নারী কে?
নারী কে?
খায়রুন্নেছা মিরাজ
নারীদের সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে নারীর সংজ্ঞা বা নারী বলতে আমর কি জানি তা আমাদের জানা থাকা আবশ্যক। المرأة শব্দটি المرء শব্দের স্ত্রী লিঙ্গ, অর্থ নারী। শব্দটি একবচন, এর কোনো বহুবচন হয় না। তবে অপর শব্দ থেকে এ শব্দের বহু বচন হলো نساء। “নারী হলো তারা যাদের আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। মূলত: আল্লাহ তা‘আলা নারীদের পুরুষ হতেই সৃষ্ট করেছেন, যাতে তাদের পরষ্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় ও গভীর হয় এবং তাদের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা ও দয়া-অনুগ্রহ যেন হয়, অতীব সুন্দর ও মধুময়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَبَثَّ مِنۡهُمَا ا كَثِيرٗا وَنِسَآءٗۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِي تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلۡأَرۡحَامَۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيۡكُمۡ رَقِيبٗا ١﴾ [النساء: ١]
“হে মানুষ তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর পর্যবেক্ষক। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১]
﴿وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَحۡمَةًۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢١﴾ [الروم: ٢١]
“আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছ যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে রয়েছে সে কাওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১]
﴿وَٱللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا وَجَعَلَ لَكُم مِّنۡ أَزۡوَٰجِكُم بَنِينَ وَحَفَدَةٗ وَرَزَقَكُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَٰتِۚ أَفَبِٱلۡبَٰطِلِ يُؤۡمِنُونَ وَبِنِعۡمَتِ ٱللَّهِ هُمۡ يَكۡفُرُونَ ٧٢﴾ [النحل: ٧٢]
“আর আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য তোমাদের থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জোড়া থেকে তোমাদের জন্য পুত্র ও নাতিদের সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি তোমাদেরকে পবিত্র রিযিক দান করেছেন তারা কি বাতিলে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর নিআমতকে অস্বীকার করে?”
আয়াত দ্বারা এ কথা স্পষ্ট যে, আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিসসালাম এর স্ত্রী হাওয়া আলাইহাসসালামকে তার থেকেই সৃষ্টি করেছেন। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের উভয় থেকে অসংখ্য নারী ও পুরুষ সৃষ্টি করেছেন। আর এসব সৃষ্টি তিনি করেছেন, বিশেষ একটি পদ্ধতিতে যাকে আমরা বিবাহ বলে আখ্যায়িত করি।
এখানে আরও একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদের সৃষ্টি করেছেন নির্ধারিত ও স্বতন্ত্র কিছু গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে, অনুরূপভাবে নারীদেরও কিছু নির্ধারিত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অবশ্যই তাদের উভয়কে নির্ধারিত ও স্বতন্ত্র যেসব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েই তাদের জীবন যাপন করতে হবে। তারপরও যদি উভয় তাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হতে বের হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে, সে তার মূল স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য হতে দূরে সরে গেল এবং সঠিক পথ হতে ছিটকে পড়ল। বুখারী মুসলিমে আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إنَّ المرأة خلقت من ضلع، وإنَّ أعوج شيءٍ في الضلع أعلاه، فإن ذهبتَ تقيمه كسرته، وإن استمتعتَ بها استمتعتَ بها وفيها عوج»
“নিশ্চয় নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের হাড় থেকে। আর পাঁজরের হাড়ের সবচেয়ে বাঁকা হাড় হলো, উপরি ভাগ। যদি তাকে ঠিক করতে যাও, তাহলে তুমি ভেঙ্গে ফেলবে, আর যদি তুমি তাকে দিয়ে সংসার করতে চাও, তাহলে বাঁকা অবস্থাতেই তোমাকে তার সাথে ঘর সংসার করতে হবে।”
ইমাম নববী রহ. বলেন, এ হাদীসটি প্রমাণ করে যে, ঐ সব ফুকাহাদের কথা সত্য, যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিসসালাম এর পাঁজরের হাড় থেকে হাওয়া আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا﴾ [النساء: ١]
“তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১]
এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা নারীদের সৃষ্টি করার মূল উপাদানেই তাদের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ গুণ দিয়েছেন, যা পুরুষের মধ্যে দেননি এবং পরুষদেরও সৃষ্টি লগ্নে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন যা নারীদের তিনি দেন নি, যার ভিত্তিতেই একজন নারী জীবনের বিভিন্ন সময়, প্রেক্ষাপট ও স্থানকাল পাত্রভেদে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন হয়। কখনো সে মা হয়, কোমল ও দুর্বল হয়, আবার কখনো সে স্ত্রী হয়। নারীরা মনের দিক দিয়ে পুরুষদের অধিক দয়ালু হয়ে থাকে। আর তাদের অবস্থার অধিক পরিবর্তন হয়ে থাকে, যা পুরুষদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। যেমন, তার মাসিক হয়, গর্ভ ধারণ করে, সন্তান প্রসব করে, তারা বাচ্চাদের দুধ পান করায়, বাচ্চাদের লালন-পালন করে, ইত্যাদি। এ সব গুণগুলো হলো নারীদের সাথে খাস ও তাদের একান্ত বৈশিষ্ট্য, যা পুরুষদের মধ্যে চিন্তা করা যায় না। অনুরূপভাবে পুরুষেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো তাদের সাথেই খাস ও তাদের সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, নারীদের জন্য সে গুলো কোনো ক্রমেই প্রযোজ্য নয়।
সুতরাং এক শ্রেণির জন্য যে সব গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তার প্রতি অপর শ্রেণীর কর্ণপাত করার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রত্যকে তার নিজ নিজ দায়-দায়িত্ব যথাযথ আঞ্জাম দিতে চেষ্টা করবে। নারীরা যদি বলে আমরা যেমন সন্তান ধারণ করি, অনুরূপভাবে পুরুষদেরও সন্তান ধারণ করতে হবে! তাহলে তা কি কোনো দিন সম্ভব? অনুরূপ ভাবে নারীরা যদি বলে পুরুষরা যা যা করে আমরাও তাই করবো, তাও কোনো দিন সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই নারী ও পরুষদের সতন্ত্র বৈশিষ্ট দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে আলাদা আলাদা যোগ্যতা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَتَمَنَّوۡاْ مَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بِهِۦ بَعۡضَكُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖۚ لِّلرِّجَالِ نَصِيبٞ مِّمَّا ٱكۡتَسَبُواْۖ وَلِلنِّسَآءِ نَصِيبٞ مِّمَّا ٱكۡتَسَبۡنَۚ وَسَۡٔلُواْ ٱللَّهَ مِن فَضۡلِهِۦٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٣٢﴾ [النساء: ٣٢]
“আর তোমরা আকাংখা করো না সে সবের যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের একজনকে অন্য জনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। পুরষদের জন্য রয়েছে অংশ, তারা যা উপার্জন করে তা থেকে এবং নারীদের জন্য রয়েছে অংশ, যা তারা উপার্জন করে তা থেকে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ চাও। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সম্যক জ্ঞানী।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩২]
﴿ٱلرِّجَالُ قَوَّٰمُونَ عَلَى ٱلنِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بَعۡضَهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖ وَبِمَآ أَنفَقُواْ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ﴾ [النساء: ٣٤]
“পরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের ওপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৪]
পুরুষ নারীদের ওপর ক্ষমতাধর হওয়ার বিষয়টি হলো, আল্লাহর অপার অনুগ্রহ, তিনি কতককে কতকের ওপর বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা পুরুষদের এমন কতক বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন, যে গুলা মহিলাদের দেওয়া হয় নি। যেমন, পুরুষরা জ্ঞানে পরিপূর্ণ, নারীদের তুলনায় অধিক ধৈর্যশীল, তারা অধিক শক্তিশালী, তারা ক্ষেতে খামারে কাজ করতে পারে, যে কোনো ভারি কাজ তারা করতে পারে ইত্যাদি। এ ছাড়াও আল্লাহ তাদের এধরনের কিছু গুন দিয়েছে যে গুলো নারীদের মধ্যে নেই। এ কারণেই আল্লাহ নারীদের পুরুষদের ওপর কিছু অধিকার দিয়েছে, যে গুলো তার শক্তি সামর্থ্য ও স্বভাবের সাথে একাকার ও অভিন্ন। আবার পুরুষদের জন্য নারীদের ওপর কিছু অধিকার দিয়েছেন, যে গুলোর সাথে তার শক্তি সামর্থ্য ও স্বভাবের সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। নারীদের দেওয়া দায়-দায়িত্ব গুলো পরুষদের দ্বারা আদায় করা কোনো দিন সম্ভব নয়।
এ ভাবেই আল্লাহ তা‘আলা নারী ও পুরুষের সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের উভয়ের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন, যাতে দুনিয়ার নিয়ম ও ধারাবাহিকতা ঠিক থাকে এবং কোথাও যেন কোনো প্রকার অসামঞ্জস্যতা এ শূন্যতা দেখা না দেয়। কিন্তু যদি আল্লাহর সৃষ্টির বাইরে গিয়ে এক শ্রেণির দায়-দায়িত্ব নিয়ে অপর শ্রেণি টান-হে-ছড়া করে, তাহলে পৃথিবীর ভারসাম্য বিনষ্ট হবে, মানবতা চরম অবনতির দিকে যাবে এবং মানবতার অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে।
মানব জাতির প্রকৃত সম্মান কী?
মানবজাতির জন্য প্রকৃত সম্মান কী? তা আমাদের অবশ্যই জানা থাকা দরকার। আমরা অনেকেই মনে করি টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, ইত্যাদিতেই মানুষের প্রকৃত সম্মান, আবার কেউ মনে করি ক্ষমতা ও রাজত্ব ইত্যাদিতে প্রকৃত সম্মান। কিন্তু কুরআন ও হাদীসের প্রমাণাদিতে চিন্তা-গবেষণা করলে, আমরা দেখতে পাই যে, মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদত্ত সম্মান দুই ধরনের হতে পারে:
এক. সাধারণ সম্মান, যার বর্ণনা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই কুরআনে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدۡ كَرَّمۡنَا بَنِيٓ ءَادَمَ وَحَمَلۡنَٰهُمۡ فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ وَرَزَقۡنَٰهُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَفَضَّلۡنَٰهُمۡ عَلَىٰ كَثِيرٖ مِّمَّنۡ خَلَقۡنَا تَفۡضِيلٗا ٧٠﴾ [الاسراء: ٧٠]
“আর আমরা তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমরা তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিযিক। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের ওপর আমরা তাদেরকে অনেক মর্যাদা দিয়েছি। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৭০]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবন কাসীর রহ. বলেন, আয়াতে আল্লাহ সংবাদ দেন যে, তিনি আদম সন্তানদের সুন্দর ও নিখুঁত আকৃতিতে সৃষ্টি করার মাধ্যমে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ সম্মান ও মহা মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা মানবকে এমন আকৃতিতে তৈরি করেছেন, যার কোনো তুলনা অন্য কোনো মাখলুকের সাথে চলে না। আল্লাহ তা‘আলা অন্য কোনো মাখলুককে জ্ঞান দেন নি। দুনিয়া পরিচালনার দায়িত্ব দেন নি একমাত্র মানবই জগতের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে।
অর্থাৎ তারা তাদের দু-পায়ের উপর দাঁড়িয়ে চলাচল করে, দু হাত দিয়ে খায়, কথা বলতে পারে ইত্যাদি। অথচ মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীব জন্তু চার পায়ের ওপর হাটে, তারা হাতে তুলে খেতে পারে না বরং মুখ দিয়ে খায়। আর আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির জন্য চোখ, কান ও হাত-পা দিয়েছেন, যেগুলোর মাধ্যমে তারা দেখতে ও শোনতে পায় এবং অন্তর দিয়ে বুঝতে ও অনুভব করতে পারে। তারা তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দ্বারা উপকৃত হয়, যেমন, এ সব দ্বারা তারা বিভিন্ন ধরনের কাজ কর্ম, ভালো মন্দের বিচার এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কোনোটি উপকার কোনোটি ক্ষতি তা বিবেচনা করতে পারে।
দুই. বিশেষ সম্মান। এটি হলো আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে এ দীনের প্রতি হিদায়াত দেওয়া এবং মহান রাব্বুল আলামীনের আনুগত্যের তাওফীক লাভ করা। আর এটিই হলো, প্রকৃত সম্মান, পরিপূর্ণ ইজ্জত ও দুনিয়াও আখিরাতের চিরস্থায়ী কল্যাণ। কারণ, ইসলাম হলো আল্লাহ তা‘আলার মনোনীত দীন, এ দীনই হলো, ইজ্জত-সম্মান ও মান-মর্যাদার একমাত্র মাপকাঠি। আর এ কথা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, যাবতীয় ইজ্জত কেবল আল্লাহর জন্য, তার রাসূলের জন্য এবং মুমিন বান্দাদের জন্য। আল্লাহর বড়ত্বের প্রতি বিশ্বাস, তার মমত্বের প্রতি অনুগত হওয়া এবং তার আদেশ-নিষেধ মানার মধ্যেই আল্লাহ তা‘আলার সম্মান যে নিহিত সে কথার ঘোষণা দিয়ে পবিত্র কুরআনে বলেন,
﴿أَلَمۡ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ يَسۡجُدُۤ لَهُۥۤ مَن فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَن فِي ٱلۡأَرۡضِ وَٱلشَّمۡسُ وَٱلۡقَمَرُ وَٱلنُّجُومُ وَٱلۡجِبَالُ وَٱلشَّجَرُ وَٱلدَّوَآبُّ وَكَثِيرٞ مِّنَ ٱلنَّاسِۖ وَكَثِيرٌ حَقَّ عَلَيۡهِ ٱلۡعَذَابُۗ وَمَن يُهِنِ ٱللَّهُ فَمَا لَهُۥ مِن مُّكۡرِمٍۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَفۡعَلُ مَا يَشَآءُ۩ ١٨﴾ [الحج: ١٨]
“তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে সাজদাহ করে যা কিছু রয়েছে আসমানসমূহে এবং যা কিছু রয়েছে যমীনে, সুর্য, চাদ, তারকারাজী, পর্বতমালা, বৃলতা, জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে অনেকে। আবার অনেকের ওপর শাস্তি অবধারিত হয়ে আছে। আল্লাহ যাকে অপমানিত করেন, তার সম্মানদাতা কেউ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ যা ইচ্ছা তাই করেন।” [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ১৮]
মনে রাখতে হবে, যাকে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনা ও বিশ্বাসের তাওফীক দেওয়া হয় নি, যার ফলে রহমানের ইবাদতকে সে করনীয় মনে করেনি, সে প্রকৃত পক্ষে অপদস্থ ও অসম্মানিত, তার সম্মান লাভের কোনো উপায় নেই। আল্লাহর পক্ষ হতে তার প্রতি কোনো প্রকার সম্মান প্রদর্শন করা হবে না।
দুনিয়াতে মানুষ তার ঈমান-আমল, কথা-কাজ ও বিশ্বাস অনুযায়ীই ইজ্জত-সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়ে থাকে। যার মধ্যে যত বেশি ঈমান আমল থাকবে, সেই তত বেশি ইজ্জত সম্মানের অধিকারী হবে। দীনকে বাদ দিয়ে যে ব্যক্তি ইজ্জত-সম্মান তালাশ করে, সে অবশ্যই পদে পদে লাঞ্ছিত হবে। ইসলামের বাহিরে গিয়ে কেউ সম্মানের অধিকারী হতে পারে না। সুতরাং ইসলামের বাহিরে গিয়ে যে সম্মান চায়, তাকে কোনো সম্মান দেওয়া হবে না, বরং তাকে অপমান করা হবে।
এখানে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, প্রথম প্রকার সম্মান লাভ করা আল্লাহর তা‘আলার পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা মানব সৃষ্টির সাথে তাদের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য গুলো দিয়েই তৈরি করেন। তাতে মানুষের কোনো দখল নেই। আর একজন যখন প্রথম প্রকার সম্মান লাভে ধন্য হয়, তা তাকে বাধ্য করে যাতে সে দ্বিতীয় প্রকার সম্মানও লাভ করে। “যাকে আল্লাহ তা‘আলা যাকে ধন-সম্পদ, টাকা পয়সা, শক্তি, সামর্থ্য ও সুস্থতা দিয়েছে, তার ওপর কর্তব্য হলো, সে যেন তার প্রচেষ্টাকে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে নিয়োজিত করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। অন্যথায় আল্লাহ তা‘আলা তাকে কিয়ামতের দিন তাকে দেয় নি‘আমতগুলির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবে। ইমাম মুসলিম স্বীয় কিতাব সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করল যে, আমরা আমাদের প্রভুকে কিয়ামতের দিনে দেখতে পাব কি? তখন তিনি বললেন,
«هل تضارون في رؤية الشمس في الظهيرة ليست في سحابة؟ قالوا: لا قال: فهل تضارون في رؤية القمر ليلة البدر ليس في سحابة؟ قالوا: لا، قال: فوالذي نفسي بيده لا تضارون في رؤية ربِّكم إلاَّ كما تضارون في رؤية أحدهما، قال: فيلقى العبد فيقول: أي فُلْ ألم أُكرمْك وأُسوِّدك وأُزوِّجك وأُسخِّر لك الخيلَ والإبل وأذرك ترأس وترْبع؟ فيقول: بلى، قال: فيقول: أفظننت أنَّك ملاقيّ؟ فيقول: لا، فيقول: فإنِّي أنساك كما نسيتني، ثم يلقى الثاني فيقول: أي فل ألم أكرمك وأُسوِّدك وأُزوِّجك وأُسخِّر لك الخيلَ والإبل وأذرك ترأس وترْبع؟ فيقول: بلى أي ربّ، فيقول: أفظننت أنَّك ملاقيّ؟ فيقول: لا، فيقول: فإنِّي أنساك كما نسيتني، ثم يلقى الثالث فيقول له مثل ذلك فيقول: يا ربِّ آمنت بك وبكتابك وبرسلك، وصلّيتُ وصمت وتصدّقتُ، ويثني بخيرٍ ما استطاع، فيقول: هنا إذاً، قال: ثم يقال له: الآن نبعث شاهداً عليك، ويتفكّر في نفسه من ذا الذي يشهد عليَّ؟! فيختم على فيه ويقال لفخذه ولحمه وعظامه: أنطقي فتنطق فخذه ولحمه وعظامه بعمله، وذلك ليعذر من نفسه، وذلك المنافق، وذلك الذي يسخط اللهُ عليه»
“পরিষ্কার আকাশে যখন কোনো মেঘের আবরণ না থাকে, তখন কি তোমাদের সূর্য দেখতে কোনো কষ্ট হয়? তারা বলল, না। তিনি আরও বললেন পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখতে কি তোমাদের কষ্ট হয়? তারা বলল, না। তখন তিনি বললেন, পূর্ণিমার রাতে চাঁদ দেখতে তোমাদের যেমন কোনো প্রকার কষ্ট হয় না, অনুরুপভাবে কিয়ামতে দিন আল্লাহকে দেখতেও তোমাদের কোনো প্রকার কষ্ট হবে না। তারপর বান্দা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করলে, আল্লাহ তাকে ডেকে বলবে, বলতো দেখি, আমি কি তোমাকে সম্মান দেইনি, তোমাকে ক্ষমতা দেই নি, তোমাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করি নি, তোমাদের জন্য উট ও ঘোড়াকে অনুগত করি নি এবং আমি কি তোমাদের স্বাধীনতা দেই নি? তখন বান্দা বলবে, অবশ্যই, তুমি আমাদের যাবতীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে ক্ষমতা দিয়েছ! তাহলে তোমরা কি এ কথা বিশ্বাস করতে যে, একদিন তোমাকে আমার সাথে সাক্ষাত করতে হবে? তখন সে বলবে, না! তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবে, আজকের দিন আমি তোমাকে ভূলে যাব, যেমনটি তুমি আমাকে দুনিয়াতে ভুলে গিয়েছিলে! তারপর আল্লাহ অপর এক বান্দার প্রতি লক্ষ করে বলবে, বলতো দেখি আমি কি তোমাকে সম্মান দেই নি, তোমাকে ক্ষমতা দেই নি, তোমাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করি নি, তোমাদের জন্য উট ও ঘোড়াকে অনুগত করি নি এবং আমি কি তোমাদের স্বাধীনতা দেই নি? তখন বান্দা বলবে, অবশ্যই, তুমি আমাদের জন্য যাবতীয় বিষয়গুলো ব্যাপারে ক্ষমতা দিয়েছ! তোমরা কি এ কথা বিশ্বাস করতে যে, একদিন তোমাকে আমার সাথে সাক্ষাত করতে হবে? তখন সে বলবে না! তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবে, আজকের দিন আমি তোমাকে ভূলে যাব, যেমনটি তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছিলে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তৃতীয় লোকটির সাক্ষাতকার নিবে এবং তাকেও অনুরূপ প্রশ্ন করা হবে, তখন সে উত্তরে বলবে, হে আমার রব! আমি তোমার প্রতি বিশ্বাস করছি, তোমার অবতীর্ণ কিতাব ও প্রেরিত রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি, সালাত আদায় করছি, রোজা রেখেছি ও দান খয়রাত করেছি। তারপর যথাসম্ভব সে উত্তম প্রসংশা করবে। তখন সে বলবে, তোমাকে ধন্যবাদ জানানো হলো, এরপর তাকে বলা হবে, তোমার বিপক্ষে কি সাক্ষ্য উপস্থিত করব? এ কথা শোনে লোকটি চিন্তায় পড়ে যাবে, কে তার বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে? তখন আল্লাহ তা‘আলা তার মুখে তালা দিয়ে দেবে। (মুখে সে আর কোনো কথা বলতে পারবে না) আর তার উরু, গোশত ও হাড়গুলোকে বলা হবে, তোমরা কথা বল, তখন তারা ষতার বিপক্ষে কথা বলবে, তার উরু, গোশত ও হাড়গুলো তার কর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। আর এ সব আল্লাহ তা‘আলা এ জন্য করবেন, যাতে সে নিজেকে অপরাধি সাব্যস্ত করতে পারে। আর এ লোকটি হলো, মুনাফেক। আল্লাহ তা‘আলা এ লোকটির ওপরই ক্ষুব্ধ। কিয়ামতের দিন তার ওপর অধিক ক্ষুব্ধ হবেন।”[2]
হাদীস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার বান্দাদের একজনকে যে, সুস্থতা, ধন-সম্পদ, ঘর-বাড়ী, টাকা- পয়সা ইত্যাদি নি‘আমত দিয়েছেন, সে সম্পর্কে তাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করবে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা-তো তাকে এ সব নি‘আমত এ জন্য দিয়েছেন, যাতে সে এগুলোকে আল্লাহর বন্দেগীতে কাজে লাগায় এবং আল্লাহর রাহে তা ব্যয় করে। কিন্তু যদি সে তা না করে, অন্যায় কাজ করে, আল্লাহর নাফরমানী করে এবং অন্য কোনো বিপথে কাজে লাগায়, তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে অবশ্যই তার নি‘আমতের হিসাব দিতে হবে।
ইসলামে নারীর সম্মান
একমাত্র ইসলামই মুসলিম নারীদেরকে ইসলামের নির্ভুল দিক-নির্দেশনা ও বাস্তবধর্মী নীতি মালার মাধ্যমে তাদের যাবতীয় অসম্মান ও অবমাননা থেকে রক্ষা করেছে। ইসলাম তাদের নিরাপত্তা বিধান করেছে, তাদের সম্ভ্রম রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের যাবতীয় কল্যাণের নিশ্চয়তা দিয়েছে। দুনিয়াও আখিরাতের সফলতা লাভের জন্য সব ধরনের পথ তাদের জন্য উন্মুক্ত করেছে। ইসলামই তাদের জন্য সুন্দর ও আনন্দদায়ক জীবন নিশ্চিত করেছে। সব ধরনের ফিতনা, ফ্যাসাদ, অন্যায় ও অনাচার থেকে ইসলাম নারীদের হিফাযত করেছে। ইসলাম তাদের প্রতি কোনো প্রকার বৈষম্য, যুলুম ও নির্যাতন করার সব পথকে রুদ্ধ করেছে। আর এগুলো সবই হলো, তার বান্দাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা অপার অনুগ্রহ, বিশেষ করে নারী জাতির প্রতি। কারণ, তিনি তাদের জন্য এমন এক শরী‘আত নাযিল করেছেন, যা তাদের কল্যাণকে নিশ্চিত করে, ফিতনা- ফ্যাসাদ থেকে তাদের হিফাযত করে, তাদের হঠকারিতা দূর ও তাদের যাবতীয় কল্যাণ নিশ্চিত করে। আল্লাহ তা‘আলা ইসলামকে আমাদের জন্য এক বিশাল নি‘আমত হিসেবে দিয়েছেন। বিশেষ করে, ইসলামই আমাদের- এক কথায় আমাদের নারীদের জন্য নিরাপত্তা-স্থল ও আশ্রয় কেন্দ্র। যারা ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় নেবে, তারাই নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারবে। বরং ইসলাম সমাজকে সব ধরনের অন্যায়-অনাচার হতে রক্ষা করে। সমাজে যাতে কোনো প্রকার বিপদ-আপদ, ঝগড়া-বিবাদ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, তার জন্য ইসলামই একমাত্র গ্যারান্টি। ইসলাম এ সব থেকে সমাজকে রক্ষা করে এবং একটি উন্নত সমাজ জাতির জন্য নিশ্চিত করে।
আর যখন সমাজ থেকে নারীদের সাথে সম্পৃক্ত বিধানগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন সমাজে অন্যায়, অনাচার, ঝগড়া, বিবাদ ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পায়। নারীদের কোনো নিরাপত্তা সে সমাজে অবশিষ্ট থাকে না।
আর মানবজাতির ইতিহাস হলো এর জ্বলন্ত ও উৎকৃষ্ট প্রমাণ, কারণ, যে ব্যক্তি পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে নজর দেবে, সে অবশ্যই দেখতে পাবে, পৃথিবীতে বড় বড় বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হলো, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, নৈতিক পতন, বেহায়াপনা ও বেলাল্লাপনার বিস্তার, অবাধে অন্যায়-অত্যাচার সংঘটিত হওয়া ইত্যাদি। আর সমাজে এ গুলো বিস্তারের পিছনে মূল কারণ হলো, নারীদের অবাধ চলা ফেরা, নারীরা পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশা করা, সাজ-সজ্জা অবলম্বন, বেপর্দা হয়ে ঘর থেকে বের হওয়া, অপরিচিত লোকদের সাথে তাদের ওঠবস, লোক সমাজে তারা অত্যন্ত সুন্দর কাপড় পরিধান করে কোনো প্রকার লজ্জা-শরম ছাড়াই বের হওয়া।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, সব ধরনের অনিষ্ট ও বিপদ-আপদের মূল কারণ হলো, নারীদের পুরুষদের সাথে অবাধ চলা ফেরা করতে সুযোগ পাওয়া। আর এটাই হলো বড় কারণ, দুনিয়াতে ব্যাপক হারে আযাব নাযিল হওয়ার জন্য। অনুরূপভাবে নারীদের কারণেই সর্বসাধারণ হোক কিংবা বিশেষ লোক, সবার ওপর বিপর্যয় নেমে আসে, সবাইকে আল্লাহর আযাবে আক্রান্ত হতে হয়।
মনে রাখতে হবে, নারীদের অবাধ মেলামেশার কারণেই সমাজে অন্যায়, অনাচার, অশ্লীলতা, যেনা ব্যভিচার বৃদ্ধি পায়, সমাজের সুনাম সুখ্যাতি বিনষ্ট হয়। আর এ সব হলো, সমাজের জন্য বড় ধরনের মহামারি ও আযাবের কারণ। মুসা আলাইহিস সালামের সৈন্যদের মধ্যে যখন নারীরা প্রবেশ করল, তখন তাদের মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ল এবং তারা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ল। যার ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর এমন আযাব পাঠালেন, একদিনেই তাদের সত্তর হাজার লোক একসাথে মারা গেল। এ ঘটনা তাফসীরের কিতাবসমূহে বিখ্যাত।
ইসলামের আগমন হয়েছে মানব জাতিকে আপদ-বিপদ হতে রক্ষা করা এবং মানবতাকে চিকিৎসা ও সংশোধন করার জন্য, যাতে সমাজে যে সব ফিতনা-ফ্যাসাদ দেখা দেয় এবং বিপর্যয় নেমে আসে তা থেকে মানবতাকে মুক্ত করা যায়। ইসলাম হলো মূলতঃ এমন একটি পবিত্র শিক্ষা, যা মানুষকে ধ্বংস ও অশ্লীল কার্যকলাপ হতে রক্ষা করে। এ জন্য বলাবাহুল্য যে, ইসলাম হলো আল্লাহর পক্ষ হতে মানব জাতির জন্য বিশেষ রহমত, যা দ্বারা বান্দাদের আত্ম মর্যাদার সংরক্ষণ হয় এবং তাদেরকে দুনিয়াতে অপমান অপদস্থ হওয়া ও আখিরাতের আযাব হতে রক্ষা করে।
হাদীস-কুরআন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, নারীদের ফিতনার কারণেই দেশ ও সমাজে ফিতনা ফাসাদ, অনিষ্টতা ও এমন এমন বিপর্যয় দেখা দেয়, যার পরিণতি ও শাস্তি যে কত ভয়াবহ, তা আয়ত্ত করা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে উসামা ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ما تركتُ بعدي فتنةً أضرَّ على الرجال من النساء»
“আমার পর পুরুষদের জন্য নারীদের ফিতনার চেয়ে মারাত্মক ও ক্ষতিকর আর কোনো ফিতনা আমি রেখে যাই নি।”[3]
এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা আলাদা নীতিমালা আরোপ করেছেন, যেগুলো মেনে চললে এবং সমাজে বাস্তবায়ন করলে যাবতীয় কল্যাণ ও দুনিয়া আখিরাতের সম্মান লাভ করা যাবে। সমাজ বা দেশে কোনো প্রকার ফিতনা, ফাসাদ আর অবশিষ্ট থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُل لِّلۡمُؤۡمِنِينَ يَغُضُّواْ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِمۡ وَيَحۡفَظُواْ فُرُوجَهُمۡۚ ذَٰلِكَ أَزۡكَىٰ لَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا يَصۡنَعُونَ ٣٠ وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ ٣١ ﴾ [النور: ٣٠، ٣١]
“মুমিন পুরুষদের বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জা-স্থানের হিফাজত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩০-৩১]
﴿يَٰنِسَآءَ ٱلنَّبِيِّ لَسۡتُنَّ كَأَحَدٖ مِّنَ ٱلنِّسَآءِ إِنِ ٱتَّقَيۡتُنَّۚ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِٱلۡقَوۡلِ فَيَطۡمَعَ ٱلَّذِي فِي قَلۡبِهِۦ مَرَضٞ وَقُلۡنَ قَوۡلٗا مَّعۡرُوفٗا ٣٢ وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ٣٣ ﴾ [الاحزاب: ٣٢، ٣٣]
“হে নবী-পত্নীগণ, তোমরা অন্য কোনো নারীর মতো নও। যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে (পরপুরুষের সাথে) কোমল কণ্ঠে কথা বলো না। তাহলে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, সে প্রলুব্ধ হয়। আর তোমরা ন্যায় সংগত কথা বলবে। আর তোমরা তোমাদের নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলী যুগের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩২-৩৩]
এ বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহের বর্ণনা অনেক। ইসলাম নারীদের বিষয়ে যে সব বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, তা মানুষের অকল্যাণ বা তাদের স্বাধীনতা হরণ করার জন্য করে নি, বরং তা করা হয়েছে সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা, সামাজিক আত্ম-মর্যাদাবোধ ও সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষে।
ইসলাম নারীদের জন্য যে সব বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, তা তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার জন্য করেনি, বরং তারা যাতে কোনো প্রকার অন্যায় ও অশ্লীল কাজে জড়িয়ে না পড়ে, নিরাপত্তা-হীনতায় না পড়ে, সে জন্যই তাদের ওপর এ সব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তাদের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করার মাধ্যমে, নারীদের অশ্লীল কাজের দিকে নিয়ে যায়, এমন সব ধরনের উপায় উপকরণ বন্ধ করে দিয়েছেন। আর এটিই হলো নারীদের জন্য সত্যিকার সম্মান ও মর্যাদা।
নারীদের অধিকার বিষয়ে কুরআনের দিক নির্দেশনা
পবিত্র কুরআন, যাকে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের জন্য বিশেষ রহমত ও অনুপম আদর্শ হিসেবে দুনিয়াতে নাযিল করেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি তার আয়াতসমূহে গভীরভাবে চিন্তা করে, সে অবশ্যই দেখতে পাবে, আল্লাহ তা‘আলা নারীদের বিষয়ে কতই না সুন্দর ব্যবস্থা রেখেছেন এবং নারীদের অধিকারকে তিনি কতই না গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সমুন্নত রেখেছেন। আল্লাহ তা‘আলা নারীদের অধিকারকে সংরক্ষণ করার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। আর যারা নারীদের অধিকার নষ্ট করে এবং তাদের ওপর যুলুম, অত্যাচার ও তাদের সাথে বিমাতা-সুলভ আচরণ করে, তাদের বিষয়ে তিনি কঠিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। নারীদের অধিকার বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত নাযিল করেছেন। এমনকি নারীদের নামে একটি সূরাও নাযিল তিনি নাযিল করেন, যার নাম সূরা আন-নিসা। যার মধ্যে এমন সব আয়াত রয়েছে, যেগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা নারীদের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন আহকাম আলোচনা করেন। তাদের সামাজিক মর্যাদা, পুরুষদের প্রতি তাদের করণীয়, নারী অধিকার, বিবাহ, ঘর-সংসার, তালাক ইত্যাদি এ সূরাতে স্থান পায়। কুরআন নারীদের সাথে আচরণের বিষয়ে যে সব দিক নির্দেশনা দিয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করা হল।
এক. নারীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা
আল্লাহ তা‘আলা নারীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতে আদেশ দেন এবং তাদের সাথে কোনো প্রকার দুর্ব্যবহার করতে নিষেধ করেন। তাদের সাথে যেন কোনো প্রকার অনিয়ম না হয় এবং আল্লাহর দেওয়া বিধান ও যাবতীয় আইনকানুন মেনে চলা হয়, তার জন্য তিনি বিশেষ নির্দেশ দেন। আর যারা তাদের ওপর যুলুম-অত্যাচার করে, আল্লাহ তা‘আলার বেধে দেওয়া সীমারেখা অতিক্রম করে এবং সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে, তাদের তিনি বিশেষ সতর্ক করেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন
﴿فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُۥ مِنۢ بَعۡدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوۡجًا غَيۡرَهُۥۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِمَآ أَن يَتَرَاجَعَآ إِن ظَنَّآ أَن يُقِيمَا حُدُودَ ٱللَّهِۗ وَتِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوۡمٖ يَعۡلَمُونَ ٢٣٠ وَإِذَا طَلَّقۡتُمُ ٱلنِّسَآءَ فَبَلَغۡنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمۡسِكُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٍ أَوۡ سَرِّحُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٖۚ وَلَا تُمۡسِكُوهُنَّ ضِرَارٗا لِّتَعۡتَدُواْۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ فَقَدۡ ظَلَمَ نَفۡسَهُۥۚ وَلَا تَتَّخِذُوٓاْ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ هُزُوٗاۚ وَٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتَ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَمَآ أَنزَلَ عَلَيۡكُم مِّنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَٱلۡحِكۡمَةِ يَعِظُكُم بِهِۦۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٞ ٢٣١ وَإِذَا طَلَّقۡتُمُ ٱلنِّسَآءَ فَبَلَغۡنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا تَعۡضُلُوهُنَّ أَن يَنكِحۡنَ أَزۡوَٰجَهُنَّ إِذَا تَرَٰضَوۡاْ بَيۡنَهُم بِٱلۡمَعۡرُوفِۗ ذَٰلِكَ يُوعَظُ بِهِۦ مَن كَانَ مِنكُمۡ يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۗ ذَٰلِكُمۡ أَزۡكَىٰ لَكُمۡ وَأَطۡهَرُۚ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٢٣٢﴾ [البقرة: ٢٣٠، ٢٣٢]
“অতএব, যদি সে তাকে তালাক দেয় তাহলে সে পুরুষের জন্য হালাল হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ভিন্ন একজন স্বামী সে গ্রহণ না করে। অতঃপর সে (স্বামী) যদি তাকে তালাক দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের অপরাধ হবে না যে, তারা একে অপরের নিকট ফিরে আসবে, যদি দৃঢ় ধারণা রাখে যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা কায়েম রাখতে পারবে। আর এটা আল্লাহর সীমারেখা, তিনি তা এমন সম্প্রদায়ের জন্য স্পষ্ট করে দেন, যারা বুঝে।
আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে অতঃপর তারা তাদের ইদ্দতে পৌঁছে যাবে তখন হয়তো বিধি মোতাবেক তাদেরকে রেখে দেবে অথবা বিধি মোতাবেক তাদেরকে ছেড়ে দেবে। তবে তাদেরকে কষ্ট দিয়ে সীমালঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে তাদেরকে আটকে রেখো না। আর যে তা করবে সে তো নিজের প্রতি যুলুম করবে। আর তোমরা আল্লাহর আয়াতসমূহকে উপহাসরূপে গ্রহণ করো না। আর তোমরা স্মরণ কর তোমাদের ওপর আল্লাহর নিআমত এবং তোমাদের ওপর কিতাব ও হিকমত যা নাযিল করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন। আর আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ যে, নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয় সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত।
আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে অতঃপর তারা তাদের ইদ্দতে পৌঁছবে তখন তোমরা তাদেরকে বাধা দিয়ো না যে, তারা তাদের স্বামীদেরকে বিয়ে করবে যদি তারা পরস্পরে তাদের মধ্যে বিধি মোতাবেক সম্মত হয়। এটা উপদেশ তাকে দেওয়া হচ্ছে, যে তোমাদের মধ্যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে। এটি তোমাদের জন্য অধিক শুদ্ধ ও অধিক পবিত্র। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২২৯-২৩২]
দুই. নারীদের জন্য খরচা করার বিধান:-
আল্লাহ তা‘আলা নারীদের ওপর ব্যয় করার বিষয়ে নিখুঁত একটি নীতিমালা তৈরি করে দিয়েছেন। আল্লাহর নির্দেশ হলো, যখন নারীদের সাথে ঘর সংসার করবে, তখন তাদের যাবতীয় খরচা তোমরাই বহন করবে। আর যদি তাদের সাথে ঘর সংসার করা কোনোভাবেই সম্ভব না হয়, তখন তোমরা দয়া ও অনুগ্রহের সাথে তাদের ছেড়ে দেবে। কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি করবে না। আর তোমাদের এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তোমরা সর্বদা তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَّا جُنَاحَ عَلَيۡكُمۡ إِن طَلَّقۡتُمُ ٱلنِّسَآءَ مَا لَمۡ تَمَسُّوهُنَّ أَوۡ تَفۡرِضُواْ لَهُنَّ فَرِيضَةٗۚ وَمَتِّعُوهُنَّ عَلَى ٱلۡمُوسِعِ قَدَرُهُۥ وَعَلَى ٱلۡمُقۡتِرِ قَدَرُهُۥ مَتَٰعَۢا بِٱلۡمَعۡرُوفِۖ حَقًّا عَلَى ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٢٣٦ وَإِن طَلَّقۡتُمُوهُنَّ مِن قَبۡلِ أَن تَمَسُّوهُنَّ وَقَدۡ فَرَضۡتُمۡ لَهُنَّ فَرِيضَةٗ فَنِصۡفُ مَا فَرَضۡتُمۡ إِلَّآ أَن يَعۡفُونَ أَوۡ يَعۡفُوَاْ ٱلَّذِي بِيَدِهِۦ عُقۡدَةُ ٱلنِّكَاحِۚ وَأَن تَعۡفُوٓاْ أَقۡرَبُ لِلتَّقۡوَىٰۚ وَلَا تَنسَوُاْ ٱلۡفَضۡلَ بَيۡنَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٌ ٢٣٧﴾ [البقرة: ٢٣٦، ٢٣٧]
“তোমাদের কোনো অপরাধ নেই যদি তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এমন অবস্থায় যে, তোমরা তাদেরকে স্পর্শ কর নি কিংবা তাদের জন্য কোনো মোহর নির্ধারণ করনি। আর উত্তমভাবে তাদেরকে ভোগ-উপকরণ দিয়ে দাও, ধনীর ওপর তার সাধ্যানুসারে এবং সংকটাপন্নের ওপর তার সাধ্যানুসারে। সুকর্মশীলদের ওপর এটি আবশ্যক।
আর যদি তোমরা তাদেরকে তালাক দাও, তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে এবং তাদের জন্য কিছু মোহর নির্ধারণ করে থাক, তাহলে যা নির্ধারণ করেছ, তার অর্ধেক (দিয়ে দাও)। তবে স্ত্রীরা যদি মাফ করে দেয়, কিংবা যার হাতে বিবাহের বন্ধন সে যদি মাফ করে দেয়। আর তোমাদের মাফ করে দেওয়া তাকওয়ার অধিক নিকটতর। আর তোমরা পরস্পরের মধ্যে অনুগ্রহ ভুলে যেয়ো না। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৩৬-২৩৭]
তিন. স্ত্রীদের মোহরানা পরিশোধ করা ফরয
আল্লাহ তা‘আলা স্বামীদের ওপর তাদের স্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত মোহরানা আদায় করাকে ফরয করে দিয়েছেন। তাদের নির্ধারিত মোহরানাতে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করাকে আল্লাহ তা‘আলা অবৈধ বা হারাম করে দিয়েছেন। তবে যদি স্ত্রী তার নিজের পক্ষ হতে কিছু কমিয়ে দেয় বা ক্ষমা করে দেয় সেটা হলো, ভিন্ন কথা। তখন তা হতে গ্রহণ করা স্বামীর জন্য অবশ্যই হালাল হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন
﴿وَءَاتُواْ ٱلنِّسَآءَ صَدُقَٰتِهِنَّ نِحۡلَةٗۚ فَإِن طِبۡنَ لَكُمۡ عَن شَيۡءٖ مِّنۡهُ نَفۡسٗا فَكُلُوهُ هَنِيٓٔٗا مَّرِيٓٔٗا ٤﴾ [النساء: ٤]
“আর তোমরা নারীদেরকে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও, অতঃপর যদি তারা তোমাদের জন্য তা থেকে খুশি হয়ে কিছু ছাড় দেয়, তাহলে তোমরা তা সানন্দে তৃপ্তিসহকারে খাও।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪]
চার. নারীদের জন্য মালিকানা প্রতিষ্ঠা
আল্লাহ তা‘আলা নারীদের জন্য উত্তরাধিকারী সম্পত্তিতে অংশ নির্ধারণ করেন। ফলে তাদের মাতা-পিতা, সন্তানাদি বা নিকট আত্মীয় কেউ মারা গেলে তারাও পুরুষদের মতো সম্পত্তির মালিক হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لِّلرِّجَالِ نَصِيبٞ مِّمَّا تَرَكَ ٱلۡوَٰلِدَانِ وَٱلۡأَقۡرَبُونَ وَلِلنِّسَآءِ نَصِيبٞ مِّمَّا تَرَكَ ٱلۡوَٰلِدَانِ وَٱلۡأَقۡرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنۡهُ أَوۡ كَثُرَۚ نَصِيبٗا مَّفۡرُوضٗا ٧﴾ [النساء: ٧]
“পুরুষদের জন্য মাতা পিতা ও নিকটাত্মীয়রা যা রেখে গিয়েছে তা থেকে একটি অংশ রয়েছে। আর নারীদের জন্য রয়েছে মাতা পিতা ও নিকটাত্মীয়রা যা রেখে গিয়েছে তা থেকে একটি অংশ (তা থেকে কম হোক বা বেশি হোক) নির্ধারিত হারে।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭]
পাঁচ. নারীদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করা
আল্লাহ তা‘আলা নারীদের কোনো প্রকার কষ্ট দিতে এবং তাদের দেওয়া মোহরানাকে ফেরত নিতে সম্পূর্ণ নিষেধ করেছেন। তাদের সদয় থাকা জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا يَحِلُّ لَكُمۡ أَن تَرِثُواْ ٱلنِّسَآءَ كَرۡهٗاۖ وَلَا تَعۡضُلُوهُنَّ لِتَذۡهَبُواْ بِبَعۡضِ مَآ ءَاتَيۡتُمُوهُنَّ إِلَّآ أَن يَأۡتِينَ بِفَٰحِشَةٖ مُّبَيِّنَةٖۚ وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ فَإِن كَرِهۡتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡٔٗا وَيَجۡعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيۡرٗا كَثِيرٗا ١٩ وَإِنۡ أَرَدتُّمُ ٱسۡتِبۡدَالَ زَوۡجٖ مَّكَانَ زَوۡجٖ وَءَاتَيۡتُمۡ إِحۡدَىٰهُنَّ قِنطَارٗا فَلَا تَأۡخُذُواْ مِنۡهُ شَيًۡٔاۚ أَتَأۡخُذُونَهُۥ بُهۡتَٰنٗا وَإِثۡمٗا مُّبِينٗا ٢٠ وَكَيۡفَ تَأۡخُذُونَهُۥ وَقَدۡ أَفۡضَىٰ بَعۡضُكُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ وَأَخَذۡنَ مِنكُم مِّيثَٰقًا غَلِيظٗا ٢١﴾ [النساء: ١٩، ٢١]
“হে মুমিনগণ, তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা জোর করে নারীদের ওয়ারিস হবে। আর তোমরা তাদেরকে আবদ্ধ করে রেখো না, তাদেরকে যা দিয়েছ তা থেকে তোমরা কিছু নিয়ে নেয়ার জন্য, তবে যদি তারা প্রকাশ্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়। আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস কর। আর যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোনো কিছুকে অপছন্দ করছ আর আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রাখবেন।
আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রীকে বদলাতে চাও আর তাদের কাউকে তোমরা প্রদান করেছ প্রচুর সম্পদ, তবে তোমরা তা থেকে কোনো কিছু নিও না। তোমরা কি তা নেবে অপবাদ এবং প্রকাশ্য গুনাহের মাধ্যমে?
আর তোমরা তা কীভাবে নেবে অথচ তোমরা একে অপরের সাথে একান্তে মিলিত হয়েছ; আর তারা তোমাদের থেকে নিয়েছিল দৃঢ় অঙ্গীকার?” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯-২১]
ছয়. নারী ও পুরুষের স্বকীয়তা বজায় রাখা বিষয়
আল্লাহ তা‘আলা নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য কতক আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে আল্লাহ পুরুষদের ওপর নারীদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন আবার কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের নারীদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কেউ যেন কারো বৈশিষ্ট্য বা অধিকার নিয়ে বিতর্কের সূচনা না করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَتَمَنَّوۡاْ مَا فَضَّلَ ٱللَّهُ بِهِۦ بَعۡضَكُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖۚ لِّلرِّجَالِ نَصِيبٞ مِّمَّا ٱكۡتَسَبُواْۖ وَلِلنِّسَآءِ نَصِيبٞ مِّمَّا ٱكۡتَسَبۡنَۚ وَسَۡٔلُواْ ٱللَّهَ مِن فَضۡلِهِۦٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٣٢﴾ [النساء: ٣٢]
‘আর তোমরা আকাঙ্ক্ষা করো না সে-সবের, যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের এক জনকে অন্য জনের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। পুরুষদের জন্য রয়েছে অংশ, তারা যা উপার্জন করে তা থেকে এবং নারীদের জন্য রয়েছে অংশ, যা তারা উপার্জন করে তা থেকে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ চাও। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩২]
সাত. ইবাদতের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ সমান বিনিময়
আল্লাহ তা‘আলা নারীদেরকে ইবাদত বন্দেগী ও আল্লাহর নৈকট্য লাভে পুরুষের সঙ্গী বানিয়েছেন। তাদেরও সেই কাজের আদেশ দেওয়া হয়েছে, যে কাজের আদেশ পুরুষদের দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেককে তাদের ইখলাস, চেষ্টা ও কর্ম অনুযায়ী কিয়ামত দিবসে সাওয়াব ও বিনিময় দেওয়া হবে। তাদের কাউকে কোনো প্রকার বৈষম্য করা হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱلۡمُسۡلِمِينَ وَٱلۡمُسۡلِمَٰتِ وَٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ وَٱلۡقَٰنِتِينَ وَٱلۡقَٰنِتَٰتِ وَٱلصَّٰدِقِينَ وَٱلصَّٰدِقَٰتِ وَٱلصَّٰبِرِينَ وَٱلصَّٰبِرَٰتِ وَٱلۡخَٰشِعِينَ وَٱلۡخَٰشِعَٰتِ وَٱلۡمُتَصَدِّقِينَ وَٱلۡمُتَصَدِّقَٰتِ وَٱلصَّٰٓئِمِينَ وَٱلصَّٰٓئِمَٰتِ وَٱلۡحَٰفِظِينَ فُرُوجَهُمۡ وَٱلۡحَٰفِظَٰتِ وَٱلذَّٰكِرِينَ ٱللَّهَ كَثِيرٗا وَٱلذَّٰكِرَٰتِ أَعَدَّ ٱللَّهُ لَهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمٗا ٣٥﴾ [الاحزاب: ٣٥]
“নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনয়াবনত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, সিয়ামপালনকারী পুরুষ ও নারী, নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাযতকারী পুরুষ ও নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও নারী, তাদের জন্য আল্লাহ মাগফিরাত ও মহান প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৩৫]
আট. স্বামীর মধ্যকার বিবাধ মীমাংসা
আল্লাহ তা‘আলা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মাঝে কোনো ঝগড়া-বিবাধ দেখা দিলে, তা মীমাংসার জন্য কতক নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছন। স্ত্রী যদি স্বামীর অবাধ্য হয়, তখন তার সাথে কি ধরনের আচরণ করতে হবে, আর স্বামী যদি বাড়াবাড়ি করে তার ব্যাপারে স্ত্রীর করণীয় কি হবে, তা আল্লাহ সবিস্তারে বলে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِنِ ٱمۡرَأَةٌ خَافَتۡ مِنۢ بَعۡلِهَا نُشُوزًا أَوۡ إِعۡرَاضٗا فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِمَآ أَن يُصۡلِحَا بَيۡنَهُمَا صُلۡحٗاۚ وَٱلصُّلۡحُ خَيۡرٞۗ وَأُحۡضِرَتِ ٱلۡأَنفُسُ ٱلشُّحَّۚ وَإِن تُحۡسِنُواْ وَتَتَّقُواْ فَإِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرٗا ١٢٨ وَلَن تَسۡتَطِيعُوٓاْ أَن تَعۡدِلُواْ بَيۡنَ ٱلنِّسَآءِ وَلَوۡ حَرَصۡتُمۡۖ فَلَا تَمِيلُواْ كُلَّ ٱلۡمَيۡلِ فَتَذَرُوهَا كَٱلۡمُعَلَّقَةِۚ وَإِن تُصۡلِحُواْ وَتَتَّقُواْ فَإِنَّ ٱللَّهَ كَانَ غَفُورٗا رَّحِيمٗا ١٢٩﴾ [النساء: ١٢٨، ١٢٩]
“যদি কোনো নারী তার স্বামীর পক্ষ থেকে কোনো দুর্ব্যবহার কিংবা উপেক্ষার আশঙ্কা করে, তাহলে তারা উভয়ে কোনো মীমাংসা করলে তাদের কোনো অপরাধ নেই। আর মীমাংসা কল্যাণকর এবং মানুষের মধ্যে কৃপণতা বিদ্যমান রয়েছে। আর যদি তোমরা সৎকর্ম কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে আল্লাহ তোমরা যা কর সে বিষয়ে সম্যক অবগত।
আর তোমরা যতই কামনা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সমান আচরণ করতে কখনো পারবে না। সুতরাং তোমরা (একজনের প্রতি) সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না, যার ফলে তোমরা (অপরকে) ঝুলন্তের মতো করে রাখবে। আর যদি তোমরা মীমাংসা করে নাও এবং তাকওয়া অবলম্বন কর তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১২৮-১২৯]
নয়. কন্যা সন্তানদের প্রতি বৈষম্য নিরসন বিষয়ে
মুশরিকরা কন্যা সন্তানদের অপছন্দ ও ঘৃণা করার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের ভর্ৎসনা করেন এবং তাদের তিরস্কার করেন।
﴿وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِٱلۡأُنثَىٰ ظَلَّ وَجۡهُهُۥ مُسۡوَدّٗا وَهُوَ كَظِيمٞ ٥٨ يَتَوَٰرَىٰ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ مِن سُوٓءِ مَا بُشِّرَ بِهِۦٓۚ أَيُمۡسِكُهُۥ عَلَىٰ هُونٍ أَمۡ يَدُسُّهُۥ فِي ٱلتُّرَابِۗ أَلَا سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ ٥٩﴾ [النحل: ٥٨، ٥٩]
“আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে কওমের থেকে আত্মগোপন করে। অপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পূতে ফেলবে? জেনে রেখ, তারা যা ফয়সালা করে, তা কতই না মন্দ!” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫৮-৫৯]
দশ. নারীদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার শাস্তি বিষয়
যারা সতী-সিদ্ধ রমণীদের অপবাদ দেয় তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন এবং তাদের ফাসিক বলে আখ্যায়িত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ يَرۡمُونَ ٱلۡمُحۡصَنَٰتِ ثُمَّ لَمۡ يَأۡتُواْ بِأَرۡبَعَةِ شُهَدَآءَ فَٱجۡلِدُوهُمۡ ثَمَٰنِينَ جَلۡدَةٗ وَلَا تَقۡبَلُواْ لَهُمۡ شَهَٰدَةً أَبَدٗاۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ ٤﴾ [النور: ٤]
“আর যারা সচ্চরিত্র নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারপর তারা চারজন সাক্ষী নিয়ে আসে না, তবে তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত কর এবং তোমরা কখনই তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করো না। আর এরাই হলো ফাসিক।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৪]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ يَرۡمُونَ ٱلۡمُحۡصَنَٰتِ ٱلۡغَٰفِلَٰتِ ٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ لُعِنُواْ فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ٢٣ ﴾ [النور: ٢٣]
“যারা সচ্চরিত্রা সরলমনা মুমিন নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত। আর তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ২৩]
এগার. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মুহাব্বাত আল্লাহর একটি নিদর্শন
আল্লাহ তা‘আলা বিবাহ সম্পর্কে বলেন, বিবাহ হলো, আল্লাহ তা‘আলার মহান নিদর্শন, যার মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের মাঝে প্রেম, ভালোবাসা ও পারস্পরিক অনুগ্রহ তৈরি হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَحۡمَةًۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢١﴾ [الروم: ٢١]
“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলি রয়েছে সে কাওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১]
বার. তালাকের বিধান
যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং তালাক অনিবার্য হয়ে যায়, তখন তাদের করণীয় কী? কতজন সাক্ষী লাগবে, কতদিন ইদ্দত পালন করতে হবে এবং তাদের খরচা কত দিতে হবে ইত্যাদি বিশদভাবে আল্লাহ আলোচনা করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ إِذَا طَلَّقۡتُمُ ٱلنِّسَآءَ فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحۡصُواْ ٱلۡعِدَّةَۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ رَبَّكُمۡۖ لَا تُخۡرِجُوهُنَّ مِنۢ بُيُوتِهِنَّ وَلَا يَخۡرُجۡنَ إِلَّآ أَن يَأۡتِينَ بِفَٰحِشَةٖ مُّبَيِّنَةٖۚ وَتِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِۚ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ ٱللَّهِ فَقَدۡ ظَلَمَ نَفۡسَهُۥۚ لَا تَدۡرِي لَعَلَّ ٱللَّهَ يُحۡدِثُ بَعۡدَ ذَٰلِكَ أَمۡرٗا ١ فَإِذَا بَلَغۡنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمۡسِكُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٍ أَوۡ فَارِقُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٖ وَأَشۡهِدُواْ ذَوَيۡ عَدۡلٖ مِّنكُمۡ وَأَقِيمُواْ ٱلشَّهَٰدَةَ لِلَّهِۚ ذَٰلِكُمۡ يُوعَظُ بِهِۦ مَن كَانَ يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّهُۥ مَخۡرَجٗا ٢﴾ [الطلاق: ١، ٢]
“হে নবী, (বল), তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে, তখন তাদের ইদ্দত অনুসারে তাদের তালাক দাও এবং ‘ইদ্দত হিসাব করে রাখবে এবং তোমাদের রব আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা তাদেরকে তোমাদের বাড়ীÑঘর থেকে বের করে দিয়ো না এবং তারাও বের হবে না। যদি না তারা কোনো স্পষ্ট অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়। আর এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। আর যে আল্লাহর (নির্ধারিত) সীমারেখাসমূহ অতিক্রম করে সে অবশ্যই তার নিজের ওপর যুলম করে। তুমি জান না, হয়তো এর পর আল্লাহ, (ফিরে আসার) কোনো পথ তৈরী করে দিবেন।
অতঃপর যখন তারা তাদের ইদ্দতের শেষ সীমায় পৌঁছবে, তখন তোমরা তাদের ন্যায়ানুগ পন্থায় রেখে দেবে অথবা ন্যায়ানুগ পন্থায় তাদের পরিত্যাগ করবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে ন্যায়পরায়ণ দুইজনকে সাক্ষী বানাবে। আর আল্লাহর জন্য সঠিক সাক্ষ্য দেবে। তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান আনে এটি দ্বারা তাকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন।” [সূরা আত-ত্বালাক, আয়াত: ১-২]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿أَسۡكِنُوهُنَّ مِنۡ حَيۡثُ سَكَنتُم مِّن وُجۡدِكُمۡ وَلَا تُضَآرُّوهُنَّ لِتُضَيِّقُواْ عَلَيۡهِنَّۚ وَإِن كُنَّ أُوْلَٰتِ حَمۡلٖ فَأَنفِقُواْ عَلَيۡهِنَّ حَتَّىٰ يَضَعۡنَ حَمۡلَهُنَّۚ فَإِنۡ أَرۡضَعۡنَ لَكُمۡ فََٔاتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ وَأۡتَمِرُواْ بَيۡنَكُم بِمَعۡرُوفٖۖ وَإِن تَعَاسَرۡتُمۡ فَسَتُرۡضِعُ لَهُۥٓ أُخۡرَىٰ ٦﴾ [الطلاق: ٦]
“তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেখানে তোমরা বসবাস কর সেখানে তাদেরকেও বাস করতে দাও, তাদেরকে সঙ্কটে ফেলার জন্য কষ্ট দিয়ো না। আর তারা গর্ভবতী হলে তাদের সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত তাদের জন্য তোমরা ব্যয় কর, আর তারা তোমাদের জন্য সন্তানকে দুধ পান করালে তাদের পাওনা তাদেরকে দিয়ে দাও এবং (সন্তানের কল্যাণের জন্য) সংগতভাবে তোমাদের মাঝে পরস্পর পরামর্শ কর। আর যদি তোমরা পরস্পর কঠোর হও তবে পিতার পক্ষে অন্য কোনো নারী দুধপান করাবে।” [সূরা আত-ত্বালাক, আয়াত: ৬]
তের. একাধিক বিবাহ সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা
যারা একাধিক বিবাহ করতে চায় তাদের জন্য চারজন পর্যন্ত বিবাহ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে যারা একাধিক বিবাহ করবে, তাদের জন্য শর্ত হলো, তারা তাদের মধ্যে ন্যায় বিচার ও ইনসাফ কায়েম করবে। অন্যথায় তাকে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَٱنكِحُواْ مَا طَابَ لَكُم مِّنَ ٱلنِّسَآءِ مَثۡنَىٰ وَثُلَٰثَ وَرُبَٰعَۖ فَإِنۡ خِفۡتُمۡ أَلَّا تَعۡدِلُواْ فَوَٰحِدَةً﴾ [النساء: ٣]
“এখানে পবিত্র কুরআন হতে নারীদের সাথে সম্পৃক্ত কিছু দিক-নির্দেশনা এবং তাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ বিষয়ে কেবল কতগুলো দৃষ্টান্ত পেশ করা হল। এগুলো ছাড়াও আরও অনেক আয়াত রয়েছে সবগুলোর আলোচনা এখানে সম্ভব নয়।
ইসলামের সুশীতল ছায়ায় নারী
একজন নারী ইসলামী শিক্ষা ও অনুপম আদর্শের ছায়া তলে ও ইসলোমের দিক নির্দেশনার আলোকে একটি সম্মানজনক অবস্থায় জীবন যাপন করতে পারে। ইসলামী বিধানে একজন নারী, সে যেদিন থেকে দুনিয়াতে আগমন করেছে, সেদিন থেকেই ইসলামী বিধানে তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তার সম্মান ও মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। তাকে কন্যা হিসেবে, মা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, বোন হিসেবে, খালা, ফুফু ইত্যাদি হিসেব, তার জীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরনের সম্মান ও অধিকার আলাদা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। একজন নারীর জীবনে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। ইসলামে নারীর অবস্থা বেধে একজন নারীকে বিভিন্ন ধরনের সম্মান ও অধিকার দেওয়া হয়েছে। নিম্নে তার সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা তুলে ধরা হল।
এক. কন্যা-সন্তান হিসেবে নারীর মর্যাদা
কন্যা হিসেবে নারীর মর্যাদা অধিক। ইসলাম কন্যা সন্তানদের প্রতি দয়া করা, তাদের নৈতিক শিক্ষা দেয়া, আদর যত্নসহকারে লালন-পালন করা এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে নেককার নারী হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। পক্ষান্তরে জাহেলিয়্যাতের যুগে যে সব কাফির মুশরিকরা কন্যা সন্তানের জন্মকে অপছন্দ করত, তাদের বিরুদ্ধে ইসলাম কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِٱلۡأُنثَىٰ ظَلَّ وَجۡهُهُۥ مُسۡوَدّٗا وَهُوَ كَظِيمٞ ٥٨ يَتَوَٰرَىٰ مِنَ ٱلۡقَوۡمِ مِن سُوٓءِ مَا بُشِّرَ بِهِۦٓۚ أَيُمۡسِكُهُۥ عَلَىٰ هُونٍ أَمۡ يَدُسُّهُۥ فِي ٱلتُّرَابِۗ أَلَا سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ ٥٩﴾ [النحل: ٥٨، ٥٩]
“আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত।
তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে কওমের থেকে আত্মগোপন করে। অপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পূতে ফেলবে? জেনে রেখ, তারা যা ফয়সালা করে, তা কতই না মন্দ!” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫৮-৫৯]
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে মুগিরা ইবন শু‘বা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إنَّ الله حرّم عليكم عقوق الأمهات، ومنعاً وهات، ووأد البنات»
“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ওপর মাতা-পিতার নাফরমানী করাকে হারাম করেছেন, ভিক্ষা করা ও কন্যা সন্তানদের পুতে হত্যা করাকে হারাম করেছেন।”
হাফেয ইবন হাজার আসকালানী রহ. বলেন, জাহেলি যুগের লোকেরা কন্যা সন্তানদের দু’টি পদ্ধতিতে হত্যা করত:
এক. তারা তাদের স্ত্রীদের যখন সন্তান প্রসবের সময় হত, তখন তারা তাদের নির্দেশ দিয়ে বলত, তারা যেন একটি গুহার নিকট চলে যায়। তারপর যখন কোনো পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করত, তখন তাকে জীবিত রাখত। আর যখন কোনো কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করত, তখন তাকে গর্তে নিক্ষেপ করে হত্যা করে ফেলত।
দুই. যখন তাদের কন্যা সন্তানদের বয়স ছয় বছর হত, তখন তারা তাদের সন্তানের মাকে বলত, তাকে তুমি সাজিয়ে দাও! আমি তাকে নিয়ে আমার আত্মীয়ের বাড়ীতে বেড়াতে যাব। মা তাকে সাজিয়ে দিলে, তার পিতা তাকে নিয়ে গভীর বন-জঙ্গলে চলে যেত এবং কুপের নিকট এসে তাকে বলত, তুমি একটু নিচের দিকে তাকিয়ে দেখ, সে যখন নিচের দিকে তাকিয়ে দেখত, তখন তাকে পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে কুপের মধ্যে ফেলে দিত। তারপর মাটি চাপা দিয়ে অথবা পাথর মেরে হত্যা করে ফেলত। এ ভাবেই তাদের মধ্যে কন্যা সন্তানদের হত্যা করার ধারাবাহিকতা যুগ যুগ ধরে চলছিল। ইসলামের আগমনের পর ইসলাম নারীদেরকে আল্লাহর পক্ষ হতে বড় একটি নি‘আমত হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং কন্যা সন্তানদের হত্যা করার প্রবণতা বন্ধ করে দেন এবং ঘোষণা দেন যে , কন্যা সন্তান হত্যা করা জঘন্য অপরাধ। কারণ, কন্যা সন্তান জন্ম কোনো মানুষের কর্মের ফল নয়, বরং তাও আল্লাহর দান। আল্লাহ যাকে চান কন্যা সন্তান দেন আবার যাকে চান পুত্র সন্তান দেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لِّلَّهِ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُۚ يَهَبُ لِمَن يَشَآءُ إِنَٰثٗا وَيَهَبُ لِمَن يَشَآءُ ٱلذُّكُورَ ٤٩ أَوۡ يُزَوِّجُهُمۡ ذُكۡرَانٗا وَإِنَٰثٗاۖ وَيَجۡعَلُ مَن يَشَآءُ عَقِيمًاۚ إِنَّهُۥ عَلِيمٞ قَدِيرٞ ٥٠﴾ [الشورا: ٤٩، ٥٠]
“আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ৪৯-৫০]
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من كانت له أنثى فلم يئدها، ولم يهنها، ولم يؤثر ولده عليها أدخله الله تعالى الجنّة»
“কোনো ব্যক্তির যদি একজন কন্যা সন্তান থাকে এবং সে তাকে হত্যা করে নি, কোনো প্রকার অবহেলা করেনি এবং পুত্র সন্তানকে কন্যা সন্তানের ওপর কোনো প্রকার প্রাধান্য দেয়নি। আল্লাহ তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।”[4]
ইবন মাজাহ উকবা ইবন আমের থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন,
«من كان له ثلاث بناتٍ وصبر عليهنَّ، وكساهنَّ من جِدَته، كنَّ له حجاباً من النار»
“যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান থাকবে এবং সে তাদের লালন- পালনে ধৈর্য্য ধারণ করে ও তাদের ভালো কাপড় পরায়, তখন তারা তার জন্য জাহান্নামের আগুনের প্রতিবন্ধক হবে।”[5]
ইমাম মুসলিম তার সহীহ-তে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من عال جاريتين حتى تبلغا، جاء يوم القيامة أنا وهو كهاتين وضمَّ أصابعه»
“যে ব্যক্তি দুই জন কন্যা সন্তান লালন-পালন করে, কিয়ামতের আমি এবং সে দু’টি আঙ্গুলের মতো এক সাথে মিলেই উপস্থিত হব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আঙ্গুল দু’টি মিলিয়ে দেখান।”[6]
ইমাম আহমদ রহ. বর্ণনা করেন, রাসুল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من عال ابنتين أو ثلاث بنات، أو أختين، أو ثلاث أخوات، حتى يبلغن، أو يموت عنهنَّ، أنا وهو كهاتين وأشاربأصبعه السبابة»
“যে ব্যক্তি দু’টি অথবা তিনটি কন্যা অথবা দুটি বোন বা তিনটি বোনকে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করে, অথবা তাদের মারা যাওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করে, জান্নাতে আমি ও সে দু’টি আঙ্গুলের মতো মিলে মিশে থাকবো। রাসূল তার শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা বৃদ্ধা আঙ্গুলের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দেন।”[7]
ইমাম বুখারী আদাবুল মুফরাদ গ্রন্থে জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من كان له ثلاث بناتٍ يؤويهنَّ، ويكفيهنَّ، ويرحمهنَّ، فقد وجبت له الجنّة البتّة، فقال رجل من بعض القوم: وثنتين يا رسول الله؟ قال: وثنتين»
“যে লোকের তিনজন বাচ্চা থাকবে এবং সে তাদের যথাযত বরণ-পোষণ, লালন-পালন ও আদর-যত্ন সহকারে ঘড়ে তুলবে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতকে ওয়াজিব করে দেবে। একথা শোনে এ লোক দাঁড়িয়ে বলল, যদি দুইজন কন্যা সন্তান থাকে, তা হলে কি বিধান হে আল্লাহর রাসূল? তখন রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলল, দু’জন হলেও একই বিধান। (সেও এ ফযীলতের অধিকারী হবে)”[8]
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«جاء أعرابي إلى النَّبيِّ فقال: أتقبِّلون صبيانكم؟ فما نقبِّلهم، فقال النَّبيُّ صلى الله عليه وسلم : (أو أملك لك أن نزع الله من قبلك الرحمة)».
“একজন গ্রাম্য লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে বললেন তোমরা কি তোমাদের বাচ্চাদের চুমু দাও? আমরা আমাদের বাচ্চাদের কখনোই চুমু দেই না। এ কথা শোনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার অন্তর থেকে যদি আল্লাহ তা‘আলা দয়া কেড়ে নিয়ে যায়, আমি তা কখনোই বাধা দিয়ে রাখতে পারব না।”[9]
দুই. মা হিসেবে একজন নারীর মর্যাদা
একজন নারী যখন মা হয়, তখন তাকে বিশেষ সম্মান ও অধিক মর্যাদা দেয়ার জন্য ইসলাম নির্দেশ দেয়। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, তাদের খেদমতে সর্বদা সচেষ্ট হওয়া এবং তাদের কল্যাণের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করান আদেশ দেয়। আর তাদের কোনো প্রকার কষ্ট না দেয়া। তাদের সাথে সুন্দর ও সর্বোত্তম ব্যবহার করা। একজন ভালো সাথী সঙ্গীর সাথে যে ধরনের ভালো ব্যবহার করা হয় তাদের সাথেও সে ধরনের ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَوَصَّيۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ إِحۡسَٰنًاۖ حَمَلَتۡهُ أُمُّهُۥ كُرۡهٗا وَوَضَعَتۡهُ كُرۡهٗاۖ وَحَمۡلُهُۥ وَفِصَٰلُهُۥ ثَلَٰثُونَ شَهۡرًاۚ حَتَّىٰٓ إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُۥ وَبَلَغَ أَرۡبَعِينَ سَنَةٗ قَالَ رَبِّ أَوۡزِعۡنِيٓ أَنۡ أَشۡكُرَ نِعۡمَتَكَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتَ عَلَيَّ وَعَلَىٰ وَٰلِدَيَّ وَأَنۡ أَعۡمَلَ صَٰلِحٗا تَرۡضَىٰهُ وَأَصۡلِحۡ لِي فِي ذُرِّيَّتِيٓۖ إِنِّي تُبۡتُ إِلَيۡكَ وَإِنِّي مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٥ ﴾ [الاحقاف: ١٥]
“আর আমরা মানুষকে তার মাতা-পিতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তা মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছে এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছে। তার গর্ভধারণ ও দুধপান ছাড়ানোর সময় লাগে ত্রিশ মাস। অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌছে এবং চল্লিশ বছরে উপনীত হয়, তখন সে বলে, হে আমার রব, আমাকে সামথ্য দাও, তুমি আমার ওপর ও আমার মাতা-পিতার ওপর যে নি‘আমত দান করেছ, তোমার সে নিআমতের যেন আমি শোকর আদায় করতে পারি এবং আমি যেন সতকর্ম করতে পারি, যা তুমি পছন্দ কর। আর আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মধ্যে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয় আমি তোমার কাছে তাওবা করলাম এবং নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তভূর্ক্ত। [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ১৫]
﴿وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ إِمَّا يَبۡلُغَنَّ عِندَكَ ٱلۡكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوۡ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفّٖ وَلَا تَنۡهَرۡهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوۡلٗا كَرِيمٗا ٢٣ وَٱخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحۡمَةِ وَقُل رَّبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤﴾ [الاسراء: ٢٣، ٢٤]
“আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ, বল না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। আর তাদের উভয়ের জন্য দয়াপরবশ হয়ে ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৩-২৪]
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো,
«يا رسول الله من أبرُّ؟ قال: أُمّك، قال: ثم من؟ قال: أمَّك، قال: ثم من؟ قال أباك»
“হে আল্লাহর রাসূল! সবচেয়ে বেশি ভালো ব্যবহারের উপযুক্ত লোকটি কে? তিনি বললেন, তোমার মা, লোকটি বলল, তারপর কে? বলল, তোমার মা, লোকটি আবারো বলল, তারপর কে? বলল, তোমার পিতা।”[10]
ইমাম আবু দাউদ ও ইবন মাজায় আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হিজরত করার জন্য অঙ্গিকার করতে আসে। আর সে তার মাতা-পিতাকে ক্রন্দনরত অবস্থায় রেখে আসছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলল,
«ارجع إليهما وأضحكهما كما أبكيتَهما»
“তুমি তাদের উভয়ের নিকট ফিরে যাও এবং তাদের যেভাবে তুমি কাঁদিয়েছিলে, সেভাবে তাদের খুশি করিয়ে দাও।”[11]
এতে প্রমাণিত হয় যে, মাতা পিতার অসুন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ রেখে রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে হিজরতও করতে দেয় নি।
সহীহ বুখারী মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা আল্লাহ তা‘আলার নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয় আমল কোনোটি? উত্তরে তিনি বললেন,
«الصلاة على وقتها، قلت: ثم أيّ؟ قال: برُّ الوالدين، قلت: ثم أيّ؟ قال: الجهاد في سبيل الله»
“সময়মত সালাত আদায় করা, আমি বললাম তারপর কোনোটি? তিনি বললেন, মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার করা, আমি বললাম তারপর কোনোটি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।”[12]
মাতা-পিতাকে কষ্ট দেওয়ার বিষয়ে ইসলাম সবোর্চ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছে, যাতে তাদের কোনো প্রকার কষ্ট দেওয়া না হয়। তাদের কোনো প্রকার কষ্ট না দেয়ার জন্য ইসলাম কঠিনভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের কোনো প্রকার কষ্ট দেয়াকে মাতা-পিতার নাফরমানী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং যারা তাদের মাতা-পিতাকে কষ্ট দেয়, তাদের কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসা করা হবে, বরং তাদের কষ্ট দেওয়াকে কবীরা গুনাহ বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সহীহ বুখারী মুসলিমে আবু বকরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার বললেন,
«ألا أُنبِّئكم بأكبر الكبائر؟ ثلاثاً. قالوا: بلى يا رسول الله، قال: الإشراك بالله، وعقوق الوالدين، . وجلس وكان متّكئاً فقال: ألا وقولُ الزور ما زال يكرِّرها حتى قلنا: ليته سكت »
“আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ কী? (এ কথাটি রাসূল তিনবার বলেছেন) তারা বললেন, হা হে আল্লাহর রাসূল! তখন তিনি বললেন, সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ, আল্লাহর সাথে শরীক করা, মাতা-পিতার নাফরমানী করা, (রাসূল হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলেন, তারপর তিনি উঠে বসে বললেন, সাবধান! মিথ্যা কথা বলা) রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথাটি বার বার বলছিল, যার ফলে আমরা চাইতেছিলাম যদি রাসূল চুপ থাকত!”[13]