হাকীকতে মীলাদ: কতিপয় প্রশ্নের জবাব
🖋অধ্যক্ষ আল্লামা শেখ মোহাম্মদ আবদুল করীম সিরাজনগরী সাহেব
সর্বপ্রথম মিলাদ শরীফের বিরোধিতা করেন তাজউদ্দিন ফাকিহানী মালিকী। তিনি মিলাদুন্নবী (দ:) পালন করাকে নিকৃষ্ট বিদআত বলে ফতোয়া প্রদান করেন এবং কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
এর জবাবে নবম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আল্লামা ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রা:) ও হাফেজ ইবনে হজর আসকালানী (রা:) কোরআন-সুন্নাহর আলোকে অকাট্য দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করে ফাকিহানীর প্রশ্নের জবাব দেন এবং মিলাদ শরীফ যে একটি উত্তম (বৈধ) কাজ তা প্রমাণ করেন। (তাফসিরে রূহুল বয়ান ৯ম জিলদ ৫৭ পৃষ্ঠা)
নিম্নে ফাকিহানী ও তার সমর্থকদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রশ্ন এবং উত্তর প্রদান করা হলো:
প্রথম প্রশ্ন – কোরআন ও সুন্নাহর মধ্যে মিলাদ শরীফের মাহফিল আয়োজন করার কোনো আদেশ নেই (মাওরিদ)।
উত্তর – আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ুতী (রা:) উত্তরে বলেন, আদেশ হলে ফরজ বা ওয়াজিব হতো। তা কোরআন, সুন্নাহ-সম্মত নতুন উৎকৃষ্ট মুস্তাহাব কাজ। কোরআন-সুন্নাহর মধ্যে (প্রচলিত মিলাদ ও কিয়ামের) কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কাজেই এটি নিন্দনীয় হতে পারে না। উপরন্তু, মুস্তাহাব প্রমাণের জন্য কোরআন-সুন্নাহর মধ্যে আদেশ পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। (মিছবাহ)
আল্লামা কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ:)-এর লিখিত ‘মালাবুদ্দামিনহু’ বইটির উর্দু অনুবাদ ‘কাশফুল হাজাত’ (অনুবাদক – মোহাম্মদ নূরুদ্দিন) শীর্ষক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে –
جوكسى اصل شرعى سى مستنبط هو سكى وه بهى بدعت نهين جيسى محفل ميلاد شريف مدارس وغيره০
অর্থাৎ, ‘যা শরিয়তের আসল বা মূল হতে ইস্তেম্বত বা বের করা হয়েছে তা বিদআত হতে পারে না। যেমন মিলাদ শরীফের মাহফিল ও মাদ্রাসাসমূহ ইত্যাদি।’
মিশকাত শরীফের ৩৩ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, সরকারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্মে কোনো উৎকৃষ্ট তরিকা বা নিয়ম পদ্ধতি বের করবে, তার আমলনামায় তার সওয়াব লিপিবদ্ধ হবে। অতঃপর তার অনুসরণে যারা তা আমল করবে, তারা যে পরিমাণ সওয়াবের অধিকারী হবে তা সবই তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ হয়ে যাবে। অথচ অনুসরণকারীদেরও সওয়াবের কোনো অংশ কম হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামের ভেতরে কোনো নিকৃষ্ট তরিকা বের করবে, তার আমলনামায় তার গুনাহ লিপিবদ্ধ হবে। তবু তার এমন নিকৃষ্ট তরিকা মোতাবেক যারা আমল করবে তাদের সমস্ত গুনাহ ওই ব্যক্তির আমলনামায় যোগ হবে। পক্ষান্তরে, অনুসরণকারীদের আমলনামা হতে তার কৃত পাপরাজি কমবে না।
এ হাদিস শরীফ দ্বারা বোঝা গেল, কোরআন-সুন্নাহর মধ্যে কোনো আদেশ না থাকলেই তা নিকৃষ্ট হয় না, বরং কোরআন-সুন্নাহসমর্থিত উত্তম নতুন পদ্ধতি শরিয়তের দৃষ্টিতে ভাল বলে পরিগণিত। সুতরাং ফাকিহানীর মত অগ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয় প্রশ্ন – আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেলাদত (ধরাধামে শুভাগমন) ও বেসাল (পরলোকে খোদার সাথে মিলনপ্রাপ্তি) একই মাসে হয়েছে। কাজেই সে মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ:), অর্থাৎ, রাসূলে পাকের জন্মোৎসব পালনের চেয়ে শোক দিবস পালন করাই অধিকতর সঙ্গত। (মাওরিদ)
উত্তর – আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (রহ:) উত্তরে বলেন, সন্তান জন্মগ্রহণের পর আকীকা করে শোকর আদায় করা ও আনন্দ প্রকাশের
বিধান ইসলামী শরিয়তে রয়েছে। কিন্তু মৃত্যুতে সবর ও ধৈর্য ছাড়া অন্য কোনো কিছু নেই; কাজেই হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেসাল শরীফ নিয়ে দুঃখ বা মাতম দিবস কেমন করে পালন করা যায়? (লাতাইফ)
তৃতীয় প্রশ্ন – ফাকিহানীর পক্ষ থেকে মিলাদ শরীফের কিয়াম স¤পর্কে প্রশ্ন হলো – মিশকাত শরীফের ৪০৩ পৃষ্ঠায় হযরত আনাস (রা:) থেকে একখানা হাদিস শরীফ বর্ণিত আছে –
عن انس قال لم يكن شخص احب اليهم من رسول الله صلى الله عليه وسلم وكانوا اذا راوه لم يقوموا لما يعلمون من كراهيته لذلك০(رواه الترمذى)
অর্থাৎ, ‘হযরত আনাস (রা:) বলেন, সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-বৃন্দের কাছে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা প্রিয়পাত্র আর কোনো লোক ছিল না। অথচ তাঁকে দেখলে তাঁরা দাঁড়াতেন না। কারণ তাঁরা জানতেন যে আল্লাহর হাবীব এরকম দাঁড়ানোকে পছন্দ করতেন না।’
উত্তর – মিশকাত শরীফের ৪০৩ পৃষ্ঠায় হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে একখানা হাদিস বর্ণিত আছে –
عن ابى هريرة قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يجلس معنا فى المسجد يحدثنا فاذا قام قمنا قياما حتى نراه قد دخل بعض بيوت ازواجه০
অর্থাৎ, হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে মসজিদে নববীতে বসে বসে হাদীস বয়ান করতেন। হাদীস শরীফ বয়ানশেষে যখন দাঁড়াতেন, আমরাও তখন আদবের সাথে ভক্তিসহকারে দাঁড়িয়ে থাকতাম। হযূরে পূর নূর (দ:) তাঁর কোনো না কোনো বিবির ঘরে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম। উল্লেখ্য যে, হাদিস শরীফে বর্ণিত
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يجلس ‘কানা ইয়াজলিসু’ ক্রিয়াটি চলমান অতীতকাল (মাজি ইসতেমরারী); এ দ্বারা বুঝা যায়, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল, তিনি প্রায় সময়-ই সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-দেরকে নিয়ে মসজিদে নববীতে বসে দ্বীনী শিক্ষা দান করতেন। তারপর কাজ শেষ করে সাধারণত নিজস্ব কোনো বিবির হুজরায় তাশরিফ নিতেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর হাবীব (দ:) হুজরার মধ্যে প্রবেশ না করতেন, ততোক্ষণ পর্যন্ত সাহাবায়ে কেরাম (রা:) ভক্তিসহকারে আদবের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
বর্ণিত হাদীস দু’টি বাহ্যতঃ পরস্পরবিরোধী প্রতীয়মান হয়। হযরত আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা বোঝা যায় সাহাবায়ে কেরাম (রা:) আল্লাহর হাবীব (দ:)-এর জন্য দাঁড়াতেন না। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে বোঝা যায় সাহাবায়ে কেরাম (রা:)-বৃন্দ আল্লাহর হাবীব (দ:)-এর জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন।
মুহাদ্দিসীনে কেরাম উভয় হাদীসের বাহ্যিক বিরোধ নিরসনে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা নিচে মিশকাত শরীফের হাশিয়ার ৪০৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে –
قد روى البيهقى فى شعب الايمان عن الخطابى فى معنى الحديث هو ان يامرهم بذلك ويلزمه اياهم على مذهب الكبر والفخر قال وفى حديث سعد دلالة على ان قيام المرء بين يدى الرئيس الفاضل والوالى العادل وقيام المتعلم للمعلم مستحب غير مكروه وقال البيهقى هذا القيام يكون على وجه البر والاكرام كما كان قيام الانصار لسعد وقيام طلحة لكعب بن
مالك ولاينبغى للذى يقام له ان يريد ذلك من صاحبه حتى ان لم يفعل حقه عليه او شكاه او عاتبه০( ১২ مرقاة)
অর্থাৎ, ‘বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম বায়হাকী (রা:) বিশ্বজোড়া মুহাদ্দিস ইমাম খাত্তাবী (রা:) হতে এ হাদীসগুলোর ব্যাখ্যায় রেওয়ায়াতে করেছেন যে, নূর-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের গৌরব ও বড়াই দেখানোর উদ্দেশ্যে সাহাবা (রা:)-বৃন্দকে তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়ানো দেখতে পছন্দ করতেন না। কেননা, সায়াদ ইবনে মুয়াজ (রা:)-এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, উপযুক্ত নেতা, ন্যায়পরায়ণ শাসনকর্তা এবং শিক্ষকের সম্মানে ছাত্রদের দণ্ডায়মান হওয়া মাকরুহ নয়, বরং মুস্তাহাব।
ইমাম বায়হাকী আরো বলেন, এ কিয়াম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও শ্রদ্ধার মানসে করা হয়ে থাকে, যেভাবে সায়াদ ইবনে মুয়াজ (রা:)-এর সম্মানার্থে আনসার (রা:)-বৃন্দ এবং হযরত কায়াব ইবনে মালেক (রা:)-এর সম্মানার্থে তালহা (রা:) দাঁড়িয়ে (কিয়াম করে)-ছিলেন। অবশ্য যার জন্য দাঁড়ানো হয়, সে যদি দাঁড়ানো প্রত্যাশা করে, এমনকি তাকে সম্মান না করলে তার প্রতি আন্তরিক শত্রুতা পোষণ করে, অথবা তার দুর্নাম রটায় এবং তাকে ভর্ৎসনা করে, তাহলে ওই ব্যক্তির সম্মানার্থে দাঁড়ানো অনুচিত (জায়েয নয়)।’ (মিরকাত শরহে মিশকাত)
ওপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, নূর-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতদেরকে আদব শিক্ষা দেয়ার জন্য কখনো দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন, আবার অহংকার, ফখর ও বড়াই থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে নিজের জন্য কিয়ামকে অপছন্দ করেছেন। সুতরাং যোগ্যতম ব্যক্তির সম্মানার্থে কিয়াম করা কখনো নাজায়েয হতে পারে না। পক্ষান্তরে, মিলাদ শরীফের কিয়ামকে আল্লাহর হাবীব (দ:) অপছন্দ করেছেন বলে হাদীস শরীফে কোনো প্রমাণ নেই, বরং নূর-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়ানো অবস্থায় নিজের মিলাদ শরীফের আলোচনা করেছেন, যা ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। অতএব, ফাকিহানী সাহেবের মত সঠিক বলে প্রমাণিত হয় না।
চতুর্থ প্রশ্ন – ফাকিহানীর পক্ষ হতে মিলাদ শরীফের কিয়াম না-জায়েয হওয়ার ব্যাপারে আরো একটি প্রশ্ন হলো, মিশকাত শরীফের ৪০৩ পৃষ্ঠায় হযরত আবু উমামা হতে একখানা হাদিস বর্ণিত আছে –
عن ابى امامة قال خرج رسول الله صلى الله عليه وسلم متكئا على عصا فقمناله فقال لاتقوموا كما يقوم الاعاجم يعظم بعضها بعضا০ (رواه ابوداؤد)
অর্থাৎ, ‘হযরত আবু উমামা (রা:) বলেন, (একবার) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একখানা লাঠির ওপর ভর করে আমাদের কাছে আসলেন। এতদ্দর্শনে আমরা তাঁর তা’জিমার্থে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি বললেন, আজমী (অনারব) লোকেরা যেভাবে একে অন্যের জন্য তা’জিমার্থে দাঁড়িয়ে থাকে, তোমরা সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে না।’
কাজেই হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় যে কাজকে নিষেধ করেছেন, তা আজ আমরা কেন করবো?
উত্তর – উপরোক্ত প্রশ্নে কয়েকটি উত্তর নিচে দেয়া হলো:
(ক) উপরোক্ত হাদীস শরীফে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মতলক (সামগ্রিক) কিয়ামকে নিষেধ করেননি, বরং বলেছেন আজমী লোকেরা তাদের বাদশাহের জন্য যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, তোমরা সেভাবে দাঁড়িও না। এতে আরবীয়দের মতো দাঁড়ানোকে নিষেধ করা হয়নি, বরং দাঁড়ানোর পদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, নামাযে কুকুরের বসার মতো বসো না। এতে মতলক বসাকে নিষেধ করা হয়নি, বরং কুকুরের বসার মতো বসাকে নিষেধ করা হয়েছে মাত্র।
(খ) আজমী লোকেরা একে অপরের তা’জিমার্থে দাঁড়িয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, মিলাদ শরীফের মাহফিলে একজন অপরজনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন না। বরং সকলেই সরকারে কায়েনাতের সম্মানার্থে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে দাঁড়িয়ে সালাত ও সালাম পাঠ করেন।
(গ) সহীহ বুখারী শরীফের বৃহত্তম শরাহ ‘ফতহুল বারী’ ১১শ জিলদের ৪১পৃষ্ঠা হতে ৫৪পৃষ্ঠাজুড়ে কিয়াম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী (রহ:)। তিনি উক্ত কিতাবের ৫০ পৃষ্ঠায় লিখেন –
لا تقوموا كما يقوم الاعاجم بعضهم لبعض واجاب عنه الطبرى بانه حديث ضعيف مضطرب السند فيه من لايعرف০ٍ
অর্থাৎ, প্রশ্নে বর্ণিত আবু উমামার উদ্ধৃত ‘তোমরা আজমীদের মতো দাঁড়িও না’ মর্মে রেওয়ায়াতটি সহীহ নয়, বরং জঈফ মুজতারাবুস সনদ, যা দলিল হিসেবে গণ্য হতে পারে না।
তবে ইবনে হজর আসকালানী (রা:) উক্ত হাদীসের স্থলে আব্দুল্লাহ ইবনে বোরায়দা (রা:)-এর একখানা হাদীস হযরত মোয়াবিয়া (রা:) হতে নকল করে বলেন, নূর-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি আশা করে যে লোকজন তার সামনে অবিরাম দাঁড়িয়ে থাকবে, তবে সে দোযখী হবে।
এ প্রসঙ্গে তাবারী বলেন, যে ব্যক্তি তার সামনে লোকজনের দাঁড়িয়ে থাকাটা পছন্দ করে, সেই ব্যক্তির জন্য কিয়াম করা জায়েয নেই। আর যদি কারো সম্মানে দাঁড়ানো হয়, তবে তা নাজায়েয বলা হয়নি।
ইবনে কোতায়বা (রা:) বলে, আজমী (অনারব) রাজা-মহারাজাদের সামনে যেভাবে লোকজনের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তা ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি তার কোনো ভাইকে সালাম দেয় এবং সে তার জন্য দাঁড়িয়ে যায়, তবে তা কোনক্রমেই নাজায়েয হতে পারে না। অতঃপর ইবনে হাজর আসকালানী (রা:) হযরত ফাতেমা (রা:)-এর আগমনে আল্লাহর হাবীব (দ:)-এর দাঁড়ানোর হাদীসখানাও দলিলস্বরূপ পেশ করেন।
মিলাদ শরীফ ও মিলাদ শরীফের কিয়াম প্রসঙ্গে মাওলানা আব্দুল হাই লাখনৌভী সাহেবের অভিমত:
মাওলানা আব্দুল হাই লাখনবী সাহেব নিজ ‘মজমুয়ায়ে ফাতওয়া’ শীর্ষক কিতাবের ২য় জিলদের হজর ও এবাহাত অধ্যায়ে লিখেছেন –
وملخص مقام اينكه ذكر مولد فى نفسه امريست مندب০০০
وكسى ندبش رامنكر نشده مكر يك طائفه قليله كه رب النوع ان طائفه تاج الدين فاكهانى مالكىست و اور طاقتى نيست كه بمقابله بعلمائى مستنبطين كه فتوى به ندب ذكر مولد دارند كند يس قولش درين باب معتبر نيست০
অর্থাৎ, ‘প্রচলিত মিলাদ অনুষ্ঠান মূলত মুস্তাহাব। মালেকী মাজহাব অবলম্বী মাওলানা তাজউদ্দিন ফাকিহানী ও তাঁর অনুগত অতি নগণ্য একটি দল ছাড়া কোনো মাজহাবের আর কোনো আলেম-ই তা অস্বীকার করেননি। যে সকল উলামায়ে মুস্তাম্বিতিন বা কোরআন-সুন্নাহর গবেষক উলামায়ে কেরামগণ মিলাদ শরীফকে মুস্তাহাব বলে ফতোয়া দিয়েছেন, তিনি (ফাকিহানী) তাঁদের মোকাবিলা করতে পর্যুদস্ত হয়ে গিয়েছেন। সুতরাং প্রচলিত মিলাদ শরীফ সম্পর্কে তার মতামতের কোনো মূল্য-ই নেই।’
লাখনৌভী সাহেব উক্ত অধ্যায়ে মিলাদ শরীফকে মুস্তাহাব প্রমাণ করতে গিয়ে হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী হায়তামী (রা:)-এর লিখিত আননি’মাতুল কুবরা আলাল আলামে শীর্ষক কিতাবকেও দলিলস্বরূপ উল্লেখ করেন। এ কিতাবটিতে মিলাদ শরীফ সম্পর্কে বহু হাদিস বিদ্যমান। তিনি (লাখনৌভী সাহেব) উক্ত কিতাবের ৩য় জিলদে লিখেছেন, মক্কা ও মদীনা শরীফের উলামায়ে কেরাম মিলাদ শরীফের মাহফিলে কিয়াম করতেন। অতঃপর তিনি ইমাম জাফর বিন হোসাইন বরজঞ্জী (রহ:)-এর লিখিত ‘মাওলিদে বরজঞ্জী’ শীর্ষক কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, বিচক্ষণ উলামায়ে কেরাম মিলাদ মাহফিলে কিয়াম করা মুস্তাহসান বলেছেন।
পঞ্চম প্রশ্ন – মিলাদ শরীফের প্রারম্ভ হতে শেষ পর্যন্ত কিয়াম করা উচিত, কিন্তু প্রচলিত মিলাদ শরীফে এরকম করা হয় না কেন?
উত্তর- দুররূল মুনাজ্জম কিতাবে লেখা আছে, নিয়ামতের আলোচনা (মিলাদ শরীফের আলোচনা) আসার সাথে সাথে শোকরিয়াস্বরূপ কিয়াম করা আবশ্যক এবং মিলাদ শরীফের মাহফিলের আরম্ভ হতে শেষ পর্যন্ত কিয়াম করা সমুচিত বটে, কিন্তু এটি দুরূহ ও কষ্টসাধ্য। এমতাবস্থায় সমধিক শ্রেষ্ঠ অংশ হলো হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভুমিষ্ট হওয়ার বয়ানের মুহূর্তটুকু। সুতরাং এই সময়-ই আমরা শোকরিয়া আদায় করার উদ্দেশ্যে কিয়াম করে থাকি (দুরূল মুনাজ্জম)। যেমন আমরা মিলাদ শরীফ পাঠকালে বলে থাকি –
فولدته صلى الله عليه وسلم كالبدر المنير অর্থাৎ, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৪ই তারিখের চাঁদের মতো ইহ-জগতে তাশরীফ এনেছেন। এই কথা বলার সাথে সাথে আমরা দাঁড়িয়ে যাই। এ অংশটুকুই মিলাদ শরীফ।
অনেকে বাংলা ভাষায় বলে থাকেন –
শান্তিদাতা মুক্তিদাতা এলেন দুনিয়ায়,
আসুন সবাই দাঁড়াইয়া সালাম জানাই।
এভাবে উর্দু, ফারসিতেও মিলাদ শরীফ পাঠ করা হয়। অতএব, প্রচলিত মিলাদ শরীফের কিয়াম সুন্নাত তরিকা অনুযায়ী-ই আদায় হচ্ছে।
ষষ্ঠ প্রশ্ন – মিলাদ শরীফের কিয়ামরত অবস্থায় অনেকে নামাযের মত হাত বেঁধে দাঁড়াতে দেখা যায়। এভাবে দাঁড়ানো শরিয়তে জায়েয আছে কি?
উত্তর – হাত বেঁধে দাঁড়ানো নামাযের জন্য খাস নয়। ‘ফতোয়ায়ে আলমগীরি’ শীর্ষক কিতাবের ১ম জিলদের ১৩৬ পৃষ্ঠায় লেখা আছে –
يقف كما يقف فى الصلوة অর্থাৎ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা শরীফ জিয়ারত করার সময় এভাবে দাঁড়াবে, যেভাবে নামাযে দাঁড়ানো হয় এবং নূর-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমুজ্জ্বল আকৃতি মোবারক হৃদয়ঙ্গম করবে, তিনি যেন মাজার শরীফে শায়িত আছেন, জিয়ারতকারীকে তিনি জানেন এবং তার কথাবার্তা শুনছেন। তারপর বলবে, ‘আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান্নাবীউ ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু’।
এতে বোঝা গেল, সালাত ও সালাম পেশ করার সময় নামাযের মতো দু’হাত বেঁধে দাঁড়ানো শুধু জায়েয-ই নয়, বরং উত্তম।
সপ্তম প্রশ্ন – অন্যান্য আমলের মতো মিলাদ শরীফ ও দরূদ শরীফের গুরুত্ব দেয়া হয় অধিক, অথচ তা একটি মুস্তাহাব আমল, এর কারণ কী?
উত্তর – মিলাদ শরীফের ভেতরেই অধিক পরিমাণ দরূদ শরীফ পাঠ করা হয় এবং আল্লাহর হাবীব (দ:)-কে সালাম দেয়া হয়ে থাকে। কালামে পাকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহপাক এরশাদ করেন –
ان الله وملئكته يصلون على النبى يايهاالذين امنوا صلوا عليه وسلموا تسليما০ (سورة احزاب)
অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ পাক ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সালাত (দরূদ) পাঠ করেন। হে মু’মিনবর্গ! তোমরাও আমার হাবীব (দ:)-এর প্রতি দুরূদ ও সালাম প্রেরণ করো।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ পাকের দরূদ পাঠ করার অর্থ আল্লাহ তা’য়ালা ফেরেশতাবৃন্দকে নিয়ে তাঁর হাবীব (দ:)-এর প্রশংসা বর্ণনা করেন। (জারকানী শরীফ)
ওপরোক্ত আয়াতে কারিমা দ্বারা নিম্নবর্ণিত কয়েকটি বিষয় অবগত হওয়া গেল:
(১) উল্লিখিত আয়াতে বর্ণিত ‘ইউসাল্লুনা’ শব্দটির কর্তা (ফা’য়েল) হন স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর নিষ্পাপ ফেরেশতাবৃন্দ। এরকম আল্লাহ তা’য়ালা ও অসংখ্য ফেরেশতা সংযুক্ত কর্তাবিশিষ্ট দ্বিতীয় কোনো শব্দ কোরআন শরীফে আর নেই। আল্লাহ পাকের এ ফরমান দ্বারা ‘সালাত আলান্ নবীর’ (নবীর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করার) মজলিস অনুষ্ঠিত করার প্রমাণ পাওয়া গেল। সুতরাং দরূদ শরীফের গুরুত্ব অপরিসীম।
(২) ভূমিকা বয়ান করার পরই আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে গুরুত্বসহ সম্বোধন করে আদেশ দিলেন, ‘তোমরাও আমাদের মতো নবী (দ:)-এর প্রতি সালাত (দরূদ) প্রেরণ করো, সালাত প্রেরণ করতে থাকবে। আয়াতে কারিমায় আল্লাহ পাক বলেছেন, আমি আমার ফেরেশতামণ্ডলীসহ নূর-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি একযোগে (তথা সমস্বরে) উপস্থিত সালাত (দরূদ) প্রেরণ করে থাকি, তোমরাও তাঁর উপস্থিত খেদমতে সালাত (দরূদ) আরজ করতে থাকো।
(৩) আল্লাহ পাক আয়াতে কারিমায় ‘ওয়াসাল্লিমু’ (সালাম প্রেরণ করো) বাক্যটি দ্বারা নূর-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র খেদমতে উপস্থিত সালাম আরজ করতে পুনর্বার আদেশ দিলেন। কারণ এখানে কারো মারফতে সালাম পেশ করার আদেশ দেয়া হয়নি (মতলক রাখা হয়েছে)। সুতরাং আয়াতের মর্মে এই প্রমাণিত হলো যে, নূর-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ-প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সকলের কাছে সর্বদা হাজির ও নাজির আছেন। এ কারণেই তো আল্লাহ পাক মোলাকাতি (সাক্ষাতে সম্ভাষণমূলক) সালামের মতো উপস্থিত সালাম তাঁর হাজের-সূচক খেদমতে পেশ করতে আমাদের প্রতি আদেশ দিলেন। আর মোলাকাতি সালাম সাধারণত দাঁড়িয়ে দেয়াই আদব হিসেবে গণ্য। অধিকন্তু, যাকে মোলাকাতি সালাম দেয়া হয়, তাঁকে শুনিয়ে উচ্চস্বরেই দেয়া হয়ে থাকে। তাঁকে না শুনিয়ে আস্তে আস্তে সালাম দিলে সালামের সুন্নাত আদায় হয় না; সুতরাং জবাব দেয়াও ওয়াজিব হবে না।
এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের ফেরেশতাদের মাধ্যম ব্যতিরেকে নিজ কান মোবারক দ্বারা শুনে থাকেন। এ ক্ষমতা আল্লাহ পাক তাঁর হাবীব (দ:)-কে দান করেছেন। উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে মিলাদ শরীফ পাঠ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল।
(৪) আল্লাহতা’লা পুনরায় ‘তাসলিমান’ শব্দ দ্বারা নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম দেয়ার মতো সালাম দিতে আদেশ করলেন। আরবি কাওয়ায়েদ মুতাবিক এর মর্ম দাড়ায় তাকিদসহ (অর্থাৎ বারবার)। শরিয়তে মোলাকাতি সালাম দেয়ার যে তরিকা (নিয়ম) প্রচলন আছে, যেমন নম্রভাবে আদবের সাথে দাঁড়িয়ে সালাম দিতে হয়, সেভাবে নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাক (খেদমতে তাঁকে উপস্থিত) সালাম পেশ করবে।
অষ্টম প্রশ্ন – আমাদের সালাত ও সালাম ফেরেশতাদের মাধ্যম ব্যতিরেকে আল্লাহর হাবীব (দ:) সরাসরি শুনতে পান বলে হাদীস শরীফে এর কোনো প্রমাণ আছে কি?
উত্তর: ‘দালায়েলুল খায়রাত’ শীর্ষক কিতাবের ২০৮ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, যারা অনুপস্থিত থেকে আপনার প্রতি সালাত (দরূদ) পেশ করে থাকেন এবং যারা আপনার বেসাল শরীফের পর আপনার খেদমতে সালাত পেশ করবেন, তা আপনার কাছে কীভাবে পৌঁছানো হয়ে থাকে বা পৌঁছানো হবে। এর জবাবে আল্লাহর হাবীব (দ:) এরশাদ করেন –
اسمع صلوة اهل محبتى واعرفهم وتعرض على صلوة غيرهم عرضا
অর্থাৎ, যারা আমার মহব্বতী বা প্রেমিক, আমি তাঁদের সালাত বা দরূদ শরীফ নিজেই (নিজের কান মোবারক দ্বারা) শুনতে পাই এবং আমি তাদেরকে চিনি। তাছাড়া অন্যান্যদের সালাওয়াত আমার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।
ইমাম কুস্তালানী তাঁর ‘মাওয়াহিবে লাদুনন্নিয়া’ শীর্ষক কিতাবের ২য় জিলদের ১৯২ পৃষ্ঠায় তিবরানী শরীফ হতে একখানা হাদিস শরীফ নকল করেছেন –
عن ابن عمر قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله قد رفعالى الدنيا فانا انظر اليها والى ماهو كائن فيها الى يوم القيامة كانما انظر الى كفى هذة০
অর্থাৎ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) হতে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা আমার জন্য সমগ্র বিশ্বজগতকে উঠিয়ে দিয়েছেন, অর্থাৎ, প্রকাশ করে দিয়েছেন। আমি এ বিশ্বজগতের প্রতি এবং যা কিছু এ বিশ্বজগতে কিয়ামত পর্যন্ত সৃষ্টি হবে, সবকিছুই দেখতে পাচ্ছি এবং দেখতে থাকবো যেমনটি নিজের হাতের তালুকে দেখছি। অর্থাৎ, হাতের তালুকে দেখতে যেমন কোনো অসুবিধা হয় না, ঠিক তেমনি সারা বিশ্বজগতকে আল্লাহর দেয়া শক্তি বলে দেখতে কোনো অসুবিধা হয় না। (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়ার শরাহ জারকানী শরীফের অনুকরণে অর্থ লেখা হলো)।
এ হাদীস শরীফ দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো, নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গোটা বিশ্বজগত দু’হাতের অধিক দূরে নয়। সুতরাং আল্লাহর হাবীব (দ:) আমাদের সালাত ও সালাম নিজ কান মোবারক দ্বারা শুনেন এবং আমাদেরকে নিজ চক্ষু মোবারক দ্বারা দেখেন, এ ক্ষমতা আল্লাহ তাঁর হাবীবকে দান করেছেন।
নবম প্রশ্ন – মিলাদ শরীফ সম্পর্কে বিরূপ সমালোচনা করেছেন কারা?
উত্তর – (১) দেওবন্দ মাদ্রাসার নেতা মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেব নিজ فتاوى ميلاد شريف وغيره ‘ফতওয়ায়ে মিলাদ শরীফ ওয়াগায়রা’ শীর্ষক কিতাবে লিখেছেন –
يس يه هر روز اعاده ولادت مثل هنود كى سانك كنهيا كى ولادت كا هر سال كرتى هين
অর্থাৎ, ‘প্রতি বছর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিলাদ শরীফের আয়োজন করা ছাং কানাইয়ার জন্মের মতো অর্থাৎ কৃষ্ণলীলা (সদৃশ)।’
অতঃপর গাঙ্গুহী সাহেব উক্ত কিতাবে মিলাদ শরীফের কিয়াম সম্পর্কে ফতোয়া প্রদান করেন –
الحاصل يه قيام اولى مين بدعت ومنكر اور دوسرى سورت مين حرام وفسق تيسرى صورت مين كفر و شرك০ جوتهى صورت مين اتباع هوا وكبيره هوتا هى يس كسى وجه سى مشروع جائز نهين০
অর্থাৎ ‘(গাঙ্গুহী সাহেব বলেন), সারকথা হলো, এই মিলাদ শরীফের কিয়াম, অর্থাৎ, আল্লাহর হাবীব (দ:)এর তা’জিমার্থে দাঁড়ানো প্রথমত বিদআত ও না-জায়েয। দ্বিতীয় কারণে হারাম ও ফিসক-ও (কু-ধারণাজনিত কবিরা গুনাহ), তৃতীয় কারণে কুফর ও র্শিক (রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহ মোবারক মিলাদ শরীফের মাহফিলে উপস্থিত হতে পারেন ধারণায় কিয়াম করা কুফুরী ও শিরেকী), চতুর্থ কারণে নিজ ইচ্ছার অনুকরণে কবীরা গুনাহ।’
অতএব কোনো অবস্থাতেই মিলাদ শরীফের কিয়াম জায়েয নয়। পক্ষান্তরে, গাঙ্গুহী সাহেবের পীর হাজী ইমদাদ উল্লাহ মোহাজিরে মক্কী (রহ:) নিজ فيصله هفت مسئله مع ارشاد مرشد ‘ফায়সালায়ে হাফত মাসায়েল মায়া এরশাদে মুর্শিদ’ শীর্ষক কিতাবে লিখেছেন –
رها يه اعتقاد كه مجلس مولد مين حضور يرنور صلى الله عليه وسلم رونق افروز هوتى هين اس اعتقاد كو كفر وشرك كهنا حدسى برهنا هى كيونكه يه امر ممكن هى عقلا ونقلا بلكه بعض مقامات يراسكاوقوع بهى هوتاهى০
অর্থাৎ, ‘বাকি রইলেঅ এ আক্বিদা, মিলাদ শরীফের মাহফিলে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিত হওয়ার আক্বীদা বা সুদৃঢ় বিশ্বাসকে কুফুরী ও শিরকী বলা শরিয়তের সীমা লঙ্ঘন করা বৈ কিছুই নয়। কেননা রেওয়ায়েত (হাদিস শরীফ) ও জ্ঞান অনুসারে হযরতের উপস্থিতি সম্ভব, বরং কোনো কোনো স্থানে এ রকম ঘটনা ঘটেছেও।’
মিলাদ শরীফ ও মিলাদ শরীফের কিয়াম সম্মন্ধে মোহাজিরে মক্কী উক্ত কিতাবে (ফায়সালায়ে হাফত মাসআলাতে) লিখেন –
اور مشرب فقير كايه هى كه محفل مولد مين شريك هوتا هون ذريعه بركت سمجهكر هر سال منعقد كرتا هون اور قيام مين لطف ولذت ياتا هون০
অর্থাৎ, ‘আমি বরকতের উসিলা মনে করে মিলাদ শরীফে যোগদান করে থাকি এবং প্রতি বছর মিলাদ শরীফের মাহফিলের আয়োজন করি এবং মিলাদ শরীফের কিয়াম-কালে আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করি।’
এখানে দেওবন্দী গাঙ্গুহীপন্থীদের কাছে জিজ্ঞাস্য, যদি মিলাদ শরীফ ছাং কানাইয়ার জন্মোৎসব হয়ে থাকে এবং নূর-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাজের ও নাজের ধারণায় কিয়াম করা কুফুরী ও শিরেকী হয়ে থাকে, গাঙ্গুহী সাহেবের ফতোয়া অনুযায়ী হাজী ইমদাদ উল্লাহ মোহাজিরে মক্কী (রা:) কি মুশরিক, কাফের, বিদআতী ও ছাং কানাইয়ার জন্মোৎসব পালনকারী হননি? নাউজুবিল্লাহ! আরও জিজ্ঞাস্য যে, মুশরিক ও বিদআতী পীরের কাছ থেকে খেলাফতি নিয়ে পীর-মুরিদী করা কীভাবে শুদ্ধ হতে পারে? অনুগ্রহ করে জবাব দিবেন কি?
(১) ওহাবীপন্থী মাওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী সাহেবের অনুসারী আই,ডি,এল প্রধান মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুর রহিম সাহেব নিজ ‘সুন্নাত ও বিদআত’ শীর্ষক পুস্তকের (সপ্তম সংস্করণ, খায়রুন প্রকাশনী, ১৩ কারকুন বাড়ি লেন, ঢাকা ১১০০) ২৬৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন –
‘আর এই যে দাঁড়িযে দাঁড়িয়ে দলবেঁধে ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া হাবিব সালাম আলাইকা বলতে হবে, আর তাতে বড়ো সওয়াব পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে, এ কথাতো কোরআন হাদিস থেকে প্রমাণিত নয়। অনেকের মতে এসব কাজ অনেকটা হিন্দুদের এক ধরনের পূজা অনুষ্ঠানের মতোই ব্যাপার’।
প্রিয় পাঠকমণ্ডলী! আগেই কোরআন, সুন্নাহর আলোকে প্রমাণ করা হয়েছে যে মিলাদ শরীফ ও মিলাদ শরীফের কিয়াম সুন্নাত ও মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম (রা:) থেকে আজ পর্যন্ত মুহাদ্দিসীন, মুফাসসিরীন, মুজতাহিদীন ও দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরাম এ আমল করে আসছেন।
কিন্তু মওদুদীপন্থী মাওলানা আব্দুর রহিম সাহেবের উক্তি ও তার ফতোয়া অনুযায়ী তাঁরা সকলেই পূজা অনুষ্ঠানের সমর্থক ও আমলকারী। নাউজুবিল্লাহ। তাহলে কি শুধু মওদুদী ও তার অনুসারী মাওঃ আব্দুর রহিম সাহেবই মুসলমান?