বিষয়: সহিহ হাদিসের ইমেজ নষ্ট। 
কৃত: মিসবাহুল ইসলাম আকিব
অনলাইন এক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ। 
             দু'দিন আগে বিগত শবে বরাত উপলক্ষে 'সহিহ হাদিস' নিয়ে অহেতুক তৎপরতা লক্ষ্য করার পর সহিহ হাদিসের মাধ্যমে হলেও আমাকে লেখায় ফিরতে হচ্ছে। 
আজ চারদিকে সহিহ হাদিসের নামে মাযহাব-বিরোধী রব উঠেছে। মানুষ এখন মাযহাব জিনিসটা একদম বুঝতে চাচ্ছে না। পান থেকে চুন খসলেই বলে উঠে, 'সহিহ হাদিসে আছে কী?' অদ্ভুত এক প্রশ্ন– 'সহিহ হাদিসে আছে কী?' প্রশ্নকর্তাদের কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন, 'সহিহ হাদিসে আছে কী'–এ প্রশ্নটা সহিহ হাদিসে আছে কী? নবিজি কি বলেছেন, 'সহিহ হাদিসে দেখো! সহিহ হাদিসে খুঁজো!'? হযরত আবু বকর (রা.) যখন ফয়সালা দিতেন, সাহাবায়ে কেরাম কি তখন জিজ্ঞেস করতেন– 'সহিহ হাদিসে আছে কী?'। না, এই প্রশ্নটা সহিহ হাদিসে নেই। তাহলে যে প্রশ্নটা সহিহ হাদিসে নেই, আমিই বা কেন সেই প্রশ্নটা তন্নতন্ন খুঁজে খুঁজে নিজেকে নিজেই ধোঁকা দেবো! 
প্রিয় পাঠক, আমিও যে কেন এই ভুল প্রশ্নটার উত্তর সহিহ হাদিস থেকেই চাইছি। দুঃখিত। প্রশ্নকর্তার একটা ভুল প্রশ্নের 'সহিহ উত্তর' খুঁজতে যেয়ে আমিও বুঝি ভুল করে ফেললাম। অজান্তেই সহিহ হাদিসে চেয়ে বসলাম। বুঝলাম এ প্রশ্নটা ভুল; তবে সঠিক প্রশ্ন কোনটি? কীভাবে জিজ্ঞেস করলে প্রশ্নটার উত্তর যথার্থ মিলবে। সেই সঠিক প্রশ্নটা একটু জানতে কি আপনারও মন চাইছে না। হ্যা, তবে বলে দিচ্ছি আকাঙ্ক্ষিত সেই প্রশ্নটা। তা হলো এই– শরীয়তের কোনো মূলনীতিতে এটা সাব্যস্ত কি? কুরআনে আছে কি, সুন্নাতে আছে কি, ইজমা-কিয়াসে আছে কি? যদি বলি সহিহ হাদিসে আছে কি, তাহলে প্রথমেই আমি কুরআনকে ইগনোর করলাম। তারপরে হাসান ও তৎনিম্নস্থ গ্রহণযোগ্য হাদিসকেও পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলাম। অতঃপর ইজমাকে, যে ইজমার শক্তিমত্তার ব্যাপারে সমস্ত আলেমগণের ইজমা (ঐকমত্য) সাব্যস্ত হয়েছে– ক্ষেত্রবিশেষে ইজমার বিরুদ্ধে যদি সহিহ হাদিসও পাওয়া যায়, তবে ইজমাকেই গ্রহণ করতে হবে, সহিহ হাদিস মানা যাবে না। তারপরে কিয়াসের প্রতি নিষ্ঠুর অবহেলা তো থাকলোই। 

           এবার নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করুন, 'সহিহ হাদিসে আছে কি?'– এই প্রশ্নের মাধ্যমে আপনি কয়টি বিষয়কে ইগনোর করছেন। প্রথমেই আপনি ঐ কুরআনকে অবহেলা করে ফেলেছেন, যে কুরআন হচ্ছে মানবতার সংবিধান; শরীয়তের বিধান সাব্যস্তকরণের প্রথম মূলনীতি। তারপরে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন হাসান হাদিসকে, যার মাধ্যমে ইসলামে এতবেশী মাসয়ালার (সমস্যার) সমাধান হয়েছে, যা বাদ দিলে ইসলাম থেকে দেয়া হাজার হাজার বিষয়ের সেই সমাধানগুলিই বাদ পড়ে যাবে। ইজমার কথা তো আগে বললামই। আর কিয়াস নিয়ে হযরত মুয়াজের প্রতি নবিজীর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে বুঝা যায়, এই কিয়াস দিয়েই কিয়ামত পর্যন্ত অসংখ্য মাসয়ালা, প্রশ্নের সমাধান আসবে। এবং তা-ই হয়েছে, হচ্ছে ও হবে।

         এখন কথা হচ্ছে, সহিহ হাদিসের এই স্লোগান আমরা কেন দিচ্ছি। আমরা কেন বাতেলের জবাব দিতে যেয়ে ঐ পাবলিককে সহিহ হাদিস শোনাচ্ছি, যে পাবলিক জানে না, 'সহিহ হাদিস কাকে বলে'! যে পাবলিক জানে না, সহিহ হাদিসের শর্ত কী কী! হাদিস কীভাবে সহিহ হয়! যে বুঝে না, সনদ সহিহ হওয়া আর হাদিসের টেক্সট সহিহ হওয়ার পার্থক্য! তাকে যদি আপনি সহিহ হাদিস দিয়ে বুঝাতে যান, তবে তা হবে, অন্ধকে হাতি চেনানোর মতো!
আমার মতে, 'সহিহ হাদিস' ব্যাপারটা মোটেও পাবলিকের জন্য না। এটা তো এলমে হাদিসের একটা পরিভাষা মাত্র। এখন এটাকেই বানানো হয়েছে, জীবন পরিচালনার সংবিধান! হায়, আফসোস। আপনারাও নিশ্চয়ই জানেন, সাহাবায়ে কেরামের যুগে 'সহিহ হাদিস' পরিভাষাটি আবিষ্কৃত হয় নি; সহিহ হাদিস কাকে বলে– মানুষ জানতে পেরেছে আরো অনেক পরে এসে। এখন প্রশ্ন হলো, যখন 'সহিহ হাদিস' পরিভাষাটির কোনো অস্তিত্বই পৃথিবীতে ছিলো না, তখন অর্থাৎ সেই যুগের সাহাবীরা কীসের অনুসরণ করতেন? কী দ্বারা জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান খুঁজতেন– সেই সোর্সটা কী? প্রশ্নের জবাবটা খুব সহজ। জেনে নিন ইমাম বুখারী'র প্রখ্যাত উস্তাদ আলী ইবনুল মাদিনী'র ইলাল গ্রন্থের ৪২ নং পৃষ্ঠা থেকে: "রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)–এর যত সাহাবি ছিলেন, সকলেই কেবলমাত্র তিনজন সাহাবির মাযহাব, কিরাআত ও তরিকা অনুসরণ করতেন। তারা হলেন– আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, যায়েদ ইবনে সাবেত এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.।" (আল ইলাল, পৃষ্ঠা: ৪২)। 
উল্লেখ্য যে, লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ফকিহ সাহাবী তথা ফতোয়া দিতেন এমন সাহাবীদের সংখ্যা প্রসিদ্ধমতে, ৬জন হলেও (মতান্তরে ১০ জন) মাযহাব প্রবর্তিত হয়েছে কেবল প্রাগুক্ত তিনজনেরই।

          কী অবাক হলেন তো! সাহাবায়ে কেরাম যে মাযহাব অনুসরণ করে জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান খুঁজতেন, তা জেনে অবাক হওয়ারই কথা। আপনার এই আশ্চর্যান্বিত হবার পেছনে কারণ কী, তাও আমার জানা আছে– ঐ যে সহিহ হাদিসের স্লোগান শুনতে শুনতে এখন মাযহাব শব্দটা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যে ঠেকেছে আরকি!

                  এখানে প্রশ্ন জাগতেই পারে, সাহাবায়ে কেরাম মাযহাব মানতে গেলেন কেন? উত্তর হতে পারে, যেহেতু মাযহাবে কুরআন-হাদিস-ইজমা-কিয়াসের অনুমোদন পাওয়া যায়, তাই একের ভেতর চার পাওয়া যায় বলে মাযহাব না মেনে উপায়ও নেই। প্রকৃতপক্ষে সহিহ হাদিসে শুধু সহিহ হাদিসই পাওয়া যায়। কুরআন পাওয়া যায় না, গ্রহণযোগ্য অধিকাংশ হাদিস পাওয়া যায় না এবং ইজমা-কিয়াস পাওয়া যায় না। তাই সহিহ হাদিসকে নয়; মাযহাবকেই জীবন পরিচালনার পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ বলতে হচ্ছে।
এখন কথা হচ্ছে, একটা সময় ছিলো, মাসয়ালার সমাধান দিতে যেয়ে মানুষকে মাযহাবের একটা ফতোয়ার কিতাব থেকে রেফারেন্স দিলেই আলেমদের চলত। এখন মানুষ ফতোয়ার কিতাব চেনে না, চেনে অদ্ভুত 'সহিহ হাদিস'। কথায় কথায় চেয়ে বসছে সহিহ হাদিস। এটা একটা বড় সমস্যা, যা আমি ইতিপূর্বেই বুঝিয়েছি। তাহলে এই বড় সমস্যাটির পেছনে কারণ কী? আমার কাছে দুটো কারণ খুব স্পষ্ট। প্রথমত: 'সহিহ হাদিস'কে যারাই আমজনতার স্লোগানে পরিণত করছেন, তারা এটাকে এতবেশী প্রচার করেছেন যে, এখন মানুষ একেই সকল সমস্যার সমাধান-সোর্চ ভাবতে শুরু করেছে। যদিও এই ভাবনার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। প্রচারকারীরাও তা জানে। সকল সমস্যার সমাধান যদি এরমধ্যেই থাকতো, তবে এই গোষ্ঠীর ইমাম ইবনে তাইমিয়া 'মাজমুউল ফতোয়া'র কিতাব না লিখে নিজেই সিহাহ সিত্তাহ অনুসরণের প্রেসক্রিপশন দিয়ে দিত। কিন্তু চালাক ব্যাটা তা করে নি। 

           দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আমাদের। সহিহ হাদিসের জবাব সহিহ হাদিস দিয়ে দিতে যেয়ে আমরাও প্রকারান্তরে সহিহ হাদিসের স্লোগানই তুলেছি। দু'পক্ষই যখন সহিহ হাদিসকে সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করতে গেলো, তখন পাবলিকও ভাবলো– আচ্ছা, ঠিকই তো। সহিহ হাদিস তো আসলেই সার্বজনীন একটা সমাধান! দু'পক্ষই সহিহ হাদিস দিয়ে দলিল দিচ্ছে! 
হ্যা, এভাবেই তৈরি হয়েছে সহিহ হাদিসের আজকের গ্রীন ইমেজ। যেই 'সহিহ হাদিস' আম জনতার কাছে রেড এরিয়া; তা আজ গ্রীন ইমেজে গিয়ে ঠেকেছে (দেখতেই তো পাচ্ছেন– সহিহ হাদিসে পাচ্ছে বলে লোকটি রফে ইয়াদাইন করছে, নাভীর উপরে হাত বাঁধছে, দোহাই দিয়ে মিলাদুন্নবী, শবে মেরাজ, শবে বরাতের মতো বিভিন্ন আমল থেকে শুরু করে খতমে কুরআনকে পর্যন্ত অস্বীকার করছে।)। আমি মনে করি, এই ইমেজ নষ্ট করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, সহিহ হাদিসই সমাধান না। এটা একটা মূলনীতির অংশ মাত্র। এছাড়াও একাধিক মূলনীতি আছে। সেখানেও অনেকরকমের দলিল-দস্তাবেজ আছে। ওগুলো আলেমদের আলোচনার টেবিলে থাকা উচিত। সেই দলিল-দস্তাবেজ পর্যবেক্ষণ করে যে সমাধানটা আসে, ওটাই পাবলিকের প্রশ্নের জবাব। কোনটা কোন মূলনীতি থেকে এলো, সেটা জিজ্ঞেস করার অধিকার পাবলিকের নেই। কেননা তার জন্য সমাধান হচ্ছে, মাযহাব। মাযহাবের কিতাবগুলোতেই আমাদের যাবতীয় বিষয়ে যথেষ্ট আলোকপাত করে সমাধান রেখে দেয়া হয়েছে।
Top