রোজার মাস আসলেই পত্রিকায় রোজার ফযিলত নিয়ে যে কথাটা আসে, এ মাসটি বরকতময়, এ মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে, কুরআন আমাদের সমস্ত জীবনবিধান, সুতরাং এ মাসের শুকরিয়া আদায় কর অধিক কুরআন পাঠ ও নফল ইবাদতের মাধ্যমে। কথাটা ঠিকই আছে, কিন্তু মাসটার মাহাত্ম্য কিন্তু এর মাঝেই সীমাবদ্ধ না। তারাবী নামায ও কুরআন খতম দেয়ার পাশাপাশি আমাদের এই খেয়ালটুকুও রাখতে হবে, এর সাথে আত্মার যোগাযোগ যেন থাকে, এগুলো কেবলই যেন বাৎসরিক অভ্যাসে পরিণত না হয়। রমজান মাসের সুফল বলতে গেলে ঘুরেফিরে বারবারই পরকালের মুক্তির কথা আসে। কিন্তু আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এর প্রতিফলন কই?
রমজান মাসকে বলা হয় আত্মশুদ্ধির মাস। আত্মশুদ্ধি – এ কথাটার মানে কী? মানে আমাদের যেসব খারাপ দিক আছে সেগুলো ঝেড়ে মুছে ফেলব এই মাসে, তাই ত? কিন্তু কীভাবে?
খারাপ দিক ঝেড়ে ফেলার ব্যাপারে বলতে হলে আগে বলতে হবে খারাপ বৈশিষ্ট্য আমাদের মাঝে কোথা থেকে আসে। কুরআনে আদম সৃষ্টির ঘটনাটা যদি কারো মনে থাকে, তবে মনে পড়বে, শয়তান আল্লাহর কাছে শপথ করে বলেছিল, আমি আদম সন্তানদের চারিদিক থেকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করব। সুতরাং বিভ্রান্তি, বা আল্লাহর পছন্দ না, এমন স্বভাবগুলোর একটা মূল কারণ শয়তান। কিন্তু শয়তানের কোন ক্ষমতা নেই আমাদের মধ্যে কিছু সৃষ্টি করার। আমাদের ভেতরেই খারাপ চিন্তাগুলোর বীজ আছে, শয়তান সেগুলোকে উস্কে দেয় কেবল। ভালবাসার তীব্রতাকে শয়তান ঈর্ষা, সন্দেহপরায়নতায় বদলে দিতে পারে, আবার জ্ঞানপিপাসাকে একটু ঘুরিয়ে বদলে দিতে পারে সন্দেহবাতিকতা ও উন্নাসিকতায়। খারাপ চিন্তার উৎসটা আমাদের ভেতরেই। মোটা দাগে একে নফস বলা যেতে পারে। সারা বছর শয়তান আমাদের বুকের ভেতরে বসে নফসকে খুঁচিয়ে যেতে থাকে, আর নফস ও খেয়ালে বেখেয়ালে তাতে সাড়া দিয়ে বসে।
আত্মশুদ্ধির এই মাসটাতে আল্লাহ আমাদের প্রতি বিরাট এক রহম করেন, তিনি শয়তানকে দোজখে বেঁধে রাখেন পুরোটা মাস। তার মানে নফস কে জ্বালাতন করার এখন আর কেউ নেই! তার মানে, আমি যদি চাই, আত্মসমালোচনা করার এটাই সবচেয়ে ভাল সময়। কারণ আমি জানি, যা কিছু খারাপ আসছে, তা পুরোপুরিভাবে আমার থেকেই আসছে, সুতরাং নিজেকে বদলাতে হলে আমার নফস এর সাথে আমার বোঝাপড়া করতে হবে।
নফস এর সাথে বোঝাপড়া – সেও কিন্তু রমজান মাসে আল্লাহ অনেক সহজ করে দিয়েছেন। নফস বলতে মোটা দাগে আমাদের শারীরিক মানসিক প্রয়োজনগুলিকে বোঝানো যেতে পারে। শারীরিক প্রয়োজনগুলি অতিমাত্রায় চর্চায় খারাপ অভ্যাসে রূপ নিতে পারে। যেমন, প্রয়োজনীয় বিশ্রামের অত্যধিক ব্যবহারে সেটা হয় আলস্য, ক্ষুধানিবৃত্তির প্রয়োজন নিয়ে বাড়াবাড়ি গিয়ে ঠেকে টেবিলভর্তি ইফতারে। তেমনি মানসিক প্রয়োজন, যেমন আবেগ ভালবাসার অনিয়ন্ত্রিত রূপ কতটা কদর্য হতে পারে, সে ত আমরা সবাই জানি।
রোজার মাসে শরীরের মনের এই সবগুলো প্রয়োজনকেই খুব নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রাখতে হয়। এত সংযম করেও আমরা যখন মারা পড়িনা, দিব্যি হেলেদুলে বেড়াই, তখনই বোঝা যায়, আমাদের মানুষের সত্যিকারের প্রয়োজনটা আসলে কত কম!
তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? শয়তান নেই, প্রবৃত্তির বাড়াবাড়ি নেই – বাকিটুকু যেটুক থাকে, তা কেবলই ‘আমি’, মানে আমার ভাল অংশটুকু। একে নিয়ে যত চিন্তাভাবনা করব, ততই একে চিনতে পারব। তখন রোজার মাস শেষ হয়ে গেলেও শয়তান একে আড়াল করে ফেলতে পারবে না।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিচ্ছি –
আমি লেখালেখির সুবাদে সামাজিক ওয়েবসাইটগুলোতে অনেকটা সময় কাটাই। উদ্দেশ্যটা ভাল, লেখার মাধ্যমে ভাল চিন্তার প্রসার ঘটাব – কিন্তু আমার সুযোগসন্ধানী নফস করে কি, একে সব রকমের কঠিন কাজ থেকে পালিয়ে বেড়ানোর উপলক্ষ বানিয়ে ফেলে। যেমন গবেষণার কাজের জন্য একটা আর্টিকেল পড়তে হবে, একটু কঠিন লাগলেই ফেলে দিয়ে ব্লগিং এ ঢুকে পড়ি। এখানে উদ্দেশ্যটা ভাল হলেও আমার যথেচ্ছ ব্যবহার এর ভাল দিকটা নষ্ট করে দিচ্ছে। তারপর ফাঁকি দিচ্ছি – এই বোধটা আসামাত্রই শয়তান যুক্তি দিতে থাকে, ‘না! এটা ত ভাল কাজ, পড়াশুনা ত পরেও করতে পারবে, এই মুহুর্তে এই লেখাটা না লিখলে পরে আর লেখা হবেনা…’
রোজার সময় আমি যেটা করার চেষ্টা করব, তা হচ্ছে, যতবারই কাজ ফেলে ব্লগিং এ মাথা গুঁজতে ইচ্ছা করবে, একটা খাতায় লিখে ফেলব, কেন এখনই ব্লগে যেতে হবে। পাশে সময়টাও লিখে রাখব, আর সে সময় কী কাজে ব্যস্ত ছিলাম, ওটাও! আশা করা যায় আমার নফস, যে কিনা সব রকমের নিয়ম কানুনের বিরূদ্ধে সদা বিদ্রোহী, সে রোজার সময় অনেক সংযত থাকবে, তালিকা বানানো নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করে দেবে না। এবার দিন শেষে তালিকায় চোখ বুলিয়ে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করব, এর মধ্যে সবগুলোই কি দরকারি, না কাজে ফাঁকি দেয়ার ছুতোও আছে? ভাগ্য ভাল, শয়তান নেই, থাকলে আমাকে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়ত, যে এর চেয়ে জরুরি কিছু পৃথিবীতে হতেই পারেনা। শয়তানের যুক্তি বোধ ত আমার চেয়ে ভাল হবেই, তার কত যুগের অভিজ্ঞতা!
এভাবে করে আমরা প্রত্যেকেই যার যার বদভ্যাসগুলি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারি। নামাযে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দু’আ করতে পারি, “আল্লাহ, এ মাসে নিজেকে বদলানো সবচেয়ে সহজ, তুমি আমার জন্য আরো সহজ করে দাও!” তারপর আল্লাহ রোজা রাখার মত সুস্থ শরীর আর মন দিয়েছেন, এই কৃতজ্ঞতায় দিনের বেলাটা যে যেই কাজই করিনা কেন, চাকুরি, পড়াশুনা, ঘরের কাজ – সেটা আরো যত্ন করে করতে পারি। এতে করে আমাদের প্রাত্যহিক কাজগুলিও ইবাদতের মর্যাদা পাবে। আল্লাহ খুশি হবেন, আমার বান্দা রোজাও রাখছে, কুরআন ও পড়ছে, শরীরের সদকাও করছে, আবার পৃথিবীর দায়িত্বগুলো ভুলে যায়নি, সেটাও করছে সুন্দর করে। আল্লাহ তা’আলা এমনিতেই রহমত আর মাগফিরাত দিয়ে পূর্ণ, এরকম একটা মাসে বান্দাদের এত সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ ইবাদত দেখলে তিনি কতটা খুশি হবেন, ফেরেশতাদের কত কতবার করে বলবেন… কল্পনা করতেই খুব ভাল লাগে!