৭ রমাদ্বানঃ আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনকের ইন্তিকাল দিবস।
⚕️💊⚕️💊⚕️💊⚕️💊⚕️💊⚕️💊
পৃথিবীর সভ্যতার উন্মেষে যে কজন বিশ্বমণীষার অবদান রয়েছে, তাঁদের মধ্যে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক ইবনে সিনা অন্যতম। জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, গণিত ও ফলিত গণিত ছাড়াও দর্শনশাস্ত্রের অবিস্মরণীয় পথিকৃৎ তিনি। তাঁর পিতা ছিলেন ইরানের খোরাসান প্রদেশের শাসক। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়া বালকের বিষয়ভিত্তিক বিদ্যাশিক্ষার জন্য পিতা যুগশ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়োগ দেন। যেমনি দশ বছর বয়সে আল কুরআন হিফজ করেছেন, ঠিক তেমনি সুফী ইসমাইল এর নিকট শেখেন তাছাউফ, ফিকাহ ও তাফসীর শাস্ত্র। পিতার মৃত্যু হলে ২২ বছর বয়সে বাধ্য হয়ে শাসকের আসনে বসেন। কিন্তু তাঁর মন পড়েছিল জ্ঞানরাজ্যের অধিকর্তা হবার নেশায়। শেষমেষ রাজ্যশাসন ছেড়ে গেলেন জ্ঞানরাজ্যের অতল মহাসাগর চষে বেড়াতে।
মহাপ্রতাপশালী সুলতান মাহমুদ গজনবী দার্শনিক চিকিৎসক ইবনে সিনার জ্ঞান ও পান্ডিত্যের প্রশংসা শুনে আশেপাশের রাজ্যের রাজা ও শাসকদের কাছে ইবনে সিনার ৪০ টি প্রতিকৃতি পাঠিয়ে তাকে গজনীতে পাঠানোর ফরমান জারি করেন।
একের পর এক উপহার দিতে থাকেন দর্শন, যুক্তিবিদ্যা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অতুল গ্রন্থ "আশ শিফা", "আল কানুন" নামের চিকিৎসা শাস্ত্রের রত্ন আকর, আল মাজমুয়া নামক বিশ্বকোষ। আল কানুন গ্রন্থটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বিপ্লব এনে দেয়। এত বিশাল গ্রন্থ সে যুগে আর কেউ রচনা করতে পারেনি। এটি ল্যাটিন ইংরেজী, হিব্রু প্রভৃতি ভাষায় অনুবাদ করা হয। ইউরোপের মেডিকেল কলেজগুলোতে আল কানুন গ্রন্থটি বহুকাল যাবত পাঠ্য ছিল। আল কানুন ৫টি বিশাল খন্ডে বিভক্ত। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪ লাখেরও বেশী। গ্রন্থটিতে শতাধিক জটিল রোগের কারণ, লক্ষন ও পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হলেন ইবনে সিনা।
আশ শিফা দর্শন শাস্ত্রের একটি অমূল্য গ্রন্থ। এটি ২০ খন্ডে বিভক্ত। এতে রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রাণীতত্ত্ব ও উদ্ভিদতত্ত্ব সহ যাবতীয় বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইবনে সিনা পদার্থ বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গনিত, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি মানুষের কল্যাণ ও জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য আজীবন পরিশ্রম করেছেন। জ্ঞানের সন্ধানে বহু জায়গা ভ্রমন করেছেন।
ইবনে সিনা-ই প্রথম মেনেনজাইটিস রোগটি সনাক্ত করেন। পানি ও ভূমির মাধ্যমে যেসব রোগ ছড়ায় সেগুলো তিনি আবিস্কার করেন। সময়ও গতির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কের কথা তিনিই প্রথম আবিস্কার করেন।
একবার পাশের রাজ্য হামাদানের সুলতান বাদশাহ শাম্স-উদ-দৌলা অসুস্থ হলে ইবন সিনা ৪০ দিন চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। এই চিকিৎসায় খুশি হয়ে সম্রাট তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু রাজনীতিতে ইবনে সিনা বরাবরের মতোই ছিলেন অনাগ্রহী। তাই এই পদপ্রাপ্তি তাঁর জীবনে নতুন বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। তাছাড়া হামাদানের সেনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিদেশি ইবনে সিনাকে সহ্য করতে পারছিল না। তাদের সাথে ইবনে সিনার বিরোধের সৃষ্টি হয়। নানা ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে ফেলে সেনাধ্যক্ষ ইবনে সিনাকে গ্রেফতার করার জন্য সম্রাটের কাছে আবেদন জানাতে থাকে। সৈন্য বাহিনীর প্রধানের অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য সম্রাটের ছিল না। তাই তিনি ইবন সিনাকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে অন্য এক স্থানে কারাবন্দি করে রাখেন। তা নাহলে শত্রুদের হাতে হয়তো তিনি মারা পড়তেন। শত্রুর পাশাপাশি ইবনে সিনার বন্ধুও ছিল অনেক। তাঁদের সহায়তায় ইবনে সিনা এই কারাজীবন থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। হামাদান থেকে পালিয়ে তিনি ইরানের অন্যতম নগরী ইস্পাহানের পথে পা বাড়ান। সুফির বেশে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা ইবনে সিনা একসময় ঘটনাচক্রে ইস্পাহানের রাজদরবারে সমাদৃত হন।
ইস্পাহানের সম্রাট ইতিমধ্যে হামাদানের বিরুদ্ধে অভিযান প্রস্তুত করেন। এ সময় সম্রাট ইবন সিনাকে চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য সাথে নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সম্রাটের অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন নি। ইস্পাহানের সৈন্যবাহিনীর সাথে হামাদানের পথে রওয়ানা করেন। হামাদানের সাথে সিনার অনেক স্মৃতি বিজড়িত ছিল। আর এখানে এসেই তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর এই অসুখ আর সারেনি। হামাদানের যুদ্ধ শিবিরে অবস্থানকালে ইবনে সিনা ১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দে (৪২৮ হিজরীর ৭ রমাদ্বান) ইন্তিকাল করেন।।
ইনসেটেঃ ১. ইবনে সিনা,
২. গবেষণায় মগ্ন মুসলিম বিজ্ঞানী,
৩. আল কানুন গ্রন্থের একটি পাতা।
_______________________
মুহাম্মদ শাহীদ রিজভী,
১ মে, ২০২০খৃঃ,
৭ রমজান, ১৪৪১ হিঃ।