হজরত উম্মে সালমা বিনতে আবু উমাইয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা
🖋মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ
.......................................................................
‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রাথমিক অগ্রানুসারী এবং যারা সদানুষ্ঠানের সঙ্গে তাদের অনুগমন করে, আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেথায় তারা স্থায়ী হবে। এটা মহাসাফল্য।’
ইসলাম-সূর্যের প্রথম আলোয় যাঁরা অবগাহন করে মহাসাফল্য লাভের শুভসংবাদ পেয়েছেন, আবু সালমা ও উম্মে সালমা দম্পতি তাঁদের অন্যতম। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকটাত্মীয় ছিলেন তাঁরা। তদুপরি আবু সালমা ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দুধভাই।
মুমিনজননী উম্মে সালমার আসল নাম হিন্দা। তাঁর পিতার নাম আবু উমাইয়া ইবনে আল মুগীরা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আল মাখযুম। তাঁর আসল নাম হুজায়ফা হলেও সকলে তাঁকে আবু উমাইয়া বলতো। দানশীল ও অতিথি আপ্যায়ক হিসেবে খ্যাতি ছিলো তাঁর। উপাধি ছিলো ‘যাদুর রবক’ (কাফেলার পাথেয়)। কোথাও সফর করলে কাফেলার খাওয়া- দাওয়াসহ সকল কিছু তিনি নিজ দায়িত্বভূত করে নিতেন। সে কারণেই জনতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন ভালোবাসার উপাধিটি।
আবু জেহেলের পিতা হিশাম, হজরত ওমর (রাঃ) এর নানা হাশিম, খালেদ ইবনে ওলিদের পিতা ওলিদ ইবনে মুগিরা, আবু হুজায়ফা মাখযুমী, আবু রবিয়া, ফাকিহা, হিন্দা বিনতে উতবার প্রথম স্বামী হাযাম, আবদুস্ শামস— এরা সকলেই ছিলেন মুগীরা আল মাখযুমীর ছেলে। আবু উমাইয়ার ভাই — সেই হিসেবে জননী উম্মে সালমার চাচা। আর হজরত আমর ইবনে আসের মা উম্মে হারমালা বিনতে হিশাম এবং হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এর মা খানতামা বিনতে হাশেম ছিলেন তাঁর চাচাতো বোন।
জননী উম্মে সালমার মায়ের নাম আতিকা বিনতে আমের ইবনে রবিয়া ইবনে মালেক আল কিনানিয়্যা। তাঁর প্রথম স্বামী আবু সালমার আসল নাম আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আসাদ আল মাখযুমী।
তাঁর পিতা এবং উম্মতজননী উম্মে সালমার পিতা দুই ভাই। আবার আবু সালমার পিতা আবদুল আসাদ ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ফুফা। ফুফু বুররাকে বিয়ে করেন তিনি। এই হিসেবে আবু সালমা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ফুফাত ভাই হন। আর হজরত আবু তালেব, হজরত হামযা ও হজরত আব্বাস হন জননী উম্মে সালমার মামা।
আবু সালমা ও উম্মে সালমা বনী মাখযুম গোত্রের লোকদের দ্বারা অত্যাচারিত হতে থাকেন। তাদের নির্দয়তা ও নিষ্ঠুরতা সইতে না পেরে তারা এক পর্যায়ে হজরত আবু তালেবের আশ্রয়ে চলে আসতে বাধ্য হন। বনী মাখযুমের লোকেরা বললো, মান্যবর আবু তালেব! এতোদিন ধরে আপনার ভাতিজাকে সাহায্য-সহযোগিতা করে চলেছেন। এখন আবার আমাদের ভাইয়ের ছেলেকে আশ্রয় দিয়েছেন। আমাদের গোত্রের ছেলেকে আমাদের হাতে দিয়ে দিন। হজরত আবু তালেব বললেন, দু’জন তো একই রকম বিপদগ্রস্ত। কাফের কুরায়েশদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চললো। নবমুসলিমদের মক্কায় বসবাস করা দুষ্কর হয়ে পড়লো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জুলুম-অত্যাচার রোধ করতে পারলেন না। সহ্যও করতে পারলেন না। হিজরতের নির্দেশ দিলেন। একদল অত্যাচারিত মুসলমান হিজরত করে আবিসিনিয়ায় চলে গেলেন। ইবনে ইসহাক মন্তব্য করেছেন, আবু সালমাই সর্বপ্রথম সস্ত্রীক আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছেন।
কিছুদিন পর প্রথম হিজরতকারী দল একটি ভুল সংবাদ শুনে মক্কায় ফিরে আসেন। দ্বিতীয় বার আবিসিনিয়ায় ফিরে যান আরো অনেক মজলুম সাহাবীকে নিয়ে। আবু সালমা এবং উম্মে সালমাও এভাবে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন দুই বার। সেখানে তাঁদের ঘরে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। তাঁরা তাঁর নাম রাখেন সালমা। তাঁর নামের সূত্রেই মানুষ তাঁদেরকে আবু সালমা ও উম্মে সালমা বলে ডাকতে থাকে। আসল নাম চলে যায় ইতিহাসের নেপথ্য অধ্যায়ে।
সালমা একটু বড় হলে তাঁরা আবার মক্কায় ফিরে আসেন। মক্কায় তখন মুসলিম জনতার অবস্থা আরো অধিক শোচনীয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদেরকে পুনঃনির্দেশ দান করেন, অবিলম্বে হিজরত করতে হবে। এবার মদীনায়।
হিজরতের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং। তাঁর রসুল সেকথা জানিয়ে দিয়েছেন কেবল। প্রত্যাদেশ আকারে একথা জানানো হয়েছে এভাবে ‘যে ব্যক্তি রসুলের আনুগত্য করলো, নিশ্চয়ই সে আনুগত্য করলো আল্লাহর।’ প্রত্যেক সাহাবী একথা জানতেন, বিশ্বাস করতেন এবং এর উপর আমলও করতেন। তাই সাহাবীগণ যিনি যখন নির্দেশ পেলেন, তখনই যেতে শুরু করলেন নতুন হিজরতভূমি ইয়াসরেবের দিকে, পরে যার নাম হয় মদীনাতুন নবী— নবীর শহর, সংক্ষেপে মদীনা।
কীভাবে যাত্রা করলেন, তার বিবরণ হজরত উম্মে সালমা নিজেই দিয়েছেন এভাবে— আবু সালমা মদীনা যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করলেন। একটি মাত্র উট ছিলো তাঁর। ওই উটের উপরে তিনি আমাকে ও আমাদের শিশু সন্তান সালমাকে ওঠালেন। আর নিজে উটের লাগাম ধরে চলতে শুরু করলেন। খবর পেয়ে ছুটে এলো আমার পিতৃকুল বনী মুগিরার লোকজন। তারা আবু সালমার পথরোধ করে দাঁড়ালো। বললো, আমাদের মেয়েকে আমরা এরকম অসহায় অবস্থায় ছাড়বো না। এই বলে তারা আবু সালমার হাত থেকে উটের লাগাম ছিনিয়ে নিলো। আমাকে ও সালমাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। ইতোমধ্যে এসে পড়লো আবু সালমার বংশের লোকেরা। তারা আমার কাছ থেকে সালমাকে ছিনিয়ে নিলো। তারা বনী মুগিরার লোকদেরকে বললো, তোমরা যদি তোমাদের মেয়েকে তার স্বামীর সাথে যেতে না দাও, তবে আমরাও আমাদের সন্তানকে তোমাদের মেয়ের কাছে থাকতে দেবো না। এভাবে আমরা তিন জন তিন দিকে ছিটকে পড়লাম। আবু সালমা মদীনার পথ ধরলো। সালমাকে নিয়ে গেলো তার বাপের গোষ্ঠীর লোকেরা। আর আমি আটকা পড়লাম পিতৃগৃহে। শোকে-দুঃখে ভেঙে পড়লাম। ভোরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঁদতাম আবতাহ্ উপত্যকার একটি টিলার উপরে বসে। সাত আট দিন গত হয়ে গেলো এভাবে।
বনী মুগিরার এক লোক একদিন আমার দুরবস্থা দেখে খুব কষ্ট পেলেন। তিনি ছিলেন দয়ার্দ্রচিত্ত ও আমাদের কল্যাণাকাঙ্কী। তিনি গোত্রের লোকদেরকে একত্র করে বললেন, আপনারা এই অবস্থায় মেয়েটিকে কেনো কষ্ট দিচ্ছেন? কী অপরাধ তার? তাকে তার স্বামী সন্তানের সঙ্গে মিলিত হতে দিচ্ছেন না কেনো? অবিলম্বে তাকে মুক্তি দিন। প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলিত হতে দিন।
লোকটির কথা ছিলো অকৃত্রিম মমতা ও আবেগে ভরপুর। তার কথা শুনে আমার পিতৃগোত্রের লোকদের অন্তরে দয়া ও করুণার উদ্রেক হলো। তারা আমাকে যথা ইচ্ছা তথা গমনের অনুমতি দিয়ে দিলো। এ সংবাদ শুনে সালমাকে তার পিতৃগোত্রের লোকেরা আমার কাছে পাঠিয়ে দিলো। আমি আবার আমার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে উটের পিঠে উঠলাম। যাত্রা করলাম মদীনা অভিমুখে। তানযীম নামক স্থানে পৌঁছতেই দেখা হয়ে গেলো কাবাগৃহের চাবিরক্ষক ওসমান ইবনে তালহার সঙ্গে। তিনি আমাকে চিনতে পারলেন। কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করলেন। আরো জিজ্ঞেস করলেন, সঙ্গে কে যাবে? আমি বললাম, আর কেউ নেই। আমি ও আমার শিশুপুত্র। একথা শুনেই তিনি আমার উটের লাগাম ধরলেন। পথপ্রদর্শক ও অভিভাবক হয়ে পথ চলতে লাগলেন মদীনা অভিমুখে।
আল্লাহ জানেন, আমি সমগ্র আরবে তালহার মতো ভদ্র ও সজ্জন আর কাউকে দেখিনি। যখন কোনো মনজিল (বিরতিস্থল) উপস্থিত হতো এবং আমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন হতো, তিনি উটকে থামাতেন। বসিয়ে দিতেন। চলে যেতেন দূরে কোনো গাছের আড়ালে। বিশ্রাম শেষে তিনি ফিরে এসে উটকে প্রস্তুত করতেন। বলতেন, উঠে বসো। আমরা উটের উপরে আরাম করে বসবার পর তিনি উটের রশি ধরে আগে আগে চলতে থাকতেন।
দীর্ঘ পথযাত্রার অবসান হলো। আমরা মদীনার সন্নিকটবর্তী বনী আমর ইবনে আউফের কোবা মহলায় পৌঁছলাম। ওসমান ইবনে তালহা বললেন, আবু সালমা এখানেই থাকেন। একটু এগিয়ে যেতেই তাঁর দেখা পেয়ে পথশ্রান্তির কথা ভুলে গেলাম। ওসমান ইবনে তালহা ফিরে গেলেন মক্কায়।
 হজরত ওসমান ইবনে তালহার এই সহৃদয়তা ও সহমর্মিতার কথা হজরত উম্মে সালমা সারাজীবন মনে রেখেছিলেন। সকলের সামনে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতেন, আমি ওসমান ইবনে তালহার চেয়ে শরীফ সঙ্গী আর কোথাও দেখিনি।
আবার হিজরতের কথা উঠলে তিনি একথাও বলতেন যে, ইসলামের জন্য আবু সালমার পরিবারকে যেরকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, আহলে বায়েতের আর কারো ক্ষেত্রে সেরকম ঘটেছে কিনা, তা আমার জানা নেই। ‘উসুদুল গাবা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, তিনিই প্রথম অভিজাত রমণী, যিনি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন।
হজরত উম্মে সালমার পিতা ছিলেন সুবিখ্যাত। কিন্তু কোবা পলীর অনেকে তাঁর পিতৃপরিচয় জেনেও দ্বিধা- দ্বন্দ্বে ভুগতো। বিশ্বাস করতে চাইতো না। ভাবতো, এতো বিখ্যাত লোকের মেয়ে এরকম অসহায়ভাবে কোথাও যাত্রা করে নাকি। হজরত উম্মে সালমা ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। তাই তিনি তাদের সন্দেহ দূর করার কোনো চেষ্টা করলেন না। মদীনায় দিন গুজরান হতে লাগলো এভাবেই। এর মধ্যে এসে পড়লো হজ্বের মওসুম। কোবা থেকে কেউ কেউ হজ্বে গেলো। তাদেরকে তিনি মক্কায় পিতার সাক্ষাতে যেতে বলে দিলেন। তারা ফিরে এসে সবাইকে জানালো, তিনি ঠিকই বলেছেন। প্রকৃতই তিনি মহানুভব আবু উমাইয়ার কন্যা।
হিজরত ফরজ করা হয়েছে। সুতরাং সাহাবীগণ যে যেভাবে পারলেন, একে একে অথবা ছোট ছোট দলে দলবদ্ধ হয়ে মদীনায় এসে উপস্থিত হলেন। হজরত আবু বকর সিদ্দীককে সঙ্গে নিয়ে এক সময় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও মদীনায় আগমন করলেন।
আল্লাহপ্রেমের বিপুল উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নির্মিত হলো মদীনা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে নিয়ে নির্বিঘেড়ব ও নিশ্চিন্তে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঠ করতে লাগলেন। ইবাদতই শান্তি। শান্তির মুক্ত আকাশে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো বিশ্বাসী জনতা।
মক্কার মুশরিকেরা নতুন পরিকল্পনা করলো। ঠিক করলো, যুদ্ধের মাধ্যমে উৎখাত করে দিতে হবে নতুন এই ধর্মমতকে। নয় তো পিতৃপুরুষদের ধর্ম রক্ষা করা যাবে না। তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো। আল্লাহ পাক বিশ্বাসী জনতাকেও জেহাদের অনুমতি দিলেন। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম জেহাদ সম্পন্ন হলো দ্বিতীয় হিজরীর রমজান মাসে। বদরপ্রান্তরে। মুশরিকদের প্রধান নেতারা নিহত হলো। বন্দী হলো অনেকে। মুসলিমবাহিনী পেলো বিপুল বিজয়। কিন্তু কাফের কুরায়েশেরা পরাজয় মেনে নিলো না কিছুতেই। প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে উপস্থিত হলো পরের বছর শাওয়াল মাসে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জেহাদের নির্দেশ দিলেন। সাহাবীগণের ঘরে ঘরে সাজ সাজরব। সকলে পরামর্শক্রমে ঠিক করলেন, উহুদ প্রান্তরে উপস্থিত হয়ে মুশরিকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে।
হজরত আবু সালমাও যুদ্ধের পোশাক পরলেন। কটিদেশে বাঁধলেন কোষাবদ্ধ তরবারী। বিদায়ক্ষণে দু’জনে দুজনের দিকে তাকালেন। বোধ করি মনে পড়ে গেলো একদিনের একটি ঘটনার কথা— উম্মে সালমা বললেন, আমি শুনেছি, স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যদি জান্নাতের উপযুক্ত হয়, এমতাবস্থায় একজন মরে গেলে অপর জন যদি পুনঃবিবাহ না করে, তবে জান্নাতে উভয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাসবাস করতে পারবে। এসো, আমরা দুজনে অঙ্গীকারাবদ্ধ হই, তুমি মারা গেলে আমি কাউকে বিয়ে করবো না, আর আমি মারা গেলে তুমিও কোথাও বিবাহবদ্ধ হবে না। আবু সালমা বললেন, একটা কথা বলি— মানবে? উম্মে সালমা বললেন, অবশ্যই। আবু সালমা বললেন, মনে হয় আমি আগে চলে যাবো। তারপর তুমি কিন্তু অবশ্যই বিবাহবদ্ধা হয়ো। আমি দোয়া করি আল্লাহ পাক তোমাকে যেনো
আমা অপেক্ষা উত্তম জীবনসঙ্গী দান করেন। উহুদযুদ্ধে মুসলিমবাহিনী পর্যুদস্ত হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং রক্তরঞ্জিত হলেন।
শহীদশ্রেষ্ঠ হজরত হামযাসহ শহীদ হলেন সত্তরজন নেতৃস্থানীয় সাহাবী। আবু সালমা শহীদ হলেন না। কিন্তু গভীরভাবে আহত হলেন। শত্র“বাহিনী থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়লো তাঁরই নামের এক মুশরিক— আবু সালামা হামবী। তীরটি বিদ্ধ হলো তাঁর বাহুমূলে। যুদ্ধ শেষে প্রায় এক মাস চিকিৎসার পর তিনি মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলেন।
কিছুদিন পর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে কাতান অভিযানে পাঠালেন। সেখানে ২৯ দিন অবস্থানের পর যখন মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন, তখন পুরনো ক্ষতস্থানটি আবার তাজা হয়ে উঠলো। নিরাময়ের দেখা আর পাওয়া গেলো না। চতুর্থ হিজরীর সফর মাসে তিনি মদীনায় আসেন, আর লোকান্তরিত হন জমাদিউস সানি মাসের নয় তারিখে।
মদীনাবাসীদের সুখ-দুঃখের সাথী ও একমাত্র অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহর রসুল। শোকসংবাদ তাঁকেই জানাতে হবে আগে। উম্মে সালমা অঝোর ধারায় অশ্রুবর্ষণ করতে করতে তাঁর পবিত্র সান্নিধ্যে উপস্থিত হলেন। অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে জানালেন স্বামীর চিরবিদায়ের খবর। তারপর ফিরে গেলেন স্বগৃহে।
একটু পরে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং উপস্থিত হলেন সেখানে। বিষাদভরা পরিবেশে দাঁড়িয়ে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুনতে পেলেন, শোকাকুল উম্মে সালমা মাঝে মাঝে বিলাপধ্বনি উচ্চারণ করছেন, হায়! একি হলো! বিদেশ-বিভূঁয়ে এ তার কেমনতর চলে যাওয়া। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে ধৈর্য্য ধারণের উপদেশ দিলেন। বললেন, তুমি তার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে থাকো। পাঠ করতে থাকো ‘আলাহুম্মা আখলিফনি খয়রাম্ মিনহা’ (হে আল্লাহ! আমাকে এর চেয়ে উত্তম কিছু দান করো)।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত আবু সালমার কাছে গেলেন। দেখলেন, তাঁর চোখ দুটো খোলা। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজ হাতে তাঁর চোখ বন্ধ করে দিলেন। মাগফিরাত কামনা করলেন। জানাযা প্রস্তুত করা হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে ইমাম হয়ে জানাযার নামাজ পড়ালেন। চার বার তকবীর (আলাহু আকবার ধ্বনি) দিতে হয়। কিন্তু তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তকবীর দিলেন নয় বার। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল! ভুল হলো না তো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ লোক হাজার তকবীরের যোগ্য।
শুরু হলো শোকপর্ব। হজরত উম্মে সালমা শোক পালন করে চললেন। দুঃখ-বেদনা ও বিলাপ নিয়ে একে একে অতিক্রান্ত হতে লাগলো তাঁর জীবনের তিক্ততম দিবস-রজনীগুলো। সঙ্গে তিনটি এতিম সন্তান— সালমা, ওমর ও দুররা। আর একটি রয়েছে গর্ভে।
জীবন এরকমই। কোনোকিছুই থেমে থাকে না— না দুঃখ, না সুখ। আবার আল্লাহ তায়ালার প্রত্যাদেশে জীবনের বৈশিষ্ট্য ঘোষিত হয়েছে এভাবে— ‘নিশ্চয়ই দুঃখের পরে সুখ, নিশ্চয়ই সুখ দুঃখের পরবর্তীতে।’
হজরত উম্মে সালমার শোকপালন পর্ব (ইদ্দত) শেষ হয়। কোলে আসে নতুন অতিথি। নাম রাখেন তার বারবাহ্। ধর্মের বিধান অনুসারে নতুন বিবাহের প্রস্তাব আসতে আর কোনো বাধা নেই। প্রথম প্রস্তাব এলো হজরত আবু বকর সিদ্দীকের পক্ষ থেকে। তাঁর অসহায়ত্ব ও অভিভাবকত্বহীনতা বিবেচনা করেই মূলতঃ তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি সুন্দরীও ছিলেন খুব। আবার ছিলেন শানিত ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। পুণ্যবতী তো ছিলেনই। তিনি হজরত আবু বকরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন।
হজরত উম্মে সালমা নিজে বলেছেন, আমি তখন ভাবতাম, আবু সালমার চেয়ে উত্তম আর কে হতে পারে। ভাবতাম আর রসুলুল্লাহর শিখিয়ে দেওয়া দোয়াটি পাঠ করতাম। তাঁর নির্দেশানুসারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখতাম ধৈর্যের উপরে। এক সময় স্বয়ং রসুলুল্লাহ বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। বলাবাহুল্য মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন আল্লাহ র নির্দেশে। জ্ঞানে, গুণে, ধর্মনিষ্ঠায় অতুলনীয় রমণীগণকে রসুলগৃহে সমবেত করাই ছিলো আল্লাহপাকের অভিপ্রায়। সুতরাং রসুলপ্রেমিকগণ একথা ভাবতে বাধ্য যে, এর মধ্যে রয়েছে সমাজ-সংসার কাল-মহাকালের প্রভূত কল্যাণ এবং পবিত্র প্রেমভালোবাসার অনুকরণীয় আদর্শ। শুভপ্রস্তাব পাওয়ার সাথে সাথে হজরত উম্মে সালমা উচ্চারণ করলেন— ‘মারহাবাম বি রসুলিল্লাহ (আল্লাহর রসুলকে স্বাগতম)। কিন্তু উত্থাপন করলেন কয়েকটি মৃদু আপত্তি—
১. আমার আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর।
২. আমার বয়স বেশী।
৩. আমার সন্তান-সন্তুতি বেশী।
৪. আমার কোনো ওলী (অভিভাবক) নেই।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সকল আপত্তি মেনে নিলেন। বললেন, আমি দোয়া করবো, আল্লাহ যেনো তোমার মর্যাদাবোধের প্রখরতাকে কোমল করে দেন। আমার বয়স তো তোমার চেয়ে বেশী। আবু সালমার সন্তান-সন্তুতি তো আমারই সন্তানসন্তু তি। আর যার ওলী নেই, তার ওলী হতে পারে যে কোনো ব্যক্তি।
যথাসময়ে শুভবিবাহ সম্পন্ন হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর নবপরিণীতা বধূকে ওঠালেন পরলোকগতা উম্মতজননী হজরত যয়নাব বিনতে খুজাইমার ঘরে। নববধূ দেখলেন, ঘরে রয়েছে একজোড়া যাঁতা, দু’টি পানির মশক, চামড়ার শয্যা- আবরণী এবং খেজুরের ছালভরা একটি বালিশ। উল্লেখ্য, অন্য মুমিনজননীগণের ঘরের আসবাবপত্র ছিলো এরকমই।
বাসর ঘরে ঢুকেই নিজ হাতে রাতের খাবার তৈরী করলেন তিনি। একটি পাত্র থেকে কিছু যব বের করলেন। অন্য একটি পাত্র থেকে বের করলেন কিছু তেল। যবগুলো যাঁতায় পিষলেন। তারপর সেগুলোর আটায় তেল মিশিয়ে একরকম আহার্য প্রস্তুত করলেন। ওই আহার্যই হলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর বাসর রজনীর আহার্য।
তাঁর সপত্নীগণের মধ্যে দেখা দিলো বিরূপ কৌতূহল। তাঁরা জানতেন, উম্মে সালমা অসামান্য রূপবতী। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর প্রতি অতি আসক্ত হয়ে পড়েন কিনা— এটাই ছিলো তাঁদের ভাবনার বিষয়। হজরত আয়েশা সিদ্দীকা তাঁকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। তাঁর মনে হলো, লোকে যেরকম বলে, তার চেয়েও উম্মে সালমা বেশী সুন্দরী। তিনি হজরত হাফসাকে কথাটা বললেন। হজরত হাফসার মনে হলো, হজরত আয়েশা বুঝি বাড়িয়ে বলেছেন। তিনিও অনেকক্ষণ ধরে হজরত উম্মে সালমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। তাঁর মনে হলো, হজরত আয়েশার মন্তব্যটি অযথার্থ নয়। ব্যস, এই পর্যন্তই। ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হয়ে গেলো। ঈর্ষার অসুন্দর দিকটির সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কই যে নেই। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র সহধর্মিণী তাঁরা। তাঁদের হৃদয়ের সম্পূর্ণ পরিসর যে নবীপ্রেমে ও আল্লাহপ্রেমে সতত সমুজ্জ্বল। ঈর্ষার সৌন্দর্যের দিকটি সেখানে কখনো কখনো ভিন্ন রঙের আলো ফেলে মাত্র। তারপর হারিয়ে যায়, অথবা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় মহাবিশ্বের মহামমতার অপার পারাবারে।
হজরত উম্মে সালমা শুধু রূপসী নন, লজ্জাবতীও। এই নিয়ে প্রথম প্রথম কিছু সমস্যাও হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর ঘরে এলে তিনি তাড়াতাড়ি কোলের শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। লজ্জায় অধোবদনা হয়ে থাকেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও লজ্জিত হন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যান। কথাটা হজরত উম্মে সালমার দুধভাই হজরত আসমা ইবনে ইয়াসিরের কানে গেলো। তিনি অতুষ্ট হলেন। কোলের শিশুটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এরপর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলো। অন্যান্য মুমিনজননীগণের মতো তিনিও চিরতরে হারিয়ে গেলেন আল্লাহর হাবীবের অনন্ত প্রেমসমুদ্রে।
নবীর সংসার। এখানে আছে কেবল জ্ঞান, প্রেম ও বিশ্বাস। সত্যান্বেষী মানুষের জন্য পথ। পথনির্দেশ। পৃথিবী ও পৃথিবীর সকল বিত্ত-বৈভব এখানে সারাক্ষণ নতজানু হয়ে নবী ও নবী পরিবারের সেবার সুযোগ অন্বেষণ করে। কিন্তু সুযোগ পায় না। আল্লাহপাক বলেন, হে আমার প্রিয়তম নবী! তুমি যদি চাও, তবে উহুদ পাহাড়কে স্বর্ণপাহাড় বানিয়ে দেই, সে তোমার নির্দেশানুগত হয়ে তোমার সাথে সাথে থাকবে। আল্লাহর নবী বলেন, বান্দা আমি। বিশুদ্ধ বন্দেগীতেই আমি নিমগ্ন থাকতে চাই সারাক্ষণ। তুমি আমাকে একদিন আহার দিয়ো। আমি তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। আর একদিন অনাহারে রেখো, সবর করবো।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহপাকের বিশুদ্ধ বান্দা ও রসুল। কীভাবে আল্লাহর অভিপ্রায়ে পূর্ণসমর্পিত হয়ে বিশুদ্ধচিত্ত বান্দা হতে হয়, সেই শিক্ষা তিনি দান করেন সকল জগতবাসীকে— কিতাব আবৃত্তি করেন, হিকমত শিক্ষা দেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন। সাহাবীগণ ও মুমিনজননীগণ সেই শাশ্বত শিক্ষারই ধারক, বাহক ও প্রচারক।
হজরত উম্মে সালমাও জ্ঞানান্বেষিণী। বিদ্যাবিনোদিনী। দেখা যায়, বিদ্যাবত্তার দিক থেকে তিনি অন্য উম্মতজননীদেরকে অতিক্রম করে চলেছেন। এভাবে সবাইকে অতিক্রম করে চলে এসেছেন শ্রেষ্ঠ বিদ্যাবতী হজরত আয়েশার প্রায় সমান্তরালে। তাঁকে নেত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন উম্মতজননীগণের একটি দল। অন্য দলটি অবশ্যই নবীপ্রিয়তমা আয়েশার।
হজরত আয়েশার ঘরে যখন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রাত্রিযাপন করেন, তখন মানুষ অনেক হাদিয়া তোহফা পাঠাতে থাকেন। নেত্রী হজরত উম্মে সালমাকে একদিন তাঁর দলের সপত্নীগণ বললেন, আমরাও আয়েশার মতো হাদিয়া তোহফা পেতে পারি— কথাটা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে উপস্থাপন করতে হবে। হজরত উম্মে সালমার কাছেও কথাটা যুক্তিপূর্ণ মনে হলো। তিনি একদিন সুযোগ বুঝে কথাটা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে পর পর দু’বার বললেন। তৃতীয়বার বলার পর উত্তর পেলেন এরকম— আয়েশার ব্যাপারে তোমরা আমাকে কষ্ট দিয়ো না। সে-ই আমার এমন স্ত্রী, যার কম্বলের নিচে থাকা অবস্থায় আমার উপরে ওহী অবতীর্ণ হয়। হজরত উম্মে সালমা একথা শোনার সাথে সাথে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনাকে কষ্টদানের জন্য আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।
অন্য উম্মতজননীগণের মতো তাঁর ঘরও ছিলো মসজিদসংলগ্ন। অন্যান্যদের মতো তিনিও মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ভাষণ খুব মনোযোগ সহকারে শুনতেন। হজরত আয়েশার মতো সেগুলো স্মৃতিস্থও রাখতে পারতেন স্থায়ীভাবে। আবার প্রতিটি হাদিসের যথাযথ ব্যাখ্যাবিশ্লেষণও দিতে পারতেন হজরত আয়েশার মতো। সব কাজ বাদ দিয়ে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বচনামৃত শোনার জন্যই তাঁর আগ্রহ ছিলো অধিক। যেমন একদিন দাসীকে দিয়ে মাথার চুলে বেনী বাঁধাচ্ছিলেন। শুনতে পেলেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মসজিদের মিম্বরে উঠে ভাষণ দিতে শুরু করেছেন। যেমনি বললেন ‘ওহে জনমণ্ডলী’ অমনি তিনি দাসীকে বললেন, তাড়াতাড়ি করো। দাসী বললো, কেবল তো বললেন ‘ওহে জনমণ্ডলী’! হজরত উম্মে সালমা বললেন, আমরা কি জনমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত নই? একথা বলেই তিনি নিজের চুল নিজেই অতি দ্রুত বেঁধে নিয়ে ভাষণ শোনায় মনোনিবেশ করলেন।
চার সন্তানের জননী হয়েও হজরত উম্মে সালমা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সেবাযত্নের প্রতি সর্বক্ষণ রাখেন মমতাময় মনোযোগ। তাঁকে ভালোবাসেন নিজের জীবনের চেয়েও বেশী। সাফিনা নামের এক ক্রীতদাসকে তিনি মুক্ত করে দেন এই শর্তে যে, সে সারাজীবন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সেবা-যত্ন করে যাবে।
 
ভালোবাসার স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একটি পশম রেখে দিয়েছিলেন। সাহাবীদের মধ্যে কেউ দুঃখ-কষ্টে পড়লে তিনি পবিত্র পশমখানি এক পেয়ালা পানিতে ডুবিয়ে দিতেন। আর ওই পানি তাঁদেরকে পান করতে দিতেন। এভাবে অনেকের দুঃখ-কষ্ট দূর হয়ে যেতো। একজন বর্ণনাকারী বলেছেন, একবার আমি মাতা মহোদয়া উম্মে সালমার সান্নিধ্যে উপস্থিত হলাম। তিনি হিন্না ও কাতানে রক্ষিত মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একটি পশম বের করে দেখালেন। তিনি নিজ হাতে সংসারের সকল কাজ করতেন। নিজের ছোট দুই মেয়েকেও লালন পালন করতেন অনেক মায়া-মমতা দিয়ে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও তাঁদেরকে অনেক আদর-যত্ন করতেন। একদিন তিনি বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমি কি আবু সালমার সন্তান-সন্তুতিদেরকে লালন পালন করার কারণে পুণ্যাধিকারিণী হবো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, অবশ্যই।
বড় ছেলের নাম সালমা। জন্মগ্রহণ করেন আবিসিনিয়ায়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে তাঁর চাচা শহীদশ্রেষ্ঠ হজরত হামযার কন্যা উসামার সাথে বিবাহ দেন। দ্বিতীয় ছেলে ওমর। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহাতিরোধানের সময় তাঁর বয়স হয়েছিলো নয় বছর। তাঁর ডাক নাম ছিলো আবু হাফস। তিনি কিছুসংখ্যক হাদিসের বর্ণনাকারী। হজরত আলী (রাঃ) এর খেলাফতকালে তাঁকে ফারেম ও বাহরাইনের শাসক নিযুক্ত করা হয়। মা তাঁকে উটের যুদ্ধের সময় হজরত আলীর সঙ্গে প্রেরণ করেন। বলেন, প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে আপনার সঙ্গে পাঠালাম। সে সব সময় আপনার সঙ্গে থাকবে। তারপর আল্লাহর ইচ্ছা যা হবে, তাই হবে। রসুলুল্লাহর নিষেধাজ্ঞা না থাকলে আমিও বের হতাম, যেমন বের হয়েছে আয়েশা— তালহা ও যুবায়েরকে সাথে নিয়ে।
তৃতীয় সন্তানের নাম দুররা। এক বর্ণনায় আছে, একবার কে যেনো রটিয়ে দিলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দুররাকে বিয়ে করতে চান। জননী উম্মে হাবীবা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর হাবীব! শুনলাম, আপনি দুররাকে বিয়ে করতে চান। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জবাব দিলেন, তা কী করে হয়। আমি তাকে লালন পালন না করলেও সে আমার জন্য কোনোভাবেই হালাল নয়। সে তো আমার দুধ ভাইয়ের মেয়ে।
তাঁর শেষ কন্যা সন্তানের নাম বাররা । মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে নতুন নাম দেন যয়নাব। উল্লেখ্য, জননী উম্মে সালমার এই চার সন্তানই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং লাভ করেন সাহাবী হওয়ার মর্যাদা।
অনাবিল সুখ ও আনন্দে ভরপুর ছিলো হজরত উম্মে সালমার দাম্পত্যজীবন। অভাব অনটন ছিলো। কিন্তু নবীপ্রেমের প্রখর জ্যোতির্ময়তার কারণে ওগুলোর প্রভাব অনুভূত হতো না। কষ্ট পেতেন কেবল তখন, যখন অতিথি আপ্যায়নে সমর্থ হতেন না। যেমন একবারের ঘটনা— এক সফর থেকে ফিরে অভুক্ত ও পরিশ্রান্ত সাহাবী হজরত আল ইরবাদ, জু’আল ইবনে সুরাকা ও আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহান সাহচর্যে উপস্থিত হলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত উম্মে সালমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এদেরকে খেতে দেওয়ার মতো কিছু আছে কি? তিনি বিমর্ষ বদনে জবাব দিলেন, হে আল্লাহর রসুল! কিছুইতো নেই।
বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর প্রখর আত্মমর্যাদাবোধেরও প্রকাশ ঘটতে থাকে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অতুষ্টি প্রকাশ করেন না। বরং উপভোগ করেন। যেমন— উন্নত খোরপোশের দাবিতে যখন উম্মতজননীগণ একজোট, তখন হজরত আবু বকর সিদ্দীক এবং হজরত ওমর ফারূক তাঁদের কন্যাদ্বয়কে শাসন করেন খুব। হজরত ওমরের মা ছিলেন হজরত উম্মে সালমার চাচাতো বোন। হয়তো সেই অধিকারে তখন তিনি জননী উম্মে সালমাকেও কিছু বলতে আসেন। হজরত উম্মে সালমা তখন যথেষ্ট উষ্মার সাথে বলেন, হে খাত্তাবের পুত্র! কী আশ্চর্য! আপনি সব ব্যাপারে না গলান। এখন দেখছি রসুলুল্লাহর স্ত্রীদের ব্যাপারেও নাক গলাতে শুরু করেছেন।
হজরত ওমর নির্বাক হয়ে গেলেন। এদিকে রাতের মধ্যে রটনা হয়ে গেলো, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সকল সহধর্মিণীকে পরিত্যাগ করেছেন। অবস্থান গ্রহণ করেছেন পৃথক একটি প্রকোষ্ঠে। কারো সাথে দেখাও করছেন না। হজরত ওমর অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর প্রবেশাধিকার পেলেন। হজরত উম্মে সালমা তাঁকে কীভাবে শাসিয়েছেন, সে কথা বললেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর অভিযোগ শুনে হেসে ফেললেন।
খন্দক যুদ্ধ শুরু হলো। বিশাল মুশরিকবাহিনী এসে ঘিরে ফেললো মদীনা। অবরুদ্ধ মুসলিমবাহিনী গ্রহণ করলো আত্মরক্ষামূলক অবস্থান। অবরোধ হলো দীর্ঘ। দীর্ঘতর। ওই সময় হজরত উম্মে সালমা ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অতি নিকটে। তিনি নিজে বলেছেন, ওই সময়ের কথা আমার এখনও মনে আছে।
রসুলুল্লাহর পবিত্র বক্ষে ধূলোবালি লেগে আছে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর সাহাবীদের মাথায় পাথর উঠিয়ে দিচ্ছিলেন আর কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। অকস্মাৎ আম্মার ইবনে ইয়াসারের প্রতি তাঁর দৃষ্টি পতিত হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে সুমাইয়ার পুত্র! একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী তোমাকে হত্যা করবে।
খন্দক যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উপরে বনী কুরায়জার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ এলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বাসঘাতক বনী কুরায়জার বসতি অবরোধ করলেন। তারা অবস্থান নিলো দুর্গের অভ্যন্তরে। ইহুদীদের মধ্যে যে বারোজন ইসলাম গ্রহণ করেছেন, হজরত আবু লুবাবা ছিলেন তাঁদের অন্যতম। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকেই আলাপ-আলোচনা করার জন্য অবরুদ্ধ ইহুদীদের দুর্গের ভিতরে পাঠালেন। ইহুদীরা তাদের গোত্রের লোককে পেয়ে উৎফুল্ল হলো। আপনজন মনে করে তাঁর কাছে পরামর্শ কামনা করে বললো, আমরা এখন কী করবো? মোহাম্মদের আদেশে বের হয়ে আসবো? হজরত আবু লুবাবা নিজের গলায় তলোয়ার চালানোর মতো করে হাত চালালেন। এভাবে মুখে না বলে ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, তাদের কণ্ঠচ্ছেদ করা হবে। পরক্ষণেই সম্বিত ফিরে পেলেন তিনি। আপন মনে বললেন, কী করলাম! আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলাম। অনুতাপের আগুন প্রজ্জ্বলিত হলো তাঁর মনে। চরম অপরাধবোধের কারণে লজ্জায় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সকাশে উপস্থিত হতে পারলেন না। কাঁদতে কাঁদতে সোজা মসজিদে নববীতে চলে গেলেন। প্রাঙ্গণের একটি খুঁটির সঙ্গে লোহার শিকল দিয়ে নিজেকে শক্ত করে বেঁধে ফেললেন। পণ করলেন, আল্লাহপাক তাঁর তওবা কবুল করার সংবাদ না জানানো পর্যন্ত তিনি মুক্ত হবেন না। জীবন যদি চলে যায়, তবুও।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একথা শুনতে পেয়ে বললেন, আমার কাছে এলেইতো হতো। তওবা সহজ হতো। এখন আমাকে তো আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
অনুতাপে, অনাহারে, অবর্ণনীয় অন্তর্জ্বালায় কেটে গেলো ছয় সাত রাত। শেষ রাতে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আপন মনে হাসলেন। ছিলেন হজরত উম্মে সালমার ঘরে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আল্লাহ আপনাকে সদা হাস্যোজ্জ্বল রাখুন। অনুগ্রহ করে বলুন, এখন হাসছেন কেনো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আবু লুবাবার তওবা কবুল হয়েছে। জননী বললেন, আমি এই শুভসংবাদটি কি তাকে শোনাতে পারবো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, পারবে। জননী তৎক্ষণাৎ তাঁর কক্ষদ্বারে দাঁড়ালেন। অদূরে আত্মবন্দী আবু লুবাবাকে লক্ষ্য করে উচ্চকন্ঠে বললেন, আবু লুবাবা! তোমাকে অভিনন্দন! তোমার তওবা কবুল হয়েছে। ঘটনাটি পঞ্চম হিজরী সনের।
ওই বছরেই অবতীর্ণ হয় পর্দা সংক্রান্ত আয়াত। উম্মতজননীগণও হলেন পর্দার বিধানের অন্তর্ভুক্ত। হজরত উম্মে মাকতুম ছিলেন সম্মানিত মুয়াজ্জিন। দৃষ্টিশক্তি ছিলো না তাঁর। তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অন্দরে যাতায়াত করতেন। সেদিন তিনি যখন রসুলগৃহে প্রবেশ করলেন, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন হজরত উম্মে সালমা ও হজরত উম্মে হাবীবা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, পর্দা করো। তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর হাবীব! তিনি তো দৃষ্টিশক্তিহীন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমরা তো দৃষ্টিশক্তিবিবর্জিত নও।
জীবন নদীতে জাগে কখনো জোয়ার। কখনো ভাটা। চলে আলো ও আঁধারের আবর্তন-বিবর্তন— দিবস-যামিনীর। নিয়মিত। নিরবধি। এভাবে প্রতিনিয়ত ভবিষ্যত হয়ে যায় অতীত। দেখা পাওয়া যায় না বর্তমানের। বর্তমান অর্থ চির-বর্তমান। কিন্তু তা তো এখানে নয়। ওখানে। পরবর্তী পৃথিবীতে। ওই চিরবর্তমান, চিরস্থায়ী জীবনের কল্যাণসাধনায় নিমজ্জিত থাকতে হয় বিশ্বাসবানদেরকে, বিশ্বাসবতীদেরকে।
হজরত উম্মে সালমার মনে প্রশ্ন জাগে, কোরআনুল করীমে তো দেখি পুরুষদের কথা আছে। নারীদের উল্লেখ নেই। কেনো? মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আছে। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মসজিদে প্রবেশ করলেন। মিম্বরে উঠে আবৃত্তি করলেন— ‘নিশ্চয় আত্মসমর্পণকারী পুরুষ ও আত্মসমর্পণকারী নারী, মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, সওম পালনকারী পুরুষ ও সওম পালনকারী নারী, যৌন অঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ ও যৌন অঙ্গ হেফাযতকারী নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারী— এদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-৩৫)
হজরত উম্মে সালমার সমগ্র জীবন কেটেছে সাধনায়, অনটনে এবং ভোগলিপ্সাবিমুক্ত অবস্থায়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে ভালোবাসতেন প্রধানতঃ একারণেই। তাঁর পুতঃপবিত্র স্বভাবের সঙ্গে ত্যাগ-তিতীক্ষার অলংকারত্ব ছিলো অধিক মানানসই। একদিন তিনি একটি সোনার হার গলায় পরে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সম্মুখে দাঁড়ালেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেদিকে তাকালেন। কিছু না বলে চুপ করে থাকলেন। হজরত উম্মে সালমা বুঝতে পারলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তেমন প্রসন্ন নন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি হারটি খুলে ফেললেন।
ইবাদত উপাসনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্য সকল মুমিনজননীদের মতো ধর্মনিষ্ঠ। প্রতি মাসে রোজা রাখতেন তিনি— সোমবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারে। ছিলেন দানশীলা। অন্যকেও উৎসাহিত করতেন দানশীলতার প্রতি। একবার কয়েকজন যাচ্ঞাকারী তাঁর কক্ষদ্বারে উপস্থিত হলো। তাঁর কাছে উপবিষ্ট উম্মুল হুসাইন তাদেরকে ধমক দিলেন। জননী উম্মে সালমা বললেন, আমরা তো এরকম করতে পারি না। দাসীকে বললেন, এদেরকে কিছু দিয়ে বিদায় করো। অন্ততঃ একটি করে খেজুর তাদের হাতে দাও।
হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে এমন একটি শুভপরামর্শ দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে তাঁর অনন্যসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয়। হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কা অভিমুখে যাত্রা করলেন। জননী উম্মে সালমাসহ অধিকাংশ সাহাবী ইহরাম বাঁধলেন জুহফায় গিয়ে। পুনরায় যাত্রা শুরু হলো। হুদাইবিয়া প্রান্তরে পৌঁছে থামতে হলো। মক্কার কাফেরেরা বললো, এ বছর হজ্ব করা যাবে না। ফিরে যেতে হবে। আরো কিছু শর্ত আরোপ করলো তারা, যেগুলো ছিলো আপাতদৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য অপমানজনক। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তবুও কেবল রক্তপাত পরিহারের নিমিত্তে তাদের সন্ধিপ্রস্তাবকে স্বাগত জানালেন। লিপিবদ্ধ হলো সন্ধিচুক্তি। উভয় পক্ষের স্বাক্ষর সম্পন্ন হলে সাহাবীগণ খুবই মনোক্ষুণড়ব হলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘোষণা দিলেন, গাত্রোত্থান করো। কোরবানী করো। মস্তক মুণ্ডন করো। সাহাবীগণ মনমরা হয়ে বসে ছিলেন। নির্দেশ পালনের কোনো আগ্রহ দেখা গেলো না তাঁদের মধ্যে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দুঃখিত হলেন। তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করে কথাটা জানালেন হজরত উম্মে সালমাকে। বললেন, মুসলমানেরা কি ধ্বংস হতে চায়? কোরবানী করতে বললাম। মস্তক মুণ্ডনের নির্দেশ দিলাম। কিন্তু তাতে কেউ এগিয়ে এলো না। জননী বললেন, হে আল্লাহর রসুল! তাঁদের আচরণে ব্যথিত হবেন না। ওমরা করতে না পেরে তারা মর্মাহত। আপনি দুঃখ পেয়েছেন বলেই তারা দুঃখ পাচ্ছে। উদ্যমহীন হয়ে পড়েছে। আপনি বরং বাইরে যান। নিজেই কোরবানী শুরু করে দিন। কাউকে দিয়ে মস্তক মুণ্ডন করুন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাই করলেন। সাহাবীগণ আর স্থির থাকতে পারলেন না। সকলেই ব্যস্ত সমস্ত হয়ে কোরবানী করলেন। একে অপরের সাহায্যে মুণ্ডিতমস্তক হলেন।
হুদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তি বাহ্যতঃ অপমানকর মনে হলেও ওই চুক্তিটিই ছিলো মক্কা বিজয়ের কারণ। আল্লাহপাক একথা জানিয়েও দিলেন এভাবে— ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয়।’ তা-ই হলো। পরের বছরই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বিজয় অভিযান পরিচালনা করলেন মক্কা অভিমুখে। মাররুজ জাহরান নামক স্থানে পৌঁছে থামলেন। তখনও তাঁর সফরসঙ্গিনী ছিলেন মুমিনজননী উম্মে সালমা। মক্কার কাফেরেরা ভীতসন্ত্রস্ত হলো। নিরাপত্তা প্রার্থনার আশা নিয়ে রাতের অন্ধকারে উপস্থিত হলো আবু সুফিয়ান ও আবদুল্লাহ ইবনে আবু উমাইয়া। হজরত উম্মে সালমা তখনও মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে শান্ত করার শুভউদ্দেশ্য নিয়ে পরামর্শ দিতে শুরু করলেন এভাবে— হে আল্লাহর রসুল! এরা দুজন তো আপনার নিকটজন।
একজন আপনার পিতৃব্যপুত্র, আরেকজন আপনার ফুফুর ছেলে, আবার আপনার শ্যালকও। প্রকৃত ব্যাপার ছিলো তাই। আবু সুফিয়ান ছিলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বড় চাচা হারিসের ছেলে। আর আবদুল্লাহ ছিলো তাঁর ফুফু আতিকার ছেলে— হজরত উম্মে সালমার আপন ভাই।
তায়েফ অভিযানের সময়েও মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সঙ্গে ছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন বিদায় হজ্বের সময়েও। তখন তাঁর শরীর সুস্থ না থাকলেও হজ্বের মতো একটি ফরজ আমল তিনি পরিত্যাগ করতে রাজী হননি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাওয়াফের সময় তাঁকে বলেন, উম্মে সালমা! যখন ফজরের নামাজের সময় এগিয়ে আসবে তখন উটের পিঠে উঠে তাওয়াফ সেরে নিয়ো। তিনি তাই করেছিলেন।
একদিন তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পাশে বসেছিলেন। তখন সাহাবী দাহিয়া আল কলবীর আকৃতিতে আবির্ভূত হলেন জিব্রাইল আমিন। কথাটা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ই তাঁকে জানালেন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একদিন তাঁর ঘরে থাকা অবস্থায় ‘আয়াতে তাত্হীর’ (পবিত্রতার আয়াত) অবতীর্ণ হলো। বলা হলো ‘হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’ (সুরা আহ্যাব, আয়াত ৩৩)।
জননী উম্মে সালমা বলেছেন, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ডাক দিলেন আলী-ফাতেমা-হাসান-হোসেনকে। তাঁদেরকে কম্বলে ঢেকে নিয়ে বললেন, হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়েত (পরিবার-পরিজন)। একথা শুনে আমি নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর নবী! আমি কি আহলে বায়েতের অন্তর্ভুক্ত নই? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কেনো নও, ইনশাআল্লাহ।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কেবল তাঁকেই ইমাম হোসেনের শাহাদতের বিষয়ে ভবিষদ্বাণী শুনিয়েছিলেন।
 মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মহাযাত্রার সময় সন্নিকটবর্তী হলো। তাঁর সকল পবিত্র সহধর্মিণীর অনুমতিক্রমে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অবস্থান গ্রহণ করলেন হজরত আয়েশা সিদ্দীকার ঘরে। সেখানেই সকলে উপস্থিত হতেন। পালাক্রমে সেবাযত্ন করতেন।
একদিন হজরত উম্মে সালমা ও হজরত উম্মে হাবীবা তাঁর পাশে বসে আবিসিনিয়ার আলাপ শুরু করলেন। দুজনেই ছিলেন আবিসিনিয়ার হিজরতকারিণী। তাঁরা বললেন, সেখানকার খ্রিস্টানেরা তাদের উপাসনালয়ে মানুষের মূর্তি রাখে। তাদের কোনো সাধুপুরুষ মারা গেলে তারা তার কবরকে উপাসনার স্থান বানিয়ে নেয়। তার মূর্তি স্থাপন করে উপাসনালয়ের ভিতরে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, মহাবিচার দিবসে তারা উত্থিত হবে নিকৃষ্টতম অবস্থায়।
অবস্থা ক্রমশঃই অবনতির দিকে যেতে লাগলো। পবিত্র স্ত্রীগণ তাঁকে দুধ পান করাতে চাইলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্মত হলেন না, কিন্তু যখন একটু অচেতন হয়ে পড়লেন, তখন হজরত উম্মে সালমা ও হজরত উম্মে হাবীবা তাঁর মুখে সামান্য পানি ঢেলে দিলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অচেতন অবস্থাতেই সেটুকু পান করলেন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কষ্ট দেখে তাঁর সহধর্মিণীগণ অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে লাগলেন। একদিন তো এমন হলো যে, হজরত উম্মে সালমা সহ্য করতে পারলেন না। চিৎকার করে উঠলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে চুপ করতে বললেন। আরো বললেন, এটা মুসলমানদের আদর্শ নয়। একদিন তাঁর প্রাণাধিকা পুত্রী হজরত ফাতেমাকে একান্তে ডেকে নিলেন। হজরত ফাতেমা পিতাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, মা! কেঁদো না। আমি চলে গেলে শুধু “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন” বলো। এতে সকলের জন্য রয়েছে শান্তি। হজরত ফাতেমা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার জন্যও? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। তারপর তাঁকে আরো কাছে নিয়ে কানে কানে কিছু বললেন। হজরত ফাতেমা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পরক্ষণে আরো কিছু বললেন। হজরত ফাতেমা হেসে ফেললেন।
অদূরে দঁড়িয়েছিলেন হজরত উম্মে সালমা। তিনি হজরত ফাতেমার এরকম কান্না-হাসির বিষয়টির প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন। প্রকৃত বিষয় জানতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু এখন তো সে সময় নয়। তাই তিনি তাঁর কৌতূহলকে শৃঙ্খলিত করে রাখলেন।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরপর কাছে ডাকলেন প্রিয় দৌহিত্রদ্বয়কে। বালক ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) গভীর মমতায় বাহুবদ্ধ করলেন। মহামমতার মহিমা দেখে অন্যদের মতো হজরত উম্মে সালমাও মমতানিমজ্জিত হলেন। সজল চোখে বিশেষ করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন ইমাম হোসেনের দিকে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কেবল তাঁর কাছেই বলেছেন, তিনি শহীদ হবেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার চলে গেলেন। পৃথিবীতে রেখে গেলেন রোরুদ্যমান ও বিচ্ছেদকাতর পরিবার-পরিজন ও সহচরবৃন্দকে। আর জন্মের আগেই এতিম করে গেলেন অনাগত কালের বিশ্বাসী প্রেমিকজনদেরকে।
বিরহযন্ত্রণার তীব্র তীক্ষ্ণ উচ্ছ্বাসকে অবদমিত করতেই হয়। স্থান দিতে বাধ্য হতে হয় অন্তরের গহীনে। বাইরে স্বাগতম জানাতে হয় প্রয়োজনকে। দায়িত্ববোধকে। জীবন তো থেমে থাকে না। নিরন্তর যাত্রা। শুধুই সম্মুখযাত্রা।
শোকাকুলা জননীগণ আরো অধিক ইবাদতমগ্ন হলেন। দুনিয়ার প্রতি হলেন অধিকতর অনাসক্ত। একদিন জননী উম্মে সালমা হজরত ফাতেমাকে প্রশ্ন করে সেদিনের কান্না-হাসির কারণ জেনে নিলেন। হজরত ফাতেমা বললেন, প্রথমে বলেছিলেন, অনতিবিলম্বে তাঁর মহাতিরোধান ঘটবে। পরে বলেছিলেন, পরিবারবর্গের মধ্যে তুমিই প্রথমে মিলিত হবে আমার সঙ্গে।
তাই হলো। ছয় মাস যেতে না যেতেই তাঁর নবী-পিতাবিচ্ছেদের অবসান ঘটলো। হজরত ফাতেমা মিলিত হলেন সুমহান পিতা, মহানতম নবীর সঙ্গে।
উম্মতজননীগণ জীবনযাপন করেন প্রত্যাদেশের সম্পূর্ণ অনুকূলে। পুরোপুরি হয়ে যান আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায়ানুকূল, যেভাবে বলা হয়েছে, সেভাবে— ‘“হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।”’ আরো একটি বিশেষ নির্দেশকে মান্য করেন তাঁরা— ‘“হে নবী পরিবার! আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানগর্ভ কথা, যা তোমাদের গৃহে পাঠ করা হয়, তোমরা সেগুলো স্মরণ করবে।”’
তাঁরা স্মরণ সংরক্ষণ করেন কোরআনের প্রত্যাদেশাবলীর যথাঅর্থের, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণীসমূহের। জ্ঞানপিপাসুরা সমবেত হয়। নিকটের ও দূরের মানুষ জানতে চায়, মানতে চায়, প্রশান্ত করতে চায় নিজেদের অনুসন্ধিৎসুতাকে।
হজরত আয়েশা সিদ্দীকা এবং হজরত উম্মে সালমার দরবারেই ভক্ত-অনুরক্তদের ও শিক্ষার্থীদের ভীড় বাড়ে বেশী। কারণ, তাঁরাই স্মরণসংরক্ষণকর্মে অধিক অগ্রগামিনী। তাঁরাই বেশী হাদিস বর্ণনা করেন। হজরত আয়েশা দুই হাজার দুই শত দশটি। আর হজরত উম্মে সালমা তিনশত আটাত্তরটি। কোরআন ও হাদিসের যথাব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সঠিকতা নিরূপণ ও সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে এই জননীদ্বয়ের অবদানই বেশী।
কবি মাহমুদ লবীদ তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন— রসুলুল্লাহর সহধর্মিণীগণ বহু হাদিস স্মৃতিস্থ করেছিলেন। তবে বলতেই হয়, এ ক্ষেত্রে জননী আয়েশা এবং জননী উম্মে সালমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না।
আসমা ইবনুল কায়্যিম বলেছেন, জননী উম্মে সালমার ফতোয়াসমূহ যদি সংকলন করা হয়, তবে তা ধারণ করবে একটি বৃহৎ পুস্তকের আকার।
ইমামুল হারামাইন বলেছেন, হজরত উম্মে সালমার চেয়ে অধিক সঠিক সিদ্ধান্তদানকারিণী আমার নজরে পড়েনি। মারওয়ান ইবনে হাকাম হজরত উম্মে সালমার কাছে মাসআলা জেনে নিতেন এবং বলতেন, আমাদের মধ্যে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্র সহধর্মিণীগণ থাকতে কীভাবে আমরা অন্যত্র গমন করি।
ইবনে হাজার বলেছেন, জননী উম্মে সালমা সৌন্দর্য-চেতনা, শুদ্ধ-প্রজ্ঞা ও সঠিক সিদ্ধান্তের গুণে গুণান্বিতা ছিলেন।
হজরত উম্মে সালমা খুব সুন্দর করে কোরআন শরীফ পাঠ করতে পারতেন। পাঠ করতেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উচ্চারণভঙ্গির অনুকরণে। একবার এক লোক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, মহাসম্মানিতা মাতা! জানতে চাই, রসুলুল্লাহ কীভাবে কোরআন পাঠ করতেন? তিনি জবাব দিলেন, এক একটি আয়াত পৃথক পৃথক করে— এভাবে। একথা বলে তিনি কিছুসংখ্যক আয়াত পাঠ করে শোনালেন।
হজরত ইবনে আব্বাস ও হজরত আবু হোরায়রা, যাঁরা জ্ঞানসমুদ্র নামে খ্যাত, তাঁরাও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে হজরত উম্মে সালমার গৃহদ্বারে উপস্থিত হয়ে জ্ঞানপ্রার্থী হতেন। তাবেয়ীগণের একটি বিরাট দল ছিলেন তাঁর ছাত্র। তাঁর নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন এরকম লোকের সংখ্যা অনেক। যেমন— ওমর (ছেলে), যয়নব (মেয়ে), আমের (ভাই), মুসআব ইবনে আবদুল্লাহ (ভাইয়ের ছেলে), আবদুল্লাহ ইবনে রাফে, নাফে, ইবনে সাফিনা, আবু বাছীর, খাযরা, সাফিয়া বিনতে শায়বা, হিন্দা বিনতে হারিস, কাবীসা বিনতে জুরাইব, আবু ওসমান নাহদী, আবু ওয়ায়েল, সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব, হুমাইদ, ওরওয়া, আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান, সুলায়মান ইবনে ইয়াসার প্রমুখ সাহাবা ও তাবেয়ীন।
অনেক প্রথিতযশা সাহাবী তাঁর কাছে উপদেশ ও সান্ত্বনা প্রার্থনা করতেন। যেমন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত বিশিষ্ট দশ সাহাবীর একজন হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ একবার তাঁকে বললেন, আম্মা! আমার কাছে এতো বেশী অর্থসম্পদ জমা হয়ে যাচ্ছে যে, আমি আতঙ্কিত বোধ করছি। জননী উম্মে সালমা বললেন, বৎস! খরচ করো। খরচ করো। রসুলুল্লাহ বলেছেন, অনেক সাহাবী এমন হবে, যারা আমার পরলোকগমনের পর আর আমাকে দেখবে না ।
মমতাময়ী জননী তিনি। সন্তানদের সংশোধনদৃষ্টি তো তাঁর থাকবেই। একবার তাঁর এক ভাতিজাকে নামাজ পড়তে দেখলেন। সেজদার স্থানে ধূলোবালি ছিলো বলে তিনি সেজদার পর কপাল ঝেড়ে নিচ্ছিলেন। নামাজ শেষে তিনি তাকে বললেন, এরকম করো না। রসুলুল্লাহ এরকম করতেন না। একবার এক ক্রীতদাসও এরকম করলো। তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য তোমার চেহারা ধূলিমলিন হলেই উত্তম।
ইসলামী শরীয়তের তত্ত্বজ্ঞান ছিলো তাঁর আয়ত্ত। তাঁর জীবনের বহু ঘটনায় একথার প্রমাণ রয়েছে। যেমন— হজরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলতেন, রমজানের রাতে কেউ অপবিত্র হলে তাকে সুবহে সাদেকের আগেই গোসল করে নিতে হবে। না হলে তার রোজা ভেঙে যাবে। একবার এক লোক কথাটি সত্য কিনা তা জানতে চান। লোকটির কথা শুনে হজরত উম্মে সালমা ও হজরত আয়েশা সিদ্দীকা যুগপৎ বলে ওঠেন, আমরা রসুলুল্লাহকে অপবিত্র অবস্থায় রোজা রাখতে দেখেছি। কথাটা হজরত আবু হোরায়রার কর্ণগোচর হলো। তিনি বললেন, কী করবো। ফজল ইবনে আব্বাসের কাছ থেকে তো আমি এরকমই শুনেছিলাম। আর একথাটিও অস্পষ্ট নয় যে, জননীদ্বয়ের জ্ঞান বেশী।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পৃথিবীবাসের সময়ের একটি ঘটনা— কয়েকজন সাহাবী হজরত উম্মে সালমার কাছে রসুলুল্লাহর গোপন জীবন সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, তাঁর প্রকাশ্য ও গোপন জীবন একই রকম— একথা বলেই তাঁর মনে হলো, তিনি আল্লাহর রসুলের গোপন কিছু বলে ফেললেন না তো! অনুতাপাহত হলেন। রসুলুল্লাহ ঘরে এলে একথা বললেনও। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, বেশ করেছো।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের (রাঃ) আসরের নামাজের পর দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তেন। মারওয়ান জিজ্ঞেস করলো, এ নামাজ আপনি কেনো পড়েন? তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহর রসুল পড়তেন। যেহেতু হাদিসটি তিনি জননী আয়েশার কাছে শুনেছিলেন, তাই মারওয়ান সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এক লোককে তাঁর কাছে পাঠালেন। তিনি বললেন, হাদিসটি আমি শুনেছি উম্মে সালমার কাছ থেকে। লোকটি জননী উম্মে সালমার কাছে গেলো। সবশুনে তিনি বললেন, আল্লাহ আয়েশাকে ক্ষমা করুন। তিনি তো শুনতে ভুল করেছেন। আমি কি তাঁকে একথা বলিনি যে, রসুলুল্লাহ ওই সময় নামাজ পড়তে বারণ করেছেন।
আগেই বলা হয়েছে, খুব লজ্জাবতী ছিলেন জননী উম্মে সালমা। একবার তাঁর সামনেই জনৈক মহিলা সাহাবী প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রসুল! কোনো মেয়ে যদি স্বপ্নে তার স্বামীর সঙ্গে সঙ্গম করতে দেখে, তবে কি তার উপরে গোসল অপরিহার্য হবে? জননী বললেন, তোমার হাত ধূলিধূসরিত হোক। তুমি রসুলুল্লাহর কাছে নারীসমাজকে লজ্জিত করেছো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রশ্নের জবাবে বললেন, পানি দেখা গেলে তার উপরে গোসল ওয়াজিব হবে। একথা শুনে জননী জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর হাবীব! মেয়েদেরও কি পানি আছে?
জননী উম্মে সালমা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর দিবস রজনীর অনেক দোয়া ও ওজীফার কথা বলেছেন। যেমন বলেছেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজর নামাজের পর পড়তেন “আলাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা রিজক্বন ত্বইয়্যেবান ওয়া ইলমান নাফিয়ান ওয়া আমালান মুতাক্বববালান” (হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করি পবিত্র জীবনোপকরণ, কল্যাণময় জ্ঞান এবং গ্রহণযোগ্য কর্ম)।
তিনি আরো বর্ণনা করেছেন, রসুলুল্লাহ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলতেন, “বিসমিলাহি তাওয়াক্কালতু আ‘লাল্লাহ ....।” (হে আল্লাহ! আমরা পদস্খলন, পথভ্রষ্টতা, অত্যাচার করা, অত্যাচারিত হওয়া, কারও উপর বলপ্রয়োগ করা অথবা আমাদের উপর কারো বলপ্রয়োগ হওয়া থেকে তোমা সকাশে আশ্রয় যাচ্ঞা করি)। আরো বলেছেন, রসুলুল্লাহ প্রায়শঃই প্রার্থনা করতেন, “ইয়া মুক্বাল্লিবাল্ কুলুব! সাব্বিত্ কল্বি আলা দ্বীনিক্” (হে হৃদয়সমূহের পরবর্তনকারী! আমার হৃদয় তোমার দ্বীনের উপরে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দাও)। উম্মতজননী আরো বলেছেন, এরকম দোয়াও তিনি করতেন “রব্বিগফিরলী ওয়ারহাম ওয়াহদিনীস সাবিলাল ক্বওমি” (হে আমার প্রভুপালক! আমাকে ক্ষমা করো। আমার প্রতি সদয় হও এবং দআমাকে সোজা পথ দেখাও)।
বয়ে চলে কালস্রোত। ক্ষয় হয় আয়ুর আতর। লয় হয় সমাজ, সংসার, জনকোলাহল। হজরত উম্মে সালমা পার হয়ে যান অনেক দিন-মাস-বছর। বছরের পর বছর। শেষ হয়ে যায় খোলাফায়ে রাশেদীন চতুষ্টয়ের স্বর্ণশাসনকাল। উপস্থিত হয় বিশৃঙ্খলা, অশুভশাসন। উমাইয়া খান্দানের শাসকের সমর্থকেরা হজরত আলী সম্পর্কে নানারকম অশালীন মন্তব্য করতে থাকে। জননী উম্মে সালমা তা সহ্য করতে পারেন না। প্রতিবাদ করেন।
হজরত আবু আবদুল্লাহ আল জাদানী (রাঃ) বলেন, একদিন আমি বিশ্বাসীগণের জননী উম্মে সালমার সঙ্গে সাক্ষাত করলাম। তিনি বললেন, তোমাদের ওদিকের লোকেরা রসুলুল্লাহকে গালি দেয়। আমি বললাম, মাআজাল্লাহ! (আল্লাহ রক্ষা করুন)। তিনি বললেন, স্বকর্ণে শুনেছি, রসুলুল্লাহ বলেছেন, যে আলীকে গালি দেয়, সে আমাকে গালি দেয়। আর এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি তখন বললেন, আলী এবং তাঁকে যারা ভালোবাসে, তাঁদেরকে কি গালাগালি করা হয় না? অথচ রসুলুল্লাহ তাঁকে ভালোবাসতেন।
কারবালা প্রান্তরে যখন ইমাম হোসেন তাঁর প্রতিপক্ষীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছেন, তখন এক রাতে উম্মতজননী উম্মে সালমা স্বপ্নে দেখলেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আগমন করেছেন। চেহারায় অশান্তির ছাপ। মস্তকের কেশ ও শ্মশ্রু ধূলোবালি মাখানো। জননী জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসুলালাহ! কী হয়েছে? বললেন, হোসেনের শাহাদতস্থল থেকে এলাম। ঘুম ভেঙে গেলো। মমতাময়ী জননী অঝোর ধারায় অশ্রুবর্ষণ করলেন। বললেন, ইরাকীরা হোসেনকে হত্যা করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন। নবীদৌহিত্রকে অপমান করেছে। আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করুন।
দুই দল মুসলমান যদি দ্বন্দ্বমুখর হয়, তবে তাদেরকে সন্ধিবদ্ধ করে দিতে হবে। এটাই আল্লাহ পাকের নির্দেশ। হজরত হাসান তাই করলেন। মুসলমানদের রক্তপাত যাতে বন্ধ হয়ে যায়, তাই তিনি কেবল আল্লাহ পাকের সন্তোষ কামনার্থে আমির মুয়াবিয়াকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলেন। সন্ধিচুক্তিতে অবশ্য এইশর্তটিও রইলো যে, আমির মুয়াবিয়া (রাঃ) এর পরলোকগমনের পর খলিফা হবেন ইমাম হাসান। তিনি যখন এইমর্মে বায়াত (অঙ্গীকার) করেন, তখনই ঘটে যায় উম্মতজননী উম্মে সালমার পরলোকগমনের শোকাবহ ঘটনাটি। উম্মত জননীগণের মধ্যে তিনিই পৃথিবী পরিত্যাগ করেন সকলের পরে, হিজরী ৬৩ সনে। তখন তাঁর বয়স ৮৪ বছর।
নিয়ম অনুযায়ী মদীনার প্রশাসক জানাযার নামাজে ইমামতি করার কথা। কিন্তু জননী অসিয়ত করে যান, সে যেনো তাঁর জানাযা না পড়ায়। তাঁর নির্দেশই প্রতিপালিত হয়। তখনকার মদীনার প্রশাসক ওলীদ ইবনে উতবা জানাযার সময় শহরের বাইরে চলে যায়। আর জানাযার নামাজ পড়ান হজরত আবু হোরায়রা (রাঃ)। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় জান্নাতুল বাকীতে অন্যান্য উম্মত জননীগণের পাশে। এভাবে চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সর্বশেষ জীবনসঙ্গিনীর স্মৃতি। আর মুসলমানদের মাতৃগৃহ হয়ে যায় শূন্য। চিরদিনের জন্য।
 
 
 
 

Top