তোমার পরিচয়
মানুষের মনন ও সুবোধ জাগিয়ে তোলা এবং সত্য ও সুন্দরের সন্ধান দেওয়াই সাহিত্যের কাজ। আর ভাষা ও সাহিত্যজগৎ কাব্য ও ছন্দ নিয়েই তার যাত্রা শুরু করেছিল। কবিতাই ছিল মানুষের সাহিত্য সৃষ্টির প্রাথমিক মাধ্যম। মানব মনন, প্রেম, অনুভূতি, আবেগ, ভালোবাসা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক কবিতা। কবি ও কবিতা কালের মহান এক সাক্ষী।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কবিতা শুনতে ভালোবাসতেন। কবি ও কবিতার প্রতি তাঁর একটি স্বভাবসুলভ আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল। তিনি তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-কে কবিতার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য সচেষ্ট ছিলেন।
রাসুল (ﷺ)-এর সাহাবি কবিদের মধ্য থেকে হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه)-কে সভাকবির মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হতো ‘শায়েরুর রাসুল’ বা রাসুলের কবি। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه) কবিতা আবৃত্তি শুরু করলে কবিকে উৎসাহিত করার জন্য কখনো কখনো নবীজি (ﷺ) সবাইকে শুনিয়ে বলতেন,
‘হাসসানের জিহ্বা যত দিন রাসুলুল্লাহ(ﷺ)'র পক্ষ হয়ে কবিতার বাণী শুনিয়ে যাবে, তত দিন তাঁর সঙ্গে জিবরাঈল (আ.) থাকবেন।’
কবিতা লেখার পুরস্কার হিসেবে হযরত হাসসান বিন সাবিত (رضي الله عنه) জীবিত অবস্থায় জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। হাসসান বিন সাবিত (رضي الله عنه)-এর কবিতা শুনে রাসুল (ﷺ) ঘোষণা দিয়েছিলেন,
‘হে হাসসান, আল্লাহর কাছ থেকে তোমার জন্য পুরস্কার রয়েছে জান্নাত।’
হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه)-এর কবিখ্যাতি ছিল আরবজুড়ে। সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতো তাঁর কবিতার পঙিক্ত। তিনি রাসুল (ﷺ)-কে পেয়েছিলেন খুব কাছ থেকে, রাসুল (ﷺ)-এর ভালোবাসাও পেয়েছিলেন অনেক বেশি। রাসুল (ﷺ)-এর প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসায় অভিষিক্ত ছিলেন। সব মিলিয়ে এক সৌভাগ্যবান কবি ছিলেন হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه)।
রাসুল (ﷺ)-কে তিনি ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে। তাঁর সেই ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না।
‘তোমার তারিফ’ কবিতায় রাসুল (ﷺ)-এর প্রতি তাঁর সেই ভালোবাসার দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই। যেমন—
‘তোমার চোখের মতো ভালো চোখ পৃথিবীতে দেখিনি
এবং বিশ্বে কোথাও কোনো মাতা এমন সুন্দর পুত্র আর প্রসব করেনি
তোমার সৃজন সে তো একেবারে দোষমুক্ত করে
এবং তুমিও তা-ই চেয়েছিলে আপন ইচ্ছায়
তোমার তারিফ এই পৃথিবীতে বেড়েই চলেছে
যেমন কস্তুরীর ঘ্রাণ বাতাসে কেবলই ছুটে চলে।…
তোমার প্রশংসা করার মতো আমার তেমন কোনো ভাষা জানা নেই
ভাষার দিক থেকে আমি তো নগণ্য কবি
নবী(ﷺ)'র সঠিক সুন্দর প্রশংসা হয় না নিছক আমার এ ভাষায়
কিন্তু নবীর ছোঁয়া পেয়ে এই কবিতা অমরত্ব পাবে।’
হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه) কবিতা রচনা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, বস্তুত কবিতার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যের প্রচার, সুন্দরের প্রতিষ্ঠা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের প্রতিবাদে, সত্য ও ন্যায়কে বিজয়ী করার মানসেই কবিতা রচিত হওয়া উচিত। তিরমিজি শরিফে এসেছে, হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه)-এর জন্য রাসুল (ﷺ) মসজিদে নববীতে একটি মিম্বার স্থাপন করেছিলেন। তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে রাসুল (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে কাফিরদের নিন্দাসূচক কবিতার উত্তর দিতেন। রাসুল (ﷺ) তাঁর কবিতা শুনে বলতেন, ‘আমার পক্ষ থেকে জবাব দাও। হে আল্লাহ, রুহুল কুদুস (জিবরাঈল)-কে দিয়ে হাসসানকে সাহায্য করো।’
একবার রাসুল (ﷺ) হযরত হাসসান (رضي الله عنه)-কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবু বকরকে নিয়ে কোনো কবিতা কি এ পর্যন্ত লিখেছ? তখন হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه) বললেন, হ্যাঁ লিখেছি। রাসুল (ﷺ) বলেন, শোনাও তাহলে। হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه)-কে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা রাসুল (ﷺ)-কে শোনাতে থাকেন। তার কয়েকটি পঙিক্ত এমন :
‘সুউচ্চ সওর গুহার দ্বিতীয় ব্যক্তি সে
তিনি যখন রক্তলোলুপ শৃগালেরা
মুখে শুঁকে শিখরে এলো
রাসুলের সঙ্গে আছেন সদা এক ছায়াতরু
সবাই জানে নবীর পরে
তিনি সৃষ্টির মাঝে সবার চেয়ে সেরা।’
তা শুনে রাসুল (ﷺ) হেসে হেসে বলেন,
‘তুমি সত্য বলেছ হাসসান, যা বলেছ তার যোগ্যই আবু বকর।’
হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه) ছিলেন ইসলামের তরে নিবেদিতপ্রাণ। তাই ইসলামী পরিভাষার প্রাচুর্য রয়েছে তাঁর রচনায়। তিনি কবিতায় কোরআনের বাক্যাংশ সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন। যেমন—
‘যাবতীয় স্তুতি, করুণা ও কর্তৃত্ব তাঁরই
তাই আমরা শুধু তাঁরই সকাশে সুপথের সন্ধান যাচ্ঞা করি
এবং শুধু তাঁরই উপাসনা করি।’
অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের বিষয়ও স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতায়। তাঁর এ ধরনের কোনো কোনো কবিতা প্রবাদের আবহে আজও সমানভাবে প্রচলিত।
রাসুল (ﷺ)-এর ওফাতের পর তিনি প্রিয় নবীর স্মরণে একটি কবিতা লিখেছেন। সেই কবিতায় তিনি বলেছেন,
‘তুমি ছিলে আমার নয়নের মণি
তোমার মৃত্যুতে আমি অন্ধ হয়ে গেছি
এখন অন্য কারো মৃত্যুতে আমার কোনো প্রতিক্রিয়াই হবে না।’
হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه) খাজরাজ গোত্রের বনু নাজ্জার শাখায় হিজরতের প্রায় ৬০ বছর আগে ৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। রাসুল (ﷺ)-এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের মা ছিলেন বনু নাজ্জার গোত্রের, এদিক দিয়ে হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه) রাসুল (ﷺ)-এর আত্মীয় ছিলেন। তাঁর বংশ ছিল কবি বংশ।
ঐতিহাসিক আহমদ ইসকান্দারি বলেন,
‘তাঁর বাবা ও দাদা উভয়েই কবি ছিলেন। তাঁর ছেলে আব্দুর রহমান ও নাতি সাঈদও কাব্যচর্চা করতেন।’
তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তাঁর জীবনে বার্ধক্য এসে গিয়েছিল। মদিনায় ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্নে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসুল (ﷺ) মদিনায় হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিল ৬০ বছর। রাসুল (ﷺ) মদিনায় এলে মদিনাবাসীর সঙ্গে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তাঁর কাব্যশক্তি দিয়ে ইসলামের খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। রাসুল (ﷺ) তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। ইসলামের খলিফারাও তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দিয়েছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-এর খিলাফতকালে ৫৪ হিজরিতে ১২০ বছর বয়সে হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (رضي الله عنه) ইন্তেকাল করেন।