা করলে জানাতে পারবে।
ওই সময় অবতীর্ণ হলো নতুন প্রত্যাদেশ। বলা হলো— ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে বলো, তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার ভূষণ কামনা করো, তবে এসো, আমি তোমাদের ভোগ-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদেরকে বিদায় দেই। আর যদি তোমরা কামনা করো আল্লাহ, তাঁর রসুল ও আখেরাত, তবে তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল, আল্লাহ তাদের জন্য মহাপ্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন। হে নবীপত্নীগণ! যে কাজ স্পষ্টত অশীল; তোমাদের মধ্যে কেউ তা করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেওয়া হবে এবং এটা আল্লাহর জন্য সহজ।
তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের প্রতি অনুগত হবে ও সৎকাজ করবে, তাকে আমি পুরস্কার দিবো দুই বার এবং তারজন্য আমি প্রস্তুত রেখেছি সম্মানজনক রিজিক। হে নবীপত্নীগণ! তোমরা অন্য
নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আলাহ্কে ভয় করো তবে পরপুরুষের সঙ্গে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে। আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন যুগের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তোমরা সালাত কায়েম করবে এবং জাকাত প্রদান করবে। এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের অনুগত থাকবে। হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণ পবিত্র করতে।’ (সুরা আহযাব, আয়াতঃ ২৮-৩৩)।
ঊনতিরিশ দিন গত হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর পৃথকবাসের অবসান ঘটালেন। প্রথমেই গেলেন হজরত আয়েশার ঘরে। হজরত আয়েশা নিজে বলেছেন, শপথের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরক্ষণেই রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার ঘরে এলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর প্রিয়তম রসুল! আপনি তো শপথ করেছিলেন এক মাসের।
আজ তো ঊনতিরিশ দিন হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ মাস তো ঊনতিরিশ দিনের। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নতুন প্রত্যাদেশ আবৃত্তি করে শোনালেন। বললেন, আয়েশা!
তুমি কী করবে, তা এক্ষুণি না জানালেও চলবে। তোমার পিতা-মাতার সাথে মতবিনিময় করে পরে জবাব দিলেও চলবে। হজরত আয়েশা বললেন, আমি তো আল্লাহ, তাঁর রসুল এবং আখেরাতকেই চাই। এ ব্যাপারে পিতা-মাতার সঙ্গে মতবিনিময়ের তো কিছু দেখি না। তবে আমার একটি মিনতি আছে। আমি যা বললাম, তা আপনার অন্য স্ত্রীদেরকে জানাবেন না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কথা দিলাম। আমি তাদেরকে এ কথা জানাতে যাবো না। কিন্তু জিজ্ঞাসিত হলে কী করবো। জানাতেই তো হবে। কারণ আমি আবির্ভূত হয়েছি সকলের মঙ্গলাকাক্সক্ষী হয়ে, অশান্তি উৎপাদনকারী হিসেবে নয়। বলাবাহুল্য, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সকল সহধর্মিণী ওই কথাই বললেন, যে কথা বলেছিলেন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা।দাবি আদায়ের ব্যাপারে যেমন তাঁরা একজোট হয়েছিলেন, তেমনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে গভীর ভালোবাসার মধ্যে তাঁরা ছিলেন অধিক অচ্ছেদ্য।
আর একটি ঘটনা ঘটিয়েছিলেন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)। সেটাও ছিলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে উৎসারিত। আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটি অসুন্দর মনে হলেও শেষফল ছিলো কল্যাণময়। কারণ ওই ঘটনাকে উপলক্ষ করেই অবতীর্ণ হয়েছিলো নতুন প্রত্যাদেশ, শরীয়তের নতুন বিধান। বিধানটি হচ্ছে— হালালকে হারাম (এবং হারামকে হালাল) করার জন্য কখনই কসম করা যাবে না। কসম করলেও তা অবশ্যই ভেঙে ফেলতে হবে।
এ সম্পর্কে জননী আয়েশা সিদ্দীকা নিজে বলেছেন, রসুলুল্লাহ মিষ্টি ও মধু খুব পছন্দ করতেন। তাঁর পবিত্র অভ্যাস ছিলো, সাধারণত আসরের নামাজের পরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সহধর্মিণীগণের প্রকোষ্ঠে যেতেন। একদিন তিনি আসরের পর প্রবেশ করলেন হাফসার প্রকোষ্ঠে। সেখানে অনেকক্ষণ অবস্থান করলেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, হাফসার এক আত্মীয়া তাঁকে মধু উপহার দিয়েছে। সেই মধুর শরবত বানিয়ে সে রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে পান করাচ্ছে। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর শপথ! এর একটা কিছু বিহিত আমি করবোই। যাতে রসুলুল্লাহ তার প্রকোষ্ঠে অধিক সময় অতিবাহিত না করেন। আমি সওদাকে ডেকে বললাম, রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন তোমার কাছে আসবে, তখন তুমি বলো, আপনি মাগ্ফীর পান করেছেন। তিনি বলবেন, না তো। তুমি বলো, তাহলে আমি গন্ধ পাচ্ছি কিসের? তুমি তো জানো, তিনি মাগ্ফীরের গন্ধ একেবারে পছন্দ করেন না। তিনি বলবেন, আমি তো হাফসার ঘরে মধু পান করেছি। তুমি বলো, তাহলে মৌমাছিরা মাগ্ফীর ফুলের রেনু থেকে মধু সংগ্রহ করেছে। এরপর তিনি আমার কাছে এলে আমিও এরকম করে বলবো। সাফিয়াকেও বলে দিবো, সে-ও যেনো এরকম করে বলে। এরপর যখন রসুলুল্লাহ সওদা, সাফিয়া ও আমার কাছে এলেন তখন আমরা সাজানো কথাগুলো বললাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিব্রত হলেন। পুনরায় হাফসার ঘরে গেলেন। হাফসা বললো, হে আল্লাহর রসুল! মধুর শরবত কি আরো পান করবেন? তিনি বললেন, না, না।
আর কখনো মধু পান করবো না। শপথ করলাম। সওদা আমাকে একান্তে ডেকে বললেন, কাজটা কি ঠিক হলো? আমি বললাম, চুপ।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হলো ‘হে নবী! আল্লাহ তোমার জন্য যা বৈধ করেছেন, তুমি তা নিষিদ্ধ করছো কেনো? তুমি তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি চাইছো; আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। আল্লাহ তোমাদের কসম থেকে মুক্তি লাভের ব্যবস্থা করেছেন, আল্লাহ তোমাদের কর্মবিধায়ক, তিনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’
জীবন শেষে আসে মৃত্যু। তারপর জীবন। মহাজীবন— এটাই আল্লাহ পাকের বিধান। এ বিধানের ব্যতিক্রম কেউ নয়। পুণ্যবান, পাপী নির্বিশেষে সকলের উপরে এই অমোঘ বিধানটি কার্যকর হয়। নবী-রসুলগণের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। তবে মৃত্যুদূত আজরাইল তাঁদের মর্যাদার দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখেন। মেনে চলেন বিশেষ নিয়ম। প্রথমে সালাম করেন। তারপর প্রাণহরণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। আর নবী-রসুলগণও অনুমতি প্রদান করেন সানন্দে। কারণ তাঁরা জানেন মৃত্যুর তোরণ পার হয়েই যেতে হয় মহাপ্রিয়তম মহাপ্রভুপালকের একান্ত সন্নিধানে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটি জানাযা শেষে গৃহে ফিরে আসছিলেন। পথিমধ্যে তাঁর মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো। মাথায় রুমাল বাঁধলেন। সমস্ত শরীর উত্তপ্ত। হজরত আয়েশার কক্ষে গিয়ে দেখলেন, তিনিও মাথাযন্ত্রণায় আহ্ উহ্ করছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কৌতুক করে বললেন, আয়েশা! কেমন হতো। যদি তুমি আমার সামনে মারা যেতে। আমি তোমাকে গোসল করিয়ে তোমার দাফন-কাফন করতাম। হজরত আয়েশাও প্রতি কৌতুকে বললেন, বুঝেছি। আপনি এ ঘরে নতুন কোনো স্ত্রীকে ওঠাতে চান।
উম্মতজননী হজরত মায়মুনার ঘরে গিয়ে তিনি শয্যা গ্রহণ করলেন। অসুস্থ অবস্থায় স্ত্রীগণের পালার নিয়মও রক্ষা করতে লাগলেন। প্রতিদিনই জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, আজ যেনো কার ঘরে থাকবো?
সকলে বুঝতে পারলেন, তিনি হজরত আয়েশা সিদ্দীকার ঘরে থাকতে চান। সবাই অনুমতি দিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আব্বাস ও হজরত আলীর কাঁধে হাত রেখে অনেক কষ্টে হজরত আয়েশার কামরায় পৌঁছলেন।
হজরত আয়েশা বলেন, রোগাক্রান্ত হলে রসুলুল্লাহ এই দোয়াটি পড়ে নিজহাতে ফুঁ দিয়ে সেই হাত দিয়ে শরীর মুছতেন— অর্থঃ হে মানুষের প্রভুপালক! বিপদমুক্ত করো। হে নিরাময় দানকারী। নিরাময় দাও। তুমি যা করো, তা ছাড়া আর কোনো প্রতিষেধক নেই। তুমি এমনভাবে আরোগ্য দান করো যেনো আর কোনো রোগ না থাকে। হজরত আয়েশা বলেন, আমি দোয়াটি পাঠ করে রসুলুল্লাহর হাতে ফুঁ দিলাম। ইচ্ছা করলাম, তাঁর হাত দিয়ে তাঁর পবিত্র শরীর মুছে দেই। কিন্তু তিনি হাত টেনে নিলেন। বললেন, ‘আলাহুম্মাগ্ ফিরলী ওয়াল্ হিক্বনী বিররফীক্বিল আ’লা’ (হে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করো এবং তোমার মহান সান্নিধ্য দান করো)।
রোগযন্ত্রণা বেড়েই চললো। একদিন একটি পাথরের উপরে বসিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। মাথায় ঢালা হলো পাঁচ মশক পানি। গোসলের পর কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন। মসজিদে উপস্থিত সাহাবীগণকে বিভিন্ন উপদেশ দান করলেন। শেষে বললেন, আলাহ্তায়ালা তাঁর এক বান্দাকে একটি অধিকার দান করেছেন— সে যেনো পৃথিবী ও পৃথিবীর বিত্তবৈভব গ্রহণ করে অথবা গ্রহণ করে পরবর্তী পৃথিবী। সে পরবর্তী পৃথিবীকেই গ্রহণ করেছে।
একথা শুনে হজরত আবু বকর কেঁদে ফেললেন। বললেন, হে আল্লাহর বাণীবাহক! আমার বাপ-মা আমার জীবন-সম্পদ আপনার জন্য কোরবান হোক। সবাই হজরত আবু বকরের কান্না দেখে অবাক হলেন। প্রতিদিনই অবস্থার অবনতি হতে লাগলো। অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মসজিদে নামাজ পড়াচ্ছিলেন। কিন্তু আর পারলেন না। ইমাম নিযুক্ত করলেন হজরত আবু বকর সিদ্দীককে। রোদনভারাক্রান্ত সাহাবীগণ বাধ্য হয়ে তাঁর পিছনেই নামাজ পড়তে লাগলেন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তো সতত প্রস্তুত। পৃথিবীতে সম্পদ রেখে যাওয়া সকল নবী রসুলের জন্য নিষিদ্ধ। একথা মনে পড়লো তাঁর। তিনি তাঁর সকল গোলামকে আজাদ করে দিলেন। জিজ্ঞেস করে জানলেন, ঘরে রয়েছে সাতটি স্বর্ণমুদ্রা। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আয়েশাকে বললেন, দীনারগুলো দরিদ্র জনতার মধ্যে বিতরণ করে দাও। সম্পদ ঘরে রেখে রসুল তাঁর প্রভুপালকের সাথে সাক্ষাত করবে— বড়ই লজ্জার কথা।
প্রাণাধিক প্রিয় কন্যা হজরত ফাতেমাকে ডাকলেন। হজরত ফাতেমা পিতাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত করতে লাগলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন কেঁদোনা মা, কেঁদোনা। আমি চলে গেলে বলো ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রজিঊন’। এতে সকলের জন্য রয়েছে শান্তি। হজরত ফাতেমা বললেন, আপনার জন্যও। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ।
হজরত ফাতেমা বার বার বললেন, হায়! আব্বার কী যন্ত্রণা! হায় আব্বার কী কষ্ট। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ফাতেমা! আজকের দিনের পর তোমার আব্বার আর কষ্ট থাকবে না। প্রিয় দৌহিত্র হাসান-হোসেনকে ডেকে আনা হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদেরকে আদর করলেন। চুম্বন করলেন। তাঁদের সম্মান বজায় রাখবার জন্য অসিয়ত করলেন। সবশেষে ডাকলেন স্ত্রীগণকে। উপদেশ দিলেন। উচ্চারণ করলেন, আল্লাজী আনআ’মা আ’লাইহিম। আলাহুম্মা ফাহুয়ার রফীক্বিল আ’লা।
হজরত আলীকে ডাকলেন। তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র মস্তক কোলে তুলে নিলেন। তাঁকেও উপদেশ দিলেন— ‘সাবধান! নামাজ! নামাজ! আর তোমাদের ক্রীতদাস-ক্রীতদাসী ও তোমাদের অধীনস্থগণ।
রোগযন্ত্রণা তীব্রতর হলো। প্রিয়তমা পত্নী হজরত আয়েশার শরীরে ঠেস লাগিয়ে আল্লাহর প্রিয়তম রসুল শেষ যাত্রার প্রতীক্ষায় পল অতিবাহিত করে চললেন। পাশে একটি পানিভর্তি পেয়ালা রাখা ছিলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওই পানিতে হাত ভিজিয়ে কিছুক্ষণ পর পর নিজের মুখমণ্ডল মুছতে লাগলেন। মুখমণ্ডলের রঙ পরিবর্তিত হতে লাগলো। কখনো লাল। কখনো শ্বেতাভ। অতি মৃদুকণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লহু ইন্না লি মাউতা সাকরাতুন’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, আর নিশ্চয়ই মৃত্যু যন্ত্রণাময়)।
ঘরে প্রবেশ করলেন হজরত আয়েশার ভাই হজরত আবদুর রহমান। তাঁর হাতে ছিলো একটি তাজা মেসওয়াক। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মেসওয়াকটির দিকে তাকালেন। হজরত আয়েশা বুঝলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মেসওয়াক করতে চান। তিনি মেসওয়াকটি হাতে নিয়ে চিবিয়ে নরম করে দিলেন। রসুলুল্লাহ মেসওয়াকটি হাতে নিয়ে সুস্থ মানুষের মতো মেসওয়াক করলেন।
মেসওয়াক শেষ করে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কেমন যেনো হয়ে গেলেন। পরিবেশ হয়ে গেলো অপার্থিব সুবাসে সুবাসিত। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর হাত একটু উপরের দিকে ওঠালেন। মনে হলো, কোথাও যেনো যাত্রা করবেন। কণ্ঠে উচ্চারিত হলো— বালির্ রফীক্বিল্ আ’লা, বালির্ রফীক্বিল্ আ’লা, বালির্ রফীক্বিল্ আ’লা। এরপর নির্বাক হয়ে গেলেন। উত্তোলিত হাত শয্যায় পতিত হলো। চোখের তারা উঠে গেলো উপরের দিকে। দৃষ্টি পতিত হলো যেনো বহু বহুদূরে- অসীম কোনোআলোর নিখিলে। হজরত আয়েশা রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র মস্তক বালিশে রেখে দিলেন। কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
শোকের আগুনে পুড়তে লাগলো মদীনা। মদীনাবাসী। মদীনার আকাশ বাতাস। নিসর্গ। মহানিসর্গ। শোকের অগ্নিগিরি অবিরত অগ্নিউৎপাত করে চলেছে। চারিদিকে কেবল হাহুতাশ, হাহাকার, রোদন-ক্রন্দন-বিলাপ। বিষাদযন্ত্রণা, ব্যথা বেদনার অনন্ত শোকোচ্ছ্বাস।
উন্মুক্ত তরবারী হাতে হজরত ওমর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগলেন, মুনাফিকেরা রটনা করছে, আল্লাহর রসুলের মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহর শপথ! তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। নবী মুসার মতো তাঁর প্রভুপালকের সাথে সাক্ষাত করতে গিয়েছেন। তিনি তাঁর উম্মতের কাছে চল্লিশ দিন অনুপস্থিত ছিলেন। তারপর ফিরে এসেছিলেন। আল্লাহর কসম! নবী মুসার মতো আমাদের রসুলও ফিরে আসবেন। যারা তাঁর মৃত্যুর কথা বলবে, আমি তাদের হাত-পা কেটে ফেলবো। শিরচ্ছেদ করবো।
হজরত আবু বকর এগিয়ে গেলেন। মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে বললেন, হে জনতা! যারা মোহাম্মদের উপাসনা করতে চাও তারা শুনে রাখো, তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। আর যারা আল্লাহর ইবাদত চাও, তারা শুনে নাও, আল্লাহ চিরঞ্জীব। মৃত্যু তাঁকে কখনোই স্পর্শ করতে পারে না। শোনো, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার এরশাদ— ‘মোহাম্মদ রসূল ব্যতীত কিছুই নয়, তার পূর্বে বহু রসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা নিহত হয়, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না। এবং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করবেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৪৪)
আল্লাহর পবিত্র বাণীর মর্মস্পর্শী আবৃত্তি শুনে সম্বিত ফিরে পেলেন সকলে। অবনমিত হলো হজরত ওমরের তরবারী। সান্তনার মেঘ জমতে শুরু করলো মদীনার আকাশে। বৃষ্টি হলো। নিভে গেলো শোকের আগুন। বন্ধ হলো শোকের অগ্নিগিরির অসহনীয় ও অবিরাম অগ্নিউৎপাত। কিন্তু ভিতরের আগুন জ্বলতে লাগলো আগের মতোই। সকলে হয়ে গেলেন রুদ্ধমুখ অগ্নিগিরি।
এভাবে হজরত আবু বকর সকলের কর্তব্যানুভূতিকে জাগ্রত করলেন বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে হলেন সকলের চেয়ে বেশী বিচ্ছেদকাতর। তদুপরি স্কন্ধে অর্পিত হলো খেলাফতের বিশাল গুরুভার। সে দায়িত্বও পালন করে যেতে লাগলেন নিয়মিত। কিন্তু ভিতরের ভাঙন রোধ করতে পারলেন না কিছুতেই। ক্ষয় হলেন। হতে লাগলেন।
সময় সবকিছুকে ক্ষয় করে ফেলে। কিন্তু হজরত আবু বকরের শোককে মুছে ফেলতে পারলো না কিছুতেই। বরং দিন দিন তিনি হয়ে পড়লেন অধিকতর কাতর। দুই বছর তিন মাসের বেশী কেটে গেলো এভাবেই।
একদিন তিনি বৃক্ষচ্ছায়ায় বসে আছেন। দেখলেন, বৃক্ষশাখায় একটি পাখি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হে পাখি! তুমি কতো সুখী। গাছের ফল খাও। আর বসবাস করো গাছের ছায়ায়। তোমার মৃত্যুর পর তোমাকে কোনোকিছু জিজ্ঞেস করা হবে না। কখনো বলেন, হায়! আমি যদি গাছ হতাম। মানুষ আমাকে কেটে ফেলতো। যদি ঘাস হতাম। পশু আমাকে খেয়ে ফেলতো।
একদিন গোসলের পর তিনি সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হলেন। জ্বর আর ভালো হলো না। যতোদিন পারলেন অসুস্থ শরীর নিয়েই নামাজ পড়াতে লাগলেন। পরে আর পারলেন না। নামাজের ইমাম বানালেন হজরত ওমরকে। পরবর্তী খলিফাও নির্বাচন করলেন তাঁকে। নির্জনে ডেকে নিয়ে তাঁকে উপদেশ দিলেন। দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমি মুসলমানদের কল্যাণ কামনার্থেই ওমরকে খলিফা নির্বাচন করেছি। আমি তোমার নির্দেশেই পৃথিবী পরিত্যাগ করছি। তোমার দাসগণের ভার তুমিই দয়া করে গ্রহণ করো। তোমার হাতে তো তাদের নিয়ন্ত্রণশৃঙ্খল। হে আল্লাহ! তুমি মুসলমানদেরকে পুণ্যবান শাসক দান করো। আর ওমরকে অন্তর্ভূত করো খোলাফায়ে রাশেদিনের মধ্যে। তাঁর প্রজাবৃন্দকে যোগ্য নাগরিক করে দাও।
সাহাবীগণ চিকিৎসককে ডাকতে চাইলেন। কিন্তু তিনি বারণ করলেন। বললেন, চিকিৎসক তো আমাকে দেখেছেন। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, কী বললেন তিনি? তিনি জবাব দিলেন ‘ফাআ’লুল্লিমা ইউরীদ্’(আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করি)।
জমাদিউস্ সানি মাসের ২২ তারিখ। হজরত আবু বকরের বয়স ৬৩ পূর্ণ হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আজ কী বার? উপস্থিত জনতা বললেন, সোমবার। তিনি বললেন, সোমবারেই তো রসুলুল্লাহর বিদায় নিয়েছিলেন? সকলে বললেন হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমিও এরকম চাই। আল্লাহ আমার বাসনা পূর্ণ করলে তোমরা রসুলুল্লাহর পাশে আমাকে কবর দিয়ো।
মহাযাত্রার সময় নিকটবর্তী হলো। তিনি তাঁর প্রাণাধিকা কন্যা হজরত আয়েশাকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রসুলকে কয়টি কাপড়ে দাফন করা হয়েছিলো? তিনি বললেন, তিনটি। হজরত আবু বকর বললেন, আমাকেও যেনো তিনটি কাপড় দেওয়া হয়। যে দুইটি আমার শরীরে আছে, সে দুটো ধুয়ে নিয়ো। আর একটি তৈরী করে নিয়ো।
হজরত আয়েশা বললেন, আব্বা! আমরা কি আপনার জন্য নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য রাখি না? আমরা কি এতোটাই দরিদ্র? হজরত আবু বকর বললেন, আম্মা! মৃতের চেয়ে জীবিতের জন্যই নতুন কাপড়ের প্রয়োজন বেশী। আমার জন্য ছেঁড়া, পুরনো কাপড়ই যথেষ্ট।
হজরত আয়েশার কণ্ঠে শোকগাঁথা উচ্চারিত হলো—
কী সুন্দর তাঁর রূপ! মেঘপুঞ্জও তাঁর কাছে পানিপ্রার্থী হয়—
তিনি পিতৃহীনদের প্রার্থনা শ্রবণ করেন, আশ্রয় হন বিধবাদের।
হজরত আবু বকর বললেন, মা! এই কবিতা তো আল্লাহর রসুলের জন্যই
শোভনীয়। তিনি আর একটি কবিতা পাঠ করলেন—
তোমার জীবনের শপথ! মৃত্যুমগ্নতার সূচনা হয় যখন,
তখন অর্থ-বিত্ত-প্রতাপ-প্রভাব কোনো কাজে আসেনা।
হজরত আবু বকর বললেন, কন্যা! বরং এভাবে বলো, যেমন আল্লাহ বলেছেন, ‘ওয়া জায়াত্ সাকরাতুল্ মাউতি বিল্ হাক্কুন জালিকা মা কুন্তা মিনহু তাহীদ’ (যে মৃত্যু থেকে তোমরা বিমুখ, সেই মৃত্যুকষ্ট তো আসবেই)।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকা পুনরায় আবৃত্তি করলেন—
রূদ্ধ অশ্রধারা একদিন প্রবাহিত হবে
প্রত্যেক পথিকের থাকে নির্দিষ্ট গন্তব্য
আর প্রত্যেক পরিধানকামী পায় বসন।
হজরত আবু বকর পুনরায় বললেন, ওভাবে নয় বেটি, এভাবে— ‘ওয়া জায়াত সাকরাতুল মাউতি বিল হাক্কুন জালিকা মা কুনতা মিনহু তাহীদ’।
মুমিনজননী আয়েশা সিদ্দীকা পিতৃহারা হলেন। নিভে গেলো রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সবচেয়ে প্রিয় ও অন্তরঙ্গ বন্ধু বাল্যবেলার সাথী ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দীক ইবনে আবু কোহাফার জীবন প্রদীপ। তাঁর মুখে সর্বশেষ বাক্য উচ্চারিত হলো— রব্বা তাওফ্ফানি মুসলিমাওঁ ওয়াল্ হিক্কনী বিস্সলিহীন’ (হে আল্লাহ! আমাকে মুসলমান হিসেবে মৃত্যু দাও এবং করে দাও তোমার সৎবান্দাগণের সঙ্গী)।
সাইয়্যেদা আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) এর ফযীলত ও মর্যাদা সীমাহীন। তিনি ছিলেন ফকীহ্ , আলেম, ফাসাহাতবিদ, বালাগাতবিদ এবং শ্রেষ্ঠ সাহাবীগণের অন্যতম। কোনো কোনো সলফে সালেহীন বলেছেন, তখন আহকামে শরীয়তের সমাধানের জন্য তাঁর কাছে যেতে হতো। হাদিস শরীফে এসেছে— তোমরা তোমাদের ধর্মের দুই তৃতীয়াংশ হোমায়রার নিকট থেকে গ্রহণ করো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে আদর করে হোমায়রা (লাবণ্যময়ী) বলে ডাকতেন।
সাহাবী ও তাবেয়ীগণের একটি বিরাট দল তাঁর নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। ওরওয়া ইবনে যোবায়ের র. বলেছেন, কোরআনের অর্থ, হালালহারামের বিধান, আরবী কবিতা এবং বংশশাখা সংক্রান্ত জ্ঞানে জননী আয়েশা সিদ্দীকার চেয়ে বড় আলেম আমি কাউকে দেখিনি।
তাঁর এক কবিতায় তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রশংসা করেছেন এভাবে—অর্থঃ মিশরের জনতা যদি তাঁর গণ্ডদেশের সৌন্দর্যের কথা জানতো, তাহলে তারা নিশ্চয়ই ইউসুফের দান দস্তরে অর্থ ব্যয় করতো না। জুলায়খার তিরস্কারকারীরা যদি আল্লাহর হাবীবের পরিচয় পেতো, তাহলে তারা তাদেরহাতের উপর নিজেদের হৃদয়গুলো রেখে টুকরো টুকরো করে দিতো।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকার সবচেয়ে বড় মর্যাদা এই যে, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে খুব বেশী মহব্বত করতেন। হজরত আনাস ইবনে মালেক থেকে বর্ণিত হয়েছে, ইসলামে সর্বপ্রথম যে মহব্বত জন্ম নিয়েছিলো, তা ছিলো হজরত আয়েশা সিদ্দীকার প্রতি রসুলুল্লাহর মহব্বত। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করতেন, আপনার নিকট সবচেয়ে প্রিয় কে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জবাব দিতেন, আয়েশা। আবার জিজ্ঞেস করতেন, পুরুষদের মধ্যে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলতেন তার পিতা। হজরত আয়েশা সিদ্দীকাকে একবার জিজ্ঞেস করা হলো রসুলুল্লাহর সবচাইতে প্রিয়জন কে? তিনি জবাব দিলেন, ফাতেমা। পুনঃপ্রশ্ন করা হলো, পুরুষদের মধ্যে? তিনি বললেন, তাঁর স্বামী। এ দুটো বিবরণের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে এভাবে যে, স্ত্রীগণের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন সাইয়্যেদা আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) আর সন্তান-সন্তনিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন হজরত ফাতেমা যাহরা (রাঃ)।
আহলে বায়েতের মধ্যে হজরত আলী (রাঃ) আর সাহাবীগণের মধ্যে হজরত আবু বকর (রাঃ)। তবে মহব্বতের আধিক্যের প্রেক্ষিত ও দিক ছিলো ভিন্ন ভিন্ন।
জননী আয়েশা সিদ্দীকার একটি বিবরণে বলা হয়েছে, একদিন রসুলুল্লাহর তাঁর পবিত্র পাদুকা সেলাই করছিলেন। আমি চরকায় সুতা কাটছিলাম। তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলের দিকে তাকালাম। দেখলাম, তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল থেকে বিকিরিত হচ্ছে অভূতপূর্ব সৌন্দর্যচ্ছটা। আমি নির্বাক হয়ে রইলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কথা বলছোনা কেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর বাণীবাহক! আপনার জ্যোতির্ময় অবয়ব এবং ললাটদেশের স্বেদবিন্দুর সৌন্দর্য দেখে আমি অভিভূত। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দাঁড়ালেন। আমার কাছে এলেন। আমার দুচোখের মধ্যবর্তী স্থানে চুম্বন এঁকে দিলেন। বললেন, আয়েশা! আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তুমি আমাকে দেখে যতোটা আনন্দিত হয়েছো, আমি তোমাকে দেখে আনন্দিত হয়েছি তার চেয়ে বেশী।
মাসরুক ছিলেন নেতৃস্থানীয় তাবেয়ী। তিনি যখন সাইয়্যেদা আয়েশা সিদ্দীকা থেকে হাদিস বর্ণনা করতেন, তখন বলতেন, এই হাদিসটি আমি শুনেছি সিদ্দীকের কন্যা সিদ্দীকা, রসুলুল্লাহর মাহবুবা থেকে। কখনো বলতেন, আল্লাহর হাবীবের মাহবুবা, আসমানী নারী থেকে।
সাইয়্যেদা আয়েশা সিদ্দীকার আরেকটি ফযীলত এরকম— তিনি বলতেন, রসুলুল্লাহ ও আমি এক পাত্রের পানি নিয়ে এক সাথে গোসল করতাম। তিনি তাঁর অন্য কোনো স্ত্রীর সঙ্গে এরকম করতেন না। মেশকাত শরীফে মুআযায়ে আদবিয়া থেকে একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে , সাইয়্যেদা আয়েশা সিদ্দীকা বলেছেন, আল্লাহর রসুল ও আমি একই মটকা থেকে পানি নিয়ে গোসল করতাম। মটকাটি আমাদের দুজনের মাঝখানে থাকতো। তিনি তাড়াতাড়ি পানি নিতে থাকলে আমি বলতাম, আমার জন্যও রাখুন। এভাবে আমরা ফরজ গোসল সম্পন্ন করতাম। মুমিন জননী আয়েশা সিদ্দীকার আর একটি ফযীলত এই যে, তিনি বলেছেন, আমার রাত্রি যাপনের পোশাক ছাড়া অন্য কারো রাতের পোশাকে আবৃত অবস্থায় রসুলুল্লাহর উপরে ওহী নাযিল হয়নি।
জননী আয়েশা সিদ্দীকা স্বয়ং বলেছেন, একবার রসুলুল্লাহ আমাকে বললেন, আয়েশা ! এই যে জিব্রাইল— তিনি তোমাকে সালাম বলছেন। আমি বললাম, ওয়াআলাইহিস্ সালাম ওয়া রহমাতুলাহি ওয়া বারাকাতুহু। হে আল্লাহর প্রেমাষ্পদ! আপনি যা দেখেন, আমরা তো তা দেখি না। সহীহ্ হাদিসে এসেছে, মুমিনজননী উম্মে সালমা একবার হজরত আয়েশার ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন।
জবাবে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছিলেন, আয়েশার ব্যাপারে আমাকে কষ্ট দিয়ো না। নিশ্চয়ই আয়েশা ছাড়া অন্য কারো রাতের পোশাকে আবৃত অবস্থায় আমার কাছে প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়নি। একথা শুনে মুমিন জননী উম্মে সালমা বলেছিলেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনাকে কষ্ট দেওয়া থেকে আমি আল্লাহর কাছে তওবা করছি।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একদিন তাঁর পরম আদরের কন্যা হজরত ফাতেমাকে বললেন, ফাতেমা। আমি যাকে ভালোবাসি, তুমিও কি তাকে ভালোবাসবে না? তিনি বললেন, অবশ্যই ভালোবাসবো হে আল্লাহর রসুল! তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি আয়েশাকে ভালোবেসো। বিশ্বাসীদের মাতা আয়েশা সিদ্দীকা নিজে বলেছেন, আমার পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতার ঘোষণা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে। আমিই ছিলাম তাঁর একমাত্র কুমারী স্ত্রী। তিনি আরো বলেছেন, শেষ যাত্রার সময়গুলো তিনি আমার ঘরেই অতিবাহিত করেছেন। আমার পালার দিনই তিনি লোকান্তরিত হন। তখন তাঁর পবিত্র মস্তক ছিলো আমার গলা ও বুকের মাঝখানে।
হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি একবার এক লোককে হজরত আয়েশা সিদ্দীকা সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য করতে শুনলেন। রাগান্বিত হয়ে বললেন, হে অপদস্থ লাঞ্ছিত ব্যক্তি! আল্লাহর রসুলের প্রিয়তমাকে তুমি মন্দ বলছো।
মাতামহোদয়া আয়েশা সিদ্দীকা তাঁর ছোট বেলার একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে— একদিন রসুলুল্লাহর আগমন টের পেয়ে আমি আমার কন্যা পুতুলগুলো জানালায় রাখলাম। একটি পর্দা দিয়ে ওগুলোকে ঢেকে রাখলাম। তাঁর সঙ্গে যায়েদও ছিলো। তিনি জানালার পর্দা সরিয়ে পুতুলগুলো রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে দেখালেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এগুলো কী? আমি বললাম, এরা আমার মেয়ে।
কন্যা পুতুলগুলোর সঙ্গে একটি ঘোড়া পুতুলও ছিলো। দুটো পাখা ছিলো ঘোড়াটির। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ঘোড়ার আবার পাখা থাকে নাকি? আমি বললাম, থাকে, থাকে। আপনি শোনেননি বুঝি, নবী সুলায়মানের ঘোড়া ছিলো। পাখাও ছিলো ওগুলোর। আমার কথা শুনে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এমনভাবে হাসলেন যে, তাঁর পবিত্র দন্তরাজি প্রকাশিত হয়ে পড়লো।
রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একদিন বললেন, যার হিসাব নেওয়া হবে সে আযাব ভোগ করবে। মাতা মহোদয়া আয়েশা বললেন, হে আল্লাহর বচনপ্রচারক! আল্লাহপাক যে বলেছেন, অচিরেই তাদের হিসাব নেওয়া হবে, আসান হিসাব। হিসাব যখন আসান (সহজ) হবে, তখন আবার আযাব হবে কেমন করে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তা হচ্ছে হিসাব প্রদান করা। হিসাব গ্রহণ করা নয়। হিসাব গ্রহণ করা মানে প্রশ্নোত্তর করা।
একবার রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মিলন হওয়াকে পছন্দ করে, আল্লাহ ও তার মিলনকে পছন্দ করেন। আর যে আল্লাহর সাথে মিলনকে অপছন্দ করে, আল্লাহ ও তার মিলনকে অপছন্দ করেন। মহামান্যা জননী বললেন, নফস ও স্বভাব অনুসারে সবাই তো মৃত্যুকে (মিলনকে) অপছন্দ করে।
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি যেমন ভেবেছো, তেমন নয়। বরং আল্লাহ তার বান্দাগণের মধ্য থেকে যাকে চান, তার মধ্যে মৃত্যুর মহব্বত তৈরী করে দেন, যখন সে হয় মৃত্যুর সমীপবর্তী।
আর একদিনের ঘটনা— রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না। মহাসম্মানিতা জননী বললেন, হে আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রচারক! আপনিও কি? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমিও। কিন্তু আমিতো (সতত) রহমতাচ্ছাদিত।
আর একদিন রসুলেপাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে হোমায়রা! তোমার হামযাদ শয়তান তোমাকে এ কাজে প্ররোচিত করেছে। তিনি বললেন, সব মানুষের সাথে কি হামযাদ থাকে? রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আপনার সাথে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। তবে আমার শয়তানটি মুসলমান (চির অনুগত) হয়েছে।
মহাপবিত্র প্রেমসাগরে সতত নিমজ্জিত থাকতেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং তাঁর প্রিয়তমা হজরত আয়েশা সিদ্দীকা। প্রেমিক-প্রেমিকাগণের মতো সূক্ষ্ম ও নিষ্কলুষ মান অভিমানও চলতো। তিনি নিজে বর্ণনা করেছেন, একবার রসুলুল্লাহ বললেন, আয়েশা ! আমি জানি, তুমি কখন আমার প্রতি প্রশন্ন অথবা অপ্রশন্ন থাকো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসুল! কেমন করে শুনি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, প্রশন্ন থাকলে বলো ‘লা ওয়া রব্বা মোহাম্মদ’ (মোহাম্মদের রবের শপথ)। আর মান করলে বলো ‘লা ওয়া রব্বা ইব্রাহীম’ (ইব্রাহীমের রবের শপথ)। আমি বললাম, হে আল্লাহর বার্তাবহনকারী! আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে আমি তো কেবল আপনার নামটিই বর্জন করি। কিন্তু আপনার পবিত্র সত্তা তো আমার হৃদয়ে সতত প্রোজ্জ্বল। ভালোবাসায় তো কোনো পরিবর্তন আসে না।
তিনি বলেছেন, একবার মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, হোমায়রা! তুমি যদি জান্নাতে আমার সঙ্গে থাকতে চাও তবে পৃথিবীতে থেকো ফকির, মুসাফির হালতে। মুসাফিরেরা সেলাইযোগ্য বস্ত্রকে পুরনো মনে করে না। এক বর্ণনায় এসেছে, মাননীয়া মাতা একবার নিবেদন করলেন, হে আল্লাহর বার্তাপ্রচারক! আমার জন্য প্রার্থনা করুন, আমি যেনো জান্নাতে আপনার স্ত্রী হতে পারি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, পারবে, যদি এই আমলটি করো— কালকের জন্য আহার্য বস্তু জমা করে রেখো না। আর কাপড় যতক্ষণ সেলাইযোগ্য থাকে, ততক্ষণ তা পরিত্যাগ করো না।
ওরওয়া ইবনে যোবায়ের থেকে বর্ণিত হয়েছে— একদিন আমি মাতা মহোদয়া আয়েশাকে সত্তর হাজার দিরহাম দান করতে দেখলাম। অথচ তাঁর পরিধেয় বস্ত্র ছিলো সেলাই করা। একবার হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রাঃ) তাঁর জন্য এক লক্ষ দিরহাম হাদিয়া প্রেরণ করলেন। তিনি ওই দিনই তা নিকটাত্মীয় ও দুস্থ জনতার মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দিলেন। ওই দিন রোজা ছিলেন তিনি। সন্ধ্যায় যখন ইফতারের জন্য ঘরে কিছু পাওয়া গেলো না তখন দাসী বললো, একটি দিরহাম রেখে দিলেও তো হতো। তিনি বললেন, মনে ছিলো না।
নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থসমূহে হজরত আয়েশা সিদ্দীকা থেকে দুই হাজার দুই শত দশটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য মুসলিম উম্মার কাছে অধিক হাদিস বর্ণনাকারী হিসেবেই যে তিনি সম্মানিতা ও মর্যাদামণ্ডিতা, তা নয়। বরং প্রধানত তিনি মহাসম্মানিতা, একারণে যে, তিনি হাদিসের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও সূক্ষ্ম মর্মবক্তব্য সম্পর্কে অন্যাপেক্ষা অধিক জানতেন। আল্লামা জাহাবী বলেছেন, রসুলুল্লাহর ফকীহ সাহাবীগণ তাঁর কাছ থেকে জেনে নিতেন। পরবর্তী সময়ের একদল লোকও তাঁর কাছ থেকে গভীর ধর্মজ্ঞান অর্জন করেন।
নবীজীবনীবিশেষজ্ঞগণ বর্ণনা করেছেন, একবার এক লোক জিজ্ঞেস করলো, পরম শ্রদ্ধেয়া মাতা! আমি কীভাবে জানবো যে, আমি পুণ্যবান? তিনি বললেন, যখন তুমি তোমার পাপ সম্পর্কে অবহিত হতে পারবে। লোকটি বললো, কীভাবে জানবো যে, আমি পাপী? তিনি বললেন, যখন জানবে তোমা কর্তৃক সম্পাদিত হচ্ছে পুণ্যকর্ম (মনে করবে তুমি পুণ্যবান)।
তিনি লোকদেরকে উপদেশ দিতেন, তোমাদের জন্য জান্নাতের দরজা খোলা থাকবে। প্রশ্ন করা হলো, কীভাবে? তিনি বললেন, ক্ষুধা ও পিপাসার দ্বারা। একবার কোরআন মজীদ পাঠ করতে করতে এই আয়াতে এসে আটকে গেলেন ‘আমি তো তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছি কিতাব, যাতে আছে তোমাদের জন্য উপদেশ, তবুও কি তোমরা বুঝবে না?
(সুরা আম্বিয়া, আয়াত১০)
এরপর থেকে তিনি যখন কোরআন পাঠ করতেন, তখন প্রতিটি আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করতেন। কখনো বলতেন, আল্লাহ পাক তাঁর পবিত্র বাণীসম্ভারে আমার কথাই জানিয়ে দিয়েছেন এভাবে— এবং অপর কতকলোক নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেছে, তারা এক সৎকর্মের সঙ্গে অপর অসৎকর্ম মিশ্রিত করেছে— আল্লাহ সম্ভবত তাদেরকে ক্ষমা করবেন
(সুরা তওবা, আয়াত ১০২)।
অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারিণী ছিলেন তিনি। ছোট বেলায় খেলাধুলা করার সময় পিতা হজরত আবু বকরের কোরআন পাঠের আওয়াজ তাঁর কানে আসতো। তিনি সেগুলো শোনার সাথে সাথে স্মৃতিস্থ করতেন। পাঠও করতেন দোলনায় দুলতে দুলতে। পরবর্তী কালের বহু ঘটনার বিবরণ তিনি দিয়েছেন সুন্দর ও সুস্পষ্ট ভাষায়। দিয়েছেন সেগুলোর যথাযথ ব্যাখ্যাও। রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে তিনি সরাসরি হাদিস বর্ণনা করেছেন, আবার বর্ণনা করেছেন পিতা হজরত আবু বকর সিদ্দীক, হজরত ওমর, হজরত ফাতেমা, হজরত সা’দ, হজরত হামযা ইবনে আমর আল আসলামী এবং হজরত জুজামা বিনতে ওয়াহাবের সূত্রেও। আবার তার কাছ থেকেও বহুসংখ্যক সাহাবী ও তাবেয়ী হাদিস বর্ণনা করেছেন। আল্লামা জাহাবী তাঁদের দুই শত জনের নাম উল্লেখ করার পর বলেছেন, এবং আরো অনেকে।
সাহাবীগণের বর্ণনা ও হাদিস লিপিবদ্ধ ও গ্রন্থনার কাজ শুরু হয় হিজরী প্রথম শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ওই সময় মদীনার কাজী ছিলেন আবু বকর ইবনে হাযাম আলআনসারী। তাঁর পাণ্ডিত্যের পেছনে তাঁর খালা হজরত উমারার অবদান ছিলো সবচেয়ে বেশী। আর হজরত উমারা ছিলেন হজরত আয়েশা সিদ্দীকার আশ্রিতা, লালিতা, পালিতা এবং ছাত্রী। খলিফা ওমর বিন আবদুল আযিয কাজী আবু বকরকে নির্দেশ দেন, তিনি যেনো হজরত উমারার বর্ণনাসমূহ লিখে পাঠান। আরব সমাজে জীবন ও কবিতা ছিলো অবিচ্ছেদ্য। তাঁদের মুখে কবিতা আবৃত্তি হতো সুখে-দুঃখে-শোকে, এমনকি যুদ্ধের সময়েও। তাঁদের এই সহজাত প্রতিভা দেখে অবাক মানতে হয়। হজরত আয়েশা সিদ্দীকার পিতৃগৃহে কাব্যর্চচা হতো। হজরত আবু বকর সিদ্দীক কবি ছিলেন। তিনিও ছিলেন তাঁর পিতার উপযুক্ত পুত্রী। তিনিও কবিতা রচনা করেছেন। বহু বিখ্যাত কবির কবিতা ছিলো তাঁর স্মৃতিস্থ। তিনি সেগুলো আবৃত্তি করে শোনাতে পারতেন।
একবার আবৃত্তি করলেন আবু কাবীর আল হুজালীর একটি কবিতা -
সে তার মায়ের গর্ভের সকল অশুদ্ধতা এবং
দুগ্ধদানকারীর সকল ব্যাধি থেকে মুক্ত।
যখন তুমি তাঁর বদনের সুদৃঢ় শিরা উপশিরার দিকে তাকাবে
তখন দেখবে, তা চমক দিচ্ছে বৃষ্টি ও বিদ্যুতের মতো—
আবৃত্তি শেষে বললেন, হে আল্লাহর বার্তাবাহক! আপনিই তো কবিতাটির উপযুক্ত পাত্র। একথা শুনে রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) খুশী হলেন।
রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর খাদেম প্রখ্যাত সাহাবী হজরত আনাস ইবনে মালেক বলেছেন, আল্লাহর রসুল যখন আমাদের এখানে আসেন, তখন আনসারদের প্রতিটি গৃহে কবিতা আবৃত্তি করা হতো।
একদিন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুনলেন, হজরত আয়েশা সিদ্দীকা যুহাইর ইবনে জানাবের এই কবিতাটি আবৃত্তি করছেন—
তুমি ওঠাও তোমার দুর্বলতাকে, যে দুর্বলতা
তোমার বিরুদ্ধে কখনো যুদ্ধ করবে না। অতঃপর
সে যা অর্জন করেছে, তার পরিণতি লাভ করবে।
সে তোমার প্রতিদান দিবে, অথবা তোমার প্রশংসা করবে।
তোমার কর্ণের যে প্রশংসা করে সে ওই ব্যক্তির
মতো, যে প্রতিদান দিয়েছে।
প্রখ্যাত তাবেয়ী সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব বলেছেন, আবু বকর কবি ছিলেন,ওমর কবি ছিলেন, আর আলী ছিলেন শ্রেষ্ঠ কবি।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকা বলেছেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহার কোনো কোনো কবিতা পাঠ করতেন। যেমন— ‘যাকে তুমি পাথেয় প্রেরণ করোনি, সে তোমার কাছে সংবাদ নিয়ে আসবে।’ তিনি আরো বলেছেন, মুহাজির সাহাবীগণ অসুখ বিসুখে অথবা মানসিক কষ্টের সময় কবিতা আবৃত্তি করতেন।
হজরত আবু বকর, হজরত বেলাল, হজরত আমের প্রমুখ সাহাবীগণের সে সকল কবিতা তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন। খন্দকের যুদ্ধে হজরত সা’দ ইবনে মাআজ যে কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন সেটিও আবৃত্তি করে শোনাতেন— কাতোইনা উত্তম হতো, যদি মুহূর্তমধ্যে এসে যেতো উট, অংশগ্রহণ করতো যুদ্ধে। মৃত্যু যখন এসে পড়েছে তখন মৃত্যু কতোইনা মনোমুগ্ধকর।
তাঁর বিবরণগুলোর মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি, আনসার মহিলাগণ বিবাহ অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করতেন। মুশরিক কবিরা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিন্দা করে কবিতা আবৃত্তি করতো। আর মুসলিম কবিরা সেগুলোর জবাব দিতেন কবিতার মাধ্যমে। মুসলিম কবিদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিলেন হজরত হাস্সান ইবনে সাবেত্ (রাঃ)।
হজরত ওসমানের শাহাদতের পর তিনি আবৃত্তি করেছিলেন এই কবিতাটি— ‘যদি আমার সম্প্রদায়ের নেতারা আমার কথা মানতো, তবে আমি তাদেরকে বাঁচাতে পারতাম এই বিশৃঙ্খলা থেকে।’ বসরায় যখন উপনীত হন, তখন আবৃত্তি করেন— এখানকার তৃণলতাকে পছন্দ করো। অতঃপর বিচরণ করো রৌদ্র উত্তাপের মধ্যে, যেমার নামক স্থানের সবুজ সতেজ প্রান্তরে।
প্রকৃত কথা হচ্ছে, কথা ও কবিতা একই। সুন্দর কথা হচ্ছে কথা সাহিত্য, আর সুন্দরতর কথার নাম কবিতা। ইসলাম শুভ-সুন্দর কবিতাকে স্বাগত জানায়। নিষিদ্ধ করে অশুভ-অশীল কবিতাকে।
আর বক্তব্য বোধগম্য করাতে গিয়ে তিনি প্রায়শঃই এই কবিতাটির উদ্বৃতি দিতেন- কালচক্র তার বিপদাপদসহ যখন কোনো জনপদের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন তা থামে তাদের সর্বশেষ ব্যক্তিটির সামনে। আমাদের এ বিপদ দেখে যারা উলসিত হয়, তাদেরকে বলো— সতর্ক হও। অতি দ্রুত তোমরা মুখোমুখি হবে, যেমন হয়েছি আমরা।
হজরত আয়েশা বলতেন, তোমরা তোমাদের সন্তান-সন্তুতিদের কবিতা শেখাও। এতে করে তাদের ভাষা সুন্দর হবে।
হজরত আবু বকর সিদ্দীকের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন হজরত ওমর (রাঃ)। তখন ইসলাম সুবিস্তৃত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা অধিকতর সচ্ছল। হজরত ওমর প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দিলেন। পবিত্র সহধর্মিণীগণের (আয্ওয়াজে মুতাহ্হারার) প্রত্যেকের জন্য নির্ধারণ করলেন দশ হাজার দিরহাম। আর হজরত আয়েশা সিদ্দীকার জন্য বারো হাজার। বললেন, আমি তাঁকে বেশী দিলাম এই কারণে যে, তিনি রসুলুল্লাহর প্রিয়তমা।
তাঁদের প্রত্যেকের জন্য তিনি একটি করে পাত্র তৈরী করেছিলেন। ওগুলোতে করে তিনি তাঁদের কাছে হাদিয়া তোহফা পাঠাতেন। কোনো পশু জবেহ্ করা হলে খেয়াল রাখতেন, মাথা থেকে পা পর্যন্ত সবই যেনো তাঁদের কাছে যায়। ইরাক বিজিত হলো। গণিমত হিসেবে উপস্থিত হলো মূল্যবান মোতিভর্তি একটি কৌটা। মোতিগুলো সকলের মধ্যে বণ্টন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়লো।
হজরত ওমর উপস্থিত জনতাকে বললেন, আমি এগুলো আমাদের মাতা সাইয়্যেদা আয়েশা সিদ্দীকার কাছে পাঠাতে চাই। আপনারা অনুমতি দিন। আপনারা তো জানেন, তিনিই ছিলেন আল্লাহর রসুলের সর্বাধিক প্রিয়পাত্রী। মোতিগুলো পেয়ে তিনি বললেন, খাত্তাবের পুত্র অনেক অনুগ্রহ দেখাচ্ছেন। হে আল্লাহ!তাঁর এসকল অনুগ্রহ লাভের জন্য আমাকে জীবিত রেখো না।
হজরত ওমর চাইতেন, তিনিও তাঁর বন্ধুদ্বয়ের পাশে শায়িত থাকবেন। একদিন তাঁর ছেলেকে অনুমতি প্রার্থনার জন্য পাঠালেন। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা বললেন, তাঁদের পাশে আমি থাকবো মনে করেছিলাম। ঠিক আছে। অনুমতি দিলাম।
অনুমতি পাওয়ার পরেও তিনি এই মর্মে অসিয়ত করে গেলেন যে, আমার লাশের খাটটি নিয়ে তোমরা জননীর দ্বারে উপস্থিত হয়ে পুনঃঅনুমতি প্রার্থনা করো। তিনি অনুমতি দিলে যথাস্থানে দাফন করো। আর অনুমতি না দিলে দাফন করো সাধারণ কবরস্থানে। তাই করা হলো। হজরত আয়েশা দ্বিতীয়বারের মতো অনুমতি দিলেন। এভাবে সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হলো তাঁর বহুদিন আগে দেখা একটি স্বপ্ন। তিনি দেখেছিলেন, তাঁর ঘরে একের পর এক তিনটি চাঁদ একে একে এসে জমা হলো। স্বপ্নটির কথা পিতাকে বলেছিলেন তিনি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহাতিরোধানের পর তাঁর পিতা বলেছিলেন, সেই তিনটি চাঁদের একটি এ-ই এবং শ্রেষ্ঠটি।
হজরত ওসমান ইবনে আফ্ফান হলেন তৃতীয় খলিফা। বারো বছর শাসন করলেন তিনি। প্রথম অর্ধাংশ কেটে গেলো শান্তির সঙ্গে। তারপর শুরু হলো অশান্তি, বিশৃঙ্খলা। অর্থাৎ লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপন করতে লাগলো অনেক অযথার্থ অভিযোগ। তারা তাঁর পদত্যাগের দাবিতে অসহিষ্ণু হয়ে উঠলো। তাঁর বাসভবন ঘেরাও করে ফেললো। তাঁর মনে পড়ে গেলো আল্লাহর রসুলের একটি বাণী। লোকেরা তোমাকে একটি বস্ত্র পরিধান করাবে। বস্ত্রটি তুমি স্বেচ্ছায় খুলে ফেলো না। তিনি পদত্যাগ করলেন না। আবার বিদ্রোহীদেরকে দমন করার নির্দেশও দিলেন না। বললেন, আল্লাহর রসুল বলেছেন, শীঘ্রই মুসলমানদের তরবারী মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত হবে। এ কাজে আমি প্রথম হতে পারি না।
সেদিন রোজা ছিলেন তিনি। অবরুদ্ধ খলিফা স্বগৃহে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। ওই সময় বিদ্রোহীরা তাঁকে শহীদ করে ফেললো। আর পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করলো হজরত আলীকে।
হজরত আয়েশা প্রতি বছরের মতো সেবারও হজ্বে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে জানতে পারলেন, খলিফা শহীদ হয়েছেন। নতুন খলিফা হয়েছেন হজরত আলী। এরকম মর্মবিদারক সংবাদ শুনে তিনি শোকে দুঃখে অধীর হয়ে উঠলেন। পথে দেখা হলো হজরত তালহা ও হজরত যোবায়েরের সাথে। তাঁরা দু’জনই ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর সাহাবী। আরো ছিলেন জানড়বাত অবধারিত হওয়ার সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের অন্তর্ভুক্ত।
তাঁরা বললেন, আমরা যাদেরকে পরিত্যাগ করে এলাম, তারা উগ্র বেদুইন ও অসহায় জনতা। তারা কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে অনবধান। তারা যেমন সত্যকে চিনতে পারছেনা, তেমনি মিথ্যাকেও অস্বীকার করতে সক্ষম হচ্ছে না। মর্মাহত মুমিনজননী হজরত আয়েশা আহত কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন— ‘যদি আমার কওম আমার কথা মানতো, তাহলে অবশ্যই তাদেরকে এ বিপদ থেকে বাঁচাতে পারতাম।’
তিনি মক্কায় ফিরে গেলেন। মানুষকে তেলাওয়াত করে শোনালেন ‘যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আমন্ত্রণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ মীমাংসা করে দিবে এবং ইনসাফ করবে।’
বহুসংখ্যক লোক তাঁকেই মীমাংসাকারিণী হিশেবে মেনে নিলো। অনেকে রয়ে গেলো নিরপেক্ষ। আশংকা করলো যুদ্ধের। এই ত্রিধাবিভক্ত জনতার মধ্যে সাহাবীগণ যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন সরলমনা সাধারণ মুসলমান। মুনাফিকেরাও মিলে মিশে ছিলো সকলের সঙ্গে। যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের বীর সন্তানগণ যাতে ধ্বংস হয়ে যায়, ভিতরে ভিতরে সেই চেষ্টাই করে যেতে লাগলো তারা। মুসলমানদের দুটি দলকে যুদ্ধলিপ্ত করতে সক্ষম হলো। ওই যুদ্ধে বিশ্বাসীদের জননী হজরত আয়েশা ছিলেন উষ্ট্রারোহী হয়ে। তাই ওই যুদ্ধের নাম হয় জঙ্গে জামাল(উটের যুদ্ধ)।
উভয় দল মুখোমুখি হলো। দুই দলের পুরোধাগণই শুভ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাই আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো। মুনাফিকেরা বিফল মনোরথ হয়ে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করলো। রাতের শেষ প্রহরে যুদ্ধ শুরু করেদিলো। মুসলমানদের মধ্যে সন্দেহ বিস্তার লাভ করতে লাগলো। তারা একে অপরকে প্রতিশ্রুতিভঙ্গকারী ভাবতে লাগলেন। হজরত আলী লোকদেরকে থামাতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। তবে নিরস্ত করতে সমর্থ হলেন তাঁর দুই বন্ধু হজরত তালহা ও হজরত যুবায়েরকে। তাঁদেরকে তিনি রসুলুল্লাহর একটি বাণী স্মরণ করিয়ে দিলেন। তাঁরা বললেন, আমরা অস্ত্রধারণ করবো না। তাঁরা মদীনার পথ ধরলেন। পথিমধ্যে নামাজ পাঠের সময় মুনাফিকেরা তাঁদেরকে শহীদ করে ফেললো।
যুদ্ধ চললো দুপুর পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের অধিনায়কগণ বুঝতে পারলেন, তাঁরা একটি ফেত্নাকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা সংযত হলেন। যুদ্ধ থেমে গেলো। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেক লোক আহত ও নিহত হলেন। সাবায়ীদের (মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে সাবার অনুসারীদের) ইচ্ছা ছিলো, তারা মুমিন জননী হজরত আয়েশাকে অপমান করবে। কিন্তু তারা সফল হলো না। তারা উটের বর্ম আচ্ছাদিত হাওদাজকে লক্ষ্য করে দূর থেকে তীর নিক্ষেপ করতে লাগলো। কিন্তু কাছে আসতে পারলোনা।
আহ! কী মর্মবিদারক ছিলো সেই দৃশ্য। উভয় দলের খাঁটি মুসলমানেরা আত্মরক্ষার জন্য আমন্ত্রণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্তরে কামনা করছেন, বন্ধ হোক ভ্রাতৃহত্যার এই জঘন্য যুদ্ধ। মুমিনজননীকে ঘিরে তাঁর সম্মান রক্ষার জন্য লড়ছেন বীর মুমিনেরা। তাঁদের কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে কবিতা— হে আমাদের মাতা, হে আমাদের সেই মাতা, আমরা যাঁকে সর্বোত্তমা বলে জানি। দেখুন, আপনার কতো বীর সন্তানের হাত-পা কাটা যাচ্ছে। কর্তিত হচ্ছে মস্তক।
হজরত আলী (রাঃ) যথাযথ সম্মানের সাথে মুমিনজননী হজরত আয়েশাকে তাঁরই একান্ত সমর্থক কুফার বিশিষ্ট নেতা আবদুল্লাহ ইবনে খালফ আল খুজায়ীর গৃহে নিয়ে গেলেন। তাঁর পক্ষের আহত সৈনিকেরাও আশ্রয় পেলো সেখানে। তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে গেলেন আমিরুল মুমিনীন হজরত আলী, হজরত ইবনে আব্বাস এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কয়েকদিন সেখানে অবস্থানের পর তিনি যাত্রা করলেন মদীনা অভিমুখে। হজরত আলী তাঁর সঙ্গে দিলেন মোহাম্মদ ইবনে আবু বকরকে এবং চল্লিশ জন সম্ভ্রান্ত বংশীয়া বসরী মহিলাকে।
যাত্রাকালে তিনি বিদায় জানাতে উপস্থিত জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন একজন নারীর কন্যার জামাতার সাথে যে সম্পর্ক থাকে, সে রকম সম্পর্ক ছাড়া কোনো বিদ্বেষমূলক সম্পর্ক আমাদের মধ্যে নেই। আমি জানি, তিনি সাধু পুরুষগণের একজন। হজরত আলী বললেন, ওহে জনমণ্ডলী! তিনি সত্যভাষিণী। আমাদের মধ্যে কোনো হিংসা-দ্বেষ নেই। তিনি তোমাদের প্রিয়তম নবীর স্ত্রী—দুনিয়া ও আখেরাতে। আর তিনি আমাদের, বিশ্বাসীগণের মাতা।
চার বছর ধরে রাজ্যশাসন করলেন আমিরুল মুমিনীন হজরত আলী। তারপর বুঝতে পারলেন, তিনি শীঘ্রই শহীদ হতে যাচ্ছেন। একদিন তিনি হাত ধোয়ার সময় নিজের দাড়িতে হাত রেখে বললেন, তুই রক্তরঞ্জিত হবি। আর একদিন বনী শোরাদের এক লোক এসে বললো, হে বিশ্বাসীগণের অধিনায়ক! সাবধানে থাকবেন। খারেজীরা আপনাকে হত্যা করতে চায়। হজরত আলী নিজেও বুঝতে পারলেন, কে এবং কারা তাঁকে হত্যা করতে চায়। তিনি কিছুমাত্র চাঞ্চল্য প্রকাশ করলেন না। তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছেদ পড়লো না এতোটুকুও ।
সে রাতে তিনি ঘুমাতে পারলেন না। শেষ রাতে এমনভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন যে, আজান শুনতে পেলেন না। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হজরত হাসান বললেন, মুয়াজ্জিন ইবনে বানাহ উচ্চকন্ঠে নামাজ নামাজ বলতে লাগলেন। আমি তাঁকে হাত ধরে ওঠালাম। তিনি অতি কষ্টে গাত্রোত্থান করলেন। মসজিদের দিকে চলতে চলতে আবৃত্তি করলেন এই কবিতাটি— মৃত্যুর জন্য পূর্ণরূপে প্রস্তুত হও। মৃত্যু তোমার সাথে সাক্ষাত করবে। মৃত্যুকে ভয় করো না, যখন সে উপস্থিত হবে তোমার গৃহদ্বারে।
একটু অগ্রসর হতেই দুই আততায়ীর তলোয়ার যুগপৎ আঘাত করলো। একটি তলোয়ারের আঘাতে দুফাঁক হলো তাঁর ললাটদেশ। তিনি উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, আল্লাহর শপথ! আমি সফলকাম।
এরপর কয়েকটি দিন মাত্র তিনি গায়ে মাখলেন নশ্বর এ পৃথিবীর আলো বাতাস। পুত্রগণকে, পরিবার-পরিজনকে এবং সাধারণ মুসলমানকে সদুপদেশ দিলেন। কিছু উপদেশ লিপিবদ্ধও করালেন। পরিবারের সদস্য-সদস্যাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে পরিবারবর্গ! আল্লাহ তোমাদেরকে রক্ষা করুন।
তোমাদেরকে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত রাখুন। আমি তোমাদের শান্তি ও কল্যাণ কামনা করি। এরকম অসিয়ত করার পর তিনি পবিত্র কলেমা বলতে বলতে চিরদিনের জন্য এই ধরাধাম থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন। কুফায় ছিলো তাঁর রাজধানী। সেখানেই মহাসম্মানের সঙ্গে তাঁকে সমাহিত করা হলো।
মদীনাবাসীগণ যখন শোক সংবাদ শুনতে পেলেন, তখন আর নিজেদেরকে স্থির রাখতে পারলেন না। ঘরে ঘরে উঠলো কান্নার রোল। সাহাবীগণ বিশ্বাসীগণের জননী হজরত আয়েশা সিদ্দীকার গৃহে সমবেত হলেন। দেখলেন, তিনি কেঁদে কেঁদে আকুল হচ্ছেন। পরদিন এই সংবাদটি প্রচারিত হলো যে, তিনি রসুলুল্লাহর রওজা পাকে আসছেন।
পরদিন মহামাননীয়া মাতা রওজা শরীফে উপস্থিত হলেন। মসজিদে উপবিষ্ট সকল মুহাজির আনসার তাঁর সম্মানে উঠে দাঁড়ালেন। সকলে সালাম বললেন। কিন্তু তিনি তখন এতোই শোকাচ্ছনড়ব যে, কারো কথা শুনতে পেলেন না। তাই জবাবও দিলেন না। নির্বাক জননী টলে টলে যাচ্ছিলেন। ওড়না বার বার পায়ের দিকে পড়ে যাচ্ছিলো। অতি কষ্টে তিনি রওজা পাকে পৌঁছলেন। অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বললেন, হে হেদায়েতের নবী! আপনার প্রতি সালাম। হে আবুল কাসেম! আপনার উপরে সালাম।
হে আল্লাহর প্রত্যাদেশবাহক! আপনার প্রতি ও আপনার সাথীদের প্রতি সালাম। আমি আপনার প্রিয়তম সহচরের মৃত্যুসংবাদ জানাতে এসেছি। নতুন করে স্মরণ করুন আপনার প্রিয়তম সাথীর কথা। আল্লাহর কসম! আপনার পরীক্ষিত বন্ধু, আপনার মনোনীত সাথী পরলোকগমন করেছেন। আহ্! আমি তাঁর শোকে অশ্রু বিসর্জনকারিণী। আপনার কবর যদি উন্মুক্ত হতো, তবে আপনিও বলতেন, নিহত হয়েছেন আপনার প্রিয়তম ও শ্রেষ্ঠ বন্ধু।
পবিত্র সহধর্মিণী মুমিনজননী হজরত আয়েশার রসুলবিরহের সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। একে একে শেষ হয়ে গেলো জ্যোতির্ময় খলিফা চতুষ্টয়ের শাসনকাল। শুরু হলো হজরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর শাসন। তিনি থাকতেন তখনকার রাজধানী দামেশকে। মদীনায় এলে তিনি জননী আয়েশা সিদ্দীকা সকাশে অবশ্যই উপস্থিত হতেন। একবার উপস্থিত হলে জননী আয়েশা তাঁকে বললেন, তুমি দেখছি নিশ্চিন্ত ও নির্বিকার। এমনও তো হতে পারতো, আমি কোনো ঘাতককে ঠিক করে রাখতাম। সে তোমাকে অতর্কিতে আঘাত করতো।
হজরত মুয়াবিয়া বললেন, অসম্ভব। মাতৃগৃহ তো দারুল আমান (নিরাপদ গৃহ)। রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ইমান হচ্ছে অতর্কিত হত্যার শিকল। কথাশেষে হজরত মুয়াবিয়া (রাঃ) বললেন, হে আমাদের মা! আপনার সাথে আমার আচরণ কেমন হচ্ছে? জননী বললেন, ভালো। হজরত মুয়াবিয়া বললেন, অনুগ্রহ করে বনী হাশেম ও আমার বিষয়টি ছেড়ে দিন। আল্লাহর দরবারে বুঝাপড়া হবে।
ইরাক ও মিশরের কিছু লোক হজরত ওসমানের নিন্দা করতো। আবার সিরিয়াবাসীদের কেউ কেউ সমালোচনা করতো হজরত আলীর। আবার খারেজীরা ছিলো উভয় দলের বিরুদ্ধে। জননী হজরত আয়েশা সিদ্দীকা সকল দল-উপদল সম্পর্কে জানতেন। আক্ষেপ করে বলতেন, কোরআনপাকে আলাহ্তায়ালা তাঁর রসুলের সাহাবীগণের জন্য রহমত ও মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করতে বলেছেন। আর এই লোকেরা তাদেরকে গালি দেয়। একবার জননী আয়েশা সিদ্দীকার উপদেশ প্রার্থনা করে একটি চিঠি লিখলেন হজরত মুয়াবিয়া। তিনি জবাবে লিখলেন, সালামুন আলাইকুম। অতঃপর আমি রসুলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মানুষের তুষ্টির দিকে দৃকপাত না করে আল্লাহর তুষ্টি কামনা করবে, আল্লাহ তাকে মানুষের অতুষ্টির পরিণাম থেকে রক্ষা করবেন। আর যে ব্যক্তি আলাহ্কে অতুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টিকামী হবে, আল্লাহ তাকে মানুষের হাতে ছেড়ে দিবেন। ওয়াস্সালামু আলাইকা।
প্রতি বছর হজ্ব করেন তিনি। একবার তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মেয়েরা জেহাদ করতে পারবে না কেনো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছিলেন, মেয়েদের জেহাদ হচ্ছে হজ্ব। বিশাল মুসলিম জনতার পরম শ্রদ্বেয়া জননী তিনি। সকলে তাঁর সেবাযতেড়বর জন্য সতত প্রস্তুত থাকেন। হাদিয়া পাঠান অনেকে। কিন্তু কোনোকিছুতেই তিনি মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হন না। প্রায় প্রতিদিনই রোজা রাখেন। মাত্র এক জোড়া বস্ত্র ব্যবহার করেন। একটি মূল্যবান বস্ত্রও তাঁর ছিলো। যার মূল্য ছিলো পাঁচ দিরহামের মতো। বিয়ে শাদীর অনুষ্ঠানে অনেকে তাঁর ওই জামাটি চেয়ে নিয়ে কনেকে সাজাতো।
কখনো কখনো জাফরান রাঙানো জামা পরিধান করতেন। মাঝে মাঝে অলংকারও পরতেন। ইয়েমেনের তৈরী শাদা কালো কাজ করা মোতির একটি হার তার কণ্ঠে শোভা পেতো। হাতের আঙ্গুলে সোনার আঙটিও পরতেন। কাসেম ইবনে মোহাম্মদ বলেছেন, আমি জননী আয়েশাকে ইহরাম অবস্থায় সোনার আঙটি এবং হলুদ রঙের পোশাক পরতে দেখেছি।
পর্দা পালন করতেন কঠোরতার সাথে, যথানিয়মে। একবার তাঁর ভাতিজি হাফসা বিনতে আবদুর রহমান একটি পাতলা ওড়না মাথায় দিয়ে তাঁর কাছে এলেন। তিনি তাঁর ওড়নাটি নিয়ে ফেঁড়ে ফেললেন। মোটা কাপড়ের একটি ওড়না তাকে দিয়ে বললেন, জানো না, সুরা নূরে আল্লাহ কী বলেছেন? একবার এক বাড়ীতে তিনি আতিথ্য গ্রহণ করলেন। দেখলেন, গৃহকর্তার প্রায় যুবতী দুটি মেয়ে চাদর ছাড়াই নামাজ পড়ছে। তিনি বললেন, মেয়েরা যেনো চাদর ছাড়া নামাজ না পড়ে।
তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। কিন্তু ছিলেন বহুসংখ্যক পিতৃহারা-মাতৃহারাদের প্রতিপালনকারিণী মা। তাদের তিনি উপযুক্ত শিক্ষা দিতেন এবং বিবাহশাদীর ব্যবস্থা করতেন।
তাঁর অস্তিত্ব ছিলো পুষ্পাপেক্ষা অধিক শুভ্রসুন্দর, পুতঃপবিত্র। পরনিন্দা তিনি কখনোই করতেন না। তাঁর বহু কথা হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোতে কারো সম্পর্কে কোনো অপমন্তব্য ও সম্মানহানির কিছু নেই। সপত্নীদের সম্পর্কে তিনি খারাপ কিছু বলতেন না। বরং উদারচিত্তে প্রশংসা করতেন। তাঁদের ভালোও বাসতেন। ক্ষমা করে দিতেন সকলের অপরাধ। এমনকি যে কবি হাস্সান ইবনে সাবেত্ মিথ্যা অপবাদের সময় মুনাফিকদের অপপ্রচারে অংশগ্রহণ করে তাঁকে কষ্ট দিয়েছিলেন, তাঁকেও তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য দানে ধন্য করেছিলেন।
অহংকার কখনোই তাঁর সত্তার সন্নিকটবর্তী হতে পারেনি। নিজেকে তিনি অনুল্লেখ্য ও অতি সাধারণ মনে করতেন। আর কেউ তাঁর সামনাসামনি প্রশংসা করুক, তা তিনি সহ্যই করতে পারতেন না। তবে পবিত্র আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে তিনি ছিলেন সতত সচেতন। পুত্রস্নেহে বড় করে তুলেছিলেন ভগ্নিপুত্র হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়েরকে। তিনিও হজরত আয়েশাকে শ্রদ্ধা করতেন মায়ের চেয়ে বেশী। তিনি একবার হজরত আয়েশার অতি দানশীলতা দেখে মন্তব্য করলেন, তাঁর দানের হাত সংযত হওয়া উচিত। একথা শুনে তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ আহত হয়। তিনি কসম খেয়ে বলেন, আর কখনো তিনি আবদুলাহ্র কোনো উপহার স্পর্শ করবেন না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের মাতৃরোষের শিকার হয়ে ভীষণ আশান্তিতে ভোগেন। সুপারিশকারী হিসেবে তাঁর পক্ষ নেন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। তাঁদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তিনি রোষ সংবরণ করেন। সূক্ষ্ম ও সঠিক ন্যায়বোধও তাঁর ছিলো। নিকটের বা দূরের যেই হোক না কেনো, সকলের শুভগুণাবলীর তিনি অকুন্ঠচিত্তে প্রশংসা করতেন। দানশীলতা ছিলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একটি সত্তাসম্পৃক্ত বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যটি তাঁর সকল প্রেমিক, প্রেমিকাগণেরও স্বভাববৈশিষ্ট্য। জননী আয়েশার স্বভাবে এই গুণটি ছিলো অন্যাপেক্ষা অনেক অনেক তীব্র। তাঁর প্রিয় ছাত্র ও প্রখ্যাত তাবেয়ী ওরওয়া বলেছেন, একবার আমার সামনেই তিনি সত্তর হাজার দিরহাম বিলিয়ে দিয়ে তাঁর চাদরের কোণা মুড়ে ফেললেন। এরকম ঘটনা একটি, দুটি নয়— অনেক। যাচ্ঞাকারীকে বিমুখ করতেন না। অল্প-বেশী যাই থাকতো প্রার্থীদেরকে নির্বিলম্বে দান করে দিতেন।
ছিলেন নির্ভীক ও সাহসী। তাঁর জীবনের বহু ঘটনায় তাঁর সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। রাতে ঘুম থেকে উঠে একাই কবরস্থানে চলে যেতেন। যুদ্ধের ময়দানেও কখনো পশ্চাদপসরণ করতেন না। উহুদ যুদ্ধে যখন মুসলিমবাহিনী অপ্রস্তুত ও আক্রান্ত, তখনও তিনি মশক ভর্তি পানি পিঠে বহন করে নিয়ে আহত সৈনিকদের তৃষ্ণা নিবারণ করেছেন। খন্দক যুদ্ধের সময় যখন মুশরিকবাহিনী দ্বারা মদীনা অবরুদ্ধ; তদুপরি ছিলো গৃহশত্রু ইহুদীদের আক্রমণাশঙ্কা, তখনও তিনি দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে মুসলিম মুজাহিদদের যুদ্ধ কৌশল প্রত্যক্ষ করেছেন। একবার তো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে জেহাদের অনুমতিও প্রার্থনা করে ছিলেন। কিন্তু অনুমতি পাননি।
দাস-দাসীদের প্রতি ছিলেন খুবই সদয়। যে কোনো অজুহাতে দাসমুক্ত করতেন। একবার তো একটি মাত্র শপথের ক্ষতিপূরণ হিসেবে চল্লিশ জন দাসকে মুক্ত করে দেন। সর্বমোট ৬৭ জন দাস-দাসী মুক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি। তাজীম গোত্রের একটি দাসী ছিলো তাঁর । তিনি রসুলুল্লাহর কাছে শুনতে পান, দাসীটি নবী ইসমাইলের বংশধর। রসুলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইঙ্গিতে দাসীটিকে মুক্ত করে দেন তিনি। মদীনায় ছিলো অর্থের বিনিময়ে মুক্ত হওয়ার জন্য মনিবের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধা এক দাসী। সে মানুষের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করতো। একথা শুনতে পেয়ে তিনি একাই সব অর্থ পরিশোধ করে তাঁকে মুক্ত করেন।
একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, কেউ হয়তো যাদুটোনা করেছে। তিনি এক দাসীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যাদু করেছো? সে বললো, হ্যাঁ। তিনি বললেন, কেনো? সে বললো, যাতে আপনি তাড়াতাড়ি মারা যান, আর আমি মুক্ত হতে পারি। তিনি নির্দেশ দিলেন, একে কোনো ধনী লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকায় একটি দাসক্রয় করা হোক এবং দাসটিকে মুক্ত করা হোক।
শরীয়তের অতি সাধারণ শুভ-অশুভ কাজের প্রতি তিনি ছিলেন সদা সজাগ। ছোট খাট অসিদ্ধ কাজগুলোও তিনি এড়িয়ে চলতেন। হঠাৎ ঘণ্টাধ্বনি শুনলে থেমে যেতেন, যাতে আর শোনা না যায়। তাঁর বাসভবনের একাংশে এক ভাড়াটিয়া বাস করতো। সে দাবা খেলতো। একথা শুনতে পেয়ে তিনি তাকে সাবধান করে দিলেন। বলে দিলেন, এ খেলা বন্ধ না করলে তাকে বের করে দেওয়া হবে।
তাঁর মন ছিলো কুসুমের চেয়ে কোমল। কারো কথায় বা কাজে কষ্ট পেলে কেঁদে ফেলতেন। মিথ্যা অপবাদের এক মাস তো কেবল কেঁদেই কাটিয়েছেন। বিদায় হজ্বের সময় নারী প্রকৃতিজনিত প্রতিবন্ধকতা দেখা দিলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। পরে রসুলুল্লাহ নিজে সান্ত্বনা দিয়ে তাঁকে প্রকৃতিস্থ করেন। দজ্জালের ভয়েও একবার আকুল হয়ে কেঁদেছিলেন তিনি।
একবার একটি কথার উপর তিনি কসম করে বসলেন। লোকেরা অনেক অনুরোধ-উপরোধ করলো। তাদের পীড়াপীড়িতে তিনি শেষ পর্যন্ত কসম ভঙ্গ করেন। কাফফারা স্বরূপ মুক্ত করে দেন ৪০টি ক্রীতদাসকে। ঘটনাটি তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলে। ঘটনাটির কথা মনে হলে তিনি কেঁদে ফেলতেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে আঁচল ভিজে যেতো। উটের যুদ্ধের কথা মনে হলেও নীরবে অশ্রুবর্ষণ করতেন। কখনো বলতেন, হায়! আমি যদি বৃক্ষ হতাম। হায়! যদি পাথর হতাম- যদি কিছুই না হতাম।
একবার বসরার এক লোক তাঁর সাথে দেখা করতে এলো। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি উষ্ট্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলে? লোকটি বললো, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তুমি কি ওই লোকটিকে চেনো, যে সেদিন আবৃত্তি করেছিলো ‘হে আমাদের জননী! হে আমাদের সেই জননী মহোদয়া, যাকে আমরা সর্বোত্তমা বলে জানি। দেখুন, আপনার কতো বীর সন্তানের হাত-পা কাটা যাচ্ছে, কর্তিত হচ্ছে মস্তক।’ লোকটি বললো, সে তো ছিলো আমার ভাই। তার কথা শুনে জননী মহোদয়া এতো বেশী কাঁদলেন যে, মনে হচ্ছিলো, তাঁর কান্না কখনোই থামবে না।
কখনো আক্ষেপ করতেন এরকম কথা বলে যে, হায়! ওই মর্মপীড়াদায়ক যুদ্ধের বিশ বছর আগেই যদি আমি দুনিয়া থেকে চলে যেতাম, তাহলে কতোই না উত্তম হতো। ‘যখন তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে’ এই আয়াত যখন তেলাওয়াত করতেন, তখনও অশ্রুবর্ষণ করতেন অঝোর ধারায়।
হিজরী ৫৮ সাল। মহামাননীয়া আয়েশা সিদ্দীকার বয়স হলো ৬৬ বছর। তিনি পরকাল যাত্রার জন্য উন্মুখ হলেন। দীর্ঘ বিরহযন্ত্রণার এবার অবসান হবে। চিরদিনের জন্য তিনি মিলিত হবেন হৃদয়ের হৃদয়, স্বামী ও রসুল মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে। আশা-আশঙ্কা-আনন্দ সবকিছু একাকার হয়ে তাঁর বিদায়যন্ত্রণাকে ঢেকে ফেলতে চায়। অবর্ণনীয় এক অনুভূতির মধ্যে সারাক্ষণ নিমজ্জিত থাকেন তিনি। সাক্ষাতপ্রার্থী ও সাক্ষাতপ্রার্থিনীদের ভিড় বাড়ে। তাদের জিজ্ঞাসার জবাবে বলেন, ভালো আছি। কিন্তু পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীদের প্রতি মনোযোগ হতে থাকে শিথিল, শিথিলতর।
শারীরিক অবস্থা ক্রমশই অবনতির দিকে যেতে থাকে। শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয় সারাক্ষণ। ওঠা-বসার শক্তি রহিতপ্রায়। তৎসত্ত্বেও স্মৃতিশক্তি ও বাকশক্তি অটুট। এ সময় হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস সাক্ষাতপ্রার্থী হলেন। জননী আয়েশা সিদ্দীকা ভাবলেন, মুমিনজননীগণের প্রতি তাঁর যেরকম গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা, তাতে তিনি হয়তো এসেই তাঁর প্রশংসা-প্রশস্তি শুরু করে দিবেন। তাঁকে মৌন থাকতে দেখে তাঁর বোনের ছেলেরা সুপারিশ করলেন, দয়া করে অনুমতি দিন। কারণ আপনি উম্মুল মুমিনীন। আর তাঁর সম্পর্কে তো জানেনই। তিনি তো ইবনে আব্বাস। আপনাকে সালাম ও বিদায় জানাতে এসেছেন। তিনি বললেন, আসতে বলো।
জননীর আশঙ্কাই সত্য হলো। হজরত আবদুল্লাহ সালাম দিয়ে বসার সাথে সাথে বলতে শুরু করলেন, সেই আদি কাল থেকেই আপনি উম্মুল মুমিনিন। আপনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রত্যাদেশবাহকের প্রিয়তমা। তাঁর সঙ্গে আপনার মিলনের সময় সমাগত। অপেক্ষা শুধু প্রাণবায়ুটুকু বের হয়ে যাওয়ার। যে রাতে আপনার কণ্ঠহারটি হারিয়ে গেলো, যখন আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীগণ অনেক খুঁজাখুঁজি করেও পানি পেলেন না, তখন আপনার কারণেই আমরা পেলাম তায়াম্মুমের বিধান। জিব্রাইল আমিন আপনার শুচিতা ও পবিত্রতা সম্পর্কিত বাণী নিয়ে এসেছেন আকাশ থেকে। ওই পবিত্র বাণীসম্ভার মহাপ্রলয় পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে গৃহে, মসজিদে, সর্বত্র।
জননী তাঁকে থামালেন। বললেন, ইবনে আব্বাস! এ সকল নন্দনবাক্য থেকে আমাকে অব্যাহতি দান করুন। আমার তো একথা ভাবতেই পছন্দ যে, আমার যদি অস্তিত্বপ্রাপ্তিই না ঘটতো। ঘটলো পবিত্র রমজান মাসের শুভাগমন। আল্লাহ পাকের দয়া ও ক্ষমার আলোয় ভরে গেলো বিশ্বচরাচর। নূরের পাবন ভরা এই মাসে তখনকার এবং অনাগত কালের সন্তানদের শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে মহিয়সী মা-জননী চিরতরে চলে গেলেন। অসিয়ত করে গিয়েছিলেন, আমাকে তোমরা জানড়বাতুল বাকী গোরোস্থানে রসুলুল্লাহর অন্য স্ত্রীগণের পাশে কবর দিয়ো। রাতে যদি চলে যাই, তবে রাতেই দাফনের কাজ শেষ করে ফেলো।
রাতে বিতির নামাজের পরেই ঘটলো তাঁর মহাতিরোধান। মাতৃহারা মদীনাবাসীগণ কান্নায় ভেঙে পড়লেন। জানাযায় এতো লোকের সমাবেশ ঘটলো যে, ইতোপূর্বে এরকম কখনোই দেখা যায়নি। মেয়েরাও উপস্থিত হয়েছিলেন দলে দলে। মনে হচ্ছিলো, ঈদ উৎসবের জনজটলা।
মুমিনজননী উম্মে সালমা কান্নার আওয়াজ শুনে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আয়েশার জন্য বেহেশত অবধারিত। তিনি ছিলেন রসুলুল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় সহধর্মিণী।
হজরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কর্তৃক নিয়োজিত মদীনার প্রশাসক তখন হজরত আবু হুরায়রা। তিনিই জানাযার নামাজের ইমাম হলেন। বিশাল সমাবেশের দোয়া ও জানাযা শেষ হবার পর তাঁকে কবরে নামালেন তাঁর বোন ও ভাইয়ের ছেলেরা— কাসেম ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আবু বকর (রাঃ), আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর, আবদুল্লাহ ইবনে আতিক, ওরওয়া ইবনে যুবায়ের এবং আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রাঃ)।