হজরত সাফিয়া বিনতে হুয়াই রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা
🖋মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ
............................................................
মদীনা থেকে নির্বাসিত হয়ে বনী নাজির গোত্রের ইহুদীরা খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। স্থানটি ছিলো বৃষ্টিপ্রধান এবং বাগবাগিচাময়। জনপদটি মদীনা থেকে প্রায় দুই শত মাইল পূর্বে অবস্থিত। সেখানে গিয়ে তারা নিকটবর্তী গাতফান জনপদবাসীদের সঙ্গেদ মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হলো। ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হতে লাগলো প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য। ইসলামের অন্য শত্রুরাও সেখানে আনাগোনা শুরু করে দিলো। খন্দকের যুদ্ধেও তারা ছিলো ইসলামের শত্রুপক্ষের সক্রিয় সমর্থক।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যথাসময়ে তাদের ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধপ্রস্তুতির সংবাদ পেলেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, খায়বরে পৌঁছে তাদেরকে সমূলে উৎখাত করতে হবে। নয়তো তাদের ষড়যন্ত্র থামবে না। উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেতে থাকবে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুদ্ধাভিযানের জন্য সকলকে প্রস্তুত হতে বললেন। ঘোষণা শুনে সাহাবীগণ বিপুলভাবে উজ্জীবিত ও উদ্দীপিত হলেন। এই ভেবে সকলে আনন্দিত ও উল্লসিত হলেন যে, এই প্রথম অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আক্রমণাত্মক একটি অভিযান।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে সপ্তম হিজরীর মহররম মাসে অনেক দুর্গম এলাকা অতিক্রম করে যখন খায়বরে উপনীত হলেন, তখন চরাচর জুড়ে নেমে এসেছে রাত্রি। খায়বরবাসীরা তাঁর আগমনের কথা জানতে পারলো না।
সকালে দলে দলে যখন কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো, তখন বিশাল মুসলিম বাহিনী দেখে খুবই আতঙ্কিত হলো। পশ্চাদপসরণ করে ঢুকে গেলো দুর্গ মধ্যে।
অনেকগুলো দুর্গ ছিলো সেখানে। আর সেগুলো ছিলো সারিবদ্ধ ও গুপ্তপথ দ্বারা পরস্পরযুক্ত। মুজাহিদ বাহিনী প্রথম দিকে তেমন সুবিধা করতে পারলো না। কারণ দুর্গ গুলো ছিলো সুদৃঢ় ও দুর্ভেদ্য। পরে একে একে দুর্গগুলোর পতন ঘটতে থাকে। মুসলিম সেনাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক সাহাবী শহীদ হন।
সবচেয়ে বড় দুর্গের নাম ছিলো কামুস। প্রায় বিশ রাত অবরুদ্ধ থাকার পর দুর্গটির পতন ঘটে বীরশ্রেষ্ঠ হজরত আলীর হাতে। অনেক ইহুদীর সঙ্গে ইহুদীদের নেতা হুয়াই ইবনে আখতাব ও তার কন্যার জামাতা নিহত হয়। বন্দী করা হয় পরাভূত পুরুষ-রমণীদেরকে। বন্দিনী হন হুয়াইকন্যা যয়নাব। তাঁর সঙ্গে তাঁর দুই চাচাতো বোনও বন্দিনী হয়।
হুয়াই নন্দিনীর যয়নাব নামটি পরে হারিয়ে যায়। তিনি খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন সাফিয়া নামে। কারণ মালে গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ও দাস-দাসী) বণ্টনের সময় তিনি পড়েন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অংশে। তখনকার আরবের রীতি অনুসারে প্রধান নেতা বা রাজার অংশের মালে গণিমতকে বলা হতো সাফিয়া। আর সেই হিসেবে তাঁর নাম হয়ে যায় সাফিয়া। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ও তাঁকে এই নামেই ডাকতেন।
হজরত সাফিয়ার পিতা ও নানা ছিলেন ইহুদীদের সম্ভ্রান্ত দুই গোত্র— বনী নাজির ও বনী কুরায়জার মহামান্য নেতা। বনী নাজিরের নেতা হুয়াই ইবনে আখতাবের নির্দেশ ও নেতৃত্বকে তাঁর গোত্রের লোকেরা বিনাবাক্যে মেনে নিতো।
আর তিনি ছিলেন নবী হারুনের বংশধর। তাঁর মাতার নাম ছিলো বাররা। তিনি ছিলেন বনী কুরায়জা অধিপতি সামাওয়ানের কন্যা।
হজরত সাফিয়ার প্রথম বিবাহ হয় বনী কুরায়জার নেতা ও বিখ্যাত কবি সালাম ইবনে মাশকামের সঙ্গে। কিন্তু ওই বিবাহবন্ধন অল্পদিনের মধ্যে ছিন্ন হয়ে যায়। পরে বিবাহ হয় আরবের বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও খায়বরের এক নেতা আবু রাফের ভ্রাতুষ্পুত্র কিনানা ইবনে আবুল হুকাইকের সঙ্গে। কিনানাও ছিলো বড় কবি এবং বিশাল কামুস দুর্গের নেতা। কামুস দুর্গের মধ্যেই মুসলিমবাহিনীর হাতে সাঙ্গ হয় তার জীবনলীলা।
মালে গনিমত বণ্টনপর্ব শুরু হলো। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ভাগে পড়লেন হজরত সাফিয়া ও তাঁর এক সহচরী। হজরত বেলাল তাঁদেরকে নিয়ে এলেন ওই পথ দিয়ে, যে পথের পাশে পড়ে আছে বনী নাজিরের নেতা ও জনতার রক্তাক্ত ও বীভৎস মরদেহ। তাই মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রথমেই হজরত বেলালকে ভর্ৎসনা করে বললেন, বেলাল! তোমার অন্তরে কি মায়াদয়া নেই। তুমি তো অন্য পথেও তাদেরকে নিয়ে আসলে পারতে। তাদের মৃত পিতা-ভ্রাতাদের লাশের পাশ দিয়ে না আনলেও তো পারতে।
হজরত সাফিয়ার সহচরীটি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে দেখে চীৎকার শুরু করলো। নিজের মুখে নিজেই ধূলোবালি মাখতে লাগলো। আঘাত করতে লাগলো তার নিজের শরীরে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এই শয়তানীটিকে এক্ষুণি এখান থেকে নিয়ে যাও। তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।
ইত্যবসরে সেখানে উপস্থিত হলেন হজরত দাহিয়া কালাবী (রাঃ)। বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমাকে একটি বাঁদী দান করুন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যাকে পছন্দ হয় নিয়ে যাও। তিনি হজরত সাফিয়াকে পছন্দ করলেন। সেখানে উপস্থিত জনৈক সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর হাবীব! বনী নাজির ও বনী কুরায়জার সর্বজন মান্য নেতার কন্যাকে তো কেবল আপনার জন্যই মানায়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ঠিক আছে। একে রেখে দাও। দাহিয়া! তুমি অন্য কোনো বন্দিনীকে নিয়ে যাও।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবার হজরত সাফিয়ার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। নির্দেশ দিলেন, একে তাঁবুর ভিতরে নিয়ে যাও। নির্দেশ পালিত হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করলেন। সাফিয়া তাঁকে দেখে দাঁড়ালেন। উঁচু একটি স্থানে বিছানা বিছিয়ে দিলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেখানে বসলেন। সাফিয়া বসলেন মাটিতে। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমার পিতা সবসময় আমার সাথে শত্রুতা করতো। শেষে আল্লাহই চূড়ান্ত মীমাংসা করে দিলেন। সাফিয়া বললেন, আল্লাহ তাঁর এক বান্দার পাপের জন্য অন্য বান্দাকে শাস্তি দেন না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি স্বাধীন। চলে যেতে পারো। অথবা ইসলাম গ্রহণ করতে পারো। ইচ্ছা করলে হতে পারো আমার জীবনসঙ্গিনী।
হজরত সাফিয়া ছিলেন খুব বুদ্ধিমতী ও ধীরস্থির স্বভাবের। তিনি নিবেদন করলেন, হে আল্লাহর রসুল! আমি আগে থেকেই আপনাকে বিশ্বাস করি। এখন তো লাভ করলাম আপনার পবিত্র দীদার। আমি মুগ্ধ, স্বাধীন ভাবে আপনি আমাকে আমার মতামত ব্যক্ত করতে বললেন। আল্লাহর শপথ! আমি আল্লাহ ও তাঁর রসুল কে চাই।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলেন। আর তাঁর মুক্তি কে নির্ধারণ করলেন মোহরানা। তারপর তাঁকে পাঠালেন হজরত আনাস (রাঃ) এর মা উম্মে সুলাইমের তত্ত্ববধানে।
এবার নতুন বধূ এবং বিজয়ী বাহিনী নিয়ে মদীনার পথ ধরলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। সাহবা নামক স্থানে পৌঁছে থামলেন। সেখানে হজরত উম্মে সুলাইম নতুন বধূর কেশবিন্যাস করে দিলেন। তাঁকে সাজালেন। রাতে পাঠালেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর তাঁবুতে। সেখানেই অতিবাহিত হলো নতুন বর-বধূর বাসর রজনী।
সারারাত কোষমুক্ত তরবারী হাতে নিয়ে তাঁবুর বাইরে পাহারা দিলেন হজরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ)। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পরদিন একথা জানতে পারলেন। তাঁকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এরকম করলে কেনো? তিনি জবাব দিলেন, হে আল্লাহর হাবীব! এ মহিলার পিতা, স্বামী, ভাই ও নিকটজনেরা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়েছে। আশঙ্কা হচ্ছিলো, তাঁর গোত্রের লোকেরা খারাপ কিছু করে বসে কিনা।
তাঁর কথা শুনে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মৃদু হাসলেন। তাঁর জন্য দোয়া করলেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লক্ষ্য করলেন, সাফিয়ার চোখের পাশে একটি সবুজ দাগ। জিজ্ঞেস করলেন, দাগটি কিসের? তিনি বললেন, এক রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম, একটি পূর্ণ আলোকিত চাঁদ আমার কোলে এসে পড়লো। সকালে কিনানাকে স্বপ্নটির কথা জানালাম। সে ভীষণ রাগ হলো। আমার মুখে খুব জোরে থাপ্পড় মেরে বললো, আরবের বাদশাহ কে চাও, না? এ দাগ সেই আঘাতের।
হজরত জাবের বর্ণনা করেছেন, সকালের দিকে আমরা রসুলুল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাত করলাম। এক সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তোমরা এখন তোমাদের মায়ের কাছ থেকে ওঠো। সন্ধ্যায় আবারও সেখানে গেলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর চাদরের মধ্য থেকে প্রায় দেড় মুদ পরিমাণ খেজুর বের করে বললেন, তোমরা তোমাদের মায়ের ওলীমা খাও।
বড় আকারের ওলীমাও তখন করা হয়েছিলো। এভাবে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নির্দেশ দিলেন, তোমাদের যার কাছে যা আছে, নিয়ে এসো। সকলে খেজুর, ঘি, পনির, আটা ইত্যাদি নিয়ে হাজির হলেন। সেগুলোকে একত্র করে বানানো হলো হায়স (খিচুঁড়ি)। পরিমাণ বেশী ছিলো না। তৎসত্ত্বেও ওই খাদ্য সকলে আহার করলেন পরিতৃপ্তির সঙ্গে। নিঃসন্দেহে ওটি ছিলো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মোজেযা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহবায় তিন দিন অবস্থান করলেন।
চতুর্থ দিনে যাত্রা করলেন মদীনা অভিমুখে। যাত্রার সময় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর হাঁটুর উপরে পা রেখে উঁটের উপরে উঠতে হলো হজরত সাফিয়াকে। কাফেলা চলছে। সকলের মনে বিজয়ের আনন্দ। নতুন জননী প্রাপ্তির প্রশান্তি। সেই অনাবিল পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি প্রকাশ পাচ্ছে অশ্ব-উষ্ট্রী-অশ্বতরগুলোর পদবিক্ষেপের ছন্দে। মরুভূমির পথে-প্রান্তরে, লু হাওয়ায়, সুমন্দ বাতাসে। পার হয়ে যাচ্ছে একের পর এক রাতের স্নিগ্ধতা ও দিনের উত্তাপ।
হঠাৎ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং হজরত সাফিয়াকে বহনকারী উটটি হোঁচট খেলো। ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলেন দু’জনেই। হজরত আবু তালহা নিকটেই ছিলেন। তিনি তাঁর বাহন থেকে লাফিয়ে পড়ে ছুটে গেলেন। বললেন, হে আল্লাহর নবী! ব্যথা পাননি তো? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজে নিজে উঠতে চেষ্টা করলেন। বললেন, না। তুমি ওর দিকে দ্যাখো। হজরত আবু তালহা কাপড়ে মুখ ঢেকে জননীর দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর দিকে ছুড়ে দিলেন এক খণ্ড কাপড়। ওই কাপড়ে নিজেকে আবৃত করে উঠে দাঁড়ালেন হজরত সাফিয়া। না। ভাবনার কিছু নেই। দু’জনেই রয়েছেন অক্ষত অবস্থায়।
হজরত আবু তালহা নিজের উটটি প্রস্তুত করলেন। তার উপরে ওঠালেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও হজরত সাফিয়াকে। কাফেলা আবার চলতে শুরু করলো। আবার পশুদের ক্ষুরের আঘাতে মৃদু-উষ্ণ শব্দে উত্থিত হতে লাগলো বালি ও প্রস্তরকণার আওয়াজ। নিকট, নিকটতর হতে লাগলো মদীনার মায়াবী মাটির সুবাস।
মসজিদ সংলগ্ন কোনো প্রকোষ্ঠ শূন্য ছিলো না বলেই হয়তো মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত সাফিয়াকে নিয়ে গেলেন সাহাবী হারেছ ইবনে নোমানের বাড়িতে। গৃহকর্তা ছিলেন সচ্ছল ও বিত্তবান। তিনি তাঁর বাড়ির সবচেয়ে ভালো কক্ষটি হজরত সাফিয়ার জন্য ছেড়ে দিলেন। এরকম বিরল খেদমতের সুযোগ পেয়ে ধন্য হলেন। মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে জানালেন অসংখ্য কৃতজ্ঞতা। বধূবরণ ও দর্শনের জন্য সেখানে হাজির হলেন অনেক আনসার রমণী। সকলের কাছে এই কথাটি প্রচার হয়ে গিয়েছিলো যে, হুয়াইদুহিতা সাফিয়া অসামান্য রূপবতী। তাই কৌতূহল নিবারণের জন্য এবং স্বচক্ষে কন্যাদর্শনের জন্য মদীনাবাসিনীগণ সেখানে ভিড় না জমিয়ে পারলেন না।
উম্মতজননীদের মধ্যে এলেন হজরত যয়নাব বিনতে জাহাশ, হজরত হাফসা ও হজরত জুওয়াইরিয়া। আর হজরত আয়েশা এলেন চাদরে মুখ ঢেকে, যাতে তাঁকে কেউ চিনতে না পারে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে ঠিকই চিনতে পারলেন। ফেরার সময় পিছু নিলেন তাঁর। মুখের আবরণ সরিয়ে বললেন, হোমায়রা! সাফিয়াকে কেমন দেখলে? হজরত আয়েশা সিদ্দীকা বললেন, কী আর দেখবো? দেখলাম এক ইহুদিনীকে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এরকম বলছো কেন? সে তো ইসলাম গ্রহণ করেছে। হয়েছে বিশুদ্ধ চিত্ত বিশ্বাসিনী।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অসীম ভালোবাসার সমুদ্রে চিরদিনের জন্য নিমজ্জিত হলেন হজরত সাফিয়া। বদলে গেলেন যেমন বদলে যান বিশুদ্ধ চিত্ত নবীপ্রেমিকেরা। তিনি যেমন সবাইকে ভালোবাসেন, তেমনি তিনি ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপন করতে চেষ্টা করেন সকলের সঙ্গে। হাদিয়া, উপহার আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে সম্প্রীতি ও প্রেম প্রতিষ্ঠিত হয়, একথা তিনি জানেন। চেষ্টাও করেন এরকম আমল করতে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কলিজার টুকরা হজরত ফাতেমাতুয্ যাহরাকে দেখে খুবই আনন্দিত হলেন হজরত সাফিয়া । পরম স্নেহের নিদর্শন হিসেবে তাঁকে উপহার দিলেন নিজের কানের এক জোড়া দুল। এরকম উপহার তিনি দিলেন তাঁর সপত্নীদেরকেও। আনসারী মহিলাদের মধ্যে যাঁরা তাঁর কাছে আসা যাওয়া করেন, তাঁদেরকেও।
ভালো রান্না জানতেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর রান্না পছন্দও করতেন নিশ্চয়। কখনো এমন হতো, হজরত আয়েশা সিদ্দীকা অথবা অন্য কোনো মুমিন রমণীর সঙ্গে রাত্রি যাপনের সময় তিনি তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাছে নিজ হাতে রান্না করা খাবার পাঠিয়ে দিতেন।
ছিলেন কুসুমের চেয়ে কোমল মনের অধিকারিণী। ‘ইহুদিনী’ বলে কটাক্ষ করলে কষ্ট পেতেন। একবার মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর ঘরে গিয়ে দেখলেন, তিনি কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছো কেনো? তিনি জবাব দিলেন, আয়েশা ও যয়নাব বলে, তারা আপনার অন্য স্ত্রীদের চেয়ে উত্তমা। কারণ, তারা আপনার স্ত্রী হওয়া ছাড়াও আপনার নিকটাত্মীয়া। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আবার যদি এরকম বলে, তবে তুমিও বোলো, আমার পিতৃপুরুষ নবী হারুন, পিতৃব্যপুরুষ নবী মুসা, আর আমার স্বামী মোহাম্মদ।
একদিন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা অভিমানভরে বললেন, হে আল্লাহর রসুল! সাফিয়াইতো আপনার সব। কিন্তু সে তো এরকম এরকম। এরকম বলে তিনি ইঙ্গিতে বোঝালেন হজরত সাফিয়া খর্বাকৃতিবিশিষ্ট। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে আয়েশা! তোমার একথা যদি সাগরে নিক্ষেপ করা যায়, তবে সাগরের পানিও বিবর্ণ হয়ে যাবে।
একবার মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রমজান মাসে মসজিদে ইতেকাফ করছেন। হজরত সাফিয়া তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কিছুক্ষণ উপবেশন করলেন। কিছু কথাবার্তা বললেন। ফেরার সময় মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে হজরত উম্মে সালমার ঘরের দোরগোড়া পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। দুজন আনসারী সাহাবী সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদেরকে শুনিয়ে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এ হচ্ছে সাফিয়া বিনতে হুয়াই (আমার স্ত্রী)। তারা বলে উঠলো, সুবহান আল্লাহ! আলাহু আকবর। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, শয়তান মানুষের রক্তপ্রবাহের মধ্যে চলাচল করতে পারে। সে তোমাদের অন্তরে খারাপ ধারণা প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে (তাকে সে সুযোগ দিলাম না)।
স্বামী-স্ত্রীর মধুর মান অভিমানও হঠাৎ কখনো দেখা যেতো দু’জনের মধ্যে। তখন বিমর্ষমনা রসুলের পবিত্র মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে তিনি কষ্ট পেতেন খুব। নিজেই অগ্রগামিনী হয়ে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে তুষ্ট করতে চেষ্টা করতেন। অবশ্য এরকম ঘটনা কেবল একবারই ঘটেছিলো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বিষয়টি মিটিয়ে ফেললেন এভাবে— হজরত আয়েশা সিদ্দীকাকে বললেন, তুমি তো জানোই নিজের পালা কেউ কখনো অন্যকে দেয় না। আজ আমার পালার রাত তোমাকে দিলাম এই শর্ত যে, তুমি রসুলুল্লাহকে আমার প্রতি প্রসন্ন হতে বলবে। হজরত আয়েশা তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। রাতে ঘরে ঢুকে হজরত সাফিয়ার স্থলে হজরত আয়েশাকে দেখে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আজ তো তোমার পালার রাত নয়। কীভাবে পেলে? হজরত আয়েশা সে রাতে একটু অতিরিক্ত সাজগোজ করেছিলেন। জাফরান রঙে রঞ্জিত একটি সুবাসিত ওড়না দ্বারা মাথায় টেনে দিয়েছিলেন ঘোমটা। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘এটা তো আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি যাকে খুশী তাকে দান করেন’। এরপর তিনি সবকথা খুলে বললেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সবশুনে হজরত সাফিয়ার প্রতি খুবই খুশী হয়ে গেলেন।
দশম হিজরীতে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন হজ্বযাত্রা করলেন, তখন তাঁর অন্যান্য সহধর্মিণীর সঙ্গে হজরত সাফিয়াও ছিলেন। পথিমধ্যে তাঁকে বহনকারী উটটি অসুস্থ হয়ে পড়লো। হজরত সাফিয়া ভয়ে ও দুঃশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়লেন। কাঁদতে শুরু করলেন। খবর পেয়ে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হজরত সাফিয়ার কাছে গেলেন। নিজের হাতে তাঁর চোখের পানি মুছে দিলেন। কিন্তু তাঁর কান্না থামলো না। বরং আরো বেড়ে গেলো। উপায়ন্তর না দেখে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যাত্রাবিরতির নির্দেশ দিলেন। সন্ধ্যার সময় হজরত যয়নাবকে বললেন, জাহাশপুত্রী! তোমার তো অতিরিক্ত উট আছে।
তুমি সাফিয়াকে একটা উট দাওনা। হজরত যয়নাব বললেন, আমি উট দিবো? ওই ইহুদিনীকে? তার এরকম কথা শুনে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রুষ্ট হলেন। দুই অথবা তিন মাস তাঁর সঙ্গে বাক্যলাপ করলেন না। পরে হজরত আয়েশা সিদ্দীকার মধ্যস্থতায় বিষয়টির একটি সুন্দর সুরাহা হয়ে যায়।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অন্যান্য সহধর্মিণীগণের মতো হজরত সাফিয়াও ছিলেন এলেম ও মারেফতের কেন্দ্র। তাঁর গৃহাঙ্গনে জ্ঞানপিপাসুদের ভীড় লেগেই থাকতো। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতো তারা। জবাব পেয়ে পরিতুষ্ট হতো। সুহায়রা বিনতে হায়বার নামের এক মহিলা একবার হজ্ব সমাধা করার পর মদীনায় উপস্থিত হলেন। সেখানে মুমিনজননী হজরত সাফিয়ার কাছে যখন গেলেন, তখন দেখতে পেলেন, কুফা থেকে আগত বহু মহিলা সেখানে বসে আছে। তারা তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করছেন। আর তিনি সেগুলোর জবাব দিয়ে যাচ্ছেন সুন্দর ও সুস্পষ্ট ভাষায়। সুহায়রাও ওই মহিলাদের মাধ্যমে নাবীজ (ফলের রস) সর্ম্পকে জানতে চাইলেন। হজরত সাফিয়া যথা জবাব দিলেন। বললেন, ইরাকীরা প্রায়শঃ এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে।
হজরত সাফিয়া থেকে দশটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো বর্ণনা করেছেন ইমাম যয়নাল আবেদীন, ইসহাক ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে হারেছ, মুসলিম ইবন সাফওয়ান, কিনানা, ইয়াজিদ ইবনে মুয়াত্তাব প্রমুখ।
নবীজীবনী বিশেষজ্ঞগণ হজরত সাফিয়ার অনেক প্রশংসা করেছেন। আল্লামা ইবনে আবদুল বার বলেছেন, মাতা মহোদয়া সাফিয়া ছিলেন ধৈর্যশীলা, বুদ্ধিমতী ও বিদুষী। ইবনুল আসীর বলেছেন, তিনি ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাবতী ও বুদ্ধিমতী। আল্লামা জাহাবী বলেছেন, মাননীয়া মাতা হজরত সাফিয়া ছিলেন ভদ্র- সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত বংশদ্ভূতা, রূপবতী ও ধর্মপরায়ণা। মহানবী স, এর হৃদয়ের রাণী তিনি হয়েছিলেন অল্প বয়সে। তিনি নিজে বলেছেন, রসুলুল্লাহর ঘরে যখন আমি আসি তখন আমার বয়স সতেরো পূর্ণ হয়নি। উল্লেখ্য, তাঁর সেই সুগভীর প্রেমভালোবাসার সংসার দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি। মাত্র তিন বছর চার মাস ছিলেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে ।
বিদায় হজ্ব সমাপন করার পর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কেমন যেনো হয়ে গেলেন। পৃথিবীর দিকে আগের মতো দৃষ্টিপাত করেন না। দিবস-রজনীর অধিকাংশ সময় উন্মুখ হয়ে থাকেন কেবল তাঁর প্রতি, যাঁর প্রেম ও সন্তোষ কামানায় উৎসর্গ করে দিয়েছেন জীবন-সম্পদ-সময়। প্রচার করেছেন মহাসত্যের বাণী লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ। সেই মহাবাণী এখন উচ্চারিত হচ্ছে মানুষের মুখে, মনে ও অস্তিত্বে। ক্রমপ্রসারমান হচ্ছে সত্যের অক্ষয় আলোক রশ্মি মানুষের সকল মোড়ে, মহলায়, জটলায়, দেশে দেশে। যাদেরকে তিনি আলোকিত করেছেন, আলো বিতরণ করার দায়িত্ব এখন তাদের। আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল এখন আলিঙ্গন করবেন মহাপ্রস্থানকে। মহামিলনকে।
প্রথমে মাথা যন্ত্রণা। তারপর অন্যান্য উপসর্গ। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শয্যাগ্রহণ করলেন। একদিন একান্তে পেয়ে হজরত সাফিয়া জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর সর্বশেষ রসুল! আপনার অন্যান্য স্ত্রীগণের আত্মীয়স্বজন আছে। আমার তো কেউ নেই। আপনি যদি চলে যান, তবে আমি কার আশ্রয়ে থাকবো? মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জবাব দিলেন, আলীর আশ্রয়ে।
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর এতোটুকু কষ্টও তিনি সহ্য করতে পারতেন না। নীরবে অশ্রুবর্ষণ করতেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন চলচ্ছক্তি রহিত এবং যখন শেষ অবস্থান গ্রহণ করেছেন হজরত আয়েশা সিদ্দীকার প্রকোষ্ঠে, তখন তীব্র মনোকষ্টে অধীর হয়ে বললেন, হে আল্লাহর প্রেমাষ্পদ! আল্লাহর শপথ! আপনার রোগযন্ত্রণা যদি আমাকে দেওয়া হতো। একথা শুনে উম্মতজননীগণের কেউ কেউ মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। তাঁদের সকল দ্বিধা-সন্দেহের অবসান ঘটালেন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)স্বয়ং। বললেন, আল্লাহর শপথ! সাফিয়া সত্যবাদিনী।
ইসলামী রাজ্যের প্রথম খলিফা হলেন হজরত আবু বকর সিদ্দীক। দুই বৎসরের কিছু অধিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তিনিও চলে গেলেন নেপথ্যে—মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একান্ত সন্নিধানে। দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন হজরত ওমর ফারূক। তিনি সকল উম্মতজননীদের জন্য বাৎসরিক ভাতা নির্ধারণ করে দিলেন— সকলের জন্য বারো হাজার দিরহাম, আর হজরত জুওয়াইরিয়া ও হজরত সাফিয়ার জন্য ছয় হাজার করে। যুক্তি দেখালেন, অল্পকিছু সময়ের জন্য হলেও একদা তাঁরা ছিলেন যুদ্ধ বন্দিনী সূত্রে দাসী। বলাবাহুল্য, হজরত ওমরের ওই যুক্তি ধোপে টিকেনি। বনী ইসরাইল কুলোদ্ভূতা জননীদ্বয় তাঁর এমতো নির্ধারণ কে প্রত্যাখ্যান করলেন। হজরত ওমর মেনে নিলেন তাঁদের যথার্থ দাবী।
প্রত্যেক উম্মতজননীর জন্যই নির্ধারণ করলেন একই রকম— বারো হাজার। হজরত সাফিয়ার এক দাসী একবার এই মর্মে খলিফা ওমরের কাছে নালিশ করলো যে, এখনও তাঁর মধ্যে ইহুদী স্বভাব আছে। তিনি এখনও সর্বাধিক সম্মানিত দিন হিসেবে শনিবার কে মানেন, আর ইহুদীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করেন। হজরত ওমর দাসীর কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য জননীগৃহে একজন বিশ্বস্ত লোককে পাঠালেন। তার মুখে সব শুনে জননী মহোদয়া জবাব দিলেন আল্লাহ আমাকে ইসলামের কল্যাণে শনিবারের পরিবর্তে দিয়েছেন জুমআ। সুতরাং শনিবারকে মান্য করবো কেনো? আর আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক রাখতে তো ইসলাম নিষেধ করেনি। সত্য বটে, খুব নিকটের না হলেও কিছুসংখ্যক আত্মীয় তো আমার আছে। (ধর্মীয় নয়, তাদের সঙ্গে রক্ষা করি সামাজিক সম্পর্ক)।
এই ঘটনার পর তিনি দাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, এরকম অভিযোগ করতে কে তোমাকে অনুপ্রাণিত করেছে? দাসী বললো, শয়তান। জননী সাফিয়া নির্বাক হয়ে গেলেন। তাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দিলেন।
হজরত ওমরের শাসনকাল শেষ হলো। তৃতীয় খলিফা হিসেবে রাষ্ট্রের কর্ণধার হলেন হজরত ওসমান জিন্নুরাইন (রাঃ)। বেশ কয়েক বছর শান্তি ও শৃঙ্খলার সাথে শাসিত হলো দেশ। অকস্মাৎ উপস্থিত হলো অশুভ পরিস্থিতি। একদল হতভাগ্য সৃষ্টি করলো ফেতনা। তারা অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে হয়ে গেলো চরম উচ্ছৃঙ্খল। মহামান্য খলিফার বাড়ি ঘেরাও করলো তারা। মান্যবর খলিফার এ অবস্থা দেখে হজরত সাফিয়ার জননীহৃদয় কেঁদে আকুল হলো। তিনি খাদ্য-পানীয় সরবরাহবিচ্যুত খলিফাকে সাহায্য করবেন বলে দৃঢ়সংকল্প হলেন। তিনি একটি খচ্চরে আরোহণ করে খলিফার গৃহাভিমুখে চললেন। সঙ্গে নিলেন তাঁর এক দাসকে। সে জননী মহোদয়ার অনুগমন করলো। বিদ্রোহীদের একজন তাঁকে চিনে ফেললো। তাই তাঁকে কিছু বললো না বটে, কিন্তু মারতে শুরু করলো তাঁর খচ্চরটিকে। জননী বললেন, ঠিক আছে, আমি ফিরে যাচ্ছি। উপায়ন্তর না দেখে তিনি স্বগৃহে ফিরে এলেন। কিন্তু নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলেন না। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হাসানকে ডেকে খলিফার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে বললেন। তাকেই দিলেন খলিফার গৃহে খাদ্য ও পানীয় পৌঁছানোর দায়িত্ব।
বিদ্রোহীদের হাতে অবরুদ্ধ খলিফা নিহত হলেন। ওই চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন হজরত আলী। মাত্র চার বছর পর তিনিও শহীদ হলেন এক খারেজী আততায়ীর তলোয়ারের আঘাতে। এরপর রাজ্য শাসনের দায়িত্ব নিলেন হজরত আমীর মুয়াবিয়া। হিজরী ৫০ সন এসে পড়লো। জননী সাফিয়ার বয়স হলো ৬০ বছর। তিনি শুনতে পেলেন অনন্তের আহবান। মহাপুণ্যবতী জননী হজরত সাফিয়া চলে গেলেন। চলে গেলেন সেখানে, যেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষমাণ তাঁর প্রিয়তম স্বামী এবং ততোধিক প্রিয়তম রসুল।
জানাযার নামাজ পড়ালেন হজরত সাইদ ইবনে আস (রাঃ)। সমাধিস্থ হলেন জান্নাতুল বাকীতে।
তাঁর বসতবাটিটি তিনি অনেক আগেই দান করে গিয়েছিলেন। অসিয়ত করেছিলেন, রেখে যাওয়া অর্থকড়ির এক ভাগ দিতে হবে তাঁর ভাগেড়বকে। ওই ভাগেড়ব ছিলো ইহুদী। লোকেরা অসিয়ত পালনের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত হলো।
জননী মহোদয়া হজরত আয়েশার কানে একথা পৌঁছানো হলে তিনি সাথে সাথে বললেন, লোকসকল! আল্লাহকে ভয় করো। তোমাদের জননীর অসিয়ত বাস্তবায়িত করো।