হুযুর পাক (ﷺ) ২০ রাকাত তারাবীহ আদায় করেছেন।
========
১) স্বয়ং আখেরী রসূল হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ২০ রাকাত তারাবীর নামায পড়েছেন। এ বিষয়ে সহীহ সনদে হাদীছ শরীফ আছে। মুছান্নাফে আবী শায়বা কিতাবে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদীছ শরীফে হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ২০ রাকাত তারাবীর নামাযের বর্ণনা রয়েছে। বাতিল ফির্কা লা’মাযহাবীরা সে হাদীছকে জাল বলে। যদিও পৃথিবীর কোন মুহাদ্দিছ তা জাল বলেননি।
ثنا أبو الحسن علي بن محمد بن أحمد القصري الشيخ الصالح حدثنا عبد الرحمن بن عبد المؤمن العبد الصالح ني محمد بن حميد الرازي حدثنا عمر بن هارون حدثنا إبراهيم بن الحناز عن عبد الرحمن عن عبد الملك بن عتيك عن جابر بن عبد الله قال: خرج النبي صلى الله عليه وسلم ذات ليلة في رمضان فصلى بالناس أربعة وعشرين ركعة وأوتر بثلاثة
অর্থ: হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাসে এক রাতে বের হলেন এবং সাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনাদের নিয়ে ২৪ রাকাত নামায ও ৩ রাকাত বিতির নামায পড়লেন। (তারীখে জুরজান ৩১৭ পৃষ্ঠা: হাদীছ নম্বর ৫৫৬)
এ হাদীছ থেকে যা বোঝা গেলো, রমাদ্বান শরীফ মাসের রাতে হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৪ রাকাত ঈশার নামায এরপর ২০ রাকাত তারাবীর নামায পড়েছেন। অর্থাৎ (৪+২০) = ২৪।
২)
حدثنا أبو الفضل عبيد الله بن عبد الرحمن الزهري , نا محمد بن هارون بن حميد الرازي , نا إبراهيم بن المختار , عن عبد الرحمن بن عطاء , عن ابن عتيك , عن جابر , أن النبي صلى الله عليه وسلم «خرج ليلة في رمضان فصلى بالناس أربعة وعشرين ركعة» .
وحدثنا ابن حيويه , عن ابن المجلد , وزاد: وأوتر بثلاث
অর্থ: হযরত আবুল ফদ্বল আবদিল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান যুহরী, মুহম্মদ ইবনে হারুন ইবনে হুমাইদ রাজী, ইবরাহীম ইবনে মুখতার, আব্দুর রহমান ইননে আতা, ইবনে আতিক রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পবিত্র রমাদ্বান শরীফ মাসে এক রাতে বের হলেন এবং সাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহু উনাদের নিয়ে ২৪ রাকাত নামায ও ৩ রাকাত বিতির নামায পড়লেন।”
(দলীল: তাসি মিনাল মিসিখাতুল বাগদাদীয়া ১/২২৯ : হাদীছ নং ২২৩
লেখক: হযরত ইবনে তহির সালফী রহমতুল্লাহি আলাইহি
শামেলা অনলাইন ভার্সন লিংক http://shamela.ws/browse.php/book-30082/page-29)
সূতরাং হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ২০ রাকাত তারাবীহর নামায প্রমাণিত।
২০ রাকাত তারাবীহ পড়া সুন্নত :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মধ্যে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তারাবী পড়েছেন। কত রাকাত পড়েছেন তা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে কোন সহীহ সূত্রে জানা যায় না। তবে হযরত উমর রা. এর খেলাফতকাল থেকে এখন পর্যন্ত বিশ রাকাত তারাবী পড়া হয়ে আসছে। এ দীর্ঘ সময় কোথাও আট রাকাত পড়ার প্রচলন ছিল না। উম্মতের এ অবিচ্ছিন্ন কর্মধারাই প্রমাণ করে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে সাহাবায়ে কেরাম বিশ রাকাতের তালিমই পেয়েছেন। সামনে আমরা এর প্রমাণসমূহ তুলে ধরছি।
• ১ নং দলীল: মারফূ হাদীস
ইবনে আবী শায়বা রহ. বলেন, আমাদের নিকট ইয়াযীদ ইবনে হারূন বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাদেরকে ইবরাহীম ইবনে উসমান জানিয়েছেন হাকামের সূত্রে, তিনি মিকসামের সূত্রে হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে বিশ রাকাত তারাবী ও বেতের পড়তেন।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৭৪; তাবারানী আল কাবীর, হাদীস নং ১২১০২; আল আওসাত, হাদীস নং ৭৯৮; বায়হাকী, ১/৪৯৬
এ হাদীসটির সনদে আবূ শায়বা ইবরাহীম ইবনে উসমান আছেন, তিনি যয়ীফ বা দূর্বল। এ কারণে বায়হাকীসহ অনেকেই এই হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন। সনদের বিবেচনায় হাদীসটি যয়ীফ হলেও এর সমর্থনে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগ থেকে এ হাদীস অনুসারে চলে আসা অবিচ্ছিন্ন আমল রয়েছে। এমন যয়ীফ হাদীস শুধু আমলযোগ্যই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা মুতাওয়াতির বা অসংখ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীসের মানোত্তীর্ণ।
• ২ নং দলীল: হযরত উমর রা. এর কর্মপন্থা
হযরত উমর রা.এর উদ্যোগে ২০ রাকাত তারাবীর ব্যবস্থা সম্পর্কে মোট সাতটি বর্ণনা পাওয়া যায়। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো
১. ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফার বর্ণনা
হযরত সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. বলেছেন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর আমলে সাহাবায়ে কেরাম রমযান মাসে বিশ রাকাত পড়তেন। (বায়হাকী , আসসুনানুল কুবরা ২/৪৯৬)
এ হাদীসের চারটি সনদ রয়েছে। যথা:
ক. আস্ সুনানুল কুবরা বাইহাকী এর বর্ণনা (হাদীস নং ৪৮০১):
এ সনদটিকে যারা সহীহ বলেছেন,
১. ইমাম নববী, আল মাজমু (৪/৩২)
২. ইমাম ওলী উদ্দিন ইরাকী, তারহুত তাসরীব (৩/ ৯৭)
৩. ইমাম বদরুদ্দীন আইনী, উমদাতুল কারী (৭/১৭৮) ও আল-বিনায়া (২/৫৫১)
৪. ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী, আল-হাভী ২/৭৪
৫. জহীর আহসান নিমাভী, আসারুস সুনান পৃষ্ঠা ৩৯৩ (২০২)
৬. শিহাবুদ্দীন ক্বাসতাল্লানী রহ. ‘ইরশাদুস সারী’ ৩/ ৪২৬
৭. আল্লামা আব্দুল হাই লখনভী রহ. ‘তুহফাতুল আখয়ার’ পৃষ্ঠা ১০৩
৮. সিদ্দিক হাসান কিন্নাউজী ‘আওনুল বারী’ ৩/৩৭৮ (২/৮৬১)
খ. মারিফাতুস সুনান বাইহাকী এর বর্ণনা (হাদীস নং ৫৪০৯):
এ সনদটিকে যারা সহীহ বলেছেন,
১. ইমাম নববী, খুলাসাতুল আহকাম ১/৫৭৬ গ্রন্থে
২. ইমাম জামালুদ্দীন যায়লায়ী, নসবুর রায়া ২/১৫৪ গ্রন্থে
৩. ইমাম তকী উদ্দিন সুবকী শরহুল মিনহাজ গ্রন্থে। তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/ ৪৪
৪. মুল্লা আলী ক্বারী, শরহুল মুআত্তা ও মিরকাতুল মাফাতিহ ৩/৯৭২ গ্রন্থে
গ. মুসনাদু আলি ইবনুল জা‘আদ এর বর্ণনা (হাদীস নং ২৯২৬) :
এ বর্ণনা বিলকুল সহীহ। কারণ, এ বর্ণনায় ইমাম আলী ইবনুল জা‘দ ও সাহাবী সায়েব ইবনে ইয়াযীদ এর মাঝে মাত্র দুইজন রাবী। ইবনু আবি যীব ও ইয়াযীদ ইবনে খুসাইফা। উভয়ে সহীহ বুখারী ও মুসলিম এর রাবী।
ঘ. কিতাবুস সিয়াম ফিরয়াবী এর বর্ণনা: (হাদীস নং ১৭৬) :
এ হাদীসের সনদও সহীহ। এতে তামীম ইবনু মুনতাসির ছাড়া বাকী সকলেই সহীহ বুখারী ও মুসলিম এর রাবী। আর তামীম ইবনুল মুনতাসিরও সিকা ও নির্ভরযোগ্য। দেখুন, তাকরীবুত তাহযীব; মাশিখাতুন নাসাঈ ১/৮৪; তারিখুল ইসলাম যাহাবী ৫/১০৯৫
২. ইবনু আবি যুবাবের বর্ণনা
হারিছ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আবু যুবাব বর্ণনা করেছেন সাইব রা. থেকে। তিনি বলেছেন, উমর রা.এর যুগে কিয়ামে রমযান বা তারাবীহ ছিল ২৩ রাকআত।-মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক : ৭৭৩৩
এর সনদে হারিছ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আবু যুবাব আছেন। ইবনে হিব্বান ও হাকেম তার হাদীসকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন।
৩. আবুল আলিয়ার বর্ণনা
আবুল আলিয়া বর্ণনা করেছেন, উমর রা. উবাই রা.কে রমযানে লোকদের নিয়ে নামায পড়তে আদেশ দিলেন এবং একথা বললেন যে, লোকেরা দিনভর রোযা রাখে, তারা সুন্দর ভাবে কুরআন পড়তেও পারে না। তাই যদি আপনি রাত্রে তাদের সামনে কুরআন পড়তেন। তিনি তখন বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! একাজ তো ইতিপূর্বে হয় নি। তিনি বললেন, আমি তা জানি। তবে এটা একটা উত্তম কাজ হবে। এরপর উবাই রা. লোকদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত পড়লেন। -আলমুখতারা : ১১৬১, এ হাদীসের সনদ হাসান।
৪. ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল আনসারীর বর্ণনা:
ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল আনসারী বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর রা. জনৈক সাহাবীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সাহাবীদের নিয়ে বিশ রাকাত পড়তে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৬৪। এ বর্ণাটি ‘মুনকাতি’ বা সূত্র-বিচ্ছিন্ন হলেও সনদ সহীহ ও গ্রহণযোগ্য।
৫. তাবেয়ী আব্দুল আযীয ইবনে রুফাই’র বর্ণনা :
আব্দুল আযীয ইবনে রুফাই বলেন, হযরত উবাই ইবনে কাব রা. রমযানে মদীনা শরীফে লোকদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বেতের পড়তেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৬৬।
এ হাদীসটিও ‘মুনকাতি’ বা মুরসাল তথা সূত্র বিচ্ছিন্ন। কিন্তু তার উস্তাদগণের মধ্যে দুর্বল কেউ নেই। তাছাড়া তিনি একা নন। তার মতো আরো তিনজন একই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। অধিকন্তু এগুলো পূর্বোল্লিখিত অবিচ্ছিন্ন ও সহীহ সূত্রে বর্ণিত হাদীসটির অতিরিক্ত সাক্ষী ও সমর্থক। তাই এতে কোন অসুবিধা নেই।
৬. তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে রূমানের বর্ণনা:
ইয়াযীদ ইবনে রূমান র. বলেন, হযরত উমর রা. এর যুগে লোকেরা রমযান মাসে ২৩ রাকাত নামায পড়তেন। -মুয়াত্তা মালেক : ৪০। এটিও মুনকাতি’ বা মুরসাল। তবে গ্রহণযোগ্য।
৭. তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে কাব আল কুরাযীর বর্ণনা:
মুহাম্মদ ইবনে কাব র. বলেন, হযরত উমর রা. এর যুগে রমযানে লোকেরা বিশ রাকাত পড়তেন। তাতে তারা দীর্ঘ কেরাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বেতের পড়তেন। -ইবনে নসর মারওয়াযী, কিয়ামুল লায়ল, পৃষ্ঠা ৯১
• ৩ নং দলীল : হযরত আলী রা. এর কর্মপন্থা
২০ রাকাত তারাবীর ক্ষেত্রে হযরত আলী রা. হযরত উমর রা.এর সিদ্ধান্তই বহাল রেখে ছিলেন। আলী রা. থেকে এক্ষেত্রে দুটি বর্ণনা পাওয়া যায়।
১. সুলামীর বর্ণনা
আবূ আব্দুর রহমান সুলামী র. হযরত আলী রা. সম্পর্কে বলেন, তিনি রমযানে হাফেজদেরকে ডাকলেন এবং তাদের একজনকে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত পড়তে নির্দেশ দিলেন। তিনি বলেন, আলী রা. নিজে তাদের নিয়ে বেতের পড়তেন। -সুনানে বায়হাকী ২/৪৯৬-৪৯৭
এ হাদীসটির সনদ যঈফ। তবে এর সমর্থক একাধিক বর্ণনা রয়েছে, সেগুলোর দ্বারা এটিও শক্তিশালী হয়। এ কারণেই হয়তো হাফেজ ইবনে তায়মিয়া রহ. ‘মিনহাজুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে (২/২২৪) ও যাহাবী রহ. ‘আল মুনতাকা’ গ্রন্থে (৫৪২) হাদীসটিকে দলিলরূপে পেশ করেছেন এবং এর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, হযরত আলী রা. তারাবীর জামাত, রাকাত-সংখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা. এর নীতিই অনুসরণ করেছিলেন।
২. আবুল হাসনার বর্ণনা
আবুল হাসনা বলেন, আলী রা. রমযানে জনৈক ব্যক্তিকে আদেশ দিয়েছিলেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত পড়তে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৬৩
আবু সাদ আল বাক্কালের কারণে এটাকে বাইহাকী রহ. যঈফ বলেছেন। তবে এক্ষেত্রে বাক্কালের সমর্থক রয়েছেন আমর ইবনে কায়স। দেখুন, মুসান্নাফু ইবনে আবি শায়বা হাদীস নং ৭৭৬৩। তাই তো বাইহাকী রহ. এ দুটি বর্ণনার পূর্বে আবু খসীব ও শুতাইর ইবনে শাকাল এর বর্ণনা উল্লেখ করে লিখেছেন, এ দুটি বর্ণনা সামনের (সুলামী ও আবুল হাসনার) বর্ণনা দুটিকে শক্তি জোগায়।
• ৪ নং দলীল : সাহাবায়ে কেরামের ইজমা বা ঐক্যমত
ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. লিখেছেন, বিশ রাকাত তারাবীই হযরত উবাই ইবনে কাব রা. থেকে বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত। সাহাবীগণের এক্ষেত্রে কোন দ্বিমত ছিল না। -আল ইসতিযকার ৫/১৫৭
• ৫ নং দলীল : মারফুয়ে হুকমী
ইমাম আবু হানীফা রহ. বলেন, তারাবী সুন্নতে মুয়াক্কাদা। হযরত উমর রা. অনুমান করে নিজের পক্ষ থেকে এটা নির্ধারণ করেননি। এ ক্ষেত্রে তিনি নতুন কিছু উদ্ভাবন করেননি। তিনি তাঁর নিকট বিদ্যমান ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রাপ্ত কোন নির্দেশনার ভিত্তিতেই এই আদেশ প্রদান করেছেন। -আল ইখতিয়ার লি তালীল মুখতার ১/৭০
* আট রাকাতের দলিল পর্যালোচনা
আট রাকাতের পক্ষে তিনটি দলিল পেশ করা হয়:
• ১ নং দলিল: আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত ১১ রাকাতের হাদীস
হযরত আবূ সালামা র. হযরত আয়েশা রা. কে জিজ্ঞেস করলেন, রমযানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামায কিরূপ হতো? তিনি বললেন, রমযান ও রমযানের বাইরে তিনি এগারো রাকাতের বেশী পড়তেন না। তিনি চার রাকাত পড়তেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞেস করো না। এরপর চার রাকাত পড়তেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞেস করো না। এর পর তিন রাকাত পড়তেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি যে বেতের পড়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়েন? তিনি বললেন, আয়েশা! আমার চোখ ঘুমায় বটে, তবে আমার কল্ব জাগ্রত থাকে। -সহীহ বুখারী হাদীস নং ১১৪৭
এ হাদীসটি অনেকেই ৮ রাকাত তারাবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল হিসাবে উপস্থাপন করে থাকে। কিন্তু প্রথম কথা হচ্ছে, খোদ সহীহ বুখারীতেই ৮ রাকাত থেকে অধিক রাকাত পড়ার কথাও রয়েছে। যেমন, হযরত ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত আছে যে, রাসূল সা. রাতে ঘুম থেকে উঠে ১২ রাকাত পড়েছেন তারপর বিতর পড়েছেন এবং সুবহে সাদিক হওয়ার পর দু রাকাত ফজরের সুন্নত পড়েছেন। (দেখুন সহীহ বুখারী হাদীস নং ৯৯২, তাওহীদ পাবলিকেশন্স)। এ হাদীসে এশা ও ফজরের সুন্নত এবং বিতর ছাড়া ১২ রাকাত পড়ার কথা রয়েছে।
তদ্রুপ সহীহ বুখারীতেই হযরত আয়েশা রা. থেকে ফজরের সুন্নত ছাড়া (১১৭০ নং হাদীসে) ১৩ রাকাত ও (১১৩৮ নং) হাদীসে ১১ রাকাত পড়ার কথা রয়েছে।
আর দ্বতীয় কথা হচ্ছে, আসলে এ হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে; তারাবী সম্পর্কে নয়। এটিকে তারাবী সম্পর্কে মনে করা ভুল। কারণ:
ক. এ হাদীসে সেই নামাযের কথা বলা হয়েছে যা রমযান ও অন্য সময় পড়া হতো, অথচ তারাবী রমযান ছাড়া অন্য সময় পড়া হয় না।
খ. এই নামায চার রাকাত, চার রাকাত ও তিন রাকাত পড়া হয়েছিল। লা-মাযহাবী আলেম মোবারকপুরী তার তিরমিযী শরীফের ভাষ্যগ্রন্থে বলেছেন,
চার রাকাত এক সালামে পড়া হয়েছিল, এমনিভাবে তিন রাকাতও এক সালামে। অথচ তারাবী দুরাকাত করে পড়া হয়।
গ. এই নামায যদি তারাবী সম্পর্কে হতো, তবে ফকীহগণের কেউ না কেউ এগারো রাকাতের মত পোষণ করতেন। অথচ তাদের কেউই অনুরূপ মত পোষণ করেননি।
ঘ. মুহাদ্দিসগণও এই হাদীসকে তারাবীর ক্ষেত্রে নয়, তাহাজ্জুদের ক্ষেত্রেই মনে করতেন। ইমাম মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, ইমাম মালেক, আব্দুর রাযযাক, দারিমী, আবূ আওয়ানা ও ইবনে খুযায়মা র. প্রমুখ সকলেই এই হাদীসকে তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেন; তারাবী বা কিয়ামে রামাযান অধ্যায়ে উল্লেখ করেননি।
মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শুধু ইমাম বুখারী র. এ হাদীস তারাবী ও তাহাজ্জুদ উভয় অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। ইমাম বুখারীর নীতি সকলের জানা। তিনি সামান্য সম্পর্কের কারণেই হাদীস পুনরুল্লেখ করেন। তিনি একথাও বুঝিয়ে থাকতে পারেন, রমযানে তারাবী পড়া হলেও শেষে তাহাজ্জুদও পড়ে নেয়া উচিৎ ।
বুখারী র. নিজেও ৮ রাকাতের বেশি তারাবী পড়ে শেষরাতে উঠে আবার তাহাজ্জুদ পড়তেন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. সনদসহ উল্লেখ করেছেন যে, রমযানের প্রথম রাতে ইমাম বুখারী রহ. এর নিকট তার সাঙ্গীরা সমবেত হত। তিনি তাদেরকে নিয়ে তারাবীহ পড়তেন। প্রতি রাকাতে ২০ আয়াত তেলাওয়াত করতেন। এভাবে কুরআন খতম করতেন। এরপর শেষ রাতে কুরআন পড়তেন। এ সময় প্রতি তিন রাতে এক খতম করতেন। দিনের বেলা প্রতিদিন এক খতম পড়তেন। ইফতারের সময় খতম শেষ হত। (দেখুন: হাদয়ুস সারী ১/৪৮১; শুআবুল ঈমান ২০৫৮, তারিখে বাগদাদ ২/১২, তাবাকাতুল হানাবিলা ১/২৭৬, তাহযীবুল কামাল ২৪/৪৪৬, তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা ২/২২৪)
লক্ষ করুন, তিনি তারাবীহতে কুরআন খতম করতেন এবং প্রতি রাকাতে ২০ আয়াত তেলাওয়াত করতেন। সে হিসাবে তারাবীহতে কুরআন খতম করতে হলে তারাবীর রাকাত সংখ্যা অবশ্যই ৮ রাকাতের অনেক বেশি হতে হবে। কেননা কুরআনের আয়াত সংখ্যা বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী ৬২৩৬ টি। আর ৮ রাকাত তারাবীহতে প্রতি রাকতে ২০ আয়াত করে পড়া হলে ৩০ দিনে পড়া হয় মাত্র ৪৮০০ টি। এতে কুরআন খতম হয় না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন।
ঙ. এই হাদীস তারাবী সম্পর্কে হলে সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে বিশ রাকাত পড়া আদৌ সম্ভব ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, তাঁর সুন্নত ও আদর্শের প্রতি তাঁদের চেয়ে অধিক মহব্বত আর কারো হতে পারে না।
চ. খোদ হযরত আয়েশা রা.ও মনে করতেন না এই হাদীস তারাবী সম্পর্কে। অন্যথায় তাঁর চোখের সামনে ৪০টি বছর মসজিদে নববীতে তাঁরই হুজরার পাশে এভাবে সুন্নতের পরিপন্থী কাজ করা হবে, আর তিনি প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকবেন- তা হতে পারে না।
ছ. এ হাদীস তারাবী সম্পর্কে হলে লা-মাযহাবী আলেম শাওকানী সাহেব কেন বলবেন, তারাবীর রাকাত সংখ্যা সম্পর্কে কোন সহীহ হাদীস নেই? দেখুন, নায়লুল আওতার ৩/৬৬। নওয়াব সিদ্দিক হাসান সাহেব ও ইবনে তায়মিয়া রহ.ও প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন। দেখুন ‘আল ইনতিকাদুর রাজীহ পৃষ্ঠা ৬১; মাজমূউল ফাতাওয়া ২২/২৭২
• ২ নং দলিল : হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. ইমামতের ঘটনা
হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রমযানে তার ঘরের মহিলাদের নিয়ে আট রাকাত পড়েছেন। (মুসনাদে আহমদ ২১০৯৮)
অনুরূপ আবূ ইয়ালায় বর্ণিত হযরত জাবির রা. এর হাদীস, উবাই ইবনে কাব রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! গত রাতে : তার উদ্দেশ্য হলো রমযানে- আমার থেকে একটি ব্যাপার ঘটে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উবাই! সেটা কি? তিনি বললেন,আমার ঘরের নারীরা বললো যে, আমরা তো কুরআন পড়তে পারি না (অর্থাৎ আমাদের কুরআন মুখস্থ নেই)। তাই আমরাও তোমার পেছনে নামায পড়বো। আমি তাদের নিয়ে আট রাকাত পড়লাম। এবং পরে বেতেরও পড়লাম।
দেখুন, মুসনাদে আবূ ইয়ালা ১৭৯৫; কিয়ামুল লাইল মুহাম্মদ ইবনে নাসর পৃষ্ঠা ৯০, আওসাত তাবারানী ৩৭৩১। সকলে একই সনদে বা সূত্রে এটি বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু এই হাদীস যয়ীফ, এটি প্রমাণযোগ্য নয়। কারণ:
ক. এর সনদে ঈসা ইবনে জারিয়া আছেন, তিনি যয়ীফ। তার হাদীস প্রমাণযোগ্য নয়। (দেখুন, আলবানী সাহেবের ‘সিলসিলাতুল আহাদিসিস্ যঈফা’ হাদীস নং ৬২৬৪ ও ৬৭২২; ‘সিলসিলাতুল আহাদিসিস্ সহীহা’ হাদীস নং ১৭৬০ ও ৬৮৭৩)।
খ. এ হাদীসের কোথাও তারাবীর কথা নেই। সুতরাং এর দ্বারা আট রাকাত তারাবী প্রমাণ করার চেষ্টা হবে ব্যর্থ চেষ্টা । মহিলাদের নিয়ে ঘরে নামায পড়া থেকে তাহাজ্জুদ পড়ার কথাই সাধারণভাবে বুঝে আসে।
গ. তারাবী সংক্রান্ত ঘটনা হওয়া তো দূরের কথা, এটাকে রমযানের ঘটনা প্রমাণিত করাও মুশকিল। কারণ এই হাদীসে ঈসা ইবনে জারিয়া কখনও রমযানে আসার কথা বলেছেন; কখনও বলেছেন, তার উদ্দেশ্য হলো রমযানে; আবার কখনও তিনি রমযানের প্রসঙ্গই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। এতে করে তার স্মৃতিশক্তির দুর্বলতাই বেশী করে প্রমাণিত হয়।
ঘ. হাদীসটি যে প্রমাণযোগ্য নয় তার একটি প্রমাণ এও হতে পারে, এটি সহীহ হয়ে থাকলে হযরত উমর রা. এর আমলে হযরত উবাই রা. যখন তারাবীর ইমাম হলেন, তখন তিনি আট রাকাতই পড়াতেন। অথচ পেছনে বহু সূত্রে আমরা প্রমাণ করে এসেছি, তিনি বিশ রাকাতই পড়িয়েছেন।
• ৩ নং দলিল : হযরত জাবির রা. এর বর্ণনা
হযরত জাবির রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে রমযানে আট রাকাত ও বেতের পড়লেন। পরের রাতে আমরা মসজিদে সমবেত হলাম এবং আশা করলাম তিনি বেরিয়ে আমাদের কাছে আসবেন। কিন্তু সকাল পর্যন্ত আমরা মসজিদে (অপেক্ষা করতেই) থাকলাম। (অর্থাৎ তিনি আর বের হননি)।
এ হাদীসটিও যয়ীফ, প্রমাণযোগ্য নয়। কারণ:
ক. এর সনদেও ঐ পূর্বোক্ত ঈসা ইবনে জারিয়া আছেন।
খ. তাছাড়া এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, এটা কেবল এক রাতের ঘটনা ছিল।